#গল্পটা_তুমিময়💕
#পর্বসংখ্যা_১
#মৌরিন_আহমেদ
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়লো আমার। চোখ মেলতেই মা রাগী গলায় বললেন,
— “আজ তোর বিয়ে, আর তুই এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস? ওঠ, বলছি, ওঠ!”
সকাল বেলা ঘুম থেকে তোলার জন্য বিয়ের কথা বলাটা মোটেও নতুন কিছু না আমার জন্য। তাই অবাক হলাম না। আরও ভালো করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে বললাম,
— “বেশ তো। যাও তোমার জামাইবাবাজী কে রুমে পাঠায় দাও। কোলবালিশ বানায়া ঘুমাই।”
মা যেন এই কথায় আরও বেশি ক্ষেপে উঠলেন। ঝাড়া মেরে গায়ের কাঁথাটা সরিয়ে দিয়ে বললেন,
— “আমার কথাকে তোর কাছে ফাজলামি মনে হচ্ছে? বললাম না আজ তোর বিয়ে, কথা কানে যায় নি? উঠ, বলছি!”
— “উফ্! মা! থামো তো তুমি। আজকে শুক্রবার, ভার্সিটি-টিউশনি কিচ্ছু নাই। কোথায় একটু আরাম করে ঘুমাতে দিবে তা না, উল্টো বিয়ে নিয়ে জোক মারছো! যাও তো তুমি! আমাকে একটু ঘুমাতে দাও!”
বলেই তার হাত থেকে কাঁথাটা উদ্ধার করে গায়ে মুড়িয়ে আরাম করে শুয়ে থাকলাম। মা কিছুক্ষণ কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন,
— “তুই তাহলে উঠবি না?.. আচ্ছা, বেশ। তোর বাপ এসে দেখুক আগে। তারপর হচ্ছে.. এই আমি গেলাম। আর একবারও ডাকতে আসবো না।”
বলেই মা দ্রুত পদক্ষেপে প্রস্থান করলেন। তার চলে যাওয়ার পর পরই চরম বিরক্তি নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলাম আমি। চোখ মুখ কুঁচকে বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে সময় দেখলাম। সবে সাতটা বাজে! তাতেই কী না এমন চিল্লাপাল্লা করে ঘুম থেকে তোলা? এরচেয়ে প্রতিদিনই তো আরাম করে ঘুমাতে পারি। রোজ উঠি নয়টায়, আর আজ! ধ্যাত!
— “মৌরি! ওঠো নি তুমি এখনো?”
ড্রয়িং রুম থেকে বাবার আওয়াজ কানে আসতেই বিরক্তিটা রাগে পরিণত হলো আমার। মা গিয়ে ঠিক ঠিক বাবার কাছে কথাটা বলেছে! এরা আমার আরামের ঘুম হারাম না করে ছাড়বেই না! উফ্! অসহ্য!
হুড়মুড় করে বিছানা থেকে নেমে ড্রয়িং রুমের উদ্দেশ্যে ছুটলাম। বাবাকে দেখে চেহারার রাগ-বিরক্তি ধুয়ে মুছে স্বাভাবিক ভাবে বললাম,
— “আমাকে ডেকেছো বাবা?”
— “এখনোও ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হও নি? শ্বশুরবাড়িতে গিয়েও কী এমন করবে না কি তুমি? সংসার তখন টিকবে তো?”
বাবা যেন ব্যঙ্গ করলেন। আমিও প্রতি উত্তরে মৃদু হাসলাম। বাবার জোকস টা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বললাম,
— “এতো সহজে তো তোমাদের ঘাড় থেকে আমি নামছি না! অন্তত আরও চার পাঁচ বছর তোমাদের হাড় জ্বালিয়ে তারপর বিদায়!..”
বলেই হাসি হাসি মুখ করে চেয়ে থাকলাম। অন্য দিন হলে বিনিময়ে বাবাও একগাল হাসতেন। আমাকে প্রশ্রয় দিয়ে আরো কিছু বলতেন। আমরা বাবা-মেয়ে তখন হাসতাম আর মা তখন সেটা দেখে রেগে বোম হয়ে থাকতেন! কিন্তু আজ তেমন কিছুই হলো না। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আমার কথা শুনে বাবার চেহারাটা কেমন যেন গম্ভির হয়ে উঠেছে। উনি রাশ ভারী আওয়াজে বললেন,
— “তোমার মা তোমাকে কিছু বলেন নি?”
মা আবার কি বলবে? কিছু না বুঝে ব্যাপারটা নিয়ে বাবাকে বলতে যাবো তার আগেই রান্নাঘর থেকে মা ছুটে এলো। হাতের বেলুনটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বললেন,
— “বলবো আর কেমন করে! আমি যা বলি, সবকিছুই তো তার কাছে ফেলনা মনে হয়। যেন আমি একটা জোকার ওর সঙ্গে জোকস মারতে বসেছি!”
এদের কথাবার্তার আগামাথা বোধ গম্য হলো না আমার। মা যে আমার নামে বিচার দিচ্ছেন সেটা বুঝেই ভোলাভালা চাহনি দিয়ে বললাম,
— “মা কিন্তু আমার নামে অহেতুক বিচার দিচ্ছে বাবা! আমি এই বদনামের জন্য ভেটো দিচ্ছি। আই ফরবিড, আমি মানি না!”
বলেই সংসদীয় স্টাইলে হাত নাড়িয়ে নিজের পক্ষের সমর্থনের চেষ্টা করলাম। বাবা আমার দিকে একপলক তাকিয়ে মার দিকে ফিরে বললেন,
— “ওকে এখনো কিছুই বলো নি?”
মা মাথা নাড়ালেন। আমি উজবুকের মতো তাকিয়ে থেকে বললাম,
— “তোমরা কি নিয়ে কথা বলছো, বলো তো?”
— “আজ তোমার বিয়ে!”
বাবা থমথমে মুখে বললেন। কথাটা শুনেই যেন বাজ পড়লো মাথায়। আশ্চর্য হয়ে বললাম,
— “কীহ? ক্ক..কার সাথে?”
— “সূর্যের সাথে। আর সেটা আজকেই। দুপুরে হলুদ, বিকেলে বিয়ে।”
ব্যস এটুকু বলেই বাবা উঠে গিয়ে নিজের রুমের ভেতর ঢুকে গেলেন। মাও নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করলেন। আর আমি স্তম্ভিত চাহনিতে ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। বাবার কথাটা পুরোটাই মাথার উপর দিয়ে গেছে! উনি এসব কি বললেন? বিয়ে মানে? তাও আবার সূর্যের সাথে? ওই উজবুক ব্যাটার সাথে? ক্যামনে কি? মাথা যেন হ্যাং হয়ে গেল আমার।
হুশ হতেই তড়িঘড়ি করে ছুটে গেলাম মার কাছে। উনি রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আমি ছুটে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম,
— “এসব কি শুনছি, মা? আমার বিয়ে মানে? এসব কী কথা? আর ওই সূর্যের সাথে..”
— “যা শুনেছ, ঠিকই শুনেছ। সূর্যের সাথেই তোমার বিয়েটা হচ্ছে।”
— “কিন্তু মা, ওনাকে আমি..”
কথা শেষ করতে পারলাম না আমি। তার আগেই মা বললেন,
–“এটা আমার সিদ্ধান্ত নয়, তোমার বাবার। কিছু বলতে হলে তাকে গিয়ে বলো!”
মা সহজ ভাবে নিজের দায়িত্ব শেষ করলেন। বাবার কাছে ঘটনা শুনতে পাঠিয়ে নিজে বেঁচে গেলেন। কথা শেষ করে নিজের মতোই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কাজে। আমি কিছুক্ষণ হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে দৌড় লাগালাম বাবার কাছে।
— “তোমাদের কথার তো কিছুই বুঝতে পারছি না আমি, বাবা! এসব কী কথা তোমাদের? আমার বিয়ে ঠিক করেছ আমাকে না বলে, না জানিয়ে.. এখানে আমার মতামতের তো একটা ব্যাপার আছে, তাই না? কিন্তু তা না করে..”
— “তোমার মতামত নেয়ার সময় ছিল না, মৌরি। সূর্যের অফিস থেকে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে। খুব দ্রুতই ইউকে যেতে হবে ওকে। আর তোমার আন্টিরা চাইছিলেন এরমধ্যে বিয়েটা দিয়ে দিতে। সূর্য তোমাকে নিয়েই ইউকে যাবে..”
— “কিন্তু তোমরা তো আমাকে কিছুই জানাও নি, বাবা! আমাকে তো জিজ্ঞেসও করো নি আমি এই বিয়েতে রাজি আছি কী না। আর ইউকে যাওয়া.. সে তো বহুদূরের কথা! আমি তো..”
— “বললাম তো জানানোর সময় ছিল না। এখন জানালাম, ব্যস! আর তোমাকে এতোদিন মানুষ করার পর নিজের পছন্দের পাত্রের সাথে বিয়ে দেয়ার ইচ্ছে থাকা কি অমূলক? বাবা হিসেবে এটা কি আমার একেবারেই অনুচিত? বলো? তাহলে এতদিন ধরে তোমাকে মানুষ করলাম কেন আমি?…”
বাবা যেন হুট করেই রেগে গেলেন। আমি থতমত খেয়ে গেলাম তার কথার যুক্তি শুনে। ধীরে ধীরে বললাম,
— “কথা তো সেটা নয় বাবা! আমি ওটা বলছি না..”
— “তুমি যেটাই বলো, আখেরে এটাই দাড়ায়। যদি সেটা না বলতে চাও। তো বিয়েটা করে নাও! আর কোনো কথা নয়!..”
এ কথার পর আর কোনো কথা খাটে না। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ হেঁটে নিজের ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘুম থেকে উঠেছি দাঁত মাজা, খাওয়া-দাওয়া কিছুই হয় নি। সব ছেড়ে বিয়ে ভাঙার ধ্যান করতে বসলাম। এই বিয়ে আমাকে ভাঙতেই হবে! যে করেই হোক!
আমি মৌরি। একটা পাবলিক ভার্সিটিতে পড়ছি। কয়েকদিন আগেই অনার্স ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম শেষ করেছি। এখন আপাদত ফ্রি। খাওয়া দাওয়া ঘুম, দু’ একটা টিউশনি, এই আমার ডেইলি রুটিন। তারমধ্যে কোত্থেকে যেন মা বাবা এই বিয়ের ভূত চাপিয়ে দিতে চাইছেন মাথায়! ধুর! ভাল্লাগে না।
এবার আসি, ওই বদ ছেলেটার পরিচয়ে। নাম হলো ওয়াসিফ হাসান। নিক নেইম সূর্য। বহুত মেধাবী ছাত্র হলেও আমার দৃষ্টিতে খাটাসের খাটাস একজন! আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ইরেটেটিং ছেলে হলো এই। কেন? বলছি..
আমার বাবা এবং এই সূর্য মহাশয়ের বাবা দুজনে বাল্যবন্ধু। গ্রামের বাড়িও পাশাপাশি। একসাথে বেড়ে উঠেছেন, একই সঙ্গে জবে জয়েন করেন। পড়ে অবশ্য আঙ্কেল জব ছেড়ে বিজনেসে ঢুকে যান, সে যাই হোক। আমাদের বাসাও পাশাপাশি। একেবারেই দেয়ালের এপাশ আর ওপাশ। তো আঙ্কেলের দুই ছেলেমেয়ে। সূর্য আর রুতবা। স্বাভাবিকভাবেই ওদের সাথে আমাদের ওঠাবসা সেই ছোট্ট বেলা থেকে। রুতবার সাথে আমার খাতিরও খুব! কিন্তু সমস্যা একখানে.. অ্যান্ড ইট ইজ সূর্য!
ছোট বেলা থেকে খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট হিসেবে নাম করেন সূর্য ভাই। সেজন্য প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই ছেলের উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে আমাকে। আমি কোন টিচারের কাছে পড়বো, কোন গাইড ইউজ করবো সবকিছুতেই অনুকরণ করতে হবে সূর্যকে! সে মহা ব্রিলিয়ান্ট, তাকে ফলো করলে আমারই সুবিধা হবে এই এক্সকিউজে।
কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এই অনুকরণীয় ছেলেটাই আমার জীবনে সবচেয়ে বিরক্তিকর লোক হয়ে দাড়ালো। সে বয়সে আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। আমি ছোট থেকেই নিজের মতো করে চলতে পছন্দ করি, কাউকে ফলো করাটা কিংবা কারো দেখে দেখে সেটাই করতে হবে এসব আমার মধ্যে নেই। তাই সূর্য ভাইকে যখন উদাহরণ হিসেবে বলা হতো আমি বিরক্ত হতাম খুব। মানতে চাইতাম না।
তার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সে কখনো আমাকে আমার নাম ধরে ডাকতো না! মৌরি না ডেকে অলয়েজ ‘পাঁচফোড়ন’ বলে চিল্লাতো! কারণ হিসেবে বলতো, মৌরি মানেই পাঁচফোড়ন! আমি চরম বিরক্ত হয়ে রাগ দেখাতাম, ঝগড়া করতাম। কিন্তু কোনকিছুতেই কোনো লাভ হতো না। সে যেখানে সেখানে, যখন তখন, ইচ্ছে মতো গলা ছেড়ে হাঁক ছাড়তো, “পাঁচফোড়ন শুনে যা!” মা বাবাকে এই নিয়ে কত নালিশ করেছি! কিন্তু কোথাও কোনো সুফল পাই নি। সে তার মতই ডেকে যেত ‘ পাঁচফোড়ন’! আমাদের বেশির ভাগ ঝগড়া বোধ হয় এই ডাকাডাকি নিয়েই লাগতো! তাছাড়া আমার নিত্যদিনের অবাধ্যতা আর ত্যাড়ামো তো ছিলই!
সূর্য ভাই শহরের সবচেয়ে ভালো স্কুল থেকে পাশ করেছেন। তাকে ফলো করতে গিয়ে তার পিছু পিছু ওই স্কুলে আমাকেও অ্যাডমিট করা হয়েছিল। এটা ঠিক ছিল, যে ওরা আমার ভালোর জন্যই ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়েছে। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো অন্য জায়গায়।
স্কুলে সবসময় নজরদারির ভেতর ছিলাম আমি। কখন কী করতাম, সবকিছুর হিসেব রাখতেন সূর্য ভাই। মাঝে মাঝে কিছু কাজ করতে মানা করতেন, কিন্তু আমি ঘাড় ত্যাড়ামো করে শুনতাম না। ওই যে বলেছি, কাউকে ফলো করাটা আমার পছন্দ নয়! তাই প্রথম থেকেই এই অসহ্য ছেলেটাকে সহ্য হতো না আমার! তার সব কথাকে অগ্রাহ্য করার জন্য এই একটা যুক্তিই আমি খাটাতাম। ফলস্রুতিতে সে মহাশয়ও ক্ষেপে গিয়ে তুলকালাম করতেন। মায়ের কাছে আমার নামে অহেতুক নালিশ করে বিচারের পসরা সাজাতেন। আগেই বলেছি মা আমার সূর্যের কথা খুব বিশ্বাস করেন! তাই যখনই একটা নালিশ পেতেন, তা ঠিক হোক বা ভুল ফল ভোগ করতে হতো আমাকেই!
এই ছেলে থাকতে স্কুল লাইফটা আমার ত্যানা ত্যানা বানিয়ে রেখেছিল! এরপর সে যখন কলেজ পাশ করে ঢাবিতে ভর্তি হয়ে রংপুর থেকে বিদায় নিলো তখন খুব খুশি হলাম আমি। তখন ক্লাস নাইনে উঠেছি। বড়দের ভাষায় পাখা গজানোর সময় যাকে বলে! পরিচিত গণ্ডির বাইরে এসে নিজের খেই হারিয়ে ফেললাম। এতদিনের ভদ্র, শৃঙ্খলে আবদ্ধ পাখিটি যখন ছাড়া পেল একেবারই উড়াল দেয়ার চেষ্টা চালালো আকাশে! আকাশে ডানা মেলে দিয়ে পুরো আকাশটাকেই আয়ত্বে আনতে চাইলো!
বন্ধু-বান্ধবী জুটলো অনেকগুলো। নতুন-পুরোনো বন্ধু মিলিয়ে আমার তখন অনেক সহচর! না লেখাপড়ায় গাফিলতি হয় নি, তবে বন্ধুদের সাহচর্যে এসে খুব উশৃঙ্খল হয়ে উঠেছিলাম। এমন চললে লেখাপড়াকেও আর সামলে উঠতে পারতাম না সেটা মনে মনে বুঝেছিলাম। কিন্তু বন্ধুদেরকে ছাড়তে পারি নি। মানুষ অভ্যাসের দাস। আর সে অভ্যাসটা বদ হলে তা ছাড়ানো আরও যন্ত্রণার! তাই আগের মতো হবো হবো করেও আর হয়ে উঠতে পারছিলাম না।
দু’ তিন মাসের ব্যবধানে আমি হয়ে গেলাম ফাজিলের চূড়ান্ত! যদিও বাসায় কিংবা পরিচিত কারো সামনে নয়, উশৃঙ্খলতার সীমাটা তখনো বন্ধু বান্ধবদের সামনেই রাখতাম। কিন্তু কী করে যেন টের পেয়ে গেল সূর্য ভাই। ছুটিতে ঢাকা থেকে এসে আমার এক্কেবারে ক্লাস নিয়ে ছাড়লো! নানান ধরনের ধমকি-ধামকি, এমনকি দুইটা চড়ও মেরেছিলেন সেদিন! সঙ্গে আরও যে কতো জাতের অপমান!
আমি ভয় পেয়েছিলাম। ক্লাসে গিয়ে ব:দ:মা:শ হয়ে যাচ্ছি এটা যদি মাকে বলে দেয়? আশ্চর্যের কথা হলো এই, সূর্য ভাই আমাকে যতোই নিজের আয়ত্বের ভিতর রাখার চেষ্টা করতেন যতোই জোর খাটাতেন আমি ঠিক ততটাই অবাধ্য হতাম। তার প্রত্যেকটা কথার প্রেক্ষিতেই কথা বলতাম। ঝগড়া করতাম। ঘটনা বেগতিক না হওয়া পর্যন্ত আমি ত্যাড়ামো করেই যেতাম! কিন্তু সেদিন! সেদিন যখন সে আমাকে গালে থা:প্প:ড় কষিয়ে অপমানিত করলেন তখন আমি কিছুই বলতে পারলাম না। তিনি খুব রাগারাগি করে শেষ পর্যন্ত থ্রেট দিলেন বেশি বাড়াবাড়ি করলে মাকে অবধি জানিয়ে দিবে! সেই প্রথমবার, হ্যাঁ, সেই প্রথমবারের মতোন সূর্য ভাইয়ের কথা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিলাম আমি। এবং এটাই বোধ হয় আমাদের প্রথম ঝগড়া ছিল যেটার রেশ বাড়ির ভেতর অবধি আসে নি!
উনি চলে আসার পর আবারো আগের মতো হয়ে গেলাম আমি। উশৃঙ্খল বান্ধবদের সাহচর্য ত্যাগ করলাম। আগের মতো নিশ্চুপ-নিস্তব্ধ-একাকী হয়ে গেলাম। পড়ুয়া বাচ্চার মতো পুরোপুরি লেখাপড়ায় ফোকাস করলাম।
এসএসসি পরীক্ষার পর আবারও পাখা গজালো আমার! কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নিজেকে যেন নতুন রূপে আবিষ্কার করলাম। নিজের পুরাতন অভ্যাস, একাকীত্ব, ঘরকুনো স্বভাব ছেড়ে মিশুক হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। পুরাতন কে ভেঙে নতুন করে গড়ে নিতে চাইলাম আমার সবটুকু! তবে এবার নিজের সীমাটা ভুললাম না। মানুষ এক ভুল দুইবার করে না। সূর্য ভাই তখনও ঢাবিতেই পড়ছেন।
কিন্তু আবারো সেই ঝামেলা লেগে গেল। তখনো নিত্য নিত্যই সূর্য ভাইয়ের সঙ্গে ক্যাচাল করছি আমি। পাশে নেই তো কী হয়েছে? ফোন আর ইন্টারনেটের যুগে ঝগড়াটাও আমাদের ডিজিটাল হয়ে উঠলো। এমনই এক দিনে..
সেদিন কলেজ থেকে ফিরছিলাম। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বোধ হয় বৃষ্টি শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। সঙ্গে ছাতা ছিল না। তাই তড়িঘড়ি করে হাঁটছিলাম। কলেজ থেকে বাসায় আমি হেঁটেই যাতায়াত করি।
হঠাৎ পার্কের সামনে আসতেই একটা উটকো ছেলে এসে পথ আগলে দাড়ালো আমার। তাকে আগে দেখেছি কী না মনে নেই। হবে কোনো বখাটে-টখাটে! আমি পাত্তা না দিয়ে এগোচ্ছি হুট করেই সে আমার হাত টেনে ধরলো। আমি আতঙ্কে শিউরে উঠে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা চালালাম। সূর্য ভাইয়ের মতো কঠিন ছেলেকে আমি ভয় পাই না, কিন্তু এমন রাস্তার বখাটেদের তো অবশ্যই ভয় পাই! তারমধ্যে ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখ দুটো লাল! আমাকে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে দাঁত বের করে হাসলো। হলুদ রঙের বিশ্রী সে দাঁতের ঝলকানি আর তার মুখভঙ্গি দেখে যেন কলিজা শুকিয়ে এলো আমার। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো। আমি ক্রমাগত হাত মুচড়াতে লাগলাম। বলতে লাগলাম, “হাত ছাড়, হাত ছাড়!”
কিন্তু ছেলেটা ছাড়লো না। বরং বিশ্রী হাসি দিয়ে নিজেকে জয়ী বলে প্রমাণ করলো। আমি ভয়ে আশেপাশে তাকালাম। আকাশের বাজে অবস্থা দেখে রাস্তা আগেই ফাঁকা হয়ে গেছে। কেউ নেই সেখানে!
চারপাশ দেখে শঙ্কিত মন বারবার অশনি সঙ্কেত দিচ্ছিলো। ছেলেটা আমাকে একটা দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। আমি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে চিৎকার করলাম। তখন দেখি একটা রিকশা যাচ্ছে ওই পথ দিয়ে। আচমকা চিৎকার করতে দেখে ছেলেটা মুখ চেপে ধরলো আমার। ভয়ে-দুশ্চিন্তায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। সাহসী মৌরিও তখন অসীম ভয়ের জগতে ঢুকে গেছে! সেখান থেকে সহজে বেরোনোর উপায় নেই!
যখন কোনোকিছুই করতে পারছিলাম না তখন মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। “লা ইলাহা ইন্না আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতুম মিনাজ জোয়ালিমিন।”– ক্রমাগত আউরে যাচ্ছিলাম। যখন দেখলাম রিকশাটা চলে যাচ্ছে তখন আরও জোড়ে চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। ছেলেটা তখন দুই হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরেছে, ব্যাপারটা ধস্তাধস্তির পর্যায়ে চলে গেল। হঠাৎ!..
হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন এসে ছেলেটাকে টান দিয়ে সরিয়ে দিলো আমার থেকে। আমি মুক্ত হয়ে চকিত দৃষ্টিতে তাকালাম সামনে দাড়ানো ব্যক্তিটির দিকে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম সূর্য ভাই রক্তিম মুখে দাড়িয়ে আছেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ সশব্দে চড় পড়লো গালে! আমি নির্বাক দৃষ্টিতে গালে হাত ঠেকালাম। ছেলেটা এসে সূর্য ভাইয়ের শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মা:স্তা:নি করতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা চড়ের শব্দ তে স্তব্ধ হলো সব! আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলাম ছেলেটাকে একটার পর একটা চড়-থাপ্পড়-কিল-ঘুষি মেরে যাচ্ছেন সূর্য ভাই। ছেলেটা প্রতিরোধের চেষ্টা করছে কিন্তু সূর্য ভাইয়ের কঠিন মা:ই:রে:র কাছে ও যেন কিছুই না!
পাঁচ দশমিনিট পর ছেলেটাকে পিটিয়ে পার্কের কাছে অচেতন করে রেখে আমার হাত ধরে টেনে আনলেন সূর্য ভাই। একটা রিকশায় এনে ধাক্কা দিয়ে তুললেন। ভয়ে-বিস্ময়ে আমার মুখ দিয়ে কথা বেরোল না। নির্বাক চাহনিতে তার মুখের দিকে তাকালাম। সে রাগে কাঁপছে যেন। রিকশায় আগে থেকেই একটা লাগেজ আর ব্যাগ রাখা ছিল। বুঝলাম সূর্য ভাই আজই, এখনই ঢাকা থেকে ফিরছেন। হয় তো পথে আমাকে দেখে..
উনিও রিকশায় ওঠার পর পরই মামা প্যাডেল ঘুরালেন। রিকশা চলতে লাগলো আর আমি মাথা নিচু করে বসে থাকলাম। সূর্য ভাই আমাকে কিচ্ছুটি বললেন না, জিজ্ঞেস করলেন না ঘটনা কি ছিল, কিচ্ছু জানতে চাইলেন না। শুধু তাচ্ছিল্য হেসে বললেন,
— “না:গ:র জুটিয়েছিস ভালোই! কলেজ ছেড়ে পার্কে বসে অসভ্যতামি! নেশাখোর-মাতালের সাথে! হাহ্!”
আমি চুপ করে রইলাম। জবাব দেয়ার মত পরিস্থিতি আমার তখন ছিল না।
বাসায় এসে চুপচাপ ঘরে চলে এলাম। জানি না এই ব্যাপার নিয়ে সূর্য ভাই মায়ের কাছে কী কী বলেছেন! কিন্তু এর পরিণতি খুব ভয়াবহ ভাবে প্রভাব ফেললো আমার জীবনে। মা-বাবা দুজনেই রেগে আগুন হয়ে রইলেন। মা তো সরাসরি এসে মে’রে ঘরবন্দী করে ফেললেন আমাকে! বাবা মা’রা’মা’রি করেন নি ঠিকই তবে কষ্ট পেয়েছিলেন খুব। আমায় ডেকে বলেছিলেন,
— “আমার সারাজীবনের দেয়া শিক্ষার এই মূল্য দিবে তুমি! ভাবি নি কখনো!”
আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে চলে এসেছিলাম। বাবার কথাটা গায়ে লাগে নি, বুকে এসে লেগেছিল। ইচ্ছে করছিল বাবার পা ধরে বলি, “আমি কিছুই করি নি বাবা! বিশ্বাস করো!” কিন্তু বলি নি, বলতে পারি নি। অজানা একটা অভিমানে মন ভারী হয়ে এসেছিল। সেটা কার উপর জানি না!
কেউ কিছু না বললেও আমি জেনে গিয়েছিলাম সেদিন ওখানে আমাকে আর ওই ছেলেটাকে দেখে সূর্য ভাই খারাপ কিছু ভেবেছিলেন। ভেবেছিলেন ছেলেটা আমার প্রেমিক। তাই হয় তো বাসায় এসে যা নয় তাই বলেছেন! সবটা মিথ্যে জেনেও প্রতিবাদ করতে পারি নি আমি। কারণ সেটা বিশ্বাস যোগ্য হতো না কারো কাছে। আর সূর্য ভাইয়ের উপরও একটা ক্ষোভ জন্মালো আমার। আমরা ঝগড়া করতাম, মা’রা’মা’রি করতাম কিন্তু তাই বলে কি সে আমাকে এতোটা খারাপ ভাবলো? সে তো আমাকে একটু বেশিই চিনতো। আমি কোথায় কি করতাম সব জানতো! তাহলে?
এ ঘটনার পর একেবারই বদলে গেলাম আমি। একেবারে নিস্তব্ধ-নিঝুম-নির্জন দ্বি প্রহরের মতো শান্ত হয়ে রইলাম। প্রায় একমাস ঘরবন্দী থাকলাম। অহেতুক-অকারণ মায়ের সামনে যেতে ভয় পেতাম। নিজেকে গুটিয়ে ফেললাম পুরোপুরি ভাবেই।
সেই ঘটনার পর হঠাৎ কেন যেন আর সূর্য ভাইকে সহ্যই করতে পারতাম না আমি। সে আমাকে বাঁচালো সেজন্য কৃতজ্ঞ ছিলাম। কিন্তু বাড়িতে এসে সে যেটা করলো তারপর আর প্রতি কোনো কৃতজ্ঞতা বোধ অবশিষ্ট রইলো না। বরং চরম ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলাম। সময়ের সাথে সাথেই সবার সাথে সম্পর্ক ভালো হয়ে গেল আগের মতো। কিন্তু সূর্য ভাইয়ের সঙ্গে ভুলেও কথা বলতাম না আমি। অভিমান না ঘৃণায় জানি না। তবে কথা বলতে ইচ্ছে করতো না।
একদিন বিকেলে ছাদের উপর একা বসে থাকার সময় সূর্য ভাই এলেন। খানিক্ষ্ন চুপ করে থেকে সরি বললেন। আমি মুখ ফেরালাম। সে পুরোনো কথাটা তুলে, ঘটনার আদি-অন্ত বললো। নিজের ভুলটা দেখিয়ে মাফ চাইলো। সহজে না মানলেও একসময় মেনে নিলাম। সম্পর্কটাও ধীরে ধীরে আগের মতো হয়ে এলো। আগের মতো ঝগড়া-ঝাটি, মা:রা-মা:রি! নিত্যদিনের অভ্যাস।
আবারো আমার লাইফে হস্তক্ষেপ শুরু করলো সে। Hsc পাশের পর পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পেলাম। ভর্তি হলাম। ততদিনে তার লেখাপড়া শেষ। একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে। সম্পর্ক আগের মতোই সাপে-নেউলে! কেউ কাউকে দেখতে পারি না। কথা হচ্ছিল তার পি এইচ ডি নিয়ে। সে ব্রিটেন থেকে পি এইচ ডি করার জন্য যাবে। ফর্মালিটিস কমপ্লিটের আগে একমাসের জন্য ইউকে তে গেলেন।
আমি আবারো ছাড়া পেলাম। আবারো ঝামেলায় জরিয়ে গেলাম। এটা আমার এক্সামের কয়েকদিন আগের কথা। এক সিনিয়র ভাই নাকি আমাকে পছন্দ করে এরকম বলছিল আমার বান্ধবীরা। ছেলেরটার নাম হলো অর্ণব। তার বাচ্চাদের মতো কিউট ফেসটা দেখলে মনেই হয় না সে মাস্টার্সে পড়া ছেলে। ব্যবহারেও সে খুব মার্জিত, খানিকটা লাজুক। তো এই লাজুক লাজুক ছেলেটা নাকি আমাকে পছন্দ করে! বান্ধবী মারফত এ খবর সে নিজেই জানিয়েছে! সামনাসামনি কিছু বলে নি। ডিরেক্ট যেহেতু কিছু বলে নি তাই আমিও আর পাত্তা দেই নি। কিন্তু হুট করে এসেই হাতে একটা গোলাপ আর একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে দৌড় দেয় ছেলেটা। আমি অবাক হয়ে কাগজের ভাঁজ খুলতেই দেখি ছোট্ট একটা প্রেমপত্র। রসবোধে ভরা। ঠিক রাজি না হলেও ছেলেটার সঙ্গে দু’ একদিন চা আর ফুসকা খেয়েছিলাম আমি। ছেলেটাকে সব জিজ্ঞেস করার পর সে শুধু বলেছিল বন্ধু হতে চায়। আমিও তাই না করি নি। কিন্তু কে জানত তাতে এমন কিছু হবে?
ভার্সিটিতে তখন মোটামুটি ভালো রকমের একটা গুঞ্জন উঠে গেছে যে আমি আর অর্ণব প্রেম করছি। কিন্তু ঘটনা বাড়ি পর্যন্ত আসবে ভাবি নি। সূর্য ভাই যে তখনো আমার পেছনে লোক লাগিয়ে রেখেছেন তা কী আমি জানতাম? ফিরে এসেই আমাকে ডেকে পাঠালেন। সেভাবে জিজ্ঞেস করলেন না কিছুই। শুধু ধমক দিয়ে বললেন,
— “ভার্সিটিতে কী প্রেম করতে যাস, ছা’গ’ল? এত্তোগুলো বাঁশ খেয়েও সাধ মিটলো না!”
আমি গাল ফুলিয়ে বলেছিলাম,
— “বাঁশটা তো আপনিই দিয়েছিলেন! সেখানে কি কোনো দোষ ছিল আমার?”
সে কথার জবাব না দিয়ে বলেছিল,
— “তুই আর ওই অর্ণবের সামনে অবধি যাবি না। যদি গিয়েছিস তো..”
— “তো?”
— “আঙ্কেলকে বলে রিক্সাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দেব তোর!”
— “ইহ! বললেই হলো! বিয়ে কি এত্ত সোজা? করবো না আমি বিয়ে। আর অর্ণবের সাথেই প্রেম করবো। আপনি দেখে নিয়েন!”
— “দেখা যাবে!”
ঝগড়ার পরি সমাপ্তি ঘটিয়ে যে যার কাজে চলে যাই। আমি তার কথাকে পাত্তা না দিয়ে বরাবরের মতো ত্যাড়ামো করলাম। ভার্সিটিতে গিয়ে অকারনেই অর্ণবের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতাম। ফুসকা, চটপটি খেয়ে বেড়াতাম। উদ্দেশ্য ছিল সূর্য ভাইকে রাগিয়ে দেয়া!
কিন্তু সূর্য ভাই যে কি সাংঘাতিক সেটা আগে বুঝি নি। সে কী করলো? প্রথমে অর্ণবকে বেনামি চিঠি দিয়ে থ্রেট দিলো। তারপর হঠাৎ করেই একদিন অন্ধকারে পি’টি’য়ে পা ভেঙে দিলো! আমি খবর পেয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখি, হসপিটালের বেডের উপর ঠ্যাং ঝুলিয়ে পড়ে আছে অর্ণব। কাতরাচ্ছে একটু পর পর। জিজ্ঞাসা করলাম, “কি করে হলো?”
সে মাথা নাড়িয়ে বললো, “বন্ধুর বাইকে যাচ্ছিলাম, অ্যাকসিডেন্ট করেছি!”
বিশ্বাস না হলেও করলাম। অর্ণবের প্রতি প্রেম দেখিয়ে, সেবা করতে গেলেই ছিটকে সরে গেল সে। আতঙ্কে লাফিয়ে উঠে বললো,
— “এই এই! এসো না তুমি! যাও এখান থেকে!”
আমি অবাক হয়ে আরও কাছে ঘেঁষতেই সে একপ্রকার ভয়েই সিটিয়ে গেল দেয়ালের সাথে। নেহাত পা ভাঙা, নয় তো ছুটেই পালাতো নিশ্চয়!
আমি কিছু বলার আগেই সে কাটকাট ভাষায় বললো,
— “তোমার সাথে আর কোনো সম্পর্ক নেই আমার, মৌরি! আমি ব্রেক আপ করছি!”
আমি অবাক হলাম। সম্পর্ক তো কিছু ছিলই না। সে তবে ব্রেক আপের কথা কেন বলছে? ঠিক তখনই তার অ্যাক্সিডেন্টের কথা বিশ্বাস করতে গিয়েও করলাম না। বুঝলাম, ভেতরে ভেতরে কলকব্জা কেউ নাড়িয়ে দিয়েছে। আর সেই ব্যক্তিটি সূর্য ছাড়া আর কেউ নয়!
রাগে ছুটে গেলাম সূর্য ভাইয়ের কাছে। কঠিন ভাষায় শুধোলাম অর্ণবকে পি’টি’য়ে’ছে কে? সে নীরব, নির্বিকার থেকে বললো,
— “আমি তার কি জানি? ও আমার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে যে আমি ওর পা ভাঙবো?”
— “সত্যিই পি’টা’ন নি? তাহলে আপনাকে কে বললো যে অর্ণবের পা ভেঙেছে?”
সরু চোখে তাকালাম। সে একটুও না ঘাবড়ে জবাব দিলো,
— “তুই হয় তো ভুলে গেছিস তুই আর তোর অর্ণব, কে কোথায় যায়, সব হিসাবই আমার কাছে থাকে! তাই কার ঠ্যাং ভেঙেছে আর কার মন সেটা আমি ভালো করেই জানি!”
বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগলো। আমি রাগে কটমট করে তাকিয়ে রইলাম। সে ব্যাপারটায় পাত্তা না দিয়ে বললো,
— “বাই দ্যা ওয়ে, মন তো ভাঙছে। নিশ্চয় ব্যথাও করছে? একটা কাজ করিস এই নে, প্যারাসিটামল। প্যারাসিটামল দুই বেলা, মন ভাঙার আগে একবার, পরে একবার!”
শেষ কথাটা মোশারফ করিম স্টাইলে বলে আমার হাতের মুঠোয় একটা প্যারাসিটামলের পাতা ঢুকিয়ে দিল। আমি চরম রাগে ভাষা হারিয়ে ফেললাম। চুপ করে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার পরবর্তী কার্যকলাপ দেখতে লাগলাম। সে হেসে হেসে বললো,
— “সরকারি হসপিটালের প্যারাসিটামল, বুঝেছিস? কাজ করবে ভালো। এর জন্য দশ টাকার টিকেট কেটে হসপিটালে রোগীর লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শুধু তোর জন্য! আফটার অল আমার পাঁচফোড়ন ছ্যাকা খেয়ে মন ভেঙে ফেলেছে! তাই আর কি!”
দাড়িয়ে থেকে তার আজাইরা প্যাঁচাল শুনতে আর ভালো লাগলো না। হাতের প্যারাসিটামলের পাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে এলাম। আসার সময় শুনতে পেলাম সে চিৎকার করছে,
— “আমার এতো কষ্টের তুই মূল্যই দিলি না, পাঁচফোড়ন? আমি এতো খাটাখাটনি করে, দশ টাকা খরচ করে হসপিটাল গিয়ে তোর জন্য প্যারাসিটামল আনলাম আর তুই? ভালাই কি কই জামানাই নেহি!”
কিছু বললাম না। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে এলাম।
_______________________
সূর্য ভাই ফিরে আসতেই তার বাড়ির সবাই তার বিয়ের জন্য তাগাদা দিতে লাগলো। কিন্তু সে সাফ সাফ না করে দিয়ে বসে রইলো। ঘটনা যখন এই, তখন তাদের বাড়ীতে দিয়ে আন্টির কান ভাঙানি দিয়ে এলাম আমি নিজেই। বললাম,
“ছেলে বিদেশে যাচ্ছে, বিয়ে শাদী করে নি, কোনো বিদেশি মেয়েকে দেখে পটে গেলে? তখন আর দেশে ফিরবে? তখন তোমরা বাসায় বসে বসে শুধু ছেলের কথা ভেবে দুঃখবিলাস করো! আর কিছু করতে হবে না!”
আমার এই কথাতেই বোধ হয় কাজ হয়ে গেল! আন্টি একেবারে নাছোড়বান্দার মতো জেদ ধরলেন সূর্য ভাইকে বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন! খবর শুনে তখন আমি খুশিতে নাচছি। এতোদিন পর সূর্য নামক ব’দ’টা আমার ঘাড় ছেড়ে নামবে! মনে মনে অভিশাপ দিলাম, “বিয়ে কর না কর! খুঁজে খুঁজে এমন বৌ আনবো যে তুই আর দম নেয়ার সময় পাবি না। বৌ যদি তোকে নাকে দড়ি দিয়ে না ঘুরায়.. তো..” ইত্যাদি ইত্যাদি। নানা ভাবনা ভেবে নিজে নিজেই আনন্দিত হলাম। কিন্তু তলে তলে যে কী কলকাঠি নাড়লো সে! আল্লাহ ভালো জানেন! দু’ দিন আগে আমাকে ডেকে থ্রেট দিয়েছিল,
— “তুই আমার আম্মুর কাছে গিয়ে কী কথা লাগিয়েছিস? যে সে আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠলো?”
আমি খুশিতে দাঁত কেলিয়ে বলেছিলাম,
— “কী যে বলেন না সূর্য ভাই! আমি তো শুধু বলেছি ছেলে বড় হয়েছে বিয়ে দিয়ে দাও! ভুল কিছু বলেছি নাকি? আপনার তো আরও খুশি হওয়ার কথা। বিয়ে করছেন, ঘরে বৌ আসছে, কয়দিন পর বাচ্চাকাচ্চা হবে! আহা!…”
— “খুব মজা না? আমাকে ফাঁসিয়ে খুব আনন্দ হচ্ছে?.. ঠিক আছে। আমিও দেখবো, কোথাকার জল, কোথায় গড়ায়…”
বলেই গটগট করে হেঁটে স্থান করলো। আর আমিও খুশিতে নাচতে নাচতে নিজের বাসায় এলাম।
এর ঠিক দুই দিন পর, আজ, আমার বাসায় বিয়ের কথা চলছে। বলা হচ্ছে আমার বিয়ে নাকি ওই ব’দ’টা’র সাথে! আর আমি এতো সহজেই সেটা মেনে নেব? কেউ না জানুক আমি তো জানি, এই বদ ছেলেটার পেটে পেটে কী বুদ্ধি! সে যে রিভেঞ্জের জন্যই বিয়ে করছে সেটা আমি ভালো মতনই বুঝতে পারছি। অর্ধেক জীবন আমার উপর দিয়ে শোষণের রোলার কোস্টার চালিয়ে সাধ মেটে নি, বাকি জীবনও জ্বালাতে চাচ্ছে! হুহ্!
এতকিছুর পরও কি এর মতো হাড়ে বজ্জাত ছেলেকে বিয়ে করা যায়? ওর মতো ইরেটেটিং, ডিসগাস্টিং ছেলেকে বিয়ে করে কে নিজের পায়ে কুড়োল মারতে চাইবে? আমি তো অবশ্যই নই! সো, এই বিয়েটা আমাকে ভাঙতে হবে। বাই হুক অর ক্রুক!
#চলবে—– কী?