“গানের ওপারে তুমি”
পর্ব- ১৫
(নূর নাফিসা)
.
.
মিহির বাড়ি ফিরেছে বিকেলে। মন তার এখনো খারাপ। চুপচাপই চলাচল করছে ঘরে। মা এসে জিজ্ঞেস করে যায়, লাঞ্চ করা হয়েছে কি না। “না” জবাব দিতেই একা একা কত বকে যাচ্ছেন খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক করে না বলে। সেই সকালে ক’টা খেয়ে বেরিয়েছে। দুপুরে যে একবার ফিরেছিলো, সে সম্পর্কে অবগত নয় তিনি। সামনেই টুলের উপর জায়নামাজ দেখে ঘড়িতে তাকায় মিহির। আসরের আজান পড়াকালে সে গাড়িতে ছিলো। এখন জামা’আত পাওয়া যাবে না ভেবে ঘরেই নামাজ আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে যায় খেতে। খাওয়ার মাঝামাঝিতেই লক্ষ্য করে, মোটামুটি অনেক্ক্ষণ যাবত এসেছে ঘরে। অথচ রিপ্তিকে দেখছে না। তাই মাকে জিজ্ঞেস করে,
“রিপ্তি কোথায়?”
“বাবার বাসায় চলে গেলো দুপুরে। ভালো লাগছে না নাকি মনটা।”
মুখে খাবার তুলতে গিয়েও থেমে যায় মিহির। মনে ক্রোধ ও বিষণ্ণতার আরেক ধাক্কা! স্পষ্ট স্মরণে আসে দুপুরের সময়টা। চোখের সামনে থেকে দূর হওয়া মানেই কি ঘর ছেড়ে যাওয়া? পরক্ষণেই মুখে ভাত তুলতে ব্যস্ত হয় সে। খাওয়ার গতি বৃদ্ধি পেয়েছে তার। আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রোধের মাত্রা। রাগারাগি হয়েছে ঠিক আছে, কিন্তু রাগ করে সে ঘরের বাইরে কেন যাবে? এ-ই তার মেজাজ বিগড়ে দিচ্ছে। ওদিকে রিপ্তি যাওয়ার পরই জিনিয়া তাবাসসুম তার সুতি শাড়ি বের করে কাঁথা সেলাইয়ে বসেছিলেন। জিতুর মাকে দেখে তারও ইচ্ছে করছিলো কাঁথা সেলাইয়ে বসতে। আগে শখের বশে কতকিছু করতো, আজকাল হয়ই না তেমন কিছু। এখন শখ জাগলো যখন, নাতি নাতনির জন্য একটা প্রস্তুতি নেওয়াই যায়। এখনো ছেলেকে খাবার দিয়ে চেয়ারে বসে সেলাইয়েই মনযোগী হয়ে রইলেন। মিহির খাওয়া শেষ করে উঠতে গিয়েই লক্ষ্য করে বলে,
“এটা কি নিয়ে বসেছো আবার?”
“বাচ্চাকাচ্চার জন্য লাগবে না? অবসর আছি যখন, বানিয়ে রাখি দু’চারটা।”
আহ্লাদ যেন আরও বিরক্তি হয়ে বিঁধলো তার বিঘ্ন মেজাজে। চুপচাপ হাত ধুয়ে চলে যায় রুমে। মাথায় চেপে বসেছে রিপ্তির কাণ্ড। মনে মনে হাজারবার খু’ন করছে তাকে। ইচ্ছে করছিলো ফোন করেই কতক্ষণ শাসিয়ে নেক। কিন্তু কেন? সে তো অধিকার গুটিয়ে নিতেই চাইছে বোধহয়! গেছে না বাবার বাসায়? তো যাক। তার এতো মরিয়া হয়ে উঠার কি দরকার? পাল্টা রাগের মাত্রা বাড়িয়ে ল্যাপটপ নিয়েছিলো একটু প্রফেশনাল দিকে মনযোগী হয়ে উঠার। তা-ও ভালো লাগছে না বিধায় ঘুমিয়েই যায় ল্যাপটপ দূরে ঠেলে দিয়ে। বালিশ টানায় এক টুকরো কাগজও সরে থাকে ল্যাপটপের দিকে। দেখেনা তুলে গুরুত্বের সাথে। মানসিক শান্তির প্রত্যাশায় মিলিয়ে নেয় চোখ দুটো।
ঘুম থেকে উঠে দেখে বাইরে সন্ধ্যার তুমুল বৃষ্টি! মন খারাপের ঘুমও শরীরটাকে ভীষণ রকমের ভারাক্রান্ত করে রাখে। হাই তুলে নামতে গেলেই চোখ পড়ে ল্যাপটপের কাছে কাগজের টুকরোর দিকে। কাগজটা ঘুমানোর আগে তখনই বালিশের কাছে দেখেছিলো মিহির। তবে বিশেষ খেয়াল স্থির করেনি। এখন শান্ত মেজাজে হাতে নিতেই দেখতে পায় রিপ্তির হাতের চিরকুট।
“স্যরি, স্যার। রিপ্তি বড়ই বেকুব। এই বেকুবটা আপনাকে ভালোও বাসে খুব। সময়ের কাজ সময়ে করবো, আর হবে না এমন।”
লেখাটা পড়তেই ভারাক্রান্ত দেহ হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে উঠে। ইচ্ছেই করে না এই স্থান হতে নড়তে। মলিন মনে ছুঁয়ে যায় ভালো লাগার এক চিলতে সুখ পরশ। দুই হাঁটু হাতের বাঁধনে বেঁধে চুপটি করে বসে থাকে বাইরে তাকিয়ে আনমনে। এই রিপ্তি তার ভারি দুষ্টু। এই যে, মন খারাপ করে আবার ভালোর ওষুধও দিয়ে যায় মনে করে। চোখ পড়ে নিঃস্ব বেশে বারবার বারান্দার দিকে ঘুরঘুর করা ম্যাও ছানার দিকে। যেন বৃষ্টি থামার খুব অপেক্ষা তার। কোথায় যেতে চায় ম্যাও ছানা? তার স্নেহময়ীর কাছে?
ফ্রেশ হয়ে মাগরিবের নামাজ পড়ে এক কাপ চা নেয় মিহির। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে রুমে এলেই এক কোণে বসে ম্যাও ম্যাও করে মনযোগ কাড়ে বিড়ালটি। মিহির আন্দাজ করে তার খুব ক্ষুধা। মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে,
“মা, বিড়ালকে খেতে দাওনি কিছু?”
“খায়নি তো অনেক্ক্ষণ। কোথায় সে?”
“এই যে, রিপ্তিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে মেবি।”
“খুঁজবেই তো। এতো আদর আর কে করে?”
জিনিয়া তাবাসসুম এসে খেতে নিয়ে যায় ম্যাওছানা। বৃষ্টি এখনো ঝরছে। গতিবেগ একটু কমলেই আবার বেড়ে উঠে। সেরে উঠার নাম নেই একদমই। ওদিকে রিপ্তিকেও ভীষণ মনে পড়ে। একটাবার কলও দিলো কেউই। দুষ্টুর মন খারাপ বলেই হয়তো গাঢ়তরভাবে মনে পড়ে সেদিনের বৃষ্টিমুখর সকালকে। এইতো, এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ম্যাওছানা সহ তারা চারজন বৃষ্টিবিলাস করছিলো। কি সুন্দর মুহুর্ত ছিলো। যদিও মিহিরের মনের কোণে তখন লুকানো ইয়ানাতের মুখোশ উন্মোচনের প্রয়াস চলছিলো, তবুও মুহুর্তটা সুন্দর ছিলো। হঠাৎ ফোনের টুংটুং শব্দ নজর কাড়ে। এক হাতের কাপ এড়িয়ে অন্য হাতের ফোনে তাকাতেই ছোটোখাটো বিস্ময়। পুরনো সেই আকর্ষণীয় ইয়ানাতের প্রোফাইল হতে টেক্সট!
“আমি তোমাকে জ্বলিয়ে ফেলবো, মিহির খাঁন। একদম ছারখার করে দিবো। কি? ভেবেছোটা কি? কৃতজ্ঞতা জানিয়েই মহান হয়ে যাবে? এই পর্যন্ত আসার সুযোগ তো তোমার প্রাপ্য ছিলো প্রচেষ্টার জোরে। সফলতাটাও সেই প্রচেষ্টার জন্যই তোমাকে ধরেছে ঘিরে। তাই বলে তুমি আমার পাত্র হবে কি এমনি এমনি করে? একটু জ্বালাতন না করলে হয় কিভাবে? একটু নয়, একদম জ্বালিয়ে দিবো। যেন আজীবন না ভুলো আমাকে। তুমি ইয়ানাতকে পাত্তা দাও আর রিপ্তিকে দাও না? এই যে, ইয়ানাতের আইডি এক্ষুণি নিশ্চিহ্ন করে দিবো। রিপ্তি নিয়ে তোমার সারাজীবন জ্বলতে হবে।”
প্রায় চার বছরের কথপোকথনেও এই দুষ্টু ভাবটা ফুটেনি ইয়ানাতের ইনবক্সে। বরং প্রতিটি বাক্য মনে হয়েছে কত ম্যাচিউর এই মেয়েটা। অথচ তখন সে আরও ছোট ছিলো। আর তার ভেতরকার রিপ্তি? এই তো, প্রতিনিয়ত একটা হাসিখুশি বাচ্চা ফুল হয়ে বেঁচে আছে তার সামনে। বয়স বাড়লেও বাচ্চামো কমছে না দুষ্টু ফুলের। টেক্সট পড়ে এবং রিপ্তিকে নিয়ে ভেবে মন খারাপের মাঝেও কিঞ্চিৎ হাসি উঁকি দিলো ঠোঁটের কোণে। যা আরও কয়েক ধাপ মন ভালো হওয়ার বহিঃপ্রকাশ।
ছমছম বৃষ্টি, মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া! ভিজে উঠেছে জানালার কাঠ৷ তবুও বন্ধ করার নাম নেই রিপ্তির৷ ভিজুক আজ ঘর। পারলে ভিজিয়ে দেক আরও এই মনের বেদনার তর। আর ভালো লাগে না যে, মন খারাপের দিন। কত ঘন্টা পেরিয়ে যায় একটা মানুষকে ভেবে, কত প্রহর গড়িয়ে যায় তার ফোনকলের অপেক্ষায়। মন বলে, ফোন করবে না ফের। বড্ড অপরাধী হয়ে রইলো যে সে, ওই মনের ঘরে রাগ জমেছে ঢের। দেখতেই নাকি চায় না এই মুখাবয়বের ঘের! কি করে অবসান ঘটবে এই মান অভিমানের? দুপুরে কিছুক্ষণ মাকে জড়িয়ে বসে রইলো। শ্বাশুড়ির মতো তিনিও শরীর খারাপ ভেবে ইচ্ছেমতো তেল মাখিয়ে দিলেন উষ্ক চুলের গোছায়। পাঠালেন বিশ্রামে। ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টায় গড়াগড়ি খেয়ে উঠে যায় সে। কখনো জানালার ধারে, কখনো বারান্দায় পায়চারি করেই কাটে এতোক্ষণ। কখনো অপরাধে জ্বলেপুড়ে, কখনো রাগ হয় ভীষণ। ফোনকলের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ধৈর্য্য হারায়। ইয়ানাতের আইডিটায় লগইন করে তাকে জ্বালাতন করতে। টেক্সট করার পর আবার মলিনতা পুষে এখন ঘন্টাযাবত বসে আছে বিছানায়। রোহান আশপাশ দিয়ে কতবার আসছে, যাচ্ছে৷ সেই খেই রাখে না সে। মন যে আজ ভীষণ খারাপ, মনের খবর রাখে কে? হঠাৎ ফোন বেজে উঠে রিপ্তির। ধীর গতিতে চোখ নামিয়ে স্ক্রিনে মিহিরের নাম দেখতেই আৎকে উঠে সে৷ বুক ধড়ফড় করে, কেন ফোন দিলো ভেবে। রাগ দেখাবে, নাকি রাগ ভাঙবে? কোনটার জন্য প্রস্তুত থাকবে সে? ভাবতে ভাবতেই ফোনটা তুলে কান পর্যন্ত নিয়ে মৃদু কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
“হ্যালো?”
“রাস্তায় এসো।”
চমকে উঠে রিপ্তির কণ্ঠ!
“এই বৃষ্টিতে রাস্তায়?”
“তবে এসো তোমাদের ছাদেই।”
“এই রাতের বেলা?”
“তো?”
“এতো বৃষ্টির মধ্যে আমি ছাদেই কেন যাবো?”
“আমি যে এতো বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে তোমার বাসার নিচে চলে এলাম, সেটা?”
চরম বিস্মিত হয় রিপ্তি। একটা কথাও বলে না আর। ফোন ফেলে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে তুরন্ত দরজা খুলে ছুটে আসে বারান্দায়। নিচে তাকাতেই উঠুনের লাইটের মৃদু আলোতে দেখে মিহির দাঁড়িয়ে আছড়ে পড়া বৃষ্টির মধ্যে! এ কি অবস্থা তার! এই অবেলায় ভিজলো কেন এভাবে? ছাতা ছিলো না সাথে? রিপ্তি ঝটপট সিঁড়ির ধারে যায়। কাঠের সিঁড়িতে ঠকঠক পায়ে অর্ধেক নামতেই থেমে যায়। মিহির উঠে এসেছে বাকি অর্ধেকটায়। দুর্দান্ত গোসল হয়েছে তার এই ধারায়। ভেজা চুল হতে টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পতিত হয়ে সর্বাঙ্গ গড়িয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে পায়ের তলা। হাতের মধ্যেই হ্যান্ড গ্লাভস দ্বারা তার ফোনকে নিরাপদে রাখা। রিপ্তি কিছু বলার আগেই ফোন পকেটে রাখতে রাখতে অন্য হাত বাড়িয়ে ভেজা মুখে প্রাণোচ্ছল হাসি ফুটিয়ে আহ্বান করে সে,
“চলো বৃষ্টি বিলাসে যাই ওই ছাদ আঙিনায়…”
অবর্ননীয় আনন্দ এসে হঠাৎ ঘিরে ধরে রিপ্তিকে। খুশির জোয়ারে ভেসে যেতে ইচ্ছে করে আহ্বানের সাড়ায়। লজ্জা ও আনন্দের মিশ্র প্রবাহে ফিক করে হেসেই উঠে। চোখের কোটরে ধরা দেয় জলধারা। তার হাসিতে হাসি মেখে হাতটা মুঠোয় ধরে ঝটপট চলতে শুরু করে মিহির। একদমই অনিচ্ছা বোধ করে না রিপ্তি। মিহিরের পায়ে তাল মিলিয়ে সে-ও অতিক্রম করতে ব্যস্ত হয় সিঁড়ির ধাপ। খোলা ছাদে এসে ভিজিয়ে দেয় নিজেকে বৃষ্টি ও প্রিয়র প্রণয়ের জোয়ারে। এই বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যা বাদে, এ কোন ধমকা হাওয়া নিয়ে এলো প্রিয়? সুখ উল্লাসে মন যে তার এলোমেলো! জুতো জোড়া ছাড়িয়ে, ছাদে বয়ে যাওয়া বৃষ্টিস্রোতে ছমছম পা ফেলে এগোয় সে। আরও বেড়ে ধারার গতি প্রশান্তির আঘাত করে যায় মাথায়। দুহাত মেলে তাই চোখ বুজে মুখমণ্ডল সপে দেয় আকাশমুখী। আহা, প্রশান্তি! আবছা আলো আঁধারের ভীড়ে স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে সম্মুখে পায় প্রিয় মুখ। কানের কাছে তার ফিসফিসে ধ্বনিতে বাজে,
“ইয়ানাত নিশ্চিহ্ন কেন হবে? তার জন্যই তো আমার সফলতা অর্জন। সে থাকুক না গানের ওপারে, কৃতজ্ঞতার জায়গায় তার ভাব নিয়ে। রিপ্তি থাকুক এপারে, আমার কাছে। আমার পাশে পাশে। আমার দুষ্টু রাণী হয়ে।”
প্রণয়ের সান্নিধ্যে লজ্জায় মরি মরি দুষ্টু রাণী। তবুও প্রেমযূগল, জুড়ে দেয় প্রেমালাপ। কেটে যাওয়া অসুন্দর মুহুর্তগুলোর সৌন্দর্যও ক্রমশই বেড়ে যায় যেন পরিপূর্ণতায়।
বৃষ্টি বিলাসে ইতি টেনে শীতল দেহে তারা নেমে এসে দাঁড়ায় দুয়ারে। রিপ্তির মা এ পর্যন্ত দুইবার বারান্দায় এসে ঘুরে গেছে, দরজা খুলে মেয়ে কোথায় গেলো! এখন মেয়ে ও জামাইকে একত্রে ভেজা নাজেহালে দেখে কিছুটা থমকে যায় যেন।
“এ কি অবস্থা! ভিজলে কেন এভাবে?”
“বাইরে বৃষ্টি নেমেছে, আম্মু। তাই ভিজে গেছি।”
মেয়ের চাঞ্চল্যকর জবাবে বুঝতে বাকি নেই, ইচ্ছাকৃতই ভিজতে গেছে তারা। কথা না বাড়িয়ে দ্রুত চেঞ্জ করতে তাড়া দেন তিনি। মিহিরকে বলতে হলো না কিছুই। সালাম বিনিময় পর্যন্তই চুপ থেকে রিপ্তির জবাবে মৃদু হেসে গেলো কেবলই। পরক্ষণে পরিবারের সকলের সাথে গল্প করতে করতে গরম গরম খাবার উপভোগ। জামাইকে দেখেই অতিরিক্ত রান্নায় ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন শ্বাশুড়ি। সকালে রিপ্তি উঠে গেলেও মিহির উঠতেই চাইছিলো না ঘুম থেকে। গা ছুঁয়ে দেখে প্রচুর জ্বর বেঁধেছে। রিপ্তি উঠে যাওয়ায় এক কাঁথায় হচ্ছে না, অতিরিক্ত কাঁথা চাইছে। ঝটপট মোটা কাঁথা এনে চেপে দিলো রিপ্তি। অবেলায় ওবাড়ি থেকে এবাড়ি আসা, আবার ছাদের সময়টা জুড়ে দীর্ঘক্ষণ ভিজলো যে। নাস্তা করতেও উঠলো না সে। একটু পরপর এসে মাথা টিপে দিচ্ছে, জলপট্টি লাগাচ্ছে সহধর্মিণী। দুপুর পর্যন্ত টানা ঘুমিয়েছে। দেহের তাপমাত্রাও কমেছে। হালকা দুর্বলতাটুকু রয়ে গেছে। জ্বরমুখে রুচিসম্মত খাবারের আয়োজন করে রেখেছে শ্বাশুড়ি মা-ও। অফিসে থেকেই শ্বশুর খবর নিচ্ছে ফোনকলে, জ্বর কমেছে কি না মিহিরের? সব ভালো লাগার মধ্যেও সবচেয়ে বেশি ভালো লাগলো তার, রোহান এসে কয়েকবার কপাল ছুঁয়ে দেখে গেছে ভাইয়ার জ্বর কমেছে কি না। ছোট্ট হাতের স্পর্শে টের পেলেই মিহির চোখ খুলে জিজ্ঞাসা ছুড়েছে,
“জ্বর কমেছে, রোহান?”
বারবারই তার জবাব এসেছে,
“আরেকটু আছে। চুপ করে ঘুমিয়ে থাকো, কমে যাবে।”
বিকেলে ফ্রেশ মনে রিপ্তির সাথে রিকশায় বাড়ি ফিরে সে। ঘরে প্রবেশকালেই বলে,
“রোহান ভালো কেয়ার করলো ভাইয়ার জ্বরে।”
“ও আরও ছোট থেকেই এমন। ঘরে কারো জ্বর হয়েছে শুনলেই বাটি নিয়ে সবার আগে দৌড়ে যায় জলপটি দিতে।”
কলিং বেল চেপে জবাব দিয়েই হাসে রিপ্তি। জিনিয়া তাবাসসুম দরজা খুলে দুজনের হাসিমুখ দেখে বেশ ভালো বোধ করেন। বাচ্চারা এমন হাসিখুশি থাকলেই না ভালো থাকে বাবামায়ের মন। রিপ্তি সালাম দিতেই হাসি মুখের গাল টিপে সালামের জবাব দেন তিনি। ওদিকে ঘরে প্রবেশ করতেই বিড়াল ছানা ছুটে আসে রিপ্তির কাছে। কোলে তুলে রুমে আসে সে। মিহিরকে আর আসতে দেখা গেলো না। বাইরে অতিরিক্ত গলার আওয়াজ। কেউ এসেছে যেন! রিপ্তি এগিয়েই দেখতে পায় একটি একক পরিবার। গতকালের সেই মেয়েটি এসেছে এখানে। ঘরে এসেই শ্বাশুড়ি মাকে জড়িয়ে ধরলো।
“আরে, শৈলী যে! দেশে ফিরলে কবে?”
“গত সপ্তাহে, আন্টি। মিহিরের বিয়ে তো খাওয়া হলো না। তাই এখন না জানিয়েই হুটহাট সেই দাওয়াত খেতে চলে এলাম।”
“এ-ই তো বেশ ভালো। বিয়েতে আয়োজন করিনি তেমন।”
“হ্যাঁ, শুনলাম।”
দরজার কাছ থেকেই আবার রুমে ফিরে যায় রিপ্তি। এ কি তবে উনার ফ্রেন্ড? ভাবতে ভাবতে হিজাব ছাড়ায়। এমনি মিহির আসে ডাকতে,
“কি করছো? এসো, মেহমান এসেছে।”
“কে?”
মিহির এক গাল হেসে বলে,
“ইয়ানাত।”
রিপ্তি লাজুক হাসে।
“উনি আপনার কেমন ফ্রেন্ড?”
“স্কুল ফ্রেন্ড। এসো।”
“আসছি।”
“এই, তুমি তার ফোন নম্বর কোথায় পেয়েছো?”
“কার ফোন থেকে যেন নিয়েছিলাম।”
জবাব দিয়েই মৃদুস্বরে কুটিকুটি হাসে সে।
“কত পানিশমেন্ট যে জমা হচ্ছে তোমার!”
“আমি তো কফিশপের বিলও দিয়ে আসিনি। দেওয়া হয়েছিলো তো?”
“শপাররা বাঁধলো না কেন তোমাকে? এসো…”
মিহিরের সাথেই দেখা করতে বেরিয়ে আসে রিপ্তি। শৈলী মেয়েটা তাকে দেখেই হেসে উঠে বলে,
“বিয়েটা করেই নিলাম তোমার কথায়। একদম বর বাচ্চাসহ হাজির। শ্বশুর বাড়িও মিরপুরেই।”
রিপ্তি লজ্জা পেলেও বাচ্চাটার গাল টেনে দিতে মিস করেনি। পাল্টা মিহিরকে জিজ্ঞেস করে,
“একদম রোহানের মতো না?”
“অনেকটা প্রায়।”
বয়সও তেমনই। শৈলী ও তার বর বসে সবার সাথে গল্প গুজবে। খাওয়া দাওয়ার বন্দোবস্ত করতে একদম নিষেধ করে। এমনি ঘুরতে বেরিয়েছিলো, এদিক পথে যেতেই দেখা করে যাওয়ার ইচ্ছা৷ তাই না জানিয়েই হুট করে চলে আসা তাদের। বাইরে থেকে খেয়েই এসেছে মাত্র। তবুও ঘরে হালকা আয়োজন করতেই ব্যস্ত হয় বউ শ্বাশুড়ি। ঘন্টাখানেক সময় দেখাসাক্ষাতে পার করেই বিদায় নেয় তারা। মিহির বেরিয়েছিলো তাদের সাথে। ফিরেছে রাতে। সাথে এনেছে রিপ্তির জন্য এক পিস গোলাপ। আজও গেঁথে দিয়েছে তার বিনুনিতে। আজ সে শুধায়,
“আজ কে দিলো? শৈলী আপু?”
“প্রতিদিনই নিজের পকেট খরচ করলাম। নাম হয় অন্যের, তাই না?”
“আমার কি দোষ? তোমার যত গল্পখোশ।”
বলতে বলতেই হাতের পিঠে জ্বর আন্দাজ করে এই দেহের। একদম নেই। বিনুনিতে ফুল রেখেই শ্বাশুড়ি মাকে ডেকে বসে খেতে। গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত সময়টুকুতে একটা ছোট কাঁথা সম্পন্ন করে তিনি ভীষণ খুশি। আরও করবে বলে জানাচ্ছিলেন রিপ্তিকে। কিছু নকশা এঁকে দিতেও হুকুম করেন নকশীকাঁথার জন্য। রিপ্তিও আনন্দ গুজে সায় দেয়। খাওয়া শেষে সবটা গুছিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মাথায় চাপে দুষ্টুমি। আজ মন বড্ড ভালো আছে তার। তার বহিঃপ্রকাশে আলমারি থেকে শাড়ি নিয়ে ছুটে বাথরুমের দিকে। তাকে যেতে দেখে মিহির বলে,
“শাড়ি পরতে যাচ্ছো বুঝি?”
“ফিরে এসে বলছি।”
মিহির বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় ফোন হাতে অনলাইনে সময় কাটাচ্ছিলো তখন। তার নতুন গানটির ভিউয়ার প্রতিনিয়তই বেশ ভালো বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যান্য গানগুলোর চেয়েও খুব বেশি এগিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। রিপ্তি শাড়ি পরে বেরিয়ে এসে মুখ চেপে হেসে বললো,
“হ্যাঁ, শাড়ি পরতেই গিয়েছিলাম। তোমার ওই রুমটায় যাই একটু, হ্যাঁ?”
মিহির বিপরীতে জবাব না দিয়ে কপালে সুক্ষ্ম ভাজ ফেলে তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে। কি করতে চাইছে সে? রিপ্তি ফিরে এলো গিটারটা নিয়ে। দরজা আটকে দিয়ে পুনরায় অনুমতি চাইলো,
“আরেকবার ধরি গিটারটা? একদম ছিঁড়তে দিবো না, প্রমিজ।”
তার পাগলামোতে প্রশান্তির হাসি লেগে আছে মিহিরের মুখে। মাথা নাড়িয়ে ইশারা করে বললো বাজাতে। রিপ্তি বিছানা বরাবরই ফাঁকা জায়গাটুকুর মধ্যখানে চেয়ার টেনে পায়ের উপর পা তুলে বসলো। বেশ ভালোই লাগছে দুষ্টুকে শাড়িতে দেখতে। ভাবটাও নিয়েছে দারুণ! গিটারে আওয়াজ তুলছে টুংটাংটুং। সেদিনের মতো এলোমেলো, অগোছালো সুর নয়। দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় যেন কিছু শুরু করার সুর উঠলো তাতে। মিহির কোমল আবদার জুড়ে দেয়,
“গাও একটু, শুনি?”
রিপ্তি মাথা হেলিয়ে আবার ছন্দে ছন্দে সুর তুললো গিটারে। কোনো ভুল নেই। একটা গানের সুন্দর তান ধরেছে।
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে। শুধু তোমায় ভালোবেসে…
আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে তোমার কাছে এসে। শুধু তোমায় ভালোবেসে…
সেই পরিচিত প্রিয় কণ্ঠ, মুগ্ধকর সেই পুরনো সুর। প্রশান্তিতে ছেঁয়ে গেলো মনটা, বিষাদ উড়ে যায় বহুদূর! একদম স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিহির, মুখাবয়বে কড়া মনযোগ। ঠোঁটের ধারে হাসি রেখেই গাইছিলো রিপ্তি, চোখে সাগর জলের ক্ষোভ। বেরিয়ে আসতে চায় বাঁধ ভেঙে৷ প্রিয় এসে ছুঁয়ে নেয় মুখ। গাল গড়িয়ে জল, হাত পর্যন্তই থেমে যায় মিহিরের। জল মুছে নিয়ে শুধায়,
“সুযোগ তো তোমারও ছিলো। গানের ক্লাসেও ভর্তি হলে। কণ্ঠও সুন্দর। তবে গান কেন ছেড়ে দিলে?”
মায়াবী হেসে সে প্রত্যুত্তর করে,
“তোমার মতো গানকে ভালোবাসতে পারিনি বলে। মনকে বসাতে পারিনি গানের তান ধরতে। ডিজাইনার হওয়ার খুব শখ। গানও শখ ছিলো বলেই ক্লাসে যাওয়ার জন্য আব্বু আম্মুর কাছে বায়না ধরেছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম ডিজাইনিংয়ে শখটা অধিক।”
“একাধিক শখ রাখাই যায়। গাইবে আবার আমার সাথে? একটু ইচ্ছুক হলে ভালোবাসা জেগে উঠবে গানের তানে।”
“হুম, গাইবো। খুব গাইবো তোমার সাথে, তোমার ঘরে। নয় গো জনসম্মুখে।”
কথায় মুগ্ধতা জাগে মিহিরের। ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে বলে,
“আমার সামনে হাজির হওয়া থেকে ঝগড়া করা, বিরক্ত করা সবটাই প্ল্যান ছিলো তোমার। তাই না?”
“দুই পাক্ষিক জীবন নিয়ে আবার প্ল্যান কি? এটা ভাগ্যের ব্যাপার বলেই ছেড়ে দেওয়া যায়। তবে রিপ্তির মিশন এটাই ছিলো যে, সুপারস্টারের সাথে প্রেমও করবো। যুদ্ধও করবো। ভাগ্যের লিখন থাকলে বিয়েও করবো, সংসারও করবো। তা-ই করছি। রিপ্তিকে শাড়িতে কেমন লাগছে, বললে না?”
“মাশাআল্লাহ।”
কপালে কোমলতা ছুঁয়ে দেয় মিহির। রিপ্তির আবদার জাগে পরক্ষণে।
“দুই লাইন গাও না রিপ্তির জন্য তবে। কতদিন হয়, সামনে থেকে শুনি না। এখন কিছু শুনাও।”
“গাওয়ার মুড নেই।”
“আলাভু, সুপারস্টার। প্লিজ…”
বলতে বলতে গিটারটা উপরে তুলে নিলো রিপ্তি। দুষ্টুর দুষ্টুমিতে মিহির মুচকি হেসে হাতে নেয়। রিপ্তির জন্যই গায় দুই লাইন…
তোর হাসিতে পড়লাম প্রেমে, দেখেছি চোখের ভয়।
হাসির গানে শিখেছি হাসতে, দুষ্টুমিতেও প্রেমের জয়।
(সমাপ্ত)