খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮

0
421

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪৬
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

চারিদিকে সুখানুভূতিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। সুখ যেন তার অনুভূতির রাজত্বে শাসন কার্য শুরু করে দিয়েছে। মনের শহরের অলিতে-গলিতে আনন্দ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। এত সুখ, এত আনন্দ সইবে তো! আজকে মুনতাসিমকে জনসভায় যেতে হবে। মুনতাসমি তৈরি হয়ে গিয়েছে। মেহেভীন মুনতাসিমের শুভ্র পাঞ্জাবীর ওপরে পড়া কটির বোতাম গুলো যত্ন সহকারে লাগিয়ে দিচ্ছে। মুনতাসিম মুগ্ধ নয়নে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীন বোতাম লাগানো শেষ করে মুনতাসিমের কেশ গুলো ঠিক করে দিতে দিতে বলল,

–মেয়ে ভক্তদের থেকে দশ হাত দুরত্ব বজায় রেখে চলবেন। যদি কোনো মেয়ের গা ঘেঁষে ছবি তুলতে দেখেছি। পরের দিন প্রভাত বেলা ব্রেকিং নিউজ হবে। মন্ত্রী মুনতাসিম ফুয়াদকে কে’টে পিস পিস করে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার ভাবতেই আনন্দ লাগছে। আপনার কেমন লাগছে মন্ত্রী সাহেব? মেহেভীনের কথায় মুনতাসিম সহজ সরল মুখভঙ্গি করে ফেলল। আঁখিযুগলে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট! সে শুকনো ঢোক গিলে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আপনি আমাকে হু’ম’কি দিচ্ছেন?

–না আপনার ঘরে যে একটা বউ আছে। সেটা মনে করিয়ে দিলাম। আমি কি ছুরিতে ধার দিয়ে রাখব মন্ত্রী সাহেব? বলা তো যায় না কখন কোন কাজে গেলে যায়।

–হ্যাঁ দিয়ে রাখুন বলা তো যায় না। ওটা দিয়ে আমি আপনার গ’লা’ও কাটতে পারি। আমার যে বউ আছে৷ সেটা যেমন মনে রাখা আমার দায়িত্ব। ঠিক তেমনই আপনারও যে স্বামী আছে। সেটা মনে রাখাও আপনার কর্তব্য।

–লোকে বলে তুমি তার মাঝে কি দেখেছ? আমি বলি তাকে দেখার পর আর কিছু দেখিনি। আপনার মায়ায় আমি এমন ভাবে আঁটকে গিয়েছি। যে আপনার থেকে যতই সুদর্শন পুরুষ আসুক না কেন? আমার কাছে আপনার থেকে সেরা কেউ হবে না। আপনার মতো সুন্দর পুরুষ আমি দু’টো দেখিনি। আপনাকে দেখার পর আমার আর কাউকে ভালোই লাগে নি। আমার মহারাজা ছাড়া ধরনীর বুকে সকল পুরুষ আমার কাছে বিষাক্ত। আমার স্বামী আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ। আপনার যত রকম অস্ত্র আছে। আপনি সব গুলো মেরামত করে রাখুন। আমি আপনাকে একশো পারসেন্ট গ্যারান্টি গিয়ে বলতে পারি। সেগুলো আপনার কোনো কাজেই আসবে না। আমাদের যদি কোনোদিন বিচ্ছেদও হয়ে যায়। তবে আমি মেহেভীন আজকে আপনাকে কথা দিলাম। আপনি ব্যতিত কোনো পুরুষ আমার জীবনে প্রবেশ করবে না। মেহেভীনের বাক্য গুলো শেষ হবার সাথে সাথে মুনতাসিম মেহেভীন মুখ চেপে ধরলো। মেহেভীনের মুখশ্রীতে বিচ্ছেদের কথা কর্ণকুহরে আসতেই ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। আনন্দ উল্লাস করা হৃদয়টা মুহূর্তের মধ্যে রক্তাক্ত হয়ে গেল। সে কাতর স্বরে বলল,

–আপনি আমায় সবকিছু বলবেন। আমি মেনে নিব। কিন্তু আর কোনোদিন বিচ্ছেদের কথা মুখে আনবেন না। বিচ্ছেদ নামটাও বিষাক্ত। নামটা কর্ণে প্রবেশ করার সাথে সাথে ভেতরটা ভিষণ বাজে ভাবে পুড়তে শুরু করেছে। আপনি বিচ্ছেদ চাইলে আমার মৃত্যু অনিবার্য। আপনি যতটুকু জানেন তার থেকেও বেশি আপনার সাথে বাঁচার ইচ্ছে আছে আমার। আপনি আমাকে রক্তাক্ত করে দিয়েন। তবুও আমার সাথে থাইকা যাইয়েন। আমি আপনায় ছাড়া আর বুঝি না৷ আমি সকাল সন্ধ্যায় প্রতিনিয়ত আপনারেই খুঁজি। বিচ্ছেদ শব্দটা উচ্চারিত হলেই বুকটা ভিষণ ব্যথা করে আমার। মুনতাসিমের কাতর কণ্ঠ স্বর আর অসহায়ত্ব মাখা মুখশ্রী মেহেভীনকে আহত করল৷ সে মলিন মুখশ্রী করে মুনতাসিমে দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীনের বিষন্ন মন দেখে মুনতাসিম পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল,

–আপনি দিন দিন কালো হয়ে যাচ্ছেন।

–কালো হয়ে যাচ্ছি বলে, আমাকে আর ভালো লাগছে না?

–আমি চাইলে আপনার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিতে পারি।

–কিভাবে?

–স্ত্রীকে স্বামী বেশি বেশি চুমু দিলে, স্ত্রীর সৌন্দর্য বেড়ে যায়। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে দূরে সরে গেল। রক্তিম আঁখিযুগল মুনতাসিমকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। মুনতাসিমের অধরের কোণে স্নিগ্ধ হাসি। মেয়েটাকে রাগানো খুব সহজ। তার অপছন্দের একটা কথা বললেই দুনিয়াদারী ভুলে যায় সে। মুনতাসিমের এটা ভেবে ভালো লাগছে। মেহেভীনের বিষন্নতাকে সে দূর সরাতে পেরেছে। মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–দূরে না গিয়ে কাছে এসে ভালোবেসে দিন। যাকে অবহেলা করে দূর সরিয়ে দিচ্ছেন। তাকে আদর করার জন্য বাহিরে অনেক তরুনী অপেক্ষা করছে। আপনি কাছে আসবেন নাকি আমি বাহিরে যাব?

