খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৫৮+৫৯+৬০

0
442

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫৮
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

রজনীর আঁধার বিলুপ্ত হয়ে ধরনীর বুকে প্রভাতের আলো উপচে পড়েছে। বিষাদকে গ্রাস করে নিয়েছে এক টুকরো সুপ্ত অনুভূতি। তিক্ততা যখন হৃদয়কে বিষিয়ে তুলে ব্যস্ত, তখনই সুখানুভূতি তিক্ততাকে গুষে নেওয়ার কর্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। অনুভূতি গুলো সুখ-দুঃখের সংমিশ্রণে দোল খেলে যাচ্ছে। একদিকে যেমন সুখ বিষাদকে পাকড়াও করে ফেলছে। অপর দিকে প্রকৃতি তার দায়িত্ব পালন করেছে। সে অন্যের ক্ষতি চাইল সৃষ্টিকর্তা তাকে নরক যন্ত্রণা মিলিয়ে দিল। বিধাতার বিচার ভয়ংকরের রকমের সুন্দর। মানুষ তার কর্ম দ্বারা ফল পেয়ে যায়। তাইয়ান অষ্টাদশী কন্যাকে কোলে নিয়ে হসপিটালের মধ্যে প্রবেশ করল। অষ্টাদশীর মস্তক বেয়ে স্রোতের ন্যায় রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তাইয়ানের কোলে কোনো নারীকে দেখে মুনতাসিমের আঁখিযুগলে বিস্ময় ধরা দিল! তার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা বলছে। তাইয়ানের আঁখিযুগলে শেহনাজের জন্য অদ্ভুত লুকানো প্রণয় সে দেখেছে। তবে এই রমনীর দেখা সে পেল কোথায়? মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–এই মেয়েটা কে তাইয়ান?

–আমি আপনাকে সব বলছি স্যার, আগে মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে। তাইয়ান বাক্য গুলো শেষ করেই দ্রুত জরুরি বিভাগের দিকে ছুটে গেল। মুনতাসিম আড়দৃষ্টিতে তাইয়ানকে পর্যবেক্ষণ করে নিল। মেয়েটার মস্তকে আঘাত লেগেছে। ডক্টররা তাকে সর্বোচ্চ ভালো চিকিৎসা দিয়েছে। তাইয়ান মুনতাসিমের কাছে আসতেই মুনতাসিম তাইয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–তুমি আবার বাড়ি যাও তাইয়ান। আমাদের বাড়ির প্রতিটি সিসি ক্যামেরা চেক করে দেখো। যদিও আমি জানি কাজটা কার, তবে আব্বার সামনে মানুষটাকে উপস্থাপন করাটা জরুরি। তাইয়ান নির্লিপ্ত চোখে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাইয়ানের দৃষ্টিতে মুনতাসিম ঘৃণা দেখতে পেল। তাইয়ানের আঁখিযুগলে কতটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ তাইয়ানের কি হয়ে গেল! তাইয়ান তো ভেজালযুক্ত প্রণয় গড়ে তুলে না। তাইয়ানের দৃষ্টিতে সে কয়েকমাস হলো প্রণয় দেখে না। তবে কি দু’জনের বিচ্ছেদ তার আড়ালেই হয়ে গেল? মুনতাসিমের মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে আছে। শূন্য মস্তিষ্ক দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে অক্ষম হলো। প্রেয়সীর চিন্তা মন মস্তিষ্ককে গ্রাস করে নিয়েছে।

তাইয়ান পথের ধারে রিয়াদ চৌধুরীর জন্য অপেক্ষা করছিল। মুনতাসিম কালকে রাতে সবাইকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। তাইয়ান তথ্য সংগ্রহ করে নিয়েই বের হচ্ছিল, এমন সময় রিয়াদ চৌধুরীর তাকে থামিয়ে দেয়। সে-ও তাইয়ানের সাথে যাবে বলে জানায়। তাইয়ান চৌধুরী গৃহের দিকে দৃষ্টিপাত করে ছিল। তখনই একটা কালো গাড়ির ভেতর থেকে একটা বস্তা রাস্তার মাঝে ফেলে দেওয়া হয়। কিছু ফেলার শব্দ কর্ণকুহরে আসতেই তাইয়ানের দৃষ্টি রাস্তার মাঝে যায়। বস্তার মুখ খুলে নারীর কেশগুলো দেখা যাচ্ছে। তাইয়ান তড়িৎ গতিতে বস্তার কাছে ছুটে যায়। বস্তার কাছে আসতেই তাইয়ানের দৃষ্টি অন্যদিকে চলে যায়। ততক্ষণে রিয়াদ চৌধুরীও চলে এসেছে। তাইয়ানকে দেখে তাইয়ানের কাছে আসতেই তার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। হঠাৎ করে ভেতরটা উথাল-পাতাল শুরু করে দিল। মুখশ্রী দিয়ে আপনা-আপনি বিশ্রী গালি চলে আসলো। তাইয়ান চিৎকার করে বলল কালো গাড়িটাকে ধরতে। রিয়াদ চৌধুরীর গায়ের চাদরটা মেয়ের কায়াতে জড়িয়ে দিল। চিৎকার দিয়ে অর্ধাঙ্গিনীকে ডাকল। আশেপাশে লোক জড়ো হয়ে গেল। চারিদিকে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল। মেয়ের করুন অবস্থা দেখে সাহেলা চৌধুরী জ্ঞান হারালো। শেহনাজকে দ্রুত হসপিটালে নেওয়া হলো। ভাগ্যের পরিহাসে যার মৃত্যুর খবরে আনন্দ উল্লাস করতে চেয়েছিল। বাস্তবতার নির্মম সত্যে আজ তার সাথেই একই হসপিটালের ভর্তি হতে হলো শেহনাজের। শেহনাজের নির্মম অবস্থা দেখে বুক কাঁপল না মুনতািসমের। সে নিরব ভূমিকা পালন করছে। তখনই কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল কিছু সুখময় বাক্য, সাদা এপ্রন পড়া নার্সে এসে জানালো মেহেভীনের জ্ঞান ফিরেছে। মুনতাসিম দ্রুত গতিতে মেহেভীনের কেবিনের দিকে ছুটে গেল। মেহেভীন নিষ্পলক চাহনিতে চেয়ে আছে। সমস্ত মুখশ্রী মলিনতায় ছেয়ে গিয়েছে। মুনতাসিমকে দেখে বুকের মধ্যে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। মানুষটা ঠিক আছে দেখে মানসিক ভাবে সুস্থ অনুভব করল মেহেভীন। মুনতাসিমের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। সে মেহেভীনের কাছে এসে মেহেভীনকে তুলে বসালো। মুনতাসিম রক্তিম আঁখিযুগল নিয়ে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–এত জেদ কিসের আপনার? আমি আপনাকে চলে যেতে বলেছি। মরে যেতে বলিনি! শুকনো পাতার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিলাম৷ আপনি এসে কুড়িয়ে নিলেন। তা-ও আবার পোড়ানোর জন্য। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন মুনতািসমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মুনতাসিমের একটা বাক্যও তার বোধগম্য হয়নি। সে বোঝার চেষ্টা করছে। মুনতাসিম তাকে কি বলতে চাইছে? মেহেভীনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি উপলব্ধি করতে পেরে মুনতাসিম চোয়াল শক্ত করে বলল,

–আপনি বি’ষ খেয়েছেন কেন? মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন বিস্ময় নয়নে মুনতাসিমের মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীন গলায় ভিষণ ব্যথা অনুভব করল। তবুও সে সময় নিয়ে একটু একটু করে বাক্য উচ্চারন করে বলল,

–আপনাকে ছুঁয়ে বলছি। আমি বি’ষ খাইনি। আমি বি’ষ খাওয়ার মতো মেয়েই না৷ যে জীবন আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। সে জীবন নষ্ট করার অধিকার আমার নেই। এত অল্পতে ভেঙে পড়ার মতো মেয়ে, আমি না৷ আমি জীবনে কম কঠিন পরিস্থিতির স্বীকার হইনি। যেখানে আমার আ’ত্ন’হ’ত্যা করার কথা ছিল। আমি সেখানে পাথরের ন্যায় শক্ত হয়েছি। সেখানে আপনার সামান্য মুখের কথায় আ’ত্নহত্যা’র মতো পাপ কাজ করে বসব! আর যদি আমি বি’ষ খেয়েও থাকি, তাহলে আপমার কি? আপনার জন্য তো আরো ভালো হবে। আপনার জীবনের অশান্তির মূল উৎস হলাম আমি। না থাকব আমি আর না থাকবে অশান্তি। আমার জন্য আপনাকে আর এতটুকু কষ্ট পেতে দিব না। যে মানুষটা ধরনীর নিয়মের উর্ধ্বে গিয়ে আমার ভালো চাইলো। আমি আমার জীবনের বিনিময়ে মানুষটার ভালো থাকা দিয়ে যাব। মেহেভীন আর কোনো বাক্য উচ্চারন করতে পারল না৷ মুনতাসিম নিজের অধরযুগলের সাথে মেহেভীনের অধরযুগল এক করে দিল। হৃদয়ের দহনে পুড়তে পুড়তে কয়লা হয়ে গিয়েছে সে। তার প্রেয়সী তাকে দ্বিগুন পোড়ানোর গল্প শোনাচ্ছে! সে পোড়াতে জানলে মুনতাসিম ভালোবাসা দিয়ে সেই আগুন নিভাতে জানে। মেহেভীন আঁখিযুগল বন্ধ করে ফেলছে। বুকের মধ্যের ধকধকানির শব্দ কর্ণকুহরে এসে বাড়ি খাচ্ছে। নিস্তেজ কায়াটা আরো নিস্তেজ হতে শুরু করেছে। অনুভূতিরা চারপাশে রাজত্ব করছে। বিষাদ গুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। বাতাসে বাতাসে প্রনয়ের আদান-প্রদান ঘটছে। মুনতাসিম মেহেভীনের মস্তকটা নিজের বুকে চেপে ধরে বলল,

–হৃদয়টা পুড়তে পুড়তে একদম ছাই হয়ে গিয়েছে। ভেতরটা পোড়ার মতো এতটুকু অংশ অবশিষ্ট নেই। আপনি কি সেটা উপলব্ধি করতে পারছেন ম্যাডাম? যে আপনার মুখশ্রী দেখে বাহিরের সমস্ত ক্লান্তি মেটায়, আপনাকে দেখার ক্লান্তি সে কাকে দেখে মিটাবে? আপনি বললে আমি সেচ্ছায় মরে যাই। তবুও এত দুঃখ দেওয়ার কি আছে? আপনি সব বুঝেন শুধু আমায় বুঝেন না। মুনতাসিমের প্রতিটি বাক্য মেহেভীনের হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল। সে নিস্তেজ কায়ার শক্তি প্রয়োগ করে মুনতািসমকে শক্ত হাতে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করার চেষ্টা করল। কিন্তু শক্তি তার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে। মানুষটাকে আঁকড়ে ধরার মতো শক্তি ক্ষয় হয়েছে। সে কোনো বাক্য উচ্চারন করল না। মানুষটাকে একটু কাছ থেকে অনুভব করার চেষ্টা করল। এই মানুষটা তার মানসিক শান্তি। যাকে ছাড়া তার দম বন্ধ হয়ে আসে। রজনীর নিদ্রা দূরে দেশে পাড়ি জামায়। মানুষটার অভিমান তার বুকে পাহাড় সমান অশান্তি সৃষ্টি করে। মেহেভীনের গলা ব্যথা হওয়ায় সে কোনো বাক্য উচ্চারন করতে পারছে না। বাক্য গুলো কণ্ঠনালিতে আসার আগেই গলায় টান ধরছে। চুপচাপ সেই যন্ত্রনা টাকে উপভোগ করতে হচ্ছে। মুনতাসিম দূরে সরতে চাইলে মেহেভীন মুনতাসিমের এক হাত আঁকড়ে ধরল। মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–ভালো করে কথা বলেছি। তারমানে এটা ভাববেন না। আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আপনার কোনো ক্ষমা নেই। খাবার এসেছে খাবার গুলো খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিবেন৷ আপনাকে হসপিটালে থাকতে হবে না। আমি আজই আপনাকে বাসায় নিয়ে যাব। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীনের কোনো ভাবান্তর হলো না৷ সে মুনতাসিমের হাত ধরে রাখল।

শেহনাজের চিকিৎসা শুরু হয়ে গিয়েছে। অবস্থা খুব একটা ভালো না। রিয়াদ চৌধুরীর সমস্ত মুখশ্রী আঁধারে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। ভেতরটা অসহনীয় যন্ত্রনায় জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হচ্ছে। তখনই মুনতাসিম আসে সেখানে বাবার পাশে না বসে তাইয়ানের কাছে গিয়ে বলল,

–কিছু খবর বাতাসের সাথে ছড়িয়ে পড়ে তাইয়ান। কিন্তু খেয়াল রাখবে খবরের সাথে যেন আমার নাম না জড়ায়। যার মেয়ে তার নাম উল্লেখ করেই যেন খবর প্রচার করে। আমার নাম কোনো টিভি চ্যানেল প্রচার করলে সেই টিভি চ্যানেলকে আমি বিলুপ্ত করে দিব। এটা প্রতিটি টিভি চ্যানেলের মালিককে বলে দিও। রিয়াদ চৌধুরী ছেলের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করল। মুনতাসিম জীবনের প্রথম বাবার দৃষ্টি উপেক্ষা করল। তখনই পাশের কেবিন থেকে কারো উচ্চ স্বর কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল। তাইয়ান মুনতাসিম দু’জনেই গেল। তাইয়ানকে দেখেই রমনী তাইয়ানের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,

–বাবুর আব্বু তুমি এসেছ? আমি তোমার জন্য কখন থেকে অপেক্ষা করছি। তুমি আমাকে রেখে কোথায় হারিয়েছিলে? আমি শহরের অলিতে-গলিতে তোমাকে খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও তোমাকে পাইনি। তুমি এতটা স্বার্থপর কিভাবে হয়ে গেলে! নিজের সন্তানের কথা ভেবে তোমার বুক কাঁপেনি? রমনীর কথায় তাইয়ান বিস্ময় নয়নে রমনীর দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে দ্রুত রমনীকে দূরে সরিয়ে দিল। মুহুর্তের মধ্যে মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠল। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–এই মেয়ে তোমার মস্তকে সমস্যা আছে? এসব তুমি কি বলছ? তুমি জানো আমি কে? আমি চাইলে তোমার কি করতে পারি, সেটা তোমার ধারনাতেও নেই। একটা থাপ্পড় দিব বাবার নাম ভুলিয়ে দিব। তুমি নিজেই একটা বাচ্চা আবার পরপুরুষকে বাবুর আব্বু ডাকতে তোমার লজ্জা করছে না!

–ঠিক টাইমে বিয়ে করলে তোমার বাবু আজ ধরনীর বুকে তোমার চুল টানত। আব্বা দেখছেন আপনার সামনে আপনার ছেলে আমাকে অপমান করছে। আপনার কি নাতির মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না। আপনি দাদা হতে চান না আব্বা। আপনার ছেলে আমার সাথে এমনটা কিভাবে করতে পারল? রমনীর কথায় তাইয়ান শব্দ করে কেশে উঠল৷ মুনতাসিমের মুখশ্রীর কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ সে গম্ভীর মুখশ্রী করে দাঁড়িয়ে আছে। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–আমি তো তাইয়ানের আব্বা না। মুনতাসিমের কথায় রমনীর মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। সে চুপসে যাওয়া কণ্ঠে বলল,

–আপনি তাইয়ানের বাবা না!

–না।

–আমি তো আপনার সাথে মজা করছিলাম। আপনি নিশ্চয়ই তাইয়ানের বড় ভাই। তাইয়ানের সাথে গাড়িতে যে ছিল সেটা আপনাদের বাবা। আমি আপনার বোনের মতো মামা হয়ে আপনার অনাগত ভাগনের প্রতি অবিচার হতে দিবেন? রমনী মিথ্যার বলছে তা মুনতািসমের বিচক্ষণ আঁখিযুগল স্পষ্ট বলে দিচ্ছে। সে রমনীর কথায় তাল মিলিয়ে বলল,

–এটা তো ঘোর অন্যায়! আমি মামা হয়ে এত বড় অন্যায় ভাগনের প্রতি হতে দিতে পারি না। তোমার কি চাই বোন? তুমি ভাইকে বলো তোমার ভাই সকল সমস্যার সমাধান করে দিবে। মুনতাসিমের কথায় রমনীর সমস্ত মুখশ্রী চকচক করে উঠল। আঁখিযুগলে আশার আলো দেখতে পেল সে। তার অভিনয় এত সুন্দর সেটা আগে জানা ছিল না। কি সুন্দর মানুষ টাকে বোকা বানিয়ে ফেলল। মানুষটা তা ঘুনাক্ষরেও টের পেল না! সে খুশিতে আহ্লাদ করে বলল,

–আমার বেশি কিছু চাই না। আমি আমার স্বামীর সাথে আপনার বাড়িতে থাকতে চাই। বাচ্চাটা হয়ে গেলেই চলে যাব। আমি জানি আমার স্বামী আমাকে আর ভালোবাসে না। সে পর নারীতে আসক্ত হয়ে গিয়েছে। রমনীর কথায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল তাইয়ান। সে রমনীর দিকে দু’কদম এগিয়ে গিয়ে বলল,

–আমার নামে যদি আর একটা বাজে কথা বলেছ। তাহলে এখানেই খু’ন করে ফেলব। আমি তোমাকে চিনি না। পথের মাঝে গাড়ির সামনে এসে পড়েছিলে, তাই তোমাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছি। তোমার ধান্দা আমি বুঝেছি। তোমার কত টাকা চাই বলো? আমি তোমাকে তোমার ক্ষতি পূরন দিয়ে দিচ্ছি।

–আমার ভালোবাসাকে তুমি টাকার সাথে পরিমাপ করছ বাবুর আব্বু? আমার ভালোবাসায় তো কোনো কমতি ছিল না। তাহলে কেন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে? তাইয়ান মুনতাসিমের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করল। সে নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,

–আমি এই মেয়েটাকে চিনি না স্যার। ও মিথ্যা কথা বলছে। হসপিটালে আসার সময় গাড়ির সামনে পড়েছিল। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি৷ মুনতাসিম কোনো কথা না বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। তাইয়ানের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। বিধাতা তাকে কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন করল! কোনো দিকেই সে স্থির হতে পারছে না। কিছু সময়ের জন্য শেহনাজের কথা মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ঘৃণায় জর্জরিত হৃদয়টাও শেহনাজের করুন অবস্থা দেখে কাঁপছে না। সে শেহনাজকে শতবার নিষিধ করেছে। সর্তক করেছে তবুও শেহনাজ উন্মাদের মতো কাজ করেছে। দীর্ঘ কয়েক মাস তাদের কথা হয় না। বিচ্ছেদের যন্ত্রনায় কত রজনী তাইয়ান কাতরেছে। হাহাকারের রাত চিৎকার করে প্রেয়ীকে কাছে চেয়েছে। প্রেয়সী আসেনি। যার চিন্তায় সে বুকটা ভরা যন্ত্রনায় দিন পার করেছে। সে অন্যের বুকে সুখ খুঁজে নিয়েছে। মানুষটার প্রতি আগের ন্যায় ভালোবাসা নেই। কিন্তু অনুভূতি গুলো মাঝে মাঝে ভেতরটা নাড়িয়ে দেয়।

রজনীর মধ্য প্রহর চলছে। বিকট শব্দে নিদ্রা ভাঙে সবার। সবাই দ্রুত শেহনাজের কেবিনে যায়। সে পাগলের মতো চিৎকার করছে। শেহনাজের এমন অবস্থা দেখে মেহেভীন অবাক হলো! শেহনাজ যে হসপিটালে ভর্তি সে কথা মুনতাসিম তাকে বলেনি। শেহনাজ চিৎকার করে বলছে। আমার কাছে তোমরা এসো না। আমি একটা নোংরা মেয়ে। আমি পাপী। আমি পাপ করেছি। আমাকে বিধাতা শাস্তি দিয়েছে। আমি তো এমন শাস্তি চাইনি। আমাকে এতটা শাস্তি বিধাতা কেন দিল? ও বাবা আমাকে জন্মের পর বি’ষ দিয়ে মারলে না কেন? সমস্ত কায়া জুড়ে অসহনীয় যন্ত্রনা করছে। আমাকে তোমরা মেরে ফেলো। আমার মতো মেয়ের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। ও ভাই আমি না তোমার অনেক ক্ষতি করেছি। আমাকে তুমি শাস্তি দাও ভাই। তোমার সাথে বেইমানি করার শাস্তি যদি হয় মৃত্যুদণ্ড। তাহলে আমি কেন এখনো বেঁচে আছি? তোমরা চলে যাও। আমার সাথে কথা বললে তোমরাও নোংরা হয়ে যাবে। আল্লাহ তুমি আমায় কি শাস্তি দিলে। আমি কিভাবে বাঁচব। আমাকে মৃত্যু কেন দিলে না? আমাকে তোমরা বাঁচিয়েছ কেন? আমাকে শাস্তি দাও মুনতাসিম ভাই। চিৎকার চেচামেচি শুনে রমনীও এসে উপস্থিত হয় সেখানে। আশেপাশে লোক জড়ো হয়েছে। ডক্টর নার্সরা শেহনাজকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। শেহনাজ কাউকে তার আশেপাশে ঠেকতে দিচ্ছে না৷ তখনই মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “তোমার শাস্তি হলো বেঁচে থাকা।” মুনতাসিমের কথায় সকলের মুখশ্রীতে বিষণ্ণ ধরা দিল। উপস্থিত সকলের আঁখিযুগল মুনতাসিমের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছে।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫৯
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

বিষন্ন আঁখিযুগল মুনতািসমের দিকে স্থির হয়ে আছে। নিস্তব্ধতায় পরিপূর্ণ পরিবেশ। মুনতাসিমের মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠল। ভেতরটা ঝনঝন করে শব্দ তুলে বলছে। এটাই সঠিক সময় হৃদয়ের গহীনে লুকানো তিক্ত বাক্য গুলো উপচে বের করে দাও। মস্তিষ্ক বাঁধা সাধলেও মন সেটার তোয়াক্কা করল না৷ বজ্রকণ্ঠে বের হতে শুরু করল কয়েক বছরের জমানো বিষাদ গুলো। মুনতাসিমের প্রতিটি বাক্য কেবিনের প্রতিটি মানুষের হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের কণ্ঠে বাবার প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্যে ফুটে উঠল। সে তাচ্ছিল্য করে বলল,

–আপনি শেহনাজের অবস্থার জন্য মেহেভীনকে দোষ কিভাবে দিতে পারেন আব্বা? আপনি অতি সন্তান ভক্ত হতে গিয়ে অন্ধ হয়ে গিয়েছেন! আপনাকে আমি এতটাই ভালোবাসি। যতটা ভালোবাসলে আপনার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলার কথা স্মরন হতেই আমার হৃদয় কাঁপে। অনুভূতিরা শূন্য হয়ে পড়ে। বাবার দিক ধরতে গেলে আপনি আপনার জায়গায় ঠিক আছেন। কিন্তু অন্যায়ের দিকে গেলে আপনি ভুল পথে হাঁটছেন আব্বা। আমাকে উত্তপ্ত হতে বাঁধ্য করবেন না। আমি আমার কথার আঘাতে আপনাকে আঘাতপ্রাপ্ত করতে চাই না৷ আপনার মেয়েকে আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্ষমা করব না৷ মুনতাসিমের কথায় জ্বলে উঠল রিয়াদ চৌধুরী। নিজের ক্ষমতা আছে বলে সব জায়গায় ক্ষমতার প্রয়োগ দেখাতে নেই। নয়তো নিজের ক্ষমতার দাপটে নিজেকেই ঝলসে যেতে হয়। রিয়াদ চৌধুরীর অপ্রত্যাশিত ক্রোধই যেন তার কাল হয়ে দাঁড়ালো। সে উচ্চ বাক্যে বলল,

–তোমার অর্ধাঙ্গিনীর জন্যই আমার মেয়েটার ক্ষতি হয়েছে। তোমার অর্ধাঙ্গিনী যদি বি’ষ না খেত, তাহলে আমার শেহনাজের জীবনে এমন কালো অধ্যায় নেমে আসত না। তোমার অর্ধাঙ্গিনীর জন্য আমার মেয়ের পুরো জীবনটাই আঁধারে তলিয়ে গেল। বাবার প্রতিটি বাক্য ভেতরটা জ্বালিয়ে দিল। সে বাবার ন্যায় উচ্চস্বরে বলল,

–আপনি নিজের মেয়ের দোষ না দেখে আমার বউয়ের দোষ কেন দেখছেন? আমার বউ তো বি’ষ খাইনি। আমার বউকে বি’ষ খাওয়ানো হয়েছে। সেটা কে খাইয়েছে আপনি ভালো মতোই জানেন আব্বা। আপনি সবকিছু জেনেও নিজের মেয়ের জঘন্যতম অপরাধ গুলো আষাঢ়ের কালো মেঘের ন্যায় আড়াল করে দিয়েছেন। মাশরাফি বলতে চেয়েছিল। আপনি তাকে-ও বাঁধা দিয়েছেন। আপনি এখনো আমাকে চিনেন নাই আব্বা। ধরণীর বুকে আমার পরিবারের খবর আমার থেকে ভালো কেউ জানে না। আমার পাশের বাসার মানুষ কখন কোথায় যায়, কি করে, তাদের অর্থ কতটুকু হালাল কতটুকু হারাম সব বলে দিতে পারব আমি। আর নিজের পরিবারের মানুষের তথ্য আমার কাছে থাকবে না। আমাকে আপনি এতটাই নির্বোধ ভাবেন আব্বা? আমি আসলে নির্বোধ না আব্বা। আমি আপনাদের সাথে কঠিন হতে চাই না বলেই আপনাদের সামনে নির্বোধ সেজে থাকি। আপনার মেয়ের করুন পরিস্থিতির জন্য আপনার মেয়ে নিজেই দায়ী। আপনি তাকে জিগ্যেস করে দেখুন। আমি তাকে শতবার নিষেধ করেছি৷ সহস্রবার সর্তক করেছি। তুমি যার সাথে মিশছ সে ভালো না। তোমাকে যেন পরবর্তী থেকে ঐ ছেলের সাথে মিশতে না দেখি। আপনার মেয়ে বাহিক্য ভাবে যেমন আলাভোলা দেখায় ভেতরটা তার ভয়ংকর রকমের বিষাক্ত। সে যদি আমার কথা শুনত তাহলে তাকে আঁধারের সমুদ্রে আঁচড়ে পড়তে হতো না৷ আপনার মেয়ে আমার বউকে বি’ষ খাইয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেল। তার বয়ফ্রেন্ড তাকে কলঙ্কিত করে তাকে ছেড়ে দিল। এখন সব দোষ আমার বউয়ের! সে চাইলে বড় ভাইয়ের কথা শুনতে পারত না। সে আমাকে কোনোদিনই নিজের ভাই মনে করেনি। তার নিজের ভাই আছে। আমি তার নিজের ভাইয়ের ভালোবাসা কেঁড়ে নিয়েছি। তার ভাইকে জোর করে বিয়ে দিয়েছি। তাই তার ভাই আমাকে খু’ন করার জন্য যা যা করতে বলছে। আপনার মেয়ে তাই তাই করেছে। আপনাকে আমি এতটাই সন্মান করি আব্বা। আপনার জন্য মুনেমের মতো অমানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছি। আপনার দুই ছেলে মেয়ে মিলে আমাকে প্রতি নিয়ত হ’ত্যা করার চেষ্টা করে গিয়েছে। আমি আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে সবকিছু সহ্য করে গিয়েছি। আমি যতদিন আপনার কথা মতো চলেছি। আমি ততদিন আপনার প্রিয় ছিলাম আব্বা। যেদিন থেকে আমি আমার সুখ আপনার থেকে চেয়েছি। সেদিন থেকে আমি আপনার কাছে অপ্রিয় হয়ে উঠেছি। আমি কখনো ভাবিনি আব্বা আপনার প্রিয় সন্তান থেকে এতটা অপ্রিয় সন্তান হয়ে উঠব। আপনি মেহেভীনকে দেখতে পারেন না কেন সেটাও আমি আপনাকে বলছি। আপনি ভেবেছেন আপনার সব কথা মেহেভীন আমায় বলেছে। না আব্বা, মেহেভীন আমায় কিছু বলেনি। মেয়েটা এতটাও খাবার নয়। জানি মেয়েটা আমায় অনেক কষ্ট দেয়। কিন্তু নিজে কষ্ট পাবে তবুও আমাকে দেওয়া প্রতিজ্ঞার অমর্যাদা সে করবে না। আমার তার প্রতি বিশ্বাস আছে। একটা কথা জমিনে ফেলতে না দেওয়া মেয়েটা আপনার কথার আঘাতে শতবার মরেছে। তবুও আপনার নামে আমার কাছে একটা অভিযোগও করেনি। কিন্তু সেদিন থেকে মেহেভীন মুনেমের কথা জেনেছে। আপনি তাকে কিভাবে প্রতিনিয়ত আমার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। সেটা জেনেছে। শেহনাজের বিপথে চলে যাবার কথা জেনেছে। সেদিনের পর থেকে মেহেভীন আপনার চোখের বি’ষ হয়ে গিয়েছে। আপনি সব সময় ভয় পেতেন। এই বুঝি মেহেভীন আমার সব বলে দিল। আমি রাগলেও আপনি ভাবতেন মেহেভীন আমার কান ভারি করেছে। আমি বাহিরের শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করে করে মানুষ চিনেছি আব্বা। প্রথমে আমার মানতে কষ্ট হলে-ও আমি পরে মানিয়ে নিয়েছি। সংসারের শান্তি চেয়েছিলাম মেয়েটার কাছে, এইদিকে মেয়েটা আমাকে শান্তি দিয়েছে। না বলেছে আপনার বেঈমানির কথা, না বলেছে মুনেমের কথা, আর না বলেছে শেনাজের উচ্ছন্নে যাবার কথা। সে শেহনাজের ভালো চাইল আর শেহনাজ তার মৃত্যু চাইল। এতে আপনি কি বুঝলেন আব্বা? পর মানুষের ভালো চাইতে নেই। পর যদি পরের মতো আচরণ না করে তাহলে তার স্বার্থকতা আসে না। পর যদি আপনের মতো আচরণ করে তাহলে এভাবেই কথার আঘাতে মরতে হয়। আপনার ছেলে আর মেয়ে আমাকে মারতে চেয়েছে। তারা জাফর ইকবালের মতো ক্রিমিনালের সাথে হাত মিলেছে। আমার এক্সিডেন্টও তারা মিলে করিয়েছে। আমার বউকে বি’ষ আপনার মেয়ে খাইয়েছে। আর আপনি আপনার ছেলেমেয়ের দোষ রেখে আমার বউয়ের দোষ খুঁজছেন। কথায় থাকে না দূরে গেলে দুরত্ব বাড়ে আর কাছে থাকলে প্রণয় বাড়ে। এই কথাটার স্বার্থকতা আমি নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারছি। আমার মা যতদিন বেঁচে ছিল। আমার প্রতি আপনার ভালোবাসাও ঠিক ততদিনই ছিল। আমার মা নেই। আমার কেউ নেই। আমার একটাই পরিচয় আমি এতিম, অনাথ। আমার সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ নেই। তিনিই আমার একমাত্র গার্ডিয়ান। মুনতাসিমের প্রতিটি বাক্য হৃদয়ের গভীরে স্পর্শ করে গেল। অদ্ভুত ভাবে পরিবেশ শীতল হয়ে উঠল। কেবিনে উপস্থিত প্রত্যেকের আঁখিযুগলে অশ্রু এসে জমা হয়েছে। তাইয়ান অপরাধীর ন্যায় মস্তক নুইয়ে আছে। ভেতরটা ভয়ে কাবু হয়ে আসছে। মুনতাসিম কখন জানি তাকে নিয়ে বলতে শুরু করে। রিয়াদ চৌধুরীর অনুভূতি নাড়া দিয়ে উঠল। সে জানত না মুনতাসিমকে শেহনাজ আর মুনেম মারতে চায়। যদি জানত তাহলে কখনো দু’জনকে সাহায্য করত না। সে প্রতিটি সন্তানকে জীবিত দেখতে চেয়েছিল। নিজের ভালোটা দিয়ে সবাইকে মিলেমিশে এক করতে চেয়েছিল। নিয়তি যে তার সাথে এভাবে ছলনা করবে। সেটা সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। সে অসহায় মাখা দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। অসহায়ত্ব যেন রিয়াদ চৌধুরীর সমস্ত মুখশ্রীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। সন্তানদের ভালো চাইতে গিয়ে সন্তানদের খারাপটা যে কখন করে ফেলল, সেটা টেরই পাননি তিনি। রিয়াদ চৌধুরী বিধস্ত শেহনাজের গালে পরপর কয়েকটা প্রহার করল। ঘুমের ঔষধ দেওয়ার কারনে তার সমস্ত কায়া নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। রিয়াদ চৌধুরী অশ্রুমাখা কণ্ঠে বলল,

–ম’রে যা তুই। তোর মতো মেয়ের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তুই এতদিন আমায় কেন মিথ্যা বলেছিস? আমাকে কেন বলেছিস মুনেম মুনতাসিমের কাছে ক্ষমা চাইবে। অতীতের কালো অধ্যায়কে ভালোবাসার শক্ত আবরণে ঢেকে দিবে। আমাকে কেন বলেছিস মেহেভীন মুনেম আর তোর নামে মুনতাসিমের কাছে বি’ষ ঢালে? আমি তোদের ভালোবেসেছিলাম। আমি তোদের বিশ্বাস করেছিলাম। তোরা আমাকে এভাবে নিঃস্ব করে দিলি শেহনাজ। প্রতিটি টিভি চ্যানেলে তোর খবর দেখাচ্ছে। সবাই আড়দৃষ্টিতে দেখছে। আজ যদি একজন মন্ত্রীর ছেলে না হতাম। তাহলে আমার বেঁচে থাকা দুর্বিষহ হয়ে যেত। আমি নিজে মুনেমকে শাস্তি দিব। এতদিন মুনেমকে বাঁচিয়েছি। আমি ভুল করেছি। এসব দিন দেখার আগে আমার মৃত্যু হলো না কেন? অর্ধবুজা আঁখিযুগলে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করল শেহনাজ। মুখশ্রীতে তার তাচ্ছিল্য ফুটে উঠেছে। ভেতর থেকে ভেঙেচুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে সে। শেহনাজ নেতিয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,

–আমার এখন আফসোস হচ্ছে ভিষণ আফসোস। আমি কেন তোমার ছেলেকে মারতে পারলাম না। আমি তোমার ছেলেকে মারিনি বলে, তোমার ছেলেও আমাকে মারছে না। আবার আমাকে বলছে। আমার শাস্তি নাকি বেঁচে থাকা। আমি কি করতাম আমি আমার ভাইকে হাহাকার করতে দেখেছি৷ প্রেয়সীকে না পাওয়ার যন্ত্রনায় ছটফট করতে দেখেছি৷ জ্বরের ঘোরে প্রেয়সীর কাছে যাওয়ার জন্য আর্তনাদ করতে শুনেছি। মুনতাসিম ভাই পেয়েছে একটা সুন্দর পরিবার কিন্তু আমার ভাই কি পেয়েছে আব্বু? আমার ভাইয়ের পরিবার থেকেও কেউ ছিল না। মুনতাসিম ভাই আমার সৎ ভাই হয়েও সুস্থ একটা পরিবার পেল। আর মুনেম আমার নিজের ভাই হয়েও সুস্থ পরিবার পেল না। মুনতাসিম ভাই তাকে গৃহত্যাগ করালো। তার ভালোবাসার মানুষের থেকে আলাদা করল৷ তাকে চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষে বন্দী করে রেখে দিনের পর দিন মানসিক এবং শারিরীক ভাবে অচ্যাচার করল। এমনকি মুনেম ভাইয়ের বউ বাচ্চাকেও মুনতাসিম ভাই খু’ন করেছে। শেহনাজের শেষোক্ত বাক্যটি কর্ণকুহরে আসতেই মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–পরী আমার বোন ছিল। তুমি আমার কাছে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলে, পরীও ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি তোমাকে প্রমাণ দেখাতে পারব শেহনাজ। আমি পরীকে খু’ন করেনি। তুমি তোমার বিকেক বুদ্ধি কাজে লাগাও। তোমার ভাই অপরাধ করেছে। সে অষ্টাদশীর মনে প্রণয় জাগিয়েছে। সেই প্রণয়ের সুযোগ লুফে নিয়ছে। বিবাহের আগেই অষ্টাদশীকে করেছে কলঙ্কিত। অষ্টাদশী যখন অন্তঃসত্ত্বা হলো তোমার ভাই তাকে অস্বীকার করল। তাদের পাপের ফল কেন একটা অবুঝ শিশু পাবে! আমি শুধুমাত্র তাদের অনাগত সন্তানের কথা ভেবেই দু’জনের বিবাহ দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার ভাই ছিল উন্মান আর চরিত্রহীন। নারীদের হৃদয়ের গভীরে গিয়ে তাদের আহত করাই ছিল তার প্রধান কাজ। সে কাউকে ভালোবাসত না। যদি ভালোবাসত তাহলে অন্য নারীর কাছে যাবার কথা দ্বিতীয় বার ভাবত না৷ সে নিজেই বিয়ের দুই মাস পরে পরীকে শ্বাসরোধ করে খু’ন করে। তারপর পলাতক হয়ে যায়। আমি তাকে খুঁজি পেয়েও যাই৷ কিন্তু তুমি আর আব্বা মিলে তাকে পলাতক হতে সাহায্য করো। আমি জেনেও চুপ থাকি৷ পরীর লা’শ খোঁজার অনেক চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু পাইনি৷ শেষবার যখন পেয়েছিলাম। তখন পরীকে দেখে আমার ভেতরটা হাহাকার করে উঠেছিল। জীবনে প্রথমবার নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছিল। কিন্তু আমি যে নিরুপমা ছিলাম। পরীর সাথে মুনেমের বিয়ে না দিলে সমাজ পরীকে বাঁচতে দিত না। আমি চেয়েও পারিনি পরীকে বাঁচাতে। পরীকে না বাঁচানোর অপরাধে আমি আজ-ও অপরাধী। এতদিন তোমরা সবাই মিলে আমাকে আঘাত করার চেষ্টা করেছ। আমি জেনেও নিরব থেকেছি। কিন্তু তোমরা আমাকে রেখে আমার হৃদয়ে আঘাত করলে। আমার ভালোর থাকার ভেতরে রক্তক্ষরণ ঘটালে। আমার ভালোবাসার মানুষকে খু’ন করার চেষ্টা করেছ। আমি তোমাদের কখনো ক্ষমা করব না৷ ভুল করেও যদি কারো হাত মেহেভীনের দিকে এগিয়ে আসে আমি সেই হাত ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিব। অদ্ভুত ভাবে শেহনাজের সমস্ত কায়া ঘৃণায় রি রি করে উঠল। সে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে শুরু করল। ঔষধের প্রভাব কাজ শুরু করে দিয়েছে। মুনতাসিম এবার তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করল৷ তাইয়ান কাঁপছে। সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসছে। মুনতাসিম শীতল হেসে বলল, “পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বেইমানের নাম হলো তাইয়ান।” মুনতাসিমের শেষোক্ত বাক্যটি তাইয়ানকে ভয়ংকর ভাবে কাঁপিয়ে তুলল। উপস্থিত সবাই কেমন জানি স্তব্ধ হয়ে গেল। এত জড়ালো ঘটনা কারো মস্তিষ্কে প্রবেশ না করলে-ও তাইয়ান এবং রিয়াদ চৌধুরীর মস্তিষ্কে গভীর ভাবে প্রবেশ করেছে। সুখানুভূতিতে মেতে ওঠা জীবনটা মুহুর্তের মধ্যে বিষাদে রুপ নিল। চারদিকে খালি বিষাদ আর বিষাদ। বিষাদময় জীবনে হৃদয়টাও বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৬০
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

অনুভূতিতে অভিমান গুলো খেলা করছে। বিষণ্ণতা হৃদয়কে গ্রাস করে ফেলছে। অতীতের কালো অধ্যায় গুলো মস্তিষ্কে এসে স্মৃতিচারণ করছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা তার নিরব চাদর দিয়ে পরিবেশকে মুড়িয়ে নিয়েছে। হৃদয়ের গহীনে হাহাকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। শেহনাজ নিদ্রা চলে গিয়েছে। পুরো কেবিন ধীর গতিতে জনশূন্য হয়ে গেল। মেহেভীন মুনতাসিমের পাশে বসে আছে। মুনতাসিমের সমস্ত মুখশ্রীতে গম্ভীরতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। স্তব্ধ সময়কে শব্দ তুলে পরিবেশের নিস্তব্ধতা ভাঙলো মুনতাসিম। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–আপনি মুনেমের কথা কিভাবে জেনে ছিলেন? মুনতাসিমের কথায় মলিন হাসলো মেহেভীন। ধরনীর সমস্ত মলিনতা যেন মেহেভীনের মুখশ্রীতে এসে রাজত্ব করছে। মেহেভীন তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে মলিন কণ্ঠে বলল,

–আপনার যে আরেকটা ভাই ছিল। সে কথা আমাকে তো আগে বলেন নি!

–কিছু জিনিস আড়ালেই সুন্দর। আড়াল কৃত কর্ম গুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটলে তিক্ততা এসে মন মস্তিষ্ককে গ্রাস করে ফেলে।

–আমি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার কথা শুনতে চাই।

–আমার মা মারা যাবার পর আমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। সে কথা তো জানেন। শেহনাজের মা যখন বধু সাজে এসে আমাকে পেল। সেদিন উনার আঁখিযুগলে আমি আমার প্রতি একরাশ ক্ষোভ এবং ক্রোধ দেখেছিলাম। আমি উনাকে প্রথমে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উনি আমার ভালোবাসর অনুমতি দেননি। বাবার সামনে আমার সাথে সব সময় ভালো ব্যবহার করতো। কিন্তু বাবা না থাকলে শারীরিক ভাবে অনেক অত্যাচার করতো। আমাকে ভয় দেখাতো আমি যদি বাবাকে বলে দেই। তাহলে উনি আমাকে খু’ন করে ফেলবে। আমার জেদ সম্পর্কে উনার ধারনা খুবই কম ছিল। উনি আমাকে যত মারতেন। আমার বিচার দেওয়া ততই প্রখর হতে শুরু করল। যেদিন থেকে বুঝলেন আমায় মে’রে কাজ হবে না। সেদিন থেকে আমাকে মারা বন্ধ করে দিল। আমাকে একাকীত্বের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিল। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে কত রজনী বাবাকে কাছে চেয়েছি। কিন্তু ঐ মহিলার জন্য আমি আমার বাবাকে কাছে পাইনি৷ আমি রাতের আঁধারকে খুব ভয় পেতাম। মা মারা যাবার পর আমার ভয় পাওয়া নিষিদ্ধ হয়ে গেল। আজ আমি আপনাকে সব বলব। আমি কেন পাহাড় হতে গিয়ে পাথর হলাম। উত্তাল সমুদ্রের মতো একজন মানুষ ঠিক কি হারালে শান্ত হয়ে যায়। বড় হবার চক্করে কিভাবে বিসর্জন দিলাম আমার কৈশোর, কোন জাদুতে আমার আঁখিযুগল ভিজে না। আমি আপনাকে সব বলব। সৎ মায়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে, আমি বড় হতে চেয়েছি। কোমলের ন্যায় কুসুম মনটাকে পাথরের ন্যায় শক্ত করেছি। ভালোবাসাহীনতায় ভুগতে ভুগতে আমার আঁখিযুগল অশ্রু ফেলে না। যার সমস্ত কৈশোর জীবনটা কেটেছে প্রিয় মানুষদের অবহেলায় এবং তুচ্ছতাচ্ছিল্যে সেই মানুষটা কিভাবে নরম থাকতে পারে বলতে পারেন? আমার সৎ মাকে বুদ্ধি দেওয়া হয়। সে যদি দ্রুত বাচ্চা নিয়ে ফেলে তাহলে আমার বাবা তার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। আর একটা সুন্দর বিষয় কি জানেন? আমার সৎ মাকে বুদ্ধিটা দিয়েছিল আমার নিজের ফুপি। আমি অবহেলা এবং অত্যাচার সহ্য করতে করতে নিরব হয়েছি৷ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ইচ্ছে ছিল। আমি বড় হয়ে আগে আমার সৎ মাকে খু’ন করব। আমি যখন বড় হলাম তখন বুঝে গেলাম। মা ছাড়া একটি সন্তানের জীবন মূল্যহীন। বাবা-মা দু’জনের মধ্যে যদি একজনের কমতি থাকে, তাহলে সবার আগে সেই সন্তান ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। বাবার বিয়ের দু’মাসের মাথায় মুনেম পেটে আসে। কি সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা হয়েছিল। তখন কেউ কি ভেবেছিল? সেই ছোট্ট বাচ্চাটা বড় হয়ে আস্ত একটা অমানুষ তৈরি হবে! তাকে গৃহ ত্যাগ করাতে হবে। তার অল্প বয়স থেকেই নারীর প্রতি ভিষণ ঝোঁক ছিল। পরী বাবা-মা মরা অনাথা মেয়ে ছিল। তার চাচা চাচি তাকে ভিষণ অত্যাচার করতো। মুনেমের কথা যখন তার চাচা চাচি জেনে যায়। মেয়েটার জীবনে অমাবস্যার আঁধার ঘনিয়ে আসে। আমি পারিনি একটা অনাথ মেয়ের জীবন দুঃখের সমু্দ্রে ভাসিয়ে দিতে। আমি তাকে সচ্ছ কাঁচের ন্যায় ঝকঝকে সুন্দর জীবন উপহার দিতে চেয়েছিলাম। লোকে বলে বিয়ের পরে অনেক পুরুষ বদলে যায়। কেউ বখাটে থেকে দারুন সংসারী হয়ে উঠে। কিন্তু লোকে তো এটা বলেনি যে বিয়ের পর একটা মেয়ের জীবন নরক হয়ে যায়। পৃথিবীতে সবচেয়ে ভাগ্যবান সেই নারী, যে নারীর স্বামী ভালো। আর পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা নারী কে জানেন? যে নারীর স্বামী ভিষণ রকমের পাষাণ হৃদয়ের নিকৃষ্ট একজন মানুষ। যে নারীর স্বামী ভালো সে নারী ধরনীর বুকেই জান্নাতের শান্তি অনুভব করে। আর যে নারীর স্বামী খারাপ সেই নারীর সারাজীবনটাই জাহান্নামে পরিনত হয়ে যায়। আমার বোন পরীও সেই দলে ছিল। আমি আজ-ও তার কাছে অপরাধী। বাক্য গুলো শেষ করে স্তব্ধ হয়ে গেল মুনতাসিম। সমস্ত মুখশ্রীতে ক্লান্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মেহেভীনের ভিষণ মায়া হলো। সে চুপচাপ সবকিছু শুনে ধীর কণ্ঠে বলল,

–আপনার ভাই তো আমারও ছোট এত অল্প বয়সে এতকিছু করে ফেলল! এত ক্ষোভ কিসের আপনার প্রতি? সে যার সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়েছিল। আপনি তো তার সাথেই তাকে বিবাহ দিয়েছিলেন।

–মুনেম আপনার ছোট ঠিকই ধরেছেন। তাকে এক নারীর মায়া কখনো বিমোহিত করেনি। সে সহস্র নারীর মোহে বিমোহিত ছিল। যে বারো নারীর স্বাদ গ্রহণ করেছে। সে কিভাবে বুঝবে এক নারীর স্বাদ কতটা ভয়ংকর! এক নারীর মায়াতে আঁটকে থাকা পুরুষ গুলো ভিষণ দুঃখী হয়। এরা আঘাতপ্রাপ্ত হতে হতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। এদের ভেতরটা রক্তাক্ত করে দিতে তাদের প্রেয়সীরা দ্বিধাবোধ করে না। তাদের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে প্রেয়সীরা তৃপ্তি পায়। যারা শত নারীতে আসক্ত থাকে দিনশেষে ভালো থাকে কিন্তু মনে শান্তি থাকে না। কিন্তু যারা এক নারীতে আসক্ত থাকে এরা দুঃখ পায়। আবার এটা ভেবে শান্তি পায় যে মানুষ টা যতই দুঃখ দিক, তার প্রিয় মানুষটা একান্তই তার। প্রিয় মানুষ যেমনটা তার। ঠিক তেমনই প্রিয় মানুষটার দেওয়া দুঃখ গুলোও তার। এটা গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারলেই জীবনটা ভিষণ রকমের সুন্দর। দু’জনের কথোপকথনের মাঝে তুলি এসে সেখানে উপস্থিত হয়। তুলিকে দেখেই মুনতাসিম মলিন হাসলো। সে তুলিকে বলল,

–তুমি এখন থেকে আমাদের সাথে থাকবে। আমার কথা মতো কাজ করবে। তাইয়ানের মনে তোমাকে জায়গা করে নিতে হবে। তোমাকে ভরসা করে বিশাল দায়িত্ব দিয়েছি। তাইয়ানকে কাবু করার দায়িত্ব আমার। শেহনাজ যদি আমার বউয়ের মতো ঘাড় ত্যাড়া হতো কিন্তু এক পুরুষের মোহে বিমোহিত থাকতো। তাহলে আমি তাইয়ানের সাথে শেহনাজের বিয়ে দিয়ে দিতাম। শেহনাজ যে তাইয়ানের বিপরীত চরিত্র আমি ভাই হয়ে তাইয়ানের দুঃখ বাড়িয়ে দিতে পারব না। এতে আমি লোকচক্ষুর বিষ হয়ে যেতে পারি। তাতেও আমার কোনো আফসোস নেই। তাইয়ানের সংসারটা গুছিয়ে দিতে পারলে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পূর্ণতা পূর্ণ হবে। আমি তোমাকে সবকিছু বলে নিয়েছি বোন। তুমি পরে অভিযোগ করতে পারবে না। তাইয়ানকে মানিয়ে নেওয়ার সময় দিবে।

–আমি আমার মতো করে চেষ্টা করব। আমার অসুস্থ মাকে দেখলেই হবে। আমার আর কিছু চাই না মা ছাড়া আমার কেউ নেই। আপনি আমাকে লোভী মেয়ে ভাবতে পারেন। মায়ের ভালো চিকিৎসা করাতে পারব বলেই আপনার শর্ত রাজি হয়েছি। আপনার ভাইকে কতটা ভালো রাখতে পারব জানিনা। তবে আমি আমার ভালোটা দিয়ে তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করব। আমি আজ আসছি। কালকে আপনাদের বাসায় সঠিক সময়ে পৌঁছে যাব। কথা গুলো বলেই তুলি স্থান ত্যাগ করল। মেহেভীনের দু’জনের কথপোকথন শুনে কিছুই বোধগম্য হয়নি। সে নির্বাক ছিল। তুলি চলে যেতেই মেহেভীন ধীর কণ্ঠে বলল,

–মুনেমের ভাস্যমতে তার প্রিয় মানুষ ছিল অন্য কেউ তাই তো? আপনি পরীর সাথে বিবাহ দেওয়াতে সে ক্ষোভে পরীকে খু’ন করে আর আপনাকে খু’ন করার চেষ্টা করে। এতে শেহনাজ মুনেমকে সাহায্য করে। আর আব্বা তার ছেলেকে আপনার হাতে থেকে বাঁচিয়েছে তাই তো?

–হুম। মনটা ভিষণ জ্বলছে মেহেভীন।

–কেনো জ্বলছে?

–কারন আপন মানুষ গুলোই মনে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। মন জ্বলবে না তো কি করবে?

–আমাকে একটা বার মাফ করা যায় না? কথা দিলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অর্ধাঙ্গিনী হয়ে দেখাবো।

–আমার যে ভেতর পুড়ছে। জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। আমার উত্তপ্ত হৃদয়কে আগে শীতল করুন। তারপরে না হয় মাফ চাইবেন। আপনাকে ক্ষমা করার মতো কোনো রাস্তা যে আমি দেখছি না। আপনি ডিভোর্স চেয়েছিলেন না খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে দিব। মুনতাসিমে প্রতিটি বাক্য সমস্ত ভেতরটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দগ্ধ করে দিচ্ছে। সমস্ত কায়া ঝলসে যেতে শুরু করেছে। ডিভোর্স শব্দটা কি বিষাক্ত শোনালো! ছোট একটা বাক্য তবুও ভেতরটাকে কিভাবে যন্ত্রনায় কাবু করে দিচ্ছে! মেহেভীন মুনতাসিমের মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তার মলিনতায় ছোঁয়া মুখশ্রী বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। একটা ভালো বাক্য শোনার জন্য বাহিরটা এমন নিকৃষ্ট বাক্য উচ্চারন করেছে। মেহেভীন শীতল মস্তিস্কে জবাব দিল,

–আমাকে দিয়ে না পোষালে আরেকটা বিয়ে করুন। প্রয়োজন চারটা বিয়ে করুন। বিয়ের করার আগে অবশ্যই আমাকে খু’ন করুন। প্রাণের মায়া থাকলে আমি জীবিত থাকা অবস্থায় করতে যাবেন না। আপনার জন্য শুধু শুধু চারটা নারীর প্রাণ যাবে। আপনি একাকিত্ব খুঁজছেন। আমি আপনাকে একাকিত্ব দিয়ে যাব। যদি কখনো একাকিত্ব ঘুচিয়ে ভালোবাসার চাদরে মোড়াতে ইচ্ছে করে, তবে আমায় ডাকবেন। আপনার জন্য আমার হৃদয়ের দরজা সর্বদা খোলা থাকবে। আপনি আমার হৃদয় গুপ্ত কুঠুরিতে প্রবেশ করতেই চাইলে তারা আপনাকে খুব সংগোপনে আলিঙ্গন করে নিবে। মেহেভীনের কথায় মুনতাসিমের ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে উঠল। এমন কিছুই সে শুনতে চেয়েছিল। তবে কি তার তিক্ত বাক্য গুলো সার্থক হলো! তিক্ততায়ও এত তৃপ্তি পাওয়া যায়? কই আগে তো জানা ছিল না! যদি জানা থাকতো। তবে আগেই তিক্ত বাক্য গুলোকে সে আহবান জানাত। মুনতাসিম কিছু বলার আগেই তাইয়ান আসলো। তাইয়ানের আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। সমস্ত মস্তক নুইয়ে মুনতাসিমের চরণের কাছে অবস্থান করল। মুনতাসিম গম্ভীর মুখশ্রী করে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। তাইয়ান দু-হাত জোর করে বলল,

–আমাকে ক্ষমা করে দিন স্যার। আপনি আমার থেকে মুখশ্রী ফিরিয়ে নিলে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাই। আমি জানি আমি অপরাধ করেছি। আমি অপরাধী। আমাকে আপনি শাস্তি দিন। আমি বেঁচে থাকতে আপনার ঘৃণা দেখতে পারব না। আপনার আঁখিযুগলে ঘৃণা দেখার আগেই যেন আমার মৃত্যু হয়। আমি একটা সময় শেহনাজকে ভালোবেসেছি। আমার ভালোবাসা থেকেই শেহনাজকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু যেদিন থেকে জেনেছি শেহনাজ আপনাকে খু’ন করতে চায়। আল্লাহর কসম করে বলছি সেদিন থেকে শেহনাজকে ভালোবাসা ছেড়ে দিতে শুরু করেছি। ভালোবাসা যদি একদিনে ভোলা যেত তাহলে আমি শেহনাজের মায়া থেকে বের হতে এতদিন সময় নিতাম না। সে আমাকে কখনো ভালোইবাসেনি। আমি বোকার মতো ভালোবেসে গিয়েছি। সে অন্য কাউকে ভালোবাসে জানার পর আমি তাকে আমার জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছি। আমি এখন অনেক ভালো আছি। আমার পুরোনো ভুলের জন্য আমাকে এত বড় শাস্তি দিবেন না স্যার। আমি একদম নিঃস্ব হয়ে যাব।

–তুমি এমন ভাবে কথা বলছ যেন আমি তোমার প্রেয়সী। তোমার সাথে প্রণয় শেষ করে ধোঁকা দিয়েছি। এখন তুমি আমাকে ছাড়া বাঁচবে না। আমাকে কি তোমার গে মনে হয় তাইয়ান? তুমি যে অন্যায় করেছ তার কোনো ক্ষমা নেই। তুমি আমাকেও বাঁচিয়েছ। আবার আমার শত্রু শনাক্ত করার পর তাকে আমার হাতে তুলে না দিয়ে তাকে-ও বাঁচিয়েছ। এর থেকে জঘন্যতম অপরাধ কি হতে পারে তাইয়ান? তোমার মতো বড় বেইমান কেউ হতে পারে না। আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করব না। তুমি আমার আঁখিযুগলের সামনে থেকে চলে যাও। তোমার মুখশ্রী আমি দর্শন করতে চাই না। মুনতাসিমের বলা প্রথম বাক্যে ভিষণ লজ্জা পেল তাইয়ান। এই মানুষটা তার ভিষণ দুর্বলতা। এই মানুষটার সামনে তার সমস্ত আবেগ উপচে পড়ে। ভেতরের আবেগপ্রবণ বাক্যগুলো অনায়াসে বের হয়ে আসে। কিন্তু শেষোক্ত বাক্যগুলো ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলে। কথায় থাকে না মানুষ প্রেমে অন্ধ হয়। তাইয়ানও হয়েছিল। তবে সে সঠিক সময় ভুলটা উপলব্ধি করতে পেরেছিল বলেই এখনো নিঃশ্বাস ছাড়তে পারছে। কিন্তু অনুভূতি গুলো কেন যে মাঝে মধ্যে নাড়া দিয়ে উঠে! কেউ কি চাইলে পারে না। এই বিশ্রী অনুভূতি গুলোকে তার স্নিগ্ধ ভালোবাসার দিয়ে ঢেকে দিতে। পরক্ষনেই তাইয়ান নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানালো। ধরনীর বুকে ভালোবাসা বলতে কিছু নেই। যা আছে তা কিছুটা অভিনয় আর বাকিটা দীর্ঘশ্বাস।

–আপনি আমার শক্তি স্যার। আপনি আমার থেকে দূরে সরলে আমি নিস্তেজ হয়ে যাই। ভেতরটা দুর্বল হয়ে পড়ে। আমাকে শেষ বারের মতো ক্ষমা করে দিন। আমি আপনাকে দ্বিতীয় বার অভিযোগ করার সুযোগ দিব না।

–আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারি। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।

–আপনার জন্য আমি সবকিছু করতে পারব।

–তোমার জীবনটা গুছিয়ে নেওয়ার সময় হয়েছে। এবার তোমার সংসারী হওয়া উচিৎ। আমি তুলির সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি৷ তোমার মতামত ছাড়া কিছুই হবে না। তুমি যদি চাও আমি শেহনাজের সাথেও তোমার বিয়ে দিব। কিন্তু যার মনে তুমি নেই। তার মনে কি ভালোবাসা পাবে? সে তোমাকে ব্যবহার করে গিয়েছে। সে কখনো তোমাকে ভালোবাসেনি। আমি তোমাকে সময় দিলাম। আমার প্রস্তাবে রাজি হলে তবে আমার সামনে আসবে। এর আগে যেন আমি তোমাকে না দেখি। মুনতাসিমের কথায় স্তব্ধ হয়ে গেল তাইয়ান। উঠে দু’কদম পিছিয়ে গেল সে। মুনতাসিম তার কাছে এ কি ধরনের আর্জি করে বসলো! তাইয়ান দোটানায় ভুগছে। ভালোবাসা নামক শব্দটাই এখন তার কাছে বিষাক্ত। সে কিভাবে অন্য এক নারীকে বধু হিসেবে গ্রহণ করবে? সবে মাত্র মনটাকে শান্ত করেছিল। মুনতাসিম যে তাকে অশান্তির সাগরে ডুবিয়ে দিল। তাইয়ানের মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে মুনতাসিম মনে মনে বলল, “আজ যেমন তোমার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে অশান্তির সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েছি। ঠিক তেমনই কোনো এক চন্দ্রের আলোতে আচ্ছাদিত রজনীর মধ্য প্রহরে তুমি আমায় বলবে। আমার জীবনের সবচেয়ে ভালোটা আপনি করেছেন স্যার। সেদিন তোমার জীবনের সমস্ত বিষণ্ণতা কে’টে গিয়ে হৃদয় জুড়ে ভালোবাসার বিচরন ঘটবে। এটা তুমি মিলিয়ে নিও তাইয়ান।”

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে