গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-১৪

0
470

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১৪.

পরদিন সারাদিন তনয়া স্বরূপের দেখা পেল না বললেই চলে। সে ব্যস্ত রইল নানান কাজে। তনয়ার কাজ নেই, সে নতুন বউ বলে কেউ কিছু ছুঁতে দেয় না। গ্রামে তেমন নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না বলে তনয়ার সময়ও কাটছিল না। দুপুরে খাবার সময় তার পরিচয় হলো স্বরূপের চাচাতো বোন মিতার সাথে। মিতার কলেজে পরীক্ষা ছিল বলে সে গতদিন আসতে পারেনি, আজ সকালে পরীক্ষা দিয়ে চলে এসেছে৷ সে এবার এইচএসসি দেবে। বয়সে ছোটো হলেও খুব মিশুক মেয়েটা তনয়ার সাথে মিশে গেল সহজেই। মিতা ওকে বলল বিকেলের দিকে কাজ না থাকলে তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবে। তনয়া জানাল, সে খুশি হয়ে অপেক্ষা করবে।

স্বরূপ দুপুরে খেতে এলো বেশ দেরিতে। কোনোরকমে খেয়ে আবার বেরিয়ে গেল। তনয়ার সাথে কথা হলো না৷ তনয়া বাইরের ঘরে একটু উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল স্বরূপের সাথে একটু কথা বলার আশায়, কিন্তু স্বরূপ তাকে চেনে না এমন ভান করে চলে গেল। এদিকে তাকিয়েও দেখল না। তনয়ার অভিমান হলো। সে স্বরূপকে বিকেলে বের হবার কথা জানাতে চেয়েছিল, জানানো হলো না। যাকগে, ও নিজের মতো থাকুক৷ তনয়া এমনিতেও সঙ্গী পেয়ে গেছে।

বিকেলের দিকে সত্যিই মিতা চলে এলো। সে-ই বাড়ি থেকে অনুমতি আদায় করল। তারপর দুজন বেরিয়ে পড়ল। তনয়ার পরনে সবুজ রঙের একটা শাড়ি৷ গয়নাগাটি তেমন পরেনি, শুধু হাতে গতকাল শাশুড়ীর দেয়া মোটা বালা আর কানে ঝুমকা। শাড়ির আঁচল দিয়ে সুন্দর করে মাথা ঢেকে বের হলো সে। যে কেউ দেখলে বলবে নতুন বউ।

ওরা যত সামনে যাচ্ছিল তনয়ার তত ভালো লাগছিল। গতকাল গাড়ির ভেতর থেকে সবটা দেখা হয়নি। ছোটো ছোটো ঘর, মাটির চুলা, ঝাঁট দেয়া পরিষ্কার একচিলতে উঠোনের বাড়িগুলো গায়ে গা লাগানো৷ একধারে নেমে যাওয়া দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত। দূরে তালগাছের সারি৷ ছোটোবেলায় যেমন গ্রামের দৃশ্য আঁকত, তেমন হাতে আঁকা চমৎকার একটা গ্রাম৷

তনয়ার অনুরোধে অনেকদূর চলে গেল তারা। একটা বড় পুকুরের ধারে এসে থামল। জায়গাটা নির্জন, পুকুরের চারদিকে গাছপালা আর ঝোপঝাড়ে ভর্তি৷ মানুষজন নেই। মিতা জানাল এখানে দুপুরে মহিলারা গোসল করতে আসে৷ এখন পড়ন্ত বিকেল বলে কেউ নেই। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। ঝিরঝির বাতাসে পুকুরের পানিতে কাঁপন ধরেছে। তনয়া মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মিতা তাকে বলল, “চলো এবার ফিরি।”

তনয়া অনুরোধের দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “একটু থাকি? জায়গাটা এত শান্তির!”

মিতা বলল, “আচ্ছা, কিন্তু বেশি দেরি করা যাবে না৷ সন্ধ্যা হলে বাড়ির সবাই আমাকে খেয়ে ফেলবে।”

সে একটা নিচু গাছের ডাল দেখিয়ে বলল, “চলো এখানে বসি।”

নির্জন জায়গা দেখে বসার পর তনয়া ঘোমটা খুলে ফেলল। চুলের খোঁপাও খুলে দিল। তার ভীষণ সুন্দর রেশমী চুলগুলো মৃদু বাতাসে ঢেউ খেলতে লাগল। ওর শরীর মন জুড়িয়ে যাচ্ছিল। এত শান্তির পরিবেশ উপভোগ করতে ভাগ্য লাগে। তার বারবার বিভূতিভূষণের উপন্যাসের কথা মনে পড়তে লাগল। ‘আরণ্যক’এ এরকম একটা জায়গার কথা ছিল না? সরস্বতী কুন্ডি!

একসময় মিতা উঠে পড়ল৷ “চলো, এরপর অনেক বেশিই দেরি হয়ে যাবে।”

তনয়াও লাফিয়ে নামতে গেল ডাল থেকে। হঠাৎ তার শাড়িতে টান পড়ল। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা হাত ওর কাঁধ ছুঁয়ে গেল। শাড়ির আঁচলটা খসে পড়ল। তনয়া পেছনে ফিরে একজোড়া চকচকে চোখ দেখতে পেল। একটা লোক! মিশমিশে কালো গায়ের রঙ। তনয়ার মনে হলো সে ভূত দেখছে। চিৎকার করে উঠল সে। নিরবতা ভেঙে খানখান হয়ে গেল।

মিতা অন্যদিকে তাকিয়েছিল৷ এসবের কিছুই তার নজরে আসেনি। মাত্র কয়েক মুহূর্তেই সবটা ঘটে গিয়েছিল। সে প্রথম শুনল তনয়ার চিৎকার, তারপর পায়ের নিচে শুকনো পাতার মচমচ শব্দ তুলে দৌড়ে যাওয়া একটা কালো ছায়া।

*****

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। দু’জন একে অপরের হাত ধরে যখন বাড়ি ফিরছিল তখন আশ্চর্য এক নিস্তব্ধতা যেন ঢেকে দিয়েছিল পথঘাট। কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছিল না৷ পুরো গ্রাম কি ঘুমিয়ে গেল? তারা বহুক্ষণ হেঁটেও যেন বাড়ি পৌঁছুতে পারছিল না৷ অবশ্য তারা গিয়েছিল এমন পথ ধরে যেদিক দিয়ে গ্রামের লোকজন কম চলাচল করে।

হয়তো ওদের ভাগ্য কিংবা কোনো অদৃশ্য টানে পথে তাদের সাথে দেখা হওয়া প্রথম ব্যক্তিটি ছিল স্বরূপ৷ প্রথমে সে ভীষণ অবাক হলো। তারপর কাছে এসে মিতাকে জিজ্ঞেস করল, “তোরা এখানে কেন?”

মিতা উত্তর দিতে পারছিল না৷ তনয়া তখনো কাঁপছে। তার চোখ ভেজা। অন্ধকার তখনো পুরোপুরি জেঁকে বসেনি৷ মৃদু আলোয় স্বরূপের চোখে তনয়ার ফ্যাকাসে মুখের ভাব ধরা পড়ে গেল। সে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে তোমার তনয়া?”

স্বরূপ তনয়ার অপর হাতটা ধরল। ওর এক হাত মিতার হতে ধরা ছিল। দু’জন দু’দিকে দিয়ে তাকে ধরে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরল তখন বাড়ির লোক আলো নিয়ে তাদের খুঁজতে বের হতে যাচ্ছে। গমগমে পরিবেশে এসে মিতার ভয় অনেকটা কেটে গেল। তবে বাড়িতে ঢুকেই সবার কাছ থেকে একগাদা বকুনি খেতে হলো তাকে। চুপচাপ শুনে গেল সে৷ একটা শব্দও করল না। তার মুখের ভয়ার্ত ভাবটা কেউ খেয়াল করল না। খেয়াল করলেও তারা ধরে নিত বকা খেয়ে ভয় পেয়েছে মেয়েটা।

স্বরূপ তনয়াকে ঘরে রেখে এসে মিতাকে পাকড়াও করল। “এবার বল, কী হয়েছে?”

মিতা সবটা খুলে বলল তাকে। লোকটাকে সে চিনতে পেরেছিল। এই গ্রামেরই লোক। বখাটে ধরনের। গ্রামের মেয়ে বউদের প্রায়ই উত্যক্ত করে থাকে৷ কিন্তু ওর বাবা ধনী লোক। গ্রামের অনেকেই তার কাছে সুদে টাকা ধার করে, জমি বন্ধক রাখে। কারও সাহস হয় না ওর বিরুদ্ধে কিছু করার৷ লোকটা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

স্বরূপ সব শুনে খুব ঠান্ডা গলায় মিতাকে বলল, “তুই তোর ভাবির কাছে গিয়ে বস। আমি আসছি।”

মিতা তার কথামতো ভাবির ঘরে চলে গেল। সেখানে তনয়া একা নয়, কিছু মহিলা বসে খোশগল্প করা শুরু করে দিয়েছিল। তনয়ার মুখের অনেকটা তখনো ঘোমটায় ঢাকা। কেউ খেয়াল করেনি তার চোখে অল্প করে জল কমছে। হাত মৃদু মৃদু কাঁপছে। মিতা ভাবির পাশে গিয়ে বসে তার হাত শক্ত করে চেপে ধরল।

****

সময় কতটা পেরিয়েছিল তাদের খেয়াল নেই৷ একসময় বাড়ির উঠোনে চিৎকার আর ধস্তাধস্তির শব্দে ভেতর থেকে সবাই বেরিয়ে এলো। উঠোনে মিশমিশে কালো একটা লোককে এনে ফেলা হয়েছে। লোকার শরীর রক্তাক্ত। তার ওপর চড়াও হয়ে থাকা স্বরূপের গাল কেটেও রক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু তার ওপর কোনো অসুর ভর করেছে যেন। শক্ত-সামর্থ্য গ্রাম্য লোকটাকে সে শুইয়ে ফেলে প্রবল আক্রোশে একেকটা ঘুষি বাগিয়ে দিচ্ছে।

কয়েকজন গ্রামের লোক ওদের পিছু পিছু চলে এসেছিল। বাড়ির লোক আর আশেপাশের আরও কিছু লোক এসে ওদের লড়াই থামাল। স্বরূপের কথামতো লোকটাকে বেঁধে ফেলা হলো উঠানের আমগাছের সাথে।

স্বরূপ তখন হাঁপাচ্ছে। ঘাম আর রক্তে তার শার্ট ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। তবে সে বসল না। গ্রামের লোকের প্রশ্নের জবাবে বলল, “ও আমার স্ত্রীকে উত্যক্ত করেছে। ও গ্রামের আরও মহিলাদের জ্বালাতন করে। আপনারা কিছু না বললে সেটা আপনাদের ব্যাপার৷ আমি তো সহ্য করব না এসব।”

তার কথায় অনেকেই সায় দিল। কিছু মহিলা সেখানেই বলে ফেলল সিরাজ তাদের সাথে কী কী করেছে৷

মিশমিশে কালো ভূতের মতো অন্ধকারের সাথে মিশে যেতে চাওয়া সিরাজ নামক লোকটা তখনো কুতকুতে হলদে চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। স্বরূপের ইচ্ছে হলো ওর চোখদুটো অন্ধ করে দিতে।

স্বরূপের ইচ্ছে ছিল সিরাজের প্রথমে বিচার হবে, তারপর তাকে ছাড়া হবে। কিন্তু সেসব কিছু হলো না। সিরাজের বাবা নিজেই এসে সবার কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলেন। ছেলেকে ছেড়ে দেবার জন্য মিনতি করে বলে গেলেন আর কখনে এমন হবে না৷

লোকটার এমন কান্ডের কারন ছিল। স্বরূপের মা এলাকায় কম প্রভাবশালী নন। গ্রামের একমাত্র স্কুলটা তিনিই গড়েছেন। গ্রামে তিনি বাদে বাকি যে ক’জন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন সবাই স্বরূপের মায়ের পক্ষেই থাকবেন। সেক্ষেত্রে ছেলের এবারের দোষ ঢাকার চেষ্টা করলে উল্টো তিনি নিজেই বিপদে পড়তে পারতেন।

স্বরূপের রাগ কমল না। তবুও সে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘরে ঢুকল। তখনো তার গা ভেজা। গায়ে লেগে থাকা রক্তের কতকটা তার, কতকটা সিরাজের। তার মাথা ব্যথা করছিল প্রচন্ড। সারাদিন কাজ করার পর এই ঝক্কিতে কাহিল লাগছিল।

মা তাকে বসিয়ে হাত আর গালের কাটা জায়গা স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলেন। তনয়া তখনো চুপচাপ। এক কোণায় দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিল সে।

স্বরূপ ঘরে গিয়ে জামা বদলে এসে দেখল খাবার বেড়ে ফেলেছেন মা। ওরা একসাথে বসে খেয়ে নিল। তারপর কিছু লোক স্বরূপের সাথে কথা বলতে চাওয়ায় সে বাইরের ঘরে চলে গেল।

তনয়া নিজের ঘরে গেল না। তার প্রচন্ড ভয় করছে। সে শাশুড়ী মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও তার সাথে হাতে হাতে কাজ করল। কাজ শেষে তার ঘরে গিয়ে বসে রইল।

মা বুঝলেন ওর মনের অবস্থা। পাশে বসে সান্ত্বনা দিলেন অনেকক্ষণ। গল্প শোনালেন নিজের। যখন স্বরূপের বাবা মারা গেল তখন তাকেও কম যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি। গ্রামের দুয়েকজন লোক উঠেপড়ে লেগেছিল তাকে বিয়ে করতে। কতকিছু সহ্য করেছেন তিনিই জানেন। তনয়া মাকে জড়িয়ে ধরল এবার। এটা তার মা নয়, স্বরূপের মা। তাতে কিছু যায় আসে না। মায়েদের গায়ে মা মা ঘ্রাণটা থেকেই যায়, সে যার মাই হোক না কেন।

*****

স্বরূপ অনেক রাতে ঘরে ফিরল। তনয়াকে না পেয়ে খুঁজতে গিয়ে দেখল সে মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে বসে আছে। স্বরূপ যেতেই মা তাকে পাঠিয়ে দিলেন৷

শুয়ে পড়ার আগে তনয়া বলল, “আজকে লাইটটা জ্বালানো থাকুক?”

“না তনয়া। আজও লাইট বন্ধ থাকবে। তোমার ভয় কাটাতে হবে। ভয় জিইয়ে রেখে কোনো লাভ নেই। আর আমি আছি তো।”

স্বরূপ বিছানায় এসে তনয়ার হাত ধরল। ও তখনো কাঁপছে। স্বরূপ জড়িয়ে ধরল তাকে। শক্ত করে ধরে রাখল। তনয়া স্বরূপের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বলল, “আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম…ও… ও আমার আঁচল টেনে ফেলে দিয়েছিল…”

স্বরূপ তার মাথা বুকে চেপে বলল, “ভয় নেই। আর কেউ কিছু করবে না তোমার।”

“তুমি থাকবে তো আমার সাথে?”

“হ্যাঁ তনয়া। আমি আর কখনো তোমাকে একা ছাড়ব না। কোনোদিনও না।”

তনয়া কাঁদতে কাঁদতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। স্বরূপ ক্লান্ত ছিল। তার চোখেও ঘুম নেমে এলো একসময়। সে আজ একটু আগে তনয়াকে যে ওয়াদা করেছিল সেটা নিজের অজান্তেই করেছিল। সচেতন মস্তিষ্কে যে ছেলেটা মনপ্রাণে চাইছিল মেয়েটা তার সাথে থেকে আফসোস করে মরে যাক, তাকে সে সারাজীবন কাছে থাকার ভরসা দিত না।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে