#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৬৪(অন্তিম পর্ব)
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
পরিবেশ জুড়ে নিস্তব্ধতার মেলা বসেছে, ডাকছে না কভু কেউ৷ সাহেলা চৌধুরী নিজ থেকে এলো মেহেভীনের কক্ষে বাঁধা দিল না কেউ। অনুভূতিরা মলিনতায় ছেয়ে গিয়েছে। বিষাদ প্রতিটি মানুষের হৃদয়কে আসক্ত করে ফেলছে। সুখ যেন হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে পালিয়েছে। ভারাক্রান্ত হৃদয়টা নিয়ে বিরতিহীন ভাবে ছুটে চলেছে জীবন। তখনই খোলা জানালার দক্ষিণের বাতাস গেয়ে উঠল,
খোলা জানালা দখিনের বাতাসে
ঢেকে যায় পর্দার আড়ালে
তখন তুমি এসে হেসে বলে দাও,
আছি আমি তোমার পাশে
বহুদূর পথ ভীষণ আঁকাবাঁকা
চলতে ভীষণ ভয়
তুমি এসে বলে দাও,
আছি আমি পাশে
নিজের ফল বাগানের গাছের নিচে বসেছিল মুনতাসিম। ফেলা আসা শহরটা স্মরন করিয়ে দিচ্ছে। আমাকে তুমি কাঁদিয়ে চলে গিয়েছ। অথচ ভালোবাসাটা আমার শহরেই তুমি পেয়েছিলে। ভালোবাসা পেয়ে তুমি আমাকেই ত্যাগ করলে! তোমাকে আবার আসতে হবে সেই দখিনেরর বাতাস গ্রহণ করতে। যে বাতাসে শুধু প্রণয়নের হাওয়া বইবে। সেখানে দুঃখ নামক কোনো শব্দ আসবে না৷ সুখের রাজত্বের রাজা হবে তুমি। প্রচন্ড ভালোবাসার পর কিছু জিনিস ছেড়ে আসতে হয় না। যদি কাউকে প্রচন্ড ভালোবাসার পর ছেড়ে দাও। তাহলে মানুষটার দীর্ঘশ্বাস না লাগলেও প্রকৃতির অভিশাপ ঠিকি লেগে যায়। মুনতাসিমকে পিছু ডাকছে সেই শহর যে শহরে সে সুখের সন্ধান পেয়েছিল। সে মনো স্থির করে নিল নিজের জীবনে যতটুকু অশান্তি সে গ্রহণ করেছে। তার একাংশও তার সন্তানের জীবনে আসতে দিবে না। সে ফিরে যাবে খোলা জানালার দক্ষিণের বাতাসে ভালোবাসার স্বাদ গ্রহণ করতে। সে উঠে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।
মেহেভীনের সামনে প্রাপ্তি, তাহিয়া, সেহেলা চৌধুরী গম্ভীর মুখশ্রী করে বসে আছে। মেহেভীন সর্বক্ষণ প্রচেষ্টা করছে সকলের মন ভালো জন্য। মেহেভীন মুনতাসিমের টি-শার্ট এবং প্যান্ট পড়ে গলায় ওড়না ঝুলিয়ে মুনতাসিমের মতো করে সকলের সামনে পায়চারি করছে। মেহেভীন মুখশ্রীতে গম্ভীরতা এনে সাহেলা চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–এই মহিলাকে আমার সামনে কথা বলতে নিষেধ করবেন আব্বা। এই মহিলা যদি আমার সামনে কথা বলার চেষ্টা করেছে, তাহলে এই মহিলাকে আমি ধংস করে দিব। মেহেভীনের বলার ধরন দেখে সাহেলা চৌধুরী হেসে ফেলল৷ মেহেভীন প্রাপ্তির সামনে গিয়ে বলল,
–কি প্রাপ্তি দিনকাল ভালো যায় তো? আজ থেকে ভালোমন্দ খাবে সামনে অনেক ধাক্কা সামলাতে হবে তো। মেহেভীনের কথায় প্রাপ্তি মলিন হাসলো। মেহেভীন এবার তাহিয়ার কাছে গিয়ে মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে নিয়ে এসে বলল,
–বিয়ে করেছি দু’দিন পরে বাচ্চার বাপ হয়ে যাব৷ কিন্তু এখনো বউয়ের সাথে বাসর করতে পারলাম না। চলো বউ বাসরটা আজকেই সেরে ফেলি। মেহেভীনের কথা শেষ হতেই সবাই শব্দ করে হেসে উঠল। তাহিয়া লজ্জায় মস্তক নুইয়ে ফেলল। মুনতাসিম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বুকে দু-হাত গুঁজে মেহেভীনের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। সাহেলা চৌধুরীর দৃষ্টি মুনতাসিমের দিকে পড়তেই তিনি আস্তে করে উঠে চলে গেলেন। সাহেলা চৌধুরীকে অনুসরণ করে প্রাপ্তি এবং তাহিয়াও চলে গেল। মুনতাসিম গম্ভীর মুখশ্রী করে মেহেভীনের কাছে এগিয়ে আসলো। মেহেভীন মুনতাসিমের পায়ের ওপরে পা রেখে মুনতাসিমের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
–আপনি কোথায় গিয়েছিলেন মন্ত্রী সাহেব? মুনতাসিম মেহেভীনকে এক হাতে আগলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
–আপনি আমার মনের সাথে জামাকাপড় গুলোও দখল করা শুরু করে দিয়েছেন?
–জামাইয়ের সব টি-শার্ট এবং প্যান্টের অর্ধেক মালিকানা হচ্ছে তার বউ। আপনার সব টি-শার্টের অর্ধেক ভাগ আমার বুঝেছেন মন্ত্রী সাহেব। আপনি চাইলে আমার সালোয়ার কামিজের ভাগ নিতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না। কথা গুলে বলেই মেহেভীন খিলখিল করে হেসে উঠল। মেহেভীনের স্নিগ্ধ হাসির প্রতিধ্বনিতে মুনতাসিমের হৃদয় শীতল হলো৷ সে মেহেভীনের অতি সন্নিকটে গিয়ে মেহেভীনের গালে চুমু খেল। মেহেভীন নিজ থেকে মুনতাসিমে ললাটে অধর ছোঁয়াল। এতে মুনতাসিম ভিষণ অবাক হলো! মুনতাসিমের ভাবনার মাঝেই সাহেলা চৌধুরী কক্ষে প্রবেশ করল। দু’জন দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো। সাহেলা চৌধুরী গম্ভীর মুখশ্রী করে বলল,
–শুনো মুনতাসিম আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই। তোমার জন্য দু’টি সন্তান এবং আমার স্বামীকে হারিয়ে আমি প্রায় সর্বহারা। আমি এদিকে বিরহে কাতরাবো আর তুমি সুখানুভূতিতে মেতে উঠবে। এটা আমার সহ্য হবে না। তুমি আমাদের থেকে দুরত্বে চলে যাও। আমি তোমাকে কোনোদিনই ভালোবাসিনি। আমি তোমার থেকে সবকিছু কেঁড়ে নিয়ে তোমাকে সর্ব শান্ত করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিধাতা আমাকে একাকিত্বের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিল। ঐ যে কথায় থাকে না অন্যের অমঙ্গল কামনা করলে নিজের ধংস অনিবার্য আমার সবকিছু ধংস হয়ে গিয়েছে মুনতাসিম। আমি তোমাকে আর দুঃখ দিতে চাই না৷ কিন্তু মায়ের মন তো তোমাকে দেখলেই আমার মস্তিষ্ক জ্বলে উঠ। আমার ভেতরটা প্রতিশোধ নেওয়ার নেশায় আক্রান্ত হয়ে যায়। তোমাকে যতটুকু দুঃখ দিয়েছি। তার থেকে দ্বিগুন দুঃখ আমি পেয়েছি। যে কয়টা দিন বাঁচব মাশরাফিকে বুকে নিয়ে বাঁচতে চাই। তুমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাও সুখে থাকবে।
–আমি নিজেও ভেবেছি আমি এ বাড়ি ত্যাগ করব। আপনি চিন্তা করবেন না। আব্বা বেঁচে থাকতে এ বাড়ি যেমন আপনার দখলে ছিল। আমি বেঁচে থাকা অবস্থায়ও এ বাড়ি আপনার দখলে থাকবে। সাহেলা চৌধুরী কিছু বলল না দ্রুত কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। মুনতাসিম সব দুঃখ কষ্ট এ বাড়িতে দাফন করে রেখে যেতে চায়। তাই সে বাবার দেওয়া ডায়েরিটা মেহেভীনের সামনে খুলল। ডায়েরির প্রথমেই লিখা ছিল।
আমার প্রিয় মুনতাসিম,
আমি জানিনা কোন মুখে তোমার থেকে ক্ষমা চাইব। আমার ক্ষমা চাওয়ার কোনো বাক্য জানা নেই। আমি তোমার ভালো করতে গিয়ে তোমার সবচেয়ে খারাপটা আমি করে ফেলেছি। তোমাকে ভালো থাকার আশ্বাস দিয়ে তোমার ভালো থাকাটা কেঁড়ে নিয়েছি। আমি সব সময় চেয়েছি তুমি ভালো থাকো। কিন্তু মেহেভীন তোমার জীবনে আসায় তুমি মেহেভীনকে নিয়ে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করতে যা আমার একদম পছন্দ ছিল না। তুমি চাইলে আমার ছেলে-মেয়ে দু’টোকে ভালোবাসতে পারতে, কিন্তু তুমি ভালোবাসোনি। আমি জানি তুমি কেন তাদের ভালোবাসো না৷ একজন মানুষ নিশ্চই তার খুনির জন্য কাঁদবে না। আমি তো বাবা আমি সর্বদা চেয়েছিলাম। আমার ছেলে-মেয়ে গুলো একসাথে মিলেমিশে থাকুক। আমি সবাইকে এক করতে গিয়ে সবার খারাপ করে ফেলছি। মেহেভীন যখন মুনেমের কথা জেনে যায়৷ তারপর থেকে আমি মেহেভীনের সাথে ভিষণ অন্যায় করে ফেলছি। কখনো মেহেভীনের সাথে ভালো করে দু’টো কথা বলিনি। সব সময় সব দোষ মেহেভীনের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছি। মেহেভীন পরের বাড়ির মেয়ে তো তাই সুযোগটা লুফে নিয়েছি। তুমি মেহেভীনকে বলো তোমার এই অধম বাবাকে পারলে যেন ক্ষমা করে দেয়। যেদিন তোমার আঁখিযুগলে আমার জন্য ঘৃণা দেখলাম। সেদিন থেকে আমার বাঁচার ইচ্ছে হারিয়ে গিয়েছিল। আমি তোমাকে ভালোবেসে বাঁচতে চেয়েছি। কিন্তু তোমার ঘৃণা আমাকে ভেতর থেকে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল। আমি জানিনা এই চিঠিটা পড়ার সময় তুমি আমাকে পাবে কি না তবুও বলব এই নিকৃষ্ট বাবাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। তোমার বাবা তার শাস্তি পেয়েছে। ভালো থেকো মুনতাসিম।
ইতি, তোমার নিকৃষ্ট বাবা।
মিষ্টিমুধুর সময় নিয়ে এগিয়ে চলছে জীবন। সেদিন মুনতাসিম ডায়েরিটা বন্ধ করে সকল দুঃখ মাটি চাপা দিয়ে চৌধুরী বাড়ি ত্যাগ করেছিল। আর পিছু ফিরে আসেনি চেনা নীড়ে, জীবন তার নিয়মে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু সুন্দর সময় পাড়ি দিয়ে চিন্তিত মুহূর্তে পার করছে মুনতাসিম। এর মাঝেই কে’টে গিয়েছে কত গুলো মাস। ঘড়ির কাঁটায় দুপুর তিনটা বাজে। সমস্ত মস্তিষ্ক কেমন জানি অকেজো হয়ে গিয়েছে। সে আহত কণ্ঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
–আমার মেহেভীনকে তুমি ঠিক রেখে আল্লাহ। আমার মেহেভীন ছাড়া আমার কেউ নেই। ওর কিছু হয়ে গেলে আমি কিভাবে বাঁচব? তুমি আমার থেকে আমার ভালো থাকাটুকু কেঁড়ে নিও না। মেহেভীন আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেলে আমি নিঃস্ব হয়ে যাব। আমাকে এভাবে সর্বশান্ত করে দিও না। আমি না আমার মেহেভীনকে ভিষণ ভালোবাসি। পৃথিবীতে এত গুলো মানুষের মধ্যে এই একটা মানুষের কাছে আমি ভিষণ দুর্বল। আমার এক কথায় কিছু মানুষের রুহু কাঁপে, কিন্তু তোমার কাছে আসলে আমার রুহু কাঁপে। আমি ছাড়া তোমাকে ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই। কিন্তু ধরনীর বুকে মেহেভীন ছাড়া আমাকে ভালোবাসার কেউ নেই। আমাকে এতটুকু দয়া করো আল্লাহ। মুনতাসিমের কথা শেষ হবার সাথে সাথে বাচ্চার কান্নার প্রতিধ্বনি মুনতাসিমের কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল। দু’জন নার্স দু’টি বাচ্চা নিয়ে এসে মুনতাসিমের সামনে ধরে বলল,
–কংগ্রাচুলেশন আপনার দু’টি বাচ্চা হয়েছে। আপনার একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে হয়েছে। মুনতাসিমের চিন্তিত মুখশ্রী প্রশস্ত হলো না৷ সে অস্থির হয়ে বলল,
–আমার অর্ধাঙ্গিনী কেমন আছে? মুনতাসিমের কথায় নার্সটা স্নিগ্ধ হেসে বলল,
–আপনার অর্ধাঙ্গিনী একদম ভালো আছে এবং সুস্থ আছে। তাকে একটু পরে কেবিনে দেওয়া হবে। আপনাকে একাই দেখছি আপনার বাড়ির কেউ আসেনি?
–আমার তো কেউ নেই। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম বাচ্চা দু’টোকে দু-হাতে কোলে নিয়ে অনবরত চুমু খেতে লাগলো। অদ্ভুত এক শান্তি অনুভব করছে মুনতাসিম। অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠেছে। সুখেরা শহরের অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মস্তিষ্ক ফুরফুরে মেজাজে আনন্দ করছে। সুখানুভূতিতে স্রোতের ন্যায় বয়ে চলছে সময়।
মেহেভীন খোলা জানালার দক্ষিনে দাঁড়িয়ে আছে। চন্দ্রের আলো এসে মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রীতে রাজত্ব করছে। কেটে গিয়েছে কত গুলো বসন্ত। সেদিনের পর আর দুঃখ মেহেভীন এবং মুনতাসিমকে গ্রাস করতে পারেনি৷ দু’টি সন্তান নিয়ে তারা বেশ সুখেই আছে। তার দু’টি ছেলে-মেয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে।
–আমি মেহবুবা চৌধুরী মেহেনুর কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করিনি আর কখনো করব না৷ আমি এখনই মাকে বলে দিব তুই চুরি করে দেখে লেখছিস। মেহেনুরের কথায় মেহেরাব জ্বলে উঠল। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,
–আমি মেহেরাব চৌধুরী সব সময় জিতেছি। আমি কখনো হারতে শিখিনি। তুই মাকে বলবি মা তোর কথা বিশ্বাস করে নিবে। এটা তো আমি পারি মুখস্থ আছে মাকে মুখস্থ বলে দিব৷ তখন তুই মার কাছে ছোট হয়ে যাবি। আর আমি সব সময় বড় থাকব।
–তোকে দেখাচ্ছি। কথা গুলো বলেই মেহেনুর মায়ের পাশে এসে দাঁড়ালো। তার মায়ের শাড়ির আঁচল টেনে বলল,
–মা মেহেরাব চুরি করে লিখছে। তুমি এসে বিচার করে দাও। মেহেভীন কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
–তোদের দু’জন পড়তে বলেছি ঝগড়া করতে বলিনি। এসে দু’টোকেই পড়া ধরব৷ আজকে যদি পড়া না পাড়িস তাহলে তোদের বাবার নাম ভুলিয়ে দিব।
–তুমি আমার মা হয়ে শত্রুতা করছ। বুঝেছি তুমি আমার বিরোধী পক্ষ শত্রু পক্ষের কাছে বিচার দিয়ে লাভ নেই। আমি যাচ্ছি আব্বু কাছে আব্বুকে এর বিচার করতেই হবে। আমি কষ্ট করে পড়াশোনা করব আর তোমার ছেলে দেখে দেখে লিখবে। আমি থাকতে এটা কিছুতেই হতে দিব না। মেহেনুর কথা শেষ করে মুনতাসিমের কাছে গেল। সে আঙুল ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,
–আমি আমার শত্রু পক্ষের কাছে গিয়েছিলাম বিচার চাইতে, কিন্তু শত্রুপক্ষ আমাকে সঠিক বিচায় দেয়নি আব্বু। তুমি সঠিক বিচার করে দাও। তোমার ছেলে দেখে দেখে লিখেছে। এখন তুমি কি করবে করো না হলে আমি পড়তে বসব না। মুনতাসিম চিন্তিত হবার ভান ধরে বলল,
–মেহেরাব তো দারুন অন্যায় করেছে! তাকে একটা কঠিন শাস্তি দেওয়া উচিৎ মা৷ তুমি চিন্তা করো না আমার মা যখন আমাকে বলেছে। আমি এর একটা সঠিক বিচার করে দিব।
–এই জন্যই তোমাকে এত ভালোবাসি আব্বু। আমি আর কখনো বিরোধী দলের কাছে বিচার চাইতে যাব না। মা যে মেহেরাবকে বেশি ভালোবাসে এটা আমি বুঝেছি। মেহেনুরের কথায় মেহেভীন বিস্ময় নয়নে মেহেনুরের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,
–আমি বিরোধী পক্ষ! তুই আজকে আসিস খালি আমার কাছে তোকে আমি দেখে নিব। মেহেভীনের কথা শেষ হতেই মেহেরাব খিলখিল করে হেসে উঠল। সে হাসতে হাসতে বলল,
–তোমার মেয়ে আমাকে হিংসা করছে এটা তুমি বুঝতে পারছ মা আম্মু। এই হিংসুটে বুড়ীকে কয়টা লাগিয়ে দাও। তাহলে ওর মাথা থেকে সব হিংসে বের হয়ে যাবে। মেহেরাবের এই বাক্যটাই আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করল। মুহুর্তের মধ্যে মেহেনুর জ্বলে উঠল। মেহেনুর মেহেরাবের দিকে এগিয়ে এসে মেহেরাবকে শাসাতে শুরু করল। দু’জনের কান্ড দেখে মেহেভীন হেসে ফেলল। মুনতাসিম মেহেভীনের কাছে এসে কর্ণে ফিসফিস করে বলল,
–এভাবে কেউ হাসে ম্যাডাম? আপনি এভাবে হাসলে আমি পাগল হয়ে যাই!
–দু’দিন পরে নিজের মেয়ে বিয়ে দিবেন। তবুও আপনার ভালোবাসা ফুরায় না!
–আপনার জন্য আমার হৃদয় ভালোবাসা অনন্তকাল থাকবে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনাকে আমি প্রথম দিনের মতোই ভালোবেসে যাব। মেহেনুর এবং মেহেরাব দু’জন ঝগড়া করতে করতে ঘুমিয়ে গিয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। এই দুই ফাঁকিবাজ পড়াশোনা না করার ভয়ে রাতে ইচ্ছে করে ঝগড়া শুরু করে তারপর ঘুমিয়ে যায়। মুনতাসিম মেহেভীনকে সাথে নিয়ে খোলা জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো। খোলা জানালার দক্ষিণে বাতাস এসে দু’জনকে আলিঙ্গন করে যাচ্ছে। যে শীতল বাতাসে নেই দুঃখে ছোঁয়া পুরো বাতাসটাই যেন ভালোবাসায় মাখা। এমন একটু সুখই তো তারা চেয়েছিল। যে সুখ এই খোলা জানালার দক্ষিণের বাতাস তাদের দিয়েছে। মুনতাসিম মেহেভীনকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,
–আমি আপনাকে ভিষণ ভালোবাসি ম্যাডাম। আপনি যতটুকু জানেন তার থেকে-ও বেশি আমি আমার বাচ্চার মাকে ভালোবাসি। মেহেভীনের হৃদয় শীতল হলো সে মুনতাসিমের বুকে মাথা রেখে বলল,
–আমিও আমার মন্ত্রী সাহেবকে ভিষণ ভালোবাসি। আমার বাচ্চার বাবা যেমন আমাকে ভালোবাসে। ঠিক তেমনই আমিও আমার বাচ্চার বাবাকে ভালোবাসি। মুনতাসিম শক্ত বন্ধনে মেহেভীনকে আবদ্ধ করে ফেলল৷ সে পরম আবেশে মেহেভীনের ললাটে অধর ছোঁয়াল। মেহেভীন মুনতাসিমের কাঁধে মস্তক ঠেকিয়ে চন্দ্রের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিম মেহেভীনকে এক হাতে আগলে রেখেছে। খোলা জানালা দিয়ে দক্ষিণের বাতাস বইছে। চারিদিক ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। অনুভূতিরা নতুন ছন্দে মেতে উঠল। মস্তিষ্ক ফুরফুরে হয়ে গেল। সুখ যেন সময়কে গ্রাস করে নিয়েছে। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ জীবন বয়ে যাবে সারাজীবন।
(সমাপ্ত)