গল্পটা তুমিময় পর্ব-০২

0
1508

#গল্পটা_তুমিময়💕
#পর্বসংখ্যা_২
#মৌরিন_আহমেদ

ভাবতে ভাবতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে আমি এখন ছুটছি সূর্য ভাইদের বাড়ির দিকে। কলিং বেল বাজাতেই রুৎবা দরজা খুলে দিলো। আমাকে দেখেই চাপা হাসি দিয়ে বললো,

— “আরে মৌরিপ্পি! বিয়ে না হতেই শ্বশুর বাড়ি চলে এলে? বাহ্ ভালো তো! আরেকটু অপেক্ষা করতে বিকেলের জন্য। একেবারে ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ তুলে আনতাম!”

বলেই দুষ্টু হাসলো। সে কথায় বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলাম না। ক্ষোভ মিশ্রিত হাসি দিয়ে বললাম,

— “কি আর করবো বলো? তোমরা এমন মানুষ যে বিয়ের কনেকে না বলেই তার বিয়ে-টিয়ে ঠিক করে ফেলেছ! ভাগ্যিস সকালে জানলাম, নয় তো দেখা যেত বিকেলে একেবারে বিয়ের আসরে কাজী এসে বলতো বলো, ‘কবুল!’ তখন কি হতো ভাবো তো?”

রুৎবা আমার কথা শুনে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। সে আমার কথার আড়ালে আবডালে লুকিয়ে থাকা ক্ষোভ টা ধরতে পারে নি। আমার কাঁধে চাপড় মেরে বললো,

— “তখনই তো আসল মজাটা হতো, আপ্পি! হেবি একটা সারপ্রাইজ হয়ে যেত তোমার জন্য!”

— ” বলেছে তোমায়! দেখা যেত, ভয়ে আমার হার্ট এ্যাটাক-ফ্যাটাক কিছু একটা হয়ে যেত! হুহ!”

আমি গাল ফুলালেই রুতবা হেসে হেসে আমাকে টেনে ধরে রুমে নিয়ে চললো। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে বললো,

— “কিন্তু আপ্পি! আমি কিন্তু তোমার উপর খুব রাগ করেছি!”

— “কেন?” ভ্রু কুঁচকে শুধোলাম।

— “এই যে তুমি আর ভাইয়া, লুকিয়ে লুকিয়ে এতোদিন ধরে প্রেম করেছো। কই আমাকে তো বলো নি? আমি আরও ভেবেছিলাম তুমি যখন প্রেম করবা তখন জিজুর কাছ থেকে আচ্ছা সে টাকা হাতিয়ে নিবো। ওদিকে ভাইয়ার জন্য ভেবে রেখেছিলাম ওর নামে নালিশ দিয়ে ভাবির কাছে একবার টাকা নিবো, আবার ভাবির ভয় দেখিয়ে ওর কাছ থেকে আরেকবার নিবো। আর তোমরা দুজন কী করলে? আমার তিন পাশ দিয়ে টাকা আসার রাস্তা ফুরুৎ করে নষ্ট করে দিয়ে একেবারে বিয়ের কথা বললে? এইটা কি ঠিক হলো, বলো আপ্পি? তুমি আমার সাথে এইটা করতে পারলে?”

রূতবা কেমন দুঃখী দুঃখী মানুষের গলায় বলে আমার দিকে তাকালো। আমি অবাক হয়ে ওর কথা শুনলাম। ও এসব কি বললো? প্রেম করেছি? তাও আমি আর সূর্য? আমি কী বাংলাদেশে না মহাকাশে? ওরে, কে কোথায় আছিস ধর রে আমায়! আমার মাথা চক্কর দিচ্ছে!

ওকে কোনোমতে সামাল দিয়ে চুপিচুপি সূর্য ভাইয়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালাম। দরজা বন্ধ না, ভেজিয়ে রাখা। আলতো হাতে টোকা দিতেই খুলে গেল। বিছানায় সূর্য ভাই শুয়ে আছেন। গায়ের উপর একটা কাঁথা এলোমেলো করে ছড়িয়ে রাখা। সে উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘরে ঢুকতে অস্বস্তি লাগলো আমার। কিন্তু ঘরে তো ঢুকতেই হবে! এই বিয়ের একটা হেস্তনেস্ত না করে তো আমি বাড়ি যেতে পারি না! সো যে করেই হোক আমাকে যেতে হবে।

অস্বস্তি নিয়েই রুমে ঢুকে পড়লাম। বিছানার কাছে গিয়ে দাড়িয়ে মৃদু গলায় ডাক দিলাম,

— “সূর্য ভাই! সূর্য ভাই! ওঠেন প্লীজ! আপনার সাথে আমার জরুরি কথা আছে!”

ভালো করেই ডাকলাম কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো জবাব দিলো না। আমি আরও একবার একই ভাবে ডাকলাম। তাতেও যখন সাড়া দিলো না তখন অনেকটা বাধ্য হয়েই এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে ডাকলাম,

— সূর্য ভাই! শুনছেন? ও সূর্য ভাই!”

— “কানের কাছে সারাদিন ‘ভাই’ ‘ভাই’ বলে বলে জ্বালাস না তো! যা এখান থেকে!”

সে ঘুমঘুম কণ্ঠেই জবাব দিলো। চোখ এখনোও মেলে নি তাহলে কি সজ্ঞানে বললো? কিন্তু আমি তো সারাজীবন সূর্য ভাই বলেই ডেকে এসেছি। কোনদিন কিছু বলে নি তাহলে হঠাৎ? সে যাক গে! আমি আবারো ডাকলাম,

— “আপনি কি উঠবেন প্লীজ? দেখেন, আমি কিন্তু আজাইরা প্যাঁচাল পারতে আসি নি। আপনি একটু উঠেন, আমার কথা শুনেন। তারপর আমি চলে যাচ্ছি। ওঠেন, প্লীজ!”

কিছুক্ষণের মধ্যেই সে নড়েচড়ে উঠলো। ঘুমগঘুম চোখ কচলাতে কচলাতে বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে চশমা তুলে নিলো। সেটা চোখে পরতে পরতে বললো,

— “তুই? এত সকালে? আমার ঘরে? কোন দুঃখে?”

কণ্ঠে তার হাজারো বিরক্তি। আমিও বিরক্ত হয়েই বললাম,

— “গুরুত্বপূর্ন কথা বলতে এসেছি। না হয় আমার ঠ্যাকা পড়ে নি..”

— “লম্বা ভূমিকা না বলে আসল কাহিনী বল্। বলে ফুট এখান থেকে! আমার ঘুমটা..”

ঢং দেখে মনে হচ্ছে যেন তাকে এইসময় ডাকতে এসে মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলেছি আমি! ন্যাকা! নিজে যে আমার ঘুম, শান্তি, সব হারাম করে বসে আছে তার বেলা? রাগ হয়ে তার দিকে একেবারই ঝুঁকে পড়লাম আমি। মুখের কাছে মুখ এনে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

— “খবরদার, একদম ন্যাকামো করবেন না! আমি তো শুধু আপনার ঘুম ভাঙিয়েছি.. আর আপনি? ঘুম থেকে উঠেই মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়েছে! এসব শুরু করেছেন আপনি, হ্যাঁ? কীসের বিয়ে.. কীসের কী..”

আমার কথা শেষ করতে দিলো না সে। চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

— “সকালে ব্রাশ করেছিলি তুই?”

সিরিয়াস মোমেন্টে এই আজিব কোয়েশ্চেন শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল আমার! খিটমিট করে উঠলাম,

— “নাহ্!”

— “এই জন্যই! এই জন্যই এই বিচ্ছিরি গন্ধটা আসছে! ছিঃ পাঁচফোড়ন, ছিঃ! তুই ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ না করেই আমার বাসায় এসেছিস? ছিঃ, গন্ধে আমার বমি আসছে! ওয়াক থু!”

বলেই মুখটা বিকৃত করলো। সকালে ব্রাশ করি নি কথা সত্যিই, কিন্তু গন্ধ তো হওয়ার কথা না। কিন্তু এ এরকম করছে কেন? হঠাৎ নিজের কাছে নিজেই বিব্রত হয়ে গেলাম। ডান হাতটা মুখের কাছে এনে ভাপটা বোঝার চেষ্টা করলাম। কই না তো! তাহলে?

