গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-১০

0
431

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১০.

পরের স্টেশনে মা চাচীদের সাবধানে বসিয়ে রেখে নেমে পড়ল স্বরূপ। ট্রেনটা ছেড়ে যেতেই ফাঁকা হয়ে গেল স্টেশন৷ শীতের রাত৷ কেউ অপ্রয়োজনে বসে নেই৷ স্বরূপের ভয় করছে। সে স্টেশন থেকে বেরিয়ে গাড়ি খুঁজতে শুরু করল। আজ মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে৷ শুধু সে একা অতৃপ্ত আত্মার মতো ঘুরছে। তনয়া কী করছে কে জানে! নিরাপদ আছে তো?

স্বরূপের মনে হলো কত যুগ পেরিয়ে গেছে! অথচ মাত্র দশ মিনিটই কেটেছে এর মধ্যে৷ শেষ পর্যন্ত সে একটা সিএনজি দেখতে পেল। লোকটা শেষ ট্রিপ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। স্বরূপকে নিতে প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। অনেকটা বুঝিয়ে বলবার পর লোকটার মন নরম হলো। স্বরূপকে তুলে নিয়ে ফাঁকা রাস্তায় সর্বোচ্চ গতিতে ছুঁটে চলল আগের স্টেশনের দিকে৷

স্বরূপ যখন ওয়েটিং রুমে ঢুকছিল, তখন তার বুক ঢিপঢিপ করছে। তনয়াকে পাওয়া যাবে তো? যদি না পাওয়া যায় তবে সে কী করবে? কোথায় খুঁজবে?

এই স্টেশনও অসম্ভব নির্জন। শেষ ট্রেন ছেড়ে গেছে। দুটো কুকুর শুয়ে আছে বাইরে৷ স্বরূপ পায়ে পায়ে ঢুকল ভেতরে। চারদিকে তাকাল। কেউ কোথাও নেই!

স্বরূপ চারদিকটা ভালো করে খুঁজল, ওয়াশরুমগুলো দেখে এলো। কাউকে পেল না। মাথায় হাত দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সেখান থেকে।

না, এখনো ভরসা আছে। হয়তো বাসায় চলে গেছে তনয়া৷ সে তনয়ার মায়ের নাম্বারে ফোন করল।

ঘুম ঘুম কন্ঠে তিনি ফোন তুলে বললেন, “হ্যাঁ বাবা বলো, ঠিকমতো ট্রেনে উঠতে পেরেছ? তনয়া ফোন ধরছে না কেন?”

তনয়ার ফোনটা তখনো স্বরূপের পকেটে। কখন বেজেছে তার কানে যায়নি। সে নিজের গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, “জি মা। ও ঘুমিয়ে গেছে। আপনার কল করা দেখে আমি ভাবলাম জানিয়ে দেই।”

“আচ্ছা বাবা। সাবধানে যেও।”

স্বরূপ ফোন রেখে দিল। বেরিয়ে গিয়ে আরেকটা গাড়ি খুঁজতে লাগল। সিএনজিটা চলে গেছে তখনই। হঠাৎ অন্ধকার একটা কোণ থেকে শব্দ শুনতে পেয়ে ফিরে তাকাল সে। এগিয়ে গেল সেদিকে। একটা সিগারেটের আলো সেদিকেই ঘোরাফেরা করছে৷ স্বরূপের মনটা কু ডেকে উঠল। সে জোর গলায় ডাকল, “তনয়া…তুমি ওখানে?”

তনয়া চিৎকার করে কেঁদে উঠল। সিগারেটের আলোটা সেকেন্ডের জন্য স্থির থেকে একদিকে ছুটে চলল। লোকটা পালিয়েছে।

স্বরূপ দৌড়ে গেল সেদিকে। অন্ধকার থেকে একটা অবয়ব ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকে। তনয়া কাঁপছে থরথর করে৷ কাঁদছে পাগলের মতো।

বেশ কিছুটা সময় লাগল তার স্বাভাবিক হতে। তাকে নিয়ে ওয়েটিং রুমে আলোতে গিয়ে বসল স্বরূপ। কিছুটা স্থির হয়ে এলে তনয়া জানাল কী হয়েছিল।

সে এক বাচ্চার মায়ের ব্যাগ পাহারা দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন জেগেছে, তখন স্টেশনে হুড়োহুড়ি লেগে গেছে। ট্রেন চলে এসেছে। সে ছুটে গেছে বাড়ির লোকেরা যেখানে ছিল সেখানে। কিন্তু কাউকে পায়নি৷ এরপর ট্রেনের কাছে গিয়ে খুঁজতে শুরু করেছে। এত বড় ট্রেনের কোথায় খুঁজবে, ট্রেনের কত নম্বর বগিতে তারা উঠেছে কিছুই সে জানত না। এরপর যখন ট্রেন চলতে শুরু করেছে, তখন একটা বগিতে উঠে পড়েছিল। কিন্তু বখাটে ধরনের কিছু লোককে দেখে ভয় পেয়ে আবার নেমে পড়েছে। ট্রেন চলে যাবার পরেই স্টেশন ফাঁকা হয়ে গেছে। তারপর থেকেই একটা লোক তার আশেপাশে ঘুরছে। লোকটার চোখ ফাঁকি দিতেই সে বাইরে অন্ধকারে গিয়ে লুকিয়েছিল। কিন্তু লোকটা তাকে খুঁজে পেয়ে গিয়েছিল৷ আর একটু দেরি হলেই সর্বনাশ হয়ে যেত।

কথাটা বলতে বলতে আবারও কেঁপে উঠল তনয়া। ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। স্বরূপ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল৷ একটু আগে তনয়ার ওপর রাগ হচ্ছিল তার। এখন রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। সে কী করে ভুলে গেল নতুন বউয়ের কথা! মনটা ছোটো হয়ে গেল স্বরূপের। সে কি এতই খারাপ লোক? তার আজ মনে হলো, তনয়া মেয়েটা ভালো। ভালো বলেই এখনো তার ওপর ভরসা করে তাকে জড়িয়ে আছে৷

*******

বেশ কিছুটা হাঁটার পর একটা চায়ের দোকান পাওয়া গেল। ঝাঁপ অর্ধেক খোলা। রাতের খাবার তারা খেয়ে বের হয়নি। ট্রেনে খাবার জন্য হাবিজাবি অনেক কিছু সারাদিন ধরে বানিয়ে সাথে নিয়ে নিয়েছেন মা। এখন সেসব তাদের সাথে ট্রেনে যাচ্ছে। তনয়া আর স্বরূপের খিদেয় পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। এতটা উত্তেজনার পর খিদেটা আর বশে আসতে চাইছে না৷

চায়ের দোকানে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। দুটো কলা আর দুই কাপ চা খেয়ে তারা আবার সামনের পথ ধরল। ট্রেন ধরতে হলে দ্রুতগামী কোনো যান ধরতে হবে। আর নয়তো ভেঙে ভেঙে যেতে হবে। সকালের অপেক্ষা করার চেয়ে এখন যতটা এগিয়ে থাকা যায় ততই ভালো।

তনয়ার শীত করছে। তার গায়ে পাতলা একটা চাদর ছিল, সেটা কোথায় পড়ে গেছে সে জানেও না। স্বরূপের গায়ে কোট আছে। তনয়ার কয়েকবার ইচ্ছে হলো সেটা চাইতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর চেয়ে উঠতে পারল না। স্বরূপেরও তো শীত লাগবে ওটা দিয়ে দিলে।

কিছুদূর যাবার পর বাসস্ট্যান্ডে এসে পড়ল তারা। একটা বাস মাত্রই ছাড়তে যাচ্ছিল। টিকিট ছাড়া কিছুতেই তারা নেবে না তাদের। স্বরূপ অনেক অনুরোধ করে বেশি টাকা দিয়ে বাসে উঠে পড়ল। বাসের সব সিট ভর্তি। রাতের যাত্রীরা ঘুমিয়ে আছে। সামনের ছোটো একটা সিটে তনয়াকে বসিয়ে দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইল স্বরূপ। বাসটা চলতে লাগল দ্রুত গতিতে। তনয়া স্বরূপের একটা হাত ধরে বসে রইল। তার কাছে সবকিছু কেমন যেন অ্যাডভেঞ্চারের মতো মনে হচ্ছে। আহা! এরকম একা রাত যেন স্বপ্নের মতো! ভালোবাসার মানুষটার সাথে অজানার পথে বেরিয়ে পড়া!

স্বরূপ এদিকে বিরক্ত হয়ে আছে। তনয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সে। মেয়েটা অল্প অল্প হাসছে। হাসির কী আছে এখানে? এই মেয়ে তার কপালে শনি বয়ে এনেছে। নইলে এই মাঝরাতে খিদে পেটে বাসে ঝুলে ঝুলে যেতে হয়?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে