#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব – ২১ (শেষ পর্ব)
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি
সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিশান ভাইয়ের ঘুমন্ত, স্নিগ্ধ চেহারা দেখলাম। তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে । আহা! চুলগুলো। আমি তার ঘুমন্ত চেহারার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছি। আমার ভীষণ ইচ্ছে হলো তার চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে। যেই ভাবনা সেই কাজ। আমি তার প্রিয় চুলগুলোতে আমার হাত বুলিয়ে দিলাম। অমনি সে আমার হাতটা ধরে ফেলল। তারপর হাতটা চেপে ধরে ভ্রু উঁচিয়ে জড়ানো গলায় বলল,’কী! লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা হচ্ছে? আমার চুলে হাত দিয়েছিস কেন?’
আমি তৎক্ষনাত কিছু খুঁজে না পেয়ে হাসতে হাসতে বললাম, ‘তোমার মাথায় একটা মাকড়সা হাঁটছে। সেটাকে সরানোর চেষ্টা করছিলাম।’
‘মিথ্যা যখন বলতে পারিস না তখন বলার চেষ্টা কেন করিস?’ নিশান ভাই প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল।
‘কে বলল আমি মিথ্যা বলেছি? একদম সত্য কথা বলেছি।’ আমি হাসি চেপে দৃঢ় কণ্ঠে বললাম।
তারপর নিশান ভাই চুপিচুপি আমার রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। আমি ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলাম। তবে আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি যে আমার জন্য অনেক বড় ধরনের অপমান অপেক্ষা করছিল।
ফুফা মুখ ভার করে ড্রয়িং রুমে বসে আছেন। আমি নিচে নামা মাত্রই আমাকে ডাকলেন । আমার হঠাৎ খুব ভয় লাগতে শুরু করল। আমার হাঁটু কাঁপছে । মনের মধ্যে শঙ্কার দামামা বেজে উঠল। ফুফা কি কোনো কিছু জেনে গেছেন আমার আর নিশান ভাইয়ের সম্পর্কে? কোনো রকমে হেঁটে তার সামনের সোফাতে বসলাম। ফুফা আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। আমি বার কয়েক ঢোক গিললাম। খুব তেষ্টা পেলো আমার । কিন্তু এখন পানি খাবার উপযুক্ত সময় নয়। আমি ভূতগ্রস্তের মতো বসে আছি ফুফার সামনে। হঠাৎ খুব শান্ত অথচ গম্ভীর একটা কণ্ঠস্বর আমার কানে বাজলো।
‘তুমি এখানে কতদিন যাবৎ আছো? ভুলবশত এটাকে কি নিজের বাবার বাসা ভেবেছ?’
আমি চমকে উঠলাম এমন প্রশ্ন শুনে। মাথা তুলে তাকালাম ফুফার দিকে । ফুফার ঠিক পিছনে অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন ফুফু। তাকে খুব অসহায় দেখাচ্ছে । মনে হচ্ছে তার ইচ্ছার বিপরীতে অনেক বড় কিছু ঘটতে চলেছে। কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারছেন না।
‘চুপ করে আছ কেনো?’ ফুফা ধমকের স্বরে চিৎকার করে বললেন।
আমি কোনোরকমে তার দিকে তাকালাম। কিছু বলতে নিতেই নিশান ভাই আমাকে বাধা দিল। বলল,’ স্মৃতি এখন থেকে এই বাসাতেই থাকবে। সব সময়ের জন্য।’
ফুফা তার কথা না শুনার ভান করে পুনরায় বললেন, ‘তোমার বাবা কি কোনো প্রকার শিষ্টাচার শেখায়নি তোমাকে?’ খানিক থেমেই আবার বললেন, ‘তোমার সাথে নিশানের সম্পর্ক কি?
আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম ফুফা কী বুঝাতে চাইছেন! আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। প্রচণ্ড আত্মসম্মানে লাগছিল। শেষমেশ বাবাকে তুলে কথা বলছে! কিন্তু কী উত্তর দিব তাও বুঝতে পারছিলাম না! নিশান ভাইয়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম। সে বলল, ‘আব্বু তুমি ভুল বুঝেছ। আমাকে একটু সময় দাও, আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলছি।’
ফুফা ডান হাত তুলে আবারও নিশান ভাইকে থামিয়ে দিলেন। গমগমে গলায় বললেন, ‘তোমার সাথে পরে কথা হবে। এখন যার সাথে কথা বলছি সে ছাড়া অন্যকারও কাছে কোনো উত্তর চাইছি না।’
এত্ত অপমানের পর আমার চোখ ফেটে কান্না চলে এলো। আমার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু বিনা অনুমতিতেই গড়িয়ে পড়ল। নিশান ভাই হয়তো তা দেখেছে । সে তৎক্ষনাত গড়গড় করে বলল, ‘আমার আর স্মৃতির বিয়ে হয়ে গেছে আব্বু । তুমি শুধু শুধু ওকে ভুল বুঝছ। আমি নিজের ইচ্ছেতেই ওকে বিয়ে করেছি।’
ফুফা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন নিশান ভাইয়ের দিকে। বজ্রকণ্ঠে বললেন, ‘আমি যে তোমার বাবা সেটা কি ভুলে গেছ? আমাদের না জানিয়ে, আমাদের মতামত না নিয়ে তুমি বিয়ে করলেই বা কি করে? তোমার আম্মু আর আমি কি মরে গিয়েছিলাম?’
নিশান ভাইকে খুব বিভ্রান্ত দেখাল। অসহায়বোধ তার চোখে মুখে স্পষ্ট ছিল। পরক্ষণেই আবার নিজেকে সামলে নিয়ে পুরো ঘটনা বললেন। সব জানার পর ফুফুর দিকে তাকিয়ে ফুফা বললেন, ‘নীলা, তোমার ভাই যে এত লোভী, তা আমার জানা ছিল না।’ আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘এভাবে নিজের মেয়েকে লেলিয়ে দিতে পারে তা তো ছিল অকল্পনীয়!’
আমার তখন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। এমন কথা শুনার আগে মৃত্যু শ্রেয়। আমি দৌড়ে চলে আসলাম নিজের রুমে । রুম থেকেই শুনছিলাম ফুফা বলছেন তিনি আমাদের বিয়ে মানেন না আর কখনোই মানবেনও না। নিশান ভাইকে তার পছন্দের পাত্রীর সাথেই বিয়ে দিবেন। নিশান ভাইয়ের সাথে অনেক বাকবিতণ্ডা হলো। কিন্তু ফলাফল ছিল শূন্য।
এর পরের ঘটনা ঘটেছে খুব দ্রুত। আমার প্রচণ্ড অভিমান হলো নিশান ভাইয়ের উপর। কেন সে জানালো না আমাদের বিয়ের কথা। আগে থেকে জানলে নিশ্চয়ই এমনভাবে আমাকে অপমানিত হতে হতো না। আমার বাবাকেও অপমানিত হতে হতো না। ঠিক করলাম আমি চলে যাব। কিন্তু যাবই বা কোথায়? শেষমেশ নিশান ভাইকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অজানার উদ্দেশ্যে । হয়তো কোনো এক নতুন ঠিকানা খোঁজার উদ্দেশ্য নিয়ে । কিন্তু এমন অচেনা , অপরিচিত শহরে কি এত সোজা নতুন ঠিকানা পাওয়া? শেষমেশ তুলির কাছে গেলাম। কোনো প্রকার জবাবদিহি ব্যতিরেকেই তার পরিবার আমাকে আশ্রয় দিল। কিন্তু এভাবে অন্যকারো বাসাতে আর কতদিন! তারপরেও ওদের বাহাতেই কাটাতে হলো প্রায় তিন মাস! নিশান ভাই এখানেও খুঁজতে এসেছিলেন কিন্তু আমি দেখা করিনি। আমি চাইনি আমার জন্য সে নিজের বাবা-মায়ের কাছ থেকে আলদা হোক।
‘এর পরের সব ঘটনাই তো আপনার জানা!’ আমি রাহাত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম।
রাহাত ভাই মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘হুম, সেদিন তুমি কলেজে যাচ্ছিলে একা। আর পথিমধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেল। কো-ইন্সিডেন্টলি আমি সেই মুহূর্তেই ওই রাস্তা দিয়ে চেম্বারে যাচ্ছিলাম। আর জটলা দেখে আমি গাড়ি থামিয়ে ভিড় ঠেলে ঢুকতেই তোমার মুখ দেখে আমার চোখ ছানাবড়া। এরপর হাসপাতালে ভর্তি করালাম তোমাকে। তবে তোমার রিপোর্ট পেয়ে আমি বেশ অবাক হলাম। কারণ তুমি মা হতে চলেছিলে। অথচ আমি জানতামই না যে তুমি বিবাহিত।’
রাহাত ভাই একটু থামলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন। নিশান আর তোমার সম্পর্কের কথা শুনে আমি বেশ অবাক হয়ে ছিলাম। তবে নিশানের খোঁজ নেবার পর আরো বেশি অবাক হয়েছিলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম সে হাসপাতালে । জানি না কীভাবে? কেন? এক মরণব্যধি পেয়ে বসল তাকে। সে পৃথিবী নামক গ্রহ ছেড়ে চলে যাবার জন্য এক প্রকার উদ্যত ছিল। আমি এই কথাটা জানার পর ভাবছিলাম তোমাকে কীভাবে জানাব! শেষমেশ সাহস করেই একদিন তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। তুমি থমকে দাঁড়িয়েছিলে। নিশান তো কথাই বলতে পারছিল না ঠিকমতো। আমি তাকে বলেছি যে সে বাবা হতে চলেছে । আনন্দে তার চোখ চিকচিক করছিল। তুমে ছিলে স্তব্ধ । সবথেকে বড় কথা নীলা ফুফু আর ফুফা না থাকলে তখন তোমাকে নিয়ে যেতে হতো। নিশান হয়তো বুঝে গিয়েছিল তার সময় শেষ। তাইতো সে আমাকে অনুরোধ করে বলেছিল যাতে তোমার দায়িত্ব নিই। আর তা শুনে তুমি খুব ক্ষেপে গিয়েছিলে। আমার উপর প্রচণ্ড চড়াও হয়েছিলে। শেষমেশ নিশানের আকুতিতে তোমাকে বিয়েতে রাজী করানো হয়েছিল। এক সময় নিশন হারিয়ে গেল আমাদের মাঝ থেকে। ফুফা তোমাকে এর জন্য দায়ী করে তাই তিনি বেশ কয়েকবার তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছেন। যেন তোমার ক্ষতি হলেই নিশান ফিরে আসবে। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন, প্রচণ্ড তিক্ত। তারপর তোমার ইদ্দত শেষ হতেই তোমাকে বিয়ে করলাম। ততদিনে তোমার মানসিক অবস্থা কেবল খারাপের দেকে যাচ্ছিল। কিন্তু যখন শুনলে মামা হার্ট এট্যাক করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন তখন তুমি পুরোপুরি মেন্টালি আনস্টেবল হয়ে গিয়েছিলে। আমার সব সময় তোমাকে চোখে চোখে রাখতে হতো। বেশ কয়েকমাসের ছুটিও কাটিয়েছিলাম। তারপর আরমানের তত্ত্বাবধানেই তোমার চিকিৎসার করালাম। যার দরুণ তুমি স্বাভাবিক হলে। ‘
রাহাত ভাই তার কথা শেষ করে আমার দিকে তাকালেন। আমার দুচোখ ভর্তি অশ্রু। তিনি তার হাত দিয়ে আমার চোখের জল মুছে দিলেন। বললেন, ‘এই চোখ জোড়াতে যেন আর কখনোই অশ্রু নামক পানি না দেখি।’ মৃদু হেসে বললেন,’এটা কিন্তু লাস্ট ওয়ার্নিং ।’
আমি মাথা দুলালাম। রাহাত ভাই বললেন,’ এবার তো একটু কথা বলে সম্মতি দাও ।’
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, রাহাত ভাই।’
রাহাত ভাই চোখ বড়ো বড়ো করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,’আর কতকাল আমাকে এই ভাই ডাক শুনতে হবে, স্মৃতি? কল্প শুনলে কি বলবে? তখন সে তার বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে চাইবে ,আচ্ছা তোমার আম্মু কি তোমার আব্বুকে ভাই ডাকে?’
আমি রাহাত ভাইয়ের কথা শুনে হাসতে লাগলাম। তারপর মৃদু কণ্ঠে বললাম, ‘ঠিক আছে,রাহাত।’
‘দ্যাটস গুড।’
কল্প দৌড়ে এসে লাফ দিতেই রাহাত ভাই ওকে ধরে বলল, ‘কী হয়েছে প্রিন্স চার্মিং? তুমি এভাবে লাফ দিচ্ছ কেন?’
কল্প হাসতে হাসতে বলল, ‘মৌন ফুফুকে আবার ফুফু বলেছি তাই।’
আমি চুপ করে দেখতে থাকলাম রাহাত ভাই আর আমাদের কল্পকে। নিশান নেই কিন্তু তার স্মৃতি আছে, থাকবে। কিছু মানুষকে কখনোই ভোলা যায় না । তারা স্মৃতির পাতায় থাকে চিরঞ্জীব । ঠিক যেমন সব সময় নিশানের বিস্মৃতির অন্তরালে আমি ছিলাম।
পরিশিষ্ট:
ডা: আরমান ঠিক বলেছিলেন, আমি অনেককিছু হারিয়ে অনেককিছু পেয়েছি। হুম, রাহাত ভাই হলেন , আমার সেই অনেককিছু। জীবন আমাকে শেষ পর্যন্ত দুহাত ভরে দিয়েছে। কল্প হলো সেই পূর্ণতা। আর রাহাত ভাই এই পূর্ণতার বেষ্টনকারী।
মাঝেমাঝে ভাবী সুইসাইড করলে কত বড় ভুলটাই না হয়ে যেত। ভাগ্যিস রাহাত ভাই ছিলেন আমার পাশে বটবৃক্ষের ন্যায় ছায়া হয়ে। নয়তো নিশানের অনুপস্থিতিতে আমিও হারিয়ে যেতাম বিস্মৃতির অন্তরালে। নিশান ভাই ছিল, আছে,থাকবে আমার বিস্মৃতির অন্তরালে। রাহাত ভাই তো সব সময় বলেন, প্রিয় মানুষকে ভোলার চেষ্টা করা এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা । বোকারা এই কাজ করে থাকে। বুদ্ধিমানরা প্রিয় মানুষকে সযত্নে মনের গোপন কুঠুরিতে লালন করে। কারণ আমাদের জীবনকে সুন্দর করার ক্ষেত্রে প্রিয় মানুষের অবদান আমাদের ভাবনার চাইতেও বেশি । তাই তাদের ভুলতে নেই ।
সমাপ্ত
আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/961283074302412/