কিছুক্ষণ আবালের মতো চেয়ে থাকতে থাকতেই ব্যাপারটা মাথায় ঢুকলো। এই পল্টিবাজ ছেলে এখন পল্টি মারার জন্য কথা ঘুরাচ্ছে। চেষ্টা করছে আজাইরা কথা বলে আমার মাথা থেকে আসল কথাটা বের করে দিতে। সবসময় এমন আজাইরা কাজ করে সে! সবটা সময়! ভাবতেই মুহূর্তেই চিড়বিড় করে উঠলো রাগটা। বললাম,

— “একদম মিথ্যে বলবেন না! আমি রাতের বেলায় ব্রাশ করেছি। মুখে কোনো গন্ধই নেই। আজাইরা প্যাঁচাল পেরে কথার টপিক চেঞ্জ করার ট্রাই করবেন না। আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি আপনার চালাকি!..”

— “এই চুপ কর! ছিঃ কী গন্ধ! পাঁচফোড়ন, আল্লাহ ওয়াস্তে তুই ওয়াশরুম যা, অন্তত কুলি করে আয়! প্লীজ! তোর মুখের বিশ্রী গন্ধের ঠ্যালায় আমাকে পটল তুলতে বাধ্য করিস না!”

তার অ্যাক্টিং দেখে রাগটা তুঙ্গস্পর্শী হলো। আমি আরও এগিয়ে এসে কলার চেপে ধরে বললাম,

— “একদম ঢং করবেন না। আমি কাল রাতে ঘুমানোর আগেই ব্রাশ করেছি। মুখে কোনো গন্ধই নেই। বিশ্বাস না হলে এই দেখুন!.. ”

বলে ইচ্ছে করেই তার মুখের কাছে এগিয়ে ক্লোজ আপ অ্যাডের স্টাইলে ভাপ ছেড়ে দিলাম। সে ‘ওয়াক থু’ বলে একঝাপে পেছনে সরে গেল। নাক মুখ সিঁটকে বললো,

— “তুই, তুই, এতো নোংরা হলি কবে থেকে, পাঁচফোড়ন! ছিঃ ছিঃ! এতো গ্যাদরা টাইপের একটা কাজ ক্যামনে করলি? ওয়াক ওয়াক!..”

— “ঠিক হয়েছে! যা করেছি, বেশ করেছি! বেশি ন্যাকামো করেন আপনি। বললাম তো রাতে ব্রাশ করেছি আমি। এখন কি ঘুম থেকে উঠেই আবার ব্রাশ করতে হবে? আজব! এখনো কিছুই খাই নি আমি। নাস্তা খাবো তারপর না…”

— “তোর কাছে কী আমি তোর ব্রাশের ফিরিস্তি শুনতে চেয়েছি? এতো বেশি পকপক করিস কেন তুই? আর একটা কথাও বলবি না। যা, ওয়াশরুম। এক্ষুণি যা। কুলি না করে যদি এসেছিস সত্যি কথা, তোর আজকে খবর আছে!..”

ভয়ঙ্কর একটা হুঁশিয়ারি শুনেও চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম। এতক্ষণ ধরে আমি যা করেছি ইচ্ছে করেই করেছি। মুখের গন্ধ নিয়ে যে সে এতো ওভার রিয়েক্ট করলো সেটার জন্যই এটা করেছি। সোজা ভাষায় tit for tat!

— “কি হলো? দাড়িয়ে আছিস যে?.. যা বলছি! দেখ পাঁচফোড়ন তুই যদি এইমুহুর্তে না যাস আই সয়ার তোর কপালে আজকে দুঃখ আছে। এমনই সক্কাল সক্কাল তুই আমার আরামের ঘুমটা হারাম করে দিয়েছিস! মেজাজ এমনই বিগড়ে গেছে তার মধ্যে তোর এই বিশ্রী, উদ্ভট কার্যক্রমে আমার মেজাজ আরও খারাপ হচ্ছে। যা বলছি!”

শেষ কথাটা আরও বেশি ধমকে উঠে বললো। যতোই ত্যাড়ামো করি না কেন বরাবরের মতোই এবারও তার ধমক খেয়ে আমার সব সাহস ফুস করে উবে গেল! মেজাজ রাগে টগবগ করে উঠলেও চুপচাপ সামন থেকে বেরিয়ে গেলাম। পেছন থেকে আবারো ডাক পড়লো,

— “ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস? ওয়াসরুমটা যে এদিকে চোখে পড়ে না?”

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ওয়াসরুমে ঢুকলাম। মেজাজ দেখিয়ে মুখে পানি ছিটাতে গিয়ে ওড়না আর চুলের অর্ধেক ভিজিয়ে ফেললাম। এমনই মেজাজ খারাপ তারমধ্যে আরও বেশি খিটমিট করে উঠলাম। সূর্য ভাই সত্যিই বলে, আই অ্যাম অ্যা ডাফার! একটা কাজও যদি ঠিকঠাক মতো করতে পারতাম! ধ্যাত!

ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই মুখের সামনে নিজের টাওয়াল ঝুলিয়ে দিলো সূর্য ভাই। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

— “একটা কাজও ঠিক করে করতে পারিস না! মুখ ধুতে গিয়ে গোসল করে এসেছিস! আক্কামা একটা!.. ধর, মুখ মোছ!”

বলেই আমার মুখের উপর টাওয়েলটা টা চটকা দিলো। রাগে কটমট করে তাকিয়ে সেটা হাতে নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে মারলাম। বললাম,

— “আমার কি গামছার অভাব পড়েছে? আপনার জিনিস নিবো কেন আমি, হ্যাঁ?”

— “আপনার গামছাটা কি এইখানে আকাশ থেকে পড়বে? না বাড়ি গিয়ে মুখ মুছবি? ঠিক আছে, যেতে পারিস। সমস্যা নাই, বাইরে যখন আমার আত্মীয়-স্বজনরা জিজ্ঞেস করবে মুখ ভেজা কেন তখন বলিস, তোর বর তোকে পানিতে চুবিয়ে ধরেছিল!”

তার উদ্ভট কথা শুনে মেজাজ গরম হয়ে গেল। কাজের কথা নেই, হুদায় ফ্যাচ ফ্যাচ করে খালি! তাকে সম্পূর্ন উপেক্ষা করে এগিয়ে গিয়ে ড্রয়ারের উপর থেকে টিস্যুর বক্সটা তুলে নিলাম। এক টান দিয়ে একেবারে চার পাঁচটা টিস্যু নিয়ে মুখ মুছতে শুরু করলাম। আমার কান্ডকারখানা দেখে লাফিয়ে উঠে হাত থেকে বক্সটা কেড়ে নিলো সূর্য ভাই। খিটমিট করে উঠে বললো,

— “অমন জলহস্তীর মতো করে টিস্যু নিচ্ছিস কেন? জীবনে টিস্যু দেখিস নি?

— “একদম কথা ঘুরাবেন না! একদম না!.. অলরেডি আমি কি কী বলতে এসেছিলাম সব ভুলে গেছি। আর একটা কথাও বলবেন না.. এখন যা বলার আমিই বলবো!”

মোটামুটি কঠিন গলায় কথাটা উচ্চারণ করলাম। সে যেন পাত্তাই দিলো না! গালের উপর হাত রেখে ঢং দেখিয়ে আমার সামনে এসে বসলো। ন্যাকা ন্যাকা কণ্ঠে বললো,

— “মাননীয় স্পিকার, এখন বলুন আপনি। কি বলিতে চান?”

— “বিয়ে নিয়ে কী করতে চাইছেন? আমার বাসায় কী বলেছেন? কেন সবাই বলছে আজ আমার বিয়ে?..”

রাগ লাগলেও ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করলাম। সে নির্বিকার চিত্তে বললো,

— “বারে! তোর বিয়ে হলে সবাই বলবে না তোকে? কি সব বলিস না তুই?..”

— “কাম টু দ্যা পয়েন্ট! কোনরকম হাংকি-পাংকি করবেন না। ডিরেক্ট যা জিজ্ঞেস করেছি তাই বলবেন! বাড়তি কথা না।.. বিয়েটা কি আপনার কাছে ছেলেখেলা মনে হচ্ছে? আপনার সাথে কী আমার ভালোবাসা-বাসির সম্পর্ক? যে আমরা বিয়ে করবো?.. আর রুতবাকে কি বলেছেন? আমরা প্রেম করতাম? আস্ত মিথ্যুক একটা!”

— “তুই মিথ্যুক! আমি যা বলার তাই বলেছি। ইভেন শুধু রুতবাকে না আমি সবাইকেই বলেছি আমরা দুজন প্রেম করছি। ওটা না বললে তোর সাথে আমার বিয়েটা দিতো না।..”

তার নির্বিকার ভঙ্গি দেখে গা জ্বলে উঠলো আমার। সাথে হতাশও হলাম। মিইয়ে যাওয়া গলায় বললাম,

— “এমনটা কেন করছেন, সূর্য ভাই? আমি জানি আপনি সবটা রিভেঞ্জের জন্য করছেন। কিন্তু এটার জন্য প্লীজ আমার লাইফটা শেষ করে দিবেন না! প্লিজ!..”

— “এক্সাকটলি! আমি রিভেঞ্জের জন্যই করছি। তোকে পইপই করে বারণ করে দেয়ার পরও তুই আমার পেছনে লেগেছিস! খুব শখ ছিল না আমার বিয়ের দাওয়াত খাওয়ার? নে, এখন বৌ সেজে নিজের বিয়ের দাওয়াত খা!”

— “সূর্য ভাই! এমনটা করবেন না প্লীজ! আমি আর এমন করবো না..”

অসহায় হয়ে বললাম। কিন্তু পাত্তাই দিলো না! উল্টো ভাব দেখিয়ে বললো,

— “সেটা তোর আগে ভাবা উচিত ছিল! যেহেতু তখন ভাবিস নি সেহেতু এখন আর ভাবতে হবে না!..”

— “বিয়েটা তো ছেলেখেলা নয়! দুইটা মানুষের সারাজীবনের ব্যাপার!.. আপনি কেন শুধু শুধু রিভেঞ্জের জের ধরে.. আই রিকোয়েস্ট ইউ, প্লীজ ডোন্ট ডু ইট! প্লীজ!.. বিয়েটা আটকান!”

— “উহুম! সম্ভব না!.. যা হবার হয়ে গেছে। আগে যদি বলতি তাও হতো। এখন আর হবে না। অলরেডি আমার বিয়ে উপলক্ষে আমার দাদী, কাকা-কাকিমারা চলে এসেছেন। পাড়ার লোকে জেনেছে আজ আমার বিয়ে। এই বিয়ে ভাঙলে আমার আর বিয়ে হবে ভেবেছিস? পাত্রী পক্ষ আসলেই তো বলবে ছেলের আগে বিয়ে ভেঙেছিল।.. তখন.. তখন.. মেলা ঝামেলা। আমি ওসবের মধ্যে নেই।..

তুই যা তো এখন এখান থেকে! বাড়ি গিয়ে সাজগোজ কর। আফটার অল বিয়ে আমি একবারই করছি। সো আমার বৌ পেত্নীমার্কা সাজে থাকবে সেটা কিছুতেই মেনে নিবো না আমি। ক্যামেরা ম্যান আসবে। ফটোশুট হবে। যা গিয়ে সাজগোজ কর!.. আর শুন, বাড়ি গিয়ে ব্রাশ করবি। খবরদার! ব্রাশ না করে যদি বিয়ের পিড়িতে বসিস তো!..”

আজাইরা প্যাঁচালের ডালি সবসময় আজাইরা প্যাঁচাল পারে! এই বিয়ে ভাঙলে নাকি তার আর বিয়েই হবে না! এহহ! কোথায় আমি পাত্রী হয়ে বসে বসে ভাবছি বিয়ে ক্যামনে আটকাবো, বিয়ে ভাঙলে আমার কি হবে সেটা নিয়ে কোনো চিন্তাই করছি না, আর সে কি না ভাবছে এই বিয়ে ভাঙলে আর বিয়ে হবে না! যত্তোসব ঢংয়ের আলাপ। হুহ!

এতসব কথার পর ঠিকঠাক বুঝে গেলাম বিয়ে নিয়ে এই ব’দ’টা’কে কিছু বলে লাভ নেই। ‘ধুপধাপ’ পায়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলাম। যা করার আমিই করবো! বাড়ি যাই আগে! আসার আগে শুধু দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,

— “বেশ! বিয়ে করার যখন শখ জেগেছে করেন বিয়ে! আমিও এর শেষ দেখে ছাড়বো! বিয়ে যদি সত্যি সত্যিই হয়ে যায়, আপনার জীবন আমি ত্যানা-ত্যানা করে যদি না ছেড়েছি!..”

— “কে কার লাইফ ত্যানা-ত্যানা বানায় না ছেঁড়া-ছেঁড়া বানায় দেখা যাবে!”
______________________

বাড়ীতে ফিরে দেখি ফ্ল্যাটের দরজা হাঁট করে খোলা। যেমনটা রেখে গিয়েছিলাম। ভেতরে ঢুকেই জোরে শব্দ করে দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। শব্দ শুনে ছুটে এলো মা। রাগী রাগী কণ্ঠে বললো,

— “আরেকটু জোরে শব্দ করতে পারিস নি? আরেকটু জোরে করতি! লোকে জানতো আমার বাড়ীতে তোর মত একটা ডাকাত মার্কা মেয়ে আছে!..”

— “পারলে আরও জোরেই করতাম। এমন জোরে করতাম যেন এই দরজা ভেঙে দুই খন্ড হয়ে যায়!.. ”

— “কোথায় গিয়েছিলি তুই? খাওয়া দাওয়া না করে কোন রাজকার্যে গিয়েছিলি শুনি?”

কথার প্রসঙ্গ বদলালো মা। আমি সে কথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না। সোজা পায়ে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছি তখনই মা আরেকবার বললো,

— “যত যাই কর, বিয়েটা আজকেই হচ্ছে!.. আমি জানি সূর্যের সাথে তোর প্রেম-ট্রেম নেই। ও মিথ্যে বলেছে, কিন্তু তারপরও এই বিয়েটা হচ্ছে। তাই এতো গাল ফুলিয়ে রেখে কোনো লাভ নেই। বুঝেছিস?.. ডাইনিংয়ে খাবার আছে খেয়ে নে!..”

বলেই আর দাড়ালেন না। নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি মোটামুটি অবাক হয়ে শুনলাম তার কথা। মা জানে সূর্য ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক নেই, তবুও কেন? সেই কথা ভাবতে গিয়েই মনে হলো আমার ভয়ঙ্কর খিদে পেয়েছে! লোকে বলে, চরম দুঃখের সময় খিদের কষ্ট মানুষের মনে থাকে না। কিন্তু আমার? মাথার উপর যখন বিয়ের হাজার টেনশন তখনো খিদেয় পেট অস্থির! উফ্! কেন এই খাওয়ার সিস্টেমটাই পৃথিবী থেকে ঊঠে যায় না?

খাওয়া দাওয়া সেরে রুমে এসে বসেছি। ফোন হাতে নিয়ে নিরাকে কল লাগালাম। নিরা আর হিয়া আমার দুই বেস্ট ফ্রেন্ড। আমার লাইফের যেকোনো সমস্যায় এদের আমি পাশে পেয়েছি। যদিও পরিচয় বেশিদিনের না! ভার্সিটিতে উঠার পর পরই বন্ধুত্ব। তবুও ওরা খুব ভালো।

প্রথমবার কল রিসিভ হলো না। ব্যস্ত হয়ে অনলাইনে মেসেজ দিলাম। ফেসবুক, ইনস্ট্রা, হোয়াটস অ্যাপ– সবজায়গায় টেক্সট পাঠালাম। নো রেসপন্স! বাধ্য হয়ে হিয়ার কাছে কল দিলাম। এর তো আরও খবর নেই! ফোন বন্ধ করে রেখেছে! উফ্! আমার এই চরম বিপদের সময় এরা লাপাত্তা হলো কেন!

ঠিক দশ মিনিট পর নিরা কল ব্যাক করলো। ফোন রিসিভ করতেই চরম বিশ্রী কিছু গালি উপহার দিয়ে বললো,

— “বজ্জাত মাইয়া! বিয়ের দিনে বর রে কল দেয়া বাদ দিয়া আমারে কল দেস ক্যান? আজব! একটু শান্তিতে ঘুমাবো তোর জ্বালায় তাও হবে না! এমনিতেই কাল রাতে ঘুমাই নাই..”

— “তোরে কী আমি ঘুমাইতে নিষেধ করছিলাম? আমারে দোষ দিস ক্যান?.. আর বিয়ার কথা তোরে কে কইলো?” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলাম।

— “কে আবার! আমার হ্যান্ডসাম জিজু বলেছে! তুই যে কিপটার কিপটা তাতে তো মনে হয় না দাওয়াত দিতি! যাই হোক, সূর্যভাই দিয়া দিছে। আমি সময় মতো চলে আসবো, সমস্যা নাই!”

নিরার কথা শুনে ঠিক কী রিয়েকশন দিবো ভেবে পেলাম না। ইচ্ছা করলো চড় দিয়ে ফাজিলটার দাঁতগুলো সব ফেলে দেই। সাথে রাগ উঠলো সূর্য ভাইয়ের উপর! যদি একবার বাগে পাইতাম! উফ্!

এখন এসব রাগারাগি করে লাভ নেই। এখন এই বিয়েটা ভাঙার জন্য হেল্প লাগবে আমার। আর সেটা নিরাই করতে পারবে! তাই সুর বদলে নরম গলায় বললাম,

— “নিরা শোন, তোর সাথে আমার জরুরি কথা আছে। তুই কি একটু আমার বাসায় আসতে পারবি? প্লীজ দোস্ত, একবার আয়?”

— “আরে আসবো তো! তোর বিয়েতে আমি না আসলে হয়?.. একটু পরেই চলে আসবো। কেবল তো ঘুম থেকে উঠলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে, নাস্তা সেরে তারপর আসি?”

— “তুই বুঝতে পারছিস না, ইয়ার! আমি যথেষ্ট প্যারার মধ্যে আছি। তুই এখন না আসলে বলে বোঝাতে পারবো না।”

— “প্যারার মধ্যে থাকবি না তো কি? বিয়ের কনের প্যারা থাকবে না? ফেসিয়াল, সাজগোজ, খাওয়া-দাওয়া কতকিছু!.. শোন, টেনশন নিস না। সুন্দর করে ফেসপ্যাক লাগিয়ে বসে থাক। গোসল করে, শ্যাম্পু দিয়ে ভালো করে চুল ধো। তারপর ওয়েট কর। আমি আসতেছি, একসাথে পার্লার যাবো। বুঝছিস? হিয়ারেও আনতেছি.. আর পারলে এখনই সারাদিনের খাওয়া খেয়ে নে। পার্লারে ছোটাছুটি করতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া কিছুই হবে না। অবশ্য সমস্যা নাই। বিয়ের দিন কনে না খেয়ে থাকলে কিছুই হয় না। রাতের বেলা বরের আদর খেলেই… ”

নিরার কথা শেষ করার আগেই কলটা কেটে ফোনটা চটকা মেরে দিলাম। কপাল করে এমন বান্ধবী পেয়েছি! যে কি না, বিপদে বন্ধুর সাহায্য করা বাদ দিয়ে উল্টো আজাইরা কথা নিয়ে বসে আছে! রাগে হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে! বিছানার ওপর চিৎপটাং হয়ে শুয়ে মনের দুঃখে আফসোস করতে শুরু করলাম,

— “আহারে! এই জীবন, এই জীবন দিয়া আমি কি করমু? আমি মইরা যামু রে! মইরা যামু!”

বসে বসে দুঃখবিলাস করছি। হঠাৎ মাথার ভেতর একটা বুদ্ধি যেন উঁকি দিলো! মোটু-পাতলু কার্টুনের পাতলুর মতো করে আইডিয়ার একশো ওয়াটের বাল্ব জ্বলে উঠলো। লাফিয়ে উঠে নিজে নিজেই বললাম,

— “আরে আমি কি জরিনা, ছকিনা নাকি? যে আমারে ধইরা বিয়া দিতে চাইলেই আমি বিয়া করমু?.. অসম্ভব! আই অ্যাম মৌরি। এই মৌরি ভাঙবে তবু মচকাবে না! দরকার হয় পালিয়ে যাবো। ইয়েস! আমি পালিয়েই যাবো! যাবো মানে যাবোই।”

ভেবেই লাফ দিয়ে উঠে আলমারির কাছে গেলাম। কিছু কাপড় -চোপড় নিয়ে একটা ব্যাগে ভরে নিলাম। সাথে টাকাও। সুতি একটা থ্রি পিচ পড়ে ফেললাম। এটা পড়েই যাবো। কিন্তু এখন একটা বোরকা দরকার! বোরকা পাই কোথায়?

চুপিচুপি পায়ে মায়ের ঘরে উঁকি দিলাম। মা কিংবা বাবা একজনও ঘরে নেই। মা সম্ভবত রান্নাঘরে আর বাবা বাজারে-টাজারে কোথাও একটা গেছে। আমি কোনো কিছু না ভেবেই আলমারির ভেতর থেকে মায়ের আদিম কালের একটা বোরকা বের করলাম। যেটা মা এখন আর ইউজ করে না। সাথে একটা শাড়ীও নিয়ে নিলাম, সেটাও পুরোনো। কারণ, নতুন জিনিসের খোঁজ মানুষ নেয়, পুরোনোটার নয়। মা যদি এটাও খোঁজ করে যে আমি কি পরে পালিয়েছি সেটাও বলতে পারবে না।

রুমে এসে একটা কাগজে চিরকুট লিখলাম। তিন বাক্যের ছোট্ট একটা চিরকুট,

— “আমি এই বিয়েটা কিছুতেই করতে পারি না, বাবা-মা। তাই পালিয়ে যাচ্ছি। যদিও আমার কাছে মনে হচ্ছে না আমি কোনো অপরাধ করছি। তবুও আমি ক্ষমাপ্রার্থী! পারলে মাফ করে দিও।”

বোরকা পরে, হাতে শাড়িটা নিয়ে গেস্ট রুমের ব্যালকনিতে চলে এলাম। এই ব্যালকনি দিয়ে সোজা বাড়ির পেছনের রাস্তায় নামা যায়। গেস্ট রুমের দরজা লাগিয়ে ব্যালকনির রেলিংয়ের সাথে শাড়িটা বাঁধলাম। নিজেকে এখন ফিল্মের হিরোইন হিরোইন লাগছে! লাইফটা সিনেমাটিক হয়ে গেল না? বাবা-মা জোর করে মেয়ে বিয়ে দিতে চাইছে, মেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। পথে নিশ্চয় ফিল্মের হিরোর এন্ট্রি হবে। দেখা হবে, প্রেম হবে! আহা! কী গল্প! ভাবতেই কেমন মজা মজা লাগছে! মনে হচ্ছে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়াটাও বুঝি ইন্টারেস্টিং!

আমার ভাগ্য খুব ভালো যে আমাদের বাসার একটা ব্যালকনির রেলিংও কোমড়ের চেয়ে উঁচু না। উপরে কোনো গ্রিলও নেই। এই নিয়ে মায়ের কাছে বাবা কত কথা শুনেছে! বলেছে,

“গ্রিল ছাড়া ব্যালকনি তোমার কোন দরকারে আসবে? এদিক দিয়ে চোর-টোর এসে বাড়িঘরের সব চুরি করে নিয়ে যাবে। তখন দেখবে!..”

বাবা হেসে বলতেন, “আসবে আসবে, এই ব্যালকনিও একদিন কাজে আসবে! তুমি দেখে নিও!”

এসব ভেবে আমি মনে মনে মুচকি হাসি হেসে ভাবলাম,

“তুমি ঠিকই বলেছলে বাবা। তোমার গ্রিল ছাড়া ব্যালকনিই আজ আমার কাজে আসবে! আই অ্যাম সরি, বাবা। পারলে মাফ করে দিও!”

হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে উঠলো। আমি আর যাই করি তাদের মান-সম্মান নষ্ট হোক এমন কিছু তো করতে চাই নি! কিন্তু তবুও তারা… ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে!

নাহ্, আর বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবে না। আর কিছুক্ষণ থাকলেই ইমোশনাল হয়ে পড়বো। তখন দেখা যাবে, পালিয়ে যাবার আগেই ধরা পড়ে যাবো! তখন এই আফসোস আমার কোনোদিন শেষ হবে না!

খুব ধীরে ধীরে শাড়ী ধরে নীচে নেমে এলাম। আহ্! শান্তি লাগছে খুব! ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। আপাদত ফোন টোন অফ! কেউ কল দিলেও আর পাবে না! হা হা হা।

কিন্তু গলির মোড়ে এসে যার সাথে দেখা হলো তাতেই পিলে চমকে উঠলো আমার। ভেতরে ভেতরে টেনশনে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলেও নিজেকে যথা সম্ভব শান্ত রেখে হাঁটতে লাগলাম। সে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল দেখে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সে গলির ভেতর ঢুকে গেল দেখে এগিয়ে গিয়ে একটা রিকশা ঠিক করলাম। বাস স্ট্যান্ডে যাবো এখন। ভাড়া ঠিক করে রিকশায় উঠবো এমন সময় পেছন থেকে ভেসে এলো পরিচিত কন্ঠস্বর,

— “মৌরি তুই?”

আতঙ্কে জমে গেলাম যেন। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলাম ব্যক্তিটি দাড়িয়ে আছে। সে যায় নি! উল্টো ঘুরে ফিরে এসেছে! কী করবো ভেবে পেলাম না। মাথার ভেতর একটা কথাই ঘুরলো আমার এত কষ্টও শেষ পর্যন্ত সার্থক হলো না! এই দুঃখ আমি কই রাখবো? আহা রে!

#চলবে————-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে