#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব-১০
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি
জানালার পর্দা ভেদ করে সকালের সূর্যের আলো প্রবেশ করে ঠিক আমার চোখ বরাবর লাগলো। আমি একটু ঘুরে টেবিল ল্যাম্পের পাশে রাখা ঘড়িটা ডান হাত দিয়ে নিয়ে দেখলাম সকাল ১০টা বেজে গেছে। ঘড়িতে ১০ টা দেখেই আমি লাফিয়ে উঠলাম। এত্ত দেরি হয়ে গেলো! কাল রাতে সত্যিই খুব দেরি হয়ে গিয়েছিল । দেরিতে ঘুমানোর কারণে আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেলো। ঘুম থেকে উঠেই ওয়াশরুমে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে নিচে নিমে দেখলাম আজ খুব শোরগোল হচ্ছে। কি হচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না। ড্রয়িং রুমে পা রাখতেই দেখলাম ফুফা বসে আছেন । অনেকদিন পর দেখলাম ফুফাকে। তার পাশে ফুফু বসে এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে তার দিকে। ফুফু আমাকে দেখতেই ডাকলেন। আমি ফুফাকে সালাম দিলাম। তারপর তার ঠিক সামনের সোফাতেই বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর নেহা আর নিশান ভাই এসে তাদের বাবাকে জড়িয়ে ধরল। সবাই খুব নস্টালজিক হয়ে পড়ল। প্রায় ছয় মাস পর ফুফা এসেছেন ইউএসএ থেকে। এবার সব থেকে বেশি সময় ধরে বিদেশে ছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই সবাই তাকে খুব মিস করেছে। ফুফা একটু পর উঠেই নিজের রুমে চলে গেলেন। আর ফুফু ফুফা আসার খুশিতে নানান আয়োজন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
আমার কেমন যেন লাগছিল! মনে হয় বাবাকে মিস করছি খুব। আমার একটা সমস্যা হলো যখনই বাবা আর সন্তানের মধ্যকার ভালোবাসা দেখি তখনই আমার কেমন যেন অদ্ভুত ফিল হয়। এখনও ঠিক তেমনই অনুভব হচ্ছে কিন্তু তা ব্যাখ্যা করতে অপারগ আমি।
আজ আমাদের তিনবন্ধুর একসাথে টিএসসি চত্বরের কাছাকাছি জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার কথা। ওখান থেকে আবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরেও যাব বলে পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু এক জাদুঘরে ঘুরতে গেলেই তো তিন থেকে চারঘন্টা লাগবে। কারণ বার্ডস আই ভিউতেও যদি কেউ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দেখতে চায় তবে তার মাস্ট দুঘণ্টা লেগে যাবে। আর আমার একটা অভ্যাস হলো আমি কখনোই বার্ডস আই ভিউ তে কোনোকিছু দেখা পছন্দ করি না। সেটা হোক প্রকৃতি, হোক কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন । ভালো করে না দেখা হলে সেইসব জায়গা বা জিনিসগুলো সম্পর্কে ভালো ধারণা নেয়া যায় না । তাছাড়া চারপাশের প্রকৃতিতে একটু প্রাণভরে শ্বাসই যদি নিতে না পারি তবে ঘুরতে যাওয়ার তো মানে নেই।
হঠাৎ মোবাইলের ঝংকার শুনে আমার চিন্তারা গুটিয়ে গেল। আমি তৎক্ষনাত মনোযোগ দিলাম আমার হাতের যান্ত্রিক মুঠোফোনের দিকে। তুলি কল করছে। আজই আমাদের যাওয়ার কথা। আমি ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছি মোবাইলের স্ক্রিনে । কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছি আর যন্ত্রটি বেজেই চলেছে তারস্বরে। কিছুক্ষণ পরে সম্বিৎ ফিরে পেতেই ভাবলাম এখন কী বলব তুলিকে। আজ কী যাওয়া ঠিক হবে? ফুফু একা একা বাসায় কাজ করবেন । আমার কী উচিত হবে না তাকে সাহায্য করা? পরক্ষণেই ভাবলাম তুলিকে বলব যে আমি আজ যেতে পারব না।
তুলি খুব রাগ করবে আমার উপর । ইমরানকে ফোন করে বললাম যে আমি যেতে পারব না। তুলিকে রাতে ফোন করে কারণ সহ স্যরির একটা মৌখিক দরখাস্ত দিতে হবে। নয়তো এই মেয়ে যে কী পরিমাণ রাগ করতে পারে সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি!
ফুফা আসার পরে বাসা থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আমরা সবাই মিলে রাঙ্গামাটি যাব। ফুফা রাঙ্গামাটি খুব পছন্দ করেন। তিনি যখনই সময় পেতেন তখনই রাঙ্গামাটি বেড়াতে যেতেন। তবে নিশান ভাই খুব কমই যেত। আর নেহা তো শুধু একবার গিয়েছিল। আমার খুব ভালো লাগলো সিদ্ধান্তটা । বাবাকেও দেখব। আমার যে কী পরিমাণ ভালো লাগছিল তা কাউকে বলি বুঝানো সম্ভব নয়।
আজ কোচিং এ যাওয়া হয়নি তাই ছাদের গাছগুলোতে পানি দিচ্ছিলাম। সবগুলো ফুল গাছ ফুলে ভর্তি হয়ে আছে। কী সুন্দর ঘ্রাণ আসছে! চেরি, মালতী, মরুগোলাপ, ডালিয়া, সূর্যমুখী,গাঁদা, গোলাপ, স্টারসহ নানা ফুল গাছে ভর্তি পুরো ছাদ । সবগুলো গাছে পানি দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছি প্রায়। ধরাম ধরাম করে শব্দ হওয়াতে আমি হঠাৎ চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম সিঁড়ি দিয়ে নিশান ভাই আসছে। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম তাকে আজ বড়ই সুন্দর লাগছে। একদম হিরো টাইপ। আমার মামাতো চাচাতো সব ভাইদের মধ্যে অবশ্য নিশান ভাইই অধিক হ্যান্ডসাম । আর সেই হ্যান্ডসাম ছেলেটার সাথেই আমার সব থেকে বেশি সখ্য ছিল ছোটোবেলায় । আমার এই বিষয়টা ভাবতে খুব ভালো লাগে। ছোটোবেলা থেকেই খুনসুটি ঝগড়াতে লেগে থাকতাম দুজন। তারপর দীর্ঘ বিচ্ছেদ। ঢাকাতে এসে যেন নিশান ভাই আমাকে ভুলেই গেল। প্রথম প্রথম কিন্তু তাকে আমি ভুলতে পারিনি। একটা মুহূর্তের জন্যও না। কিন্তু সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে আমিও তাকে ভুলে গিয়েছিলাম পরের সময়গুলোতে।
তবে সবথেকে বেশি অবাক হয়েছিলাম যখন দেখলাম নিশান ভাইয়ের বেডরুমে আমাদের দুজনের ছোটোবেলার ছবিটি ফ্রেমে আটকানো। তখন এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিলো হয়তো নিশান ভাইও আমাকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলেনি। আমি ছিলাম তার মনে সবসময় । হয়তো থাকবো!
নাহ্…না। এটা কী করে সম্ভব! নিশান ভাই তো এখন আমাকে আরো বেশি সহ্য করতে পারে না। সব সময় তো আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় । আচ্ছা আমি কেন তার কথা এতো ভাবছি? সে তো আমাকে নিয়ে ভাবছে না! তাহলে আমি কেন ভাবছি?
মাথায় হালকা আঘাত পাওয়াতে আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম নিশান ভাই আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে । সে চোখের ভ্রু উঁচু করে আমাকে প্রশ্ন করলো,’ এত কী ভাবিস,বলতো?’
আমি কিছু বলার মতো পেলাম না। তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলাম। ঘোরলাগা দৃষ্টিতে। খানিক তার দৃষ্টিতেও তা লক্ষ্য করলাম। তবে তা বোধহয় দু কি তিন সেকেন্ডের জন্য। আমি দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে বললাম,’গাছের কথা ভাবছি।’
নিশান ভাই অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল। তারপর বলল,’তুই কবে থেকে গাছ বিশারদ হয়ে গেলি? কই জানতাম না তো!’
আমার তার কথায় রাগ হলো না। শান্ত স্বরে বললাম,’ গাছ বিশারদরাই কি শুধু গাছ নিয়ে চিন্তা করে? অন্যরা করতে পারে না?’
‘না। তা পারবে না কেন? অবশ্যই পারে। তবে তুই ঠিক কবে থেকে গাছ নিয়ে ভাবছিস সেই বিষয়টা জানতাম না।’
‘তুমি কি ভুলে গেছো আমাদের ছাদের সবগুলো গাছ আমি নিজে লাগিয়েছি?’
‘তুই মাফ কর আমাকে! এই বিষয় বাদ দে । তোর পড়ালেখার কী খবর বল?’
‘ভালোই চলছে।’ আমি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললাম ।
‘পরীক্ষা তো আর দেরি নেই। ভালো করে প্রিপারেশন নিবি। আর গাছের পরিচর্যা ও গাছের ভাবনা পরেও ভাবতে পারবি। পরীক্ষার আর মাত্র দু’সপ্তাহ বাকি । তাই পড়াশুনাতে মনোযোগ দে।’ নিশান ভাই আদেশ দিবার ভঙ্গিতে ডানহাত টা নাড়তে নাড়তে
বলতে লাগলো ।
আমি শুধু মাথা নাড়ালাম।
তারপর আবার কিছু মনে করার ভঙ্গিতে শান্ত স্বরে বলল,’পড়বি ভালো করে বুঝলি? নাহয় তোকে যে কী করে বিয়ে দেব সেই চিন্তাই তো আমার রাতে ঘুম হয় না!’
‘আমার বিয়ে নিয়ে তোমার এতো চিন্তা কেন?’ আমি বুকের উপর দুহাত আড়াআড়িভাবে ভাজ করে নিশান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বললাম।
নিশান ভাই এবার এক গাল হেসে নিয়ে বলল,’বুঝলি? আমার মনটা অনেক বড় । আমি ক্ষুদ্র স্বার্থের মানুষ না। তাই আমাকে সবার কথা চিন্তা করতে হয়।’
‘তা আর কার কার কথা ভাব তুমি?’
‘সব কি তোকে বলতে হবে?’
‘প্রশ্ন করেছি। এখন তুমি বলতে চাইলে বলবে নয়তো বলবে না।’
‘খুব কথা শিখেছিস!’ নিশান ভাই চোখ রাঙিয়ে বলল।
‘আমি কি সারাজীবন ছোটই থাকব বলো? বড় হব না?’
‘হয়েছিস বলেই তো মনে হচ্ছে। তবে এখনো এতটাও বড় হসনি যে আমাকে তোর কাছ থেকে শিখতে হবে!’
‘সেটা কি আমি এক বারের জন্যেও বলেছি?’
‘সব কিছু বলতে হয় কি?’
‘বলতে হয় না। তবে তারপরেও বলা উচিত। নয়তো….!’
নিশান ভাই আমার খুব কাছে এসে বলল,’নয়তো কী?’
আমি তার দিক থেকে মুখটা ঘুরিয়ে বললাম,’কিছুনা।’
এবার যেনো নিশান ভাই কথা ঘুরাতে চায়লো। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,’শোন রাঙ্গামাটি যাচ্ছি আমরা সবাই । তুইও যাবি আমাদের সাথে। আব্বু চাচ্ছিলেন এই মাসেই যেতে আমি বলেছি নেক্সট মাসে যাওয়ার জন্য । তোর এডমিশন এক্সাম শেষ হলে আমরা একদম রিল্যাক্স হয়ে রাঙ্গামাটি চষে বেড়াব।’
‘কী বলিস?’
‘হুম।’
‘কথা বলতে পারিস না? সবসময় মাথা নাড়াবি নয়তো হুম বলে বেড়াবি! তোর কি কথা বলতে খুব সমস্যা হয়?’
‘সমস্যা হবে কেন? যখন যেরকম জ্যাস্চার দিতে হবে বলে মনে হয় সেটাই দিই।’
‘তোর কথা বলতে সমস্যা হলে বলিস আমাকে। আমি মুখ আর জিহ্বার অনেকগুলো ব্যায়াম জানি। ওসব ব্যায়াম করলে তোর কথা বলতে আর কোনো সমস্যা হবে না।’
‘আমার কথা বলতে কোনো সমস্যা হয় না।আপনি রাখেন আপনার ব্যায়াম আপনার কাছে।’
‘তোর ভালো চাই বলেই তো বললাম । শিখতে চায়লে বলিস আমাকে।’
এবার খুব রাগ হলো আমার। আমি নিশান ভাইয়ের কাছে এগিয়ে আমার পা দুটো উঁচিয়ে তার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে দৌড়ে চলে এলাম নিজের রুমে। আর পিছনের সেই হুংকার অবশ্য আমার কানে বেজে চলেছে।
চলবে…ইন শা আল্লাহ্
আগের পর্বের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/948356528928400/