#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪৯
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি কোণায় নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে। পরিবেশ জুড়ে পিনপতন নিরবতা। মুনতাসিমের শীতল চাওনি প্রলয়ের ভেতরে ঝড় তুলে দিয়েছে। সমস্ত মন মস্তিষ্ক ভয়ে কাবু হয়ে আসছে। মানুষটা তার সাথে কোনো কড়া বাক্যে কথা বলেনি। তবুও সে ভয় পাচ্ছে ভিষণ ভয়। বাক্য গুলো কণ্ঠ নালিতে এসে আঁটকে যাচ্ছে। প্রলয়ের ভেতরে দারুন জড়তা কাজ করছে। মুনতাসিমের গম্ভীর আঁখিযুগল প্রলয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের শীতল দৃষ্টি প্রলয়ের ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলছে। যাকে দেখলে অন্যরা ভয় পায়। আজ সে কাউকে দেখে ভয় পাচ্ছে! ভয় তো পাবারই কথা একজন মন্ত্রীকে তো আর বলা যায় না। স্যার আপনার বউয়ের সাথে অন্য একটা পুরুষ একান্তে কথা বলতে চায়। আপনি কথা বলার অনুমতি দিন। বিরক্তিতে মুনতাসিমের সমস্ত মুখশ্রী কুঁচকে এল। মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে বলল,
–আপনার সময়ের মূল্য না থাকতে পারে প্রলয়। কিন্তু আমার সময়ের মূল্য আছে। আপনি দশ মিনিট ধরে এখানে চুপচাপ বসে আছেন। আপনাকে দেখার জন্য নিশ্চয়ই আমাকে বসিয়ে রাখেন নি। আপনার যা কথা বলার আছে। আপনি কোনো জড়তা ছাড়াই বলতে পারেন। মুনতাসিমের বাক্যগুলো কর্ণকুহরে আসতেই প্রলয় এলোমেলো হয়ে গেল। মস্তিষ্ক শূন্য হতে শুরু করল। বুদ্ধিরা কাজ না করার পণ করেছে। প্রলয় কোথায় থেকে শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না। সে গাঢ় শ্বাস ছেড়ে বলল,
–সাতদিন ধরে আপনার বাসায় আসছি। আপনার দেখা না পেয়ে আমাকে বারবার ঘুরে যেতে হচ্ছে। আমি একটা অনুমতি চাইতে আপনার কাছে এসেছি। আমি জানি আবদারটা আমার জন্য কতটা ভয়ংকর। তবুও আমি নিরুপায় স্যার। আপনি আমাকে সাহায্য করুন।
–আমি জানি আপনি আমার অর্ধাঙ্গিনীর সাথে জারিফকে শেষ বারের মতো কথা বলিয়ে দিতে চাইছেন। আমি ইচ্ছে করেই সাতদিন আপনার সাথে দেখা করিনি। আপনি নিশ্চই চাইবেন না। আপনার অর্ধাঙ্গিনীকে পরপুরুষের কাছে কথা বলতে পাঠাতে। এমন কোনো কথা বলবেন না। যেটা আমি রাখতে পারব না। আপনার সততাকে আমি সন্মান করি। আশা রাখছি। আপনি আমার সন্মানের মূল্য দিবেন। মুনতাসিমের কথায় প্রলয়ের মুখশ্রীতে অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। তবে কি জারিফকে দেওয়া কথা রাখতে পারবে না সে? জারিফ যে তার অস্তিত্ব বিলীন করে দিবে ধরনীর বুকে থেকে। প্রলয় কাতর কণ্ঠে বলল,
–জারিফকে কথা দিয়েছিলাম। লা’শ দু’টোর সন্ধান দিলে তাকে মেহেভীনের সাথে কথা বলিয়ে দিব। সে তার কথা রেখেছে। আমি তাকে দেওয়া কথা রাখতে পারিনি বলে, সে আমার অর্ধাঙ্গিনী আর সন্তানকে আঁটকে রেখেছে। আপনি যদি সদয় না হোন। তাহলে আমার জন্য আমার প্রিয় মানুষ গুলো ধরনী থেকে বিলীন হয়ে যাবে। আমি যে জীবিত লা’শ হয়ে যাব স্যার। আমাকে একটু দয়া করুন।
–আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার অর্ধাঙ্গিনী আর সন্তানকে পেয়ে যাবেন। তাদের আপনার হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। আপনি এবার আসতে পারেন। আমাকে বের হতে হবে। আর পরের বার মেহেভীন নয় ম্যাডাম বলে ডাকবেন। মনে থাকে যেন। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম নিজের কক্ষে চলে গেল। প্রলয় আহত হৃদয় নিয়ে চৌধুরী বাড়ির বাহিরে আসলো। জারিফ আগ্রহ নিয়ে প্রলয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। প্রলয়ের মলিন মুখশ্রী দেখে জারিফের যা বোঝার বুঝে গেল। সে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে চৌধুরী বাড়ির দিকে দৌড় দিল। প্রলয় সহ আরো চারজন পুলিশ জারিফের পেছনে দৌড়ে দিল। একজন গার্ড জারিফকে গুলি করল। সেটা জারিফের কায়া স্পর্শ না করেই অন্য দিকে চলে গেল। প্রলয় গার্ডদের গুলি করতে নিষেধ করল। জারিফকে তারা ধরবে। গার্ডরা শুনলো না। সবাই মিলে জারিফকে ধরার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলো। জারিফ দৌড়ে মুনতাসিম এবং মেহেভীনের থেকে দশ হাত দুরত্বে এসে স্থির হয়ে গেল। সে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। হাতে তার হ্যান্ডকাফ লাগানো। সমস্ত কায়া শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। আঁখিযুগলের নিচে কালো দাগ পড়েছে। রমণীদের আর্কষণ করা সুদর্শন পুরুষটা আজ তার সৌন্দর্য হারিয়েছে। জারিফকে দেখেই মেহেভীন শক্ত হাতে মুনতাসিমের হাত আঁকড়ে ধরল। গার্ডরা এসে জারিফকে টানতে চাইলে এক চুল নড়াডে পারছে না। জারিফ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
–আমি দশটা মিনিট মেহেভীনের সাথে কথা বলব স্যার। আমার মৃত্যুর আগে শেষ চাওয়া আপনার কাছে। আপনি তো সারাটাজীবন আমার শখের মানুষটার সাথে কাটাবেন। সেখানে থেকে আমাকে দশটা মিনিট সময় দেওয়া যায় না স্যার? আমি আপনার পায়ে পড়ি। আমাকে আপনি এখানেই রক্তাক্ত করে দিন। আজ যদি মেহেভীনের সাথে কথা বলতে না পারি। তবে আমাকে এক চুল পরিমাণ সরাতে পারবেন না। আমাকে খু’ন করুন না হলে মেহেভীনের সাথে কয়টা কথা বলতে দিন। মেহেভীন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মেহেভীনের মুখশ্রীতে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। মুনতাসিম আঁখিযুগল দিয়ে মেহেভীনকে ভরসা দিল। মেহেভীনের হৃৎপিণ্ডের গতিবেগ তড়িৎ গতিতে ছুটে চলেছে। গার্ডরা জারিফকে টানাটানি করতে লাগলে মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–ছাড়ো ওকে। এখন সাতটা দশ বাজে সাতটা বিশে তোমার সময় শেষ। যা বলার আমার সামনেই বলতে হবে। বাড়াবাড়ি করার চেষ্টা করলে দেহ থেকে মাথা আলাদা করে দিব। মুনতাসিমের অনুমতি পেয়ে জারিফের হৃদয় শীতল হয়ে গেল। আঁখিযুগলে অশ্রু এসে ভরে গেল। অদ্ভুত ভাবে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। জারিফের দৃষ্টিতে প্রিয় মানুষকে দেখার জন্য কত দিনের তৃষ্ণা জমে আছে। এত দিনের জমিয়ে রাখা তৃষ্ণা আজ সব উসুল করে নিচ্ছে। পিপাসিত হৃদয়টা আজ প্রেয়সীকে দেখে শীতল হয়ে গেল। তিন মিনিট সে মেহেভীনকে মন ভরে দেখে নিয়েছে। বাকি সাত মিনিটে কথা গুলো বলে শেষ করতে হবে। জারিফ আহত দৃষ্টিতে মেহেভীনকে পর্যবেক্ষণ করে নিল। প্রিয় মানুষটাকে অন্যের পাশে দেখে বুকটা ভারি হয়ে আসছে। ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে। মনটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। জীবনে মৃত্যু আসুক তবু্ও প্রিয় মানুষকে অন্যের পাশে দেখার মতো পরিস্থিতি কারো না আসুক। জারিফ কাতর কণ্ঠে বলল,
–আমার মনের রাণী কি সুন্দর একটা ভরসার হাত পেয়েছে। ধরনীর বুকে কত-শত পুরুষ আছে। কিন্তু আমার মহারাণী কাউকে ভয় পায় না। শুধু আমাকে ভয় পায় । আর পাবেই না কেন? মানুষ তো মানুষকে ভয় পায় না। ভয় পায় মানুষরুপী জা’নো’য়া’র’কে আমি তো মানুষ না। আমি একটা মানুষ রুপী জা’নো’য়া’র। কতটা ভাগ্য নিয়ে জন্মালে আমার শখের মানুষটাকে অন্য কেউ না চাইতেই পেয়ে যায়। আর আমি এত চেয়েও পাইলাম না। আমার মুনতাসিমকে ভিষণ করে ঈর্ষা হয় জানিস। আমি কেন মুনতাসিম হতে পারলাম না বল তো? পরপারে যদি আমাদের দেখা হয়। তাহলে আল্লাহকে বলব। আল্লাহ যেন আমাকে মুনতাসিম বানিয়ে দেয়। আজ আমার জায়গায় মুনতাসিম আছে। সেদিন মুনতাসিমের জায়গায় আমি থাকব। আমাকে কেন ভালোবাসলি না মেহেভীন? আমার মধ্যে কিসের কমতি ছিল? এতটা ভালোবাসা দিয়েও আমি কেন তোকে পেলাম না? আমাকে এরা ফাঁসি দিচ্ছে না কেন বল তো? আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। আমার মতো নষ্ট পুরুষের সাথে তোর যায় না। মুনতাসিমের মতো অসাধারণ পুরুষের পাশেই তোকে মানায়। তোকে না পাওয়ার আক্ষেপ আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থেকে যাবে। জারিফের কথায় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মেহেভীন। প্রতিটি মানুষের জীবনে যেমন খারাপ কিছু মুহূর্তে থাকে। ঠিক তেমনই ভালো মুহূর্তও থাকে। আজ মেহেভীনের ভালো মুহূর্তের কথা স্মরন হলো। সে কঠিন বাক্যে বলল,
–তুই আমাকে ভালোবেসে ছিলি এটা ঠিক। কিন্তু তোর ভালোবাসার কৌশল সঠিক ছিল না। ভালোবাসা পেলে শত্রুরাও গলে যায়। যেখানে আমি একজন মানুষ মাত্র তা-ও তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলি। ভালোবাসার মতো ভালোবাসলে তোকে ভালোবাসতে বাধ্য ছিলাম আমি। কিন্তু তুই সবকিছু নিজের মন মতো চেয়েছিস। তোর যা লাগবে তুই পেলেই হবে। অন্য কারো যে মন আছে। তার-ও যে মতামত আছে। সেটা তুই ভাবসি নি। তুই আমাকে কলঙ্কিত করতে চেয়েছিলি। আমার সাথে পৈশাচিক আরচণ করেছিস। জোর করে চাহিদা মেটানো যায়। কিন্তু ভালোবাসা পাওয়া যায় না। তুই সব সময় নিজের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিয়েছিস। তোর ভাষায় যেটা ভালোবাসা। আমার ভাষায় সেটা শরীরের কামনা। যদিই ভালোই বাসতি। তাহলে আমাকে অসুস্থ করে দিতি না। সেদিনের কথা স্মরন হলে আজও আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেঁপে ওঠে। আজ-ও আমি তোকে ভয় পাই। ভালোবাসায় তো ভয় থাকে না। ভালোবাসায় থাকে শুধু বিশ্বাস আর ভরসা। যেটা তোর মধ্যে আমি কোনোদিন পাইনি। আর কি বললি মুনতাসিম আমাকে না চাইতেই পেয়ে গেছে। মুনতাসিম একটাই এক পিস। সে আমাকে পাবার জন্য যা কিছু করেছে। তা তোর মানসিকতায়ও আসেনি। তোকে তোর কামনা মিটাতে দেইনি বলে তুই আমাকে প্রহর করতে দু’বার ভাবিসনি। আর মুনতাসিম আমাকে প্রহার করবে না বলে সে নিজেই নিজেকে প্রহার করে। আমি তোর হতে চাইনি বলে তুই আমায় সন্মান নষ্ট করতে চেয়েছিস। আর আমি মুনতাসিমের হতে চাইনি বলে, সে আমায় ভালোবাসতে বাধ্য করেছে। আমি তাকে কশ-শত অসম্মান, অবহেলা, দুঃখ দেওয়ার পরও মানুষটা শুধু আমায় চেয়েছে। মুনতাসিম এমন একটা মানুষ যাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না। এখানেই তোর আর মুনতািসমের পার্থক্য। মুনতাসিম সব সময় আমার চাওয়া পাওয়ার মূল্য দিয়েছে। আমাকে গুরুত্ব দিয়েছে। আমার স্বামী আমার কাছে সুপার হিরো। আমার চোখে দেখা শ্রেষ্ঠ পুরুষটি হচ্ছে আমার স্বামী। আমার স্বামীর সাথে নিজের তুলনা দিয়ে আমার স্বামীকে অসম্মান করিস না। তোর মতো অমানুষের সাথে আমার স্বামীর মতো অসাধারণ মানুষের তুলনা দিলে-ও পাপ হবে। পরিশেষে একটা কথাই বলব। আমি তোকে ঘৃণা করি। মনের গভীর থেকে ভিষণ ভাবে ঘৃণা করি। তোর মুখশ্রী দেখে আমার সমস্ত কায়া ঘৃণায় রি রি করে ওঠে। আমার জন্য দু’টো খু’ন করলেই তোর পাপ সব ছাপ হয়ে যাবে না। আমি তোমার স্বামীকে ভিষণ রকমের ভালোবাসি। আমি আমার স্বামীকে নিয়ে সুখ আছি। আর কখনো আমার স্বামীর সাথে নিজের তুলনা দিয়ে নিজেকে নিচু মন মানসিকতার পরিচয় দিস না। আমি আর তোর সাথে কথা বলতে চাইছি না। তুই আমার সামনে থেকে চলে যা। তোর মতো বড়লোক ঘরের ছেলেদের আমার চেনা আছে। বাবার টাকা দিয়ে দু’দিন পর ঠিকই জেল থেকে বের হয়ে আসবি। মেহেভীনের কথায় জারিফ মলিন হাসল। হাসিটা যে কারো হৃদয় কাঁপিয়ে তুলবে। কিন্তু হৃদয় কাঁপল না মেহেভীনের। সে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরে নিল। মুনতাসিম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল আর এক মিনিট সময় আছে। জারিফের ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। শেষ বারের মতো মেহেভীনকে আলিঙ্গন করতে ইচ্ছে করল। পূর্ণতার জীবনে সবকিছু পূর্ণতা পায় না। কিন্তু অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হয়। জারিফ নিজ থেকেই সামনের দিকে এগোতে লাগলো। আঁখিযুগল বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। আঁখিযুগল অসম্ভব ভাবে লাল হয়ে গিয়েছে। অধরের কোণে মলিনতার হাসি। সমস্ত কায়া দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। শেষ বারের মতো মেহেভীনকে এক নজর দেখে নিল। পুরুষ মানুষের আঁখিযুগলে অশ্রু বড্ড বেমানান। এতদিন তেজে হুংকার করা মানুষটা হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল। চরণ দু’টি যেন আর এগোচ্ছে না। প্রলয় গভীর ভাবে জারিফকে পর্যন্ত করল। মনের অজান্তেই জারিফের জন্য বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠল। জারিফ বাহিরে এসে চিৎকার করে বলল,
–আমার সবকিছু মিথ্যা ছিল মেহেভীন। কিন্তু আমি যে তোকে ভালোবাসি। তোর প্রতি আমার ভালোবাসাটা এতটুকুও মিথ্যা ছিল না। আমার সব মিথ্যার মধ্যে আমি যে তোকে ভালোবাসি, এই কথাটা মৃত্যুর মতো সত্য ছিল। তোকে না পাওয়ার আক্ষেপ আমাকে প্রতিটি মুহুর্তে পোড়াবে। তুই দেখে নিস। জারিফ আর তোর পিছু নিবে না। এই অমানুষটা ম’রে গেলে লা’শটা দেখতে আসিস না। আমার মৃত মুখটা তোর দুঃখ বাড়িয়ে দিবে। বেঁচে থাকতে যত দুঃখ দিয়েছি। সেগুলো পুষিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তবে তোর পিছু ছেড়ে শান্তিতে থাকতে দেওয়ার পথ আমার জানা আছে। তুই ভালো থাকিস। আমাদের আর দেখা হবে না। পৃথিবীকে জানিয়ে গেলাম। তোমরা প্রেমে পড়ো না প্রেম মানুষকে বাঁচতে দেয় না। যদি প্রেম তোমার কাছে চলে আসে। তবে প্রিয় মানুষটাকে নিজের করে নিও। নিজের শখের মানুষটাকে অন্যের পাশে দেখার মতো ভয়ংকর যন্ত্রনা পৃথিবীতে দুটো নেই। মৃত্যু আসুক তবুও প্রেম না আসুক। কথা গুলো বলেই জারিফ গাড়িতে গিয়ে উঠে বসল।
প্রাপ্তির মা চৌধুরী বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে ছিল। মেহেভীন আর মুনতাসিম ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই প্রাপ্তি মা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–তুমি কেমন মেয়ে রে মেহেভীন? তোর মাকে পুলিশ ধরে গিয়েছে আর তুই নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছিস! এই তোর মায়ের প্রতি ভালোবাসা! তোর মতো স্বার্থপর মেয়ে আমি দু’টো দেখিনি। যেই মন্ত্রীর বউ হয়েছিস। ওমনি মায়ের কথা ভুলে গিয়েছিস!
–আপনি কি সংসারে অশান্তি লাগানোর জন্য এসেছেন চাচি? আমি প্রতিদিন মায়ের সাথে কথা বলি। কাল রাতেও বলেছি। এসব মিথ্যা কথা আমার কাছে বলে লাভ নেই।
–তোকে মিথ্যা কথা বলে আমার লাভ আছে। তোর স্বামীও জানে তোর মাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে। সে কি তোরে বলে নাই। আরো নতুন নতুন খবর শুনলাম। তোর মা নাকি তোর বাপকে খু’ন করেছে। মুনতাসিম নাকি তোর মাকে সাহায্য করেছে। তুই একজন খু’নি’র সাথে সংসার করেছিস মেহেভীন? মেহেভীনে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। সে মায়া ভরা দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে তাকালো। মুনতাসিম অপরাধীর ন্যায় মস্তক নুইয়ে নিল। মেহেভীন শান্ত কণ্ঠে বলল,
–চাচি যা বলছে সব সত্যি কথা বলছে মুনতাসিম? মেহেভীন সহজে মুনতাসিমের নাম ধরে ডাকে না। আর যখন ডাকে তখন মুনতাসিমের হৃদয় কাঁপিয়ে তুলে। মুনতাসিম অনুভূতি শূন্য হয়ে গেল। উপস্থিত বুদ্ধি আজ কাজ করছে না। মুনতাসিম কেন জানি মিথ্যা কথা বলতে পারে না। তবে আজ সত্য মিথ্যার সংমিশ্রণ সে করবে। সে মেহেভীনের দিকে না তাকিয়েই বলল,
–সব সত্যি। আমি আপনার বাবাকে খু’ন করেছি। আপনার মা আমাকে বাঁচানোর জন্য নিজে পুলিশের কাছে ধরা দিয়েছে। আপনি আপনার মাকে বোঝান। সে যেন ফিরে আসে। আপনি আপনার মাকে ভুল বুঝবেন না। আপনার যা শাস্তি দেওয়ার আমাকে দিন। বাক্য গুলো কর্ণকুহরে আসতেই মেহেভীনের সমস্ত কায়া নিস্তেজ হয়ে গেল। মনটা বিশ্বাস করতে চাইছে না। তবুও মস্তিস্ক অচল হয়ে পড়তে শুরু করেছে। মেহেভীন আহত দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। সামনে ভয়ংকর রকমের কিছুর আভাস পাচ্ছে মেহেভীন। তবে কি সে ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি হতে চলেছে। ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত ভাবে শ্বাস আঁটকে আসছে তার। মেহেভীন দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে গেল। মুনতাসিম শত ডেকে ও মেহভীনের থেকে সাড়া পেল না। তবে কি দুঃখ এসে সুখে ভাঙ্গন ধরে গেল!
চলবে…..
#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫০
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বেড়েছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বুদ্ধিরা আজ শূন্য হয়ে গিয়েছে। বুকের ভেতরটা অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করছে। আঁখিযুগলে অশ্রুকণা এসে জমা হয়েছে। মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রীতে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। রাইমা বেগম মেয়েকে দেখে প্রশান্তির হাসি হাসলেন। তার মুখশ্রীতে নেই কোনো ভয়! আতঙ্ক মেহেভীনকে স্পর্শ করতে পারলেও রাইমা বেগমকে স্পর্শ করতে পারেনি৷ মেহেভীনের মন, মস্তিষ্ক চিন্তায় অকেজো হয়ে গিয়েছে। রাইমা বেগম জেলের অন্ধ কুঠুরি থেকে মেয়ে দিকে এগিয়ে আসলেন। মেহেভীনের মুখশ্রীতে হাজারটা প্রশ্নের উত্তর শোনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। রাইমা বেগম শীতল কণ্ঠে বলল,
–কেমন আছিস মা?
–তুমি এখানে কিভাবে আসলে আম্মু? তোমার সাথে আমার রোজ কথা হয়। তুমি কেন আমাকে জানাওনি? যে তোমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে এসেছে! আমি আজকেই তোমার জামিনের ব্যবস্থা করছি। তারা কিসের ভিত্তিতে তোমাকে এখানে নিয়ে আসলো? তুমি তাদের বাঁধা প্রয়োগ করলে না কেন? মুনতাসিম কি সব বাজে কথা বলছে। চাচি এসে তোমার নামে বাজে কথা বলে যাচ্ছে। এবার কিন্তু তার স্বামীর সাথে তাকে-ও জেলে ভরে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিব আম্মু।
–মুনতাসিম তোকে কি বলেছে?
–সে বলেছে সে নাকি আমার বাবাকে খু’ন করেছে। আবার চাচি বলছে তুমি নাকি বাবাকে খু’ন করেছ।
–মুনতাসিম তোকে মিথ্যা বলেছে। আর তোর চাচি তোকে সত্যি কথা বলেছে। আমি-ই তোর বাবাকে খু’ন করেছি। আমি অনেক আগেই ধরা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মুনতাসিমের জন্য পারিনি। ছেলেটা তোকে বড্ড বেশি ভালোবাসে। তোকে হারানোর ভয়ে প্রতিটি মুহুর্তে তার হৃদয় কাঁপে। আমার জন্য ছেলেটাকে ভুল বুঝিস না মা। মুনতাসিমের মতো জীবনসঙ্গী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার এমন ভাগ্য সবার থাকে না। তুই ভাগ্য করে পেয়েছিস। হৃদয়ের গুপ্ত কুঠুরিতে আগলে রাখিস। রাইমা বেগমের বাক্য গুলো শেষ হতেই মুনতাসিম এসে উপস্থিত হয়। মুনতাসিমকে দেখেও রাইমা বেগমের মুখশ্রীতে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল। মুনতাসিম কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হতেই রাইমা বেগম বললেন,
–আজ তুমি কিছুই বলবে না মুনতাসিম। আজ আমি বলব। তোমরা শুনবে।
–আমার দোষ কেন শুধু শুধু নিজের কাঁধে নিচ্ছেন আন্টি?
–তুমি মিথ্যা বলায় ভিষণ কাঁচা মুনতাসিম। মিথ্যা কথা বলতে গিয়ে তোমার কণ্ঠনালি কাঁপছে। আমাকে তো অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখলে আর কতদিন বাঁচাবে? একজন খু’নিকে একদিন না একদিন মরতেই হবে। শুধু শুধু আমাকে বাঁচিয়ে রেখে কি লাভ? তুমি যে যন্ত্রনাটা মেহেভীনের থেকে আড়াল করতে চাইছ। সেটা মেহেভীন নিজ থেকে জানতে পারলে দ্বিগুন কষ্ট পাবে। তার থেকে ভালো আমি বলে দিয়ে কষ্টটা কমিয়ে দেই। সত্যটা যত তাড়াতাড়ি মেহেভীন মেনে নিতে পারবে। তত তাড়াতাড়ি মেহেভীনের জন্য মঙ্গল। তুমি আমাকে আন্টি না ডেকে মা ডাকবে। আন্টি ডাকে ভালোবাসা খুঁজে পাই না।
–আপনি মা হয়ে ছেলের কথা রাখলেন না কেন মা? আমাকে আর একটু সময় দিলে আপনার খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত? মুনতাসিমের মুখশ্রীতে মা ডাকটা খুব মধুর শোনালো রাইমা বেগমের কাছে। সে বুক ভারি করা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
–আমি তোর বাবাকে খু’ন করেছি। তাকে ছয় টুকরো করে ছয় জেলায় লুকিয়ে রেখেছিলাম। আমি অনেক আগেই আত্নসমর্পণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মুনতাসিমের জন্য পারিনি। তখন তোর সদ্য চাকরি চলে গিয়েছে। তোর বাবার তোর ছোট্ট হৃদয়টা রক্তাক্ত করে দিয়েছিল৷ তুই যখন আমাকে বললি তোর চাকরিটা আর নেই। তখন আমি ভিষণ ভয় পেয়েছিলাম। তুই বাড়ি আসলে আবার সবকিছু বুঝে না ফেলিস। তোর বাবার মৃত্যুর খবরটা তোকে একদম ভেতর থেকে শেষ করে দিয়েছিল মেহেভীন। তুই ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতি না। চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষে নিজেকে বন্দী করে ফেলছিলি৷ তোর মুখের হাসিটা যেন কোথায় বিলীন হয়ে গেল। তোর চেহারার দিকে তাকানো যেত না। দিন দিন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিলি। মা হয়ে মেয়ের এমন করুন অবস্থা কিভাবে সহ্য করতাম বল? তাই নিজের যন্ত্রনাকে মাটি চাপা দিয়ে তোকে সুখী দেখতে চেয়েছি। মুনতাসিমের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। আমি মুনতাসিমকে বলেছিলাম তিন মাস আমি তোমাকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য সময় দিলাম। কিন্তু বিশ্বাস কর প্রতিটি সেকেন্ড আমি শতবার করে মরে যাই। যে মানুষটাকে ঘৃণা করতে করতে তার পবিত্র ভালোবাসায় জড়িয়ে গিয়েছি। যার মায়ায় আমি নিজেকে হারিয়েছি। তাকে হারিয়ে আমি কিভাবে বাঁচব বল? বলতে পারিস বুড়ো বয়সে এসে মা এসব কি কথা বলছে! ভালোবাসায় কোনো বয়স মানে না। মানে না কোনো জাত। ভালোবাসার মতো ভালোবাসলে আশি বছরেও ভালোবাসার গভীরতা ব্যাখ্যা করা যায়। তোর বাবাকে আমি প্রথমে প্রচুর ঘৃণা করতাম। সে আমার সাথে ছলনা করে আমাকে বিয়ে করেছে। আমি মন থেকে ভালোবাসতাম মাহতাবকে। মাহতাব অনেক ভালো মনের মানুষ ছিল জানিস মেহেভীন। এই তো দুপুরেও আমরা দু’জন মিলে যুক্তি পরামর্শ করেছি। রজনীর মধ্য প্রহরে দু’জন পালিয়ে যাব। আমাদের প্রণয়নের সম্পর্কটা বাড়ি থেকে মেনে নিচ্ছিল না। তোর বাবা আর মাহতাব দু’জন বেস্ট ছিল। ওদের বন্ধুত্ব দেখে লোকে হিংসা করত। ওদের একটা বাজে স্বভাব ছিল। ওরা দু’জন জু’য়া খেলতো। তাদের কাছে জুয়ার নেশা একদিকে ধরনীর মানুষ আরেক দিকে। যেদিন রাতে আমাদের পালানোর কথা ছিল। সেদিন রাতে তোর বাবা আর মাহতাব জুয়া খেলে। তোর বাবা মাহতাবকে শর্ত দিয়েছিল। যে মাহতাব হারলে ফরিদ যা বলবে মাহতাব তাই মেনে নিবে। ফরিদের শর্তে মাহতাব রাজি হয়ে যায়। এই সুযোগ টাই ফরিদ লুফে নেয়। ফরিদ আমাকে মনে মনে ভালোবাসত। কিন্তু প্রাণ প্রিয় বন্ধুর প্রেয়সীকে তো আর সরাসরি চেয়ে নাওয়া যায় না। তাই সে অসৎ পথ অবলম্বন করে। সেদিন ফরিদ আমার বাড়ি এসেছিল। সে আমাকে বলল তাকে মাহতাব পাঠিয়েছে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে। আমি তৈরি হবার জন্য প্রস্তুত হতেই পেছনে থেকে ফরিদ আমার মুখ চেপে ধরল। তারপরে আমার আর কিছুই মনে ছিল না। পরের দিন সকালে লোকজনের কোলাহলে আমার নিদ্রা ভাঙে। তোকে একটা মেয়ের গল্পটা শুনিয়ে ছিলাম না মেহেভীন। সেই মেয়েটাই আমি। বিয়ের পরে আমি মাহতাবের কাছে গিয়েছিলাম। সে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আমাকে বলে আমি যদি ফরিদকে ডিভোর্স দিয়ে তার কাছে আসি। তাহলে এই সমাজ আমাদের সুখে সংসার করতে দিবে না। একটা মেয়ের জীবনে বিয়ে কতবার হয়? একবার যখন বিয়েটা হয়ে গিয়েছে। তখন তুমি ফরিদের সামনে মানিয়ে নাও। সেদিন আমি মাহতাবের পা পর্যন্ত ধরেছি। তবুও সে আমায় গ্রহন করেনি। আমার ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। আমি প্রতিটি মুহূর্ত মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করেছি। কতবার যে আ’ত্ন’হ’ত্যা করার চেষ্টা করেছি। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমার অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই তোর বাবা আমাকে ভালোবাসার চাদরে মোড়ানোর চেষ্টা করল। একজনকে মনে রেখে আরেকজনের সাথে সংসার করা এতটাই সহজ বল! আমি কতটা যতটা সহজ ভাবে বলছি। কিন্তু আমার পরিস্থিতি এতটা সহজ ছিল না। আমি প্রতিটা মুহূর্ত পুড়েছি। তোর বাবাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না। আমি খুব করে চাইতাম তোর বাবাকে মেনে নিতে। কিন্তু আমার মন তোর বাবাকে গ্রহণ করত না। সবাই আমাকে পরামর্শ দিল। আমি যেন একটা বাচ্চা নেই। তাহলে তোর বাবার প্রতি ভালোবাসাটা আমার মনে আসবে। এরপর তুই হলি তবুও আমার মনে তার জন্য কোনো মায়া কাজ করে না। তোকেও আমার বিরক্ত লাগত। তোর বাবা রাত জেগে তোকে দেখাশোনা করত। দিনে আমাকে রান্না করে খাওয়াত। আমি বাড়ির কাজ করতাম না। তোর বাবার এত কেয়ার এত ভালোবাসা দেখে মনের অন্তরালে তার জন্য সুপ্ত অনুভূতি কাজ করতে লাগলো। তাকে আমি শর্ত দিলাম আমার সাথে থাকতে হলে জুয়া খেলতে পারবে না। সন্ধ্যার পরে বাড়ির বাহিরে থাকতে পারবে না। মানুষটাকে আমার আর দ্বিতীয়বার এসব কথা বলতে হয়নি। আমার এক কথায় ফরিদ সবকিছু ছেড়ে দিল। আমি ভালো থাকব কিসে সারাক্ষণ এটা নিয়ে চিন্তা করত। আমি কষ্ট পাব এমন কাজ থেকে বিরত থাকত। আমি অসুস্থ থাকলে রাত জেগে আমার সেবা করত। সে আমাকে এমন ভাবে ভালোবেসেছে তাকে আমি খু’ন করে ফেললেও মুখশ্রী দিয়ে একটা শব্দ বের করত না। এমন মানুষের মায়ায় না বেঁধে আমি যেতাম কই? আমাকে ভালোবাসতে হয়নি ভালোবাসা গুলো ফরিদকে ভালোবেসেছে। ফরিদকে মেনে নিতে আমার কয়েকটি বসন্ত কে’টে গিয়েছে। আমার পরে গিয়ে মনে হয়েছিল। আমি ফরিদকে ভালো না বেসে মাহতাবকে কেন ভালোবেসে ছিলাম? আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা ফরিদেরই হওয়া উচিৎ ছিল। আমার মৃত্যুর পরে যদি বলা হয়। আমি কাকে চাই? তাহলে আমি তোর বাবাকে চাইব। তোর বাবা আমাকে অনেকটা যত্ন আর অনেকটা ভালোবাসা দিয়েছে। সেই ভালোবাসা ছেড়ে আমি কেন যে আমায় গ্রহণ করেনি। তাকে চাইব! মাহতাব ভালো মানুষ ছিল। কিন্তু ভালোবাসার মানুষ হিসেবে সে শূন্য। কিন্তু তোর বাবা মানুষ হিসেবে একটু খারাপ ছিল। কিন্তু ভালোবাসার মানুষ হিসেবে সে ছিল পরিপূর্ণ। তোর বাবার ভালোবাসা এতটা ছিল যে নিজেকে কোনো রাজ্যের রাণী ছাড়া অন্য কিছু মনে হত না। নিজের বউকে সেই রাণীর মতো করে রাখে। যার মনটা রাজার মতো। পরপারে যদি তোর বাবার সাথে আমার দেখা হয়। তবে আল্লাহকে বলব শুদ্ধ আর পবিত্র হয়ে যেন আমাদের দেখা হয়। তোর বাবা ভালোই ছিল। শেষ বয়সে এসে হঠাৎ করে কি যে হয়ে গেল। মানুষের নজরে আমি খুব একটা বিশ্বাস করতাম না। তবে আজ গভীর ভাবে বিশ্বাস করি। ভালো জিনিসে মানুষের নজর লাগে। তাই ভালো জিনিস গুলো লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে হয়। তোর বাবা তোকে আমার সামনে কটু বাক্য শোনাল। তবুও আমি তোর বাবাকে কিছু বলিনি। সে মাহতাবকে সন্দেহ করল। তবুও আমি তাকে কিছু বলিনি। সে আরিয়ানের বাবার সাথে জুয়া গেলে হেরে গেল। সে তোকে নিয়ে বাজি ধরেছিল। ফরিদ হারলে তোকে আরিয়ানের সাথে বিয়ে দিতে হবে। তোর সাথে মাহতাবের যোগাযোগ আছে। সেটা আমি জানতাম না। তবে তোর বাবা কিভাবে জানি খবর পায়। আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে মাহতাবকে খু’ন করে বসে। এতকিছুর পরে-ও আমি তোর বাবাকে ক্ষমা করেছি জানিস। কারন আমি মানুষটাকে অত্যন্ত ভালোবেসে ফেলছি। নিজের ভালোবাসার মানুষ যতই বড় অন্যায় করুক না কেন, সেটা তার ভালোবাসার মানুষের কাছে অন্যায় মনে হবে না। আমিও চেয়েছি তোর বাবা বাঁচুক। কিন্তু তোর বাবা দিন দিন অমানুষ হয়ে উঠছিল। জুয়ার নেশা তোর বাবাকে ধংস করে দিয়েছিল। সে ভালোমন্দ বিচার করা ভুল গিয়েছিল। ধীরে ধীরে সে মাদকদ্রব্য সেবন করা শুরু করে দেয়। আমাকে বাজি ধরে একদিন রাতে জুয়া খেলেছিল। ফরিদ হেরে গেলে একজন পর পুরুষ এক রাত আমার সাথে থাকবে। এমন শর্ত দেয় বিপরীত পক্ষের মানুষটা। তোর বাবাও রাজি হয়ে যায়। তোর বাবা সেদিন হেরে যায়। রজনীর মধ্য প্রহরে তোর বাবা একটা শ্যাম পুরুষকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে। আমি ভেবেছিলাম। তোর বাবার কোনো বন্ধু হবে হয়তো। পরে যখন কথা গুলো শুনলাম। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল। আমার সব ধৈর্যর বাঁধ ভেঙে মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠেছিল। সেদিন আমি নিজের নিয়ন্ত্রণ ছিলাম না। তোর বাবার সাথে আসা মানুষটা তার কুৎসিত চাহনি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছিল। ভয়ে আমার সমস্ত কায়া অবশ হয়ে গিয়েছিল। উপস্থিত বুদ্ধি কাজ করছিল না৷ হঠাৎ করে মনে পড়ে তোর বাবা তোকে অজ্ঞান করে আরিয়ানের সাথে বিয়ে দাওয়ার জন্য ঔষধ এনে রাখছিল। আমি সেটার ব্যবহার করি। তার জন্য আমাকে অনেক কাট কয়লা পোড়াতে হয়। আমাদের এলাকায় একটা পুকুর আছে না। সেখানে খুব একটা মানুষ আসে না। আমি সেখানে দু’জনকে নিয়ে যাই। রজনীর মধ্য প্রহর চলায় মানুষ খুব কম ছিল। রাতের আঁধারের সুযোগ নিয়ে দু’জনকেই ছয় পিস করি। জীবনে দ্বিতীয় বার তৃতীয় খু’ন করে প্রচুর শান্তি পেয়েছিলাম। আমার ইন্দ্রিয় খুব সজাগ ছিল। আমি অনুভব করলাম আমাকে খু’ন করতে কেউ দেখে ফেলছে। আমি টুকরো গুলো বস্তায় পুরে পানিতে ডুবিয়ে রেখেছিলাম। কচুরি পানা দিয়ে সেগুলো খুব সাবধানে আড়াল করে রাখি। পরে সময় সুযোগ পেলে সরিয়ে ফেলব। বাড়ি ফিরে সমস্ত মন মস্তিষ্ক শীতল হতে শুরু করল। বুঝলাম রাগে বশীভূত হয়ে কি করে ফেলেছি। রাগ মানুষকে ধংস করে দেয়। যখন বুঝলাম তখন অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। পরবর্তীতে মনে হয়েছে। যা হয়ে ভালো হয়েছে। যে সম্পর্কে সন্দেহ আর বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে যায়। সেই সম্পর্ক কোনোদিন আগের মতো জোড়া লাগে না। তোর বাবা আজ একজনকে আমার বিছানায় পাঠাতে চেয়েছে। কাল দশজনকে পাঠাতে চাইবে। যে পাপে জর্জরিত হয়ে গিয়েছে। তাকে কিভাবে ঠিক করতাম বল? আমার কথার অবাধ্য না মানুষটা আমার কথার অবাধ্য হয়েছে। আমার সাথে উচ্চস্বরে কথা না বলা মানুষটা কথায় কথায় আমাকে ধমকেছে। আমার ভাগ কাউকে দিবে না বলে ছলনা করে আমাকে বিয়ে করল। সেই মানুষটা পর পুরুষকে আমার বিছানাতে পাঠাতে চাইল। এটা তো আমি মেনে নিব না। একটা নারীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে তার সন্মান। যে নারীর সন্মানে আঘাত করার চেষ্টা করবে। তার মৃত্যু অনিবার্য। যে স্বামী তার স্ত্রীর সন্মান নষ্ট করতে চায়। আমি মনে করি তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই। কথা গুলো একদমে বলে থামলো রাইমা বেগম। শীতল চাহনিতে মেহেভীনের দিকে চেয়ে আছে। কথা গুলো বলার সময় রাইমা বেগমের কণ্ঠনালি কাঁপেনি। আঁখিযুগলে এসে অশ্রুকণা জমা হয়নি। কিন্তু তার ভেতরটা যে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। সেটা কি মেহেভীন দেখতে পেয়েছে। মেহেভীন অদ্ভুত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবেশ শীতল হয়ে উঠল। চারিদিকে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। এই মুহূর্তের নিস্তব্ধতা প্রতিটি মানুষের হৃদয় কাঁপিয়ে তুলছে।
চলবে…..
#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৫১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
সুখের শক্ত আবরণকে দুঃখের দমকা হাওয়া এসে মুহুর্তের মধ্যে সুখ গুলোকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে গেল। ধরনীর বুক জুড়ে হাহাকার নেমে গিয়েছে। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। অশ্রুকণা গুলো যেন আজ অভিমান জমিয়েছে। সেজন্য বোধহয় আঁখিযুগলে এসে ভিড় জমাচ্ছে না। মনের আনাচেকানাচে দুঃখরা রাজত্ব করছে। মেহেভীন বাসায় আসার পর থেকেই পাথরের ন্যায় বসে আছে। মুখশ্রী দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারন করছে না। প্রেয়সীর রক্তিম আঁখিযুগলের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই মুনতাসিমের বক্ষথলে মোচড় দিয়ে উঠল।
–এভাবে নিজেকে কষ্ট কেন দিচ্ছেন? আপনার রাগ হলে আমাকে ঘৃণা করুন। আমাকে কথার আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিন। তবুও আপনি নিরব হয়ে যাইয়েন না। নিরবতা যে ভিষণ ভয়ংকর! প্রতিশোধের নেওয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে নিরবতা। আমি আপনাকে ভালো রাখার লোভী ভিষণ লোভী হয়ে উঠেছিলাম। আমি আঘাত পেলে আপনার যেমন ব্যথা লাগে। ঠিক তেমনই আপনার ব্যথা হলে আমি তার থেকে দ্বিগুন পুড়ি। আপনার মলিন মুখশ্রী দেখে আমি ভেতর থেকে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি। সেটা কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন না! আমি থাকতেও আপনি এভাবে পুড়বেন? আর সেটা বসে বসে আমাকে দেখতে হবে! আমাকে আপনি শাস্তি দিন। তবুও নিজেকে শেষ করে দিয়েন না। মুনতাসিমের প্রতিটি বাক্য মেহেভীনের হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল। মুখশ্রীতে ঢাকা শক্ত আবরণটা খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু কষ্ট গুলো যেন আজ ভেতর থেকে বের হতে চাইছে না। মেহেভীন মলিন কণ্ঠে বলল,
–ভালো থাকা আর ভালোবাসা দু’টোই আমার জন্য অভিশপ্ত। জীবনে কঠিন এক সময় পার করছি। তবে এখন যে সময় পার করছি। সেটা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। যে জীবন আমার প্রতি এতটা নিষ্ঠুর হবে। মাঝে মাঝে আমার ভাগ্যটাকে নিয়ে ভিষণ আফসোস হয়। আমার জীবন টা তো এমন হওয়ার কথা ছিল না! আমার জীবনটা আর একটু সুন্দর হলে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত?
–আপনি যতটুকু ভেবেছেন। তার থেকে দ্বিগুন সুন্দর জীবন আপনাকে উপহার দিব। কথা দিলাম।
–সেই সুন্দর জীবনে যদি আমার বাবা-মা-ই না থাকে, তাহলে সেই জীবন নিয়ে আমি কি করব? মেহেভীনের কথায় মুনতাসিম নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মনের অজান্তেই বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। জীবনের কঠিন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে মেহেভীন। যাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা এখনো তৈরি হয়নি। তবে পাশে থেকে ভরসা দেওয়ার ক্ষমতা তার আছে। সেই ভরসা টুকু দিয়ে না হয় মেহেভীনকে আগলে নিবে। মুনতাসিমকে নিরব দেখে মেহেভীন নিজেই বলল,
–মাসের ফাঁ’সি কবে?
–উনি সব তথ্য আগেই পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছে। পুলিশ তদন্ত করে সব সঠিক প্রমাণ পেয়েছে। কোর্ট থেকে রায় হলেই উনার ফাঁ’সি হয়ে যাবে। মেহেভীনের ভেতরটা কেঁপে উঠল। অদ্ভুত ভাবে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। খুব শান্ত ভাবে বলল,
–একজন খুনির মেয়ের সাথে সংসার করবেন! আপনার সমস্যা হবে না? সবকিছু জানাজানি হয়ে গেলে, আপনার ওপরে অনেক চাপ আসবে।
–নিজের জিনিসকে কিভাবে আগলে রাখতে হয়। সেটা মুনতাসিমের ভালো ভাবে জানা আছে। মুনতাসিমকে কিছু বলতে হলে দশবার ভাবতে হয়। আমি মায়ের এতবড় সত্য সবার কাছে আড়াল করে গিয়েছি। শুধু মাত্র আপনাকে হারানোর ভয়ে। আপনার সুখ নষ্ট হবে ভেবে দিনের পর দিন মিথ্যা না বলা মানুষটাও মিথ্যা বলেছে। আর আপনি বলছেন আপনার সাথে থাকতে আমার সমস্যা হবে!
–আমার মা এমন করতে পারে না। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমাকে আপনি বলুন না এটা সত্যি নয়। আমি স্বপ্ন দেখছি। আমার নিদ্রা ভাঙলেই সবকিছু মিথ্যা হয়ে যায়। আমার না ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি মাকে ছাড়া কিভাবে থাকব? ভেতরটা আমার দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। আমার মা আমার কথা কেন ভাবল না! যাকে দেখলে আমার মনের জোড় বেড়ে যায়। সেই জোড়ই যদি শেষ হয়ে যায়। তাহলে আমি কিভাবে সোজা থাকব? আমি যে ভেঙেচুরে একদম গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাব।
–সমস্ত পৃথিবীর সামনে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকি। পাথরের মতো শক্ত হতে গিয়ে হৃদয়ের খুব কাছে এসেও ভেঙে যাই খুব সংগোপনে। কাউকে বোঝানো যায় না। আমাদের ম্যাচিউরিটির শক্ত আবরণের ভেতরে আসলে কতটা কাঁদা মাটি থাকে! সেটা প্রকাশ করলে আপনাকে অচিরেই বিলীন হতে হবে। আর প্রকাশ না করে ধৈর্য ধরলে মনের জোর এনে রাজ্য চালানোর ক্ষমতা আপনার হবে। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ করেই মেয়েটা একদম চুপ হয়ে গেল। মেয়েটার চুপ থাকাটা যে অপর প্রান্তের মানুষটাকে কঠিন ভাবে পোড়াচ্ছে। সেটা কি মেয়েটা দেখতে পাচ্ছে না! হৃদয় পোড়া যন্ত্রনা গুলো এমন হয় কেন? ভেতরটা পুড়ছে অথচ কেউ দেখতে পাচ্ছে না। যে পুড়ছে সে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ে জ্বলে ওঠা আগুনটা যদি কেউ দেখতে পেত, তাহলে নিশ্চয়ই আগুন নেভানোর চেষ্টা করত। হৃদয়ের যন্ত্রনা শীতল করার ঔষধ নেই বলেই, শরীরের আঘাতের যন্ত্রণার চেয়ে হৃদয় পোড়ার যন্ত্রনা অনেক বেশি!
দুঃখ আছে বলে জীবন সুন্দর। দুঃখ না থাকলে আমরা আক্ষেপ করতাম কি নিয়ে? এই যে আমরা সুখে থাকলেও বিষাদ অনুভব করি। দুঃখ আছে বলেই সুখের এত মূল্য। নয়তো সুখ গুলোও কিছু মানুষের ন্যায় গুরুত্বহীন ভাবে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত! দুঃখীনির দুঃখ ঘুচবে কি করে? দুঃখ যে বেড়ে যাওবার সময় এসে গিয়েছে! সেটা কি দুঃখীনি অনুভব করতে পেরেছে? সেজনই বোধহয় দুঃখীনি ভেতরটা পুড়তে পুড়তে কয়লা হয়ে আবার জ্বলে উঠছে। মেহেভীনের মাকে আজ ফাঁ’সি দেওয়া হবে। জেলের অন্ধকার কুঠুরি থেকে রাইমা বেগমকে বাহিরে নিয়ে আসা হলো। এই কয়দিনে চেহারায় মলিনতা এসে গিয়েছে। আঁখিযুগলের নিচে কালো দাগ পড়ে গিয়েছে। সমস্ত মুখশ্রী বলে দিচ্ছে মানুষটা ভালো নেই। প্রতিটি মুহুর্ত মানুষটা যন্ত্রনায় ছটফট করছে। মেহেভীনকে দেখে রাইমা বেগম মলিন হাসলেন। মেয়ের মস্তকে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
–মাকে ক্ষমা করে দিস। তোর মা তোর সুখটা কেঁড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। মুনতাসিমের ওপরে ভরসা করে চলে যাচ্ছি। আমি তোকে যতটা দুঃখ দিয়েছি। তার থেকে দ্বিগুন সুখ সে তোকে উপহার দিবে। আমার মেয়েকে কষ্ট দিলে তার হিসাব কিন্তু আমি নিব। মা তোকে ভিষণ ভালোবাসে মেহেভীন। এই অভাগী মাকে ভুল বুঝিস না। আমাকে ক্ষমা করে দিস। তোর বাবা ভুল পথে না গেলে আজ আমরা সবাই বেঁচে থাকতাম। আমাদের একটা সুন্দর সংসার হতো। সেখানে সুখ শান্তি দিয়ে পরিপূর্ণ থাকতো। বিধাতা হয়তো আমাদের জীবনটা এভাবেই সাজিয়েছিলেন। তাই আমাদের জীবনের সমাপ্তি এভাবেই হলো। আমার জীবনের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। তবে মুনতাসিম তোকে আঘাত করলে আমার অভিযোগ তৈরি হবে। মৃত্যুর পরবর্তী জীবন কেমন হবে জানি না। যে পাপ করেছি। সেই পাপের শাস্তি পেতে শুরু করলে দুনিয়াদারী ভুলে যাব। তোকে একটা কথাই বলব। মায়ের জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করিস। আমার কবর টা যেন তোর বাবার পাশেই দাফন করা হয়। এটা আমার শেষ ইচ্ছে বলতে পারিস। আমাকে যেতে হবে মা। নিজের খেয়াল রাখিস। মুনতাসিমকে কখনো দুঃখ দিস না। স্বামীর মন মতো হয়ে চলিস। মায়ের কথায় নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না মেহেভীন। শক্ত আলিঙ্গনে মাকে বুকের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলল। কান্নার শব্দে চারিদিক মুখরিত হয়ে গেল। মেহেভীনের হৃদয় ভাঙা চিৎকার দেখে মুনতাসিমের ভেতরটা উথাল-পাতাল শুরু করে দিল। মেহেভীন কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
–আমায় ছেড়ে যেও না মা। আমি তোমায় ছাড়া কিভাবে বাঁচব। আমি কথা না শুনলে কে আমাকে বকবে? তোমাকে ছাড়া আমি নিঃস্ব হয়ে যাব মা। আমার প্রতি এতটা নিষ্ঠুর তুমি হয়ো না। তুমি এতটা পাষাণ কিভাবে হয়ে গেলে? আমার মা তো এমন ছিল না! আমার আঁখিযুগলে অশ্রু আসার আগেই যার হৃদয় কোমল হয়ে যায়। আজ আমার হৃদয় ভাঙা চিৎকারে তার মন কেন নরম হচ্ছে না? আমার এই আর্তনাদ কি তোমার রুহু কাঁপাচ্ছে না মা। আমাকে এভাবে এতিম বানিয়ে দিও না। এতিমদের যে বড্ড জ্বালা। এত জ্বালা আমি কিভাবে সহ্য করব? তুমি আমাকে বি’ষ দিয়ে মে’রে দাও মা। আমি এত যন্ত্রনা কিভাবে সহ্য করব। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আল্লাহ আমার আর কত ধৈর্যের পরীক্ষা নিবে? তুমি আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও। আমি আর বাঁচতে চাই না। যে পৃথিবীতে আমার বাবা-মা থাকবে না। সেই পৃথিবীতে আমিও থাকতে চাই না। মেহেভীনের আর্তনাদের প্রতিটি মানুষের আঁখিযুগলে অশ্রুকণা এসে জমা হয়েছে। রাইমা বেগমও আজ শক্ত খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসলো। মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মেয়ের মুখশ্রীতে শত-শত আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে। পৃথিবীতে সবকিছু কেনা গেলেও সময় কেনা যায় না। সময় দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে। মেহেভীন মাকে শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরে আছে। মাকে ছেড়ে দিলেই যে মা হারিয়ে যাবে। এত ভালোবাসা বুঝি এভাবে হারাতে দেওয়া যায়। মেহেভীনকে দু’জন মহিলা পুলিশ সরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আজ মেহেভীনের শক্তি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গিয়েছে। দু’জন ব্যর্থ হয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। একজন পুলিশ অনুরোধ করে বলল, তাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সে যেন মেহেভীনকে দূরে সরিয়ে নেয়। মুনতাসিম মেহেভীনের এক হাতে টেনে বলল,
–মা কে ছেড়ে দিন। ওদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। মুনতাসিমের কথায় রাইমা বেগম তাল দিয়ে বলল,
–আমাকে ছেড়ে দে মা। আমাকে যেতে হবে। মেয়ে হয়ে যদি মায়ের দুঃখ না বুঝিস৷ তাহলে আমি কোথায় যাব বল?
–ও মা আমার কাছে থেকে যাও না। আমার নিজের জীবনের বিনিময়ে তোমাকে সুখে রাখব। তোমার এত কিসের জেদ? আমার ভালো চাও না তুমি! তুমি কি আমার নিজের মা না। তুমি এতটা স্বার্থপরের মতো কাজ কিভাবে করতে পারলে! আমি তোমার পায়ের নিচে পড়ে থাকব। আমাকে এভাবে দুঃখী করে দিও না। আমার ভেতরটা যে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছ না কেন তুমি? আমাকে একটু ভালো থাকা ভিক্ষা দাও মা। আমারও ভালো থাকার অধিকার আছে। মেহেভীনের হৃদয় ভাঙা চিৎকার রাইমা বেগমের বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। রাইমা বেগম মুনতাসিমকে ইশারা করতেই মুনতাসিম মেহেভীনকে নিজের কাছে টেনে নিল। মেহেভীন এক হাতে মায়ের হাত ধরে আছে। ভয়ে মেহেভীনের সমস্ত কায়া থরথর করে কাঁপছে। আঁখিযুগল ভয়ংকর ভাবে রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। মেহেভীন মায়ের হাতটা শক্ত ভাবে ধরে আছে। দু’জন মহিলা পুলিশ রাইমা বেগমকে টান দিতেই দু-হাত আলগা হয়ে গেল। মেহেভীনের সামনে দিয়ে রাইমা বেগমকে গাড়িতে তোলা হলো। মেহেভীন দৌড়ে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। মুনতাসিম মেহেভীনকে উলটো দিকে ঘুরিয়ে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল। মেহেভীন পাগলের ন্যায় ছটফট করছে। মেহেভীনের করুন অবস্থা মুনতাসিমকে ভেতর থেকে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। মেহেভীন ক্ষিপ্ত হয়ে মুনতাসিমের ওপরে চেচামেচি করতে শুরু করে দিল। আশেপাশে ভিড় জমে গেল। জীবনে প্রথম মুনতাসিম মেহেভীনকে এতটা চিৎকার করতে দেখল। মেহেভীনের সমস্ত কায়া নিস্তেজ হয়ে আসতে শুরু করল। কণ্ঠনালি দিয়ে শব্দ আসা বন্ধ হয়ে গেল। কায়ার সমস্ত ভর মুনতাসিমের উপরে ছেড়ে দিল মেহেভীন। মুনতাসিম তাকিয়ে দেখল জ্ঞান হারিয়েছে মেহেভীন। বুকটা ভারি হয়ে আসছে মুনতাসিমের। দুঃখের পাহাড় এতটা ভারি হয়ে গেলে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কষ্টকর। মুনতাসিম মেহেভীনকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়ির দিকে অগ্রসর হলো। পথের প্রতিটি মানুষ একজন দুঃখীর হৃদয় ভাঙা চিৎকার দেখল। প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রনা যে কতটা যার হারায় সেই তো অনুভব করতে পারে! সুখের ভাগ নেওয়ার মানুষ অভাব নেই। তবে দুঃখ ভাগের সময় এত অভাব হয় কেন? সুখ যেমন মানুষকে ভালো রাখে, ঠিক তেমনই দুঃখ জীবনকে পরিপূর্ণ করে। সে পরিপূর্ণতা গ্রহণ করতে এত কিসের অনিহা!
চলবে…..