❌ কপি করা নিষেধ ❌
“গানের ওপারে তুমি”
পর্ব- ২
(নূর নাফিসা)
.
.
কোনো কারণে অভিমান করেনি তো তার উপর? কিন্তু কেন করবে? সে তো তার সর্বোচ্চ চেষ্টায় ইয়ানাতের সাথে সম্পর্কিত থাকতে চেয়ে এসেছে। কোনো ভুল কিংবা মন্দ ব্যবহার তার দিক থেকে হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।
মিহির মানাতে পারলো না নিজেকে। দাম্ভিকতা হোক আর যা-ই হোক, সরাসরি কথা বলে একটা নিশ্চয়তায় আসা যায়। কিন্তু সেই সুযোগটা কোনোভাবেই দেয়নি ইয়ানাত। দিনগুলোতে খুব চেষ্টা করেও ঠিকানা সংগ্রহ করতে পারেনি। ইয়ানাতের অবহেলিত আচরণে অভিমান করা সত্ত্বেও সে বাইরের দিক থেকে যোগাযোগের সূত্র খুঁজতে চেষ্টা করেছে ভীষণ। রশীদ স্যারের সাথেও যোগাযোগ করে একটু খোঁজ নিতে চেষ্টা করেছে। এছাড়া কেউ তাকে জানে, এমন লোক আর পাওয়া গেলো না। তবে রশীদ স্যার তাকে হতাশ করেছেন। তিনি কোনোরকম তথ্য দেয়নি, ইয়ানাতের নিষেধাজ্ঞা আছে বলেই। কথা দিয়ে কথা ভঙ্গ করার ব্যক্তি রশীদ স্যার নয়। অর্থাৎ ইয়ানাত প্রমাণ করে গেলো যে, কোনোভাবেই মিহিরকে তার কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে দিবে না।
বিগত ছয়টা মাস ধরে এই অভিমান নিয়েই টিকে আছে মিহির। অপমানবোধ করে আর টেক্সট করেনি ইনবক্সে। তবে খুব অপেক্ষায় আছে ইয়ানাত নিজ থেকেই একটা টেক্সট করবে। তার অভিমান দূর করে দিবে ছোট একটা “হ্যালো!” লিখেই। এই অপেক্ষা আজও ফুরায় না। দিনকাল কাটছে স্টুডিওতে গান, কনসার্ট আর বিভিন্ন মিউজিক ভিডিওর সাথে। সুদর্শন যুবক হওয়ায় মিডিয়ার নাট্যমঞ্চ থেকেও অফার আসছে। কিন্তু সেদিকে ঝুঁকতে কিংবা লিপ্ত হতে ইচ্ছুক নয় মিহির। মিউজিক তার শখের শীর্ষে। মিউজিক তার আয়ের উৎসও। এখান থেকেই তার ভালো আয় হচ্ছে। জনপ্রিয়তার উর্ধ্বেও ভালো সম্মানজনক পর্যায়ে আছে সে। এই সম্মানটুকু ধরে রাখার ইচ্ছাটাই মনে পুষে নিয়েছে আপাতত। অন্যদিকে অতিরিক্ত ব্যস্ততা বাড়িয়ে তোলায় একদমই আগ্রহ জন্মায় না। ব্যক্তিগত জীবনে বর্তমান হয়ে কেবল ইয়ানাতই এক বেদনার দীঘিনালায় ভাসিয়ে রাখছে তাকে। এছাড়া বর্তমান অগ্রগামী পথে নতুন করে বিষাদ হয়ে নেমে দাঁড়ায়নি কোনো কিছু। পারিবারিক দিকেও তার ভালো অগ্রগতি হয়েছে। বাবার ভবনটি পঞ্চম তলা পর্যন্ত গড়ে রঙিন বেশে সুন্দর করে ফুটিয়েছে। দাদার জমিতে পাশাপাশি তিনটি ভবনের মধ্যে তাকালে তাদের ভবনটিই এখন মুগ্ধতা ছড়াবে বেশি। অন্যান্য সব নিম্নরুচিপূর্ণ মনে হবে। নিজস্ব গাড়িও হয়েছে। গাড়িতে ড্রাইভার রাখা হলেও মায়ের নিষেধে বাড়িতে কাজের লোক রাখা হয়নি। মায়ের হাতের রান্নায়ই মা ছেলের আহার চলে। জিনিয়া তাবাসসুম ঘর থেকে বের হলেই গাড়িতে চড়াচড় করেন। নিজে কতটুকু ভোগ করছেন, সেদিকে তিনি এখনো দেখেন না। তবে ছেলের সফলতা দেখে বুক ভরে নিশ্বাস নেন। বাবা হারা ছেলেটার প্রতি রবের সদয় হয়েছে ভেবে শান্তি পান।
.
ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত দেখে বছরখানেক সময় ধরে জিনিয়া তাবাসসুম চাইছেন বিয়ের জন্য পাত্রী দেখবে। এদিকে ইয়ানাতকে পাওয়ার প্রত্যাশায় মিহির তার মাকে আশ্বাস দিয়ে রেখেছিলো,
“তোমার জন্য মিষ্টি বউ নিয়ে আসবো, মা। নিশ্চিন্তে থাকো।”
প্রায় ছয়মাস হলো, মাকে দেওয়া আশ্বাস মিথ্যে হয়ে ফুটে রইলো। মা আজও সকালে জানতে চায়,
“কিরে, কবে নিয়ে আসবি মিষ্টি বউ? বার্ধক্যে নেমে যাচ্ছি যে।”
দুশ্চিন্তায় নত মুখে মিথ্যে হাসি ফুটে তার। জিনিয়া তাবাসসুম ছেলের হাসির প্রেক্ষিতে জিজ্ঞেস করলেন,
“কাউকে পছন্দ করিস? তবে কথা পাকাপাকি করছিস না কেন? উপযুক্ত ছেলে থাকতেও ঘরটা আমার খাঁ খাঁ করে।”
মলিন কণ্ঠে মিহির উত্তর দেয়,
“করতাম মা। তাইতো তোমাকে বলেছিলাম সেদিন।”
“কেন, এখন কি হয়েছে? মেয়ে রাজি না?”
“তার কোনো খোঁজই নেই আমার কাছে। আমার মতো সম্পর্কে জড়িয়ে থাকতে ইন্টারেস্টেড না সে।”
“তুই বলিস কিছু হয়নি। কিন্তু আমি তো তোর চেহারা দেখে আগেই বলেছিলাম কিছু হয়েছে। স্বীকার যাস না তুই। ওসব থাক! ওই মেয়ে রাজি নয় তো কি হয়েছে? দুনিয়াতে মেয়ের অভাব পড়েছে? ঘটক লাগালে মেয়েদের সিরিয়াল পড়বে দেখবি। আমাকে তো কত দিক থেকেই বলছে, ছেলেকে বিয়ে করাবো কি না।”
“বাদ দাও মা। এখন না।”
“আর কবে? বয়স বাড়লে সুন্দর মেয়ে পাওয়া যাবে?”
“ভাগ্যে যে আছে, সে তো আসবেই।”
“তাই বলে চেষ্টা করবো না? ঘরে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে কি ভাগ্য এসে বউ দিয়ে যাবে ঘরে? এই যে তুই এদিক সেদিক চলে যাস। বাড়িতে আমি একা একা থাকি। আমারও তো একটা মনোভীতি আছে। ঘরে একটা মানুষ থাকলেও মনে সাহস লাগে। সময়টা ভালো কাটে। একা একা কি বাস করা যায়? বুঝিস না কেন এখনো?”
“মা, আমার মনমানসিকতা এখন ভালো না। বিয়ের জন্য প্রস্তুত না আমি। হুটহাট মেয়ে পছন্দ করলেই তো হলো না। সময় নেওয়া দরকার। নিজেকে প্রস্তুত করে আমি বলবো তোমাকে।”
“জানি না তোর মন কি বলে। পরে আফসোস করিস বসে বসে। চল, নাস্তা করবি।”
“একটু হেঁটে আসি বাইরে থেকে।”
“নয়টা বাজে। খেয়েই যা।”
“আসছি। দূরে যাবো না। এদিকেই হাঁটবো।”
তৃতীয় তলা থেকে নেমে এলো মিহির। ঘুম থেকে উঠার পর চোখমুখ কেমন টানটান লাগছে। তাই আলোবাতাসের সংস্পর্শে আসার জন্য বেরিয়ে এলো। বাড়ির পাশেই ছোট রাস্তা। রাস্তা ঘেঁষে দোকানপাটে ভরপুর। ডানে একটু এগিয়ে গেলেই বড় রাস্তায় উঠা যায়। বামে একটু এগিয়ে গেলে বাজার পাওয়া যায়। বড় রাস্তা থেকে বাজার পর্যন্ত শুধু বহুতল ভবন চোখে পড়লেও পরের এলাকায় ছোট বড় ঘরের মিশ্রণজাত ঘনবসতি লক্ষ্যনীয়। বাজারের দিকেই হাঁটতে লাগলো মিহির। সচরাচর তার বাজার করা হয় না। ড্রাইভার ভাইকে দিয়ে করায় তার মা। তবে সময় পেলে নিজেও খুব করে। যদিও এমন সময় সীমিতই আসে। যেতে যেতে বাজারের পাশে এক চাচার সাথে দেখা। তাদের বাসার পাশেই এই চাচার বাসা। মিহির দেখে সালাম দিলো। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বলেন,
“কি ব্যাপার, মিহির? তোমাকে তো দেখাই যায় না। বহুদিন পর দেখলাম মনে হয়। এদিকে থাকো না নাকি?”
“এইতো, চাচা। কাজেকর্মে ছুটতে হয় একটু এদিকসেদিক।”
“হ্যাঁ, ওইদিন সাকিল গেলো গাড়িটা তোমার গ্যারেজে রাখার জন্য। ইন্ডিয়া নাকি গেছো, তোমার মা বললো।”
“জ্বি, থেকে এলাম আট দিন।”
“যাক, ভালোই। বড় হও। আরও বড় হও। দিনশেষে খাঁটি মানুষগুলোই সফল হয়। দেখে তো এখন লোকে, কার জোর কতদূর। বাবা হারাইছো তো কি হইছে? আল্লাহই হেফাজতে রাখছে।”
“জ্বি, দোয়া করবেন।”
“হ্যাঁ, দোয়া তো করিই। কোথায় যাও?”
“এইতো, বাজারেই এলাম।”
“আচ্ছা, যাও।”
মিহির সৌজন্যতার সাথে হেসে বিদায় নিয়ে হাঁটতে লাগলো নিজ পথে। নিজ এলাকায় হাঁটতে গেলে কতরকম স্মৃতিই পথের সঙ্গী হয়। মনে পড়ে শৈশবকে, মনে পড়ে কৈশোরকে। বাবার সাথে কত যেতো এইপথে বাজারে। স্কুল কলেজ কিংবা খেলার মাঠ পর্যন্ত যেতে চেনা ছিলো আশপাশের পথঘাটের আনাচে কানাচে৷ কর্মব্যস্ততায় জড়ানোর পর অনেক পরিবর্তনই নেমে এসেছে ডানেবামে। এখন চেনা পথগুলোও যেন অচেনা কিংবা নতুনত্বের ঘ্রাণ ছড়ায়। চলতে চলতে রাস্তার বিপরীত পাশ থেকে হঠাৎ উত্তেজিত মেয়ে কণ্ঠ শুনতে পেলো মিহির।
“সুপারস্টার মিহির! একটু, একটু দাঁড়ান। একটু দাঁড়ান।”
মিহির ওপাশে তাকিয়ে দেখলো একটা বাড়ির গেইটের সামনে থেকে সাদা এপ্রোন পরনে একটা মেয়ে সাথে একটা বাচ্চা ছেলের হাত ধরে বেশ উৎফুল্ল হয়ে যেন তাকে ডাকলো। দ্রুত এপাশে আসার জন্য ছটফটও করতে লাগলো খুব। দুজনের কাঁধেই ব্যাগ। রাস্তায় চলাচলকৃত রিকশার জন্য যেন এপাশে আসতে দেরি হয়ে যাচ্ছে তার। মিহির না চলে যায়, সেই ভয়। কিন্তু মিহির চলে গেলো না। অপেক্ষা করে সুযোগ দিলো তাকে ধীরেসুস্থেই আসার। কিসের আর ধীরেসুস্থে আসা? রিকশা যেতেই বাচ্চাটির হাত ধরে যতটুকু সম্ভব ছুটে এসেছে। উত্তেজনায় যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। বেশ উৎফুল্লতা বিরাজ করছে চোখেমুখে। এই মেয়েটাকে মাসখানেক আগে আরও একবার দেখেছিলো মনে হচ্ছে মিহিরের। ছুটে এসে অটোগ্রাফ নিয়ে গেছে ওই বড় রাস্তায়। সেদিনও এক বন্ধুর সাথে হাঁটতেই বেরিয়েছিলো ওই মূল রাস্তার দিকে। মেয়েটি এসেই এখন উৎফুল্লতার সঙ্গে বললো,
“হাই, আমি রিপ্তি। মনে আছে আমাকে? ওইদিন অটোগ্রাফ নিলাম যে? অবশ্য মনে না থাকারই কথা। অটোগ্রাফ তো কত মানুষই নেয়। যাকগে, আপনি ভালো আছেন?”
মিহির ঈষৎ হাসিমুখে ধীরস্থির গলায় জবাব দেয়,
“জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ। তুমি ভালো আছো?”
মেয়েটি উতলা কণ্ঠেই তার জিজ্ঞাসার উত্তর দেয়,
“অনেক অনেক ভালো।”
“আমার মনে পড়েছে, তুমি ওই মেইন রোডে দেখা করেছিলে না আগেরবার?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি সে-ই। আপনার মনে আছে তবে! আল্লাহ! আপনি ভাবতেও পারবেন না, আমি আপনার কতবড় ফ্যান। আপনার মতো একজন সেলিব্রিটির এলাকায় আমি থাকি, ভাবতেই শিহরিত হয়ে যাই। আজকে আরেকটা অটোগ্রাফ দিবেন, প্লিজ? প্লিজ, প্লিজ…”
“শিওর।”
আহ্লাদিত রিপ্তি ঝটপট ব্যাগ থেকে ডায়েরি আর কলম বের করে আনলো। মিহিরের হাতে দিয়ে ওদিকে আবার আঙুল তাক করে তার বাড়ি দেখালো।
“ওইটা আমাদের বাসা। আমার আব্বু চিনে তো আপনাকে। এটাও জানে, আমি আপনার কত বড় ফ্যান। আমার আম্মুও জানে। আমার ছোট ভাইও জানে। রোহান, বল। চিনিস না উনাকে? আমার রুমে উনার ছবি আছে না অনেকগুলো? বল তিনি কে?”
পাশে থাকা ছোট ভাইকে ঠেলে জিজ্ঞেস করতেই সে ভ্যাবলা ভঙ্গিমায় কচি গলায় জবাব দেয়,
“হ্যাঁ, মিহির দুলাভাই।”
সাথে সাথেই জিভ কেটে ভাইয়ের মুখ চেপে ধরেছে রিপ্তি। সর্বনাশ করেছে! ঘরে তো ক্রাশকে তার কাছে দুলাভাই বলে পরিচিত করাতো, এখানে এসেও যে দুলাভাই ডেকে ফেলবে কল্পনা করেনি সে। এদিকে লেখা রেখে রোহানের মুখের দিকে তাকালো মিহির। পরপরই রিপ্তির দিকে তাকাতেও ভ্যাবাচ্যাকা মুখে হাসলো রিপ্তি। ইতস্ততভাবে কথা কাটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো।
“এইটা না খুব দুষ্টু বাচ্চা। যা পারে তা-ই বলে ফেলে। সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে। তাকেও কি একটা অটোগ্রাফ দিবেন?”
চলবে