গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব-১৯

0
1044

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব-১৯
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি

‘হায় হায় হায়! কেমুন দিন আইয়া পড়ছে। এখন এইসব নোংরামি করে বেড়াইতেছ তুমরা দিন দুপুরে? চক্ষু লজ্জা বলতে কিচ্ছু কি নাই তোমাগো?’

হঠাৎ জামিলা খালার গলার কণ্ঠ শুনে আমি নিশান ভাইকে দূরে ঠেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম জামিলা খালা খুবই ঘৃণার চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি সেই দৃষ্টি দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। এই মানুষটা কথা রটাতে বেশ দক্ষ! বলতে গেলে তিলকে তাল বানাতে সিদ্ধহস্ত তিনি। আমাদের ঘরে ছুটা বুয়া হিসেবে কাজ করেন। আমি ভয় মিশ্রিত কণ্ঠে বললাম, ‘খালা তুমি যেরকম ভাবছ সেই রকম কিছু না কিন্তু ।’

‘হ, আমি তো আর চোখে দেখি না। যা দেখবার আমি দেখছি। আমারে আর কিছু কওন লাগত না।’ জামিলা খালা মুখে ঝামটা মেরে বললেন।

নিশান ভাই বলল, ‘এই স্মৃতি! তুই কাজের মানুষের কাজে এত কৈফিয়ত দিচ্ছিস কেন? উনার যা ইচ্ছা তাই ভাবুক। তোকে কোনো ক্লারিফিকেশন দিতে হবে না।’

নিশান ভাইয়ের কথা শুনে জামিলা খালা যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, ‘হ, আমাগো কিচ্ছু কওন লাগত না।’

নিশান ভাই আঙ্গুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে বললেন, ‘তুমি এখানে কি কাজ করতে এসেছ করে বিদেয় হও। বেশি কথা বলবে না একদম।’

খালা ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকালেন নিশান ভাইয়ের দিকে। আমি কিচ্ছু বলতে নেবার আগেই খালা ত্যাড়ছাভাবে একবার আমার দিকে আর একবার নিশান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন। আমার খুব ভয় লাগতে শুরু করল। এই কথা না জানি কার কার কানে যায়! কথা ছড়াতে এই মহিলা অত্যন্ত পটু। ভুয়া কথা তো আরও বাতাসের বেগের চাইতে বেশি দ্রুত গতিতে ছড়ায় ।

রাতে আমার ঠিকমতো ঘুম হলো না দুশ্চিন্তাতে। সারারাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম। মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরে বেড়াচ্ছে যে, জামিলা খালা বসে থাকবেন না। আমার নামে বদনাম রটিয়ে হলেও তিনি তার অপমানের প্রতিশোধ নিবেন। এটা আমি নিশ্চিত। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখলাম অনেক মানুষের ভিড় আমাদের বাড়ির আঙিনায় । বাবা মাথা নিচু করে বসে আছেন। কিছুক্ষণ পর আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমি যা শুনছি তা কি ঠিক?’

আমি মাথা নিচু করে থাকলাম। বাবা করুণ স্বরে বললেন, ‘তোকে মনে হয় আমি মানুষ করতে পারি নাই। আমার সমস্ত মান সম্মান আজ শেষ হয়ে গেল শুধু তোর জন্য। আমি আসলেই একজন ব্যর্থ বাবা।’

নিশান ভাই হুট করে এসে বললেন, ‘মামা, আপনি এই মহিলার কথা শুনে নিজের মেয়েকে অবিশ্বাস করছেন? এটা আপনার কাছ থেকে আশা করি নাই।’

তখন বিচার নিয়ে আসা লোকেদের মধ্যে একজন বলল এই ধরনের নোংরামি তারা সহ্য করবেন না। তাদের পরিবারের উপর এর প্রভাব পড়বে। যা তারা কখনোই মেনে নিবে না।

শেষমেশ সবাই সিদ্ধান্ত নিল যে এর বিচার বাবাকেই করতে হবে। যেহেতু বাবাকে অনেকেই সম্মান করে তাই সবাই এর সিদ্ধান্ত বাবার উপর ছেড়ে দিল। বাবা বললেন শিগগিরই আমার বিয়ের ব্যবস্থা করবেন। আমার তখন জান যায় যায় অবস্থা । আমি ভাবতেই পারছিলাম না এত তাড়াতাড়ি বিয়ের কথা। ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলে উঠল যার সাথে কেলেঙ্কারি হয়েছে তার সাথেই বিয়ে দেবার জন্য। তা হলেই সব ঠিক হবে। বাবা কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর নিশান ভাইকে ডেকে বললেন আমাকে বিয়ে করতে তার আপত্তি আছে কি না! নিশান ভাই চট করে বললেন যে সে আমাকে বিয়ে করতে রাজী। বাবা ফুফুকে জানানোর জন্য কল করেছিলেন কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়াতে যোগাযোগ না করেই আমাদের বিয়ে দিতে হলো।

ব্যস, বিকেলের দিকে কাজী ডেকে এনেই আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। বাবা বিয়ে দেবার পর পরই কঠিন গলায় বললেন যাতে আমি আর নিশান ভাই কাল সকালের মধ্যেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিই। আমি শুনে খুব অবাক হলাম। বাবা এতটা রেগে যাবেন আমার উপর তা আমার ভাবনার বাইরে ছিল। আমি বাবার সাথে কথা বলতে চেয়েও কোনো লাভ হলো না। কিছুতেই আমার কথা শুনলেন না।

ঢাকায় আসার পরে কেন যেন আমি আর নিশান ভাই কেউই আমাদের বিয়ের কথা জানাতে পারলাম না। ভার্সিটিতে ভর্তির হবার পর নিয়মিত ক্লাস করছি। এভাবেই কাটতে লাগল দিন। এডমিশন রেজাল্টের পর বাবাকে কল করেছিলাম কিন্তু তিনি আমার কল রিসিভ করেননি। আমার বাবা যে এতটা জেদী তা আমার বুঝতে বেশ সময় লেগে গেল। এদিকে নিশান ভাইও ফুফুকে কিছুই বলল না। আমি না হয় বলতে পারছি না কিন্তু তার তো বলা উচিত।

একদিন ইমরানকে বিদায় দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গেইটের কাছে দাঁড়িয়েছিলাম রিকশার জন্য। হঠাৎ একটা কার আমার সামনে থামলো। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম যে আমি কারটা চিনি। এটা নিশান ভাইয়ের । কার থেকে বেরিয়ে এলেন নিশান ভাই। আমার সামনে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
‘ইমরানের সাথে এত কথা কিসের তোর ? আর সব সময় তোর সাথে এভাবে পোস্টারে মতো সেঁটে থাকে কেন?’

নিশান ভাইয়ের প্রশ্ন শুনে আমি সত্যিই খুব অবাক হয় গেছি। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম,’ তাতে তোমার কী সমস্যা?’

‘আমার সমস্যা? আমার সমস্যা আছে কি নেই বুঝাচ্ছি তোকে দাঁড়া !’

‘তাড়াতাড়ি বলো। আমার বাসায় যেতে হবে।’

‘গাড়িতে ওঠ বলছি।’

‘আমি তোমার গাড়িতে যাব না।’

‘আমার গাড়িতে তুই না তোর ঘাড় শুদ্ধ যাবে।’

এই বলে নিশান ভাই আমাকে পাঁজাকোলা করে গাড়িতে তুললেন। আমি হাত পা ছোড়াছুড়ি করেও কোনো লাভ হয়নি।

নিশান ভাই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিলো। আমি অনেক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করেছি কিন্তু তাতে কোনো লাভ তো হলোই না বরং আমার কথা বলার রাস্তাই বন্ধ করে দিলো এই বজ্জাত ছেলেটা। গাড়িটা থামিয়ে সে আমার ওড়নার একাংশ বেঁধে দিলো আমার মুখে । আর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় ধরে রাখল শক্ত করে। তাও আমি কথা বলার যারপরনাই চেষ্টা করতে লাগলাম। আর মি. রাক্ষস রাজ পৈশাচিক হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমি কোনোরকমে তার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে এবার তার শার্টের কলার টেনে ধরলাম। এতেই সে বললো,’ অন্যের আমানতে হস্তক্ষেপ করতে নেই, স্মৃতি। এই ন্যূনতম জ্ঞানটুকুও কী নেই তোর?’

নিশান ভাইয়ের কথা শুনে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। সিরিয়াসলি ? অন্যের আমানত? তাহলে আমাকে জোর করে সাথে নিয়ে আসার মানেটা কি?

হঠাৎ আমার নিজের চিন্তার কারণে নিজেরই লজ্জা লাগছিল। আমি নিশান ভাইয়ের শার্টের কলার থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিলাম। তারপর হাত গুটিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। আমার দৃষ্টি বাইরে হলেও আমি ঠিক বুঝতে পারছি যে নিশান ভাই বারবার আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

তার এভাবে নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে থাকা দেখে আমি কড়া গলায় বললাম, ‘এসব কোন ধরনের অসভ্যতা? আমি তোমার কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ কখনো আশা করিনি।’

‘আমিও তো আশা করিনি। তারপরেও তুই একটু আগে কি করেছিস! মনে আছে?’

আমি মাথা নিচু করে ফেললাম । মাথা নিচু করেই বললাম,’ আমি কিচ্ছু করিনি।’

‘তোর এই লজ্জা পাওয়াটাই আমার কাছে খুব ভালো লাগে। ‘ নিশান ভাই নরম গলায় বলল ।

‘কী বললে?’ তারপর বিড়বিড় করে বললাম, ‘আসল কথাটাই বলতে পারছ না বাসায়!’

‘কিছু বলেছিস?’

‘আমি কেন তোমাকে কিছু বলতে যাব। আর বললেই তুমি শুনবে নাকি?’

‘বিয়ের কথাটাই তো বলছিস। তাই না?’

আমি প্রত্যুত্তরে কিছু বললাম না। তাকিয়ে থাকলাম অন্যদিকে, জানালার বাইরে। নিশান ভাই গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আমি কেন বলছি না তার পেছনে নির্দিষ্ট কিছু কারণ আছে। তবে এটা মনে রাখিস যখন বলাটা আবশ্যক হয়ে পড়বে তখন কিন্তু আমি পিছিয়ে থাকব না।’

চলবে…ইন শা আল্লাহ্

আগের পর্বের লিংক:

https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/959873084443411/

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে