#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব – ০৮
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি
ব্যস্ততা যেনো শীতের রাতের কুয়াশার মতো জেঁকে বসেছে আমার জীবনে। পড়া আর পড়া। কোচিং করতে হয়। তারপর আবার গ্রুপ স্টাডি করো। একদম হাঁপিয়ে উঠেছি। ইমরান, তুলি আর আমি মিলে এখন রেগুলারই গ্রুপ স্টাডি করছি। কখনো ইমরানের বাসায় তো কখনো ফুফুর বাসায় । তুলির বাসায় স্টাডি করার সুযোগ নেই। তাই তুলি এসে আমাদের সাথে যোগ দেয়।
অ্যাকাউন্টিং করতে আমার ভালোই লাগে। তবে মাঝে মাঝে চরম বিরক্তি এসে যায় । খাতার মধ্যে ঘর আঁকো তারপর অঙ্ক করো। তাই মাঝে মধ্যে কোনোপ্রকার আঁকা আঁকি ছাড়াই অঙ্ক কষে ফেলি। সময় বাঁচানোর ধান্দা সব। একটু যদি ঘুরতে না পারি, আরাম করতে না পারি, পরিবেশ আর প্রকৃতির সৌন্দর্য যদি অবলোকন করতেই না পারি তাহলে কি জীবনের কোনো মানে হয়! রাঙ্গামাটিতে থাকতে আমি তো প্রতিদিন বাগানে গিয়ে হাঁটা হাঁটি করতাম । আমার গাছগুলোতে পানি দিতাম। নতুন নতুন গাছ লাগাতাম। মাঝে মধ্যে বন্ধুদের নিয়ে নদীর তীরে হাঁটতে যেতাম। নৌকায় চড়তাম। আর এখন! পুরাই চার দেয়ালে বদ্ধ জীবন! এখন বুঝতে পারছি বাবার কেন এখানে দম বন্ধ হয়ে আসে? আমারও দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমাকে কেউ কোথাও ঘুরতেও তো নিয়ে যায় না! এরা কি আমাকে দেখাবে না এদের ঢাকা শহরটা! থাক আমি নিজেই দেখব। ইমরান আর তুলিকে সাথে নিলে তো আমি দিব্যি ঘুরে বেড়াতে পারব। বেশি দূরে কোথাও হয়তো যেতে পারব না আপাতত, তবে কাছের জায়গাগুলোতে যাওয়াই যায় ।
তাছাড়া এখন যদি ফুফুকে বলি বেড়াতে যাওয়ার কথা তাহলে বলবে, পরীক্ষা শেষ হোক তারপর আমরা সবাই মিলে যাব।
আমার কাছে একেবারে অসহ্য লাগে। পরীক্ষা বলে কি আমি সব কাজ ছেড়ে দেব! খাবার খাওয়া, ঘুমানো এসব তো ছাড়িনি। মন বলে যে একটা কিছু আছে তা মানুষ এখন ভুলতে বসেছে। আর মনেরও রিফ্রেশমেন্ট দরকার তা তো এক এলিয়েনের ধরায় এসে প্রাত্যহিক জীবনযাপন করার মতো এক ব্যাপার।
আমি ঠিক করেছি আমি যখন বিয়ে করব তখন আমার বাচ্চাদের নিয়ে প্রতি সপ্তাহে ঘুরতে যাব। প্রতিদিন ওদের মাইন্ড রিফ্রেশমেন্টের ব্যবস্থা করব। ওদেরকে পড়ালেখা করার ব্যাপারে কখনো কোনো চাপ দেব না। ওদেরকে ওদের ইচ্ছেমতো একটা লাইফ লিড করার স্বাধীনতা দেব।
মোবাইলের তারস্বরে বাজার শব্দে আমার ঘোর কাটলো। টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা নিয়ে দেখলাম ইমরান কল করেছে। আমি রিসিভ করা মাত্রই ওপাশ থেকে ইমরানের তিরিক্ষি মেজাজের মুখ বর্ষিত শব্দের ঝংকার কানে এলো।
‘এতো দেরি কেন হচ্ছে আজ? আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছে পা দুটো খসে পড়বে!’
আমি দ্রুত চোখ রাখলাম দেয়াল ঘড়িটার দিকে। দেখলাম ঘড়িতে ৩ টা ৪৫ মিনিট। আমি দ্রুত ইমরানকে বললাম,’ওয়েট, আই এম জাস্ট কামিং উয়িদিন ফাইভ মিনিটস্।’
‘ইটস্ অলরেডি গেটিং লেইট।জাস্ট মেইক ইট ফাস্ট।’ ইমরান রাগান্বিত কণ্ঠে বলল ।
‘ওকে। প্লিজ ,জাস্ট ওয়েট।’
আমি দ্রুত রেডি হয়ে নিচে নেমে এলাম। নিচে এসেই দেখলাম ইমরানের কোনো হদিস নেই। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মোবাইলটাও রুমে ফেলে আসলাম। তাই মোবাইলের চিন্তা বাদ দিয়ে রিকশা খুঁজতে লাগলাম। রিকশা ডাকতে গিয়ে খেয়াল করলাম নিশান ভাই তার কারটা নিয়ে আমার সামনাসামনি থামাল। কাচের গ্লাস নামিয়ে বলল,’ গাড়িতে ওঠ।’
আমি তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। একটু হেঁটে বাম পাশে এসে আবারও রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। নিশান ভাই তখন গাড়ি থেকে বেরিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল । তারপর বলল,’কি ,কথা কানে যায় না?’
‘আমি যাব না তোমার সাথে। আমি এক্ষুণি রিকশা নিব।’
নিশান ভাই বলল,’আমাকে কি চাকর পাইছিস? তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বস।’
আমি তারপরেও তার কথায় নড়লাম না। অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ নিশান ভাই আমার ডান হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গেল গাড়ির দিকে। আমার মেজাজ বিগড়ে গেলো। আমি রাগান্বিত কণ্ঠে বললাম,’হাত ছাড়ো। আমি কি বলেছি তোমার সাথে যাব?’
‘তা বলবি কেন? তুই তো ইমরানের সাথে যাবি!’ নিশান ভাই হিসহিসিয়ে বলল।
আমার রাগ এবার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। আমি নিশান ভাইয়ের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত একটা রিকশা নিয়ে কোচিং এর জন্য রওনা দিলাম। আমি জানি নিশান ভাই এখন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। থাকুক। তাতে আমার কী?
কোচিং ক্লাসে আজ কোনোভাবেই মনোযোগ দিতে পারছি না। খালি নিশান ভাইয়ের অদ্ভুত সব কথাবার্তা মনে পড়ছে। কখনো কখনো খুব রাগ হয়। আবার কখনো কখনো মনে হয় নিশান ভাই এমন কেন করে! একটু ভালো আচরণ করলে তার কি খুব বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে?
আমি জানি এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই । হঠাৎ আমার মনে পড়ল নিশান ভাইয়ের রুমের দেয়ালে ঝোলানো আমাদের সেই ছোটোবেলায় তোলা ছবিটার কথা। তখন আমার মনে একটা প্রশ্নই উঁকি দিচ্ছিল, যে মানুষটা আমাকে সহ্যই করতে পারে না তার রুমের একটা ওয়াল জুড়ে আমার ছবি! কীভাবে ঠাঁই পেলাম আমি ! ওই ছবিতে তো নিশান ভাই নিজেও আছে।শুধুই কি তাই নিশান ভাই ওই ছবিটা রেখেছে নিজের ঘরে? নাকি অন্যকিছু?
আমি এবার নিজের মাথায় নিজেই চাপড় মেরে বললাম,’ অন্য কোনো কারণ আর কীই বা হতে পারে? হয়তো ওই ছবিটা তার খুব প্রিয়! হয়তো এতই বেশি প্রিয় যে আমাকেও খানিক সহ্য করে নিলো।’
তুলির চিমটি কাটার কারণে আমি উফ্ শব্দ করে ওর দিকে তাকালাম। সে আমাকে ঈশারা করে বলল যে স্যার আমার দিকেই নজর দিচ্ছেন। আমি দ্রুত মনোযোগী হওয়ার ভান করলাম। ভাগ্যিস তুলি সঠিক সময়ে আমাকে চিমটি কাটলো নয়তো স্যার যে কী না কী বলত কে জানে! আর স্যার নিশ্চিত আমাকে পাগল ভাবছে। যে নিজে নিজে কথা বলে তাকে তো পাগলই বলবে! তবে স্যার যে কিছু বলেনি, সেটাই অনেক।
কিন্তু আমি সত্যিই বুঝতে পারি না ,নিজে নিজে কথা বললে মানুষ কেন পাগল বলে! কেমন উদ্ভট মনে হয় বিষয়টা আমার কাছে। নিজের প্রাইভেসি বলতে কি কিছু নেই ? আমার তো দম বন্ধ হয়ে যাবে যদি আমি নিজের সাথে নিজে কথা বলতে না পারি। ইমরান অপেক্ষা না করাতে তার উপর আমার প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল । তাই তার সাথে কোনো কথাই বলিনি। অবশ্য কথা বলার কোনো সুযোগই হয়নি।
চলবে…ইন শা আল্লাহ্
আগের পর্বের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/946851889078864/