গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৫২
সন্ধ্যা হতেই কুঞ্জন ধীর পায়ে মায়ের রুমের গেলো তারপর তার সামনে গিয়ে বসলো, এই মুহুর্তে ওকে দেখলে যে কেউ বলবে ওর থেকে ইনোসেন্ট বাচ্চা আর কেউ নেই। ওর মা ওর দিকে তাকিয়ে বিচলিত কন্ঠে বললো
“কি হয়েছে বাবা?তোমার চোখ মুখের এই অবস্থা কেনো? তুমি কান্না করেছো? মন খারাপ তোমার?”
কুঞ্জন মাথা নাড়িয়ে না বললো তারপর ছলছল নয়নে মায়ের দিকে তাকালো। মুহুর্তেই কোথা থেকে সব খারাপ লাগা জড়ো হলো নিজেই বুঝতে পারলো না, ও মায়ের দিকে তাকিয়ে খুব কষ্টে বললো
“পাপাকে খুব মিস করছি মাম্মা!”
“তোমার পাপা তো আজ সকালে গেলো বাড়ি থেকে, আমিও হসপিটালের মর্নিং শিফটে ছিলাম তাই তার সাথে দেখা হয়নি। তুমি তাকে বলোনি কেনো তাহলে তো সে যেতো না”
“তখন তো বুঝতে পারিনি কিন্তু এখন খুব খারাপ লাগছে!পাপাকে খুব মনে পড়ছে,আমি তার কাছে যাবো মাম্মা!”
“কিন্তু তোমার বাবা তো মাত্র সেখানে গিয়েছে, এখন আসতে তো সময় লাগবে।আমি তাকে বলবো দ্রুত যাতে কাজ শেষ করে চলে আসে, আমাদের কুঞ্জন তাকে খুব মিস করছে!”
“মাম্মা আমি তাকে এখন দেখতে চাই!”
“ঠিক আছে,সেখানে পৌছলে তুমি ভিডিও কল দিয়ে দেখে নিও”
“আম্মু আমি তাকে সরাসরি দেখতে চাই, ফোনে দেখে হবে না। চলো আমরা পাপার সাথে দেখা করতে লন্ডন যাই,পাপাকে সারপ্রাইজ দেই। তুমি পাপার সাথে যে ওই আঙ্কেলটা আছে না, যে এখন লন্ডন থাকে! তাকে বলো সব ঠিক করে দিতে। তারপর আমরা লন্ডন গিয়ে পাপার সাথে দেখা করলে পাপা অনেক খুশি হবে!”
“না কুঞ্জন! তোমার পাপা দুদিন পর চলে আসবে তাই শুধু শুধু গিয়ে কি লাভ?আমরা অন্যকোন সময় তোমার পাপার সাথে গিয়ে ঘুরে আসবো”
কুঞ্জন মুখ ফুলিয়ে মায়ের কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়লো, তারপর সোজা নিজের রুমে গিয়ে দরজা লক করে দিলো। তারপর মুচকি হেসে চোখের পানি মুছে নিলো আর নিজের জামাকাপড় প্যাক করা শুরু করলো। ও জানে ওর মা বেশিক্ষন না রাজি হয়ে থাকতে পারবে না, ঠিক কতোক্ষণ পর এসে বলবে কুঞ্জন সব গুছিয়ে নাও। আমরা তোমার বাবার কাছে যাচ্ছি, তুমি মন খারাপ করোনা।এইজন্যই মাকে এতো ভালোবাসে ও।বাবাকেও অনেক ভালোবাসে তবে মাকে একটু বেশিই ভালোবাসে!
ও যা ভেবেছিলো তাই হয়েছে,রাতে রুম থেকে বের না হওয়ায় সকালেই ওর মা রাজি হয়ে গেছে আর বলেছে সন্ধ্যায় ওদের ফ্লাইট!আগেই পাসপোর্ট করা থাকায় সবকিছু মেনেজ করতে দেরি হয়নি, কুঞ্জন তো মহাখুশি। নিজেকে কেমন যেনো গোয়েন্দা মনে হচ্ছে,ডায়রির শেষের অংশের রহস্য উদ্ধারে কুঞ্জন দ্যি গ্রেট লন্ডনের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিয়েছে। কথাগুলোর ভাবতেই প্রচণ্ড এক্সাইটমেন্ট ফিল করছে কুঞ্জন! লন্ডনের পথের সারা রাস্তা ঘুমিয়েই এসেছে, লন্ডনে গিয়ে তাকে রহস্য সমাধানে মশগুল থাকতে হবে তাই রেস্টের প্রয়োজন।
দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে তারা একটি বিশাল বাংলোর সামনে এসে পৌছলো, কুঞ্জন একবার ভেবেছিলো মাকে জিজ্ঞেস করবে এটা কার বাড়ি কিন্তু পরে ভাবলো নাহ! নিজেই রহস্য উদ্ধার করবে। মাথার ক্যাপটা ঠিক ঠাক করে কলিংবেল চেপে বেশ ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তখনি কেউ একজন দরজা খুলে দিলো, মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে আসতেই ও সেদিকে ফিরে তাকালো। একটা গৌর বর্ণের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, লম্বায় প্রায় ওর সাইজেরই বা ওর থেকে ছোট কিন্তু বয়সে বড়োই মনে হলো! বিদেশের মাটিতে থাকলেও চেহারায় একটা বাঙালিয়ানা ফুটে উঠেছে। বিদেশের মাটিতে বাঙালিরা বাঙালি কাউকে পেলে কতো খুশি হয় তা কেবল তারাই জানে! কুঞ্জন কিছু বলার পুর্বেই সেই মেয়েটি নেটিভ স্পিকারের মতো বলে উঠলো
“হু আর ইউ?হোয়াচ ইউ ওয়ান্ট?”
কুঞ্জনের মুখটা চুপসে গেলো, মেয়েটার ইংলিশ শুনে নিজে যাও একটু আধটু ইংলিশ জানতো তাও ভুলে গেলো। ও কি বলবে বুঝতে পারছে না! কিন্তু ওই মেয়েটাই হঠাৎ হেসে বললো
“সামু আন্টি!কতোদিন পর তোমাকে দেখলাম!কেমন আছো তুমি?”
বলেই কুঞ্জনের মাকে তাড়াতাড়ি জড়িয়ে ধরলো দৌঁড়ে এসে, মেয়েটির মুখে এতো মার্জিত বাংলা শুনে কুঞ্জন ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো! বাংলা যদি জানতোই তবে ওর সামনে এতো ইংলিশে ফরফর করার কি দরকার ছিলো। কুঞ্জন যেনো মহা বিরক্ত হলো, ওই মেয়েটি এবার ওর দিকে ফিরে কৌতুহল নিয়ে বললো
“ওকি তাহলে ছোটু?আমাদের ছোটু কতো বড় হয়ে গেছে! বাহ দেখতে তো লম্বা চৌড়াও হয়েছে বেশ!”
বলে হুট করে এসে জড়িয়ে ধরলো আর আর গালে কিস করে বসলো আর ওর মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে চলে গেলো। যদিও এটাই লন্ডনের কালচার তবুও ও তো এসবে অভ্যস্ত নয়, ও বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। প্রত্যেকটা স্পন্দন যেনো বলছে
“এক পারদেসি মেরা দিল লে গায়ি!”
ও নিজেকে সামলে ভিতরে হাটা ধরলো ভিতরে, এখন ওর এসব ভাবার সময় নেই। যদিও ও আরোও এই ছোটু নাম শুনেছে কিন্তু আম্মুকে জিজ্ঞেস করলে বলতো তার বান্ধুবী বা বান্ধুবীর মেয়ে।তাই তাদের প্রতি তেমন আগ্রহ ও দেখায়নি আর না ভিডিও কলে কথা বলেছে কখনো! তাহলে কি নিজের মায়ের বান্ধুবীর বাসায় আছে ওরা?
ভেতরে ঢুকতেই সোফায় নিজের বাবাকে দেখতে পেলো সাথে তার সমবয়সী আরেকজনকে! তার সাথে একটু আগের মেয়েটির অনেক মিল চেহারার তবে পুরোপুরি নয়। অনেকটাই মিল আবার অনেকটাই অমিল!ওদের দেখেই ওর বাবা দাঁড়িয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে আর বলে উঠলো
“সামু!তোমরা?এখানে কখন এলে আর কিভাবে এলে? আমাকে বললে না কেনো তোমরা আসছো? আমিই তো সাথে করে নিয়ে আসতে পারতাম”
“আর বলোনা, তোমরা বাবা-ছেলে কোনদিন শান্তি দিয়েছো আমায়?ইনান তোমার ছেলে রাতের বেলায় হুট করে এসে বলে পাপাকে মিস করছি তার কাছে যাবো। আর জানোই তো তোমার মতো জেদি তাই না মেনে পারা যায়?তাই আসতে হলো এইখানে!”
“তো আমাকে বলোনি কেনো?”
“তোমার ছেলে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে তাই বলিনি”
“সেটাই আমার ছেলে আমাকে মিস করবে তাইনা?দেখো তোমার সাথে থেকেও বাবাকে ছাড়া থাকতে পারেনা। আমার ছেলে বলে কথা!”
সামু মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলো আর ইনান মুচকি হেসে ছেলের দিকে তাকালো।কুঞ্জন ভেবেছিলো ওর বাবা রেগে যাবে কিন্তু এমনটা হয়নি। বাবার চোখে মুখে খুশির ঝলক দেখে ওর মুচকি হাসলো, বাবা এতোটা খুশি হবে ও ভাবে নি। ও সোফায় বসে সামনের ব্যাক্তিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো, ভাবতে লাগলো যদি ও ঠিক জায়গায় আসে তবে ডায়েরি অনুযায়ী এই ব্যাক্তিটি কে হতে পারে?দেখতে লম্বা, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি তবে দেখতে অনেক ইয়াং!গৌর বর্ণ, মুখে চাপ দাড়ি যদিও তার দু একটাতে পাক ধরেছে কিন্তু এখনো হিরোদের মতোই লাগছে। খুব সুদর্শন দেখতে, এখনো নিশ্চই মেয়েরা তার পেছনে ঘুরে?হাতে খবরের কাগজ, চেহারায় আলাদা এক গাম্ভীর্য! তবুও কি মোহনীয় লাগছে!সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট যেনো বেশ মানিয়েছে তাকে! অবশ্য এমন সুপুরুষকে সকল কিছুতেই মানাবে এমন ধারণাই কুঞ্জনের। এমন সময় সদর দরজা দিয়ে দুজন নর-নারী ঢুকলো। ও সেই নারীর দিকে গভীর ভাবে তাকালো, খুব পরিচিত হলো মুখখানি! ও চোখবন্ধ করে ভাবতে লাগলো কে এই নারী?কে হতে পারে?ওর মা যদি সেই ডায়েরীর সামু হয় তবে সামনের জন কে?রুশি না চন্দ্রিকা?যদি রুশি হয় তবে পাশের জন কি সায়ান?তাহলে সায়ান রুশিকে কোথায় খুঁজে পেয়েছিলো আর ওদের মেয়ে কোথায়?
#চলবে
গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৫৩
কুঞ্জন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই নারীর দিকে, বয়স ত্রিশোর্ধ কিন্তু চেহারায় সেই ভাব ফুটে উঠে নি। এই নারী যৌবনে খুব সুন্দর ছিলো তা দেখেই বুঝা যায়!কিন্তু এ রুশি হতে পারেনা, ডায়েরীর মতে রুশির চেহারায় হাজারো মায়া ভীড় করে আর খাড়া নাক সাথে মায়াবিনী চোখ!যদিও সামনের নারী খুব সুন্দরি তবে সে রুশি নয় এটা বুঝতে কুঞ্জনের সময় লাগলো না, ও মুচকি হেসে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো
“আপনি চন্দ্রিকা তাইনা?আপনি আগেও সুন্দরি ছিলেন এখনোও সেইরকম আছেন”
সামনের নারীটি অবাক হলেও মুচকি হেসে বললো
“হুম আমিই চন্দ্রিকা! কিন্তু তুমি আমাকে চিনো নাকি? কিভাবে হুম?”
উত্তরে কুঞ্জন হাসলো আর ভাবলো আমি না জানলে আর কে জানবে?আমার থেকে তো ভালো আর কেউ কিছু জানেই না।ও হাসি হুট করেই ফুস হয়ে গেলো যখন ওর পারদেসি মানে পাখি নামক মেয়েটা কথা বলে উঠলো
“আরে চন্দ্রি ফুপ্পি! ও আমাদের ছোটু তোমাকে ওর কথা বলেছিলাম না!দেখছো কতো বড় হয়ে গেছে!আমিতো চিনতেই পারিনি!”
চন্দ্রিকা খুব মনোযোগ সহকারে কুঞ্জনের দিকে তাকালো, এদিকে কুঞ্জন দেখলো চন্দ্রিকার পাশের পুরুষ লোকটি সোফায় গিয়ে বসলো আর ওর বাবা আর সেই লোকটির সাথে কথায় মেতে উঠলো। তাদের সম্পর্ক খুব ভালো দেখেই বুঝা যাচ্ছে! শাহেদের সাথে তাদের সম্পর্ক এতো ভালো হলো কবে?আর চন্দ্রিকাও এখানে আসছে!তখনি কেউ একজন ওর গাল টেনে ধরলো আর বলে উঠলো
“আমাদের ছোটু তো আসলেই বড় হয়ে উঠেছে!কতটুকু দেখেছিলাম!মনে আছে সামু ওর বয়স যখন দেড় বছর তখন ওকে নিয়ে লন্ডন এসেছিলি তোরা। পাখি তখন দুবছরের ছিলো! বাবুকে দেখেই কোলে নেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো, অন্য বাচ্চারা ছোট বাচ্চা দেখলে বলে এটা আমার ভাই বা বোন! কিন্তু পাখি দেখেই বলে উঠলো ‘এটা আমাল বল’ তখন আধোও আধোও কথা বলতো ও, ছোটুকে দেখেই বলতে লাগলো ‘আমি বলো হয়ে ওলে বিয়ে করলবো’ আর সবাই কি হেসেছিলাম!”
“হ্যা মনে আছে! আমিতো এখনো পাখিকে আমার ছেলের বউ হিসেবে মানি, পাখি রাজি থাকলেই হয়!কিরে পাখি রাজি আছিস?”
“আমিতো এক পায়ে খাড়া ফুপ্পি! তোমার ছেলে রাজি থাকলেই হয়।কিরে ছোটু বিয়ে করবি আমায়?”
কুঞ্জন হুট করে কেশে উঠলো, এতো ওপেনলি মানুষ বিয়ের কথা কি করে বলে?তাও আবার সবার সামনে! তারউপর এই মেয়ে গুনে গুনে ওর থেকে একবছরের বড়ো! মানে শেষমেশ কুঞ্জন তুই একটা সিনিয়র আপুর উপর ক্রাশ খাইলি?আর ওর মাকে দেখো ছেলের মতামত বলে যে একটা জিনিস আছে সেটা তো ওনার মাথায় নেই, আমাকে জিজ্ঞেস করা ছাড়াই ছেলের বউ ঠিক করে ফেলেছে। নাহ এসব বিয়ে সাদি মাথা থেকে ঝাড়তে হবে, পারদেসি থুক্কু পাখি থেকে ওর আখি সরাতে হবে। কুঞ্জন ফোকাস অন ইউর গোল!ভুলে যাস না সাত সমুদ্র পাখি দিয়ে কেনো এসেছিস এখানে!
কুঞ্জন পাখি থেকে সত্যি সত্যি নিজের আখি সরিয়ে নিলো তখনি পাখি বলে উঠলো
“কিরে জবাব দিলি না?লজ্জা পাইসস?আচ্ছা থাক পরে জবাব দিস। আমার এতো তাড়া নাই”
কুঞ্জনের মাথা চাপড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে! কি বেশরম রে বাবা!কুঞ্জন ডোন্ট ফল ফর দিস!ফোকাস!
কুঞ্জন আবার সেই বাবার বয়সী লোকটির দিকে তাকালো, নাহ লোকটি শাহেদ নয় কারণ শাহেদ পাশে বসা আর ওর বাবা হচ্ছে ইনান মানে সায়ানের বেস্ট ফ্রেন্ড মানে সামনের ব্যাক্তি সায়ান ছাড়া অন্যকেউ হতেই পারেনা! তাহলে ওই মেয়েটি কি সায়ান রুশির মেয়ে? ওয়েট মেয়েটির নাম পাখি! সায়ান আদর করে তার মেয়েকে পাখি ডাকতো তারমানে ওই মেয়েটি সায়ান রুশির মেয়ে পাখি?রুশির অনেক বড়ো ত্যাগের ফসল!ওর এতোক্ষন এই জিনিসটা মাথায় কেনো আসেনি?ওহ গড! সবকিছু ওর সামনে ছিলো আর ও বুঝতেই পারেনি! কুঞ্জনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো, সায়ান যেহেতু সামনে তবে রুশিরও থাকার কথা কিন্তু সে কোথায়?
আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগলো কিন্তু কোন নারী মুর্তিকে খুজে পেলো না। তবে কি সায়ান তার রুশিকে খুঁজে পায়নি কিন্তু সামনের জন যদি সায়ান তবে সে রুশিকে খুঁজে পেয়েছে! কারণ সায়ান রুশিকে অনেক ভালোবাসে আর রুশি ছাড়া তার মুখে এই হাসি থাকতো না বরং থাকতো একরাশ কঠোরতা! কিন্তু তাহলে রুশি কোথায়?
কুঞ্জন তার কৌতুহলি মন দমিয়ে রাখতে পারলো না, ও সামনের ব্যাক্তির দিকে তাকিয়ে বললো
“সায়ান মামা?আপনি তো সায়ান মামাই তাইনা?”
লোকটি কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো তারপর বললো
“ইনান!তোর ছেলে তো দেখছি খুব বুদ্ধিমান রে, আমাদের সেই দেড় বছর বয়সে দেখেও সবাইকে মনে রেখেছে। বাহ!”
“আমি কিন্তু আরো চিনি যেমন ইনি হচ্ছে শাহেদ!চন্দ্রিকা আন্টির হাজবেন্ড হয়তো! তারপর ওইযে পাখি সে আপনার মেয়ে আর একটু আগে যে পেপার নিয়ে বেরিয়ে গেলো উনি হচ্ছেন সাহেল!”
তখন ইনান মুচকি হাসলো আর কুঞ্জনের কাঁধে হাত রেখে বললো
“আমার ছেলে বুঝলি!টোটাল চ্যাম্প!”
কুঞ্জন বারবার আশেপাশে তাকালো কিন্তু রুশিকে দেখতে পেলো না। ওর বিশ্বাস ও রুশিকে দেখলেই চিন্তে পারবে, রুশির বর্ণনা এতো গভীর ভাবে পড়েছে যে ও রুশিকে কল্পনা পর্যন্ত করেছে বহুবার!ওর ভাবনার মাঝেই ওর মা বলে উঠলো
“ভাই ভাবি কই?সে কখন থেকে আসলাম কিন্তু ভাবির দেখা পেলাম না”
“মেডাম কিচেনে আছেন,সকালে তার হাতের রান্না না খেলে দিন শুরু হয়না বুঝলি!আর উনিও বেশ সুন্দর করে আমাদের খাওয়াতে পছন্দ করেন”
কুঞ্জন ভেবেছিলো সায়ান, রুশিকে রুশি বলে ডাকবে বা মিসেস খান বলে কিন্তু তার কিছুই বলেনি। তাহলে কি রুশিকে খুঁজেই পায়নি?অন্য মুভি বা গল্পের মতো অন্য একজনকে বিয়ে করেছে তারপর তাকে ভালোবেসে ফেলেছে?কুঞ্জনের হঠাৎ করেই বুক কাঁপতে লাগলো আর যাইহোক সায়ান রুশির শেষ পরিণতি ও এমনটা হলে মেনে নিতে পারবে না। সেই বাংলাদেশ থেকে ও এসেছে সায়ান-রুশির গল্পের বাকি অংশ জানার জন্য তবে তাতে যদি এদের মিল না হয় তবে ওর সবকিছু বৃথা হয়ে যাবে।আর তাছাড়া সায়ান রুশিকে পাগলের মতো ভালোবাসে! আর যাইহোক অন্যকেউকে মেনে নিবে এটা ও বিশ্বাস করেনা, অন্তত সেই ডায়েরীতে ভালোবাসার গভীরত্ব অনেক বেশি ছিলো সেসব নিছক মিথ্যে নিশ্চই হবে না!
ওর মন অশান্ত হয়ে উঠলো হঠাৎ! সায়ানের ওয়াইফকে দেখার তীব্র ইচ্ছে ওর কিন্তু ভয়ও করছে যদি সে রুশি না হয়?ওতো মেনে নিতে পারবে না, একবার মনে হচ্ছে গিয়ে দেখুক কিন্তু পরক্ষনেই মনে হচ্ছে না সবরে মেওয়া ফলে। ওর ধৈর্যের কারণেই হয়তো রুশির দেখা মিলতে পারে। ও চুপচাপ বসে থাকার মাঝেই এক নারীকন্ঠ ভেসে উঠলো
“আরে সামু!তুই আসলি আর আমার কাছে গেলি না?আমিতো জানতেই পারতাম না যদি ড্রয়িংরুমে না আসতাম!আজ এতোবছর পর আসলি!কতোকরে বলেছি আসতে কিন্তু এটা ওটার ব্যাস্ততা দেখিয়েই যেতি। কতো সুন্দর হয়ে গেছিস তুই!”
কুঞ্জনের মনে হলো সেই নারীকন্ঠ অনেক সুন্দর হয়তো শুধু কন্ঠ শুনেছে বলে!ও খুব সাহস নিয়ে তারদিকে তাকালো, পাতলা গড়নের একজন নারী!ফর্সাও নয় আবার কালোও নয়। এ যেনো এক শ্যামসুন্দরী!বয়স ত্রিশোর্ধ হলেও চেহারায় আলাদা এক মায়া আছে আর তার হাসি!অদ্ভুতভাবে পাখির সাথে মিলে যায়!তবে কি এই সেই রুশি?ডায়েরী অনুযায়ী তো তাই হওয়ার কথা!ওর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো! ওর মন বলছে এটা রুশি ছাড়া অন্যকেউ হতেই পারেনা, সায়ানের মতে রুশি খুব বেশি সুন্দর, তার চেহারায় মায়া কাজ করে। দীঘল কালো চুল, টানা চোখ আর খাড়া নাক সবমিলিয়ে খুবই সুন্দরি এক শ্যামল বর্ণের নারী!তিনি ওর তাকিয়ে বললো
“ও ছোটু! মাশাল্লা কতো বড় হয়ে গেছে!সেদিন ছবিতে এইটুকুন দেখলাম! পাখির সাথেও তো একটা ছবি আছে সেটা আমাদের ঘরে টানানো আছে।কি সুন্দর লাগছিলো ওকে!”
কুঞ্জন নিজের কৌতুহলি মন দমাতে না পেরে প্রশ্ন করলো
“আপনি?”
“বলোতো আমি কে?”
কুঞ্জনের যদিও মনে হচ্ছে উনি রুশি তবে কনফার্মেশন চাচ্ছে ও, তাই মায়ের দিকে তাকালো। ও মা বিশেষ কোন ভংগি করলো তাই বুঝার ক্ষমতা নেই দেখে বাবার দিকে তাকালো। দেখে ওর বাবা মাথা নিচু করে বসে আছে!ডায়েরীর ইনান একসময় রুশিকে ভালোবাসতো কিন্তু পরিস্থিতির কারণে সে রুশিকে পায়নি বরং বাস্তাবতা মেনে নিয়ে সামুকে বিয়ে করেছিলো! কিন্তু ছেলেরা তাদের প্রথম ভালোবাসা কখনোই ভুলতে পারেনা,ইনানের ক্ষেত্রে তার ব্যাতিক্রম হয়তো হয়নি। হয়তো এখন আর ভালোবাসা না থাকলেও স্মৃতি গুলো ভুলতে পারেনি! বা হয়তো ভালোবাসে কিন্তু সামুকে তার থেকেও বেশি ভালোবাসে!আর সবচেয়ে বড়ো কথা বাস্তাবতা মেনে নিয়েছে!
কুঞ্জন সেই নারীর দিকে মুচকি হেসে বললো
“আপনি রুশি তাইনা?রুশানি আনাম!সম্পর্কে আমার মামি আর সায়ান জামিল খানের ছোট্ট পরী সাথে তার মিসেস খানও”
সবাই কুঞ্জনের কথায় চমকে উঠলো! সবার জিজ্ঞাসু চাহনি দেখে কুঞ্জন নিজের ব্যাগ থেকে সেই ডায়েরীটি বের করলো আর টেবিলের উপর রাখলো তাতে কেউ না চমকালেও সায়ান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! কুঞ্জন জানতো আর কেউ না চিনিলেও সায়ান চিনবে আর ঠিক তাই হয়েছে! কুঞ্জন তার দিকে তাকিয়ে বললো
“ছোট থেকেই দেখেছি আমাদের বাড়িতে অনেকগুলো কামরা, তাদের সবগুলোতে আমার যাওয়া আসা ছিলো কিন্তু একটা কামরা আমাকে বেশ আকর্ষিত করতো যার দরজায় বিশাল বড়ো এক তালা ঝুলানো থাকতো! তাই সেই রুমের কাছে প্রতিদিন একবার হলেও ঘুরে আসতাম। বড়ো হওয়ার পর কৌতুহল খুব বেশি থাকলেও অনেক খুঁজে সেই দরজার চাবি খুঁজে পাইনি, তাই কৌতুহল দমাতে না পেরে একদিন সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর সেই রুমের তালা খুললাম মায়ের চিকন ক্লিপ দিয়ে। রুমটা বেশ সাজানো গুছানো ছিলো, মনে হচ্ছিলো কেউ পরম যত্নে নিজ হাতে সবটা সাজিয়েছে! সবকিছু দেখতে দেখতে একসময় বিছানার নিচে একটা ডায়েরী খুঁজে পেলাম,শুরুটা এতোটাই আকর্ষণীয় ছিলো যে প্রতিদিন নিয়ম করে লুকিয়ে সেই ঘরে গিয়ে এই ডায়েরী পড়ে আসতাম আর কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি!প্রথমে ভেবেছিলাম কোন সাহিত্যিক খুব সুন্দর করে একটি গল্প সাজিয়েছে যার মাঝে একজন ছিলো রুশি আরেকজন সায়ান!দুজনের জীবনেই কিছু অতীত, কিছু কষ্ট, বিচ্ছেদ আর ধোঁকা ছিলো! সম্পুর্ণ বিপরীত দুটো চরিত্র হলেও তারা কোন এক দিক দেখে একই সুত্রে গাঁথা!কিন্তু সেই কথাগুলোর এক পর্যায় আমি দুটো নাম খুঁজে পাই, একটা হচ্ছে ইনান আরেকটা সামু!আমার বাবা মায়ের নাম তখন বুঝতে পারো এটা কোন মনগড়া গল্প নয় বরং বাস্তবতা!কেউ একজনের আত্মকথা! আমি ডায়েরীর লিখার শেষপাতা পর্যন্ত পরেও সবটা জানতে পারিনি, অনেক প্রশ্ন, অনেক কিন্তু থেকেই গেলো। আমি সেই উত্তর খুঁজতে আমি এতোদুর এসেছি শুধু জানতে সায়ান-রুশির সাথে এরপর কি হয়েছিলো আর তাদের সেই মেয়েটি কোথায়?আমি জানি আমার এই প্রশ্নের জবাব আপনাদের কাছে আছে তাই আমি সবটা জানতে চাই সেই সায়ান রুশিকে কি করে পেয়েছিলো আর সেই রুশি সায়ানকে এতো সহজে কি করে মেনে নিলো?”
#চলবে
গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৫৪
সায়ান একদৃষ্টিতে ডায়েরীর দিকে তাকিয়ে আছে, এই ডায়েরীতে ওদের কাটানো হাজারো স্মৃতি রয়েছে যাতে আছে কিছু ভালো অনুভুতি সাথে একরাশ তিক্ততা আর কষ্ট! এই জীবনে কম কষ্ট পায়নি ও আর না রুশি পেয়েছে। রুশিকে যতোটা সহজে পেয়েছে তার থেকেও বেশি কঠিন ছিলো ওকে ধরে রাখা। ওদের সম্পর্কে অনেক উত্থান পতন ছিলো, ছিলো মিলন, বিচ্ছেদ আরো কতোকি!আর এই সবকিছুর সাক্ষী ছিলো এই ডায়েরী, ও মুচকি হেসে রুশির দিকে তাকালো আর তার হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো! রুশি বিচলিত কন্ঠে বললো
“আ্ আরে খাবার সার্ভ করতে হবে তো!আমি এখানে বসলে…”
“চুপচাপ বসো! এখানে এমন অনেক কিছু আছে যা তোমার জানা প্রয়োজন! তোমাকে এতোদিন বলিনি কিন্তু আজ যেহেতু বলছি তাই তোমারও শোনার অধিকার আছে!”
সায়ান রুশিকে নিজের পাশে বসিয়ে তারপর কুঞ্জনের দিকে তাকালো, ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি তখনো ঝুলছে!ও বলতে শুরু করলো
“এই ডায়েরীটা আমাদের বিছানার নিচে পেয়েছো তাইনা?আমি রেখে এসেছিলাম সেখানে লুকিয়ে। ভেবেছিলাম যদি বাংলাদেশে যাওয়ার সুযোগ হয় আবার তবে এটা রুশিকে দেখাবো। এই ডায়েরীটা রুশির লেখনী, প্রথম থেকে আমাদের পুরো সম্পর্কের সবকিছু আছে এখানে। কিন্তু এর শেষ অংশ আমার লিখা,রুশি আমার কাছ থেকে যাওয়ার প্রায় পনেরো দিন পর আমি এই ডায়েরী খুঁজে পেয়েছি আর পড়ে খুব অবাক হয়েছিলাম! এই ডায়েরী পরার পর রুশিকে আরো বেশি মিস করতাম! পুরো বাড়িতে প্রত্যকটা কোনায় যেনো রুশির আনাগোনা ছিলো আর হুট করে ও কোথাও নেই সেটা মেনে নিতে পারছিলাম না! এই ডায়েরী কতোবার পড়েছি হিসাব নেই,প্রত্যেকবার পড়েছি এটা ভেবে যে ওকে হয়তো কম মিস করবো কিন্তু রুশির শুন্যতা আরো বেশি অনুভব করতাম!এদিকে পাখিও খুব ছোট, ওকে সামলাতে পারছিলাম না। পরে মা আর আমি মিলে নতুন বাড়িতে শিফট হয়ে যাই যার খবর কেউ জানতো না কারণ আমি সামাদ খানকে খুঁজে পাইনি তাই ভয় হতো যদি হুট করে কিছু করে বসে পাখির!তার মাঝেই ইনানের মা মারা যায় আর সামু-ইনান দুজনেই একা হয়ে। তাই আমরা সামু আর ইনানকে আমাদের সাথে শিফট হতে বলি যাতে ইনান অফিসে গেলে সামু একা না থাকতে হয়! আমাদের কোম্পানি তখন কো-পার্টনার ছিলো।আমাদের সেই ছোট্ট পরিবারকে দিন কাটছিলো আর আমি প্রহর গুনছিলাম কবে পাখি একটু বড় হবে আর কবে আমি দেশ ছাড়তে পারবো।”
এতোটুকু বলে সায়ান থামে আর দেখে কতোগুলো কৌতুহলি চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ও আবারও বলতে শুরু করলো
“পাখির দুবছরের সময় আমি লন্ডনের উদ্দ্যেশ্য পাড়ি জমাই,সাথে চন্দ্রিকা, শাহেদ আর আমার মা।চন্দ্রিকা আর শাহেদের সাথে সম্পর্ক তখন স্বাভাবিক ছিলো আমাদের, আমরাই ওদের বিয়ে দেই কারণ প্রিয় মা আর বাবা ছিলো না আর তাদের সাথে ওদের যোগাযোগ ছিলো না, বলতে গেলে তারা রুশিকে বাঁচাতে কারো সাথে যোগাযোগ রাখে নি এমন নিজের সন্তান শাহেদের সাথেও না।
আমার মন বলছিলো রুশি লন্ডনে আছে। আর তাছাড়াও প্রিয় আন্টিরা পুর্বে লন্ডনে ছিলো তাই ভেবেছিলাম। উত্তর লন্ডনের ক্যামডেন টাউনে থাকতো তারা তাই আমিও সেখানে থাকা শুরু করি কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। পুরো লন্ডন শহর তন্নতন্ন করে খুঁজেও রুশিকে পাইনি, আমি বেশ হতাশ হলাম। মনের ভিতরের আশার প্রদিপগুলো একটি একটি করে নিভতে লাগলো, মনে হচ্ছিলো রুশিকে কি আর পাবো না আমি তাহলে। ততদিনে প্রিয় আন্টিরা লন্ডনে আসেনি তা আমি শিউর হয়ে গিয়েছিলাম!আমাদের এখানে আসার ছয়মাস পর ইনান আর সামু আমাদের সাথে দেখা করতে আসে তখন কুঞ্জন মানে তোমার বয়স ছিলো দেড় বছর আর পাখির বয়স আড়াইবছর। আমরা সবাই মিলে একদিন ঘুরতে বের হই আর ঘুরার মাঝখানে বেখেয়ালিতে আমি আর পাখি আলাদা হয়ে যাই। আমি পাখির হাত ধরে হাটছিলাম ঠিক তখনি তীক্ষ্ণ কিছু একটা আমার বাম হাত ঘেষে যায়,আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি মাস্ক পরা একজনের হাতে গান আর সে আমাকে এটাক করেছে! আমি পাখিকে কোনরকম কোলে নিয়ে ছুটতে শুরু করি আর বুঝতে পারি তারা অনেকজন তাই আমার পক্ষে একা লড়াই করা সম্ভব নয় তারউপর পাখি আছে সাথে তাই একটা পার্কিংয়ে গাড়ির পেছনে লুকিয়ে পড়ি। সারা রাস্তায় পাখি চিৎকার করে কান্না করলেও গাড়ির পেছনে এসে ও চুপ হয়ে যায় আর আমার গায়ের সাথে মিশে থাকে। এটা কি ভাগ্য ছিলো নাকি ও বুঝতে পেরেছে আমি জানিনা তবে আল্লাহ সেদিন সত্যিই সহায় হয়েছিলেন নাহয় ধরা পড়ে যেতাম!এদিকে দৌড়ানোর ফলে ফোন হারিয়ে ফেলেছি তাই কাউকে কল করতে পারিনি এমনকি কে কোথায় কি অবস্থায় আছে তাও জানা নেই। পরে যার গাড়ির পেছনে লুকিয়ে ছিলাম সে গাড়ি নিতে এসে আমাকে নোটিস করে আর আমাকে তার গাড়িতে উঠায়। তার সাহায্যে সাহিলকে কল করি আর জানতে পারি বাকি সবাই সেফলি বাসায় আছে।লোকটি আমাকে হসপিটালে পৌঁছে দেয় আর ডাক্তার আমার বেন্ডেজ করা অবস্থায় সাহিল সেখানে আসে।ওই যাত্রায় বেঁচে গেলেও আমরা এটাক সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনা তাই ইনান সামুকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেই আর আমরা ক্যালিফোর্নিয়ায় শিফট হওয়ার চিন্তা ভাবনা করি!”
কুঞ্জন হুট করেই প্রশ্ন করে বসলো
“তাহলে রুশি ক্যালিফোর্নিয়ায় ছিলো?আপনি তাকে সেখানেই পেয়েছেন!”
“নাহ! আমাদের ক্যালিফোর্নিয়ায় শিফট হওয়ার চান্সই হয়নি কখনো কারণ আমাদের যেদিন শিফট হবো তার আগের দিন রাতে আমার ফোনে মেসেজ আসে যাতে লিখা ছিলো
“সি তু ভিউক রিনকন্ত্রের তন এমিউর, ভিয়ন্সা প্যারিস”
প্যারিস ছাড়া আর কিছুই আমার বোধগম্য হয়নি, সেই রাতে সাহিলকে কল করে এটা ফরওয়ার্ড করি কারণ ও বহু ভাষায় এক্সপার্ট ছিলো! ও শুধু এইটুকু বলতে পেরেছিলো যে এটা ফ্রেঞ্চ এ কিছু লিখা কিন্তু কি ও জানেনা কিন্তু ও বের করতে পারবে। কতক্ষন পর ও মেসেজ করে পাঠায় এটার মানে হচ্ছে
“যদি নিজের ভালোবাসার দেখা পেতে চাও তবে প্যারিসে আসো”
আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম কি করে পেলে তখন ও বললো গুগলে সার্চ করে, এন্ড আই ওয়াজ লাইক আমার মাথায় এটা কেনো আসলো না?”
সায়ান নিঃশব্দে হাসলো যেনো নিজের বোকামিতে সে বেশ মজা পেয়েছিলো তারপর আবার বলা শুরু করলো
“আমি জানতাম না সে কে ছিলো আর তার উদ্দ্যেশ্য কি ছিলো, শুধু এইটুকু জানতাম রুশিকে খুঁজে পাওয়ার এটাই শেষ উপায় আর সেটা ভুল হোক বা সঠিক আমার কিছু যায় আসেনা। তার বিরোহে পুড়ে মরার চেয়ে তাকে খুঁজে বের করার সবধরনের চেষ্টা করতে আমি প্রস্তুত! আমি সেদিনই প্যারিসের যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকি আর একসময় আমার গন্তব্যে পৌঁছে যাই! চন্দ্রিকা আর শাহেদ লন্ডনেই ছিলো তবে দক্ষিণ লন্ডনের টেমস নদীর পাশের এই বাংলোতে যা আমরা ফ্রান্সে যাওয়ার আগে কিনেছিলাম। কারণ মনে হচ্ছিলো ওখানে থাকা সেফ হবে না, আমি আর পাখি সাথে সাহিল আমরা ফ্রান্সের প্যারিসে পৌঁছালাম কিন্তু ওই মেসেজ ছাড়া আর কোন ক্লু ছিলো না। আর সবচেয়ে বড়ো কথা ওই নাম্বার বন্ধ ছিলো, আমি রুশিকে খুঁজতে লাগলাম পাখিকে নিয়ে কিন্তু পাইনি। একদিন সাবওয়ের পাশ দিয়ে আমি একা হাঁটছিলাম, পাখি সাহিলের কাছে ছিলো।আমি বেশ অন্যমনস্ক ছিলাম তাই কোনসময় রাস্তায় চলে এসেছি বুঝতে পারিনি। হঠাৎ একজোড়া হাত আমাকে টান দিয়ে সরিয়ে দেয় আর আমি হুশে ফিরে আসি। আমি না তাকালেও আমার হাত পা কাঁপছিল, এই স্পর্শ আমার চেনা ছিলো বহুদিনের! আমি না তাকিয়ে বুঝতে পারছিলাম ও রুশি, বহুকষ্টে তাকিয়ে দেখলাম রুশি বাংলায় বকছে আমায় আর কিছু কাগজ নিচ থেকে উঠাচ্ছে। ও দাঁড়াতেই নিজেকে সংযত করতে পারিনি, কি হয়েছে সব ভুলে গিয়েছিলাম! শুধু এইটুকু জানতাম ও আমার রুশি, আমার ভালোবাসা!আমি হুট করে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলাম “আমি পেয়েছি তোমায়, খুঁজে পেয়েছি!”
আমাকে অবাক করে দিয়ে আমাকে ও ধাক্কা দেয়নি বরং জড়িয়ে ধরে ছিলো শক্ত করে কিন্তু আমি ছেড়ে দিতেই চলে যায় সামনে থাকা গাড়িতে করে আর আমি বাঁধা দেয়ার সময়ই পায়নি। আমি সেখানেই স্তব্ধ ছিলাম কিছুক্ষণ, মনে হচ্ছিলো আমি কি পেয়েও আবার হারিয়ে ফেললাম?মাথা কাজ করছিলো না কিন্তু সেই রাস্তার পাশে থাকা কাগজ দেখে সেটা হাতে উঠিয়ে নিলাম, এটা সেই কাগজ ছিলো যা রুশি উঠাচ্ছিলো। হাতে নিতেই দেখি একটি এনজিওর কাগজ যাতে ডোনেশন চাচ্ছে!মনে হলো হয়তো এখানে গিয়েই ওকে পাবো,সেদিন আমি ঠিক কতো খুশি ছিলাম বলে বোঝাতে পারবো না”
কুঞ্জন উৎসুক মনে প্রশ্ন করলো
“তাহলে সেই এনজিওতে তাকে পেয়েছিলেন?”
সায়ান কিছু বলবে তার পুর্বেই রুশি বলে উঠলো
“সেই এনজিওতে আমি জব করতাম না, মাঝেমাঝে ভিজিট করতাম আর সেই সুবাদে তাদের সাহায্য করছিলাম তাই ও আমাকে সেখানে গিয়ে পায়নি। কিন্তু সেদিন সায়ানের হুট করে জড়িয়ে ধরা আমার মনে বেশ দাগ কেটেছিলো। আমি প্যারিসে প্রায় আড়াই বছরের বেশি ছিলাম কিন্তু আমি বেশ শুন্যতায় ভুগতাম আর সবচেয়ে বড় কথা মা সবমসময় একটা কথাই বলতো যে আমি কোন সম্পর্কে জড়াতে পারবোনা কিন্তু তার কারণ কখনোই বলতো না। আর সত্যি বলতে এখানকার ইউনিভার্সিটিতে আমাকে কম ছেলে প্রোপোজ করেনি কিন্তু আমি সবমসময় শুন্যতায় ভুগতাম। মনে হতো কিছু একটা আমার কাছে নেই, কাউকে আমি খুব মিস করছি কিন্তু সে কে তাই আমার জানা নেই। যখনি তাকে ভাবার চেষ্টা করতাম আমার বুকে ব্যাথা হতো, খুব কষ্ট হতো তাই আমি ভাবতাম না কিন্তু সায়ানকে দেখে একমুহুর্তের জন্য সেই শুন্যতা যেনো পুরণ হয়ে গিয়েছিলো। মাকে প্রশ্ন করেছিলাম সেদিন যে আমার লাইফে কেউ ছিলো কিনা বা আমি কি কাউকে ভুলে গিয়েছি যাকে ভুলে যেতে চাইনি। কিন্তু মা কিছু বলেনি!আমি তাই ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দেই কারণ আমি সবসময় তার কথা ভাবতাম যাকে আমার মনে নেই যার ফলে মাথায় খুব প্রেশার পড়ে আর আমি জ্ঞান হারাই। যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি ছোট দুটো হাত আমাকে ধরে আছে আর মাম্মাম বলে ডাকছে।আমি কেনো জানিনা অবাক না হয়ে খুশি হয়েছিলাম অনেক! আমার হসপিটালের দিনগুলোতে সেই বাচ্চাটি ছিলো সাথে। নাম জিজ্ঞেস করলে বলতো ‘আমাল লাম পাখি’। মেয়েটির কথার মাঝে শুধু বাবা ছিলো কিন্তু মা ছিলো না, মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই বলতো ‘তুমি তো আমাল মাম্মাম’ আমিও একসময় বিশ্বাস করতে থাকি ও আমার মেয়ে। হসপিটালে থাকাকালীন সায়ান আমার সাথে দেখা করেনি কারণ তার ধারণা ছিলো আমার সাথে দেখা করলে আমার মাথায় আবার প্রেশার পড়তে পারে। ধীরেধীরে আমি পাখিকে পেয়ে স্বাভাবিক হয়ে যাই আর সম্পুর্ণ ওর মা হয়ে উঠি আর একদিন হুট করে পাখির বাবা মানে সায়ান আসে আমার সামনে। তখন আমার অবস্থা বেশ স্টেবল ছিলো, সে আমাকে বেশি কিছু বলেনি শুধু এইটুকু বলেছে যে আমাদের একসময় বিয়ে হয়েছিলো আর এটা আমাদের সন্তান আর যদি আমি চাই আমাদের সন্তান আমার সাথে থাকুক তবে আমাকে অতীত সম্পর্কে ভাবা বন্ধ করে দিতে হবে আর তার সাথে থাকতে হবে। যেহেতু কিছুই মনে নেই আমার তাই আমরা আবার বিয়ে করবো”
রুশি থামলো তারপর বললো
“আমার লাইফে পাখি ব্লেসিং ছিলো কারণ আমার এর পুর্বে বেঁচে থাকার কারণ ছিলো না।আমি সত্যিই পাখিকে আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম আর তার জন্য যদি একজন স্ট্রেঞ্জারকে বিয়ে করতে হয় তবে আমি করতে রাজি আছি। সবচেয়ে বড় কথা বাবা-মা এতে কিছু বলে নি তাই আমি বুঝে গেছি ওদের সাথে আমার অতীতে সম্পর্ক ছিলো তাই রাজি হয়েছি যদিও এতোটা সহজ ছিলো একজন অপরিচিত মানুষকে বিশ্বাস করা কিন্তু আমি সেই রিস্ক নিয়েছিলাম আর আমি ঠকিনি। সায়ানের চেয়ে ভালো হাজবেন্ড আমি আর কোথাও পাবো না, আর না পাখির মতো মেয়ে। আমার অতীতের কিছুই মনে নেই তবে বর্তমানে তারা আমার সাথে আছে তাই আমার কোন রিগ্রেট নেই। আমি বর্তমান নিয়ে বেঁচে আছি আর ভবিষ্যতেও থাকতে চাই।হ্যা আমি আমাদের অতীতের মুহুর্তগুলো মনে করতে চাই, কিভাবে দেখা হয়েছিলো আমাদের, কখন আমি তাকে ভালোবেসেছি, আমাদের লাভ কনফেশন সবকিছু!কিন্তু তার থেকেও বেশি আমি বাঁচতে চাই তাদের সাথে আর আমি তাদের আবারও ভালোবাসি।ব্যস এইটুকুই অনেক!”
কুঞ্জন মুচকি হাসলো সবটা শুনে, ভালোবাসা হয়তো এমনি। সব ভুলে গেলেও অনুভুতি ভুলা যায়না তাই হয়তো রুশি আবারও এতো সহজে সায়ানকে ভালোবাসতে পেরেছে!ও বলে উঠলো
“আচ্ছা সায়ান মামাকে সেই মেসেজ কে করেছিলো যে রুশি মামি প্যারিসে আছে?”
#চলবে