খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৫৫+৫৬+৫৭

0
412

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫৫
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সুখ গুলোকে গ্রাস নিয়েছে বিষাদের কালো মেঘের দল। নিস্তব্ধ রজনী মুহুর্তের মধ্যে হাহাকার করে উঠল। শহরের আনাচ-কানাচে দুঃখরা রাজত্ব করছে। অনুভূতিরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। বাক্যরা ছন্দ হারিয়েছে। কণ্ঠনালি আওয়াজ তুলতে ভুলে গিয়েছে। বুকের মধ্যে ব্যথাটা জানান দিচ্ছে সে চলে এসেছে। তার ব্যথায় ভেতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিবে। কোলাহল বিহীন হসপিটালটা মুহুর্তের মধ্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। ডক্টর, নার্স যে যেদিকে পারছে ছুটে চলেছে। মুনতাসিমকে জুরুরি বিভাগে নেওয়া হয়েছে। মুনতাসিমের অবস্থা খুব একটা ভালো না। যেকোনো সময় দেহ থেকে প্রাণ পাখিটা উড়াল দিতে পারে। তাইয়ান পাথরের ন্যায় বসে আছে। এখন তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। তাকে শক্ত থাকতে হবে। তার দেহে প্রাণ থাকা অবস্থায় মুনতািসমের জন্য লড়তে হবে। মুনতাসিমের করুন দৃশ্যটা মুখশ্রীর সামনে ভেসে উঠতেই তাইয়ানের বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। সে চৌধুরী বাড়িতে খবর দিবে কি না সেটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভূগছে। মেহেভীন তাইয়ানকে আটত্রিশ বার ফোন করেছে। মুনতাসিমকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ফোনটা তুলতে পারেনি তাইয়ান। তাইয়ানের ভাবনার মাঝেই মুঠোফোন ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠল। তাইয়ান ফোনের স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই মেহেভীনের নামটা ভেসে উঠল। তাইয়ানের সমস্ত কায়া ধীর গতিতে কাঁপছে। সে শক্ত হাতে ফোনটা রিসিভ করল। অপর প্রান্ত থেকে মেহেভীনের রাগান্বিত কণ্ঠ স্বর ভেসে এল।

–আপনি আমার মেসেজের রিপ্লাই করছেন না কেন? আপনি যে শেষে বললেন, মুনতাসিম আপনাকে গাড়ি থেকে নামতে বলেছে। তারপর থেকে আপনার খোঁজ খবর পাচ্ছি না। আপনারা এখন কোথায় আছেন? উনাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসুন। আপনি যদি বাড়ি নিয়ে আসতে না পারেন। তাহলে উনার কাছে ফোনটা দিন। আমার যা বলার বলছি। মেহেভীনের কড়া বাক্য গুলো তাইয়ানের মস্তিষ্ক স্পর্শ করতে পারল না। তার কণ্ঠনালি দিয়ে কোনো বাক্যই আসছে না৷ তার বাবা মরেও নিজেকে এতটা অসহায় লাগেনি। যতটা অসহায় মুনতাসিমকে রক্তাক্ত হতে দেখে লাগছে। তাইয়ানের নিরবতা মেহেভীনের হৃদস্পন্দনের গতিতে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ভেতরটা অদ্ভুত ভাবে হুঁ হুঁ করে উঠছে। কায়ার সমস্ত শক্তি শুষে নিচ্ছে একদল চিন্তা। তাইয়ান নিজের মনকে শক্ত করে নিল। সে মলিন কণ্ঠে বলল,

–স্যার এক্সিডেন্ট করেছে ম্যাডাম। আমরা স্যারকে হসপিটালে নিয়ে আসছি। স্যারের অবস্থা খুব একটা ভালো না। ডক্টররা বলছে যেকোনো সময় স্যার মারা যেতে পারে। স্যারের কায়া থেকে প্রচুর রক্ত বেড়িয়েছে। আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত সংগ্রহ করতে পারছি না। আমি একা একা ভেঙে পড়ছি। আমার নিজেকে ভিষণ ক্লান্ত লাগছে। আপনারা সবাই আসুন না। আপনি বড় স্যারকে খবরটা দিন। বড় স্যার জানলে কিছুতেই ঘরের কোণে বসে থাকতে পারবে না। ধরনীর বুকে হুলস্থুল লাগিয়ে দিবে। তাইয়ানের বাক্য গুলো কর্ণপাত হতেই মেহেভীন হৃদয়বিদারক চিৎকার দিয়ে উঠল। মেহেভীনের চিৎকারে চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি দেওয়াল কাঁপে উঠল। গার্ডরা দৌড়ে মেহেভীনের কক্ষে এল। চারদিকে কোলাহল সৃষ্টি হলো। ততক্ষণে সকলের নিদ্রা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। সবাই বিরক্তি মাখা মুখশ্রী করে মেহেভীনের কক্ষ এল। ফজরের আজান কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাচ্ছে। মেহেভীন দৌড়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। মেহেভীনের এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে সবাই বিরক্ত হলো। তখনই রিয়াদ চৌধুরীর মুঠোফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা কর্ণে ধরতেই কিছু বিষাক্ত বাক্য এসে ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল। চৌধুরী বাড়িতে প্রতিটি আঙ্গিনা তিক্ততায় রুপ নিল। রিয়াদ চৌধুরীর মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। বুদ্ধিরা অকেজো হয়ে গিয়েছে। সে অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়েছে। তারা বিলম্ব না করে দ্রুত হসপিটালের উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পড়ল।

রজনীর শীতল হাওয়া এসে মেহেভীনকে আলিঙ্গন করে যাচ্ছে। নিস্তব্ধ রজনী কায়াকে শীতল করতে পারলেও উত্তপ্ত হৃদয়কে শীতল করতে পারছে না। ভেতরটা প্রিয়জন হারানোর ভয়ে হাহাকার করে উঠছে। সময় যে আজ ভিষণ পাষাণ হয়ে গিয়েছে। এতটুকু পথ তবুও যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। বিপদের পথ গুলো এত দীর্ঘ হয় কেন? দুঃখ গুলো এত অপেক্ষা করায় কেন? খারাপ সময়টা কিছুতেই সামনের দিকে দ্রুত এগিয়ে যায় না। ধীরে ধীরে সামনের দিকে আগায় তবুও পোড়াতে পোড়াতে নিয়ে যায়! হসপিটালের মধ্যে প্রবেশ করতেই তাইয়ান সহ আরো কিছু গার্ডদের দেখা গেল। তারা এতটুকু সময়ের জন্য আইসিইউর সামনে থেকে সরেনি। রিয়াদ চৌধুরীকে দেখেই তাইয়ান এগিয়ে আসলো। তাইয়ান উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,

–আরো দুই ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন স্যার। আমরা রাতে দু’ব্যাগ জোগাড় করেছি। আর কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আপনার পরিচিত কেউ থাকলে ফোন দিয়ে আসতে বলুন। রিয়াদ চৌধুরীর মুখভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে না। সে কতটা আঘাত হয়েছে। সমস্ত মুখশ্রীতে গম্ভীরতা বিদ্যমান। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–তুমি চিন্তা করো না। আমি দু’জনকে বলেছি। তারা আসছে। তারা দু’জন সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ। রিয়াদ চৌধুরীর কথায় শান্ত হলো তাইয়ান। মুনতাসিমকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। একটু পর পর মুনতাসিমের অবস্থা এক একেক রকম হচ্ছে। তাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে। শব্দ যেন প্রতিটি মানুষের মুখশ্রী থেকে হারিয়ে গিয়েছে। হঠাৎ করে মেহেভীনের হৃদয়টা বলে উঠল, “ধৈর্য কি জানেন? হৃদয়টা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে রক্তক্ষরণ হওয়ার পরও আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল করে কষ্টের বিনিময়ে ভালো কিছু প্রত্যাশা করা। মেহেভীনের হৃদয়টা কড়া করে বলছে। রবের কাছে গিয়ে হাত তুলো। সবাই তোমাকে নিরাশ করলে-ও তোমার রব তোমাকে নিরাশ করবে না। তোমার রব খুব শীঘ্রই তোমার সকল দুঃখ মোচন করে দিবে। মেহেভীনে আশেপাশে নার্সদের খুঁজতে শুরু করল। কিছু সময় যাবার পরেই সাদা এপ্রন পড়া একটা নার্স ইনজেকশন হাতে আইসিইউর দিকে এগিয়ে আসছে। মেহেভীন তাকে দেখে আহত কণ্ঠে বলল,

–আপনাদের হসপিটালের নামাজের ঘর আছে?

–জি ম্যাডাম আছে। আপনি নামাজ পড়বেন। চলুন আমি আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি। মেহেভীনকে ম্যাডাম সম্মোধন করায় মেহেভীনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মলিন মুখশ্রী নিয়ে নার্সকে একবার পর্যবেক্ষণ করে নিল। মেহেভীন অজু করে এসে নামাজ আদায় করে নিল। মোনাজাতে এসে মেহেভীনের দমিয়ে রাখা অশ্রুকণা গুলো বাঁধ ভেঙে বেড়িয়ে আসলো। ভেতরটা ভিষণ জ্বলছে। অসহনীয় যন্ত্রনায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে সে। মুনতাসিমের সর্বোচ্চ ভালো সে বিধাতার কাছে চাইল। মানুষটাকে ছাড়া যে সে একদম নিঃস্ব! ধরনীর বুকে আপন বলতে এই মানুষটাই আছে তার। এই মানুষটা থাকবে না ভাবতেই বুকটা খালি খালি লাগছে। মেহেভীনের আঁখিযুগল ফুলে গিয়েছে। মেহেভীনের রক্তিম আঁখিযুগলের দিকে দৃষ্টি যেতেই তাইয়ানের ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে গেল। দু’জন মানুষ দু’জনকে কতটা ভালোবাসে, কিন্তু পরিস্থিতি কিছুতেই দু’জনকে সুখী থাকতে দিচ্ছে না। তাইয়ানের পরিস্থিতির ওপর ভিষণ রাগ হচ্ছে। তার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে সে পরিস্থিতিকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিত।

কক্ষের সমস্ত আসবাবপত্র চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলছে জাফর ইকবাল। হেরে যাওয়ার ক্রোধ সমস্ত কায়াকে উত্তপ্ত করে তুলছে। সে পরপর কয়েকবার ভয়ংকর রকমের গর্জন করে উঠল। তার গর্জনে প্রতিটি গার্ডের হৃদয় কেঁপে উঠল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণের আনা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। হাত কে’টে রক্ত স্রোতের ন্যায় গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–কু’ত্তা’র বাচ্চাকে ডেকে নিয়ে আয়। আজকে আমার হাতেই খু’ন হবে। সে এতবড় দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। তাহলে তাকে দায়িত্ব নিতে কে বলেছিল? তোদের স্পষ্ট ভাবে বলেছিলাম। মুনতাসিম যেন হসপিটাল পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে। এক্সিডেন্ট হবার সাথে সাথে যেন দেহ থেকে প্রাণ পাখিটা দেহ থেকে উড়াল দেয়। তবুও মুনতাসিম কিভাবে বেঁচে গেল? জা’নো’য়া’রে’র বাচ্চা গুলো আমার মুখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা। ঐ তিন কু’ত্তা’র বাচ্চাকে আমার সামনে এখন এই মুহূর্তে হাজির কর। জাফর ইকবালের গর্জনে গার্ড গুলো থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। সায়ান আঁখিযুগল দিয়ে ইশারা করতেই সবাই কক্ষ ত্যাগ করল। তারা যেতেই তিন ট্রাক ড্রাইভারদের কক্ষে নিয়ে আসা হলো। জাফর ইকবাল শান্ত কণ্ঠে বলল,

–তোদের আমি এমনি এমনি টাকা দিয়েছিলাম। কাজ করতে পারিস না। তাহলে আমার কাজ করতে এসেছিলি কেন? তোদের জন্য এত দিনের সব পরিকল্পনা মুহূর্তের মধ্যে তচনচ হয়ে গেল। তোদের কে’টে পি’স পি’স করে কুকুরকে দিয়ে খাওয়াব আমি। কথা বলছিস না কেন জা’নো’য়া’রের বাচ্চা গুলো। কথা বল না হলে তোদের জ্যান্ত পুঁ’তে ফেলব। জাফর ইকবালের প্রতিটি বাক্য তিন জনকে ভয়ে কাবু করে ফেলল। একজন কম্পন মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,

–আমরা উনাকে মেরেই ফেলতাম। আমরা উনার কাছে পৌঁছানোর আগেই উনার গার্ড এসে তাকে ঘিরে ফেলে। সেখানে থেকে যদি আমরা না পালাতাম। তাহলে ওরা আমাদের ধরে ফেলত। ড্রাইভারের কথায় জাফর ইকবালের কোনো ভাবান্তর হলো না। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–মুনতাসিম বেঁচে গেল কিভাবে?

–আসলে উনি গাড়ি থেকে লাফ দিতে চেয়েছিলেন। আমরা দ্রুত সামনে চলে আসায় আর পারেনি। উনি লাফ দিতে যাবে। তখনই উনি সিটকে এসে আমাদের ট্রাকের সাথে বাড়ি খায় এবং মাটিতে পড়ে যায়। উনি আবার উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমরা তাকে আবার ধাক্কা দিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলি। তিনি যেভাবে পড়ছিলেন। আমরা ভেবেছি উনি মারা গিয়েছে। উনার যে অবস্থা আমরা দেখেছি বাঁচার কোনো সম্ভবনাই ছিল না।

–আগে যদি জানতাম তোরা এতটা কাঁচা খেলোয়াড়। তাহলে কখনোই তোদের এড বড় দায়িত্ব দিতাম না৷ আমাকে পুতুল খেলার গল্প শোনাচ্ছিস? যেভাবে ধাক্কা দিয়েছিস। সেই ধাক্কায় একটা মুরগীও মরবে না। আমি তোদের শেখাচ্ছি কিভাবে মা’র’তে হয়। বাক্য গুলো শেষ করেই সায়ানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল জাফর ইকবাল। সায়ান বন্দুক এগিয়ে দিতেই পরপর ছয়টা গুলি তিনজনের বুক ছিদ্র করে দিল। তিনজন গলা কাটা মুরগীর ন্যায় ছটফট করছে। রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে জাফর ইকবালের কক্ষ জুড়ে।

সূর্যের রশ্মি ধরনীর বুকে আঁচড়ে পড়ছে। সোনালি আলোয় মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। রজনীর নিস্তব্ধ হসপিটাল কোলাহলে পরিপূর্ণ হয়েছে। মুনতাসিমের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। ডক্টর বলেছে আটচল্লিশ ঘন্টা না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছে না। সবাইকে মলিনতা গ্রাস করে ফেলছে। একটি ভালো বার্তার আশায় সবাই চাতক পাখির ন্যায় বসে আছে। রিয়াদ চৌধুরীর মেহেভীনের দিকে দৃষ্টি যেতেই মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠল। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–এবার তোমার শান্তি হয়েছে মেহেভীন? একদিন রাগ করে বলেছিলাম। আমার ছেলেকে খেয়ে তোমার শান্তি হবে। তুমি সত্যি সত্যি আমার রাগটাকে প্রতিশোধ হিসেবে ধরে নিলে? তুমি আমার ছেলের জীবনে না আসলে আমার ছেলের এই অবস্থা হত না। ধৈর্য যখন বাঁধ ভেঙে যায় মস্তিষ্ক তখন ভদ্রতা ভুলে যায়। হঠাৎ করেই মেহেভীনের মুখভঙ্গি ক্রোধে রুপ নিল। তার সহ্য সীমা পরে হয়ে গিয়েছে। একটু সুখের আশায় কত কিছুই সহ্য করে নিল। দিনশেষে তার বুকেই ছুরি চালানো হলো! সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আমি যদি বলি আপনার ছেলের অবস্থার জন্য আপনি দায়ী। তখন আপনি কি করবেন আব্বা? কাল রাতে আপনি আমাদের কক্ষে না আসলে মুনতাসিমকে আমি কিছুতেই কক্ষের বাহিরে যেতে দিতাম না। আমি তার ক্রোধ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আপনি কি করলেন উত্তপ্ত আগুনে ঘি ঢেলে দিলেন। কালকে আপনার পা ধরা বাকি ছিল আব্বা। কতবার করে বলেছিলাম। উনাকে যেতে দিয়েন না। উনি ভয়ংকর রকমের রেগে আছে। আমি হয়তো আপনার থেকে আপনার ছেলেকে কম চিনি। কিন্তু তার মনে কি চলছে। এই কয়দিনে সেটুকু বোঝার ক্ষমতা আমার হয়েছে। আপনি আমায় ভালোবাসেন না কেন আব্বা? আমার ভালোবাসলে কি আমার ভালোবাসায় ঘাটতি পড়ে যাবে। আপনাদের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য কত তিক্ত কথাই না সহ্য করলাম। তবু্ও আপনাদের মন পেলাম না। আপনার মেয়ে রাত করে বাড়ি ফিরে বলাতে আমি খারাপ হয়ে গেলাম। আপনার ছেলের এক্সিডেন্ট হলো এতেও আমার দোষ! আপনি বাবা হয়ে কেন ছেলেকে আঁটকে রাখলেন না। আপনার এক ছেলে আরেক ছেলেকে প্রতিনিয়ত খু’ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এতেও আমার দোষ! আপনি নিজের সন্তানদের কোনো দোষই দেখছেন না। তাদের সব রাগ আমার উপর ঝারছেন। কেন আমি পরের মেয়ে বলে তাই? মুনতাসিম আপনার প্রাণ প্রিয় ছেলেকে মে’রে রক্তাক্ত করে দিয়েছে। তাই আপনার হৃদয়ে আঘাত লেগেছে। আর আপনি বাবা হয়ে ছেলের সংসার ভাঙতে বলেছেন। আপনার ছেলের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বাড়বে না। আপনি আমার আব্বা না বলেই আপনি আমার সব কাজে দোষ দেখতে পান। আব্বা জানেন আমার বাবাও আমার ভুলগুলো আপনার মতো করে আড়াল করে দিত। আপনি মুনতাসিমকে রক্তাক্ত করে না দিয়ে নিজের মেয়েকে শাসন করলে আপনাকে এই দিন দেখতে হত না। আপনার ভালোবাসায় আমি খাদ দেখতে পাচ্ছি আব্বা। আমার মনে হয় আপনার চোখের বি’ষ আমি নয়, মুনতাসিম। আমার মাধ্যমে মুনতাসিমকে আঘাত না করে একবারে মেরে ফেলুন। মেহেভীনের কথায় রিয়াদ চৌধুরীর অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। সে বিস্ময় নয়নে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে! মেহেভীন এতকিছু কিভাবে জানল? হঠাৎ করে দুশ্চিন্তা মস্তিষ্ককে গ্রাস করে ফেলল। সাহেলা চৌধুরী তাচ্ছিল্য করে বলল,

–কি চৌধুরী সাহেব খুব কষ্ট হচ্ছে? এই মেয়েটার মতো করে যদি আমিও বলতে পারতাম। তাহলে আমার সন্তান গুলো সমান সামান বাবার ভালোবাসা পেত। আপনাদের পরের ছেলের এই একটা অভ্যাস সব দোষ হচ্ছে পরের বাড়ির মেয়ের। কাল রাতে আপনাকে যেতে নিষেধ করেছিলাম। তবুও আপনি গিয়েছিলেন। ছেলেটাকে রাগালেন। ছেলেটা গৃহ ত্যাগ করল। তার ক্ষতি হলো। এখন সব দোষ বাড়ির বউয়ের! আপনার নয় কেন চৌধুরী সাহেব? রিয়াদ চৌধুরীর মস্তক নুইয়ে গেল। বুকের মধ্যে চিনচিন করে ব্যথা করছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ব্যথাটা তীব্র হতে শুরু করেছে। তখনই মুনতাসিমের আইসিইউর ওয়ার্নিং বেলটা বেজে উঠল। তার শব্দে হসপিটাল মুখরিত হয়ে গেল। সে উচ্চ শব্দে জানান দিচ্ছে রোগীর দেহ থেকে প্রাণ পাখিটা বের আসার সময় চলে এসেছে। ওয়ার্নিং বেল বাজতেই ডক্টর, নার্স প্রাণপণে আইসিইউর দিকে ছুটে চলেছে। কারো হাতে ইলেকট্রনিক শক, কারো হাতে আরো একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার, কারো হাতে ইনজেকশন নিয়ে ঝড়ের গতিতে আইসিইউর দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। ওয়ার্নিং বেল অনবরত বেজেই চলেছে। ডক্টর নার্সকে দ্রুত ইলেকট্রনিক শকটা এগিয়ে দিতে বলল। সে ইলেকট্রনিকস শক হাতে নিয়েই মুনতািসমের বুকে চেপে উঠল। কয়েকবার দেওয়ার পরই মুনতাসিম রেসপন্স করা ছেড়ে দিল। মুহুর্তের মধ্যে আইসিইউ জুড়ে নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরল।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫৬
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সময়! তবে কি ভালোবাসার বিপরীতে গিয়ে সময়ের স্রোত বাধাগ্রস্ত হলো? প্রনয়ণের হাওয়া সময়কে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছে। প্রিয়জনকে তার মায়াবিনীর ফিরিয়ে দিতেই হবে, তবেই তার মুক্তি। বাহির পুড়লে মানুষ দেখতে পায় ভেতর পুড়লে দেখতে পায় না কেন? প্রতিটি মুহুর্তে দম আঁটকে আসছে মেহেভীনের। এই বুঝি দেহ থেকে প্রাণ পাখিটা উড়াল দিবে। সমস্ত কায়া নিস্তেজ হয়ে আসতে শুরু করেছে। কায়ার সমস্ত হাড় গুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবার মতো ব্যথা অনুভব করছে সে। ডক্টররা হাল ছেড়েই দিয়েছে। আইসিইউর প্রতিটি মানুষের মুখশ্রীতে অমাবস্যার আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। ডক্টর শেষ বারের মতো মুনতাসিমের বুকে তাপ দিতেই মুনতাসিমের জোরে শ্বাস দেওয়ার শব্দে খুশির আলোড়ন ছড়িয়ে পড়লো। তারা আবার ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পরে ডক্টরের মুখশ্রী দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এল, “আলহামদুলিল্লাহ।”

প্রভাত যেমন জমিনের বুকে ছড়িয়ে পড়েছে। সূর্য তার কিরণ দিয়ে ধরনীকে করেছে আলোকিত। ঠিক তেমনই প্রভাতের নতুন আলোর সাথে নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছে মুনতাসিম। চারদিন পর জ্ঞান আসলো তার। আঁখিযুগল মেলে তাকাতেই চারপাশ ঝাপসা লাগছে। কিছু সময়ের ব্যবধানে স্পষ্ট হতে শুরু করল চারপাশ। সমস্ত কায়া ব্যথায় জর্জরিত হয়ে আছে। বাহির থেকে কোলাহলে কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাচ্ছে। মুনতাসিমের সমস্ত মুখশ্রীতে মলিনতা এসে ধরা দিয়েছে। সে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো স্মরন করতে লাগল। হঠাৎ করেই সমস্ত চিন্তাধারা থমকে গেল। মনের গহীনে থেকে কিছু বাক্য মস্তিষ্কে এসে বাজছে। আমার কেউ ছিল না। আমার কেউ নেই। আমি একান্তই আমার নিজের আমি কারো না। কিন্তু পাষাণ মন প্রেয়সীকে দেখার জন্য অশান্ত সমুদ্রের ন্যায় উথাল-পাতাল করছে। নিজেকে দমানো গেলেও অবাধ্য মনকে দমানো যাচ্ছে না। মস্তিষ্ক অদ্ভুত ভাবে বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। মুনতাসিম কাউকে ডাকল না। সে নিষ্পলক চাহনিতে স্থির হয়ে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে।

–স্যার আপনার জ্ঞান ফিরেছে? সাদা এপ্রন পড়া নার্সের বাক্য গুলো কর্ণপাত হতেই মুনতাসিম আঁখিযুগল বন্ধ করে ফেলল। মুনতাসিমের নিস্তব্ধতার কারণ খুঁজে পেল না নার্সটি। অন্যান্য রোগীদের তুলনায় মুনতাসিমকে বেশ অদ্ভুত লাগল! যেখানে মানুষ সুস্থ হয়ে প্রিয়জনদের দেখায় তৃষ্ণায় কাতর থাকে, সেখানে মুনতাসিম কিভাবে এতটা নির্বাক হয়ে আছে? নার্স দ্রুত কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। চাকত পাখি যেমন বৃষ্টি পেলে প্রানবন্ত হয়ে উঠে, ঠিক তেমনই মুনতাসিমের জ্ঞান ফেরার খবর কর্ণকুহরে আসতেই সকলের মুখশ্রীতে প্রাণবন্ত হাসির রেখার দেখা মিলল। রিয়াদ চৌধুরী দ্রুত ছেলের কেবিনে গেল। বাবাকে দেখেই মুখশ্রী ঘুরিয়ে নিল মুনতাসিম। রিয়াদ চৌধুরী কোমল কণ্ঠে বলল,

–কেমন আছিস বাবা? বাবার প্রতিটি বাক্য বিষাক্ত শোনালো মুনতাসিমের কাছে। সে নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,

–কেন এসেছেন? আপনাকে না বলেছি। আমি মরে গেলে-ও আমার লা’শে’র কাছে আপনি আসবেন না। উচ্চ স্বরে কথা গুলো বলতে গিয়ে মস্তিষ্কে কঠিন ভাবে চাপ লাগল। চারপাশে আঁধার ঘনিয়ে আসতে শুরু করল। মুনতাসিম ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টি যেতেই ডক্টর রিয়াদ চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–আপনি এখনই কেবিন থেকে বের হয়ে যান স্যার। উনার মস্তকে ভিষণ বাজে ভাবে আঘাত লেগেছে। এখন যদি উনার মস্তকে চাপ প্রয়োগ করা হয়। তাহলে মস্তিষ্কে হঠাৎ করে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা রক্তক্ষরণ দেখা দিতে পারে। এতে রোগীর প্রতিটি মস্তিষ্কের কোষগুলি কাজ করা বন্ধ করতে বা মারা যেতে পারে। যখন মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষগুলি মারা যায়, তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা শরীরের অঙ্গগুলির কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা হারিয়ে যায়। এতে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। আপনাকে আমি কি বোঝাতে পেরেছি চৌধুরী সাহেব? রিয়াদ চৌধুরী কোনো বাক্য উচ্চারণ না করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। ছেলের বিধস্ত মুখশ্রী ভেতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দগ্ধ করে দিচ্ছে। মুনতাসিমের কাছে শুধু তাইয়ানকে আসার অনুমতি দিল মুনতাসিম। তাইয়ান ব্যতিত অন্য কেউ প্রবেশ করলে ফলাফল ভয়ংকর রকমের হবে। মুনতাসিমের কথা মতো ডক্টর সবাইকে তার কেবিনে যেতে নিষেধ করেছে। তাইয়ান শুকনো মুখশ্রী করে মুনতাসিমে পাশে বসল। মুনতাসিমকে দেখে তার উত্তপ্ত হৃদয় মুহুর্তের মধ্যে শীতল হয়ে গেল। তাইয়ানের দিকে দৃষ্টি যেতেই মুনতাসিম মলিন হাসলো। তাইয়ান অভিমানের সুরে বলল,

–আপনি ভিষন স্বার্থপর স্যার। আমি আপনাকে বলেছিলাম। আপনার সাথে আমার জীবন জড়িয়ে আছে। তাই বাঁচতে হলে আপনার সাথে বাঁচব। আর ধরনীর মায়া ত্যাগ করতে হলে দু’জন একসাথে করব। তবে কেন আমার সাথে বেইমানি করলেন স্যার?

–তাইয়ান তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী বা প্রেমিকা নও! এভাবে কথা বলছ কেন? আমি তোমার সাথে প্রেম করে ধোঁকা দিয়েছি নাকি! পুরুষ মানুষের মতো কথা বলো। আমাকে দেখে তোমার লেসবিয়ান মনে হয়? মুনতাসিমের কথায় লজ্জা পেল তাইয়ান। ধরনীর বুকে সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে এই মানুষটাকে বোঝা। কণ্ঠনালিতে এসে বাক্য গুলো বেঁধে যাচ্ছে। তবুও তার রসিকতার শেষ নেই। এই মানুষ টাই তার অনুপ্রেরণা। মৃত্যুর সন্নিকটে গিয়ে ফিরে এসেও নিজেকে কিভাবে শক্ত রাখতে হয়। সেটা এই মানুষটাকে দেখে শেখা উচিৎ। তাইয়ানের মনটা ভালো হয়ে গেল। হঠাৎ করেই মস্তিষ্ক ফুরফুরে হয়ে উঠল। অনুভূতিরা আনন্দে মিছিল করছে। তাইয়ান নিম্ন কণ্ঠে বলল,

–আপনি অনুমতি দিলে ম্যাডামকে নিয়ে আসি স্যার? আপনি বোধহয় ম্যাডামের অপেক্ষায় আছেন। তাইয়ানের বাক্য গুলো কর্ণপাত হতেই মুনতাসিমের মুখশ্রীতে শত জনমের আকুলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। আঁখিযুগলে প্রেয়সীকে দেখার তৃষ্ণা কণ্ঠে একরাশ ক্রোধ নিয়ে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মুনতাসিমের শীতল দৃষ্টি তাইয়ানের মস্তক নুইয়ে ফেলল। মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আমার জীবনের বারবার মৃত্যু আসুক তাইয়ান। তবু আর কখনো ভালোবাসা না আসুক। কোনো স্বার্থপর নারীর মুখ আমি দেখতে চাই না। আমাকে দেখার অনুমতি যদি হারাতে না চাও। তবে এ বাক্য আমার সামনে দ্বিতীয় বার উচ্চারন করবে না। এবার তুমি চলে যাও। আমার একা থাকতে ইচ্ছে করছে। তাইয়ান বিলম্ব করল না। দ্রুত কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। তাইয়ান একটা রাগান্বিত মানুষকে দেখে গেল। কিন্তু একটা পিপাসিত হৃদয় প্রেয়সীকে দেখার তৃষ্ণায় শতবার মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করছে। সেটা তাইয়ান দেখল না। দেখলে কখনো এভাবে চলে যেত না। মানুষটাকে রক্তাক্ত হওয়া থেকে বাঁচাতে তার প্রেয়সীকে মানুষটার সামনে হাজির করত।

অভিমান অভিযোগের খেলা খেলতে খেলতে কে’টে গিয়েছে দেড় মাস। মস্তিষ্কে অভিমান হৃদয়ে এক গুচ্ছ ভালোবাসা। এই নিয়েই চলছে দু’জনের প্রণয়ের খেলা। যে মানুষটার মুখ দেখতেও নারাজ সেই মানুষটাকে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার অনুভূতিটা ভয়ংকর রকমের সুন্দর। আবার যে মানুষটা মুখ দেখবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। রজনীর মধ্য প্রহরের নিদ্রায় বিভোর থাকা সেই মানুষটাকে দেখার অনুভূতিটা পরম শান্তির। মান-অভিমানের আড়ালে লুকোচুরির ভালোবাসা গুলো একটু বেশিই সুন্দর। মুনতাসিম পাঁচ দিন হলো বাড়ি ফিরেছে। ডক্টর তাকে দু’মাস থাকতে বলেছিল। কিন্তু মুনতাসিম বলেছে সে থাকবে না। তাকে ধরে রাখার সধ্যি কার আছে? মেহেভীনের মুখ দেখতে চায় না বিধায় মেহেভীনকে অন্য কক্ষে থাকতে হচ্ছে। রজনী মধ্য প্রহর চলছে। সবাই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে। ঘুম নেই শুধু মেহেভীনের আঁখিযুগলে। কারন রজনীর মধ্য প্রহরেই তার প্রিয় মানুষটিকে দেখার সুযোগ মিলে। তাকে কারো কড়া বাক্য শুনতে হয় না। শখের মানুষের পাশে কিছু সময় শান্তিতে বসে থাকতে পারে। কি অদ্ভুত তাই না মেহেভীন রোজ রজনীর মধ্য প্রহরের মুনতাসিমে দেখতে যায়। গিয়ে মুনতাসিমের কবাট খোলা পায়। মায়াময়ী কি জানে না তার আগ্রহে কেউ নিদ্রাহীন রজনী পার করে। সে আসবে বলেই কবাট খোলা থাকে। সে কি চাইলে পারে না নিজের অধিকার টুকু ছিনিয়ে নিতে! তার অধিকার আজ-ও তারই আছে। সে চাইলেই নিজের অধিকারটুকু ফলাতে পারে। তার অধিকার একটা মানুষের মন গলিয়ে দিতে পারে। অভিমানের শক্ত আবরণ ভালোবাসার শক্তি দিয়ে ভেঙে ফেলতে পারে। কিন্তু পাষাণী মন বুঝে না। সে শুধু জানে ভুল বুঝতে আর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বাড়াতে।

মেহেভীনে মুনতাসিমের অবাধ্য কেশগুলোতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঘুমন্ত মুনতাসিমকে ভিষণ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। মনটা ভিষণ অসভ্য হয়ে উঠেছে। এই মাঝ রাতে প্রিয়তমকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। নিজের ইচ্ছেটাকে দমালো না মেহেভীন। খুব সাবধানতা অবলম্বন করে মুনতাসিমের ললাটে অধর ছোঁয়াল মেহেভীন। মেহেভীনের উষ্ণ ছোঁয়াতে মুনতাসিমের ভেতরে উথাল-পাতাল শুরু করে দিল। অন্যদিন মেহেভীন আসে চুপচাপ বসে থাকে কিছুক্ষণ চলে যায়। কিন্তু আজ যে এমন অকল্পনীয় কিছু করে ফেলবে। তা মুনতাসিমের চিন্তাধারার বাহিয়ে ছিল। আচমকা মুনতাসিম আঁখিযুগল মেলে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করল। হঠাৎ মুনতসিম সজাগ হওয়ায় মেহেভীনের হৃদস্পন্দনের গতিবেগ বেড়ে গেল। হৃদয়টা অশান্ত হয়ে কেমন ধড়ফড় করছে। চোর যেমন ধরা পড়লে বুদ্ধি কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসে ঠিক তেমনই মেহেভীনের সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসতে শুরু করেছে। লজ্জায় সমস্ত মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। মুনতাসিমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত কক্ষ থেকে বেড়িয়ে গেল। মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে।

চারিদকে প্রভাতের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। মুনতাসিমের অসুস্থতার খবর পেয়ে রাজনৈতিক দলের বহু নেতা এসে মুনতাসিমের সাথে সাক্ষাৎ করে গিয়েছে। প্রভাতের আলো ফুটতেই কয়েকজন নেতা এসে হাজির হয়েছে। মুনতাসিম তাদের সাথে ভালোমন্দ কথা বলে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিল। তখনই তাহিয়া আর সুফিয়া চৌধুরী গৃহে প্রবেশ করে। তাদের দেখে মুনতাসিমের গম্ভীর মুখশ্রী আরো গম্ভীর হয়ে যায়। মুনতাসিম তাদের সাথে সংক্ষেপে আলোচনা শেষ করে তাদের বিদায় জানালো। তাহিয়া দৌড়ে মুনতাসিমের কাছে আসতে চাইলে মুনতাসিম বিরক্ত হয়ে নিজের কক্ষ চলে গেল। তাহিয়ার সমস্ত মুখশ্রীতে অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। তাহিয়া অশ্রুসিক্ত নয়নে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সুফিয়া চৌধুরী মেয়েকে আশ্বাস দিয়ে বলল,

–মুনতাসিম আর মেহেভীনের দুরত্ব আমি ডিভোর্স পর্যন্ত নিয়ে যাব। তুই হবি মুনতাসিমের অর্ধাঙ্গিনী। তুই মায়ের ওপরে ভরসা রাখ ভাগ্যিস দু’জনের দুরত্বের কথা জেনেছিলাম। তাহিয়া কোনো বাক্য উচ্চারন করল না। নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল।

মুনতাসিম নিজের ক্ষত স্থানে মেডিসিন দিচ্ছিল। এক হাতে ব্যথা থাকায় সেই হাত প্রয়োগ করে মেডিসিন দিতে পারছে না। কবাটের আড়াল থেকে মেহেভীন বলল,

–আমি লাগিয়ে দেই?

–না।

–হিজাব মেরে এসেছি মুখ দেখা যাচ্ছে না তো। মেহেভীনের দিকে দৃষ্টি যেতেই মুনতাসিম হতভম্ব হয়ে গেল। সেটা বাহিরে প্রকাশ না করে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–খু’ন করে ফেলব কিন্তু। আমার কক্ষের সামনে থেকে চলে যান।

–খু’ন হতে এসেছি গো মন্ত্রী সাহেব। আমাকে একটু খু’ন করবেন। জীবনে কোনোদিন খু’ন হইনি। একবার খু’ন হয়ে দেখতাম খু’ন হতে কেমন লাগে? বিরক্ততে মুনতাসিমের সমস্ত মুখশ্রী কুঁচকে এল। সে কবাট বন্ধ করতে যাবে তখনই মেহেভীন মুনতাসিমের হাত থেকে মেডিসিনটা নিয়ে মুনতাসিমকে দিয়ে দিতে লাগল। মুনতাসিম সরে যেতে চাইলে মেহেভীনের কিছু বাক্য কর্ণে আসতেই স্থির হয়ে গেল সে। মেহেভীন খুব শান্ত কণ্ঠে বলল,

–ভয় নেই খু’ন করতে আসিনি। আপনি আমার মুখ দেখতে চান না। আমিও আমার মুখ আপনাকে দেখাতে চাই না। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি। আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হলেই আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। এতটা দূরে চলে যাব। যতটা দূরে গেলে আমার কথা আপনার আর মনে পড়বে না। কি বিষাক্ত শোনালো কথা গুলো! ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। একরাশ ক্ষোভ তৈরি হলো মেহেভীনের প্রতি। সে মেহেভীনের হাত থেকে মেডিসিনটা নিয়ে ছুরে ফ্লোরে ফেলে দিল। রাগান্বিত হয়ে বলল,

–যার তার হাতে মেডিসিন নেই না। এখনই আমার কক্ষ থেকে বের না হয়ে গেলে, আমি নিজেই কক্ষ থেকে বের হয়ে যাব। আপনাকে আমার বিষাক্ত লাগে এটা আপনি বুঝেন না। আমি আপনাকে ইগনোর করে চলছি। সেটা আপনি দেখতে পাচ্ছে না। আপনি কিসের আশায় এখানে পড়ে আছেন? আপনি ভাববেন না। আপনার সাথে কথা বলছি মানেই আপনার সব ভুলগুলো ক্ষমা করে দিয়েছি। যেখানে আমি আপনাকে চাইছি না। সেখানে এ বাড়িতে থাকা আপনার মূল্যহীন। চলে কেন যাচ্ছেন না? আপনি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যান। আমাকে মুক্তি দিয়ে যান। এবার আপনার শান্তি হয়েছে। এ কথা গুলোই শুনতে চেয়েছিলেন। আপনি সর্বদা নির্দোষ থাকতে চেয়েছিলেন। আমাকে দোষী সাবস্ত করতে চেয়েছিলেন। আমি আপনার মনে ইচ্ছে পূর্ণ করে দিলাম। সব গল্পে আপনিই শ্রেষ্ঠ চরিত্র হিসেবে থাকুন। গল্পের মূল্যহীন আর নিকৃষ্ট চরিত্রটা না হয় আমি হলাম। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম বেলকনিতে চলে গেল। মেহেভীন কেমন দম বন্ধ লাগছে। বুকের মধ্যে ব্যথা করছে। মস্তক থেকে হিজাব খুলে ফেলল সে। মুনতাসিমের আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। নিজের বলা বাক্য গুলো এখন নিজেকেই ভিষণ পোড়াচ্ছে। কাউকে কড়া বাক্য শুনিয়েও শান্তি নেই। কাউকে বলার পরে কড়া বাক্য গুলো পরক্ষনে নিজেকেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। মুনতাসিমের ভাবনার মাঝেই এক জোড়া কোমল হাত মুনতাসিমকে পেছনে থেকে আলিঙ্গন করল। সে সক্ষম হয়েছে। মেয়েটাকে কাঁদাতে চেয়েছিল মেয়েটাকে কাঁদছে। কি অদ্ভুত যে মানুষটা তাকে আঘাত দিল! সে মানুষটাকেই আলিঙ্গন করে কষ্ট মোচন করার প্রয়াস চালাচ্ছে। মেহেভীন কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,

–আপনি মানিয়ে নিবেন বলেই আমি রাগ করি। আপনি শুধরে দিবেন বলেই ভুল করি। আপনি সহ্য করবেন বলেই আঘাত করে ফেলি। আপনি গুছিয়ে দিবেন বলেই আমি বারবার এলোমেলো হয়ে যাই। আপনি ছেড়ে যাবেন না বলেই আপনাকে এত বিরক্ত করি। আমাকে আঘাত করবেন না বলেই আপনার অপছন্দের কাজ করি। তবুও দিনশেষে এটাই ভাবি আপনি শুধুই আমার। সেই আপনি টাই যদি আমার না থাকেন। তাহলে এখানে থাকাটা আমার মূল্যহীন। আপনি তো আমায় অনেক সহ্য করলেন। আর কয়টা দিন করুন। আমি খুব বেশিদিন আপনার বিরক্তির কারন হব না। আপনি সুস্থ হলেই আমি চলে যাব। আমার ছায়াও আপনার আশেপাশে পড়তে দিব না। মেহেভীনের প্রতিটি বাক্য মুনতাসিমের মস্তিস্ক উত্তপ্ত করে দিল। সে তাচ্ছিল্য করে বলল, “ধুর বোকা মেয়ে খু’ন করার পর খু’নি’রা কি লা’শে’র জন্য কাঁদে নাকি!” মুনতািসমের কথায় কিছু সময়ের মেহেভীনের হৃদস্পন্দনের গতিবেগ থেমে গেল। পরিবেশ জুড়ে নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরলো। প্রকৃতি দেখল একজনের বাহির পুড়ছে আরেকজনের ভেতর পুড়ছে। প্রকৃতির যদি বলার ক্ষমতা থাকতো। তাহলে সে মেহেভীনকে চেঁচিয়ে বলত। ও নিষ্ঠুর রমনী পাষান মনের অধিকারীনি ভালোবাসার কাঙ্গাল ছেলে টার থেকে ভালোবাসা কেঁড়ে নিয়ে তাকে নিঃস্ব করে দিও না।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫৭
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সময় ধারার সাথে সন্ধি করে তাল মিলিয়ে গড়িয়ে যায়। চারদিক আমের মুকুলে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। শিমুল তার সৌন্দর্য দিয়ে ধরনীরকে করেছে মনোমুগ্ধকর। শিমুলের মুগ্ধতায় হৃদয়ের গহীনে প্রণয়ের হাওয়া বইছে। শিমুন ফুল যেমন তার সৌন্দর্য দিয়ে অন্যকে আকর্ষিত করছে। ঠিক তেমনই মুনতাসিমের সুস্থতা মেহেভীনকে গৃহ ত্যাগ করার আহবান জানাচ্ছে। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত রৌদ্রের মতো হৃদয়টা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। গ্রীষ্মের রৌদ্রের তেজ যেমন জমিন ফাটিয়ে দেয়। ঠিক তেমনই কারো হৃদয়টাও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় । সহ্য সীমা আগের ন্যায় বেড়ে গিয়েছে মেহেভীনের। সে কথায় কথায় বিষন্ন হয়ে উঠে না। মলিনতা এসে তার মুখশ্রীতে ধরা দেয় না। আঁখিযুগলে অশ্রু এসে জমা হয় না। আঘাত মানুষকে শক্ত করে, শক্ত করে মানুষের কোমল হৃদয়টাকে। মাঝে মাঝে শখের পুরুষকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে ভেতরটা হাহাকার করে উঠে। দম বন্ধ হয়ে আসে। চুপচাপ হৃদয়ের দহনে পুড়তে হয়। কি বিশ্রী এক অনুভূতি, না বাঁচতে দেয় না মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে দেয়!

কারো চরণের পদধ্বনি কর্ণকুহরে এসে বাড়ি খেতেই মুনতাসিমের থেকে দুরত্বে এসে অবস্থান করল মেহেভীন। আঁখিযুগলে শুকিয়ে আসা শেষ অশ্রুটুকু আদুরে হাতে মুছে নিল। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। চেহারায় বিষন্নতা ফুটে উঠেছে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটছে। তখনই গম্ভীর মুখশ্রী করে রিয়াদ চৌধুরী কক্ষে প্রবেশ করে। মেহেভীনকে উদ্দেশ্য করে কোমল কণ্ঠে বলল,

–তুমি কি চাও মেহেভীন আমি তোমার সাথে কঠিন আচরণ করি? তোমাকে কতবার বলেছি! মুনতাসিমের মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। সে তোমার সঙ্গ এখন চাইছে না৷ তবুও কেন বারবার ওকে উত্তেজিত করতে আসো? দেখো মা তুমি যেমন আমার মেয়ে, মুনতাসিমও আমার ছেলে। তোমার একার ভালো চাইলে তো হবে না। আমার ছেলেটার দিকেও দৃষ্টি দিবে হবে। আমি তোমাকে অনুরোধ করে বলছি। তুমি আর মুনতাসিমের কক্ষে এসো না।

–আর আসব না আব্বা।

–এই নিয়ে কতবার বললে যে আর আসবে না? তুমি প্রতিবারই বলো আসবে না। কিন্তু নিজের শপথ রক্ষা করতে ব্যর্থ তুমি।

–এবার সত্যি বলছি আব্বা। আপনি মিলিয়ে নিয়েন। আমি আর আসব না। কথা গুলো বলেই মেহেভীন সেদিন কক্ষ ত্যাগ করেছিল। আর পিছু ফিরে তাকাইনি। মুনতাসিম সেদিন নির্বাক ছিল। ভুল করেও যদি প্রেয়সীকে একটা ডাক দিত। তাহলে একটা রক্তাক্ত হৃদয় সুস্থ হয়ে উঠত। সব বিষাদকে গ্রাস করে নিয়ে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করে দিত মানুষটাকে৷ কিন্তু মানুষটা তাকে ডাকেনি। এই বাড়িতে সে ছাড়া তার অনেক মানুষ আছে। কিন্তু মেহেভীন! মেহেভীনের সে ছাড়া আর কে আছে? মানুষটা তাকে বুঝল না। উল্টো তার জন্য মানুষটা দিন দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে! নিজের আঁখিযুগলে শখের মানুষটার শেষ হয়ে যাওয়া সে কিভাবে দেখবে? দুরত্বের গল্প আপনাকে ছুঁয়ে দেখা হলো না। প্রার্থনা করি এতটা সুখে থাকেন, যতটা সুখে থাকলে আমাকে আর মনে পড়বে না। হঠাৎ হঠাৎ বুকের বা পাশে ব্যথা করে, দম বন্ধ হয়ে আসে, কাউকে বলতে পারি না আমার ভেতরটা মানুষ হারাতে হারাতে শূন্যতার হাহাকারে ডুবে মরে, নিজের ভাগ্যের প্রতি কিছুটা ক্রোধ এবং আক্ষেপ জমা হয়ে রয়েছে। চিন্তাধারা গুলো মস্তিষ্কে বাসা বাঁধতেই বুক ভারি হওয়া একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে গেল। এই মাঝে কেটে গেল কতগুলো দিন, কতগুলো প্রহর, কতগুলো হাহাকারে রাত, প্রভাতের দুঃখ মেশালো শীতল হওয়া। কালকে মেহেভীন চলে যাবে। মনটা বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। মাশরাফি এসে কতবার ডেকে গেল। মেহেভীন এক বাক্য বলে দিল খেতে ইচ্ছে করছে না। সে খাবে না। মেহেভীন আসবে না জেনে মুনতাসিম দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিল। ক্রোধে সমস্ত কায়া জ্বলে উঠল। এত জেদ কিসের মেয়েটার! অশান্ত আঁখিযুগল প্রেয়সীকে দেখার তৃষ্ণায় কাতরে মরছে। আর মানুষটা তাকে পোড়াতে ব্যস্ত! কাছে এসে ভালোবেসে কি বুকে জড়িয়ে নেওয়া যায় না। শুধু পারে রাগ করতে আর ভুল বুঝতে। মুনতাসিম উঠে চলে গেল। সবাই নিস্তব্ধ হয়ে আহার আহরন করতে শুরু করল।

মেহেভীন নিজের প্রয়োজনীয় বস্ত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। তখনই শেহনাজ আসে কক্ষে। শেহনাজের হাতের খাবারের প্লেট। শেহনাজ মেহেভীনের পাশে বসল৷ মুখশ্রীতে মলিনতা ঘিরে ধরেছে। শেহনাজ বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,

–তুমি চলে যেও না ভাবি। তুমি থেকে যাও। তুমি যদি ভাইয়ের ক্রোধের ভাষা না বুঝো তাহলে কে বুঝবে? আমি চাই তুমি থেকে যাও। বড় বোনের মতো সেদিন যেমন প্রতিবাদ করেছিলে, সারাজীবন এই ভালোবাসাটা আমি পেতে চাই। যে ভালোবাসা আমাকে সঠিক পথে চালনা করবে।

–তুমি আমার ননদ আর ননদ কখনো বোন হতে পারে না। তুমি রাগ করলেও বলব। সেদিনের পর থেকে তোমাকে আমি ননদ ছাড়া আর কিছুই ভাবি না৷

–তারমানে তুমি চলে যাবে?

–হ্যাঁ।

–তাহলে আমার শেষ একটা ইচ্ছে পূর্ণ করে দাও। আজকে তুমি খাবার টেবিলে আসোনি। তুমি না খেয়ে চলে যাবে। এটা আমার সহ্য হবে না। আজকে আমি তোমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেই। প্লিজ, তুমি না করো না।

–আমার ইচ্ছে নেই। তুমি খাবার নিয়ে যাও। আমি খাব না।

–তুমি না খেলে ভাইও খাবে না। আমি ভাইকে কথা দিয়েছি। তোমাকে খাইয়ে তারপর ভাইয়ের কক্ষে খাবার নিয়ে যাব। ভাইকে কতগুলো ঔষধ খেতে হয় জানো তো। সেগুলো যদি একদিন না খায় ভাইয়ের যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায়। তখন কি করবে ভাবি?

–তুমি খাবার রেখে যাও। আমি খেয়ে নিব। উনাকে গিয়ে বলবে, আমি খেয়েছি।

–না তুমি আমার সামনে খাও। শেহনাজের কথায় মেহেভীন কোনো বাক্য উচ্চারন করল না। সে হাত ধুয়ে এসে খেতে শুরু করল। তখনই মাশরাফি কক্ষে প্রবেশ করল। মেহেভীন কাল চলে যাবে। সেটা মাশরাফি জানে না। সে মেহেভীনের পাশে বসে বলল,

–আমার সামনে পরীক্ষা ভাবি। তুমি তো ম্যাথে ভিষণ দক্ষ। এই কয়টা দিন তুমি আমাকে একটু ম্যাথ দেখিয়ে দিবে। তুমি খেয়ে নাও। আমি খাতা আর বই নিয়ে আসছি। মাশরাফি কথা শেষ করেই উঠে চলে গেল। মেহেভীন কিছু বলার সুযোগ পেল না। শেহনাজ হাসোজ্জল মুখশ্রী করে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীনের খাওয়া শেষ হতে শেহনাজ এক প্রকার প্লেট কেঁড়ে নিয়ে কক্ষ ত্যাগ করল। শেহনাজ যাওয়ার কিছু সময় পর মেহেভীন অনুভব করল ভেতরটা ভিষণ জ্বালা করছে। সময়ের সাথে যন্ত্রনা প্রকোপ পেতে শুরু করেছে। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। সে কি অসহনীয় যন্ত্রনা! মেহেভীন মৃদুস্বরে মাশরাফি কে ডাকল। কিন্তু তার নিম্ন কণ্ঠে বলা একটা বাক্যও মাশরাফি পর্যন্ত পৌঁছাল না। মেহেভীন উঠে কক্ষের বাহিরে আসার চেষ্টা করল। ততক্ষণে ভেতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কায়াকে কাবু করে ফেলছে। মেহেভীনের মুখশ্রী দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এল, মা। আর কিছু বলার সুযোগ পাইনি মেহেভীন মুহুর্তে মধ্যে জ্ঞান হারালো সে। মাশরাফি বই খাতা নিয়ে এসে মেহেভীন অবচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে আর্তনাদ করতে উঠল। মেহেভীনের মুখশ্রী দিয়ে সাদা বর্ণের কিছু একটা বের হচ্ছে, তা দেখে মাশরাফি চমকে উঠল। সে অস্ফুট স্বরে বলল, বি’ষ! ভাবিকে কে বি’ষ দিল? মাশরাফির আর্তনাদে রিয়াদ চৌধুরী মেহেভীনের কক্ষে এল। মেহেভীনকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে আঁতকে উঠল রিয়াদ চৌধুরী। সে উত্তেজিত হয়ে বলল,

–দ্রুত মুনতাসিমকে ডেকে নিয়ে আসো। আমি গাড়ি বের করতে বলছি। রিয়াদ চৌধুরী হুলস্থুল লাগিয়ে দিল। চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি দেওয়াল আতঙ্কে কেঁপে উঠল। মুনতাসিম ল্যাপটপে কিছু একটা করছিল। তখনই মাশরাফি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

–ভাই তাড়াতাড়ি নিচে চলুন। ভাবি বি’ষ খেয়েছে। মাশরাফির বাক্য গুলো কর্ণকুহরে আসতেই হৃদয়টা ভয়ংকর ভাবে কেঁপে উঠল মুনতাসিমের। সে ল্যাপটপ ফেলে দিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। দৌড়াতে গিয়ে পায়ে ভিষণ ব্যথা অনুভব করল। কায়ার ক্ষত গুলো এখনো পুরোপুরি ভাবে সারেনি। প্রেয়সীর নির্মমতার খবরের কাছে এই ব্যথা অতি নগন্য। মেহেভীনের কক্ষ এসে মেহেভীনের নির্মম অবস্থা দেখে ভেতরটা ব্যথায় কাতরিয়ে উঠল মুনতাসিমের। সে অস্থির হয়ে মেহেভীনের কাছে গেল। মেহেভীনে মস্তক নিজের কোলে তুলে নিয়ে কাতর স্বরে বলল,

–আমি সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে আপনাকে চেয়েছি। আপনি কিছুতেই হারাতে পারেন না। আমি এত সহজে আপনাকে হারাতে দিব না। আমি থাকতে আপনার কিছু হবে না। আব্বা তাড়াতাড়ি গাড়ি বের করতে বলেন। মেহেভীনের কিছু হয়ে গেলে আমি কিভাবে বাঁচব? কথা গুলো বলতে বলতে নিজের শুভ্র পাঞ্জাবি দিয়ে মেহেভীনের মুখশ্রী মুছে দিল। দ্রুত মেহেভীনকে কোলে তুলে নিয়ে বের হয়ে গেল। মাশরাফিও ভাইয়ের সাথে গেল। যদি কোনো তথ্যের প্রয়োজন হয় তবে সে দিতে পারবে। রিয়াদ চৌধুরী, মুনতাসিম, মাশরাফি চলে যেতেই শেহনাজ ছাঁদে চলে গেল। মুঠোফোনটা বের করে প্রিয়তমকে ফোন নিল। ফোনটা রিসিভ হতেই উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,

–আব্বা আর ভাই দু’জনেই বাসায় নেই। তাইয়ান ঘুমিয়ে আছে। এটাই সুযোগ আমি কি পালাব? অপর পাশে থেকে প্রশান্তির নিঃশ্বাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো। এতদিনের পরিকল্পনা সফল হতে যাচ্ছে। বোকা মেয়েটা জানেও না নিজের অজান্তে নিজের কত বড় ক্ষতি করে ফেলল।

–এটা আবার বলতে হবে জান। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো পাখি। তোমার জন্য হৃদয়টা কতদিন ধরে পুড়ছে। আমরা আজকেই বিয়ে করে ফেলব। আমাদের বিয়ে হয়ে গেলেই তুমি পুরোপুরি ভাবে একান্তই আমার। আমাদের অনেক ভালোবাসা বাকি। দু’জনের উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ হওয়া বাকি। একসাথে চন্দ্র বিলাস করা বাকি। আমার অশান্ত হৃদয়টাকে শান্ত কর বাকি। সময় অপচয় না করে দ্রুত চলে এসো সুইটহার্ট। প্রিয়তমের কথায় সমস্ত মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ছাড়িয়ে পড়লো। শেজনাজ বিলম্ব করল না। দ্রুত বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে বের হয়ে গেল। মুনতাসিমের ফলের বাগানের মধ্যে দিয়ে একটা গুপ্ত দরজা আছে। সেটা মুনতাসিম আর তাইয়ান ছাড়া কেউ জানে না। শেহনাজ কৌশলে জেনে নিয়েছে। আজ সে সুযোগে সৎ ব্যবহার টা করে নিল। সবাই মেহেভীনকে নিয়ে চিন্তিত আছে।

–উনি শেষ কি খাবার খেয়েছিল? ডক্টরের প্রশ্নে মাশরাফি তড়িৎ গতিতে জবাব দেয়,

–ভাত।

–আমাদের সন্দেহই ঠিক। উনার খাবারের সাথে বি’ষ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা দ্রুত বি’ষ বের করার ব্যবস্থা করছি। ডক্টর আর দাঁড়াল না। দ্রুত জরুরি বিভাগের দিকে ছুটে গেল। চিন্তায় সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসছে। ধরনীর এই মানুষটার কাছে তার সকল শক্তি তুচ্ছ! মানুষটার কিছু হলেই ধরনীর সব অসহায়ত্ব তার বুকে এসে বাসা বাঁধে। ছেলের চিন্তিত মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টি যেতেই রিয়াদ চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–মেয়েটাকে যখন এতটাই ভালোবাসো, তাহলে এভাবে মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছ কেন? মেয়েটা তোমার জন্য বি’ষ খেয়ে বসেছে। এখন যদি মেয়েটার কিছু হয়ে যায়। তখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে তো? মুনতাসিম নিস্তব্ধ রইলো। মাশরাফি কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হতেই রিয়াদ চৌধুরী থামিয়ে দিল। মাশরাফি বাবার মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে, কোনো বাক্য উচ্চারন করার সাহস পেল না।

শহরের সুনশান নিস্তব্ধ নিষিদ্ধ কক্ষে শেহনাজকে নিয়ে এসেছে স্বাধীন। কক্ষে প্রবেশ করতেই ছয়জন যুবককে দেখতে পেল শেহনাজ। তাদের প্রতিটি মুখশ্রী শেহনাজের পূর্ব পরিচিত। সে কক্ষে প্রবেশ করে আস্তরণে গিয়ে বসল। স্বাধীন আচমকা কবাট লাগিয়ে দিল। কবাট লাগানোর শব্দ চমকে উঠল শেহনাজ! সে বিস্ময় নয়নে স্বাধীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। স্বাধীনের মুখশ্রীতে পৈশাচিক হাসি বিদ্যমান। মুহুর্তের মধ্যে শেহনাজে ছোট্ট হৃদয়টাকে ভয় গ্রাস করে ফেলল।

–তুমি কবাট বন্ধ করলে কেন স্বাধীন? আমাদের বিয়ে হবে না, কাজী কোথায়? শেহনাজের প্রশ্নে কক্ষ জুড়ে হাসির প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল। শেহনাজ অসহায় দৃষ্টিতে সবার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। স্বাধীন তাচ্ছিল্য করে বলল,

–তুই তো পাঁচ হাজার টাকার মেয়ে। তুই ভাবলি কি করে তোকে আমি বিয়ে করব। তোর মতো মেয়েকে টেস্ট করা যায়। কিন্তু সারাজীবন সংসার করা যায় না। তোকে বিয়ে করলে আমার বউ তোকে মেনে নিবে? স্বাধীনের কথায় অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে শেহনাজের। মস্তকের উপরে থাকা বিশাল আকাশটা তার কায়ার ওপরে এসে পড়লো। মুহুর্তের মধ্যে ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসছে। সে দৌড়ে পালাতে চাইলে স্বাধীন খপ করে শেহনাজকে ধরে ফেলে। শেহনাজ হাত মোচড়াতে মোচড়াতে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আমাকে ছেড়ে দে বেইমান। তুই আমার সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করবি। সেটা যদি আমি আগে জানতাম কখনোই তোর কাছে আসতাম না। আমাকে এভাবে ঠকালি কেন? আমি কি অপরাধ ছিল? আমার একটাই অপরাধ আমি তোকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছি। স্বাধীন আমার না বিশ্বাস হচ্ছে না। তুমি বলো না সবকিছু মিথ্যা তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমার ভিষণ কষ্ট হচ্ছে স্বাধীন। আমাকে এভাবে না মানসিক মৃত্যুদন্ড দিও না। আমি সবাইকে ছেড়ে তোমার কাছে এলাম। এ তুমি কেমন হয়ে গেলে? তুমি তো এমন পাষাণ ছিলে না! এতটা পাষাণ কিভাবে হলে স্বাধীন? তুমি না আমাকে ভালোবাসো। তুমি তো আমাকে কষ্ট দিতে পারো না। আল্লাহর দোহাই লাগে তোমার আমাকে কলঙ্কিত করো না। আমি নিজ ইচ্ছেয় আমাকে তোমার নামে লিখে দিয়েছি। কবুল বললেই আমি তোমার দলিল করা সম্পদ হয়ে যাব। শেহনাজের কথায় পাষাণ প্রেমিকের হৃদয় পুড়ল না। সে শেহনাজের বুক থেকে একটা টানে ওড়না সরিয়ে ফেলল। শেহনাজ সাথে সাথে হৃদয়বিদারক চিৎকার দিয়ে বলেই উঠল, ”তাইয়ান।”

গভীর নিদ্রায় তলিয়ে ছিল তাইয়ান। আচমকা নিদ্রা ভেঙে গেল তার। ললাট বেয়ে তরতর করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। ভেতরটা অদ্ভুত ভাবে অস্থির হয়ে উঠছে। এত ভয় লাগছে কেন তার! হৃদয়টা এতটা বিষণ্ণ হয়ে উঠছে। সে পানি খেয়ে আবার নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। নিদ্রায় বিভোর থাকা তাইয়ান জানতেও পারল না। তার হৃদয়ের কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখা পাষাণ রমণীর জীবনের সবচেয়ে বড় অনর্থটা হয়ে গেল। রমণী বুঝল কে তার প্রিয়জন এবং কে তার প্রয়োজন। কিন্তু বুঝতে যে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে। সময় আজ তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে গিয়েছে। পাপ ডেকে বলছে। কিছু মনে পড়ছে। প্রকৃতি ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয় না।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে