#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব – ০৯
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি
পরেরদিন কোচিং ক্লাসে পৌঁছেই ইমরানকে খুঁজতে লাগলাম । ক্লাসে একেবারে শেষ মাথায় বসেছে সে। তুলি বসেছে তৃতীয় বেঞ্চে । আমি ক্লাসে ঢুকেই সরাসরি শেষের দিকের বেঞ্চে বসলাম। পাশের মেয়েটি খুব মনোযোগ দিয়ে স্যারের লেকচার শুনছে। আর আমি রাগে, দুঃখে ফুঁসছি । একে তো নিশান ভাইয়ের উপর প্রচণ্ড রাগ তার উপর এই ইমরানের উপর প্রচণ্ড বিরক্ত হচ্ছি । সে আমাকে ডাকতে গেলো কিন্তু একা একাই চলে আসলো। আমি তো বলেছিলাম পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে । কিন্তু সে কী করল! একা একা সাগর পাড়ি দিলো! আমি আর কথাই বলবো না ভাবছি । কী দরকার এমন বন্ধুত্বের!
আরে ধুর! এসব কী ভাবছি আমি। এসব দিগ্বিদিক ভাবনার জালে হাতড়াতে হাতড়াতেই ক্লাস শেষ হয়ে গেলো। স্যার যাওয়ার আগে অবশ্য বলে গেলেন যে কিছু দিনের মধ্যেই আমাদের টেস্ট পরীক্ষা নেওয়া হবে। কোচিং এ টেস্ট এক্সাম নিবে অথচ আমার পরীক্ষার পড়ার মধ্যে কিচ্ছু পড়া হয়নি। আমার যে কী পরিমাণ কষ্ট হচ্ছিল তা বলে বুঝানো যাবে না!
ক্লাস শেষ হতেই বাইরে বেরিয়ে গেল সবাই। আমি ঠায় বসে রইলাম আমার বেঞ্চটাতে। আমার কেন যেন কিছুই ভালো লাগছে না। মনের মধ্যে কী চলছে কে জানে! কিছুই বুঝতে পারছি না। কেমন যেন উদাস উদাস মনে হচ্ছে নিজেকে।
‘কী ভাবছিস?’ তুলির কণ্ঠ শুনে তার দিকে মুখ তুলে তাকালাম ।
আসলেই তো কী ভাবছিলাম! ভাবছিলাম কিন্তু কী তা তো বুঝতেই পারছি না! ঢাকায় আসার পর থেকেই আমার ভাবুক হওয়ার প্রবণতা ঢের বেড়েছে। কোনো উত্তর না দেওয়াতে তুলি আমার ডান হাতটা আঁকড়ে ধরে নাড়া দিয়ে বলল,’কোনো কারণে কী আপসেট তুই?’
আমি চটজলদি উত্তর দিলাম, ‘ আপসেট! আর আমি? নাহ্ ….একদম না।’
‘তাহলে তোকে এত বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেনো? গতকালও এরকম দেখাচ্ছিল।’
আমি প্রলম্বিত এক শ্বাস নিলাম।।তারপর ক্লান্ত গলায় বললাম,’এমনিতেই হয়তো!’
‘গতকাল এত দেরি হলো কেন তোর?’ ইমরানের সরাসরি প্রশ্নে আমার রাগ বেড়ে দ্বিগুণ হলো।
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে অন্য পাশে তাকিয়ে রইলাম।
ইমরান এবার উঁচু গলায় বলল,’কী ব্যাপার? আমার কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?’
আমি এবার নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বললাম,’এখানে কী? তুই এখানে কেন? তোর সাথে আমার কোনো কথা নাই। যা তুই ।আমার চোখের সামনে থেকে যা।’
ইমরান অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার চোখে চোখ রেখে ম্লান হেসে বলল,’আরেব্বাহ্! আমি কী করলাম?’
ইমরানের হাসি দেখে আমার রাগ আরও বেড়ে গেল। তাই চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, ‘নাহ্। তুই তো কিছুই করিসনি। সব আমিই করসি।’
ইমরান এবার আমার দিকে আরো কয়েক কদম কাছে এসে বলল,’রাগ করার কথা আমার আর রাগ করছিস তুই! কী আশ্চর্য!’
তুলি আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের দুজনের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছিল। এক পর্যায়ে সে বলল,’ এবার থামবি তোরা? কী হয়েছে আমাকে খুলে বল।’
আমি তুলির দিকে তাকালাম। তারপর সরাসরি প্রশ্ন করলাম ইমরানকে,’গতকাল তুই আমাকে ফেলে চলে আসলি কেন?’
‘দেখ, নিশান ভাই ..!’
নিশান ভাইয়ের নাম শুনে মেজাজটা আবারও বিগড়ে গেল । আমি আমার ডান হাতটা তুলে বললাম,’থাম , আর কিছু বলতে হবে না। আমাদের মধ্যে নিশান ভাই আসলো কীভাবে? নিশান ভাইয়ের নাম আমার সামনে নিবি না।’
আমি এবার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে একাই বেরিয়ে গেলাম। ইমরান আর তুলি দৌড়ে এসে আমাকে ধরলো। তুলি আমার বাম হাতটা খামচে ধরে বলল,’ দোস্ত চল না আজ ফুচকা খাই। তোরে তো রাজীই করাইতে পারি না। চল আজ খাই।’
‘আজ মুড নাই।’ আমি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললাম।
‘মুড নাই তো কী হইসে? মুড বানাবি!’
‘মন ভালো না।’
‘দোস্ত ওই যে সামনের দোকানের ফুচকা খাইলে মন ,প্রাণ সব ভালো হয়ে যায় । তুই আমার কথা শুনেই দেখ একবার।’ তুলি একটু থেমে মুখে এক বিশেষ ভঙ্গি এনে আবার বলল,’আমার পেটে যে কেমন গুড় গুড় শব্দ হইতেসে! তুই শুনতে পাচ্ছিস?’
‘হ, দোস্ত। লাগতেসে তুই আজ সকাল থেইকা অভুক্ত ।’ ইমরান সহাস্যে বলল।
তুলি এবার মুখ বিস্তৃত করে মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই বলল,’হ, দোস্ত । খালি তুই বুঝলি। আর কেউ তো বুঝে না।’
আমি তুলি আর ইমরানের কথায় হেসে ফেললাম। তারপর বললাম,’আচ্ছা, চল।’ আমাদের বন্ধুত্বের বয়সটা খুব বেশি না হলেও এই অল্পদিনে আমাদের ভরসার জায়গাটা খুব গভীর হয়ে গিয়েছে। তাই তুলি আর ইমরানের সাথে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারি না।
বেশ কিছুদিন পর আমি আর নেহা রাতে ছাদে বসে রাতের আকাশ দেখছিলাম। নেহা এক প্রকার জোর করেই নিয়ে গেল। তার মতে আজ আকাশে তারার মেলা সঙ্গে আছে থালার মতো আলো ছড়ানো পূর্ণিমার চাঁদ। ছোটবেলা থেকেই তারা ভর্তি আকাশ আমার খুব ভালো লাগে। তাই দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। তাছাড়া এমন সময়ে ছাদে বা উঠোনে সকলে মিলে আড্ডা দেবার মজাটাই আলাদা। খুব মিস করি ছোটোবেলার সময়গুলোকে। ইচ্ছে করে ফিরে যাই আবার সেই সময়গুলোতে।
নেহা খুব ভালো গান গাইতে পারে । তাই সে গান গেয়েই চলেছে একটার পর একটা। আমারও শুনতে ভালোই লাগছে। একটু পর গিটারের টুং টাং শব্দে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম নিশান ভাই তার গিটার নিয়ে ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর চোখ বুজে বাজাচ্ছে গিটার। আকাশের ভরা পূর্ণিমার আলোতে তার মুখখানা আমার কাছে বড়ই কমনীয় মনে হলো। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে আরো ভালো লাগছে তাকে। আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তার দিকে। গিটারের শব্দের বন্ধ হওয়ার পর আমার খেয়াল হলো গিটার বাজানো বন্ধ হয়ে গেছে। এবার আমার চোখ মিললো তার গভীর অথচ অশান্ত চোখ জোড়ার সাথে। কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক তাকিয়েই ছিলাম হয়তো। বুকের মাঝে ধক করে উঠল হঠাৎ । দ্রিম দ্রিম শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আচমকা আমার ভয় লাগতে শুরু করল যে ওই শব্দ যদি তার কান অবধি পৌঁছে যায়! আমি তৎক্ষনাত সিদ্ধান্ত নিলাম ছাদ ছেড়ে নিজের রুমে চলে যাওয়ার। কিন্তু যেই নিজের জায়গা থেকে উঠতে যাব নেহা আমার ডান হাতটা টেনে ধরলো। বলল,’স্মৃতিপু আজ রাতে একটা বাজার আগে কোনো ঘুম যাওয়া যাওয়া হবে না।’
আমি অপারগ হয়ে বসে রইলাম। রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় রাস্তায় পড়ন্ত ছায়ার পানে তাকিয়ে দেখছি। কেমন যেন মনে হতে লাগলো! নিশান ভাইয়ের দিকে তাকাতেই পারছিলাম না। এমন কেন হচ্ছিল সেটাও বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, আমি কি কোনোভাবে নিশান ভাইকে ..!
না তা কী করে সম্ভব! তুলির কাছে শুনেছিলাম ভালোবাসলে বুকের ভিতর দ্রিম দ্রিম শব্দ হয়। ভালোবাসার মানুষটিকে দেখলে বুকটা ধক করে উঠে। আবার না দেখলে মনটা কেমন যেন আনচান করতে থাকে।
কই আমার তো এমন হয় না। না কি হয়? ধুর আমার এসব কেন হবে এই রাক্ষসটার জন্য? শুধু দেখলেই কেমন যেন দ্রিম দ্রিম শব্দ শুনতে পাই । আর হঠাৎ করে সামনে এলে বুকটা ধক করে উঠে। হঠাৎ করে দেখলে এমন ধক করে উঠা তো স্বাভাবিক! তাই নয় কি?
‘কী ভাবছিস এতো?’ নিশান ভাইয়ের শান্ত স্বরে করা প্রশ্নে আমি তার দিকে মুখ তুলে তাকালাম।
আমার খুব কাছাকাছি এসে বসেছে নিশান ভাই । আমি কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন নির্বাক হয়ে গেলাম । নিশান ভাইয়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর আমি দিতে পারলাম না। শুধু নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলাম ওই গভীর কালো বর্ণের চোখের দিকে।
চেতনা ফিরে পেতেই আমি কয়েকবার এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখি নেহা আপন মনে বসে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছে। তার কোনো ধ্যানই নেই আমাদের দিকে। এই মেয়েটা যে কী ! আমি একদম বুঝতে পারি না।
‘চিন্তার চেইনটা মাঝেমধ্যে টেনে ধরিস। নয়তো তোকে কবে কোথায় নিয়ে যায় কে জানে!’ নিশান ভাই আমার মাথায় চাটি মেরে বলল।
আমি কোনোমতে বললাম, ‘ কই কিছু ভাবছি না তো!’
‘অনেক রাত হয়ে গেছে । এবার ঘুমুতে যা।’
আমি রাগ করে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললাম,’তুমি সবসময়ই এরকম করো। প্রশ্ন এড়িয়ে যাও।’
নিশান ভাই কোনো উত্তর দিল না। রাগও দেখলাম না তার দুচোখে। কেমন যেন ক্লান্ত, শ্রান্ত অথচ স্মিত লেগে থাকা মুখটাকে আজ খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। তবে আমি জানি নিশান ভাই খুব ভালো। হঠাৎ তার জন্য কেমন যেন মায়া হলো।
চলবে…ইন শা আল্লাহ্
আগের পর্বের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/947592489004804/