#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
বাতাসে বিরহ বইছে। অনুভূতিরা শূন্য হয়ে গিয়েছে। মস্তিষ্কের একাংশ ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। মনের আনাচে কানাচে দুঃখরা আনন্দ করছে। এখন যে তাদের সময়! সব সময় যদি সুখই রাজত্ব করে, তাহলে তারা রাজত্ব করবে কখন? এখনই যে সুবর্ণ সুযোগ এই সুযোগটা বুঝি হাতছাড়া করা যায়! বিরহরা চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি আঙ্গিনা দখল করে নিয়েছে। পাখিরা আর সুর তুলে না। ফুল গাছে ফুল ফুটে না। গাছ গুলো কেমন ঝিমতে শুরু করে দিয়েছে। অযত্নে রাখলে তো লাহায়ও মরিচা ধরে যায়। সেখানে ফুল গাছে সকালে পানি না দিলে বিকেলেই মিইয়ে যায়। একমাস ধরে পানি না দিলে তার অস্তিত্ব তো মুছে যাবেই। রাইমা বেগম চলে গিয়েছে একমাস হয়েছে। প্রাকৃতিক নিয়মে সবার জীবন আগের ন্যায় ছুটে চলেছে। সময় তো কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের তো কোনো দুঃখ নেই। যদি থাকতো তাহলে এভাবে বিরতিহীন ভাবে ছুটতে পারত! কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকেনি। শুধু থেমে গিয়েছে মেহেভীনের মন৷ হাসোজ্জল মেয়েটা মুহুর্তের মধ্যে নিরব হয়ে গিয়েছে। সেই সাথে কেঁড়ে নিয়েছে কিছু মানুষের ভালো থাকা। সে কি জানে না! তার ভালো থাকার ওপরে একটা মানুষের ভালো থাকা নির্ভর করে। তবে কেন এত নিরবতা? মেহেভীন আস্তরণের বসে চিন্তায় মগ্ন ছিল। তখনই রিয়াদ চৌধুরী আসে। মেহেভীন রিয়াদ চৌধুরীকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। ভদ্রতা বজায় রেখে বলল,
–কিছু বলবেন আব্বা?
–তোমার সমস্যা কি বলতে পারো? তুমি এমন ভাব করছ যেন পৃথিবীতে শুধু তোমার মা-ই মারা গিয়েছে। আমার ছেলেটার মা ছোট বেলায় মারা গিয়েছে। তুমি অর্ধেক জীবন তোমার বাবা-মাকে পাশে পেয়েছ। কিন্তু আমার ছেলে সেটাও পাইনি। মুনতাসিম বুক ভরা হাহাকার নিয়ে বড় হয়েছে। তোমার চিন্তায় ছেলেটা আমার আধমরা হয়ে গিয়েছে। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে তোমাকে আগলে রাখার চেষ্টা করছে। আর তুমি তাকে দুঃখ দিয়ে মুড়িয়ে ফেলছ! সব সময় নিজের কথা ভাবলেই হয় না। বিপরীত পক্ষের মানুষটার কথাও ভাবতে হয়। তোমরা দু’জন ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো না। আগের মতো হাসো না। এগুলো কি মেহেভীন? আমার পরিবারকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমি তোমাকে দিয়েছিলাম। আর তুমি পরিবারটাকে বিষাদে পরিপূর্ণ করে দিলে। আজ থেকে যদি তুমি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা না করেছ। তবে আমাকে এ বাড়ি ছাড়তে হবে। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস সুখ দেখে ছাড়তে চাই, দুঃখ দেখে নয়। তোমরা যখন ঠিকই করে নিয়েছ। তোমরা সুখে নয় দুঃখেই সুখী। তাহলে আমিও না হয় সুখের সন্ধানে গৃহ ত্যাগ করব।
–আর হবে না আব্বা। আমি সবকিছু আবার আগের মতো করে দেওয়ার চেষ্টা করব। রিয়াদ চৌধুরী কোনো বাক্য উচ্চারন না করেই কক্ষ ত্যাগ করল। মেহেভীনের বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করেছে। কথা গুলো সত্য হলে-ও ধারালো অস্ত্রের মতো মেহেভীনের হৃদয় এসে বিঁধল। যে মানুষটার জন্য তার বাঁচতে ইচ্ছে করে। যে মানুষটা না থাকলে তার জীবন মূল্যহীন হয়ে যেত। ধরনীর সকল মানুষের কাছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য পেত। যে মানুষটা তাকে তার সাম্রাজ্যের রাণী বানিয়েছে। তাকে দিয়েছে পাহাড় সমান সন্মান। সেই মানুষটাকে সে প্রতিনিয়ত আঘাত করে যাচ্ছে। মানুষটা তো আমার দেওয়া যন্ত্রনা সহ্য করে নিচ্ছে। সে আমাকে যেমন ভাবে সহ্য করছে। অন্য কেউ সহ্য করবে না এটাই স্বাভাবিক। এই যে তার মা মারা যেতে না যেতেই সবাই তাকে ভুলে গেল। সে মা’রা গেলেও বুঝি মানুষ তাকে ভুলে যাবে। আজকাল অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তাধারা এসে মস্তিষ্কে বাসা বাঁধে। আজকাল মুনতাসিমকে হারিয়ে ফেলার ভিষণ ভয় হয়। এই যে সে মুনতাসিমকে অবহেলা করছে। মুনতাসিম সেটা অমৃতের ন্যায় সদরে গ্রহণ করে নিচ্ছে। আচ্ছা মুনতাসিম না থাকলে তার কি হবে? কথাটা মস্তিস্কে হানা দিতেই অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। সে বুকে পাথর চাপা রাখবে। দুঃখ গুলো মাটি চাপা দিবে। আর মুনতাসিমকে দুঃখ দিবে না। মুনতািসমের ও ভালো থাকার অধিকার আছে। যে মানুষটা সবার ভালো চাইল। দিনশেষে সেই মানুষটার ভালো থাকাই সে কেঁড়ে নিল। আজ থেকে সে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করবে। তবে কি চাইলেই স্বাভাবিক হওয়া যায়?
–আপনি কি মানুষ! আপনি মেয়েটার সাথে এমন ব্যবহার না করলেও পারতেন। সারাদিন খালি নিজের ছেলের ভালো থাকার কথা ভাবেন। মেয়েটার ভেতর দিয়ে কি যাচ্ছে। সেটা আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। আপনাদের পুরুষ মানুষের এই একটা সমস্যা আপনারা নারীদের কিছুতেই বুঝতে চান না। আপনারা এতটা স্বার্থপর কেন বলেন তো? সাহেলা চৌধুরীর কথায় আড়দৃষ্টিতে অর্ধাঙ্গিনীর দিকে দৃষ্টিপাত করল রিয়াদ চৌধুরী। কণ্ঠে গম্ভীরতা এনে বললেন,
–মানুষ বেশি আদর পেলে কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা হারায়। এই মুনতাসিম তাকে এতটা ভালোবাসা দিচ্ছে, আগলে রাখছে। মেয়েটা কি স্বাভাবিক হতে পেরেছে? সে ভেতরটা আরো দুর্বল হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে দু’জনই শেষ হয়ে যাবে। একটা মানুষকে শক্ত করার জন্য কিছু বিষাক্ত বাক্যই যথেষ্ট। পর মানুষ পরের মতো আচরণ করেছি। আমারটা আমাকে বুঝতে দাও। আমি কেন এমন আচরন করেছি। সেটা সময় হলেই বুঝতে পারবে। মেয়েটাকে ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে মে’রে ফেলতে পারব না। বাক্য গুলো শেষ করে স্থান ত্যাগ করল রিয়াদ চৌধুরী।
ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। সারাদিনের ক্লান্তি কায়াতে নিয়ে বাড়িতে ফিরল মুনতাসিম। সমস্ত মুখশ্রী বিষন্নতায় আচ্ছন্ন। মনটা বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। প্রেয়সীর ভালো থাকাটা যখন আঁধারে রুপ নেয়। তখন নিজের ভালো থাকাটা আমাবস্যার রজনীর ন্যায় হয়ে যায়। বুকভরা হতাশা নিয়ে নিজের কক্ষে প্রবেশ করল মুনতাসিম। চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষ জুড়ে অন্ধকারের রাজত্ব। এটা নতুন কিছু নয় অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। সে ফ্রেশ হতে চলে গেল। আজ কতগুলো দিন হয়ে গেল আনন্দ করে আহার করা হয় না। আনন্দ গুলো যেন বিলীন হয়ে গিয়েছে। সে ফ্রেশ হয়ে এসে নিঃশব্দে মেহেভীনের পাশে শুয়ে পড়লো। তখনই কর্ণকুহরে কারো গম্ভীর কণ্ঠ স্বর ভেসে এল,
–না খেয়ে শুয়ে পড়ছেন কেন?
–আপনি ঘুমাননি?
–আমাকে প্রতিদিন ঘুমের ঔষধ খাওয়ান কেন?
–আপনি যেন শান্তিতে রজনী পার করতে পারেন, তাই।
–আর নিজে অশান্তিতে থাকেন। নিদ্রাহীন রজনী পার করেন। এই যে আমার পেছনে এত ছুটেন ক্লান্ত হন না।
–মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হব না।
–খাবার উপরে নিয়ে আসব নাকি নিচে গিয়ে খাবেন?
–আপনি না খেয়ে ঘুমাবেন। আর আমি খেতে যাব!
–আমার সাথে আপনার সাথ?
–অবশ্যই।
–আমি দুই হাঁড়ি ভাত খাব। আপনি খাবেন?
–চলুন। কথা গুলো শেষ করেই মুনতাসিম আস্তরণ ত্যাগ করল। মেহেভীন উঠে কেশগুলো ঠিক করতে করতে কক্ষের আলো জ্বলিয়ে বাহিরে চলে গেল। মেহেভীনের পেছনে পেছনে মুনতাসিমও গেল। মেহেভীনের স্বাভাবিক আচরণে মুনতাসিম একটু অবাক হলো! তবুও মেহেভীনকে বুঝতে না দিয়ে সে মেহেভীনের সাথে ডাইনিং টেবিলে বসল। মুনতাসিমে সমস্ত মুখশ্রী কেমন চকচক করছে। মেহেভীনের স্বাভাবিক আচরণ ক্ষণিকের জন্য হলে-ও মুনতাসিমের বিষন্নতা দূর করে দিয়েছে। মেহেভীনের হাসোজ্জল মুখশ্রী মুনতাসিমের সারাদিনের ক্লান্তি এক নিমিষেই শেষ করে দিল। মেহেভীন খাবার বেড়ে মুনতাসিমের সামনে দিল। নিজেও কিছুটা খাবার বেড়ে নিল। খাবার সামনে নিয়ে মলিন মুখশ্রী করে বসে আছে। কণ্ঠ স্বর স্বাভাবিক থাকলে-ও মুখশ্রীতে বিষন্নতা বিদ্যনাম। মেহেভীনের দিকে দৃষ্টি যেতেই মুনতাসিম মেহেভীনের সামনে এক লোকমা ভাত তুলে ধরল। মেহেভীন কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই ভাত টুকু মুখে পুরে নিল। মেহেভীনের আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন হতে শুরু করেছে। অশ্রুকণা এসে চোখের কার্ণিশে এসে জমা হয়েছে। মুনতাসিম যত্নসহকারে অশ্রু ঝড়ার আগেই মুছে দিল। আদুরে ভাবে মেহেভীনকে নিজের বুকের মধ্যে আগলে নিল। মেহেভীনকে বুকের মধ্যে রেখে খাইয়ে দিতে থাকলো। মেহেভীন অসহায়ত্ব মাখা কণ্ঠে বলল,
–আপনি না থাকলে আমার কি হতো? আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচব কিভাবে? আপনি কখনো আমাকে ছেড়ে যাইয়েন না। আমি আপনাকে আর কখনো কষ্ট দিব না। আপনি আমাকে একটু সময় দিন। আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে ফেলব।
–আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি। আপনি ততক্ষণ রানীর মতো বাঁচবেন। আপনি এমন এক রাজার রানী, যে রাজার রাণীকে আঘাত করার কথা স্মরন হতেই প্রতিটি মানুষের হৃদয় কাঁপে। এই রাজ্য আপনার আপনি আপনার রাজ্যে যেভাবে খুশি থাকবেন। আপনার দুঃখ হলে কাঁদবেন। আপনি সুখ অনুভব করলে, চারিদক হাসির প্রতিধ্বনিতে মুখরিত করে রাখবেন। আপানাকে কেউ গোপনে আঘাত করলে আপনি আমাকে গোপনে স্মরন করবেন। বাকিটা বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব আমার। এই মানুষটা মন খুলে কথা বলে এটা মেহেভীনের ভিষণ ভালো লাগে। হৃদয় শীতল করা তার প্রতিটি বাক্য। দুঃখ গুলো কিছু সময়ের জন্য চাপা পড়ে যায়। মেহেভীন দু’হাতে মুনতাসিমের আঁকড়ে ধরল। তা দেখে মুনতাসিমের অধরের কোণে হাসির রেখার দেখা মিলল। দু’জনের প্রণয় দেখে রিয়াদ চৌধুরী বুকটা প্রশান্ত হলো। সে চা খাবার জন্য আসছিল। দু’জনকে খাবার টেবিলে দেখে দু’টি চরন স্থির হয়ে যায়। সাহেলা চৌধুরী রাগান্বিত হয়ে বলল,
–এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছেন? লজ্জা করছে না আপনার! আজকে আপনাকে চা খেতে হবে না। কক্ষে ফিরে চলুন। রিয়াদ চৌধুরী অর্ধাঙ্গিনীর কথায় লজ্জিত বোধ করল। সে কোনো বাক্য উচ্চারন না করেই হনহন করে চলে গেল। সাহেলা চৌধুরী এবার বুঝলেন। রিয়াদ চৌধুরী কেন মেহেভীনকে কড়া বাক্য শুনিয়েছিল। কিছু আঘাত ভালোবাসা দিয়ে নয় আঘাতপ্রাপ্ত মানুষটাকে আঘাত দিয়েই শক্ত করতে হয়।
চারদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। শেহনাজ খুব সাবধানতা অবলম্বন করে বাড়ি ফিরল। কতগুলো প্রহর কাটিয়ে দু’টি মানুষ মন খুলে কথা বলার মুহূর্তটা ভিষণ সুন্দর। কিন্তু কিছু সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী হতে গিয়ে কিছু সত্যের মুখোমুখি হবার যে ব্যাপারটা! সেটা ভিষণই অদ্ভুত। শেহনাজ সাবধানতা অবলম্বন করে-ও শেষ রক্ষা পেল না। অন্ধকারের মধ্যেই কারো সাথে ধাক্কা খেল সে। মেহেভীন চিৎকার করার আগেই শেহনাজ মেহেভীনের মুখ চেপে বলল,
–ভাবি আমি শেহনাজ চিৎকার করো না। কথা গুলো বলেই মেহেভীনের মুখ থেকে হাত সরিয়ে দিল। মেহেভীন বিস্ময় নয়নে শেহনাজের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। শেহনাজের মুখশ্রীতে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। মেহেভীন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–তুমি এতরাত পর্যন্ত বাহিরে ছিলে শেহনাজ? তুমি এটা জানো না। চৌধুরী বাড়ির মেয়ে-বউরা সন্ধ্যার পর বাড়ির বাহিরে থাকে না। তোমার ভাই জানলে কি অবস্থা হবে, এটা কখনো ভেবে দেখেছ?
–আমার ভুল হয়ে গিয়েছে ভাবি। আমি আর কখনো এমন রাত করে বাড়ি ফিরব না৷ আমি মাকে জানিয়েছিলাম। আজকে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্মদিন ছিল। ওর কথা ফেলতে পারিনি বলেই এত রাত হয়ে গিয়েছে।
–শেহনাজ তুমি কি ম’দ খেয়েছ? তোমার শরীর থেকে ম’দে’র গন্ধ আসছে।
–তুমি এভাবে আমাকে জেরা করছ কেন? আমি কেমন মেয়ে তুমি জানো না ভাবি? আমার ফ্রেন্ডরা খেয়েছে কসম করে বলছি ভাবি। আমি এসব খাইনি। তুমি ভাইকে কিছু বলো না ভাবি। ভাই জানলে আমাকে শেষ করে ফেলবে। আমাকে একটা সুযোগ দাও।
–তুমি নিজের কক্ষে যাও। আর কখনো এমন করো না। মেহেভীনের থেকে অনুমতি পেতেই শেহনাজ দ্রুত নিজের কক্ষে চলে গেল। মেহেভীনের মস্তিষ্ক বলছে। শেহনাজ মিথ্যা বলেছে। শেহনাজ কথা বলার সময় শেহনাজের মুখশ্রী দিয়ে মদের বিশ্রী গন্ধ নাসারন্ধ্রে এসে ঠেকছিল। মেহেভীন অশান্তি চায় না বলেই বিষয়টা চেপে গেল।
লা’শে’র ফ্রিজিং ড্রয়ারটা খুলতেই রক্তবিহীন সাদা বর্ণের দেহটা বের করল যুবক। সে খুব দ্রুত লা’শ’টা বের করতে চাইছে। যেকোনো মুহূর্তে এই লা’শ’টার খোঁজ মুনতাসিম পেয়ে যেতে পারে। এই লা’শে’র সন্ধান তো মুনতাসিমকে পেতে দেওয়া যাবে না। মুনতাসিম লা’শ পর্যন্ত পৌঁছে যাবার আগেই লা’শ’টা’কে সরাতে হবে। যুবকের সমস্ত কায়া ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে। যুবকে তাড়াহুড়ো করতে দেখে লা’শ পাহাড়া দেওয়া গার্ডটা বলল,
–লা’শ নিয়ে কোথায় যাবেন?
–আমার রেখে যাওয়া লা’শ আমি যেখানে খুশি সেখানে রাখব। আপনাকে এত কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। আমার সামনে থেকে সরে যান না হলে খু’ন করে ফেলব। যুবকের কথায় সরে দাঁড়াল মানুষটা। বরফের ন্যায় শীতল দেহটা নিয়ে ছুটে চলেছে যুবক। কিছু পথ যেতেই কালো পোশাক পড়া ভারি সুঠাম দেহের লোক এসে যুবককে ধরে ফেলল। যুবক বজ্রকণ্ঠে হুংকার দিয়ে উঠল।
–আমাদের আশিটা মেয়ে দেওয়ার কথা ছিল স্যার। আমরা ঊনআশি মেয়ে জোগাড় করতে পেরেছি। আর একটা মেয়ে খুঁজে পাচ্ছি না। এত দ্রুত এত মেয়ে তোলা অসম্ভব ব্যাপার ছিল স্যার। জিহানের কথায় জাফর ইকবাল গা-ছাড়া ভাব নিয়ে আস্তরণে শায়িত হলেন।
–তোমরা এত চিন্তা কেন করছ? মুনতাসিমের অর্ধাঙ্গিনী আছে না। তাকে দিয়েই আমরা আশিটা পূর্ণ করে দিব। এবার সময় এসে গিয়েছে। তোমরা চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকবে। সুযোগ পেলেই মুনতাসিমের অর্ধাঙ্গিনীকে তুলে নিয়ে আসবে। জাফর ইকবালের কথায় জিহান সম্মতি জানিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল।
চলবে…..
#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
বিষন্ন হৃদয়টা মেনে নিতে শিখে গিয়েছে। হাসি দিয়ে বুকের মধ্যে জমে থাকা চাপা কষ্ট গুলো কিভাবে আড়াল করতে হয়। সেটা পরিস্থিতি অবুঝ মনকে বুঝিয়ে দিয়েছে। দুঃখরা অভিমানে দূর দেশে পাড়ি জমিয়েছে। হতাশারা দুঃখ পেয়ে বিলীন হতে শুরু করেছে। সুখ গুলো একটু একটু করে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এসে জমা হচ্ছে। অনুভূতিরা ফিরতে শুরু করেছে আপন নীড়ে। আঘাতপ্রাপ্ত মানুষকে আঘাত করলে যে আর দুঃখ লাগে না। সেটা কি মানুষ জানে না? তারা যদি জানতো তাহলে কখনোই এমন বোকামি করতো না। আঘাত প্রাপ্ত মানুষটাকে চূর্ণবিচূর্ণ করার জন্য নতুন পথ খুঁজত। মেহেভীন মলিন মুখশ্রী করে কক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তখনই কারো হাসির প্রতিধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠল। কিছু সময়ের ব্যবধানে চাপের কাপটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। কিছু ভাঙার শব্দ কর্ণকুহরে আসতেই মেহেভীনের দৃষ্টি সোফার দিকে গেল। রিনি এসেছে। রিনির সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে সুফিয়া চৌধুরী। তার পাশেই বসে আছে তাহিয়া। মেহেভীনকে দেখেই সুফিয়া চৌধুরী মেহেভীনকে ডাকলেন। মেহেভীন ভদ্রতা বজায় রাখতেই নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। সুফিয়া চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–তোমার কি কোনো কাজ আছে মেহেভীন?
–না।
–তাহলে তুমি একটা কাজ করো। এই বাড়ির বউ হয়ে আসোনি তো এসেছ রাজরানী হয়ে, সংসারের কোনো কাজে হাত দাও না। তোমার আর কি দোষ দিব বলো। আমাদের মুনতাসিম হয়েছে একটা বউ পাগল। বউয়ের একটা ফুলের টোকা লাগলেই যেন সে রক্তাক্ত হয়ে যায়। একটা রাজার মেয়েও তো এভাবে বসে খায় না। রাজার মেয়েও তো শখ আছে। সে সংসারের কাজ করবে। ভালোমন্দ রান্না করে শশুর বাড়ির লোকজনকে খাওয়াবে। তোমার কি কোনো শখ আহ্লাদ নেই? এমন শুয়ে-বসে খেতে পেলে কে-ই বা কাজ করতে চায় বলো। এই জায়গা টুকু পরিষ্কার করে দাও। সুফিয়া চৌধুরীর কথায় মেহেভীনের সমস্ত কায়া জ্বলে উঠল।তার প্রতিটি বাক্য মেহেভীনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছে। মেহেভীন কাঁচের টুকরো গুলো তুলতে তুলতে বলল,
–আমি একটা সময় চাকরি করতাম ফুপি। সেখানে থেকে কিছু টাকা জমিয়েছি। আমার বাপ ফকিরের সন্তান ছিল না। আমার বাপের যা আছে। তা আপনি আপনার মেয়ে সহ আরো দশটা পরিবার সুন্দর মতো বসে খেতে পারবে। শুধু তাই নয় সারাজীবন বসে খেলেও ফুরাবে না। নিজের প্রশংসা নিজের করতে হয় না। তবে আমি মেয়েটা ভিষণ পরিশ্রমী জানেন। ধরনীর বুকে খুব কাজ কাজই আছে যেগুলো আমি পারি না। তাই খাওয়ার খোঁটা অন্তত আমাকে দিয়েন না। আমি নিজের হাত খরচের টাকা পর্যন্ত মুনতাসিমের থেকে নেই না৷ কিন্তু সে প্রতি মাসে যত্ন সহকারে আমার হাতে তুলে দেয়। সেগুলো আমার কোনো কাজেই আসে না। আমি সেগুলো তুলে রাখি। আপনি যাকে বউ পাগলা বলছেন। ইসলাম তাকে শ্রেষ্ঠ স্বামী বলে। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক একজন ব্যথা পেলে তো আরেকজন আঘাত প্রাপ্ত হবেই। এটাই স্বাভাবিক। যে স্ত্রী তার স্বামীর মন মতো চলে না। আল্লাহ তায়ালা সেই স্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্ট হন। আমার স্বামী আমাকে কাজ করতে বললে আমি অবশ্যই করব। মেহেভীনের কথায় অপমানে সমস্ত মুখশ্রী চুপসে খেল সুফিয়া চৌধুরীর। মেয়েটাকে রিনির সামনে ছোট করতে গিয়ে নিজেই অপমানিত হবে। সেটা তার চিন্তাধারার বাহিরে ছিল। সুফিয়া চৌধুরী রিনিকে আঁখিযুগল দিয়ে ইশারা করতেই রিনি মেহেভীনের হাতে পা রাখলো। মেহেভীনের মুখশ্রী থেকে বিষণ্ণতাকে গ্রাস করে নিয়েছে একরাশ ক্রোধ। মেহেভীনের জ্বলে ওঠা আঁখিযুগলে দৃষ্টিপাত করেও রিনির ভাবান্তর হলো না। রিনিকে অবাক করে দিয়ে মেহেভীন রিনির পা মুচড়ে ধরল। রিনি ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল। মুনতাসিম বাহিরে থেকে গৃহে প্রবেশ করতেই মেহেভীনকে এমন অবস্থায় দেখে নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গেল। মুনতাসিমকে দেখে রিনির কলিজা শুকিয়ে গেল। রিনিকে কাঁপতে দেখে মেহেভীন পেছনের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মুনতাসিমকে দেখেই হাতটা আলগা করে নিল। মেহেভীনের হাত আলগা হতেই সে দৌড়ে রিয়াদ চৌধুরীর কক্ষে চলে গেল। মুনতাসিম এসে মেহেভীনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। মেহেভীন মুনতাসিমের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল।
–নিচে বসে কি করছিলেন?
–মেহমান চায়ের কাপ ভেঙে ফেলেছে। সেটাই পরিষ্কার করছিলাম।
–আমার বাসায় কি গার্ডের এতই সংকট পড়লো! আমি কি নতুন গার্ড নিয়োগ দিব? চৌধুরী বাড়িতে এত এত মানুষ থাকতে আপনি কেন অন্যের ভেঙে ফেলা জিনিস পরিষ্কার করবেন? মুনতাসিমের হুংকারে কেঁপে উঠল চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি দেওয়াল। মুনতাসিমের উত্তপ্ত মেজাজ দেখে সুফিয়া চৌধুরী রাগান্বিত হয়ে বলল,
–আমি মেহেভীনকে পরিষ্কার করতে বলেছি। নিজের সংসারের কাজ করলে কি তোর বউয়ের হাত খসে যাবে?
–তোমার মেয়েও তো তোমার পাশে বসে আছে ফুপি। তোমার মেয়েকে না বলে আমার বউকে কেন বললে? আমি বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছি কোনো চাকরানি না। তোমার সব সময় এটা মস্তকে রাখতে হবে। মেহেভীন এ বাড়ির বউ কাজের লোক না। এই বাড়িতে কাজের মানুষের অভাব নেই। আপনি কাঁচের টুকরো গুলো হাত থেকে এখনই ফেলবেন। এখনই মানে এখনই। আমার কথার অবাধ্য হবার চেষ্টা করলে সবকিছু তচনচ করে দিব। তাহিয়া তুই উঠে আয়৷ এখনই এই জায়গাটা পরিষ্কার করে দিবি। আমার একটা বাক্য যেন দ্বিতীয় বার উচ্চারন করা না লাগে। যদি লেগেছে আজ চৌধুরী বাড়িতে লা’শ পরবে। মুনতাসিমের বলার প্রতিটি বাক্য তাহিয়ার হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল। ভয়ে সমস্ত কায়া অবশ হতে শুরু করেছে। সে আড়দৃষ্টিতে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করল। সে মায়ের কথার অপেক্ষা না করেই কাঁচ গুলো তুলতে শুরু করল। নিজের ওড়না দিয়ে খুব দ্রুততার সঙ্গে জায়গাটা আগের ন্যায় পরিষ্কার করে দিল। সুফিয়া চৌধুরী যেন নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গেল। সে রাগান্বিত হয়ে চেচিয়ে বলল,
–একটা খু’নি’র মেয়ের জন্য এত আদিখ্যেতা কিসের? যে মেয়ের জন্য সারা পৃথিবীর সাথে লড়াই করছিস। একদিন সেই মেয়ের স্বার্থে আঘাত লাগলে, মেয়েটা তোর বুকে আঘাত করবে। এটা সব সময় মনে রাখিস। এই খু’নি’র মেয়ের জন্য সমাজে মুখ দেখাতে পারি না৷ পথে বের হলেই লোকজন জনসম্মুখে অপমান করে। এই মেয়ের জন্য তুই আমার মেয়েকে দিয়ে কাজ করালি!
–তোমাকে সমাজে মুখ দেখাতে কে বলেছে ফুপি? তুমি তো এই সমাজে থাকো না। দু’দিনের অতিথি হয়ে এসেছ। আবার দু’দিনের অতিথি হয়ে চলে যাবে। সমাজ কি বলল সেটা দেখার বিষয় তোমার না। সমাজ আমাকে আর আমার বউকে অন্ন-বস্ত্র দিয়ে আমাদের ভরনপোষণ করে না। আমার বউকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করবে কার এত সাহস? আমিও দেখতে চাই। কার কলিজা এত বড় হয়েছে? তার বড় কলিজা তো আমাকে মেপে দেখতেই হবে। মুনতাসিমের কথায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সুফিয়া চৌধুরী। ততক্ষণে রিয়াদ চৌধুরীকে নিয়ে রিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছে। রিয়াদ চৌধুরীকে দেখে সুফিয়া চৌধুরী অশ্রুভেজা কণ্ঠে বলল,
–আপনি দেখলেন ভাই। মুনতাসিম সামান্য একটা বিষয় নিয়ে আমাকে থাকার খোঁটা দিল। আমি আর কখনো আপনাদের বাড়িতে আসব না। আজই তাহিয়ার দাদির বাড়ি চলে যাব। যে মেয়েকে নিয়ে এত অহংকার করছে। সেই মেয়েই একদিন সব অহংকার ভেঙে দিবে। সুফিয়া চৌধুরী রিয়াদ চৌধুরীর থেকে কিছু কড়া বাক্য আশা করেছিলেন৷ কিন্তু সুফিয়া চৌধুরীকে বিস্ময় করে দিয়ে রিয়াদ চৌধুরী নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে। বাক্য গুলো আজ রিয়াদ চৌধুরীর মুখশ্রীর আশেপাশে নেই। শব্দরা ক্ষণিকের জন্য ছুটি নিয়েছে। মুনতাসিম রিনির দিকে রক্তিম চোখে দৃষ্টিপাত করে বলল,
–তোকে আমি সাবধান করেছিলাম। তুই আমার কলিজাতে হাত দিয়েছিস। সেদিন তোকে আমি ক্ষমা করেছি। আজ তোর পা আমি ভাঙব-ই। মুনতাসিমের কথায় রিনির সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। মেহেভীনের মলিন মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টি যেতে মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–আপনার সাথে আমার কথা আছে। দ্রুত কক্ষ আসবেন। আপনাকে আমি বলেছি না। আমি যতক্ষণ বাসায় থাকব। আপনার ততক্ষণ কোনো কাজ নেই। আপনার শুধু একটাই কাজ আমার সামনে বসে থাকা। কতবার বলেছি কক্ষে প্রবেশ করেই যেন আপনার মুখশ্রী আমি দেখতে পাই। বাক্য গুলো শেষ করেই মুনতাসিম গম্ভীর মুখশ্রী করে নিজের কক্ষে চলে গেল। রিয়াদ চৌধুরী ইশারা দিয়ে মেহেভীনকে যেতে বলল। মেহেভীন বিলম্ব করল না দ্রুত স্থান ত্যাগ করল।
চারদিকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। রজনীর মধ্য প্রহর চলছে। সবাই নিদ্রা দেশে তলিয়ে গিয়েছে। আজকাল মেহেভীন প্রতি রজনীতে ভিষণ বাজে স্বপ্ন দেখে। কিছু স্বপ্ন ভেতরটায় সারাক্ষণ যন্ত্রনা দেয়। মাঝেমাঝে মায়ের কথা স্মরন হতেই নিরবে অশ্রু বিসর্জন দেয়। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে মেহেভীন। মস্তিষ্ক এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। মস্তিষ্ক সচল হতেই পানির অভাববোধ করল সে। পাশেই মুনতাসিম গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। সুফিয়া চৌধুরী চলে গিয়েছে সাতদিন হয়েছে। রিয়াদ চৌধুরী ফোন করে আসতে বলেছে। তবুও তিনি আসেননি। তার এক কথা মুনতাসিম ক্ষমা না চাইলে আসবে না। মেহেভীন নিঃশব্দে উঠে নিচে আসলো। পানি খেয়ে কক্ষের আসার সময় কারো কালো অবয়ব দেখতে পেল সে। মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রী কুঁচকে এল। সে অস্ফুট স্বরে বলল,
–কে ওখানে? মেহেভীনের বাক্য শেষ হতেই উচ্চ স্বরে কিছু পড়ার শব্দ হলো। রজনীর মধ্য প্রহর চলায় শব্দটা খুব স্পষ্ট ভাবেই কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল। মেহেভীন ড্রয়িং রুমের আলো জ্বালাতেই শেহনাজকে দেখতে পেল। শেহনাজের মুখশ্রীতে বিরক্তির ছড়াছড়ি। শেহনাজ কোনো বাক্য উচ্চারন না করে নিজের কক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। তা দেখে মেহেভীন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–এত রাত পর্যন্ত তুমি কোথায় ছিলে শেহনাজ? আজকাল দেখছি রাত করে বাড়ি ফিরো। তোমাকে নিষেধ করার পরও কথা শুনো না কেন? তোমার ভাই জানলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে ভেবে দেখেছ কখনো?
–সব কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে! দু’দিন ধরে এসেই বাড়ির সবার ওপরে কর্তৃত্ব ফলাতে চাইছ। ভাই জানলে কি হবে আবার কিছুই হবে না। সে আমার সৎ ভাই নিজের ভাই না। সে জানলেই কি আর না জানলেই কি আমার কোনো যায় আসে না। আমাকে ধরার জন্য এভাবে প্রতিদিন চোরের মতো বসে থাকো। মানুষের সংসারে বউ আসে শান্তি নিয়ে আর আমাদের সংসার বউ এসেছে অশান্তি নিয়ে। যেদিন থেকে এসেছ সংসারের সুখ-শান্তি একদম কেঁড়ে নিয়েছ। যাও গিয়ে ভাইয়ের কাছে আমার নামে বি’ষ ঢালো।
–এভাবে কথা বলছ কেন শেহনাজ? তুমি আমার বোনের মতো। তোমার ভালো খারাপ দিক গুলো লক্ষ্য করা আমার দায়িত্ব।
–তুমি পরের মেয়ে পরের মেয়ের মতো থাকবে। একদম আমার জীবন নিয়ে তদারকি করতে আসবে না। তোমার সাহস হয় কি করে? একটা বাহিরের মেয়ে হয়ে আমার থেকে কৈফিয়ত চাওয়ার! শেহনাজের চিৎকারে মুনতাসিম, রিয়াদ চৌধুরী, সাহেলা চৌধুরী উঠে আসে। দু’জনকে তর্ক করতে দেখে সবাই স্থির হয়ে যায়। শেহনাজের শেষ বাক্যটা সহ্য করতে পারল না মুনতািসমের টগবগে মস্তিষ্ক। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,
–থাপ্পড় দিয়ে তোমাকে ভদ্রতা শিখিয়ে দিব বেয়াদব মেয়ে। সে তোমার বড় ভাবি হয়। তাকে সন্মান দিয়ে কথা বলবে। দীর্ঘ দিন যাবত তোমার অসভ্যতামি দেখছি। আমি তোমাকে বারবার সতর্ক করেছি। তুমি শুধরে যাওয়ার বদলে দিন দিন মাত্রা ছাড়া বিগড়ে যাচ্ছো। আমাকে রাগিও না মেয়ে। আমি রাগলে তোমাকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। এই যে তুমি প্রায় প্রায় মধ্যরাতে বাড়ি ফিরো। সেটা মেহেভীন দেখেও চুপ থাকে। সে চুপ থাকে কেন জানো? আমি তাকে বলেছিলাম। এই পরিবারের শান্তি রক্ষা করার দায়িত্ব তার। সে পরের মেয়ে হয়ে মেনে নিতে শিখে গেল। আর তুমি এই বাড়ির মেয়ে হয়ে কি করলে?
–আপনি শুধু নিজের বউয়ের হয়ে কথা বলেন ভাই। আপনার বউ সত্যি বলছে নাকি মিথ্যা বলছে সেটা কেন যাচাই করেন না? আপনার বউ মধ্য রাতে খাবার ঘরে এসে কি করে? আগে নিজের ঘরের বউকে সামলান। তারপর না হয় অন্যের মেয়েকে সামলাতে আসবেন। শেহনাজের বাক্য গুলো শেষ হবার আগেই শেহনাজের লাগে সজোরে থাপ্পড় বসলো মুনতাসিম। মুনতাসিমের রাগান্বিত মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে প্রতিবাদ করার সাহস পেল না শেহনাজ। সে অসহায় দৃষ্টিতে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। রিয়াদ চৌধুরীর সহ্য সীমা পার হয়ে গিয়েছে। জীবনে প্রথম ছেলের উপরে চেচিয়ে বললেন,
–আমার মেয়ের গায়ে হাত দেওয়ার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে? আমি তোমাকে বলেছি আমার মেয়েকে শাসন করো। নিজের বউয়ের প্রতি অন্ধ হয়ে গিয়েছ? আজকাল বোনের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করছ না। এই মেয়েটা যেদিন থেকে সংসারে এসেছে। সেদিন থেকে সংসারের সুখ-শান্তি বিলীন হতে শুরু করেছে। আজ যদি আমার কথা মতো রিনিকে বিয়ে করতে। তাহলে আজ আমাকে এই দিন দেখতে হতো না। সেদিন আমার বোনের সাথে খারাপ ব্যবহার করে তাকে বাড়ি ছাড়া করলে। এই মেয়ের জন্য আমাদের খু’ন করতেও দ্বিধাবোধ করবে না। আজকে এই মেয়ের একটা বিহিত করেই ছাড়ব। হয় এই মেয়েকে ডিভোর্স দিবে নয়তো আমাকে ত্যাগ করবে। রিয়াদ চৌধুরীর কথায় মেহেভীন যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। বাবার প্রতিটি বাক্য মুনতাসিমের বুকে ধারালো অস্ত্রের ন্যায় আঘাত করল। সে-ও দ্বিগুন উচ্চ স্বরে চেচিয়ে বলল,
–করলাম না আপনার মেয়েকে শাসন। আপনি কতটুকু জানেন আপনার মেয়ের সম্পর্কে? আপনার মেয়ের সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি শুনলে এতদিন বেঁচে থাকতে পারতেন না। এমন মেয়ের ভাই আমিও হতে চাই না। মুনতাসিম ফুয়াদ চৌধুরীর বোন হাতেও যোগ্যতা লাগে। সেই যোগ্যতা আপনার মেয়ের নেই। আর আমি কাকেই বোন বলছি। সে তো আমার জন্মদাত্রী জননীর সন্তান নয়। সে যদি আমায় খু’ন ও করে ফেলে আপনি আমাকে দেখতে আসবেন না। আপনার মতো বাবা আমারও চাই না৷ আপনি থাকুক আপনার মেয়েকে নিয়ে আমি ম’রে গেলে আমার লা’শে’র পাশেও যেন আপনাকে কেউ আসতে না দেয়। যদি দেয় আমি তাকে অভিশাপ দিয়ে যাব। ক্রোধে মুনতাসিমের সমস্ত কায়া থরথর করে কাঁপছে। সে ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। রিয়াদ চৌধুরী আগের ন্যায় বলল,
–তোমার মতো ছেলেরও আমার দরকার নেই। যে বউ পেয়ে পরিবারের মানুষকে আঘাত করতে দ্বিধাবোধ করে না। আজকের পর থেকে তুমি আমার সাথে কথা বলবে না। যে মেয়েটা তোমাকে অসম্মান করতে দ্বিধাদ্বন্দে ভূগে না৷ তোমাকে দুঃখ দিয়ো যার মন কাঁপে না। সেই মেয়েটা তোমাকে কতটা ভালোবাসে সেটা আমার ভালো করেই জানা আছে। এই মেয়েকে আমার আগে থেকেই পছন্দ ছিল না। তোমার পাগলামির জন্য এ বাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছিলাম। কে জানতো যে এই মেয়েটাই ভেতরে কালসাপ বের হবে!
–আমি আপনাকে অনেকটা সন্মান করি আব্বা। আপনি এমন কোনো বাক্য মুখশ্রী দিয়ে উচ্চারন করবেন না। যাতে আপনার প্রতি আমার সন্মান টুকু নষ্ট হয়ে যায়। আপনার সাথে কথা বললাম না। আমার কি হবে। এমনিতেই মা মারা যাবার পর থেকে কোনোদিন মন খুলে আমার সাথে আপনি কথা বলেননি। কথায় থাকেনা দুরত্ব বাড়লে গুরুত্ব কমে যায়। আমার মা যখন ছিল। তখন আমার গুরুত্বের অভাব ছিল না। মা চলে গিয়েছে সাথে নিয়ে গিয়েছে আমার ভালোবাসা, গুরুত্ব, হাসি, ভালো থাকা সবকিছু। যখনই একটু ভালো থাকা কুড়িয়ে নিয়ে আসলাম৷ তখনই সেটা কেঁড়ে নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন! আপনার মেয়ে ম’রে যাক আমার দেখার বিষয় নেই। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম বিলম্ব করল না। দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। মেহেভীন অপরাধীর ন্যায় সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে গেল। কারো ভালো চাইলে যে এতটা কষ্ট পেতে হয়। সেটা তো তার জানা ছিল না। যদি জানা থাকতো। তাহলে এমন জঘন্যতম অপরাধ কখনোই সে করত না।
চলবে…..
#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫৪
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
সুখ গুলোকে শুষে নিয়ে তিক্ততায় পরিপূর্ণ হয়েছে মন। এই যে লোকে বলে মেয়েদের নিজেস্ব কোনো বাড়ি হয় না। কিন্তু মেয়েদের ছাড়া কোনো বাড়িই সম্পূর্ণ হয় না। যে বাড়িতে নারী নেই। সেই বাড়িটা মরুভূমির মতোই মূল্যহীন। নারীই বাড়ির সৌন্দর্য। নারী ছাড়া বাড়ি তার সৌন্দর্য হারায়। সেই নারীকে কতই না তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়। নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেও সবার কাছে অবহেলিত হওয়ার নামই নারী। এই যে মেহেভীন নিজের বোনের মতো শেহনাজের ভালো চাইল। কিন্তু দোষটা তার হয়ে গেল! মুহুর্তের মধ্যে তার হৃদয়টা রক্তাক্ত করে দিল। বাবার বাড়িতে একটা কথা মাটিতে ফেলতে না দেওয়া মেয়েটাও আজ শশুর বাড়িতে এসে বিষাক্ত বাক্য গুলো চুপচাপ হজম করে, নিরব থাকে! মায়ের মুখে মুখে তর্ক করা মেয়েটা আজ কথা আঘাত ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। তবুও মুখশ্রী দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারন করে না। নিজের মেয়ের ভুল, ভুল। কিন্তু পরের মেয়ের ভুল অন্যায়! এই সমাজের নিয়ম এতটা জঘন্য কেন? পরের মেয়েকে যদি একাংশ নিজের মতো করে একাংশ ভালো দিত। তাহলে এই সমাজ থেকে অশান্তি নামক বাক্যটা বিলীন হয়ে যেত। মেহেভীন পাথর ন্যায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিয়াদ চৌধুরী রাগান্বিত হয়ে বলল,
–এবার তোমার শান্তি হয়েছে? এটাই তো চেয়েছিলে, তুমি! তোমাকে নিজের মেয়ের মতো করে রাখতে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু তুমি প্রমাণ করে দিলে সবাই মেয়ে হবার যোগ্যতা রাখে না। তুমি আমাদের অশান্তি ছাড়া কিছুই দিতে পারোনি। আমাদের আলার করে তোমার হৃদয় শীতল হয়নি। এখনো কিসের জন্য এখানে দাঁড়িয়ে আছ? রিয়াদ চৌধুরীর কথায় মেহেভীনের ভিষণ করে বলতে ইচ্ছে করল, “আপনি আমাকে মেয়ে ভাবলে শেহনাজের মতোই আমার বলা সত্যি কথাটা যাচাই না করেই গ্রহণ করে নিতেন। আপনি আমার দোষ গুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। আমার ভুল গুলো খুঁজে খুঁজে বের করে দিলেন। আপনি যেমন আজ শেহনাজের দোষটা আপনার ছায়া দিয়ে আড়াল করে দিলেন। আপনার জায়গায় আমার বাবা থাকলে-ও একই কাজ করত। কিন্তু বাড়ির বউদের যে বলতে মানা। নারী মেনে নিতে আর মানিয়ে নিতে পারলেই সেই নারীর জীবন সুন্দর। আপনি নিজের মেয়ের দোষটা দেখলেন না। আমার ভুলগুলো দেখিয়ে দিলেন। তাহলে আপনি আমার বাবা হলেন কোথায় আব্বা?” কিছু বাক্য ধারালো অস্ত্রের মতো হৃদয়ে আঘাত করতেই থাকে। তবুও তা প্রকাশ করার নিয়ম নেই। প্রকাশ করলেই যে হৃদয়টা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। মেহেভীনের বাক্য গুলো কণ্ঠনালিতে এসে বেঁধে গেল। সে নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করল।
দখিনা বাতাস এসে মুনতাসিমের সমস্ত কায়া আলিঙ্গন করে যাচ্ছে। বিষাদের ছোঁয়ায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে, মুনতাসিমের মন। ভেতরটা অদ্ভুত ভাবে যন্ত্রনা করছে। বাবার থেকে এমন অপ্রত্যাশিত আচরণ একদম আশা করেনি সে। বাবারা তো সংসার ভাঙার কথা বলে না। বাবারা তো সংসার টিকিয়ে রাখে। তাহলে আমার বাবা সংসার ভাঙার কথা কেন বলল? আমার ভেতরটা যে বাবার ছোট্ট কথায় রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে। সেটা কি বাবা দেখতে পেল না? যদি দেখতে পেত, তাহলে বাক্য গুলো কণ্ঠনালিতে আসার আগেই বাবার বুক কেঁপে উঠত। মেহেভীনের আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। সে নিঃশব্দে আস্তরণের এসে বসলো। বাক্য গুলো আজ শব্দ হারিয়েছে। অনুভূতিরা শূন্য হয়ে গিয়েছে। মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে পড়েছে। সমস্ত কায়া নিস্তেজ হতে শুরু করেছে। তখনই মুনতাসিম মেহেভীনের পাশে অবস্থান করল। মেহেভীন মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মানুষ টার মুশ্রীর দিকে দৃষ্টি পড়তে-ই মেহেভীনের ভেতরটা অদ্ভুত ভাবে শীতল হয়ে গেল। একবার নয়, দুই বার নয়, অসংখ্যবার এই চোখের মায়ায় পড়েছে মেহেভীন। কিন্তু আজ তার জন্য মুনতাসিম তার বাবার থেকে আলাদা হয়ে গেল। ভাবতেই ভেতরটা যন্ত্রনায় কাবু হয়ে আসছে। বুকটা হাহাকার করছে। সমস্ত কায়া অস্থিরতায় ছটফট করছে। মেহেভীন শান্ত কণ্ঠে বলল,
–আপনার বাবা সঠিক কথাই বলেছে। আমি আপনার যোগ্য না। আমি যেদিন থেকে আপনার জীবনে এসেছি। সেদিন থেকে আপনাকে আমি দুঃখ ছাড়া কিছুই দিতে পারিনি। আপনি আমায় ডিভোর্স দিয়ে দিন। আপনি বাবার পছন্দ মতো বিয়ে করে নিন। দেখবেন জীবনে সবশেষে সুখী মানুষটি হবেন আপনি। আমি জানতাম না আব্বা আমাকে এতটা অপছন্দ করে। মেহেভীনের প্রতিটি বাক্য আগুনে ঘি ঢালার জন্য যথেষ্ট ছিল। ডিভোর্স শব্দটা মুনতাসিমের ভেতরটা বিষাক্ত করে দিল। সে অন্য দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–আমার মতো মানুষ পেয়েও যে বিচ্ছেদ চাইল! সে জীবনে আরো ভালো কিছু পাক। আপনি আপনার মন মতো জীবন সঙ্গী খুঁজে নিয়েন। আমার মতো নিকৃষ্ট মানুষের সাথে আপনার যায় না।
–আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি আপনার ভালো জন্য… মেহেভীনের প্রতিটি বাক্য বিষাক্ত করে তুলেছে মুনতাসিমকে। আজ যেন তার ক্রোধ শিরায়-উপশিরায় চলাচল করছে৷ মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠছে। উত্তপ্ত মেজাজে দৃষ্টি অন্য দিকে রেখেই হাত দিয়ে মেহেভীনকে থামিয়ে দিল। অদ্ভুত ভাবে মুনতাসিমকে মেহেভীনের ভয় লাগছে! নিরবতার থেকে ভয়ংকর প্রতিশোধ ধরনীর বুকে দু’টো নেই। মেহেভীন মুনতাসিমের হাতে হাত ছুঁতে গেলে মুনতাসিম গর্জন করে উঠল।
–একদম আমাকে ছোঁবেন না। আমাকে ছোঁয়ার অধিকার আপনি হারিয়েছেন। খুব সহজে পেয়ে গেলে মানুষ মানুষের কাছে সস্তা হয়ে যায়। আমি আপনাকে বলেছিলাম ধরনীর বুকে মহাপ্রলয় আসলেও আমার ওপরে ভরসা রাইখেন। আমি সবকিছু ঠিক করে দিব। কিন্তু আপনি ধরণীর অশান্তিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আপনার জীবনে আমার মূল্য কোথায়? আপনি আমার ভালোবাসা দেখেছেন। কিন্তু আমার নিষ্ঠুরতা দেখেন নাই। আমি যে কতটা জঘন্যতম মানুষ সেটা আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন। আমি আপনাকে অনুরোধ করে বলেছিলাম। আমার প্রতি অভিযোগ থাকলে বলবেন। আমি পুষিয়ে নিব। কিন্তু কখনো বিচ্ছেদের কথা মুখশ্রীতে উচ্চারন করবেন না। আমি বিষাক্ত হয়ে গেলে, আপনি জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবেন৷ তবুও আপনার প্রতি আমার এতটুকু মায়া কাজ করবে না। ভালোবাসা শেষ পরিনতি বুঝি মানসিক মৃত্যুদন্ড হয়? তাহলে সেই মানসিক মৃত্যুদন্ড নিয়ে জীবন পার করে দিব। তবুও যার কাছে আমার থেকে অন্যের মূল্যায়ন বেশি সেই মানুষের মুখ আমি দেখব না। আমি আর আপনার মুখ দেখতে চাই না। আপনি আর কখনো আমার সামনে আসবেন না। আমি আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে দিব। শেষের বাক্যটা উচ্চারন করার সময় কণ্ঠনালি কাঁপছিল। যেখানে ছেড়ে দেওয়ার কথা উচ্চারন করতেই ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। সেখানে মানুষটাকে ছাড়া সে থাকবে কি ভাবে? ভাবনা গুলো আজ শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির তৈরি করে দিয়েছে। ভেতরটা কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এই যে অসহায় লাগার ব্যাপারটা বিধাতা ছাড়া বোঝার ক্ষমতা কারো নেই। চারদিকে এত মানুষ এত কোলাহল তবুও মুনতাসিমের নিজেকে ভিষণ একা লাগছে। তার পাশে বসে ভরসা দেওয়ার কেউ নেই। সে কেবল যন্ত্রনা সহ্য করার জন্যই জন্ম নিয়েছে! তার ভাগ্য এমন কেন? একদিন ভালো কাটলে এক যুগ কাটে আপন মানুষের দেওয়া আঘাতে! মুনতাসিমের মলিন মুখশ্রী মেহেভীনের মস্তিষ্ক সচল করে দিল। পারিবারিক অশান্তিটা খুব সিক্রেট একটা কষ্ট, না কাউকে বলা যায় আর না সহ্য করা যায়। প্রতিদিন এত এত অশান্তি হলে তো মাথা খারাপ হবেই। তার যেমন মুনতাসিম ছাড়া ভালোবাসার কেউ নেই। মুনতাসিমেরও তো সে ছাড়া ভালোবাসার কেউ নেই। সে যদি সবকিছু ঊর্ধ্বে গিয়ে মেহেভীনের পাশে থাকতে পারে। তাহলে সে কেন অল্পতেই ভেঙে পড়ে! সে তো আগে এমন ছিল না। বেশি ভালোবাসা পেলে মানুষ দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা হারায়। তবে কি মুনতাসিমের অপ্রত্যাশিত ভালোবাসা মেহেভীনের দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা শুষে নিল। মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে উঠে চলে যাচ্ছিল। ভেতরটা অসহনীয় যন্ত্রনায় ছটফট করছে। জীবনে প্রথম মেহেভীনের ওপরে রাগ করল মুনতাসিম। সেই রাগ কতটা ভয়ংকর রুপ নিতে পারে৷ তার আভাস মেহেভীন পাচ্ছে। ভেতরটা কেমন জানি কু গাইছে! অদ্ভুত এক অনুভূতি! মন বলছে মুনতাসিমকে যেতে দিলে মস্ত বড়ো ভুল হবে। মেহেভীন মুনতাসিমের সামনে গিয়ে পথরোধ করে দাঁড়াল। মুনতাসিম রক্তিম আঁখিযুগলে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের আঁখিযুগলে প্রেয়সীকে নিয়ে কত-শত রাগ আর অভিযোগ দেখতে পাচ্ছে মেহেভীন। যে আঁখিযুগল ভালোবাসায় পরিপূর্ণ থাকতো। কিছু সময়ের ব্যবধানে সেই আঁখিযুগল বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। মুনতাসিমের আঁখিযুগলে ভালোবাসা ছাড়া অন্য কেউ দেখতেই ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। মেহেভীন মুনতাসিমকে শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,
–আপনি আমাকে খু’ন করে ফেললেও বাহিরে যেতে দিব না। আমার ভিষণ ভয় করছে। বুকের মধ্যে অসহনীয় যন্ত্রনা করছে। আপনি একটু শান্ত হন। আমি আপনাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি।
–আমাকে ছাড়ুন বলছি। আজ আপনাকে আঘাত করার কথা দ্বিতীয় বার ভাববো না। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েন না৷ দরকার পড়লে আপনাকে খু’ন করেই কক্ষ ত্যাগ করব। মুনতাসিমের হুংকারে কেঁপে উঠল মেহেভীনের সর্বাঙ্গ। তবুও শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে মুনতাসিমকে। আজকে সে কিছুতেই মানুষ টাকে ছাড়বে না৷ মানুষটার যে রাগ বেশি। যাকে দেখলে মানুষটার রাগ বিলীন হয়ে যেত। আজ সেই মানুষটার ওপরেই মুনতাসিম রেগে গিয়েছে। সেই রাগের পরিনতি কতটা ভয়ংকর হতে পারে? ভাবতেই মেহেভীনের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। দু’জন ধস্তাধস্তি করতে করতে মেহেভীন কায়া নিস্তেজ হয়ে আসতে শুরু করল। তার হাতের বাঁধন আলগা হতে শুরু করেছে। সে মুনতাসিমের ক্রোধ নিবারণ করতে অনেকটা সক্ষম হয়েছে। কিন্তু কথায় থাকে না যার ভাগ্য সহায় হয় না তার থেকে দুঃখী আর কেউ নেই। দু’জনের চেচামেচিতে রিয়াদ চৌধুরী উপরে আসলো। তাকে দেখেই মেহেভীন দুরত্বে সরে আসে। রিয়াদ চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–এটা ভদ্র লোকের বাড়ি! রজনীর শেষ প্রহরে এসে এমন অসভ্যের মতো চিৎকার চেচামেচি করছ কেন? দু’দিন পরে বাড়ি না গোরুর গোয়াল হয়ে যাবে। এত বছরের সব নিয়ম কানুন কয়েক দিনেই মাটির সাথে মিশে গিয়েছে। এমন অসভ্যের মতো আচরণ করা বন্ধ করবে নাকি আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব। এতকিছু করে শান্তি হয়নি তোমাদের? এমন মানসিক ভাবে অত্যাচার করছ কেন তোমরা? রিয়াদ চৌধুরীর কথায় কোনো উত্তর করল না মুনতাসিম। দ্রুত কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। মেহেভীন মুনতাসিমকে স্পর্শ করার আগেই মুনতাসিম ধরা ছোঁয়ার বাহিরে চলে গেল। মেহেভীন দ্রুত কক্ষের বাহিরে যেতে চাইলে রিয়াদ চৌধুরী থামিয়ে দিয়ে বলল,
–তুমি কোথায় যাচ্ছো?
–উনি অনেক রেগে আছে আব্বা। উনাকে বাহিরে যেতে দিবেন না। আপনি অনুমতি দিলে উনাকে গিয়ে নিয়ে আসি?
–আমার ছেলের মস্তক খেয়ে শান্তি হচ্ছে না? এবার কি তার জীবন খাবে! তাকে একটু তার মতো থাকতে দাও। তার রাগ পড়লে একাই বাড়ি ফিরে আসবে। তার পেছনে যাওয়ার কোনো দরকার নেই।
–আপনি যতটা সহজ ভাবে বলছেন। ব্যাপারটা এতটা সহজ হলে এতটা যন্ত্রনা সহ্য করতাম না। যাকে দেখে মানুষটার রাগ শীতল হয়। তার ওপরে রাগলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হয়। সেটা আপনাকে কে বোঝাবে আব্বা? মানুষটা যে ভিষণ রাগী। রাগ হলে নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। মানুষটার কিছু হলে আমি একদম নিঃস্ব হয়ে যাব। মেহেভীনের কথা গুলো রিয়াদ চৌধুরীর কর্ণকুহরে পৌঁছাল কি না কে জানে? তিনি নিজের কথা শেষ করেই মেহেভীনের থেকে অনেকটা দুরত্বে চলে গিয়েছে। রিয়াদ চৌধুরীর সামনে থাকায় মুনতাসিমের কাছে যেতেও পারছে না। এটা নিয়েও যদি অশান্তি হয়। এই যে অসহায় লাগার মতো বাজে অনুভূতি দু’টো নেই। মেহেভীন তাইয়ানকে ফোন দিয়ে বলল সে যেন মুনতাসিমের সাথে যায়। তাইয়ান বাহিরেই ছিল। সে মেহেভীনের কথা মতো মুনতাসিমের গাড়িতে গিয়ে উঠে বসল। মুনতাসিমের রাগ হলে সে নিরিবিলি প্রাকৃতিক স্থানে গিয়ে বসে থাকতে স্বাচ্ছন্ন বোধ করে। তাই তাইয়ান স্বাভাবিক রাগ ভেবেই অন্য কাউকে ডেকে তুলল না। রজনীর আঁধারে কি আর কেউ ক্ষতি করার জন্য বসে থাকবে? তাইয়ান কি জানে না। বাহিরের লোক বসে না থাকলে-ও ঘরের লোক বসে ঠিকই থাকে। মুনতািসমের কোনো দিকে হুস নেই। এই অশান্তি নামক শব্দটা জীবনটাকে একদম মূল্যহীন করে তুলেছে। সে গাড়িতে উঠেই চলে গেল। সেই দৃশ্যটা ছাদের কার্নিশ থেকে কেউ একজন দেখে তৃপ্তির হাসি হাসল। মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে আনন্দ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
–মুনতাসিম তাইয়ানকে নিয়ে একা বেড়িয়ে গিয়েছে। মুনতাসিমের সাথে আজ কোনো গার্ড যাইনি। এটাই সুযোগ এই সুযোগটা যদি লুফে নিতে না পারো। তাহলে জীবনে মুনতাসিমকে ধংস করতে পারবে না। মুনতাসিম আজকে ভিষণ রেগে আছে। ও রেগে থাকলে নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তুমি দ্রুত জাফর ইকবালকে খবরটা পৌঁছে দাও। আমরা নিজে আর কিছুই করব না। তুমি বাহিরে বের হয়ো না। তাহলে মুনতাসিম কিন্তু আবার তোমাকে ধরে ফেলবে।
রজনীর মধ্য প্রহর হওয়াতে পথে তেমন গাড়ি নেই। কেউ গভীর নিদ্রায় ব্যস্ত কেউ বা রাত জেগে নিজের লক্ষ্য পূর্ণ করতে ব্যস্ত। এত ব্যস্ততার মধ্যে একটি অশান্ত হৃদয় গন্তব্যহীন ভাবে ছুটে চলেছে। মুনতাসিমকে এমন বেখেয়ালি ভাবে কোনোদিন গাড়ি চালাতে দেখেনি তাইয়ান। মুনতাসিম খুব দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছে। যেন এ শহর ছেড়ে পালাতে পারলেই সে বাঁচে। তাইয়ানের ভেতরটা ভয়ে কাঁপছে। সে ভীত কণ্ঠে বলল,
–স্যার গাড়ি আস্তে চালান। যেকোনো সময় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
–আমি তোমাকে আমার সাথে আসতে বলিনি। তবুও তুমি কেন এসেছ? আর যখন এসেছ তখন ভয় কেন পাচ্ছ? আমি ম’রে গেলে আমার সাথে তুমিও ম’রেও যাবে। আমি বেঁচে থাকলে তুমিও বেঁচে থাকবে। তুমি কি মরতে ভয় পাচ্ছ তাইয়ান?
–আপনার জন্য আমি সর্বদা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে প্রস্তুত। তাইয়ানের কথায় মুনতাসিম শীতল দৃষ্টিতে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করল। তাইয়ান নির্ভয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাইয়ানের আঁখিযুগলে মুনতাসিমের জন্য কত ভালোবাসা! এই ভালোবাসার ক্ষতি মুনতাসিম জেনে-বুঝে করবে? সেটা কখনোই না। তাইয়ানের সামনে নিজেকে স্বাভাবিক করতে হবে।
জাফর ইকবাল গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিলেন। মুনতাসিমের খবরটা কর্ণকুহরে আসতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। সে দ্রুত নিজেদের লোকদের হুলস্থুল করে ডেকে তুলল। মুনতাসিম যে এরিয়ার মধ্যে আছে। সেই এরিয়ার মধ্যে দ্রুত তিনটা ট্রাকের ব্যবস্থা করতে বলল। প্রতিটি সেকেন্ড যেন ঘন্টার সমান হয়ে গিয়েছে। জাফর ইকবালের সমস্ত কায়া থরথর করে কাঁপছে। পনেরো মিনিট হয়ে গেল। তবুও এখনো সবকিছু রেডি করতে পারল না! জাফর ইকবালের সবকিছু চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে ইচ্ছে করছে। কক্ষের সব আসবাবপত্র তচনচ করে দিতে শুরু করেছে। তখনই মুঠোফোনটা বার্তা নিয়ে আসলো। মুনতাসিম মাঝ পথে গাড়িয়ে থামিয়েছে। এই সুযোগে তারা কায়দা কৌশল সঠিক ভাবে প্রস্তুত করে ফেলল। জাফর ইকবালের হৃদয়টা আজ শীতলতা অনুভব করছে। মুখশ্রীতে তার তৃপ্তির হাসি।
–গাড়ি দাঁড় করালেন কেন স্যার?
–বুঝতে পারছি না তাইয়ান। একটু বাহিরে গিয়ে দেখবে কি সমস্যা হয়েছে? তাইয়ান একটু অবাক হলো মুনতাসিম এতটা স্বাভাবিক হয়ে গেল কি করে? সে অদ্ভুত চাহনিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে বলল,
–তোমাকে যেতে হবে না থাক আমি যাচ্ছি। মুনতাসিমের কথায় তাইয়ান দ্রুত গাড়ি থেকে নামল। তাইয়ান গাড়ি থেকে নামতেই মুনতাসিম গাড়ি টান দিয়ে সামনের দিকে ছুটে চললো। তাইয়ান নিজেই নিজের ললাটে প্রহার করল। সে কেন মুনতািসমের ফাঁদে পা দিল? তাইয়ান দৌড়াতে শুরু করল। সে গার্ডদের কল করে দিয়েছে। তারা যেন গাড়ি নিয়ে দ্রুত উপস্থিত হয়। তারা অর্ধেক পথ চলে এসেছে। কিন্তু এখন সে মুনতাসিকে কিভাবে ধরবে? তাইয়ান আবার দৌড়াতে শুরু করে দিল। মুনতাসিম গাড়ির স্প্রিড সর্বোচ্চ বাড়িয়ে দিল। তাইয়ান যেন তাকে ধরতে না পারে। কিছুদূর যেতেই মুনতাসিমের দৃষ্টিতে তিনটা ট্রাকের দেখা মিললো। ট্রাকগুলো দ্রুত গতিতে তার দিকে ধেয়ে আসছে। মুনতাসিমের ভ্রুযুগল কুঁচকে গেল। তারা ভুল পথ দিয়ে গাড়ি নিয়ে আসছে। মুনতাসিম গাড়ি পেছাবে তার কোনো সুযোগ নেই। তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাবে এমন অবশিষ্ট জায়গা নেই। মুনতাসিমের বিচক্ষণ মস্তিস্ক যা বোঝার বুঝে ফেলছে। সে এটা ভেবে শান্তি পেয়েছে। যে তাইয়ানকে সে নিরাপদে রেখে আসতে পেরেছে। মুনতাসিম নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করার আগেই ট্রাক গুলো মুনতাসিমের গাড়িটা গুঁড়িয়ে দিল। কালো পিচ ঢালাই করা রাস্তাটা রক্তে ভেসে যেতে শুরু করল। মাটি খুব যত্ন সহকারে মুনতাসিমের দেহ থেকে বেড়িয়ে আসা রক্ত গুলো শুষে নিচ্ছে। রাস্তায় রক্তের ছাড়াছাড়ি দেখে তাইয়ানের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। পাশেই মুনতাসিমের রক্তাক্ত নিথর দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। শুভ্র পাঞ্জাবিটি রক্তে ভিজে নতুন রুপ নিয়েছে। তাইয়ানের সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসছে। আশেপাশেই দু-একজন মানুষ আসতে শুরু করেছে। মুনতাসিমের কোনো জ্ঞান নেই। দুই গাড়ির সংঘর্ষ হবার পর সাথে সাথেই কি সে জ্ঞান হারিয়েছে? মুনতাসিমের এমন ভয়ংকর অবস্থা দেখে তাইয়ানের ভেতর হাহাকার করে বলে উঠল, “মানুষটা বেঁচে আছে তো?”
চলবে…..