“গানের ওপারে তুমি”
পর্ব- ৩
(নূর নাফিসা)
.
.
“এইটা না খুব দুষ্টু বাচ্চা। যা পারে তা-ই বলে ফেলে। সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে। তাকেও কি একটা অটোগ্রাফ দিবেন?”
মিহির সুস্থ-স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
“তার অটোগ্রাফ নেওয়ার বয়স হয়নি।”
“অটোগ্রাফ নিতে বয়স লাগে?”
উৎসুক দৃষ্টিতে মেয়েটি প্রশ্ন জুড়ে দেয় মিহিরের দিকে। মিহির ঠোঁটের এক কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলে,
“লাগে না? যে ব্যক্তি কোনো জিনিসের মর্ম বুঝে, সে সেটি যত্নে সংরক্ষণ করে রাখে এবং পাওয়ার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষিত হয়। আর যে মর্ম বুঝে না, তার কাছে এসব কিছুই না। রোহানও অটোগ্রাফের মর্ম বুঝে না। যখন বুঝবে, তখন হয়তো তোমার মতোই আগ্রহ দেখাবে।”
“ও, আচ্ছা। তবে বড় হলে দেখবেন সে-ও আপনার ফ্যান হয়ে গেছে। এখনো তো সাউন্ড বক্সে জোরে জোরে আপনার গান শোনে। আমিও শুনি।”
লেখা শেষ হওয়ায় মিহির ডায়েরি ও কলম ফিরিয়ে দিয়ে বললো,
“ওকে। স্কুলে যাচ্ছো?”
“হ্যাঁ। তাকে স্কুলে দিয়েই আমি কলেজ যাবো। বেশি না, টু তে পড়ে রোহান।”
মিহির হালকা করে রোহানের গাল টিপে বললো,
“কিউট বাচ্চা। ওকে, যাও।”
“আমাদের বাসায় চলুন না?”
“না, না। কাজ আছে। যাও, তোমরা স্কুলে যাও।”
“আচ্ছা, আপনার বাসার সামনে দিয়েই প্রতিদিন যাই। কিন্তু কোন বাসাটা যে আপনার, সেটা চিনি না। আবার দেখা হবে, ভালো থাকবেন।”
“হুম।”
তাদের আগেই মিহির চলে গেলো নিজ পথে। আবেগে অতি আপ্লুত যেন মেয়েটা। স্বভাবতই কথাটা একটু বেশি বলে। ক্রাশকে দেখেছে বলে কথা, তাই বারবারই পিছু ফিরে দেখছে আবার মিহিরের চলার দিকে। মিটিমিটি হাসছে। অটোগ্রাফ পড়ছে। মেইন রোডের পাশেই কিন্ডারগার্ডেন স্কুলটা। ভাইকে সেখানে পৌঁছে দিয়েই সে নিজের প্রতিষ্ঠানে যাবে।
বাজারেও আরও পরিচিত জনদের সাথে দেখা হলো মিহিরের। তবে খুব একটা সময় অতিবাহিত করলো না। মাছের ওদিকটায় গিয়ে দেখলো তাজা মাছ কি আছে। বেছে বেছে কিছু বড় মাছ কিনে কাটিয়ে নিলো মায়ের কষ্ট লাঘব করতে। অল্প কিছু ছোটমাছ নিলো মায়ের বেশি সময় যেন পার না হয় এই মাছ কাটতে। অল্প কিছু শাকসবজি নিলো টাটকা খাওয়ার জন্য। শাকসবজির ক্ষেত্রে প্রতিদিনের বাজার প্রতিদিন করিয়ে নিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে জিনিয়া তাবাসসুম, টাটকা খাওয়ার প্রত্যাশায়। অতঃপর মুদি দোকান থেকে প্রায় এক মাসের তেল, ডাল, মশলা, লবণ, চিনি, চা-কফি কিনে নিয়েছে মিহির। কেনাকাটা শেষে একটা রিকশা নিয়ে বাসার সামনে এলো। তার হাতভরা বাজার দেখে জিনিয়া তাবাসসুম বললেন,
“আবার এতো মাছ আনার কি প্রয়োজন ছিলো? তারিকুলকে দিয়ে কালকে মাত্র মাছ আনলাম।”
“সমস্যা কি, ফ্রিজে রেখে দাও। তাজা মাছ দেখে নিয়ে এলাম।”
“হাতমুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি নাস্তা খা। আব্রাহাম আর দিলু না কি ছেলেটার নাম, তোরই বন্ধুবান্ধব যে। তারা এসেছিলো একটু আগে। খুঁজে গেছে তোকে।”
“আসুক। নাস্তা দাও আমার। ফ্রেশ হয়ে আসি।”
কথার পরপর চলে গেলো সে হাতমুখ ধুতে। মাঝে মাঝে কষ্টে সে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসে মনে মনে। এখনো হাসলো। হাসলো এই ভেবে যে, সুসময়ে বন্ধুর অভাব হয় না। জীবনে প্রকৃত বন্ধু খুব কমই পাওয়া যায় এবং সেই কমজন খুব কম মানুষের ভাগ্যেই জুটে। একটা সময় তাকে গিটার হাতে দেখে এই মানুষগুলো উপহাস করতো। আর এখন দিনের পর দিনই দেখা করতে চায়। বাড়ি পর্যন্ত চলে আসে খোঁজ নিতে। ওইতো, আশেপাশের চাচাদের কথাই বলা যাক। নিজের চাচারা যখন এই বাড়ি থেকে বিতারিত করতে চাইছিলো, তখন একটা মানুষ আসেনি চাচাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তাদেরকে একটু সাপোর্ট করতে। বাবা মারা যাওয়ার পর এমন দুজন মানুষকে পাওয়া যায়নি, যারা এসে একবেলা জিজ্ঞেস করেছে তারা মা ছেলে খেয়েছে কি না? বাড়ি ভাড়াও তো সব ভাড়াটে দেয় না ঠিকঠাক। তবুও জানতে এলো না কেউ যে, এই আয়ে তাদের চলছে কি না? এখন পাড়াপড়শিরও অভাব নেই, খোঁজ নেওয়ার মতো বন্ধুবান্ধবদেরও অভাব নেই। টাকায় তবে কি না হয়? এই পৃথিবীর সুখটুকুও টাকাতেই কেনা হয়। টাকা না থাকলে ঘরের আপন মানুষগুলোও পর হয়ে যায়। বন্ধুগুলোও পথেঘাটের শত্রু হয়ে যায়। টাকা শত্রুসহ সবাইকেই আপন করে রাখতে জানে। একটু সুযোগ পেলে হয়তো সেই আপন চাচারাও ঘাঁটি গেড়ে বসতো। জেনেশুনে এই সুযোগটুকু দেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করে না মিহির। ঘরের একমাত্র ছেলে সে। বর্তমান জীবনযুদ্ধের একমাত্র যোদ্ধা। কাজের জন্য বহু জায়গায়ই ছুটে যেতে হয়, সময় কাটাতে হয়। মা ঘরে একা থাকে। মাকে নিয়ে তার এমনিতেই ভয় হয়। সুতরাং জানাশোনা শত্রু ডেকে এনে কালসাপ পোষার কোনো মানেই হয় না। তাকে একরোখা মনোবল নিয়ে বাঁচতে হবে।
একটা গানের কাজ চলছে মিহিরের। গানটা পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হলেই আগামী মাসে মিউজিক ভিডিওর জন্য শুটিংয়ে যাবে এবার প্যারিসে। এমনিতে প্রতিনিয়তই প্রাকটিস চলছে বাসায় এবং অফিসে। ঘরে এখন অনেক ইনস্ট্রুমেন্টসই আছে তার। তৃতীয় তলার দুইটা ফ্ল্যাটকে একত্রিত করে ফেলেছিলো উপরের দুই তলা নির্মাণের সময়। এখন তার গানের প্রাকটিসের জন্য আলাদা একটা রুমই রাখা আছে। নিচতলায় গাড়ি রাখার জন্য একটা অংশ ফাঁকা করেছে। আজ সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে মেইন রোডের পাশে নেমে গিয়েছিলো অফিসেরই একজনকে দেখে। ড্রাইভারকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে গাড়িসহ। মিহির ধীর গতিতে হাঁটতে হাঁটতে কথা বললো তার সাথে। এই গরমে ঠান্ডা পানীয় খাওয়ার অফার করলো দোকান থেকে। লোকটা কিছু নিতে চাইলো না। মিহির জোর করেই দুইটা স্পিড ক্যান নিলো। খেতে খেতে একটু আলাপ করলো। এদিকেই কোনো আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছে লোকটা। মিহির বাসায় আসার জন্য সাধলো দুয়েকবার। তিনি কথা শেষে সেখান থেকেই বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। লোকটা প্রস্থান করতেই মিহির বাসায় ফেরার জন্য হাঁটতে লাগলে বাসার কাছেই একটা দোকান থেকে হুট করে দৌড়ে বেরিয়ে এলো এক মেয়ে।
“আ…! সুপারস্টার, সুপারস্টার!”
মিহির ভ্রু কুচকে পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখলো সেই মেয়েটাই। পিছু থেকে আবার দোকানদার ডাকছে,
“এই মেয়ে, তোমার বোয়াম নিয়া যাও।”
“ওহ্! একটা মিনিট দাঁড়ান প্লিজ।”
মিহিরকে দাঁড়াতে বলে সে আবার দোকানে গিয়ে কাচের একটা বোয়াম নিয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলো,
“টাকা দিয়েছি না, আঙ্কেল?”
“হু, হু।”
বোয়াম হাতে সে আবার ছুটে বেরিয়ে এসেছে। মিহিরের পাশে এসে বলে,
“আমি রিপ্তি। আপনার মনে আছে আমাকে? এই ক’দিন আগেই না আমার বাসার সামনে আপনাকে দেখলাম?”
“হ্যাঁ, আছে।”
“আল্লাহ! মনে আছে তবে? আমি ধন্য! আমি বিমুগ্ধ! একটা অটোগ্রাফ দিবেন প্লিজ?”
“সবসময়ই অটোগ্রাফ লাগে?”
“দিলে কি সমস্যা? একটু লেখবেনই তো।”
“এতো অটোগ্রাফ দিয়ে কি করো?”
মিহির সরলতরভাবে জিজ্ঞেস করতেই রিপ্তি উৎসুক ভঙ্গিতে জবাব দেয়,
“জমা রাখি। ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করি। ভালো লাগে পছন্দের মানুষদের স্মৃতি জমা করতে।”
“ফেসবুকও চালাও!”
“আবার জিগায়! আরও কত আগে থেকে।”
“অল্প বয়সেই মাথা নষ্ট করে ফেলেছো। দাও, কলম দাও।”
“কলম! কলম তো নেই আজকে আমার সাথে। আপনার কলমেই অটোগ্রাফ দিন না।”
“আমার কাছেও কলম নেই।”
“ওপ্স! আপনি সেলিব্রিটি মানুষ, আর একটা কলম রাখবেন না সাথে? জানেনই লোকে দেখলে অটোগ্রাফ চেয়ে বসবে, তবে লাগবে না কলম?”
“অদ্ভুত তো! আমি কি অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য বেরিয়েছি এখন?”
“তা-ও চিন্তার বিষয়। আচ্ছা, একটা ফটোগ্রাফই হোক তবে। ফোন আছে আমার সাথে। হবে নাকি?”
“ওকে।”
রিপ্তি ফোন বের করলে মিহির নিজেই সেল্ফি তুললো তার সাথে। হাতের বোয়ামটা সামনে রেখে মিষ্টি হেসে দাঁড়িয়েছে দুষ্টু রিপ্তি। দুই ক্লিকে দুইটা সেল্ফি তুলে ফোন ফিরিয়ে দিতে দিতে মিহির বললো,
“এটা কি?”
রিপ্তি কাচের বোয়াম উপরে তুলে ধরে জবাব দেয়,
“এটা? এটা বিডি ফুডের মিক্সড আচার। মাত্রই কিনলাম। নানু বাসা থেকে এলাম তো, মনে হতেই ভাবলাম কিনে নিয়ে যাই। খাবেন?”
“উহুম। যাও।”
“নিন না। নিয়ে যান। খুব টেস্ট। ঝাল ঝাল, ওফ্ফ!”
“উহুম, খাবো না। যাও।”
“ওকে। আপনার বাসা তো এদিকেই, তাই না? কোনটা আপনার বাসা?”
যা-ই মিহির পা বাড়িয়েছিলো বাসায় যাওয়ার জন্য, এখন থেমেই গেলো রিপ্তিকে আগে বাড়ি পাঠানোর জন্য। এই মেয়ে যা আগ্রহ দেখানো শুরু করেছে, দেখা যাবে এদিকে যাওয়া আসার পথে বাড়ি এসেই অটোগ্রাফ, ফটোগ্রাফ নিয়ে যাবে। তাকে নিজের বাড়ি দেখানো যাবে না। বিপদসংকেত পাওয়া হয়ে গেছে তার। তাই রিপ্তির বাড়ির পথ দেখিয়ে বললো,
“তোমার বাসা ওইদিকে। রাত হয়ে যাচ্ছে, বাসায় যাও দ্রুত।”
“আপনার বাসাটা…”
“আমার বাসা ভিনগ্রহে। তোমার বাসায় তুমি যাও।”
“আমি আপনাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি। আপনি সেলিব্রিটি তো। যায়ই না রিকুয়েষ্ট। মেসেজও দিয়েছিলাম, আপনি এক্সেপ্ট করেননি। ‘রিপ্তি কুইন’ আইডির নাম। চেক করলেই দেখতে পাবেন। একটা রিকুয়েষ্ট দিবেন প্লিজ? আপনি এক্সেপ্ট না করলেই কি, দেখবেন আমি চট করেই এক্সেপ্ট করে ফেলেছি।”
“ওকে, যাও। দেখলে দিবো।”
“আজকেই মনে করে দেখবেন। যাচ্ছি কিন্তু। আপনি আপনার বাসাটাই দেখালেন না। অথচ আমার বাসার সামনে যাওয়ার পর আপনাকে বলেছিলাম কিন্তু বাসায় যাওয়ার জন্য। আরেকবার দেখলে টেনে নিয়ে যাবো।”
কথা শেষ করেই রিকশা ডেকে উঠে গেলো রিপ্তি। দিনের সময়টা হলে দশবার যাওয়া আসার প্রয়োজন হলেও এইটুকু হেঁটেই যেতো। এখন রাত এবং একা হওয়ায় রিকশায় উঠে গেলো। সে যাওয়ার পরই মিহির এখান থেকে নড়লো বাসায় যাওয়ার জন্য। বিগ ফ্যান জেনে প্রথমে ভালো লাগলেও এখন ভয়ংকর মনে হচ্ছে মেয়েটাকে। মাথায় সমস্যা আছে নাকি? অযথাই বকবক করে। ধ্যাৎ! বারবার অটোগ্রাফ দিয়েও বোধহয় ভুল করছে। আস্কারা পেয়ে মাথায় চড়তে বসেছে। কি তেজে বললো, সাথে কলম রাখে না কেন? বাবাহ! সব ব্যবস্থা করেই যেন তাকে পথে বের হতে হবে। একটু খোলামেলা হেঁটেও স্বস্তি নেই! কে যাবে আবার ফেসবুক আইডি খুঁজতে? নামটা রিপ্তি আর কি যেন বললো সাথে? মনেও তো নেই। ধ্যাৎ! ভুলেছে তো ভুলেছেই। অতি পাকামো বিরক্তিকর। বিরক্তি সহিত ভাবতে ভাবতেই বাসায় প্রবেশ করলো সে।
চলবে।