#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০৮
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
নিস্তব্ধতার রেশ যখন সবাইকে ঘিরে ধরতে ব্যস্ত। তখনই প্রাপ্তি সুযোগ পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে চলে যাবার জন্য অগ্রসর হলো। সবাই মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তখনই মেহেভীনের নজর যায় প্রাপ্তির দিকে, প্রাপ্তি দৌড় দিতে চাইলে মেহেভীন খপ করে প্রাপ্তির হাত ধরে ফেলে। রক্তিম আঁখিযুগল প্রাপ্তির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। আল্লাহ তায়ালা যদি চোখ দিয়ে খু’ন করার শক্তি দিত। তাহলে প্রাপ্তি এতক্ষণে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকতো।
–কোথায় পালাচ্ছ আপু? এত সহজে তোমাকে ছেড়ে দিব ভাবছ! আমার সবকিছুর হিসাব আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে, তারপরে এখানে থেকে পালাবে। এর আগে পালানোর চেষ্টা করলে পা ভে’ঙে রেখে দিব। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে প্রাপ্তি মেহেভীনের গালে প্রহার করতে চাইলে, মেহেভীন প্রাপ্তির হাত ধরে ফেলে। অদ্ভুত ভাবে মেহেভীন ভেতর থেকে দিগুণ শক্তি অনুভব করল। নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না৷ প্রাপ্তির গালে ক’ষে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিল। উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। মেহেভীনের মতো মেয়ে এমন কাজ করতে পারে! তা সবার ধারণার বাহিরে ছিল। প্রাপ্তি মেহেভীনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করল। মেহেভীন পড়ে যেতে চাইলে শেহনাজ এসে তাকে ধরে ফেলল। মেহেভীন নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গিয়েছে। সমস্ত শরীর ভূমিকম্পের ন্যায় কাঁপছে। রাগান্বিত হয়ে প্রাপ্তির দিকে ছুটে যেতে চাইছে। কিন্তু শেহনাজ তাকে ধরে রাখায় যেতে পারছে না। তাকে আঁটকে রাখার যুদ্ধে নেমে পড়ল নাকি শেহনাজ।
–তুই কাকে ক্ষমতার পাওয়ার দেখাচ্ছিস মেহেভীন? তুমি জানিস আমি চাইলে তোর কি করতে পারি৷ আজ তুমি সফল হয়েছিস কার জন্য শুধু মাত্র আমার জন্য। সেই তুই আমার গালে প্রহার করলি! এর ফলাফল কতটা ভয়ংকর হতে চলেছে। তা তোর ধারণার বাইরে তোর সবকিছু কেঁড়ে নিব আমি৷ অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে দেখে, আয়মান দৌড়ে প্রাপ্তি কাছে গেল। প্রাপ্তিকে টানতে টানতে নিজের কক্ষের দিকে এগিয়ে নিতে চাইলে, প্রাপ্তি হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে নেয়। কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হয় প্রাপ্তি। মেহেভীন ও শেহনাজকে ছাড়িয়ে দেয় নিজের থেকে। মেহেভীন সামনের দিকে অগ্রসর হতেই, একজোড়া হাত এসে মেহেভীনকে ধরে ফেলে। মেহেভীন তাকিয়ে দেখে ফরিদ রহমান তার হাত ধরে আছে। বাবাকে দেখে সমস্ত রাগ নিমিষেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল৷ চুপসে এল রণচণ্ডী রুপ ধারণ করা মুখশ্রী।
–তুই এখানে কার অনুমতি নিয়ে এসেছিস?
–আব্বু আমি আম্মুর থেকে অনুমতি নিয়ে আসছি।
–চুপ কর বে’য়াদব মেয়ে! আবার গর্ব করে বলছে। দূরে গিয়ে অভদ্রতা শিখে এসেছিস। দোষ তো তোর তুই কেন আমাদের সাথে যোগাযোগ করিসনি। নিজের দোষ অন্যের ওপর চাপিয়ে বেঁচে যেতে চাইছিস? আজকে বাসায় চল আগে, তারপরে তোর একটা ব্যবস্থা করব আমি। বাবার কথায় লজ্জাবতী পাতার ন্যায় মাথা নুইয়ে গেল। বাবার প্রতি ভিষণ অভিমান জমলো মনের গহীনে। সে তো স্বীকার করছে। দোষ তার ও আছে। তাই বলে যে বেইমানি করেছে। তাকে তো আর ছাড় দেওয়া যায় না৷ সুযোগ পেয়ে সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে ভুললেন না সাহেলা চৌধুরী।
–দেখেছেন ভাই মেয়েকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি। কেমন করে নিজের বড় বোনের গায়ে হাত তুলল। আবার বড় বড় কথা বলছে। আপনার মেয়ের কত টাকা চাই। আমাদের বললে আমরা দিয়ে দিতাম। এভাবে কোন সাহসে আমাদের বাড়ির বউয়ের শরীরে প্রহার করে।
–আপনি-ও আপনার বাড়ির বউকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি। তা-না হলে এভাবে ছোট বোনের টাকা চুরি করে নেয়। আমার মেয়েকে আমি কথা শোনাব৷ বাহিরের কাউকে কথা বলতে বলিনি আমি।
–এই পালিয়ে যাওয়া মেয়েকে নিয়ে এত অহংকার! না জানি কার সাথে কি করতে গিয়েছিল। আবার আপনাদের মুখ পোড়াতে আসছে।
–সাবধানে কথা বলবেন। আমার মেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা বলার অধিকার আমি আপনাকে দেইনি। আপনি নিজের চরিত্র দেখুন। অতীতের কাহিনি বলব কেঁচো খুঁজতে গিয়ে কেউটো বের না হয়ে আসে আবার। আপনার বাড়ির বউকে বলেন। আমার মেয়ের টাকা গুলো যেন ফেরত দেয়৷ ফরিদ রহমানের কথায় সমস্ত মুখে আঁধার ঘনিয়ে আসে সাহেলা চৌধুরীর। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে না। বাকরুদ্ধতা যেন তাকে সম্পূর্ণ রুপে গ্রাস করে ফেলছে। প্রাপ্তি মুখটা ছোট করে নিজের কক্ষ থেকে টাকা গুলো বের করে নিয়ে আসলো। সবার সামনে মাফ চেয়ে টাকা গুলো ফেরত দিল। মেহেভীন ছাড় দিতে চাইনি। ফরিদ রহমান অজানা কারনে প্রাপ্তিতে শাস্তি দিতে নিষেধ করেছে। ভেতরটা তার ভয়ে কাবু হয়ে আসছে।
আঁধারকে বিদায় জানিয়ে প্রভাতের আলোয় আলোকিত হয়েছে সমস্ত ধরনী। কালকে মেহেভীন মলিন মুখশ্রী নিয়ে বাসায় ফিরেছে। ক্রোধে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে। নিজের ওপরে ভিষণ রাগ হচ্ছে, কেনো সে এত বোকামি করল। কথায় থাকে না কঠিন মুহূর্তে বুদ্ধি কাজে আসে না। সেই মুহুর্ত চলে যাবার পর হাজার রকমের বুদ্ধি বের হয়৷ কিন্তু তা অকেজো হয়ে যায় কেনো কাজেই আসে না। মেহেভীনের সফলতার খবর পুরো এলাকায় ছড়িয়ে গিয়েছে। সবাই প্রশংসা করছে। এমন সময় খবর আসলো। প্রাপ্ত ছাঁদ থেকে পড়ে গিয়েছে। অবস্থা খুব একটা ভালো না। আয়মানকে রাস্তার কিছু ছেলে ধরে মা’র’ছে। দু’জনের অবস্থা খুব একটা ভালো না৷ এক রাতের ব্যবধানে এতকিছু হয়ে গেল। সবকিছুই কি কাল্পনিক ভাবে হয়েছে! নাকি এর পেছনে কারো হাত আছে। কথা গুলো মেহেভীনকে ভিষণ করে ভাবাচ্ছে। প্রাপ্তির জন্য এতটুকু ও মায়া লাগছে না৷ মেহেভীনের বাবা প্রাপ্তির বাবার সাথে হসপিটালের চলে গিয়েছে। প্রাপ্তির মায়ের সাথে মেহেভীনের আম্মু হাসপাতালে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেহেভীনের সবকিছু বিষাদ লাগছে। সে বাসায় থেকে বের হয়ে গেল। প্রাপ্তি নামক অশান্তি তার জীবনের সব শান্তি কেঁড়ে নিয়েছে। এই মেয়েটা কেই সে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো। অথচ মেয়েটা তার প্রতি কতটা অবিচার করল! কথা গুলো ভাবতে ভাবতে মেইন রোডে চলছে আসছে মেহেভীন।
মাশরাফি স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে বাসার দিকে আসছিল। তখনই চায়ের দোকানের সামনে হিমেলের সাথে দেখা। হিমেল হাতে সি’গা’রে’ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাশরাফিকে দেখে সি’গা’রে’ট’টা মাশরাফির দিকে এগিয়ে দিল। মাশরাফি প্রথমে ভয়ে নাকচ করে দিল। সেদিনের মারের কথা মনে হলে এখনো দম বন্ধ হয়ে আসে। হিমেল অনেক করে বোঝানোর পরে, নিতে রাজি হলো। কাঁপা কাঁপা হাত বাড়ালো সিগারেট হাতে নেওয়ার জন্য। আশেপাশে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিল। অথচ রাস্তার ওপাশে একজোড়া রক্তিম আঁখিযুগল তার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে৷ সেদিকেই তার নজর পড়েনি। আচমকা সেদিকে নজর যেতেই কলিজা শুকিয়ে আসলো। মুনতাসিমের কিছু বলতে হলো না৷ চোখের গরমেই কাবু হয়ে গেল মাশরাফি। দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। মাশরাফি চলে যেতেই মুনতাসিম নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
চারিদিকে টুংটাং প্রতিধ্বনিত মুখরিত। এত কোলাহলের মধ্যে মেহেভীন একটু নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ খুঁজছে। মনের মধ্যে শান্তি নেই তার৷ অশান্ত হৃদয় নিয়ে ছুটে চলেছে অজানা গন্তব্যে। বাবা-মা বাসায় আসলে তবে তার শান্তি মিলবে। বাবা কথা বলছে না। কথাটা স্মরন হতেই বুকটা চিনচিন করে উঠলো। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে গিয়ে কখন যে রাস্তার মাঝে চলে আসছে। সেদিকে তার খেয়াল নেই। শতশত গাড়ির চলাচল চারদিকে। একটা গাড়ি মেহেভীনের দিকে ধেয়ে আসছিল। তখনই কেউ একজন হাত ধরে সরিয়ে নিয়ে আসে। আকষ্মিক ঘটনায় মেহেভীন স্তব্ধ হয়ে গেল। পেছনে ফিরে চেনা মুখশ্রী দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো মেহেভীন।
–জামাই হারিয়ে গিয়েছে ম্যাডাম। এভাবে দেউলিয়া হয়ে রাস্তার মাঝে নেমে এসেছেন কেন? মনে খুব বেশি ব্যথা করছে? আমাকে বললেই পারতেন। আমি নিজ দায়িত্বে আপনার স্বামীকে আপনার হাতে তুলে দিতাম। মুনতাসিমের কথা রাগান্বিত হয়ে গেল মেহেভীন। এই মানুষটা এতটা বেশি কথা বলে কেন! বেশি কথা বলা মানুষ তার একদম পছন্দ না। সে তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছে বলে, তাকে যা খুশি তাই বলবে!
–আমাকে বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ। প্রাণে বাঁচিয়েছেন বলে, নিজেকে কি মনে করেন? আমাকে যা খুশি তাই বলা যায়৷ বেশি কথা বলা মানুষ একদম পছন্দ না আমার৷ এরপরে আমার সামনে বেশি কথা বলার চেষ্টা ও করবেন না।
–বেশি কথা বলা মানুষটা যখন চুপ হয়ে যাবে। সেই নিরবতা টা আপনি নিতে পারবেন না ম্যাডাম। নিরবতা বড্ড ভয়ংকর। আপনার মানতে কষ্ট হবে। দম বন্ধ হয়ে আসবে। আগের মানুষটাকে ফিরে পেতে চাইবেন৷ কিন্তু শত চেষ্টা করে আগের রুপে ফেরাতে পারবেন না। মানুষ একবার পরিবর্তন হয়ে গেলে, তার মনে জায়গা দখল করার মতো কঠিন কাজ ধরণীর বুকে নেই।
–আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?
–সব কথা যদি সবাই সহজে বুঝে যেত। তাহলে হৃদয়টা জ্বলে পুড়ে এতটা দগ্ধ হয়ে যেত না। বলতে না পারার আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে। হারিয়ে ফেলার ভয় সমস্ত শরীরকে কাবু করে ফেলছে৷ মেহেভীন তাকিয়ে দেখল মুনতাসিম অদ্ভুত ভাবে ঘামছে। শরীর জুড়ে অস্থিরতা কাজ করছে। শরীরের শিরা-উপশিরা ভয়ে কাঁপছে। মানুষটার এত অস্থিরতা, ভয় হয়ে কাবু হয়ে আসা, তার সামনে এত কথা বলা। মানুষটার এই একটাই রুপ নাকি আরো কোনো রুপ আছে। যে রুপের কথা মানুষটা তার সামনে বলতে চাইছে না৷
–আপনি এত ঘামছেন কেন?
–প্রচন্ড গরম পড়েছে তাই।
–আপনার বাসা এখানে? আপনি কোথায় থাকেন? এদিকে কি করতে আসছেন?
–আমি পালিয়ে যাচ্ছি না। চাইলে আমাকে কোলে নিয়ে আপনার বাসায় যেতে পারেন। আমি আপনার কোলে বসে খেতে খেতে উত্তর দিব। মেহেভীন নিজের ললাটে নিজেই প্রহার করল। একটা পাগলের সাথে কথা বলছে সে। এমন উল্টা পাল্টা কথা ছাড়া তার থেকে ভালো কিছুই আশা করা যাবে না। মেহেভীনকে নিরব দেখে মুনতাসিম আবার বলে উঠলো,
–যদি-ও আপনার বয়সটা বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর। কিন্তু আপনার তো বাচ্চা নেই। তাই আপনি চাইলে আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরবার চেষ্টা করতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না।
–আপনার মতো আস্ত একটা হাতিকে কোলে নিতে হলে, আমাকে আবার জন্ম নিতে হবে। আমার ভুল হয়েছে আপনার সাথে কথা বলা৷ কেন যে বারবার আপনার সাথে আমার দেখা হয়। বিরক্ততে মুখশ্রী কুঁচকে এল মেহেভীনের। তখনই মাতাল করা সুগন্ধি এসে ঠেকল মেহেভীনের নাকে। গন্ধটা তার পূর্ব পরিচিত সে এই ফুলটা ভিষণ ভালোবাসে। ছোট বেলায় এই ফুলের জন্য কতশত পাগলামি করত।
মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই মুনতাসিম শিউলি ফুলের মালা মেহেভীনের সামনে ধরে বলল,
–ফুলের জন্য ফুল নিয়ে এসেছি৷ আপনার শিউলি ফুল ভালো লাগে৷ মেহেভীন ফুল দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। আবেগে উৎফুল্ল হয়ে গেল। চট করে মুনতাসিমের হাত থেকে শিউলি ফুলের মালাটা হাতে তুলে নিল। মেহেভীনের হাসোজ্জল মুখশ্রী দেখে, মুনতাসিমের বুকটা প্রশান্তিতে ভয়ে গেল। তোলপাড় করা হৃদয়টা শান্ত নদীর ন্যায় স্থির হয়ে গেল। প্রেয়সীর মুখশ্রীতে এক টুকরো হাসি তুলে দিতে পেরেছে। এটাই তার কাছে সবথেকে বড় পাওয়া। মনটা নিজের হয়েও অন্যের ভালো থাকার উপরে নিজের ভালো থাকা নির্ভর করে। মেহেভীন মালাটা খোঁপায় পড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। মুনতাসিম মেহেভীনের হাত থেকে মালাটা নিয়ে পড়িয়ে দিল। মেয়েরা অল্পতেই খুশি মেয়েদের খুশি করার বেশি কিছু লাগে না। আর সবচেয়ে যেটা পেলে খুশি হয়। সেটা হচ্ছে ফুল। যে মেয়ে ফুল ভালোবাসে না৷ সে মেয়ে কোনো মেয়েই না। মুনতাসিম মনোমুগ্ধকর হয়ে বলল,
“ফুলের সুন্দর্য কেও হারিয়ে মানিয়ে দিবে। আমার ব্যক্তিগত ফুল। ফুলের চেয়েও বেশি সুন্দর। আমার ব্যক্তিগত ফুল। ”
চলবে…..
#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০৯
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
অভিমান যেন শরীরের শিরায়-উপশিরায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। দিনের আলো বিদায় নিয়ে চারদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। মেহেভীন নিজের কক্ষে কিছু একটা করছিল। রাতে খাবে না বলে দিয়েছে সে। মেয়ের অভিমানের ভাষা বুঝতে বাবার মন এতটুকু সময় নিল না। পরিস্থিতি আমাদের এমন বানিয়ে দেয়। যে-সময় টাতে নিজের মেয়ের থেকে, অন্যের মেয়েকে বেশি প্রাধান্য দিতে হয়। কাল কেও সে নিরুপায় ছিল। মেয়ের ভালোর স্বার্থে মেয়েকে দমিয়ে রাখতে হয়েছে। বাবাদের অল্পতে মাথা গরম করতে নেই। তাদের প্রতিটি কথা বলার পেছনে একটি করে দায়িত্ব থাকে। তাই তাদের এক একটা কথা হিসাব করে বলতে হয়। বাবারা হুটহাট রাগ করতে জানে না। কিন্তু আগলে রাখার ব্যাপারে তাদের তুলনা হয় না৷ ফরিদ রহমান মেহেভীনের কক্ষে আসলো। মেয়ের পাশে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
–অভিমান তো আমার করার কথা! তুই আমার সম্মানের কথা না ভেবে পালিয়েছিস। আবার বিয়েও করেছিস। বাবা-মায়ের কথা একটা বার ভাবলি না। আমাদের সাথে যোগাযোগ না করে, তুই মস্ত বড়ো অন্যায় করেছিস। আমি প্রাপ্তিকে দোষ দিব না। আমি মনে করি দোষ টা তোর। তুই নিজের বাবা-মায়ের থেকে চাচাতো বোনকে বেশি বিশ্বাস করেছিস। আজ আমার সাথে এমন করছিস তো। একদিন ঠিক বুঝবি বাবা কি জিনিস। আমি যদি একবার চোখ বন্ধ করি। তাহলে এখানে একটা দিন টিকতে পারবি না। দেখতে পাবি চেনা মানুষের অচেনা রুপ। সেসব সহ্য করতে পারবি না। তোর পছন্দের চিংড়ি মাছ নিয়ে আসছি। তুই খাসনি বলে আমরা সবাই না খেয়ে বসে আছি। তুই কি চাস আমি না খেয়ে নিদ্রা চলে যাই। বাবার কথায় বুকটা ভারি হয়ে এল। বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠলো। বাবা থাকবে না কথা ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাবা নামক বৃক্ষের ছায়া মাথার ওপরে থেকে সরে গেলে, মাথার ওপরের উত্তপ্ত সূর্য খানা সোজা মাথার মগজে এসে অবস্থা করবে। সে কি ব্যথা অসহনীয় যন্ত্রনা সহ্য করার মতো নয়। কথা গুলো কল্পনা করলেই সমস্ত শরীর কাটা দিয়ে উঠছে।
সময় স্রোতের ন্যায় গড়িয়ে চলে যায়। দেখতে সাতদিন হয়ে গিয়েছে। মেহেভীনকে নিতে গাড়ি আসছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে রৌদ্রের প্রখরতা দিগুণ ভাবে বেড়ে চলেছে। মেহেভীনের মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ফরিদ রহমান মেয়ের হাতে কিছু টাকা দিয়ে দিল। মেহেভীন মুগ্ধ নয়নে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সত্যি বাবা চরিত্র টা অতুলনীয়। বাবার ব্যাখ্যা করতে গেলে শুরু হবে। কিন্তু শেষ হবে না। এতটাই সুন্দর বাবা নামক বটগাছের ছায়া। মেহেভীন সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। রাইমা বেগম মেয়ের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছেন। রুপা আগেই বাসায় চলে আসছে। সকাল থেকে পুরো বাসা পরিষ্কার-পরিছন্ন করেছে সে। মেহেভীন একটু খুঁত খুঁতে ধরনের মেয়ে। তার সবকিছু পরিষ্কার চাই। রুপা সবে মাত্র বসেছিল। তখনই দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। রুপার অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠলো। এই বুঝি আপা চলে এসেছে। কতদিন পর সে আপাকে দেখবে। মেহেভীনকে না দেখলে রুপার মনের গহীনে অজানা বিষাদ এসে ধরা দেয়। দরজা খুলে মেহেভীনকে দেখে, আবেগে উৎফুল্ল হয়ে পরে রুপা। মেহেভীনকে শক্ত করে আলিঙ্গন করে। রুপার পাগলামি দেখে মেহেভীন হেসে দিল।
–রুপা এবার ছাড় বাহিরে থেকে এসেছি। রাস্তায় কত ধুলাবালির ছিল। আমাকে এখন স্পর্শ করিস না।
–আপা আমার এসবে অভ্যাস আছে। আমার আপনাকে ছাড়া একদম ভালো লাগে না। আমার আপনি ছাড়া কে আছে বলেন। আমার পুরো ধরণীটাই হচ্ছে আপনি। আমার এক টুকরো আবেগ আপনি। আমার সুখ, শান্তি, ভালো থাকা, আমার আহ্লাদ করা, আমার শখ পূরন করে দেওয়া, আমার সবকিছু শুধু আপনাকে ঘিরে। এত ভালোবাসা পাওয়ার পরে ভালোবাসার মানুষ টিকে ছাড়া থাকা ভিষণ দুষ্কর আপা। হাসোজ্জল মুখশ্রী খানা মুহুর্তের মধ্যে মলিনতায় ছেয়ে গেল। বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেল চঞ্চল হৃদয়। সমস্ত আঁধার ঘনিয়ে ধরলো মেতে ওঠা মস্তিষ্কের আনন্দ গুলোকে। মেহেভীন রুপার মলিন মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলল,
–এই যে বিষাদ রাণী! আপনি মাঝে মাঝে বিষাদের শহরে হারিয়ে যান। মনকে এত বিষাদগ্রস্ত করে তুলছেন কেন? আমি কি বিষাদিত হবার মতো কোনো কাজ করেছি। মা অনেক খাবার পাঠিয়েছে। সেগুলো বের কর আমি ফ্রেশ হয়ে এসে খাব। কথা গুলো বলেই চলে গেল মেহেভীন। মা শব্দটা অতি আবেগের মা শব্দটার মধ্যে লুকিয়ে আছে অফুরন্ত ভালোবাসা। যে ভালোবাসার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। যার মা নেই সে বুঝে ধরনীর বুকে টিকে থাকার কতটা কঠিন। রুপা যেন মেহেভীনের মায়ের রান্না করা খাবারে, নিজের মায়ের ভালোবাসার স্বাদ খুঁজে পেল। এই রান্নার মধ্যে মেয়ের জন্য মায়ের কত ভালোবাসা আছে। ভাবতেই বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠলো। আজ যদি তার মা বেঁচে থাকত তাহলে তাকে-ও এভাবে রান্না করে খাওয়াত। রুপার আঁখিযুগল অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছে। সেদিকে তার খেয়াল নেই। তখনই একটা হাত তার মুখের সামনে এক লোকমা খাবার ধরল। রুপার তড়িঘড়ি করে অশ্রুকণা গুলো মুছে নিল। মেহেভীনকে দেখে কৃত্রিম হাসার চেষ্টা করল।
–তোর আপা আছে না। তোর আপা থাকতে তোকে একদম কষ্ট পেতে দিবে না। আমার ভুল হয়েছে। তোকে আমার সাথে নিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। আমি একটু ভয়ে ছিলাম। তাই তোকে রেখে গিয়েছিলাম। এরপরে যখন যাব। তখন তোকে নিয়ে যাব। জানি মায়ের কথা স্মরণ করে কষ্ট পাচ্ছিস। আর কয়দিন পরে আমার মা আমার কাছে আসবে। আমার মা অনেক ভালো জানিস। আমার মাকে নিজের মা মনে করবি। আমার অনেক কাজ আছে। কয়টা দিন অনেক ব্যস্ত থাকব। তোকে বলেছিলাম না। বেআইনি ভাবে জমি নিজের নামে নিতে চাইছে। শুধু মাত্র আমার একটা সাইনের জন্য পারছে না। সে আমার ওপরে খুব রাগান্বিত হয়ে আছে বুঝছিস। যেকোনো সময় ক্ষতি করে দিতে পারে। বাসা থেকে একা একা বের হবি না। কিছু লাগলে দারোয়ানকে বলবি। কাউকে না পেলে আমাকে কল দিবি। আমি আসার সময় নিয়ে আসব। আর বেশি কথা বলিস না। চুপচাপ খেয়ে নে আমার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে নিস্তব্ধ হয়ে গেল পরিবেশ। মেহেভীন নিজে একবার খাচ্ছে। আরেকটা রুপাকে খাইয়ে দিচ্ছে। এজন্য মেহেভীনকে রুপা এতটা ভালোবাসে। মেয়েটা এতটা দায়িত্ববান আর যত্নশীল যা দেখে রুপা প্রতিবারই মুগ্ধ হয়। মানুষটার প্রতি ভালোবাসা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এই মানুষটা যদি তার জীবন থেকে হারিয়ে যায়। তাহলে কিভাবে সমাজের বুকে সাহস নিয়ে বেঁচে থাকবে। সবাই তাকে ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য শেয়াল কুকুরের মতো অত পেতে থাকবে।
মেহেভীন ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিল। তখনই রুপা এসে জানান দিল। জুনায়েদ খান এসেছেন। মুহূর্তের মধ্যে মেহেভীনের মুখশ্রী বিরক্তিতে কুঁচকে এল। এই লোকটা বাসা পর্যন্ত চলে আসছে। মেহেভীন ভদ্রতা সুলভ রুপাকে নাস্তা নিয়ে আসতে বলল। রুপা চা সহ আরো বিভিন্ন ধরনের নাস্তা নিয়ে এসে সামনে হাজির হলো। জুনায়েদ খান বিরক্তি মাখা হাসি দিয়ে বলল,
–আমার কথা কি ভুলে গিয়েছেন ম্যাডাম। কতদিন ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। এই সাতটা দিন পাগলের মতো অফিসে গিয়ে আপনাকে খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি এভাবে না বলে কোথায় চলে গিয়েছিলেন?
–আমি কোথায় যাব না যাব। সেটা আমার ব্যক্তিগত বিষয় এটা নিশ্চয়ই আপনাকে বলে যেতে হবে না। আপনি এখানে কি কাজে আসছেন। সেই আলোচনায় আসা যাক।
–আমার বেশি কিছু চাই না ম্যাডাম। আপনি শুধু দলিল টাই সাইন করে দিবেন। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার ম্যাডাম। আপনি সাইন করে দিলে, আপনিও মুক্ত আর আমিও খুশি।
–দেখুন জুনায়েদ আমি আপনাকে আগেও বলেছি। আজকে আবারও বলছি। আপনি যেটা চাইছেন। সেটা কখনোই সম্ভব নয়। আমি মেহেভীন কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করিনি। আর এই দেহে প্রাণ থাকা অবস্থায় করব ও না। এটা সব সময় মাথায় রাখবেন। আপনি এবার আমার সামনে থেকে চলে যেতে পারেন।
–আমি জানতাম সোজা কথা শোনার মতো মানুষ আপনি না। তাই আমি আপনাকে রাজি করানোর জন্য একটা জিনিস নিয়ে আসছি। যেটা দেখলেই আপনার মস্তিষ্ক সচল হয়ে যাবে। আর বুদ্ধিমানের মতো আপনি সাইন করে দিবেন। কথাগুলো বলে বিলম্ব করল না জুনায়েদ খান। সে একটা টাকার ব্যাগ রাখল মেহেভীনের সামনে। টাকা গুলো দেখে মেহেভীন ক্রোধের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। জুনায়েদ বিশ্রী হেসে জবাব দিল,
–এবার নিশ্চয়ই আপনার কোনো আপত্তি নেই। এখানে একদম পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আছে। আপনি যদি চান। তাহলে আপনাকে আরো টাকা দিতে রাজি আছি। আপনি শুধু সাইনটা করে দিন ম্যাডাম। আমি সারাজীবন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।
–খোঁজ নিয়ে জেনেছি। আপনার অর্থসম্পদের অভাব নেই। এত অর্থ সম্পদ থাকার পরেও অন্যের জিনিসের প্রতি এত লোভ লালসা কেন? আমাকে জবাব দিন জুনায়েদ খান। সুস্থ অবস্থায় যদি থাকতে চান। তাহলে এখনই আমার বাসা থেকে বের হয়ে যান। আপনি পঞ্চাশ লক্ষ কেন পঞ্চম কোটি টাকা দিলেও আমি সাইন করব না। এখনই যদি আমার সামনে থেকে চলে না যান। তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে জুনায়েদ খান মেহভীনের পা জড়িয়ে ধরল। সাইন করার জন্য অনুরোধ করতে লাগলো। মন গলল না মেহেভীনের সে দারোয়ানকে ডেকে জুনায়েদকে বাসা থেকে বের করে দিল।
চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। জুনায়েদ অশ্রুসিক্ত নয়নে মেহেভীনের বাসার দিকে তাকিয়ে আছে। বুকটা তার খাঁ খাঁ করছে। মেহেভীনের প্রতি ক্ষোভ জমেছে মনে। সে মেহেভীনের শেষ দেখে ছাড়বে। কাউকে একটা কল দিয়ে কিছু একটা বলল জুনায়েদ। ওপর পাশ থেকে হাসির শব্দে মুখরিত হয়ে গেল চারপাশ।
মেহেভীনের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা যুবক। চোখে তার শত জনমের ব্যথা। বুকে জমে আছে টুকরো হয়ে যাওয়া হাজারো স্বপ্ন। এলোমেলো কেশগুলো বিরতিহীন ভাবে উড়ে চলেছে। ফুলের মতো চেহারাটা আজ নেশায় জর্জরিত হয়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মুখশ্রীতে সব সময় হিংস্রতার প্রকাশ পায়। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন হয়ে আছে। মনটা ভালো নেই। যে মানুষ গুলো মনে থাকে, সেই মানুষ গুলোই মনে আঘাত করে। যুবকটি মেহেভীনের ছবির দিকে হিংস্র নয়নে তাকিয়ে আছে। চোয়াল শক্ত হয়ে এল যুবকের। সে ছবির দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল,
–তোমার জ্বালিয়ে দেওয়া আগুনে, আমি যেমন জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হচ্ছে যাচ্ছি মেহেভীন। ঠিক এমন করেই তোমার জীবনটা আমি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিব মেহেভীন। আমার আঁখিযুগলের দিকে কখনো চেয়েছ? যদি চাইতে তাহলে দেখতে এই চোখ কতটা তৃষ্ণা জমে আছে। তোমাকে দেখার তৃষ্ণা। তোমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য আমি কতটা আকুল হয়ে থাকতাম। একটু দেখার জন্য কতটা ছটফট করতাম। ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে ফেলতে চাইছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে বানিয়েছ চরিত্রহীন। আদরের ছেলেটাকে হতে হয়েছে বাড়ি ছাড়া। আমার প্রতিটি কষ্টের প্রতিশোধ আমি নিব মেহেভীন। তোমার জীবনটা নরক বানিয়ে ফেলব। তুমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হও। আমি আসছি।
চলবে…..