–সাহস থাকলে যান। কথা গুলো বলেই সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার নিয়ে এসে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরালো মেহেভীন। মুনতাসিম নিজেই মেহেভীনের অতি সন্নিকটে এগিয়ে আসলো। মেহেভীন দূরে সরতে চাইলে মুনতাসিম মেহেভীনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিল। মেহেভীন মুহুর্তের মধ্যে আদুরে বেড়ালের মতো গুটিসুটি মেরে মুনতাসিমের বুকের মধ্যে লেপ্টে থাকলো। মানুষটা তার সামনে আসলেই মেহেভীনের সমস্ত ক্রোধ ছুটি নেয়। মুনতাসিম মেহেভীনের কর্ণের কাছে গিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল,

–শুনুন মেয়ে আপনাকে ছোঁয়ার ইচ্ছে আমার নেই।

–আমাকে ছুঁয়েই কথা গুলো বললেন। ছাড়ুন আমাকে পাপী বান্দা। আমাকে ম’রা’র শখ জেগেছে বুঝি। যে ধরণীর বুকে আমি থাকতে পারব না৷ সেখানে আপনিও থাকতে পারবেন না। আপনাকে খু’ন করে তবেই ধরনীর মায়া ত্যাগ করব। এত সহজ নয়। আমাকে আপনার থেকে আলাদা করা। আপনি আমার না তো কারো না।

–কেন আমি আপনার হলে, আপনি আমাকে সবার মাঝে বিলিয়ে দিতেন? মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মেহেভীনের আঁখিযুগলের দিকে দৃষ্টিপাত করে আঁতকে উঠল মুনতাসিম। মেয়েটার আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন হয়ে গিয়েছে। সমস্ত মুখশ্রীতে প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলার ভয়। মুনতাসিম অস্থির হয়ে বলল,

–আপনি আমার কথায় দুঃখ পেয়েছেন? আমি আপনার মন ভালো করার জন্য মজা করছিলাম। আপনি দুঃখ পেলে আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। আমি ভুল করে ফেলছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি আর কখনো এমন করব না৷ মুনতাসিমের কথায় হেসে ফেলল মেহেভীন। সে হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,

–আপনি অস্থির হবেন না। আপনি অন্য কারো হবার কথা বলছেন। এতেই আমার খারাপ লেগেছে। আর কখনো বলবেন না। কারন সব মজা, মজা লাগে না আমার কাছে। মেহেভীনের কথায় মুনতাসিমের হৃদয়ে অস্থিরতার ঝড় বয়ে যেতে শুরু করল। সে তার প্রিয় অর্ধাঙ্গিনীকে আঘাতপ্রাপ্ত করতে চায়নি। মুনতাসিম মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রীতে আদরে আদরে ভরিতে তুলতে লাগল। মুহুর্তের মধ্যে মলিনতাকে গ্রাস করে ফেলল এক টুকরো লজ্জা। বিষন্নতা কেটে গিয়েছে প্রয়নের হাওয়ায়। অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করছে মনে গহীনে। মুনতাসিম মেহেভীনের ললাটে চুমু খেয়ে বলল,

–আমি বের হচ্ছি। যেতে সময় লাগবে। আপনি দেখে শুনে থাকবেন। কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে ফোন করবেন। আপনার ফোনটা আজ আমার কাছে থাক। আমি আমার দ্বিতীয় ফোনটা আপনার কাছে রেখে গেলাম।

–আপনি সাবধানে যাবেন। আপনাকে নিয়ে আমার ভিষণ চিন্তা হয়। ড্রাইভারকে বলবেন গাড়ি আস্তে চালাতে।

–আমার ম্যাডাম যা বলবে। আমি সবকিছু শুনতে বাধ্য। আসছি। বলেই কক্ষ ত্যাগ করল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ফিরে এসে মেহেভীন আলিঙ্গন করল। যাবার সময় বলে বলে গেল, “বাহিরে যাবার আগে বউকে জড়িয়ে ধরলে বিপদ কম হয়।” মুনতাসিমের এমন অদ্ভুত কথায় মনের অজান্তেই মেহেভীনের অধরের কোণে হাসির রেখার দেখা মিলল।

মুনতাসিম গাড়ি থেকে নামতেই মানুষেই হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা তার দৃষ্টিতে এসে আঁটকে গেল। তার সামনে পেছনে পুলিশ প্রটেকশন দিয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে প্রিয় নেতার স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছে। প্রিয় নেতাকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে জেগেছে মুনতাসিম ভক্তদের। সবাই হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। মুনতাসিম নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে সবার সাথে হাত মেলানোর চেষ্টা করছে। মুনতাসিম মঞ্চ উঠতেই সবাই গর্জন করে উঠল। মুনতাসিম হাত উঁচু করে সবাইকে ভালোবাসা নিবেদন করল। আশেপাশে আরো নেতারা রয়েছে। মুনতাসিমের জন্য রাখা নিধারিত চেয়ারে গিয়ে সে বসল। মুনতাসিমকে বক্তৃতা দেয়ার জন্য আহবান করা হলো। মুনতাসিম সালাম দিয়ে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করল। বাঘের ন্যায় গর্জন করে বক্তৃতা দিচ্ছে মুনতাসিম। তার গর্জন করে বলার বাক্য গুলো কারো কারো কলিজা কাঁপিয়ে তুলছে। বক্তৃতা দেওয়ার সময় একটু সময়ের জন্য তার কথা গুলো বেঁধে যায় না। সেজন্য মুনতাসিমের বক্তৃতা দেওয়া সবার কাছে ভিষণ প্রিয়। দীর্ঘ আটচল্লিশ মিনিট বক্তৃতা দেওয়ার পর মঞ ত্যাগ করল মুনতাসিম। সমস্ত জনতা তাকে ঘিরে ধরতে ব্যস্ত, তখনই গু’লি’র শব্দে সেই স্থান নিরব হলো। তাইয়ানের দৃষ্টি সেদিকে যেতেই তাইয়ান মুনতাসিমকে নিয়ে মস্তক নিচু করে ধরল। গু’লি’টা গিয়ে লাগলো একটা গার্ডের কায়াতে। গার্ডটা যন্ত্রনায় ছটফট করতে লাগল। তখনই ভয়াবহ ভাবে মঞ্চের দিকটায় বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো। আনন্দ আয়োজনের স্থানটা মুহুর্তের মধ্যো ভয়ানক রুপ নিল। জনগণ নিজেদের প্রাণ রক্ষার্থে প্রাণপণে এদিক সেদিক ছুটে চলেছে। পুলিশ প্রশাসন তাদের টিম, ফারার সার্ভিস সহ আরো নিরাপত্তার দলকে দ্রুত সেখানে আসতে বলল। দেড়শো জনের মতো মানুষ গুরুতর ভাবে আহত হলো। টাইম বো’ম’টা মাঝারি ধরনের হওয়ায় মঞ্চের আশেপাশে থাকা মানুষ গুলোর বেশ ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। পরপর আরো চারটা গু’লি এসে মুনতাসিনের কর্ণ ভেদ করে চলে গেল। পুলিশ সদস্য কোনদিকে গুলি করবে বুঝে উঠতে পারল না৷ হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কে গুলি করছে। তারা সেটা কিভাবে বের করবে? ভূল বসত যদি নিরীহ মানুষের কায়াতে গিয়ে লাগে। মুনতাসিমের বিচক্ষণ দৃষ্টি সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,

–কালো চাদর মুড়িয়ে থাকা মানুষটাকে মারুন গুলিটা সে-ই করছে। দেরি করবেন না, তাইয়ান সুট করো। পুলিশ সদস্য তাক করার আগেই ব্যক্তিটা পুলিশ সদস্যের বুকটা গু’লি দিয়ে ছিদ্র করে দিল। পুলিশ সদস্য মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তারা তাকে সুট করতে যাবে। তখনই সে মস্তক নুইয়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল। এত ভিড় ঢেলে সামনের দিকে আগানোও যাচ্ছে না। মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে ভিড় ঠেলে সামনের দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই একজন সিনিয়র নেতা এসে মুনতািসমের হাত ধরে ফেলে। সে খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

–তুমি প্রটেকশনের বাহিরে যেও না। তোমার ক্ষতি হবে।

–জা’নো’য়া’রে’র বা’চ্চা’কে তো আমি দেখে নিব। ও আমার হাতে পড়লে আমি ওকে জ্যা’ন্ত পুঁ’তে ফেলব। আপনি আমার হাত ছাড়ুন স্যার। আমার ভালোবাসার মানুষদের আঘাতপ্রাপ্ত করেছে। তার চামড়া ছি’লে লবন মরচি লাগাব আমি। তার ভয়াবহ শরীরটা জনগণের সামনে আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মা’র’ব।

–মুনতাসিম এটা ক্রোধের সময় নয়। তুমি নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গিয়েছ। তুমি দ্রুত স্থান ত্যাগ করো। আমার অভিজ্ঞতা বলছে। ওরা তোমাকেই মারতে এসেছে। তুমি যতক্ষণ এখানে থাকবে। ততক্ষণ তারা আক্রমণ করতেই থাকবে। তুমি এখানে থাকলে হিতে বিপরীত হবে। তোমাকে আঘাত করতে গিয়ে ক্ষত হবে সাধারণ জনতা। এই ভিড়ের মধ্যে কেউ তোমাকে খু’ন করে দিয়ে গেলে-ও আমরা টের পাব না কে তোমাকে খু’ন করে গেল? তার থেকে ভালো তুমি স্থান ত্যাগ করো।

–আমি মরলে মরব। মরার আগে কু’ত্তা’র বাচ্চাকে খু’ন করে তবেই মরব। মুনতাসিম সামনের দিকে এগোনোর প্রস্তুত হতেই দেড়শোর মতো গাড়ি নিয়ে নিরাপত্তা দল এসে হাজির হলো। একজন পুলিশ এসে বলল,

–স্যার আপনি স্থান ত্যাগ করুন। আপনি থাকলে পরিস্থিতি আমাদের হাতের বাহিরে চলে যাবে। আপনি দূরে অবস্থান করলে, আমরা খুব সহজে পরিস্থিতি হাতের নাগালে নিয়ে আসতে পারব। মুনতাসিম আজ নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গিয়েছে। চারদিকে হাহাকার লেগে গিয়েছে। মুনতাসিম সবার কথার অর্থ উপলব্ধি করতে পেরে নিজ থেকেই স্থান ত্যাগ করল। চারিদকে আতঙ্কের ছাপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। পরে আরো পঞ্চাশটা গাড়ি এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সক্ষম হয়েছে। সন্দেহ জনক উনিশ জনকে আটক করা হয়েছে। আহতদের হসপিটালে নেওয়া হয়েছে। খবরটা মুহুর্তের মধ্যে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। হামলার কথা কর্ণকুহরে আসতেই রিয়াদ চৌধুরী অস্থির হয়ে উঠলেন। সে অনবরত তাইয়ানকে ফোন করে যাচ্ছে। কিন্তু তাইয়ানকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। সময়ের সাথে চিন্তার মাত্রা প্রকোপ পেতে শুরু করল। সে তার পরিচিত পুলিশকে ফোন করেছিল। সেই পুলিশটা বলেছে। মুনতাসিম সমাবেশ থেকে এক ঘন্টা আগে বের হয়ে গিয়েছে। ভয়ে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল রিয়াদ চৌধুরী। রাজনীতিতে শত্রু বেশি প্রাণ হাতে নিয়ে ঘুরতে হয়। সেজন্য সে রাজনীতি জিনিসটা পছন্দ করে না। ছেলেকে কত করে নিষেধ করেছিল। রাজনীতিতে যাস না। মুনতাসিমের জেদের কাছে হেরে গিয়েছিল সে। ভয়ে ভেতরটা কাবু হয়ে আসছে তার। মুনতাসিমের খবরটা পেয়ে মেহেভীনও যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। বরাবরের মতোই ফলাফল শূন্য। অদ্ভুত ভাবে হাত পা কাঁপছে তার। সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসছে। সে যদি বেরই হয়ে থাকে তাহলে গৃহে আসছে না কেন! তখনই বাহিরে থেকে অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল। অ্যাম্বুলেন্স থেকে সাদা কাপড়ে ঢাকা লা’শ বের করে নিচে নামানো হলো। সাদা কাপড়টা রক্তে ভিজে যাচ্ছে। একদম তাজা রক্ত। যেন সবে মাত্র আহত হতেই দেহ থেকে প্রাণপাখিটা বিদায় নিয়েছে। তখনই শেহনাজ এসে বলল,

–ভাবি তাড়াতাড়ি নিচে এসো। নিচে অ্যাম্বুলেন্সে করে কার জানি লা’শ নিয়ে আসা হয়েছে। কিছু সময়ের জন্য মেহেভীনের হৃদস্পন্দনের গতিবেগ স্থির হয়ে গেল। রিয়াদ চৌধুরী কক্ষে থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে বের হয়ে এল। মেহেভীন দৌড়ে বাহিরে চলে আসলো। রিয়াদ চৌধুরী সামনের লা’শে’র দিকে তাকিয়ে জ্ঞান হারালো। মেহেভীন রক্তে মাখা সামনে শুয়ে থাকা লা’শ’টা দেখে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। সমস্ত কায়া নিস্তেজ হয়ে আসতে শুরু করেছে। সে মাটিতে ধপ করে বসে পড়লো।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪৭
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

চারদিকে হাহাকারে ভরে গিয়েছে। কান্নার প্রতিধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠেছে। লা’শে’র পাশে বসে দু’টো বাচ্চা আর একজন অর্ধবয়স্ক মহিলা লা’শ’কে জড়িয়ে ধরে অনবরত অশ্রুবিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। মুহুর্তের মধ্যে পরিবেশটা বিষাদময় হয়ে উঠল। মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে গেল। বুদ্ধিরা জোট বেঁধে বিলীন হয়ে গিয়েছে। ভেতরটা কেমন জানি ফাঁকা লাগছে। চৌধুরী গৃহের সদর কবাটে হাহাকারের মেলা বসেছে। বাচ্চা দু’টোর হৃদয়বিদারক চিৎকার দেখে মেহেভীনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মেহেভীন আঁখিযুগল দিয়ে ইশারা করতেই একজন গার্ড বলল,

–এটা শরিফুলের লা’শ স্যারের সাথে জনসভায় ছিল। যেখানে গু’লা’গু’লি হবার সময় সে, সেখানে উপস্থিত ছিল। আমারা বেঁচে ফিরতে পারলেও ভাগ্য তার সহায় হলো না। যারা অশ্রুবিসর্জন দিচ্ছে। তারা শরিফুলের অর্ধাঙ্গিনী আর সন্তান। কিছু ব্যথার কোনো ঔষধ হয় না৷ কিছু দুঃখের কোনো শান্তনা হয় না। শরিফুলের পরিবারকে মেহেভীন কোন ভাষায় শান্তনা প্রয়োগ করবে, তা জান নেই মেহেভীনের। বাচ্চা দু’টো বাবার চরণ দু’টি আলিঙ্গন করে উন্মাদের মতো চিৎকার করে যাচ্ছে। আঁখিযুগল দিয়ে অশ্রুর বন্যা বয়ে যাচ্ছে। মহিলাটি কেমন অস্থির হয়ে হয়ে উঠছে। সমস্ত কায়া নিস্তেজ হয়ে আসছে। কিছু সময়ের ব্যবধানে মহিলাটি জ্ঞান হারালো। ভালোবাসা কি অদ্ভুত জিনিস! যাকে ছাড়া দম বন্ধ হয়ে আসে। মৃত্যুর কাছে সেই ভালোবাসা হার মেনে যায়। এত মায়া, এত ভালোবাসা, এত এত পূর্ণতা অপূর্ণ করে দিয়ে চলে যায় মানুষটা। মহিলাটির অবস্থা দেখে মেহেভীনের বুকের মধ্যে চিনচিন করে ব্যথা করছে। একটু পরে একটা গাড়ি আসলো। সেই গাড়ি করে শরিফুলকে দেশের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে। শরিফুলের শেষ ইচ্ছে ছিল। তার লা’শ’টা যেন তার দেশের বাড়িতে দাফন করা হয়। মুনতাসিম শরিফুলকে দেওয়া কথা রেখেছে। শরিফুলের লা’শ দেশের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সমস্ত বন্দোবস্ত করে দিয়েছে মুনতাসিম। তাইয়ান ফোন করে জানিয়েছে তারা হসপিটালে আছে। সবাই শান্ত হলে-ও তিক্ততা হৃদয়কে গ্রাস করে ফেলছে। এত এত হাহাকার প্রিয় মানুষ হারানোর যন্ত্রনা ভেতর টাকে কাবু করে তুলছে।

রজনীর শেষ প্রহর চলছে। সবাই নিদ্রা দেশে তলিয়ে গিয়েছে। মেহেভীন কায়াতে শীতের বস্ত্র পরিধান করে আস্তরণে বসে আছে। মুনতাসিমের চিন্তায় সারারাত আঁখিযুগল এক করেনি সে। মানুষটাকে দেখার জন্য ভেতরটা ছটফট করছে। মস্তিষ্ক ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছে। অনুভূতিরা আজ অভিমানে দূর দেশে পাড়ি জমিয়েছে। অশান্ত আঁখিযুগল বারবার কবাটের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। এই বুঝি মানুষটা এসে তার সামনে দাঁড়াবে। কিন্তু মেহেভীনকে হতাশ করে দিয়ে মানুষটা আসছে না। অসহ্য যন্ত্রনায় ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। যাকে কোনোদিন কল্পনা করত না৷ আজ তার জন্যই ভেতরটা কতই না পুড়ছে! তাকে না জানিয়েছিল আমন্ত্রণ না দিয়েছিল অনুমতি। তবুও সে এসেছিল। তার ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে তাকে ভালোবাসতে বাধ্য করল। সে তো বলেনি ভালোবাসলে এভাবে পুড়তে হয়! নিজের জন্য সে কোনোদিন এতটা যন্ত্রনা অনুভব করেনি। আজ মুনতাসিমকে হারিয়ে ফেলার ভয় তাকে যতটা যন্ত্রনা দিচ্ছে। নাকের ডগা রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে মেহেভীনের। আঁখিযুগল ফুলে গিয়েছে। সমস্ত মুখশ্রীতে কেমন বিষন্নতা ছড়িয়ে পড়েছে। মেহেভীনের ভেতরের হাহাকার গুলো যেন তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে।

শুভ্র পাঞ্জাবীটা রক্তে ভিজে রক্তলাল বর্ণ রুপ নিয়েছে। শীতে সমস্ত কায়া থরথর করে কাঁপছে। হাত-পা সহ কায়ার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বরফের ন্যায় জমে আছে। মুনতাসিম আর তাইয়ান সবে মাত্র গৃহে ফিরেছে। মুনতাসিম নিজের কক্ষের দিকে অগ্রসর হতেই কারো গম্ভীর কণ্ঠ স্বর ভেসে এল। মানুষটা মুখশ্রীতে আঁধার নিয়ে এসে বলল,

–তোমার আব্বা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। নিজের কক্ষে যাবার আগে তার সাথে দেখা করে যাও। সাহেলা চৌধুরীর কথায় মুনতাসিম বিলম্ব করে না। দ্রুত রিয়াদ চৌধুরীর কক্ষে ছুটে যায়। রিয়াদ চৌধুরীর হাতে এখনো স্যালাইন বিদ্যমান। আঁখিযুগলে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে তার। ছেলেকে দেখে হৃদয় শীতল হলো। হাত বাড়িয়ে মুনতাসিমকে নিজের নিকটে ডাকল। মুনতাসিম দূরে থেকেই বলল,

–আপনি এত বেশি চিন্তা করেন কেন আব্বা? আমার কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি৷ আপনার কিছু হলে আমার কতটা কষ্ট হয়৷ সেটা আপনি কবে বুঝবেন? যদি বুঝতেন তাহলে নিজের যত্ন নিতেন। আমি বাহিরে থেকে এসেছি। দেখুন সমস্ত কায়াতে রক্তের ছড়াছড়ি। এভাবে আপনার কাছে যাব না। আপনি বিশ্রাম নিন। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। আপনার শরীর এখন কেমন আছে?

–তোমাকে দেখে উত্তপ্ত হৃদয়টা শীতল হয়ে গেল। তুমি আমার কাছে এসো। ছোট বেলায় কত ধূলাবালি নিয়ে খেলেছ। সেই কায়াতে আমার কোলেও এসেছ। তখন কিছু হয়নি৷ আর এখন কি হবে? সন্তান যেমনই হোক না কেন বাবা-মায়ের কাছে তারা সব সময় রাজকুমার। তুমি আমার জন্য কি সেটা তুমি বুঝবে না। যেদিন বাবা হবে সেদিন বুঝবে। কেন তোমার আব্বা তোমাকে নিয়ে এত বেশি ভাবত? তুমি তোমার কক্ষে যাও। ফ্রেশ হয়ে আসার দরকার নেই বিশ্রাম নিবে। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে সকালে কথা হবে। মুনতাসিম বিলম্ব করল না। দ্রুত কক্ষের দিকে এগিয়ে গেল। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সমস্ত কায়াতে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। সাথে মেহেভীনের জন্য ভিষণ মন পুড়ছে৷ মেয়েটা নিশ্চয়ই তার জন্য অস্থির হয়ে আছে। কবাটের কাছে আসতেই মেহেভীনকে দেওয়ালের সাথে মস্তক ঠেকিয়ে চিন্তিত হয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুনতাসিমের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। এই গৃহে তো আরো মানুষ আছে৷ তার বাবা আর মেহেভীন ছাড়া তার জন্য কেউ এতটা যন্ত্রনা নিয়ে ছটফট করতে করতে রজনী পার করেনি। মুনতাসিম কক্ষে প্রবেশ করল। মেহেভীন মুনতাসিম দেখে উঠে দাঁড়াল। মেহেভীনের মুখশ্রী কাছ থেকে দেখতেই ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল। মেয়েটার সমস্ত মুখশ্রীতে কেমন বিষন্নতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মেহেভীন কোনো বাক্য উচ্চারন না করে আলমারি থেকে মুনতাসিমের টি-শার্ট, প্যান্ট আর তোয়ালে বের করে আস্তরণে রাখল। মুনতাসিম চোরা দৃষ্টি মেহেভীনকে দেখছে। মেহেভীন নিজেই মলিন কণ্ঠে বলল,

–আপনি বস্ত্র বদলে আসুন। এভাবে আপনাকে দেখতে খারাপ লাগছে।

–আপনি রাগ করে আছেন? কথা গুলো বলতে বলতে মেহেভীনের দিকে এগিয়ে আসলো। মেহেভীন আগের ন্যায় আস্তরণে গিয়ে বসল। মুনতাসিম কাঁধে হাত রাখতে চাইলে মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে বলল,

–একদম ছোঁবেন না আমাকে। মুনতাসিম বুঝল মহারাণীর রাগটা বেশ গভীর ভাবেই হয়েছে। আগে নিজেকে বাঁচাতে হবে। তারপর মহারনীর ক্রোধকে দমন করা যাবে। সে কোনো বাক্য উচ্চারন করল না। বস্ত্র নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। মেহেভীন অশ্রুসিক্ত নয়নে মুনতাসিমের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। অভিমানী আঁখিযুগল নিরবে শতশত অভিযোগ করে যাচ্ছে। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই মুনতাসিম গোসল করে বের হলো। সামনের চুল বেয়ে টুপ টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে৷ শীতে থরথর করে কাঁপছে মুনতাসিম। মেহেভীন উঠে এসে মুনতাসিমের হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে মস্তক মুছিয়ে দিতে দিতে বলল,

–আপনি পাগল হয়ে গিয়েছেন? এই ভোর রাতে গোসল করতে গিয়েছেন কেন? সকালে উঠে গোসল করলেই পারতেন! হায় আল্লাহ সমস্ত কায়া বরফের ন্যায় জমে গিয়েছে। আপনি আস্তরণে গিয়ে বসুন। আমি আসছি। কথা গুলো বলেই মেহেভীন কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। একটু পরে সরিষার তেল নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল। মুনতাসিমের মস্তক আরো একবার ভালোভাবে মুছে দিল। মুনতাসিমের দুই হাত নিজের হাতের মধ্যে নিতেই সমস্ত কায়া কেঁপে উঠল। মেহেভীন বিলম্ব না করে দ্রুত সরিষার তেল মুনতাসিমের দুই হাতের তালুকে ঘষতে লাগল। মুনতাসিম চুপচাপ মেহেভীনের কর্ম পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। মেহেভীন মুনতাসিমের হাত ছেড়ে চরণের কাছে গেল। এবার মুনতাসিম বাঁধা সাধলে মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আমাকে বেশি জ্ঞান দিতে আসলে আপনার সাথে আমার তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ লেগে যাবে।

–সে যাক, কিন্তু পা ছুঁতে দিব না।

–কেন আপনার পা ছুঁলে আমার হাত নষ্ট হয়ে যাবে? এসব কেমন ধরনের পাগলামি! কথা গুলো বলেই মেহেভীন দ্রুত মুনতাসিমের দু’টি চরণ নিজের কোলে তুলে নিয়ে তেল দিয়ে ঘষতে শুরু করে দিল। অদ্ভুত ভাবে কয়েক মিনিটের মধ্যে মুনতাসিমের হাত-পা গরম হয়ে আসতে শুরু করল। মুনতাসিম বিস্ময় নয়নে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। কায়ার কম্পন কমে গিয়েছে৷ সে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।

–আপনি অপেক্ষা করুন খাবার নিয়ে আসছি।

–বেশি করে নিয়ে আসবেন। দু’জন একসাথে খাব। ভুলেও রান্না ঘরে ঢুকবেন না। খাবার গরম করার কোনো ব্যাপার থাকলে গার্ডকে ডেকে নিবেন। মেহেভীন কোনো উত্তর করল না। দ্রুত কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। একটু পরে খাবার গরম করে নিয়ে এসে মুনতাসিমের মুখের সামনে ধরল। মুনতাসিম মুখশ্রী অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল,

–আগে আপনি খাবেন।

–আমি খেয়েছি।

–মিথ্যা কথা বলছেন কেন?

–আমাকে নিয়ে আপনার এত ভাবতে হবে না। যার কেউ নেই। তাকে নিয়ে ভাবার জন্য আল্লাহ তায়ালা আছেন।

–আসলে…মুনতাসিমকে সম্পূর্ণ বাক্য শেষ করতে না দিয়ে মেহেভীন এক লোকমা ভাত মুনতাসিমের মুখে পুরে দিল। মুনতাসিম রক্তিম আঁখিযুগল নিয়ে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমকে দেখতে পেয়ে মেহেভীন যেন নিজের জান ফিরে পেয়েছে। অভুক্ত পেটটা জানান দিচ্ছে তার প্রচন্ড ক্ষুদা পেয়েছে। রাগ আছে মুনতাসিমের সাথে আছে। খাবারের সাথে কোনো রাগ নেই। মেহেভীন নিজেও মুনতাসিমের সাথে খেতে শুরু করল। তা দেখে মুনতাসিম মুচকি হাসল। সবকিছু গুছিয়ে মেহেভীন শায়িত হবার জন্য প্রস্তুত হতে মুনতাসিম মেহেভীনের হাত ধরে ফেলল।

–আপনাকে ছুঁতে নিষেধ করেছি।

–কি একটা বউ পেয়েছি। এতবড় বিপদের মধ্যে থেকে বেঁচে ফিরলাম। অন্য কোনো বউ হলে এতক্ষণে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দিত। স্বামীর সমস্ত মুখশ্রীতে হাজার খানেক চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিত। আর আমি হতভাগা বাহিরেও যুদ্ধ করব। ঘরে এসেও বউয়ের রাগে ধংস হব। ভালোবাসা আমার ভাগ্য নেই। নিরামিষ কোথাকার। এত রাগে আসে কোথায় থেকে আপনার?

–তাহলে সেই সব বউদের কাছে যান। কথা গুলো বলেই হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বেলকনিতে চলে গেল মেহেভীন। মুনতাসিমের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। শীতল কণ্ঠে বলা বাক্য গুলো ভিষণ ভয়ংকর রকমের হয়। পাথরের ন্যায় শক্ত মানুষটার হৃদয় টাও কাঁপিয়ে তুলে। মেহেভীন বেলকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সমস্ত শক্তি ক্ষয় হতে শুরু করেছে। শক্ত আবরণের খোলস টা বরফের ন্যায় গলতে শুরু করেছে। চাইলেই সব সময় স্ট্রং থাকা যায় না। ভেতরের চাপা আর্তনাদ লুকিয়ে রাখা যায় না৷ জমে থাকা ব্যথা গুলো হঠাৎ করেই বলে ওঠে, আমি আর পারছি না। মেহেভীনের আঁখিযুগলের কার্নিশ অশ্রুকণা এসে জমতে শুরু করেছে৷ ভেতরে অসহনীয় যন্ত্রনার মাত্রা প্রকোপ পেয়েছে। ছুটে গিয়ে মানুষ টাকে আলিঙ্গন করে হাজারো অভিযোগ করতে ইচ্ছে করছে। তবুও নিজের মনকে দমিয়ে নিল মেহেভীন। শান্ত নদীর ন্যায় স্থীর হয়ে গেল সে। যে মানুষের জীবনে তার কোনো মূল্য নেই । সে চাইলেই তো আর জোর করে মূল্য আদায় করে নিতে পারবে না৷ সে তার মতো ভালো থাকুক। সে ভালো থাকলেই ধরনীর সমস্ত সুখ মেহেভীনের হৃদয়ে এসে ধরা দিবে। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই মুনতাসিম মেহেভীনকে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরল। মেহেভীনের কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে অপরাধীর ন্যায় বলল,

–আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন। আমার ফোনটা নিজের কাছে ছিল না৷ সেজন্য আপনাকে দিকে জানাতে পারিনি৷ এত এত মানুষ আহত হয়েছে। চারিদিকে প্রিয়জনদের এত এত হাহাকার আমাকে দিশেহারা করে দিয়েছিল। আমার জন্য এত গুলো মানুষ আহত হলো। শরিফুল পরপারে গমন করল। তার বউ স্বামী হারা হয়ে গেল। তার সন্তানরা বাবা হারা হলো। আমি উন্মাদের এদিক সেদিক ছুটেছি। আমি আপনার কথা ভুলিনি। তাইয়ানকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছি। নিজে খবর দিতে পারিনি বলে, আপনি যে আমার কাছে মূল্যহীন এমনটা কোনোদিন ভাববেন না। আমার নিজের থেকে-ও বেশি আপনি আমার কাছে মূল্যবান। আপনার অভিমান হওয়াটা স্বাভাবিক। আমি আপনাকে আমার পরিবারকে যেমন ভালোবাসি। ঠিক তেমনই জনগণকেও আমি ভিষণ ভালোবাসি। তাদের ভালো রাখার শপথ গ্রহন করেছি। তাদের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্বটাও আমার। আমি সবাইকে নিরাপদ চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে দিয়ে কিভাবে গৃহে আসতাম বলেন? আমি যদি নিজের কথা ভেবে চলে আসতাম। তাহলে আমার ভালোবাসার মানুষদের সাথে অন্যায় করা তো। আপনি রাগ করুন। আমাকে শত-শত কথা শোনান৷ আপনার সমস্ত শাস্তি আমি মস্তক পেতে নিব। তবুও আপনি এভাবে কষ্ট পাবেন না। আপনার ব্যথা আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। আমার ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে যায়। মেহেভীন নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না। মুনতাসিমকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মুনতাসিমের ভেতরটা অশান্ত নদীর ন্যায় উথাল-পাতাল করতে শুরু করে দিয়েছে। সে শক্ত বন্ধনে নিজের প্রেয়সীকে বুকের মধ্যে আবদ্ধ নিল।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪৮
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

চারদিক বিষাদে পরিপূর্ণ। তবুও কোথাও জানি এক টুকরো সুখ এসে মনের আনাচেকানাচে ঘুরঘুর করছে! মুনতাসিমকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে মেহেভীনের কাবু হয়ে আসা মুখশ্রী মুনতাসিমকে ভিষণ আনন্দ দিচ্ছে। ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে উঠছে। এমন একটা দিনের জন্য কতগুলো দিন তাকে পুড়তে হয়েছে। প্রেয়সীর অশ্রুসিক্ত আঁখিযুগল ভেতরটা অশান্ত সমুদ্রের ন্যায় উথাল-পাতাল করছে। মুনতাসিম মেহেভীনের অশ্রুকণা গুলো নিজ দায়িত্ব মুছে দিল। মেহেভীনের দু’গাল দু’হাতের তালু দ্বারা আবদ্ধ করে ফেলল। কণ্ঠে কমলতা নিয়ে এসে বলল,

–কি হয়েছে, এভাবে কাঁদছেন কেন?

–আপনি এত নিষ্ঠুর কেন বলেন তো? আমি কি আপনার কাছে এতটাই তুচ্ছতাচ্ছিল্যে করা মানুষ নাকি সহজেই পেয়ে গিয়েছেন বলে সস্তা মনে হচ্ছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি পাগলের মতো এদিক সেদিক ছুটেছি৷ আপনি কেবল মুখেই ভালোবাসা দেখান। কাজের বেলায় আপনি একদম শূন্য। আর একটু হলেই আমার দেহ থেকে প্রাণপাখিটা বের হয়ে যেতো। আপনি সারাদিন আপনার জনগণের কাছে থাকুন। তাদের সেবা করুন। আমার কোনো সমস্যা নেই। আপনি একটা বার আমাকে ফোন দিয়ে জানাতে পারতেন। আপনি ঠিক আছেন। সুস্থ আছেন। তাহলে এই অশান্ত মনটাকে শান্ত করতে পারতাম। আপনার কি একবারও আমার কথা মনে হয়নি? ভয়ে বুক কাঁপেনি আপনি হীনা আমার কি হবে সে কথা ভেবে? আমার প্রতি এত অবহেলা, এত অনীহা!

–আপনার প্রতি যদি আমার অনীহা থাকতো। তাহলে রজনীর শেষ প্রহরে গৃহে ফিরে আসতাম না। আমার কোনো পিছুটান ছিল না। আমি যদি সারারাত গৃহে না ফিরতাম। আমার খোঁজ নেওয়ার কেউ ছিল না। শুধু আব্বা ফোন দিয়ে খোঁজ নিতো সুস্থ আছি কি না। আমার এত কিসের টান ছিল গৃহে ফেরার? আমি চাইলেই আজ রাতটা হসপিটালের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে বসে কাটিয়ে দিতে পারতাম। এত হাহাকার, এত বিষাদ, এত তিক্ততার মধ্যে থেকে-ও তাইয়ানকে দিয়ে খবর পাঠাতাম না। যেখানে মানুষ রেগে গেলে মানুষের ফোন পর্যন্ত রিসিভ করে না। সেখানে আমি কঠিনতম পরিস্থিতির মধ্যে থেকে-ও আপনার কথা ভেবেছি। আপনাকে আর সবাই নিয়ে ভাবতে ভাবতে সবাই নিজের কথা ভাবতেই ভুলে গিয়েছি আমি। আমি শেষ কবে নিজের কথা ভেবে তা আমার জানা নেই। তবে আজ থেকে জানলাম। আমার নিজের কথা ভাবার দরকার নেই। আমার কথা ভাবার জন্য একটা পূর্ণিমার চাঁদ আছে। এত সুন্দর চাঁদ যদি আমার কথা ভাবে, এরপরেও যদি নিজের কথা নিজে ভাবি। তাহলে এ জীবন আমার বৃথা যাবে।

–আপনাকে বারবার করে বলেছি। আপনি কোনোকিছু করার আগে আমার কথাটা একটু ভাববেন। আপনার কিছু হয়ে গেলে আমি কিভাবে থাকব? আপনায় ছাড়া আমার কিছু ভালো লাগে না। আমি সুখ দুঃখ বলতে আপনাকেই বুঝি।

–কেন?

–কারন আমি আপনাকে… বাক্যটা কণ্ঠ নালিতে এসে আঁটকে গেল। হৃদস্পন্দনের ক্রিয়া দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করল। বক্ষথলে ধড়ফড় করতে লাগলো। সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসতে শুরু করেছে। মুনতাসিমের আঁখিযুগলে তীব্র আগ্রহ। বাক্যটা শোনার জন্য ভেতরটা ছটফট করছে। মুনতাসিমের তীব্রতা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে মেহেভীন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। শান্ত নদীর ন্যায় স্থির হয়ে গেল। আঁখিযুগল নিচের দিকে বিদ্যমান। মুনতাসিম মেহেভীনের নিরবতা দেখে নিজেই বলতে শুরু করল,

–যাকে হারানোর ভয়ে আপনার বুক কেঁপে ওঠে। যাকে হারানোর ভয়ে চেতনায়, অচেতনায় আপনার আঁখিযুগলে অশ্রুকণা এসে জমা হয়। আপনি তাকে ভালোবাসেন।

–মিথ্যা কথা।

–আমাকে তো আপনি ভালোবাসেন না। তাহলে হারাতে ভয় পাচ্ছেন কেন? আমি কখনো চাইনি আমাদের মাঝে প্রেম হোক। কারন প্রেমে বিচ্ছেদ হয়। আমি সব সময় চেয়েছি আমাদের মাঝে ভালোবাসা তৈরি হোক। কারন ভালোবাসায় বিচ্ছেদ নেই। হাত ধরলে মানুষ হাত ছেড়ে চলে যায়। সেজন্য আমি আপনার মনে ধরেছি। মন তো আর ছেড়ে চলে যেতে পারবে না। আমার মন বলেছে। আপনি আমায় মায়ায় পড়ুন। ছায়া কখনো ছেড়ে যায় না। আর মায়া কখনো পিছু ছাড়ে না৷ ধরনীর বুকে সব নেশা কাটানোর ঔষধ আছে। কিন্তু মায়ার নেশা কাটানোর কোনো ঔষধ নেই। মায়ার নেশায় যে পড়েছে। সে মরেছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই নেশা বয়ে বেড়াতে হয়। জানেন ম্যাডাম আপনার মতো কেউ আমারে এত মায়া করেনি। আমার জন্য নির্ঘুম রজনী পার করেনি। আমায় ভালোবেসে খাইয়ে দেইনি। আমারে হারানোর ভয়ে ছটফট করেনি। আপনার মতো আমার জন্য কারো আঁখিযুগলে অস্থিরতা দেখিনি। আমার অসুস্থ কায়াকে দ্রুত সুস্থ করার চেষ্টা করেনি। আপনি আমায় এত মায়ায় কেন বাঁধছেন? এত সুখ, এত আনন্দ, এত ভালোবাসা আমার জীবন সহ্য করতে পারবে তো! আমাকে এতটা মায়ায় বাঁধবেন না। আপনায় ছাড়া চলতে ভিষণ কষ্ট হয়৷ আগে বাহিরে গেলে ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করেনি। আর এখন বাহিরে গেলে দ্রুত কাজ শেষ করে ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করে। কোন জাদুবলে আমায় গ্রাস করে নিলেন আপনি? আমি ভুল করলে অভিযোগ করবেন। তবুও যেন বিচ্ছেদ শব্দটা আমাদের সম্পর্কের মধ্যে না আসে। যদি আসে তাহলে আমার আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। মেহেভীন মনযোগ দিয়ে প্রতিটি বাক্য মস্তিষ্কে গেঁথে নিল। মানুষটাকে দুঃখ দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। নিশ্চুপ হয়ে গেল মেহেভীন। অধীর আগ্রহ নিয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে সে। এই বুঝি মুনতাসিম আজ তাকে ভালোবাসি বলে দিবে। মেহেভীনকে হতাশ করে দিয়ে মুনতাসিম নিদ্রা যাবার জন্য প্রস্তুত হলো। মেহেভীনের কুঁচকে যাওয়া মুখশ্রী আড়দৃষ্টিতে দেখে মুনতাসিমের ভিষণ আনন্দ লাগছে। সে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। মেহেভীন বেলকনির গ্রিল ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।

চারদিকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। শীতল পরিবেশে নিস্তব্ধতার মেলা বসেছে। পাখিরা যেন আজ সুর তুলতে ভুলে গিয়েছে। মানুষ যেখানে কম্বলের উষ্ণ আলিঙ্গনের নিদ্রায় আচ্ছন্ন। সেখানে নিদ্রা ত্যাগ করে শহর থেকে দুইশো আটান্ন কিলোমিটার দূরে আসতে হয়েছে জারিফকে। জারিফের হাতে হ্যান্ডকাফ পড়ানো আছে। প্রলয় জারিফের কলার চেপে ধরে বলল,

–এতদিন অনেক জ্বালিয়েছিস। আজকে যদি একটুও ফাজলামি করার চেষ্টা করেছিস। তবে তোর বোনকে একদম শেষ করে ফেলব। তাড়াতাড়ি বল লা’শ কোথায় রেখেছিস? প্রলয়ের কথায় জারিফের মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠল। রক্তিম আঁখিযুগল দিয়ে প্রলয়কে ভস্ম করে দিতে ইচ্ছে করছে। ক্রোধ যেন শিরায় শিরায় চলাচল করছে। জারিফ পুলিশকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছে পুলিশ সদস্যরা সেদিকেই যাচ্ছে। পথ চলতে চলতে একটা নিস্তব্ধ শ্মশানের কাছে এসে জারিফ স্থির হলো। শ্মশানের পাশ দিয়ে আঁকাবাকা নদী বয়ে গিয়েছে। শীতল বাতাস এসে সমস্ত মন মস্তিষ্ককে কাঁপিয়ে তুলছে। নদীর পাশেই বিশাল একটা বটগাছ। জারিফ বটগাছটা দেখিয়ে বলল,

–এখানে মিরাজুলের লা’শ পুঁ’তে’ছি। প্রলয় গভীর ভাবে চারদিক পর্যবেক্ষণ করে নিল। চারদিকে গাছপালায় ঘেরা। জনবসতি নেই বললেই চলে। ছেলেটা দারুন বুদ্ধিমান না হলে লা’শ গায়েব করার জন্য এত সুন্দর স্থান নির্ধারণ করে। এই পর্যন্ত আসতে তাদের অনেকটা সময় ব্যয় হয়ে যেতো। চারদিক কেমন সুনশান একটা মানুষকে খু’ন করে রেখে গেলে-ও কেউ দেখার নেই। প্রলয় গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–আর আরিয়ানের লা’শ কোথায় পুঁ’তে’ছ?

–নদীর ওপারে জঙ্গলের মধ্যে গেলে দেখাতে পারব। প্রলয় লা’শ উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে দিতে বলল। মিরাজুলের লা’শটা বের করার জন্য মাটি খুঁড়তে শুরু করে দিল। প্রলয় জারিফকে নিয়ে সাঁকো দিয়ে জঙ্গলের ভেতরে গেল। জঙ্গলটা বেশ ভয়াবহ। জঙ্গলের যত গভীরে যাচ্ছে ভেতরটা ততই কেঁপে উঠছে। একজন পুলিশ সদস্য বলল,

–আমাদের সামনের দিকে না আগানোই ভালো হবে স্যার। আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে জঙ্গলের গভীরে যেতে হবে। এভাবে জঙ্গলের ভেতর গেলে আমাদের ক্ষতি হতে পারে। বলা তো যায় না জঙ্গলের কোনো হিংস্র পশু এসে আক্রমণ করল! তখন আমরা কি করব স্যার? পুলিশ সদস্যের কথায় জারিফ শব্দ করে হেসে উঠল। তাচ্ছিল্য করে বলল,

–এই জান নিয়ে পুলিশ হয়েছিস! এই তোকে পুলিশের চাকরি দিয়েছিল কে? আমি যদি তোদের থানায় কাজ করতাম। তাহলে আগে তোকে লা’থি দিয়ে থানা থেকে বের করতাম। তোরা আটজন মানুষ এসেছিস। তা-ও ভয় পাচ্ছিস! আর আমি একা এসেছি তা-ও লাশ কাঁধে নিয়ে। আমার তোকেও আরিয়ানের মতো বুঝাইতে ইচ্ছে করছে। জারিফের কথায় প্রলয় রাগান্বিত হয়ে বলল,

–তুমি কিন্তু আমার কথা ভুলে যাচ্ছো জারিফ। আমার এক ফোনে তোমার বোনের জীবন শেষ। মুহুর্তের মধ্যে জারিফের মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। সে মুখশ্রী গম্ভীর করে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। গভীর অরণ্যের মাঝখানে এসে জারিফ থামলো। চারিদিক থেকে বিশ্রী গন্ধ এসে নাসারন্ধ্রে ঠেকছে। জারিফ সামনের দিকে ইশারা করতেই সবার দৃষ্টি সামনের দিকে গেল। গাছের সাথে রশি দিয়ে আরিয়ানকে ঝুলানো আছে। দু’চরণের মাংস হাঁটুর অবধি নেই। হয়তো কোনো হিংস্র পশুর খাবার হয়েছে। মস্তকের সমস্ত কেশগুলো ঝরে পড়েছে। দেহ থেকে মাংস গুলো খসে পড়তে শুরু করেছে। আঁখিযুগল দু’টি বেড়িয়ে পড়ে গিয়েছে। লা’শে’র দেহ জুড়ে শতশত মাছি ভনভন করছে। কিছু বিষাক্ত পোকা লা’শ টাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। কায়ার হাড্ডি গুলো বের হতে শুরু করেছে। হাতের আঙুল থেকে নখ খসে পড়েছে। পেটের অর্ধেক নাড়িভুড়ি হয়ে আসছে। লা’শে’র বিশ্রী গন্ধে দাঁড়িয়ে থাকা দুষ্কর হয়ে গিয়েছে। প্রলয় সবাইকে নিয়ে একটু দূরে অবস্থান করল। আরিয়ানের এমন ভয়াবহ রুপ দেখে একজন পুলিশ সদস্যের মস্তক ঘুরতে শুরু করল। সে শীতের মধ্যেও তরতর করে ঘামছে। প্রলয় কাউকে ফোন দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে কিছু লোক পাঠাতে বলল। ত্রিশ মিনিট পর কিছু লোক এসে আরিয়ানের লা’শ নামিয়ে নিয়ে শ্মশানের দিকে অগ্রসর হলো। তারা প্রায় সাত ফিটের মতো মাটি খুঁড়ে ফেলেছে। তবুও লা’শে’র দেখা মিলছে না। প্রলয় জারিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–লা’শ কোথায়?

–সবে তো শুরু আরো নিচে যাও ওসি সাহেব।

–আনুমানিক কত ফিট নিতে পুঁ’তে’ছ?

–বিশ থেকে পঁচিশ ফিট হবে। মেপে দেখেনি।

–তোর কলিজা দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।

–অবাক হবার কিছু নেই। তুমি আমাকে কথা দিয়েছ। ফাঁসির আগে মেহেভীনের সাথে কথা বলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। তুমি তোমার কথার বরখেলাপ করলে আমার পরবর্তী টার্গেট তোমার অর্ধাঙ্গিনী আর সন্তান। মৃত্যুর আগে নিষ্ঠুর মনটাকে বুঝিয়ে যেতে পারব। মেহেভীনের সাক্ষাৎ পাইনি তো কি হয়েছে। যে কথা দিয়ে কথা রাখেনি। তার সমস্ত সুখ কেঁড়ে নিতে পেরেছি। আর জারিফ যেটা বলে সেটা করেই ছাড়ে বাকিটা তোমাকে বলে দিতে হবে না।

–প্রলয় কথা দিলে কথা রাখে। প্রলয়ের কথায় জারিফ মৃদু হাসল। কুয়াশাকে গ্রাস করে নিয়েছে একফালি রৌদ্র। আশেপাশেই দু’একজন মানুষ দেখা যাচ্ছে। কিছু সময়ের ব্যবধানের শ্মশানটা মানুষ দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। লা’শ দেখতে ভিড় জমিয়েছে শত মানুষ। এক কান দু’কান করতে করতে আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে গেল খু’নের কথা। বেলা গড়িয়ে দুপুরে হয়ে আসতে শুরু করেছে। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হবার পর লা’শের’ দেখা মিলল। লা’শে’র নাড়িভুড়ি বের হয়ে গিয়েছে। লা’শ পঁচে মাটির সাথে মিশতে শুরু করেছে। লা’শ পঁচা গন্ধে নিচে থাকা দুষ্কর হয়ে গিয়েছে। ওপর থেকে কেরোসিন ফেলা হলো। লা’শে’র ওপরে কয়েক কেজি কেরোসিন ঢেলেও গন্ধ দূর করা গেল না। কয়েকজন তো বমি করে দিল। বাচ্চারা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। একজন কিশোরী লা’শ দেখা মাত্রই জ্ঞান হারালো। এমন ভয়াবহ লা’শ তারা জীবনে দেখেনি। প্রলয় সবাইকে ধমকে দূরে সরতে বলল। সময়ের সাথে মানুষের ভিড় বাড়ছে। কড়া বাক্য গুলো যেন মানুষের কর্ণে যাচ্ছে না। উদ্ধার কর্মীদের মধ্যে একজন সহ্য করতে না পেরে অনবরত বমি করতে শুরু করল। মস্তক রীতিমতো ঘুরছে। সমস্ত কায়া তরতর করে ঘামছে। লা’শ ধরে তুলতে গেলেই গলে গলে খসে পড়ছে। লা’শ তোলার জন্য ওপর থেকে বস্তা ফেলা হলো। সেটার ওপর লা’শ তুলে রশি দিয়ে লা’শ টাকে মুড়িয়ে ফেলল। ওপর থেকে রশি ফেলতেই লা’শটা বেঁধে টেনে ওপরে তোলা হলো। চারদিকে পুলিশ ঘিরে রেখেছে। লা’শে’র আশেপাশে কাউকে আসতে দিচ্ছে না। সবাই শোরগোল শুরু করে দিল। লা’শ দু’টো গাড়িতে তুলে জারিফকে নিয়ে দ্রুত স্থান করল প্রলয়।

বিষাদে ভরপুর মুহুর্ত গুলো ভিষণ দীর্ঘ হয়। কিন্তু সুখ! সুখ জিনিস টা এমন কেন? দমকা হাওয়ার মতো আসে আবার সুখের স্থানটাতে দুঃখ পুষিয়ে দিয়ে সুখ কেঁড়ে নিয়ে চলে যায়! সুখ শব্দটা যেমন সুন্দর তার স্থায়িত্ব তেমনই ক্ষণিকের জন্য হয়। কিন্তু দুঃখ শব্দটা যেমন বিষাক্ত তার স্থায়িত্ব তার থেকে-ও দীর্ঘ হয়। এই যে মানুষ বলে আমাকে হয়তো সুখে মানায় না। আমি দুঃখ নিয়েই আছি বেশ। তবে দুঃখ গুলো কি মানুষের চাওয়া-পাওয়া গুলোকে আদরে গ্রহণ করে নিল। দুঃখের চেয়ে সুখের পরিমাণ বেশি হলেই যে, দুঃখ আমাদের জীবনে পোড়াতে চলে আসে। মুনতাসিম রাজনৈতিক আলোচনায় মশগুল ছিল। তখনই মুঠোফোনেটা অনবরত বেজেই যাচ্ছে। মুনতাসিম বিরক্ত হয়ে ফোনটা তুলতেই ওপর পাশ থেকে কিছু বিষাক্ত বাক্য মস্তিস্কে এসে বাসা বাঁধল।

–আমি আজকে আত্নসমর্পণ করে ফেলব। আমি আর পারছি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এভাবে থাকলে আমি নিজের ক্ষতি নিজে করে ফেলব। আমায় তুমি ক্ষমা করে দিও। তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে পারলাম না।

–আপনি এমনটা করতে পারেন না। আপনি আমায় কথা দিয়েছিলেন। আপনাকে তো আমি বলেছি। আপনি আমাকে তিনমাস সময় দিন। আমি সবকিছু ঠিক করে দিব।

–আমি তিনটা সেকেন্ডে তিনবার করে মরছি। তিনটা মাস কিভাবে বাঁচব বলো? আমায় তুমি মাফ করে দিও। আমার ফুল টাকে দেখে রেখো। আমার খুব যত্নে তৈরি করে ফুল সে। তাকে আঘাত করলে পরকালে হিসাব নিব। ভালো থাকবে এবং তার খেয়াল রাখবে। কথা গুলো বলেই ফোনটা রেখে দিল। মুনতাসিম অনবরত ফোন করেই যাচ্ছে। কিছু সময়ের ব্যবধানের ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। জীবনে কোনোদিন সে এমন ভাবে দিশেহারা হয়নি। আজ যেভাবে সে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। মুনতাসিম চিৎকার করে বলল,“আপনি বেইমান। আপনি আমায় কথা দিয়ে কথা রাখলেন না। আপনি আমায় কোনোদিন ভালোই বাসেননি। যদি ভালোবাতেন। তাহলে আমার সুখ কেঁড়ে নেওয়ার আগে আপনার বুক কাঁপত। আপনি কিভাবে পারলেন এতটা স্বার্থপর হতে? আপনি তো এমন ছিলেন না! আমাকে গুছিয়ে ওঠার সময়টা দিয়েও কেঁড়ে নিলেন? আপনি যেমন আমার কাছে হিসাব চাইবেন। পরপারে আমাদের দেখা হলে আমার সুখ কেঁড়ে নেওয়ার হিসাবটাও আমি আপনার থেকে চেয়ে নিব।”

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে