“গানের ওপারে তুমি”
পর্ব- ৯
(নূর নাফিসা)
.
.
আগামীকাল সন্ধ্যায় ফ্লাইট। আজও মিহির বসেছে তার মিউজিক রুমে। রিপ্তি রান্নার জন্য ঝটপট শ্বাশুড়িকে সবজি কেটে দিয়ে ছুটে এসেছে এদিকে। ধীর গতিতে দরজা খুলে প্রবেশ করলো রুমের ভেতরে। মিহির গাইছে। গাওয়ার মধ্যেও তাকে লক্ষ্য করে মৃদু হেসেছে। নিঃশব্দে একটা চেয়ার টেনে পাশেই বসলো রিপ্তি। মনযোগে লক্ষ্য করলো মিহিরের হাতের দিকেও। কি সুন্দর ছন্দে ছন্দে সুর তুলছে ওই বাটনগুলো চেপে! কি চমৎকার ধারাবাহিকতা মেনে নড়ছে আঙুলগুলো! চোখ, কানের মুগ্ধতার পরশ যেন নির্বিঘ্নে ছড়িয়ে যাচ্ছে পিঞ্জরে। মিহির গান শেষ করতেই হাতের তালুতে তিন আঙুলের শব্দ তুলে তালি দিলো রিপ্তি।
“এতো সুন্দর কিভাবে গাইতে পারেন আপনি?”
মিহির এক আঙুলে রিপ্তির নাকের ডগা ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
“একবার তুমি, একবার আপনি কেন? ‘তুমি’ সম্বোধনেই না ডাকতে বলেছি?”
“চেষ্টা করছি তো। ভুলে যাই। এটা কি আমার দোষ?”
“নাহ, তবে চেষ্টাটা মনযোগ দিয়ে করতে হবে। নয়তো ভুলেই যাবে। ইচ্ছাকৃত ভুলে যাওয়াটা তোমার রোগ।”
“হিহিহি… আচ্ছা, দিবো মনযোগ। এবার বলো, কিভাবে গাও?”
“এইযে, চেষ্টায়।”
“দেখি তো, আমি চেষ্টা করে পারি কি না?”
“দেখো।”
রিপ্তি এলোমেলো সুর তুলেই ডিজিটাল পিয়ানোতে আঙুল চেপে গেলো শুধু। কি গান গাইবে ভেবে না পেয়ে সে এবার শুরু থেকে বাটনগুলো চাপতে লাগলো। কারণ সে জানে, এসব বাটনে সারেগামাপা সুর সাজানো থাকে। তাই সিরিয়ালি বাটন চাপতে চাপতে গলা ছাড়লো, সা রে গা মা পা… পা মা গা রে সা। এইটুকু গেয়ে নিয়েই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। হাত সরিয়ে নিয়ে নিজেকে তিরস্কার করে বললো,
“এই গান শুনলে কুকুর গিয়ে সুইসাইড খাবে।”
মিহির হাসলো শুধু। রিপ্তি পাশে রাখা গিটারটা দেখিয়ে বললো,
“ওইটা একটু বাজাতে দিবে? আমার খুব শখ গিটার বাজানোর।”
“বাজাও।”
তার শখের চাওয়া পূরণে কোনোরকম ভাবতে হলো না মিহিরের। ওপাশ থেকে গিটার এনে হাতে দিতেই রিপ্তি গিটারের তারে এলোমেলো নাড়ছে আর টুংটাং আওয়াজ হচ্ছে। সুর তো তুলতে পারে না, তবুও এই টুংটাংয়ের মধ্যেই মিহিরের গাওয়া একটা গান ধরলো।
তুমি ফিরেছো, শুনেছি সন্ধ্যা হেমন্তে।
আমি খুঁজেছি, তবুও খুঁজে পাইনি তোমাকে।
পেয়েছি তোমারও সুবাস, পেয়েছি ছেঁড়া নুপুর,
শুধু পাইনি তোমার বিরহে কাটানো একটি দুপুর।
কথা ঠিক থাকলেও, না হয়েছে সুর আর না মিলেছে ছন্দ। কণ্ঠটাও যেন মায়ার বিপরীতে করছিলো তুমুল দ্বন্দ্ব। পারলে এক দমেই শেষ করে ফেলতে চায় সবটা। মিহির বললো,
“আস্তেধীরে গাও। এমন করে গাইলে তো লোকে বলবে ঝগড়া করতে গিয়েছো।”
“এখন আপনি কি বলতে চান, আমি আপনার সাথে ঝগড়া করছি গিটার ধরে?”
“আমি না বললেও লোকে তো বলবে।”
“আমি তো লোকের সামনে গাইছি না। আপনার সামনে গাইছি। সো আপনি একটু ভালো বললেই আমি এখন খুশি হয়ে যাই।”
আবেগী গলায় প্রশংসা পাওয়ার আবদার জুড়ে দেয় রিপ্তি। মিহির তার আবেগ উতলা করতে রসিকতা জুড়ে বললো,
“ওকে, ফাইন। ভালোই গেয়েছো। আর গাইতে হবে না, রাখো। তোমার গান শুনে আমার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয়ে যাচ্ছে।”
“গান শুনলে কারো গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা হয় বুঝি?”
মিহির হাত থেকে গিটার নিতে নিতে বললো,
“আমার হয়ে গেছে।”
বিপরীতে গিটার টেনে রিপ্তি বললো,
“না, আরেকটু বাজাবো। ভালো লাগছে আমার।”
মিহির ছেড়ে দিলে সে-ও তার টুংটাং চালাতে শুরু করলো সবে। তারে আঙুল আটকে কিভাবে যেন তারটাই ছিঁড়ে গেলো গোড়া থেকে! হা করে আছে রিপ্তি। এটা কি করলো সে! পরক্ষণে দাঁতে দাঁত চেপে ভ্রু জোড়া বাঁকিয়ে কণ্ঠে অপরাধ টেনে গিটার ফিরিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়।
“আমি ইচ্ছে করে করিনি।”
মিহির গিটার কোলে নিয়ে দেখতে লাগলো তারটা কিভাবে ছিঁড়ে এলো। দেখলো, এটা স্ক্রু থেকেই ছুটে এসেছে। কোনোভাবে হয়তো ঢিলে হয়েছিলো, এখন ছুটে এসেছে। এদিকে রিপ্তি ভারি অপরাধবোধে মত্ত হয়ে গেলো যেন!
“আমি স্যরি, হ্যাঁ?”
প্রত্যুত্তর করলো না মিহির।
“তুমি মন খারাপ করছো?”
জিজ্ঞাসায়ও জবাব নেই তার মুখে। চোখের মনযোগ গিটারে থাকলেও কানটা সজাগ রিপ্তির কণ্ঠস্বরে। রিপ্তি কতটা বলতে পারে, তা-ই যেন পরিমাপ করতে চাইছে।
“মন খারাপ করো না, হ্যাঁ? আব্বুকে বলবো একটা গিটার তোমাকে কিনে দিতে।”
পরপর বলা কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া না করলেও শেষ বাক্যের পর মাথা নিচের দিকে হেলানো রেখেই এক পলকের জন্য চোখ তুলে তাকালো মিহির। এবারও বললো না কিছুই। আবারও মনযোগ দিলো গিটারের তার লাগানোর জন্য। রিপ্তি আবারও অনুতপ্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“এই গিটার কিনতে কত টাকা লাগে?”
মিহিরের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে যাচ্ছে। সে গিটারের তার লাগানো শেষ করেই এবার জবাব দিতে প্রস্তুত হলো। মুখের হাসি সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করে এক হাতে রিপ্তির গাল টিপে জবাব দিলো,
“তোমাকে লাগে। এই যে গিটার দিলাম ঠিক করে। এবার তোমাকে দিয়ে দাও।”
“আল্লাহ! ছিঁড়েনি তবে! আমার আব্বুর টাকাটা বেঁচে গেলো, ওফ্ফ!”
“ছিঁড়ে গেলেই তোমার আব্বুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসতে?”
“নিবো না? উনার মেয়েই তো ছিঁড়েছে।”
“আমার বউও তো উনার মেয়েটাই। এখন কি শ্বশুরের কাছে জরিমানা নিবো?”
“নিবেন না তবে?”
“এই বোকামি কিন্তু ভুলেও করো না। মানইজ্জত শেষ! না তোমার বাবাকে আমার বাসায় ছোট হতে দিবে। আর না আমাকে তোমার বাবার বাসায় ছোট হতে দিবে। এটা মাথায় থাকে যেন সবসময়।”
“ওকে, থাকবে। থাকবে। নো টেনশন। আমি এমনি দুষ্টুমি করেছি।”
“এজন্যই তো দুষ্টু ডাকি। উঠো, চলে যাই। তোমার শখ যখন, প্যারিস থেকে ফিরে একটু একটু করে শিখিয়ে দিবো সবকিছু চালাতে। এখন সময় নেই।”
“ওক্কে। বাট, গিটার বাজিয়ে এবার একটু গাও না প্লিজ। বেশি না, একটুই…”
তার কথা রাখতে মিহিরও সেই গানের চার লাইনই গাইলো এবার গিটারের সুরে,
“তুমি ফিরেছো, শুনেছি সন্ধ্যা হেমন্তে।
আমি খুঁজেছি, তবুও খুঁজে পাইনি তোমাকে।
পেয়েছি তোমারও সুবাস, পেয়েছি ছেঁড়া নুপুর,
শুধু পাইনি তোমার বিরহে কাটানো একটি দুপুর।”
পরক্ষণে মুচকি হেসে গিটার রেখে দুজনেই বেরিয়ে এলো। সময় কাটাতে গেলো টিভি দেখে। রাতে খাওয়াদাওয়া করে মিহির যখন ঘুমানোর জন্য রুমে এলো, বিছানায় বসে বসে রিপ্তিকে কিছু খেতে দেখলো। রিপ্তি যেন হুট করেই পিছু লুকিয়ে ফেললো কিছু। মুখের নাড়াচাড়াও বন্ধ করতে ইচ্ছুক এমনটাই গম্ভীর চোখমুখ। মিহির হালকা করে ভ্রু কুচকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
“কি ওটা, দেখি?”
রিপ্তি মাথা নাড়লো দুদিকে। মিহির বিছানায় হাত ভর করে ঝুঁকেই পেছন থেকে লুকানো খাবারটা নিয়ে নিলো। এটা সেই মিক্সড আচার।
“আচার! এটা লুকিয়ে খাওয়ার কি আছে?”
“এইটুকুই আছে তো। ভাবলাম, কেউ দেখলেই তো সাধতে হবে। এইটুকু থেকে কি আর দিবো?”
“এটা সেদিন কিনেছো না, এই সামনের দোকানটা থেকে?”
“ওটা তো কবেই খেয়ে শেষ! এটা আবার কিনেছিলাম। বাসা থেকে আসার সময় ব্যাগে করে নিয়ে এসেছি। পুরোটা খাওয়া হয়নি। একটুখানি বাকি আছে। এক বোয়াম দুইদিন যায়ই।”
“এতোই মজা?”
“খেয়ে দেখো না একটু।”
“লুকিয়ে খাচ্ছো যখন, তুমিই খাও। এইটুকুতে ভাগ বসাই কিভাবে?”
“আরে একটু নাও। কিছু হবে না। তোমাকে তো একটুও সাধতে পারবো। মাকে কি আর এইটুকু দেয়া যাবে, বলো? তাই লুকিয়ে খাচ্ছিলাম।”
“আমি এমনিতেও আচার খাই না বললেই চলে। তুমিই খাও আর বেড থেকে নেমে খাও। কভারে পড়লে দাগ হয়ে যাবে।”
“পড়েনি একটুও। নাও তো!”
শেষ অংশ থেকেই এক চামচ তুলে দিলো মিহিরের মুখে। প্রচুর ঝাল! মিহির বললো,
“এই আচার তুমি দুই দিনে শেষ করে ফেলো? পেট খারাপ হয় না? রাখো!”
“এইটুকু ঝাল কি খাওয়া যায় না?”
“যায়। তাই বলে তোমার মতো পরিমাণে এতো নয়। পেটে সমস্যা হয়ে যাবে।”
“গরম ভাত দিয়ে খাই। অনেক মজা। আবার এনে তোমাকে গরম ভাত দিয়েই খেতে দিবো। রেখে দিলাম এখন।”
রাখতে গিয়েও রাখে না রিপ্তি!
“নাহ, শেষ করেই নেই। ঘুমিয়ে যাবে এখনই?”
“হুম।”
রিপ্তি খাওয়া শেষ করে বালিশ ঠিক করতে ব্যস্ত হল। মিহির তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। সামনের দোকানটার চালে একটা সাদা বিড়াল নজরে পড়লো খানিক দূর থেকেই। রিপ্তির বিড়াল লাগবে নাকি, বলতে গিয়েও যেন বলা হলো না। বিড়ালের কথা তুললে না আবার মনটাই খারাপ করে বসে দুষ্টুমিষ্টি পরীটা। এসময় কারো মন খারাপ করতে একদমই দিতে ইচ্ছুক না মিহির। ওদিকে বিছানা ঠিক করে রিপ্তি এসে পাশে দাঁড়ালো।
“বিছানা গুছিয়ে দিয়েছি।”
মিহির পরীক্ষামূলকভাবে কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“আমি যে আগামীকাল এতোদিনের জন্য যাচ্ছি, তোমার খারাপ লাগছে না?”
“লাগেই তো।”
“কোথায়, বললে না তো একবারও।”
“আমি জানি, তুমি যে না বলতেই বুঝে যাও। তাই বলিনি।”
মিহির হাসলো। অতঃপর রিপ্তিকে এক হাতে জড়িয়ে মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ রেখে বললো,
“আমি তো গান শুনিয়েছি, তুমি একটা গল্প শুনাও।”
“কি গল্প?”
“যা ইচ্ছে।”
“যা ইচ্ছে বলতে পারবো না। যেকোনো একটা টপিক বলো।”
“প্রেমের গল্পই শুনাও। আরেকটু প্রেমে পড়ি।”
খিলখিলিয়ে হেসে রিপ্তি প্রত্যুত্তর করে,
“আচ্ছা, তবে একটা প্রেমের গল্পই বলি। আমার জীবনেরই প্রেম।”
“তুমি প্রেমও করেছো!”
“প্রেম কে না করে? প্রেম তো সবাই-ই করে। কেউ নিজের সাথে, কেউ ফ্যামিলির সাথে, কেউবা তথাকথিত বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ডের সাথে।”
“ঠিকই তো! তুমি কোনটায় পড়েছো?”
“বলছি তো। সবই বলছি। আমি আসলে নিজের প্রেমেও পড়েছি আবার একটা ছেলের প্রেমেও পড়েছি। কত পাগলামো করেছি এই ছেলেটাকে নিয়ে৷ কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য এই যে, ছেলে জানতোই না আমি যে প্রেমে পড়ে গেছি। আর ছেলেটার দুর্ভাগ্য এই যে, আমি এখন তারই বউ।”
তার অনু প্রেমগল্প শেষ হতেই নিজেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। মিহিরও হাসলো শরীর কাঁপিয়ে, নিঃশব্দে।
“এটা কোনো গল্প হলো?”
চলবে