গন্তব্যহীন পঞ্চম পর্ব

0
1090

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০

গন্তব্যহীন পঞ্চম পর্ব

সামিহা হোসেন শৈলী

৮.
“নুড়ি, ও নুড়ি, একটু এদিক আয় মা। আমি একা হাতে কতদিক সামলামু?”
মায়ের ডাক শুনে বইটা বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো নুড়ি, এরপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে বললো,
“আসতাছি মা”
.
নুড়ি এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। আর তিন মাস পরই তার পরীক্ষা, চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণের সময় তো এটাই। অথচ তার পরীক্ষা নিয়ে বাড়িতে মা ছাড়া আর কারো কোনো মাথাব্যাথা নেই, একান্ত যখন একা একা আর কোনো কাজ সামাল দিতে পারেন না, তখনই মা মিলি বেগম মেয়েকে সাহায্যের জন্য ডাকেন। এতো বড় সংসারে গোটা হেশেল সামলানোর দায়িত্ব তার একার। একবার পান থেকে চুন খসলেই হলো, কথা শোনাতে ছাড়ে না কেউই।
মাঝেমাঝে নুড়ি ভাবে, তার মাকে নিয়ে এ গ্রাম ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবে, যেখানে থাকবে না রইসুল রমিজের মতো বাবারা। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবনা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে, কেননা এখান থেকে চলে গেলে কোথায় নিয়ে রাখবে মাকে? কি খাওয়াবে তাকে?
তবে রইসুল রমিজের এই অলিখিত বন্দীশালা থেকে মুক্তির ভাবনা একেবারে ঝেরে ফেলে না। নুড়ি অপেক্ষায় আছে সুদিনের। তার দৃঢ় বিশ্বাস, এমন একদিন নিশ্চয়ই আসবে, যেদিন ও আত্মনির্ভরশীল হবে, সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচবে, সেদিন রইসুল রমিজ কিংবা তার পরিবারের কালোছায়া পড়বে না নুড়ি আর তার মায়ের জীবনে। শুধু একটাই ভয় হয়, ততদিন মাকে পাশে পাবে তো? মা যদি সেই সময়টুকু তাকে না দেয়? মা ক্রনিক আলসারের রোগী, ইদানিং অসুখটাও বেড়েছে। বাড়বে না’ইবা কেন? ঠিকঠাক খাওয়া নেই, ঘুম নেই, বিশ্রাম নেই। মায়ের জন্য বড্ড কষ্ট হয় নুড়ির, সারাজীবনই তার কষ্টের মাঝে কেটে গেলো। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তিনি, চার ভাইবোনের মাঝে মিলি বেগম ছিলেন বড়। সংসারে অভাবের ছায়া বরাবরই ছিল, তাই মাধ্যমিকের দোরগোড়ায় পৌঁছানো হয় নি তার।
ষোড়শী মিলি আহামরি না হলেও চোখে পড়ার মতো সুন্দরী ছিলেন আর সাথে জুটেছিলো উৎপাত-উপদ্রবের মেলা। তা থেকে বাঁচতেই বাবা তার অল্পবয়সে বিয়ে দিয়ে দিলেন, তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, এ উপদ্রব হয়তো মানুষের চেয়ে অভাবেরই বেশি ছিলো। বিয়ের পরের দিনগুলোও খুব বেশি সুখের কাটে নি মিলি বেগমের। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হুট করে মেম্বারের বউ হলে যা হয়। বিয়ের দুবছরের মাথায় স্বামী আবারো বিয়ে করলেন, সতীন আনলেন। শুরু হলো কষ্টের জীবনের আরেকটি ধাপ, সেই থেকে চলছেই।
তবে বাবা চরিত্রটা নুড়ির কাছে বড্ড ধোঁয়াটে। এ বাড়ির বড় মেয়ে যে এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে, সেটাই হয়তো তার বাবার মনে নেই।
অথচ মুনিয়া, তার সাথেই এবার পরীক্ষা দেবে। তাই মুনিয়ার বাবা বাড়িতে আলাদা করে অংক-ইংরেজি পড়ানোর শিক্ষক রেখেছেন। স্কুলের হাশেম স্যার সপ্তাহে চারদিন বাড়িতে এসে মুনিয়াকে ফিজিক্স কেমিস্ট্রি পড়িয়ে যান।
নুড়িকে তো তার বাবা ব্যাচে পড়ার স্যারদের মাসিক বেতনের টাকাটাও ঠিকমতো দেয় না। প্রথম প্রথম নুড়ির ভীষণ লজ্জা করতো, যখন স্যারদের একসাথে দুতিন মাসের বেতন বকেয়া হতো। এরপর একদিন বাড়ি ফিরে মাকে বলেই ফেললো,
“মা আমি আর পড়তে যামু না।”
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share

“ক্যান কি হইসে? স্যারেরা কিসু কইসে?”
“না! স্যারেরা ভালা মানুষ, তাই কিসু কয় না। কিন্তু আমার আর ভাল্লাগে না, মা। এমন কইরা কদ্দিন পড়া যায় কও তো? তুমি বাবারে কিসু কইবার পারো না? এমন না যে, হ্যার টাকা-পয়সার অভাব আছে। খালি তোমার আমার বেলায়ই তার কোনো খেয়াল নাই। কই? তার ছোটবউ আর ওই ঘরের পোলাপাইন তো মুখ ফুইট্টা বলোনের আগেই হ্যায় সব হাজির করে, তয় তোমার-আমার বেলায়ই এমন ক্যান মা? আমিও তো তার সন্তান, আমারও তো শখ আল্লাদ আছে। কখনো কিছু চাইসি? খালি একটু মাস্টার গো বেতন দেয়, সেইখানেও গাফিলতি…” কথাগুলো বলেই মায়ের কোলে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলে নুড়ি।
“আহা মা, এমন কইরা কইতে হয় না। হ্যায় না তোমার বাপ হয়…”
“হ, নামের বাপ!”
“আহা মা আমার, এমন কইরা কয় না। আর ওই ঘরের পোলাপাইন তো তোমার ভাইবোন হয়, তাগো নামে এমন কইরা কেউ কয়?”
“কচুর ভাইবোন, খালি বিলুডা একটু আমার কোলে আসে। বাকিগুলান তো আমারে বড় বইন বইলাই মানে না। হারাদিন দুচ্ছাই করে, পড়নের সময় বইখাতা নিয়া যায়, হয় পুড়াইয়া ফেলে, না হয় ছিঁইড়া ফেলে। উঠানে শুকান দেয়া আচার-মরিচ সব আউলা-ঝাউলা কইরা ছোডমা’র কাছে গিয়া আমার নামে মিছা কথা কয়। খাওনের সময় ভাতের প্লেটে ছাই ফিইক্কা মারে, না হয় তরকারিতে লবণ ঢালে। সবগুলা একেকটা মকরম শয়তান…!”
“এমন কইরা রাগ করলে চলে মা? এই আমারে দেখস্ না? এমন রাগ নিয়া থাকলে কি বারো বছর সতীন নিয়া ঘর করবার পারতাম? মাঝে মাঝে মন চায়, যে দিকে দুচোখ যায়, চইলা যাই। শুধু তোর ভবিষ্যতের দিকে তাকায়া…” দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের হাত বুলিয়ে দেন মিলি বেগম। চোখে তার শূন্য দৃষ্টি, এখন আর সহসা জলের দেখা মেলে না এ অঞ্চলে। দুঃখের গাঙে বইতে বইতে অশ্রুরাজিও হয়তো আজ ক্লান্ত।
৯.
“ও বিলুর মা, নুড়িরে আইজ পাত্তরপক্ষ দেখতে আইবো। নুড়ির মায়রে কথাডা কইয়া আহো, হ্যায় যেন মাইয়ারে শিখায় পড়ায় দেয়। আর তোমার আলমারিরতে একডা ভালা শাড়ি দিইয়া আইসো তো” স্ত্রীর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলেই বিছানায় গা হেলিয়ে দিলেন রইসুল রমিজ।
“ক্যান? আমার শাড়ি ক্যান দিমু?” মুখ ঝামটা মেরে বললেন আমিরা বানু।
“এতো প্যাঁচাল পারো ক্যা? তোমারে কি কম শাড়ি দিসি নি?” স্বামীর ঝাড়িতে চুপ হয়ে গেলেন আমিরা। কিছুক্ষণ পর মিনমিন করে বললেন,
“তা পোলা কি করে?”
“সদরে বাপের দোকান আছে, কাপড়ের কারবার। ব্যবসায়ী মানুষজন, জায়গা-জমিও কম নাই।”
“বয়স কেমন পোলার?”
“পুরুষ মাইনষের আবার বয়স কি?”
“না, মানে আমার জরিডারও তো বিয়ার বয়স হইতাছে। ভালো পাত্র পাইলে খোঁজ নিয়া…”
“নুড়ির পর সে ভাবন যাইবো” স্বামীর কথার পৃষ্ঠে আর কিছু বললেন না আমিরা বানু। তবে মনে মনে তিনি বেশ আনন্দিত, নুড়ি নামের আপদটাতে যে বিদায় হতে চললো।
চলবে…
.
.
.
চতুর্থ পর্ব:
https://mbasic.facebook.com/groups/884724498624937?view=permalink&id=944281226002597&_rdr