#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব – ২০
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি
একদিন আমি পড়ছিলাম হঠাৎ দরজা লক করার শব্দ পেয়ে ফিরে তাকালাম দেখলাম নিশান ভাইকে । তাকে দেখে আমার প্রচন্ড ভয় লাগতে শুরু করল। আমি একটু জোরেই বললাম,’ তুমি এখানে কী করছ? দরজা লক করেছ কেন?’
নিশান ভাই আমার মুখটা নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরলো। তারপর খুব ধীর স্বরে বলল,’আমার বউ কী করছে দেখতে এলাম।’
আমার বুকের মধ্যে তখন ধুক ধুক করছে। এত জোরে শব্দ হচ্ছে যে আমার ধারণা তা নিশান ভাই আর একটু কাছে এলেই শুনতে পাবে । নিশান ভাই এবার আমার মুখ থেকে তার হাতটা সরিয়ে নিলো । আমি একেবারে খাটের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলাম। নিশান ভাই আবার বলল,’ একটা কিছু মিসিং মনে হচ্ছে না তোর?’
আমি ডানে বামে ক্রমাগত মাথা নাড়ালাম। নিশান ভাই এবার আমার আরো কাছে আসতে লাগলো। আমি বললাম,’কাছে আসবে না কিন্তু। নইলে…!’
‘নইলে কী? কাছে না আসলে আমাদের বাসর রাত হবে কী করে?’ নিশান ভাইয়ের মুখে এক দুর্বোধ্য হাসি।
‘আমি কিন্তু তোমার সাথে কোনোদিন কথা বলব না এমন করলে?’ আমি সতর্ক গলায় বললাম।
‘এখন থেকে তো সারা জীবন আমার সাথেই কথা বলতে হবে তোর। হাজার হোক একটা মাত্র স্বামী।’ দম্ভভরা কণ্ঠে বলল, নিশান ভাই।
‘আমার কিন্তু তোর কাছ থেকে বাসর রাত পাওনা রইলো। খুব তাড়াতাড়ি শোধ করে দিবি।’ মুখে দুষ্টু হাসি টেনে বলল।
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল,’আগে সবার সামনে বিয়ের কথা বলো । তারপর সব শোধ করা হবে।’
আমার নিজের কথাতেই আমি কুপোকাত হয়ে গেলাম। এতো লজ্জা লাগছিল। আমি চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে ফেললাম। নিশান ভাইয়ের পদ ধ্বনি আমার কানে স্পষ্ট বাজছে। সে কাছে আসছে। খুব কাছে। আমার পেছনে দেয়াল। ছুটে পালিয়ে যাওয়ার তো কোনো জায়গা নেই। হঠাৎ আমার কপালে এক গভীর ভালোবাসার পরশ পেলাম। জীবনের প্রথম ছোঁয়া । আমি যেন জমে গেলাম। মনে হলো এক পবিত্র অনুভূতি । এক অন্যরকম শিহরণ অনুভূত হলো। আমার চোখের কোনা বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু তা পড়ার আগেই নিশান ভাই তার হাতে নিয়ে নিলো। তারপর আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,’এতটুকু অধিকারও কি পেতে পারি না?’
আমি কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। অপলক তাকিয়ে ছিলাম তার ওই গভীর কালো চোখের দিকে। তারপর সে দ্রুত পায়ে আমার রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আর আমি আমার কপালের ওই অংশটুকু চেপে ধরে বসে রইলাম। যেন হাত সরাতেই সে স্পর্শ, সেই অনুভূতি, সেই ভালোবাসার পরশ হারিয়ে যাবে!
নিশান ভাই আমার রুম থেকে বের হবার পর পরই আমি দরজা লাগানোর জন্য আসতেই ফুফাকে দেখলাম। আমার রুম অতিক্রম করেই যাচ্ছিলেন। তবে যাবার আগে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন। যেই দৃষ্টির অর্থ আমি তৎক্ষনাত ধরতে পারলাম না।
তার বেশ কিছুদিন পর আমরা সবাই ড্রয়িং রুমে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ ফুফা নিশান ভাইকে ডেকে পাঠালেন। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জেগে উঠল। আমার মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হতে চলেছে। খুব খারাপ কিছু! তারপরেও আমি অনেকটা জোরপূর্বক মনোযোগ দিচ্ছিলাম টিভিতে। কিছুক্ষণ পর নিশান ভাই হনহন করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। এবার আমার সন্দেহ আরো তীব্র হলো। নিশ্চয়ই ফুফার সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে নিশান ভাইয়ের ।
এরপর থেকেই অদ্ভুতভাবে খেয়াল করলাম সবাই কেমন যেনো থম মেরে আছে। ফুফুও আমার সাথে তেমন কথা বলছে না। আর ফুফা তো আমাকে কেনো যেন সহ্যই করতে পারে না। এই বিষয়টা আমি খেয়াল করছি ফুফার রাঙ্গামাটি থেকে ভ্রমণ শেষে আসার পর। তখন থেকেই আমার মনে হতে লাগলো ফুফা কোনো কারণে অমার উপর রেগে আছেন। অথবা তিনি চান না আমি এই বাড়িতে থাকি।
আমি পরিস্থিতি বুঝে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম । দুপুরের খাবার খাইনি। আমাকে কেউ ডাকতেও আসেনি। এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতে চলেছে । আমি বিছানা থেকে উঠে এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ আমার ব্যালকনির দরজাতে ঠক ঠক আওয়াজ শুনতে পেয়ে আমি ভয় পেয়ে উঠে বসলাম। তারপর ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। ভীত কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, ‘কে ওখানে?’
কয়েক সেকেন্ড কোনো শব্দ নেই। আমি আবার জোরে শব্দ করে বললাম,’ কে ওখানে?”
‘আমি। দরজা খোল।’ ফিসফিস শব্দ আমার কানে পৌঁছানোর পরই আমি বুঝতে পারলাম এটা আর কেউ না বরং নিশান ভাই ।
আমি আবার বললাম ,’ তুমি এভাবে চুপিচুপি ওখানে কী করছ?’
নিশান ভাই এবার রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,’ তুই দরজা খুলবি নাকি দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকব?’
আমি কোনোকিছু না বলে দ্রুত দরজা খুললাম। নিশান ভাই দ্রুত রুমে ঢুকেই ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। আমি বিড়বিড় করে বললাম, ‘এতো রাতে তুমি এখানে কী করছ ?’
‘নিজের বৌ এর কাছে আমি রাত, দিন, সকাল,বিকাল,এমনকি মধ্যরাত যেকোনো সময়েই আসতে পারি ।’ নিশান ভাইয়ের নির্বিকার উত্তর।
‘ঠিক আছে মানলাম। তো চোরের মতো কেন এসেছ?’ আমি পাল্টা জেরা করলাম।
‘প্র্যাকটিস করছি। চোরের মতো নিজের বউ এর কাছে আসার অনুভূতি কেমন হয় তা আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা করছি!’
‘তো কেমন অভিজ্ঞতা হলো?’ আমি সিরিয়াস ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলাম।
‘মাইন্ড ব্লোয়িং। ভাবছি এখন থেকে সব সময় এভাবে চুপিচুপিই আসব।’ দুহাত সম্প্রসারিত করে বলল, নিশান ভাই।
‘আমি দরজাই খুলব না।’
‘দরকার হলে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকব। তখন চোর থেকে ডাকাত হয়ে যাব।’
‘তুমি আবার ডাকতও হবে?’
‘তুই দরজা না খুললে ডাকাতের অভিজ্ঞতাটাও নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা করতে হবে এই আরকি!’
‘আমি তোমাদের এই বাড়ি ছেড়েই চলে যাব।’
‘তোকে সারাজীবন আমার কাছেই থাকতে হবে। যেতে পারবি যখন আমি থাকব না তোকে বাধা দেবার জন্য । তার আগে কখনোই চলে যাবার কথা মুখে আনবি না।’
‘তোমার কথা আমি কেন শুনব?’ প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালাম।
‘আমি তোর স্বামী। তাই আমার কথা শুনবি।’ আদেশ দেবার ভঙ্গিতে বলল, নিশান ভাই।
‘আমি তোমাকে স্বামী বলে মানি না।’
‘সত্যিই মানিস না?’ আহত কণ্ঠে প্রশ্ন করল।
‘না।’ আমার স্পষ্ট উত্তর।
‘আমার চোখে চোখ রেখে বলতে পারবি?’
‘কেন পারব না। চোখে চোখ রাখতে হবে কেন? তোমার চোখ কি সত্য মিথ্যা ডিটেক্ট করার মেশিন?’
‘হুম। তোর বলা সত্য মিথ্যা আমার চোখ অনায়াসেই ডিটেক্ট করতে পারে।’ নিশান ভাই প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল।
‘বন্ধ করো তোমার জ্ঞানমূলক কথাবার্তা ।’
‘আমি জ্ঞানমূলক কথাবার্তা বলতেই পারি না। বন্ধ করব কীভাবে? এখন চুপটি মেরে এখানে বস। আমি তোর জন্য খাবার এনেছি।’
‘আমার খিদে নেই।’ আমি নিশান ভাইয়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললাম।
‘আমি জানি, তোর খিদে নেই। কিন্তু আমার প্রচন্ড খিদে পেয়েছে । তাই তোকে খেতে হবে।’ আমার ডান হাতের কনুই ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল নিশান ভাই।
‘তোমার খিদে পেয়েছে তুমি খাও।আমাকে কেন খেতে বলছ?
‘তুই না খেলে যে আমার পেট ভরবে না।’
আমি আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। নিশান ভাই খাবারের প্যাকেট খুলে তার হাত দিয়ে আমার মুখের সামনে খাবার তুলে ধরলো। আমি অপলক তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার চোখের কোণে জল জমেছে। হয়তো গড়িয়ে পড়তো! কিন্তু তার আগেই নিশান ভাই তার হাত দিয়ে মুছে নিলো। তারপর বলল,’ আমি থাকতে তোকে কখনো কষ্ট পেতে দেব না। চোখের জলগুলো জমা করে রাখ। যখন আমি থাকব না তখন কাজে লাগবে।’
আমি তার বলা এই কথাটা সহ্য করতে পারলাম নে। হঠাৎ করেই খুব কান্না আসতে লাগল।
নিশান ভাইকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদলাম। নিশান ভাই তার বাম হাত দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগল। আর বলল,’ আমার পাগলিটা। এখানে কাঁদার মতো কিছু বলেছি কি?’
আমি নাক টানতে টানতে বললিম,’আগে প্রমিস করো তুমি না থাকার কথা কখনো বলবে না?’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। বলব না। এত্ত ভালোবাসিস আমাকে?’
আমি মাথা নাড়ালাম। নিশান ভাই বলল,’ এত মোটা আর বড় মাথাটা হেলাতে পারিস আর হালকা ছোট্ট জিহ্বাটা একটু নাড়াতে পারিস না!’
আমি আবারো মাথাটা উপর নিচে দুলিয়ে সম্মতি জানালাম। নিশান ভাই এবার হেসে ফেলল। তারপর আমার মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল,’ সারাদিন কিছু খাসনি কেন?’
‘এমনিতেই। তুমি খেয়েছ?’
‘তুই আগে খেয়ে নে। তারপর বলছি।’
‘নাহ্। আমি জানি তুমি কিচ্ছু খাওনি। হা করো। আমি খাইয়ে দিচ্ছি তোমাকে।’
‘ইয়াক। তোর নোংরা হাত দিয়ে আমি খাব না।’
‘কী! আমার হাত নোংরা? যাও আমিও খাব না।’
‘আচ্ছা সরি । এমনিই বলেছি। আর তোর হাত নোংরা মানে খুব নোংরা হলেও আমি খাব।’
খাবার শেষ হওয়ার পর আমি আর নিশান ভাই খাটের পাশে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম । আমাদের মধ্যে খানিক দূরত্ব ছিল। নিশান ভাই আমাকে তার কাছে টেনে নিল। খুব কাছে। আমার মাথাটা তার প্রশস্ত বুকের উপর রাখল । আমার কানে বাজতে লাগলো তার হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দন । সেই স্পন্দন অনেক কিছু বলে যাচ্ছে । অনেক ভাষা ব্যাখ্যা করে যাচ্ছে । আমি খানিকবাদে আমার মাথাটা তুলে নিশান ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। তাকে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হলো। আমি খুব ধীরে প্রশ্ন করলাম,’ এসব কী ঠিক হচ্ছে?’
নিশান ভাই আমার চোখে চোখ রেখে বলল,’কী ঠিক হচ্ছে না?’
‘আমরা এভাবে…?’
‘সব ঠিক হচ্ছে । এখন প্লিজ তুই একটু আমার কাছে থাক। কোনো কথা বলিস না।’ নিশান ভাই এবার আমাকে এক দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করল। যেনো তার হাতের বাঁধনটা একটু ঠিল করলেই আমি হারিয়ে যাব।
চলবে…ইন শা আল্লাহ্
আগের পর্বের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/960554911041895/