গল্পটা তুমিময় পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
1738

#গল্পটা_তুমিময়💕
#পর্বসংখ্যা_৪ (শেষ পর্ব)
#মৌরিন_আহমেদ

বিয়ের কয়েক দিন পরেই সূর্য নামক মানুষটা হাত ধরে ইউকের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালাম আমি। বাবা-মা, পরিবার-পরিজন সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে এসে পড়লাম অজানা, অচেনা এক রাজ্যে! যেখানকার মানুষগুলো আমার অপরিচিত, এমনকি স্বজাতীয় নয়! কী যে কষ্ট হয়েছিল মানিয়ে নিতে!

চলে আসার দিনও অভিমানে কথা বলতে চাই নি বাবা-মায়ের সাথে। বাবা কাছে ডেকে বলেছিলেন,

— “আমি জানি এই বিয়েটার জন্য তুমি আমাদের উপর রাগ করে আছো। বিয়েটা মন থেকে মানতে পারো নি। তারপরও আমি বলবো বিয়েটা মেনে নাও। তুমি আর সূর্য দুজন দুজনকে ছোটবেলা থেকে চেন। একজন আরেকজনের সম্পর্কে অনেককিছুই জানো। তোমার বিয়েটা যদি আমি অন্য কোথাও দিতাম তুমি তখন এতোটা স্বাভাবিক থাকতে পারতে না যতটা এখন আছ। আমার ধারণা আমি বিয়েটা দিয়ে অবশ্যই ভুল করি নি। সেটা তুমি আজ না স্বীকার করলেও একদিন করবে। সেটা সময়ের অপেক্ষা।.. আমি সবসময় দোয়া করবো তোমাদের সুখের জন্য। ভালো থেকো।”

এখানকার স্থানীয় কারও সাথে কথা বলতে হলে ইংরেজির আশ্রয় নিতে হতো, যার সাথেই কথা বলি, যেটাই বলি, সব ইংরেজীতে! আমার প্রিয় বাংলার ঠাঁই নেই কোত্থাও! এখানে এসে এই ভাষার কষ্টটা অনুধাবন করলাম খুব! বুঝলাম, মাতৃভাষার মর্যাদা ঠিক কতখানি! তাই এখানে এসে পারতপক্ষে বাইরের কারো সাথে কথাই বলতাম না আমি। সারাদিন চুপচাপ, একলা, একলা হয়ে থাকতাম।

আমি স্বভাবতই ঘরকুনো। চিরজীবন ঘরে বসে থেকে উপন্যাসের পাতায় মুখ গুঁজে দেয়া সেই আমিটাও এই সুদূর প্রবাসে বই পড়তে ভুলে গেলাম। সারাদিন অ্যাপার্টমেন্টে নিজের ব্যক্তিগত রুমের জানালায় মাথা এলিয়ে বসে থাকি। এদিকে বাংলা উপন্যাসেরও খোঁজ খুব একটা নেই। আসার সময় লাগেজ ভর্তি করে যতগুলো বই এনেছি, সেগুলোই সম্বল। পড়তে হলে ইংরেজি নোভেল পড়তে হয়! কী যে খারাপ লাগে না আমার!

তবে অবাক কর বিষয় হলো, আমাকে এই দেশে আনার পর আমার প্রতি ব্যবহার বদলে গেল সূর্যের। যেই ছেলেটা আমাকে সবসময় বিরক্ত করতো, কারণে-অকারণে খোঁচাতো, সেই ছেলেটাই হুট করে আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলো। সারাদিন কারও সাথে কথা না বলতে পেরে, যে খারাপটা আমার লাগতো সেগুলো মেটানোর জন্যই তার সাথে কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। কখন সে আসবে, কখন কিছু বলবে, আমি প্রতি উত্তর করবো! কিন্তু সে যেন কোনো কিছুতেই কোনো কথা বলতো না! আগের যে মিষ্টি মিষ্টি ঝগড়া গুলো করতাম, চুল টা:না-টা:নি মা:রা-মা:রি করতাম, সেগুলোর কিছুই আর হতো না। সে ব্যস্ততার দোহাই দেখাতো, না কি আমাকে শা’স্তি দেবার চেষ্টা করতো জানি না!

একসময় অতিষ্ট হয়ে উঠলাম আমি। একদিন রাতে চরম একটা ঝগড়া করার প্রস্তুতি নিয়ে জেগে রইলাম অনেকক্ষণ। রাত বারোটার দিকে সূর্য এলেন। আমাকে এতরাতে জেগে থাকতে দেখে খানিক চমকালেন। আমি সাধারণত এতরাত জাগি না। সাড়ে দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে যাই। তাই সে রাত করে এলে দেখা হওয়ার সুযোগও থাকে না। কিন্তু তারপরও যেন কিছুই বললেন না। চুপচাপ ফ্রেশ হতে চলে গেলেন।

আমাকে উপেক্ষা করছে দেখে রাগে গা জ্বলে উঠলো আমার। উনি বেরোতেই তড়াক করে সামনে দাড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

— “সমস্যা কী আপনার?”

— “মানে?” ভ্রু কুঁচকে ফেললো সে।

— “মানে হলো আপনার সমস্যা কী? কী চাইছেন কী আপনি? কেন এমন করছেন?” রাগে চিৎকার করে উঠলাম আমি।

— “কী করছি আমি? আশ্চর্য!.. পাঁচফোড়ন ক্লিয়ার করে বল্ তো একচুয়ালি তুই কি বলতে চাইছিস?”

‘পাঁচফোড়ন’ এই নামটা যেন বহুদিন পর শুনলাম। অদ্ভুত ভাবে আজ এটা শুনে রাগ হলো না। পরিচিত কিছুর সংস্পর্শে এসে মন যেন অজানা আনন্দে আনন্দিত হলো। তবুও ক্ষেপে উঠে বললাম,

— “ন্যাকা! যেন কিচ্ছুটি বোঝে না।.. দেখুন, আমার সঙ্গে আলগা ঢং দেখাবেন না। যা বলার ক্লিয়ারলি বলবেন।.. বলেন আপনার সমস্যাটা কি? কেন আপনি আমার সাথে কথা বলেন না? কেন একই অ্যাপার্টমেন্টে থেকেও আমরা দুই জন দুই গ্রহের প্রাণীর মতো বিচ্ছিন্ন? বলেন, কেন? কেন? কেন?”

কথা বলতে বলতে কখন যে তার শার্টের কলার চেপে ধরেছি সে হুশ নেই। সে বোধ হয় হঠাৎ এমন আচরণ দেখে অবাকই হলো। ভ্রূ কুঁচকে বললো,

— “তুই কি কখনো আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলি? যে আমি বলবো?”

— “না, বলি নি!.. প্রত্যেকটা দিন আপনার সাথে কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকি আমি, অপেক্ষায় থাকি কখন আসবেন। আর আপনি? আসেন তো মেলা রাত করে! কথাও বলেন না!”

অভিমানে গলা ধরে আসতে লাগলো আমার। হুট করে কোত্থেকে যে এই আবেগ নামক বস্তুটা চলে এলো কে জানে! মনকে সামাল দিতে না পেরে অভিমানে জলকণা কপোল বেয়ে ঝরলো। কান্নায় গাল ভিজিয়ে, নাক টেনে সরে এলাম সামন থেকে। যে ভয়ঙ্কর ঝগড়া করার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম সব নশ্চাত হয়ে গেছে! যে ভাবে কান্নার বেগ বাড়ছে তাতে আর কিছুক্ষণ এর সামনে থাকলেই হেঁচকি উঠে যাবে আমার! ছোট বেলা থেকেই নিজের অশ্রু আর আবেগ, এই দুটো নিয়ন্ত্রনে আমি খুব অপটু। একবার কোনো কারণে কান্না শুরু হলে থামতেই চায় না!

আমি ক্রমাগত রোদন থামানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বাঁ হাতে চোখ মুছে হাঁটা ধরেছি রুমের দিকে। এখন আর পেছনে ফিরবো না আমি! একটুও না!

রুমে ঢুকেই ‘ঠাস’ করে দরজা লাগিয়ে দিলাম আমি। না, সিটকিনি লাগাই নি। সে অভ্যাস নেই। ফলোস্রুতিতে দরজাটা ‘দুম’ করে শব্দ করে আবারো ফিরে এলো। কান্না থেমে গিয়ে রাগ উঠলো খুব! আবারো জোরে ধাক্কা মারতেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো! দরজাটা না লেগে, উল্টো ‘ক্যাচ’ ‘ক্যাচ’ করতে করতে ফিরে এলো। মাথার ভেতর ক্রোধের অনল তখন দাউ দাউ করছে! ইচ্ছে করছে, এই দরজাটা খুলে আছার মেরে ভেঙে ফেলি! কিন্তু দরজা না ভেঙে সিটকিনি লাগিয়ে দিলেই যে ঝামেলা শেষ হয়ে যায় সে বুদ্ধি তখন আর নেই!

পরপর দু’ বার শব্দ শুনে সূর্য বললেন,

— “দরজাটা ভাঙতে চাচ্ছিস নাকি! এমন করে বারি দিচ্ছিস কেন?

— “হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ! ভেঙে ফেলবো আমি! ভেঙে ফেলবো এই দরজা, এই অ্যাপার্টমেন্ট, এই বিল্ডিং, অ্যান্ড আপনাকে! ভেঙে চুরমার করে দেব!”

বলেই দরজার উপর আরও একটা বারি দিয়ে চুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মেজাজ খারাপ খুব, গায়ে আগুন জ্বলছে যেন! সারা শরীরে রাগ চিড়বিড় করে উঠছে। সূর্য নামের ফালতু ছেলেটাকে তুলে আছার মারতে মন চাইছে। সব এর ষ’ড়’য’ন্ত্র! ইচ্ছে করে বিয়ে করে এখানে এনে ফেলেছে আমাকে! যেন তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে মা:রা যাই আমি! নিজে কথা বলবে না, আবার কথা বলতে চাইলে ঢং করবে!

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেল অনেকটা সময়। আমি নিশ্চুপ হয়ে বিছানার সাথে ল্যাপটে আছি। ঘুম ধরা দেয় নি চোখের পাতায়। তাই নিরব-নিস্তব্ধ-নিঝুম-নিশুতি রাতের আঁধারে অক্ষিগোলকের মনিটা সারা ঘরময় ছুটে বেড়াচ্ছে। খানিক্ষণ পর পর পাশ বদলাচ্ছি, তবুও অবস্থার পরিবর্তন নেই। একসময় ক্লান্ত হয়ে চোখ দুটো বন্ধ করলাম। চিৎ হয়ে শুয়ে মনে মনে ফিবোনাক্কি সংখ্যা নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। এটা একটা ঘুম আনার টেকনিক। মনে মনে কোনো সংখ্যা নিয়ে হিসেব কষতে শুরু করলে খুব দ্রুতই মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে আসে। অবসাদ নেমে আসে শরীরে আর মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে। আর ম্যাথে একটু কাঁচা বলে ম্যাথ সংক্রান্ত যেকোনো কিছু ভাবলেই আমার ঘুম পায়। কিন্তু আজকে আমার দ্বারা সেটাও সম্ভব হলো না। একের পর এক ট্রিক পাল্টাচ্ছি, এটা ছেড়ে ওটা, ওটা ছেড়ে আরেকটা, কিন্তু ঘুম ধরা দিচ্ছে না!

হঠাৎ অনুভব করলাম অন্ধকারের ভেতরে নিঃশব্দে কে যেন ঘরে ঢুকছে আমার। এতো রাতে ঘরে কে ঢুকতে পারে সেটা ভেবেই শিউরে উঠলাম আমি! এই দমবন্ধ ফ্ল্যাটে কখনো চোর জাতীয় লোকের অনুপ্রবেশ ঘটা সম্ভব নয়, আসলে সূর্যই আসবেন। কিন্তু সে কখনোই এ ঘরে পা ফেলবে না। কারণ এই বাসায় এভাবেই আমরা থাকি দুই জন দুই দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে। তার রুমের আশেপাশে আমি যাই না আর আমার রুমের আশেপাশে সে আসে না! তাহলে আজ হঠাৎ?

হুট করেই খুব ভয় পেয়ে গেলাম। মোটামুটি ভীরু স্বভাবের মেয়ে আমি, তাই এই মুহূর্তে এমনই যেন ভয়ে সিটিয়ে গেলাম। সূর্য ভাই এগিয়ে এসে আমার বিছানার কাছে হাঁটু মুড়ে বসলেন।

তারপর বেশ কিছুক্ষণ কোনো সাড়া শব্দ পেলাম না। ভয়ে চুপে করে শুয়ে থাকলাম। সে কিছু না বলে হঠাৎ করেই আমার খুব কাছে চলে এলো। হাতের আলতো ছোঁয়ায় ছুঁয়ে দিতে লাগলো আমার মুখশ্রী। খুব সংগোপনে একটা ঢোক গিলে ফেললাম। কী করতে চাইছে কী সে? হুট করেই আরেকটা কান্ড করলো সে। মুখের কাছে মুখ নামিয়ে এনে টুপ করে চুমু এঁকে দিলো ললাটে। আমি এবার সত্যিই কেঁপে উঠলাম। অন্ধকারে ব্যাপারটা তার দৃষ্টিগোচর হলো কী না জানি না তবে সে মুচকি হাসলো বুঝতে পারলাম। হাসির মৃদু একটা শব্দ কানে এসে বাজলো আমার।

সে আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে আমার লম্বা লম্বা চুলগুলো নিয়ে এলোমেলো করতে লাগলো। চুল এনে মুখের উপর দিয়ে আবার সরিয়ে নিয়ে শুরু করলো খেলা। এবার সত্যিই বিরক্ত হলাম।। করছে কী এ? সমস্যা কি? জ্বীন-টিন কিছু ধরছে নাকি? আজব!

তুমুল বিরক্তি নিয়েই ঘুমিয়ে গেলাম। সে তারপর কখন ঘর থেকে চলে গেছে জানি না।
____________________________

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি পুরো অ্যাপার্টমেন্ট ফাঁকা। সূর্য অনেক আগেই অফিসে চলে গেছে। এলোমেলো মন নিয়ে হেলতে দুলতে নাস্তা সারলাম। রুমে গিয়ে বসেছি হঠাৎ কাল রাতের কথা মনে পড়লো। সূর্য কাল রাতে সত্যি সত্যিই অদ্ভুত ব্যবহার করেছিল! যেটা সে আগে কখনো করে নি!

কী যেন ভেবে বিছানা থেকে নামলাম। ধীর পায়ে হেঁটে তার ঘরের সামনে এলাম। দরজাটা আলগা করে বন্ধ করে রাখা। সে ঘরে না থাকলেও এটা এভাবেই থাকে। আমি কখনোই তার ঘরের আশেপাশে আসি না, ঢোকা তো দূর!

আলতো হাতে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। ঘরের ভেতর পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ ম ম করছে। স্বাভাবিক ভাবেই আমার মস্তিষ্কে একটা কথাই ঘুরলো,

“এই ছেলে কি গোসল করে না? এতো পারফিউম ব্যবহার করে কেন? আজব। আমি মেয়ে হয়ে পারফিউম ইউজ করি না আর সে! যত্তোসব ঢং! পারফিউমের সৌরভে সুরভিত ঘরে বেশিক্ষণ থাকলে আমার পাগল পাগল লাগবে। মাতাল হয়ে যাবো! বাপ রে!”

বিছানার ওপর পড়ে আছে একটা ডায়েরী। বালিশের পাশে যত্নে রাখা। আমি কৌতূহলী হয়ে ডাইরিটা হাতে নিলাম। কালো রঙের একটা ডায়েরী। কাভার পেজ উল্টাতেই ভেসে উঠলো সূর্যের লেখা,

” তুমি আমার অব্যক্ত অনুভূতি, মৌপাখি!”
নীচে তার সিগনেচার।

আমি অবাক হয়ে পৃষ্ঠা উল্টালাম। একটার পর একটা পৃষ্ঠা। লেখায় লেখায় পূর্ন সেসব।

— “তুই এতো কেন জেদি, মৌপাখি? এতো জেদ আর এতো কেন রাগ তোর? তোর এই রাগেই যে আমার সর্বনাশ হয়েছে, জানিস তুই? সেই ছোট্টবেলা থেকে তোর এই রাগ আর জেদ দেখে দেখে আমি দূর্বল হয়েছি তোর প্রতি। তুই জানিস, তোর অভ্যাস, তোর ঝগড়াটে আচরণ, প্রতিবাদী ভাবনা, রাগে লাল হওয়া মুখ, ঠোঁটের কোণের দুষ্টুমি হাসি, আনন্দে উচ্ছ্বসিত হওয়া চেহারা আমাকে কতটা টানে?

তুই জানিস, আমি কেন তোকে এতো জ্বালাই? কেন এত চোখে চোখে রাখি? কারণ আমি তোকে ভালোবাসি। যখন বুঝতে শিখেছি ‘ভালোবাসা’ কি তখন থেকেই আমি তোকে ভালোবাসি। কিন্তু কোনোদিন বলি নি। আমি চাই নি তোর অবুঝ বয়সেই তোকে আমার ভালোবাসার শিকল পড়িয়ে বন্দী করে ফেলতে। তোকে ছেড়েছি তোর মতো করে। যেন কোনো ভূল করে না ফেলিস তাই সবসময় তোকে নজরে নজরে রাখতাম। ভেবেছিলাম কোন একটা সময় এসে তোকে আমার মনের কথা বলবো।

কিন্তু আমার ভালোবাসার কথা জানানোর আগেই তুই বদলে গেলি, সম্পর্কগুলো বদলে গেল। তুই আগের থেকেও বেশী রাগী, একগুঁয়ে আর জেদি হয়ে উঠলি। উচ্ছৃংখল হয়ে উঠলি। তোকে শাসন করলাম, তুই শোষণ ভেবে নিয়ে দূরে সরে গেলি আমার। জানিস, তখন তোর ওই অবহেলাটা আমার জন্য কতটা যন্ত্রনাময় হয়ে উঠেছিল? কতোটা পোড়াতো তোর ঘৃণাটা? আমি জানতাম তোর দোষ ছিল না কিন্তু তোকে ভালোবাসতাম বলেই তোর দ্বারা কোনো ভুল হয়ে যাক সেটা চাই নি। মিথ্যে বলে আটকে ফেলেছিলাম তোকে। সময় বদলালো, সম্পর্কটাও আগের মতো হয়ে উঠলো।

আমি নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলাম তোকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে দেয়ার জন্য। সারপ্রাইজ প্ল্যানিং করলাম, কিন্তু মাঝখান থেকে কোত্থেকে যেন উদয় হলো অর্ণবের। সেদিন তোর ভার্সিটিতে যেতেই কানে আসলো তোদের প্রেম কাহিনী! রাগে শরীর জ্বলে উঠলো। আমার ভালোবাসা কেন আমার না হয়ে অন্য কারো হবে? তোকে ডেকে সাবধান করলাম। অর্ণবকে বেনামি চিঠি দিলাম। তোরা যেন পাত্তাই দিলি না! রাগে আরও বেশি ক্ষেপে গেলাম। সেদিন হকিস্টিক নিয়ে গেছিলাম অর্ণবকে সামান্য ভয় দেখাতে। ব্যাটার সাহস বোধ হয় একটু বেশিই ছিল! তোর মতোই ঘাড় ত্যাড়া জাতের! সোজা কথার উল্টা মিনিং করলো। ক্ষেপে-টেপে গিয়ে দিলাম ঠ্যাংয়ের উপর একটা বারি! কে জানতো তাতে ওর পা ভেঙে যাবে? পা তো ভাঙলো, সাথে সাথে ছেলের সাহসও গেল হারিয়ে। ভয়ে সিটিয়ে গিয়ে বললো,

— “সরি ভাই! মাফ করে দেন!”

তখন ওর মুখ দেখে কী যে হাসি পেয়েছিল আমার! যে ছেলে একটু আগে এত বড় বড় কথা বললো, তোকে কখনোই ছাড়বে না বললো, সেই ছেলে শুধু হকিস্টিকের একটা বারি, জাস্ট একটা বারি খেয়ে পল্টি খেল? পাঁচফোড়ন তুই আমাকে পল্টিবাজ বলিস, কিন্তু তোর সেই প্রেমিক পুরুষ যে কি পল্টিবাজ সেটা আমিই বুঝেছিলাম! হা হা হা!

এরপর ভাবলাম তোকে একটা শিক্ষা দেয়া দরকার। কিন্তু কীভাবে করবো ভেবে পেলাম না। এরমধ্যে বাড়িতে তুই বিয়ের বায়না লাগিয়ে দিয়েছিস। একে তোর উপর মেজাজ খারাপ, তার উপর..

তখন আমি কি করতাম বল্ তো? তাই রাগে জেদে বিয়েটা করেই ফেললাম। আমার বাড়িসহ তোর বাড়ির সবাইকে বললাম আমরা প্রেম করছি। আমাদের বাসায় এই নিয়ে কোনো কথা হলো না। সবাই বিশ্বাস করে নিলো। কিন্তু বিশ্বাস করলো না আন্টি! আমি তাকে যতটা বোকা ভেবেছিলাম সে কিন্তু আদৌ বোকা নয়! সবসময় তোর নামে নালিশ করলে সে নির্দ্বিধায় সব বিশ্বাস করতো কিন্তু এখানে এসেই করলো না!

আন্টি ঠিক বুঝেছিল আমার মিথ্যেটা। আমাকে একলা ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল ঘটনাটা। আমি বাধ্য হয়েই সবটা স্বীকার করেছি। সাথে একটা মিথ্যেও! বলেছি অর্ণব নামে একটা বাজে ছেলের সাথে তোর দীর্ঘদিনের রিলেশন। তোর যদি এখনই বিয়ে না দেয় তাহলে বড় রকমের অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারিস! শত হোক, মেয়ের মা বলে কথা! যতোই বুদ্ধিমতী হোক, আন্টিও এ ব্যাপারটার ভয়ে শঙ্কিত ছিলেন। তাই আর কথা বাড়ান নি। আমার সাথেই তোর বিয়েটা হয়ে গেল।

আমি জানি তুই আমাকে ভালোবাসিস। তুই আমাকে না বললেও আমি জানি। অথচ তুই? ভাঙবি তবু মচকাবি না। তোর মুখ থেকে ভালোবাসার কথা শুনবো বলে তোকে এতো দিন ধরে এমন ঘরবন্দী করে রেখেছিলাম। আটকে রেখেছিলাম আমার কাছে। ইচ্ছে করেই তোর সাথে কথা বলি নি। কষ্ট দিয়েছি। ভেবেছিলাম তাতে অন্তত তোর পরিবর্তন হবে। স্বেচ্ছায় কাছে আসবি তুই। অথচ তুই? একা একা থেকেছিস, গুমরে গুমরে থেকেছিস কিন্তু তবুও তুই আমার কাছে আসিস নি। আজ এতদিন পর যখন সেই পুরোনো রূপে ফিরে গেলি আমি ভাবলাম আমার এতোদিনের সাধনা বোধ হয় সত্যিই হলো। বরাবরের মতো এবারও আমি ব্যর্থ। আমি জানি আমি খুব খারাপ, মৌপাখি! খুবই খারাপ। সেজন তুই আমাকে সহ্য করতে পারিস না। কিন্তু তারপরও তুই আমাকে ভালোবাসিস তাই না? তাহলে কি ক্ষতি হয় সেই কথাটা মুখে স্বীকার করলে? কী হয় তোর একটু নরম হলে? কী হয় আমাকে একটু ভালোবাসলে? কী এমন ক্ষতি হয় তোর?

যদি ভালোবাসা পাই
আবার শুধরে নেব
জীবনের ভুলগুলি

যদি ভালোবাসা পাই
ব্যাপক দীর্ঘপথে
তুলে নেব ঝোলাঝুলি।

যদি ভালোবাসা পাই
শীতের রাতের শেষে
মখমল দিন পাবো।

যদি ভালোবাসা পাই
পাহাড় ডিঙাবো আর
সমুদ্র সাঁতরাবো।

যদি ভালোবাসা পাই
আমার আকাশ হবে
দ্রুত শরতের নীল।

যদি ভালোবাসা পাই
জীবনে আমিও পাব
মধ্য- অন্তমিল।

যদি ভালোবাসা পাই
আবার শুধরে নেব
জীবনের ভুলগুলি।

যদি ভালোবাসা পাই
শিল্পদীর্ঘপথে
বয়ে যাবো কাঁথাগুলি… ”

[ কবিতা: যদি ভালোবাসা পাই__ রফিক আজাদ]

ডায়েরীটা পড়ে থমকে গেলাম। এসব কী লিখেছে সে? এসব আসলেই সত্যি? সূর্য সত্যি সত্যিই আমাকে ভালোবাসে? এমন চরম সত্যটা জেনে সত্যিই চমকে গেলাম। ডায়েরীটা আগের জায়গায় রেখে শূন্য মস্তিষ্ক নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম।

তব্দা মেরে বসে রইলাম অনেক্ষণ। বাকিটা সময় কীভাবে কেটে গেল জানি না। নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়া করলাম। আমার সারাটা জীবনের হিসেব করে দেখলাম সেখানে সূর্য ভাইয়ের জায়গাটা ঠিক কোথায়! আমার প্রত্যেকটা গল্পেই সে মিশে আছে। প্রতিটা ক্ষেত্রে। কখনো বকেছে, কখনো মেরেছে। শাসন করেছে। ভালো কি বেসেছে? কেয়ার নিয়েছে, যদিও সেটা ধমকের আড়ালে! কিন্তু নিয়েছে তো?

এখন আমার কী করা উচিত? সবটা মেনে নেয়া? আচ্ছা, আমিও কি তাকে ভালোবাসি না? এই যে এই নিস্তব্ধ একাকী সময়গুলো আমি একা একা বসে কাটাই তখন আমি কার কথা ভাবি? সূর্যের কথাই নয় কী? আগের দুষ্টু-মিষ্টি ঝগড়াটে সম্পর্কটাকে মিস করি না আমি? চাই না যে সম্পর্কগুলো আবার আগের মতো হোক? একশো বার চাই! কারণটা কী? আমি কি তবে তাকে ভালোবাসি?

দুপুর হয়ে এলো। জানালায় দাঁড়িয়ে দেখলাম আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। বৃষ্টি হবে নিশ্চয়!

সূর্য ফিরে এলো আজ খুব তাড়াতাড়ি। কিন্তু আমার আশেপাশেও এলো না। অবশ্য সে কখনোই আসে না। যাই হোক, তাকে আসতে দেখে কেমন উতলা হয়ে উঠলো মন। গোসল সেরে সুন্দর একটা শাড়ী পড়লাম। চোখে কাজল দিলাম। ব্যালকনি থেকে একটা গোলাপ ছিঁড়ে খোঁপায় গুঁজলাম।

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আমি সেজেগুজে তার ঘরের দরজায় এসে দাড়ালাম। ঘর ফাঁকা, সে এখানে নেই। আমি দৌড়ে গিয়ে ব্যালকনিতে দাড়ালাম। এটাকে ঠিক ব্যালকনি বলা যায় না, মিনি ছাদের মতো অনেকটা। অর্ধেকটার ছাদ আছে অর্ধেকটা খোলা মেলা। কাঁচের রেলিং দিয়ে ঘিরে রাখা ব্যালকনি। একসাইডে কয়েকটা ট্রেডস্ক্যান্টিয়া (tradescantia), ওয়াক্স বেগোনিয়া (wax begonia), নীল রঙের মর্নিং গ্লোরি (morning glory) গাছ লাগানো। খুব সুন্দর গোছানো একটা ব্যালকনি। মানুষটার মতোই পরিপাটি, নির্মল, সুন্দর!

সূর্য উল্টো ঘুরে দাড়িয়ে আছে। বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে। সে নিশ্চুপ, নিশ্চল হয়ে দাড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার আকাশপানে। হাত দুটো প্রসারিত করে ব্যালকনির রেলিংয়ে রাখা। আমি ছুটে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। সে অবাক হলো, চমকালো। আমি পাত্তা দিলাম না। দু’ হাতে তার বলিষ্ঠ শরীরটা আকঁড়ে ধরে পিঠে মুখ গুঁজে দিয়ে বললাম,

— “ভালোবাসি!”

সূর্য এক ঝটকায় পেছনে ফিরে তাকালো। আমার দিকে তাকাতেই নিজের অজান্তেই চোখের কোণা দিয়ে বয়ে গেল অশ্রুজল! সে অবিশ্বাসে অস্পষ্ট স্বরে বললো,

— “কি বললি?”

— “ভালোবাসি!”

বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। জানি না কেন কাঁদছি। তবুও কাঁদতে ভালোলাগছে। সে খানিকক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে হঠাৎই জড়িয়ে ধরলো আমায়। কারো আদুরে ছোঁয়া পেয়ে আরও বেশি আহ্লাদে কান্না পেল আমার। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে বললাম,

— “আপনি মহা পল্টিবাজ সূর্য ভাই, মহা পল্টিবাজ! অ’স’ভ্য, অ’ত্যা’চা’রী, ব্রিটিশ! আপনি জেনে বুঝে এতদিন ধরে আমাকে কষ্ট দিয়েছেন। আপনার নামে আমি মামলা দিবো। জেলে দেব আপনাকে!..”

আমার কঠিন হুঁশিয়ারি শুনে সে হাসলো। হেসে আমার নাক টেনে দিয়ে বললো,

— “ঠিক আছে, দিস। আপত্তি নেই। তবে জেলে পাঠালে বরের সাথে তার বৌকেও পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করিস! নয় তো বৌ পাগলা বর আবার বৌয়ের টানে হাজত থেকে পালাবে! ”

বলেই হাসতে লাগলো সে। আমি লাজুক হেসে তার বুকের উপর মাথা এলিয়ে দিলাম। বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যাচ্ছি দুজনে। সে খেয়াল নেই। মৃদু গলায় বললাম,

— “আপনি সত্যিই আমায় ভালোবাসেন?”

— “জানি না। হয় তো হ্যাঁ।”

— কেন বাসেন?”

— “তুমিময় গল্পগুলোতে ‘তুমি’কে ভালো না বাসলে সেটা গল্প হয় না। আমার গল্পটা যে পুরোটাই তুমিময়। তুমিময় আসক্তি, তুমিময় ঝগড়া, তুমিময় ভালোবাসা, তুমিময় প্রেম। গল্পটাই যখন তুমিময় তখন সেই ‘তুমি’কে ভালো না বেসে থাকা যায়? তাই আমি এই ‘তুমি’কে ভালোবাসি!”

প্রেমিকের কাব্যিক কথা আমার কোনোকালেই ভালো লাগতো না। কিন্তু আজ লাগলো। ভয়ঙ্কর ভাবে মন ছুঁয়ে গেল তার কথা! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কারণটা অবশ্য জানা নেই। সম্ভবত প্রেমের হাওয়া লাগলে সবারই এমন হয়!

এমন মুগ্ধময় পরিস্থিতিতে একটা ভয়ঙ্কর কান্ড করে বসলাম। টুপ করে চুমু খেয়ে বসলাম তার গালে। সে স্তম্ভিত চাহনিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো,

— “তুই আজকেও ব্রাশ করিস নি, পাঁচফোড়ন? ছিঃ! হাউ নোংরা!”

আমি চমকালাম। এই রোমান্টিক ওয়েদারে, এই রোমান্টিক মুড টাইমেও কেউ এমন কথা বলতে পারে আমি জানতাম না! দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বললাম,

— “ইয়ে মানে.. আপনাকে জ্বীনে-টিনে ধরলো নাকি সেই টেনশনে ব্রাশ করতে ভুলে গেছি! হি হি। সরি!”

— ” তুই আমাকে ব্রাশ না করেই চুমু খেয়ে ফেললি? ছিঃ!.. তোর সরির আমি খেতা পুরি! দুপুর হয়ে যাচ্ছে এখনো ব্রাশ করে নি, গ্যাদরা কোথাকার! যা ব্রাশ করে আয়!.. ছিঃ ছিঃ! আমার ভাবতেই বমি পাচ্ছে। ওয়াক ওয়াক!”

রাগে মুখ লাল হয়ে উঠলো। সামান্য একটা ব্রাশ না করে চুমুর জন্য এতো কথা? তোকে আর জীবনেও চুমু খেলে বলিস! যত্তোসব ফাউল! কোথায় খুশি হয়ে আরেকটা চুমু দিবে তা না। ন্যাকার ষষ্ঠী!

— “কি হলো? এখনো যাচ্ছিস না কেন?.. ইসস তোর মুখের গন্ধে আমার বমি বমি পাচ্ছে। প্রেগনেন্ট মহিলা লাগছে নিজেকে। এই যা বলছি, যা!”

ভয়ঙ্কর রাগ নিয়ে ধুপধাপ পায়ে হেঁটে আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। ব্যা’টা ব’দ! ব্রাশ খোঁজার জন্য ওয়াসরুমে যাচ্ছি তখন শুনলাম সে চেঁচাচ্ছে,

— “ইয়ে, মানে.. পাঁচফোড়ন! শোন একটা কথা.. ব্রাশ করে আমার ঘরে আসিস তো! একটা চুমু খাবো। আমি তো তোর মতো নোংরা না, ব্রাশ করা আছে। আসিস প্লীজ!..”

কী সাবলীল তার ভঙ্গি! তবুও খোঁচা মারা। কিন্তু কথাটা কি ছিলো? ভাবতেই লজ্জা লাগলো আমার। ইসস! এতো কেন লজ্জা লাগছে আমার? আড়ষ্ট হয়ে এগিয়েছি তখন আবারো শুনতে পেলাম,

— “না আসলে কিন্তু তোর খবর আছে বলে দিলাম। কান ধরে লন্ডনের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখবো! বি কেয়ারফুল!”

ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি! লজ্জায় দৌড়ে গিয়ে ঢুকলাম ওয়াসরুমে। আমি আর তার সামনে যাবো না। একদমই না। তাতে যদি লন্ডনের রাস্তায় কান ধরে দাঁড় হতে হয় তো হবো। তবুও ওর সামনে যাবো না।…

অতঃপর? অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল! প্রেমে প্রেমে পূর্ন হইয়া উঠিল তাহাদের আলয়! প্রিয়জনের ভালোবাসায় সিক্ত হইয়া কাটিয়া গেল তাহাদের বাকি জীবন!

———- সমাপ্ত ———–

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে