#খোলা জানালার দক্ষিণে
#পর্ব_৪৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
অর্ধবুজা আঁখিযুগল নিয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে মেহেভীন। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। মুনতাসিম কক্ষে এসে টাকা গুনছে। দু’জনের মাঝে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। মেহেভীন নিদ্রায় তলিয়ে যেতে চাইলেই, মেহেভীনের হাত ধরে তুলে বসিয়ে দিচ্ছে মুনতাসিম। বিরক্ততে ললাটে কয়েক জোড়া ভাজ পড়লো মেহেভীনের। মেহেভীন দেওয়ালের সাথে মস্তক ঠেকিয়ে আঁখিযুগল বন্ধ করল। তখনই কর্ণকুহরে এসে মুনতাসিনের কণ্ঠ স্বর পৌঁছাল। মেহেভীন আঁখিযুগল মেলে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল।
–এই নিন দেনমোহরের টাকা। এগুলো আমার কালকেই বুঝিয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল। আমি সময় মতো দিতে পারিনি। তার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। এগুলো গ্রহণ করুন আর আমার পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে, মনের অন্তরালে কোনো অভিযোগ রাখবেন না।
–এগুলো কি আমি চেয়েছি? এগুলো তো পরে-ও দিতে পারতেন। আজ কয়েকটা দিন হলো আমার ঘুম হয়নি ভালো করে। আমাকে ঘুমোতে দিলেই পারতেন।
–এগুলো চাইতে হবে কেন? এগুলো আপনার প্রাপ্য অধিকার। সেটা যথাযথ ভাবে আপনার হাতে তুলে দেওয়া আমার দায়িত্ব। এবার টাকা গুলো সব গুনে নিন দেখুন তো সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না?
–গুনতে হবে না রেখে দিন আপনি।
–টাকা-পয়সার ব্যাপার টা ভিষণ খারাপ ম্যাডাম। আপনার যতই কাছের মানুষ হোক না কেন? আপনি সর্বদা টাকা-পয়সা লেনদেন করার সময় গুনে নিবেন।
–এখন নিজের জীবন বাঁচানো বাদ দিয়ে টাকা গুনতে শুরু করব! পরে দেখা গেল টাকা গুনতে গুনতে আমি ক’ব’রে চলে গিয়েছি। মেহেভীনের একটা বাক্য মুনতাসিমের হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল। অজানা যন্ত্রনায় ভেতরটা ছটফট করছে। বিষণ্ণ আঁখিযুগল মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের বিষন্ন মাখা মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টি পড়তেই মেহেভীনের নিদ্রা উবে গেল। সে আন্দাজ করতে পারছে মুনতাসিম রেগে গিয়েছে। মানুষটা তার সাথে রেগে গেলে একদম নিশ্চুপ হয়ে যায়। মেহেভীন মনে কিছুটা ভয় আর বাহিরে স্বাভাবিক মুখভঙ্গি করে মুনতাসিমের হাত থেকে দ্রুত টাকা গুলো নিয়ে নিল। সেগুলো নিজের ব্যাগে রেখে এসে বলল,
–আমি সকালে টাকা গুলো গুনে নিব। আজকে ঘুমাই টাকা কম পেলে জানাব। কথা গুলো বলেই মেহেভীনের আস্তরণের এক কোণে গিয়ে শুয়ে পড়লো। কাল রাতে নতুন জায়গায় তার ঘুম আসছিল না। আজ হঠাৎ মুনতাসিমকে দেখে রাজ্যের সমস্ত নিদ্রা এসে তার আঁখিযুগলে ধরা দিয়েছে। কিন্তু মুনতাসিমের বিষণ্ণ মুখশ্রী ভিষণ পোড়াচ্ছ তাকে। মুনতাসিম কক্ষের আলো নিভিয়ে নিজেও শুয়ে পড়লো। সে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। মৃত্যুর মতো চিরন্তন সুন্দর সত্য ধরনীর বুকে দু’টো নেই। মৃত্যু হবে জেনেও আমরা ভালোবাসি। মৃত্যুর কাছে ভালোবাসার হার নিশ্চিত জেনেও, আমরা প্রিয়জনকে হারাতে ভয় পাই। প্রিয়জনকে আঁকড়ে ধরে রাখার বিথা চেষ্টা করি। প্রিয়জনের মৃত্যুর কথা কর্ণপাত হতেই আমাদের সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে। চিরন্তন সত্যটা মেনে নিতে বুকের ভেতরটায় অসহনীয় জ্বালা পোড়া করে। মনের গহীনে হাহাকার করে ওঠে। প্রিয়জন হারানোর ভয় মানুষকে নিরব করে তোলে। মনের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল মুনতাসিমের। আগে যে মানুষটা মৃত্যুর পরোয়া কোনোদিন করেনি। বিপদ হবে জেনেও সেই সকল স্থানে গিয়েছে। যার না ছিল কোনো পিছুটান। আজ সেই মানুষটা কাউকে হারানোর ভয়ে কাবু হয়ে গিয়েছে। মেহেভীনের বলা বাক্য গুলো স্মরন হতেই ভেতরটা ভিষণ জ্বালাপোড়া করছে। মেহেভীনকে দু’টো কড়া কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। এত সুন্দর মুহূর্তটাকে বিষিয়ে না তুললেই হতো না। ক্রোধে চোয়াল শক্ত হয়ে এল তার। দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করছে। মুনতাসিমের জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার শব্দ মেহেভীন অনুভব করতে পারছে। জড়তার কারণে মুখশ্রী দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারন হচ্ছে না। দু’জন দুই দ্বিপের ন্যায় উল্টো দিকে শায়িত আছে। পিনপতন নিরবতার দেওয়াল ভেঙে মেহেভীন বলল,
–আপনি আমার কথায় রাগ করেছেন?
–না।
–আমি আসলে মজা করে বলেছি। আপনি সিরিয়ালি নিয়ে নিবেন ভাবতে পারিনি! তাছাড়া সবাইকেই তো একদিন চলে যেতে হবে। এটা বললে রাগ করার কি আছে?
–আপনার ঘুম পেয়েছে, আপনি ঘুমান। মেহেভীন কোনো বাক্য উচ্চারন করল না। কয়েকদিন ধরে কায়ার ওপর দিয়ে ভিষণ ধকল গিয়েছে। কিছু সময়ের ব্যবধানে মেহেভীন নিদ্রা দেশে তলিয়ে গেল। মেহেভীন নিদ্রা যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মুনতাসিম ও নিদ্রা চলে গেল।
প্রভাতের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। গাছের মগড়াল থেকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ কর্ণকুহরে ভেসে আসছে। সেই শব্দে নিদ্রা ভেঙে যায় মেহেভীনের। এত পাখি এল কোথায় থেকে? কর্ণ একদম ঝালাপালা করে দিল। মেহেভীন আঁখিযুগল মেলতেই মুনতাসিমের স্নিগ্ধ মুখশ্রী খুব কাছ থেকে দেখতে পেল। সে অনুভব করল কারো শক্ত হাতের বাঁধনে সে আবদ্ধ রয়েছে। মুনতাসিম তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। মুনতাসিমকে এত কাছে থেকে দেখে, মেহেভীনের হৃদস্পন্দনের গতিবেগ অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেল। অদ্ভুত এক ভালো লাগার সংমিশ্রণের ভেতরটা সুখানুভূতিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মুনতাসিমের অবাধ্য কেশ গুলো ললাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মেহেভীন এক হাত বের করে সেগুলো যত্ন সহকারে সরিয়ে দিল। আচমকা মুনতাসিম আঁখিযুগল মেলে তাকালো। আকষ্মিক ঘটনায় মেহেভীন থতমত খেয়ে গেল। সে বিলম্ব না করে দ্রুত আঁখিযুগল বন্ধ করে নিল। মুনতাসিম ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল,
–আপনার অভ্যাসটা ভিষণ খারাপ! এভাবে আঁখিযুগল দিয়ে ঘুমন্ত মানুষের সর্বনাশ করছেন৷ আপনি জানেন না। আমার বউ আছে। এখন আমি আমার বউয়ের সামনে মুখ দেখাব কি করে? আর অভিনয় করে লাভ নেই। আমি দেখেছি আপনি সজাগ হয়েছেন। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন গম্ভীর দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। সে কণ্ঠে গম্ভীরতা বজায় রেখে বলল,
–আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছেন কেন? আমাকে জড়িয়ে ধরার আগে বউয়ের কথা মনে পড়েনি? আমাকে ছাড়ুন বলছি!
–কে বলেছে আমি জড়িয়ে ধরেছি? আমার মতো মানুষ কোনো নারীকে জড়িয়ে ধরতেই পারে না! আপনি রাতে আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন।
–মিথ্যা কথা, আমার কাউকে জড়িয়ে ধরার অভ্যাস নেই।
–কিন্তু আমার আছে। কোলবালিশ ভেবে ধরে ফেলেছি। এত ভাব নেওয়ার কিছু নেই। এমনিতেই আপনাকে ছোঁয়ার ইচ্ছে আমার নেই।
–অথচ আমাকে ছুঁয়ে আছেন! হাত সরান আমি বাড়ি যাব। মেহেভীনের কথায় মুনতাসিমের আঁখিযুগল বিস্ময় হয়ে গেল। সে সহজ-সরল মুখভঙ্গি করে জবাব দিল,
–আমার রাগিনীর রাগ আমার ভিষণ প্রিয়। রাগিনীকে রাগাতে আমি ভিষণ আনন্দ পাই। রাগিনী রাগ করলে সমস্ত মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করে, তখন আমার রাগিনীকে এত্ত গুলো ভালোবেসে দিতে ইচ্ছে করে। আপনি রাগ করছেন কেন? আমি তো আপনার সাথে মজা করছিলাম৷ তাই বলে আপনি আমাকে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার হুমকি দেখাবেন!
–আমি আপনাকে হুমকি দেখাচ্ছি না। আপনি কালকে মাকে কি বলেছিলেন? সেটা আপনার মনে নেই! মুনতাসিম নিষ্পলক চাহনিতে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের আঁখিযুগল জুড়ে আজ শুধুই মুগ্ধতা। সুখ গুলো আর মুনতাসিমের হৃদয়ে ধরা দিয়েছে। আজ বিষাদ সুখকে নয় সুখে বিষাদকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে ফেলছে। ধরনীর বুকে নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে হচ্ছে মুনতাসিমের। সে প্রসন্ন মন নিয়ে মেহেভীনকে বলল,
–পাশ ফিরলেই আপনাকে দেখতে পাব। এমন একটা দিনের জন্য আমি কতগুলো প্রহর অপেক্ষা করেছি। আমার অপেক্ষার ফল সার্থক হয়েছে। ধমনীর বুকে সবচেয়ে সুখী মানুষটা হচ্ছে আমি। আপনাকে দেখলে আমার ভেতরের দুঃখ গুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই যে আপনি আমায় সুখ এনে গুলো দিলেন। এই সুখ কোনো কেঁড়ে নিয়েন না। যদি কখনো আমার প্রতি কোনো অভিযোগ আসে মনে, তবে নির্দ্বিধায় বলে দিবেন। আমি অভিযোগ করার সুযোগ রাখতে দিব না। আপনি আমার পাশে থাকলে, আমি আপনাকে হৃদয়ের গুপ্ত কুঠুরিতে আগলে রাখব। আমি কখনোই চাইনি আমাদের মাঝে প্রেম হোক। কারন প্রেমে বিচ্ছেদ হয়। আমি সব সময় চেয়েছি আপনি আমায় ভালোবাসুন। আমার মায়ায় জড়িয়ে যান। ভালোবাসায় কখনো বিচ্ছেদ হয় না। আর মায়া কখনো কাটানো যায় না। আমি আপনাকে হালাল ভাবে চেয়েছি বলেই আপনার থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলেছি, কারন হারামে আরাম নেই। সেজন্য বোধহয় আমাদের মাঝে মনমালিন্য হতো। আমি একদম বিয়ের দিন আপনার সামনে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনার বিপদের কথা শুনে স্থির থাকতে পারিনি। বিয়ের মতো সুন্দর আর পবিত্র জিনিস দু’টো নেই। যখন থেকে কবুল বলেছেন। আমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তখন থেকেই আপনার আঁখিযুগলে আমার জন্য মুগ্ধতা দেখেছি। আগে আমি রাগ করলে কষ্ট পেলে আপনাকে দ্বিগুন যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখিনি। কিন্তু কালকে আমি আপনাকে আমার জন্য ভয়ংকর ভাবে পুড়তে দেখেছি৷ এরপরেও আপনার প্রতি আমার রাগ জমে থাকতে পারবে? আপনাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার ইচ্ছেটা যে আরো দ্বিগুন ভাবে বেড়ে গেল ম্যাডাম। এতক্ষণ মুনতাসিমের কথা গুলো মনযোগ দিয়ে শুনছিল মেহেভীন। আজকাল মুনতাসিমের সবকিছুই তার ভালো লাগে। কবুল বলার পর থেকে আলাদা একটা টান তৈরি হয়েছে মুনতাসিমের প্রতি। যেটা আগে তার কখনোই ছিল না। হালাল জিনিস হোক বা সম্পর্ক সেটা সব সময় সুন্দর হয়। তা মেহেভীন বিয়ের পর থেকেই উপলব্ধি করতে পারছে। মেহেভীনের মুখশ্রীতে স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে। মেহেভীন নরম কণ্ঠে বলল,
–আপনি অনেক সুন্দর কথা বলতে পারেন। এভাবে সবার সাথে কথা বললে, প্রতিটি মানুষ আপনার ওপর দুর্বল হয়ে পড়বে। সত্যি করে বলুন কতজনকে এভাবে গিলিয়েছেন? আল্লাহ তায়ালা আপনাকে দারুন একটা ক্ষমতা দিয়েছে। আপনি খুব সহজে মানুষের মনের গভীরে চলে যেতে পারেন।
–আপনার মনের গভীরে কতটা গিয়েছি ম্যাডাম?
–মনের গভীরে তো দূর মনের ধারে কাছেও আসতে পারেন নি স্যার। এবার উঠে তৈরি হয়ে নিন৷ সবাই বলবে নতুন বউয়ের লজ্জা নেই। কত বেলা হয়ে গিয়েছে এখনো ঘুমোচ্ছে। মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য মনটা ভিষণ ছটফট করছে।
–আমার কাছে থাকতে ভালো লাগছে না? মেহেভীন উত্তর দিল না৷ মুহুর্তের মধ্যে মেহেভীনের মুখশ্রী মলিনতায় ছেয়ে গেল। মেহেভীনের মলিন মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে মুনতাসিম বলল,
–আমি নিয়ে যাব। তবে আমার একটা শর্ত আছে।
–কি শর্ত?
–আপনি দু’দিনের বেশি থাকতে পারবেন না।
–কেন? আমি তো ভাবছি সাতদিন থাকব। আমাদের দু’জনের গৃহের দুরত্ব তো খুব একটা বেশি না!
–তাহলে যেতেই দিব না। আমি বউ ছাড়া থাকতে পারব না।
–এতদিন কিভাবে থেকেছেন?
–এতদিন বউ ছিল না। এখন বউ হয়েছে। আগেকার ব্যাপার আর এখনকার ব্যাপারের অনেক তফাৎ আছে।
–বিয়ে করার সাথে সাথে আপনার মস্তকটাও গিয়েছে। কেমন ছোট বাচ্চাদের মতো আরচণ করছেন! কথা গুলো বলেই মেহেভীন উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল। মুনতাসিম কম্বল মুড়ি দিয়ে মুখশ্রী ঢেকে ফেলল। আজকে তার কিছুতেই আস্তরণ ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। দীর্ঘদিন পরে সে প্রশান্তিতে ঘুমিয়েছি। ভেতরটা আজ আনন্দে মনের শহরের অলিতে-গলিতে মিছিল করছে।
আজ চারদিন হলো মেহেভীন মায়ের কাছে এসেছে। মাকে একা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। এদিকে মুনতাসিম ও রাগ করে আছে। রাইমা বেগম বুঝিয়ে বলাতে মেহেভীন আজকে চলে যাবে। মায়ের কোলে মস্তক রেখে মেহেভীন শায়িত আছে। রাইমা বেগম মেহেভীনের মস্তকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
–আব্বু থাকলে দু’দিন আগেই চলে যেতাম। আব্বু নেই সেজন্য তোমাকে একা রেখে যেতে ভয় লাগছে আমার৷ এদিকে উনিও রাগ করে আছেন। আজকাল উনি রাগ করলে, কষ্ট পেলে আমার ভেতরটা ভিষণ পুড়ে জানো আম্মু। আমি সহ্য করতে পারি না৷ উনি ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকি। উনার রাগের কাছে হার মেনেই যেতে রাজি হয়েছি। আরো তিনটা দিন থাকার ইচ্ছে ছিল। রাইমা বেগম মেয়ের কথায় মুচকি হাসলেন৷
–স্বামী জিনিস হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। তাকে ভালোবাসতে জানলেই তার ভালো থাকা, খারাপ থাকার ওপরে নির্ভর করে স্ত্রীর ভালো থাকা, খারাপ থাকা। সেখানে ভালোবাসা আছে। সেখানে কষ্ট থাকবে স্বাভাবিক। ভালোবাসলেই পুড়তে হবে। ভালোবাসার পরে-ও যদি কেউ না পুড়ে। তাহলে সেখানে কখনোই ভালোবাসা ছিল না। মুনতাসিম ছেলেটা ভিষণ ভালো।ছেলেটাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখিস৷ নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখিস৷ ধরনীর সবচেয়ে সুখী আর ভাগবতী নারীটি হবি তুমি। মুনতাসিমের মনটা রাজার মতো। আমি জানি সে তোকে রানীর মতো করে রাখবে। বিয়ের মতো পবিত্র জিনিসটা এমনই হয়। যার প্রতি কোনোদিন কোনো টান ছিল না৷ সে ভালো থাকলেই কি বা খারাপ থাকলেই কি? তাতে আমাদের কোনো যায় আসত না। বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবার পরে, মানুষটার প্রতি টান আপনা-আপনি চলে আসে। মানুষটার সবকিছু অদ্ভুত ভাবে ভালো লাগতে শুরু করে। মানুষটাকে আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত জানতে ইচ্ছে করে। রাইমা বেগমের কথা শেষ হবার সাথে সাথে কলিং বেল বেজে উঠল। মেহেভীন উঠে বসলো। মুনতাসিম চলে এসেছে। মেহেভীন ব্যাগ নিয়ে কক্ষ থেকে বের হলো। সারাদিন সে কাজে ব্যস্ত থাকে বলেই রাতে মেহেভীনকে নিতে এসেছে। মুনতাসিম রাইমা বেগমের সাথে কুশল বিনিময় করল। মুনতাসিম আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। তখনই রাইমা বেগম আঁখিযুগল দিয়ে ইশারা করতেই দু’জন বিদায় নিয়ে চলে গেল।
ঘড়ির কাঁটায় রাত একটা ছুঁই ছুঁই। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবে মাত্র মাত্র কক্ষে এসেছিল মুনতাসিম। তখনই মুঠোফোনটা টুং করে বেজে উঠল। সে ফোনটা নিয়ে দেখল অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। ইনবক্সে একটা ভিডিও পাঠিয়েছে কেউ। ভিডিওটা ওপেন করতেই মুনতাসিমের সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। চিন্তায় মস্তক ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। ভয়ংকর কিছুর আভাস পাচ্ছে সে। এই ঝাড়ের সাথে সে কিভাবে মোকাবেলা করবে? নিজেকে ভিষণ দুর্বল লাগছে তার। অদ্ভুত ভাবে হাত কাঁপছে। শীতের মধ্যেও কর্ণ বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। তবে কি সত্যি টা সামনে চলে আসার সময় এসে গিয়েছে। কথা টা ভাবতেই রুহু কেঁপে উঠল তার। সে চারিদিকে হাহাকার দেখতে পাচ্ছে। কিছু তিক্ত সত্য আনন্দ শুষতে শুরু করে দিয়েছে। মুনতাসিমের ভাবনার মাঝের মেহেভীন কক্ষে প্রবেশ করল। মেহেভীনকে দেখেই মুনতাসিম দ্রুত ফোনটা লুকিয়ে ফেলল।
চলবে…..
#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪৪
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
মেহেভীন আড়দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিম মনোমুগ্ধকর হাসি হেসে বেলকনিতে চলে গেল৷ মুনতাসিমের এমন ব্যবহারে মেহেভীনের ভ্রুযুগল কুঁচকে গেল। মেহেভীন সন্দিহান দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে চেয়ে আছে। মুনতাসিমের হাত অদ্ভুত ভাবে কাঁপছে। নিজের প্রতি নিজেরই ভিষণ বিরক্ত লাগছে। জীবনে এত কঠিন কঠিন কাজ সে করেছে। কিন্তু কোনোদিন এতটা ভয় পাইনি। যতটা ভয় সে মেহেভীনের সামনে পায়!
–আপনার ফোনটা দিন তো।
–আমার ফোন নিয়ে, আপনি কি করবেন?
–আমি কি আপনার ফোন দেখতে পারি না?
–অবশ্যই পারেন। কথা গুলো বলেই ফোনটা এগিয়ে দিল। মনের মধ্যে অস্থিরতার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে ভীরু দৃষ্টিতে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীন কিছু একটা দেখে ফোনটা এগিয়ে দিল। মেহেভীনের মুখশ্রী দেখে বোঝা যাচ্ছে না। সে কোনো কিছু দেখেছে কি না। সে অপেক্ষা করতে পারল না৷ সে নিজেই গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–একে তো আমার কথা রাখেননি। তার ওপরে আজকে এসেই আমার ফোন নিয়ে টানাটানি করছেন! আপনার সমস্যা কি হ্যাঁ?
–আপনি রাগ দেখাবেন, ভালো ভাবে দেখান। এভাবে তোতলানোর কি আছে? অন্যদের সাথে তো ঠিকি গর্জন করে উঠেন। কথা গুলো বলেই মেহেভীন কক্ষে চলে গেল। মুনতাসিম দ্রুত ফোন চেক করল। ভিডিওটা ডিলিট করে দেওয়ার হয়েছে। এটা দেখেই মুনতাসিম স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।
রজনীর শেষ প্রহর চলছে। সবাই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে। মুনতাসিম আঁখিযুগল মেলে তাকালো। পাশে তাকিয়ে দেখলো। মেহেভীন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সে ফোনের আলো জ্বালিয়ে উঠে বসলো। গায়ে কালো রঙের চাদর মুড়িয়ে কবাটের কাছে আসতেই মেহেভীনের নিদ্রা মিশ্রিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল,
–এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন? মেহেভীনের বাক্য গুলো কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই থেমে যায় দু’টি চরণ। মুহুর্তের মধ্যে মুনতাসিমের মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে গেল। বুদ্ধিরা জোট বেঁধে পালাতে শুরু করেছে। ভেতরটা ধীরে ধীরে শূন্য হয়ে আসতে শুরু করেছে। মুনতাসিম নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। কণ্ঠে গম্ভীরতা এনে বলল,
–আপনি ঘুমান নি?
–ঘুমিয়ে ছিলাম। আমার কথায় পরে আসুন। আগে আপনি বলুন। এতরাতে আমাকে না জানিয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন?
–আমার প্রয়োজন পড়েছে, তাই যেবে হবে। আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন। তাই জানাতে পারিনি। সব কথা কিছুর কৈফিয়ত আপনাকে দিতে হবে!
–হ্যাঁ হবে একে তো মাঝরাতে উঠে বাহিরে বের হয়ে যাচ্ছিলেন। আবার আমাকেই উল্টো রাগ দেখাচ্ছেন! আপনি আর এখন একা নন। আপনার জীবনের সাথে আমার জীবনটা জড়িয়ে গিয়েছে। আপনার কিছু হলে আপনার থেকে আঘাতটা আমার বেশি লাগবে। এখন থেকে কোথাও গেলে আমাকে কৈফিয়ত দিয়েই যেতে হবে। মেহেভীনের কথায় মুনতাসিমের সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। এখন সে কি করবে? মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিম কথা বাড়ালো না। সে দ্রুত আস্তরণে এসে শুয়ে পড়লো। মেহেভীন বিরক্ত মাখা মুখশ্রী করে মুনতাসিমের দিকে চেয়ে থাকলো। মাঝেমধ্যেই মুনতাসিম এমন আচরন করে, কিছু বললেই চুপ হয়ে যায়। মেহেভীন হতাশ হয়ে আঁখিযুগল বন্ধ করল।
চারিদিকে প্রভাতের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দে মেহেভীনের নিদ্রা ভেঙে যায়। সে উঠে বেলকনিতে আসে। আজকে সে দেখেই ছাড়বে। এত পাখির ডাক কোথায় থেকে আসে? সে বেলকনিতে আসতেই দৃষ্টি যায় গৃহের পেছনের দিকে বিশাল ফলের বাগানের দিকে। যেখানে নানারকমের ফলের গাছ লাগানো রয়েছে। সেখানে কিছু কিছু গাছে লোভনীয় ভাবে ফলে পেকে আছে৷ মেহেভীন ফ্রেশ হয়ে নিচে আসলো। এই গৃহটা দূরে থেকেই দেখেছে সে। তার কোনোদিন কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আজকে সে গৃহের চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখবে।
–এত সকালে কোথায় যাবে ভাবি? শেহনাজের কথায় মেহেভীন হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,
–আমাদের কক্ষের পেছনে ফলের বাগান দেখলাম। সেখানে অনেক রকমের ফল পেকে আছে। আমার দেখে ভিষণ লোভ লাগছে। আমি গিয়ে পেরে নিয়ে আসি।
–সর্বনাশ! ওটা তো ভাইয়ের বাগান। আমাদের কাউকে যেতে দেয় না। কেউ যদি ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া বাগানে প্রবেশ করে, তাহলে ভাইয়া গৃহে তান্ডব চালানো শুরু করে দেয়। ভাইয়া বাগান টা খুব শখ করে তৈরি করেছে। ভাইয়ার চিন্তাধারা অনুয়ায়ী বাগানের ফল গুলো নাকি পাখি খাবে। ভাই পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে ভিষণ পছন্দ করে। রোজ প্রভাত বেলায় পাখির কিচিরমিচির শব্দে ভাইয়ের নিদ্রা ভাঙে। আমাদের কাউকে ফল খেতে দেয় না ভাইয়া। ঐ বাগান নাকি শুধু পাখিদের জন্য বরাদ্দ আমাদের জন্য না। কথা গুলো বলতে বলতে শেহনাজের মুখশ্রী মলিনতায় ছেয়ে গেল। শেহনাজের কথায় বিস্ময় হলো মেহেভীন। সে বিস্ময় কণ্ঠে বলল,
–তোমাদের ফল পেরে খেতে ইচ্ছে করে না?
–আমি যে পরিমাণ ফল খেতে ভালোবাসি। বাগানে যাবার অনুমতি থাকলে, এই লোভনীয় ফল গুলো এতদিন বাগানে থাকতো!
–উনি কোনোদিন একটা ফলও বাসার কাউকে দেয় না?
–দেয়, তবে বছরে একবার। ভাইয়ের মন চাইলে তবেই দেয়।
–আমার সাথে চলো। আজকে তোমার ভাইয়ের বাগানে দু’টো নতুন পাখির আগমন ঘটবে।
–আমি যাব না ভাবি। আমার এত সাহস নেই। তুমি গিয়ে নিয়ে এসো। আমার জন্য কয়টা লাল পেয়ারা পেরে নিয়ে এসো। আমার অনেক দিন ধরে খেতে ইচ্ছে করেছে। আমি ভয়ে যেতে পারি না। শেহনাজের কথায় মেহেভীন হাসলো৷ সে বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে বাগানের দিকে চলে গেল। কাঁচা-পাকা ফল দেখে মেহেভীনের ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে গেল৷ মহান আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি অপরুপ সুন্দর। দেখলই সমস্ত মন মস্তিষ্ক শীতল হয়ে যায়। ভেতরে স্নিগ্ধ অনুভূতি কাজ করে।
অন্ধকারে আচ্ছন্ন কক্ষে মুনতাসিমের অপেক্ষায় বসে আছে যুকব। মুখশ্রীতের তার প্রশান্তির হাসি বিদ্যমান। আজকে নিজেকে ভিষণ করে সার্থক বলে মনে হচ্ছে তার। জীবনে প্রথম সে মুনতাসিমের ভেতরে ভয় প্রবেশ করাতে পেরেছে। আনন্দে তার ভেতরটা শান্তি অনুভব করছে। সে আয়েশি ভঙ্গিতে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত। তখনই মুনতাসিম হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। যুবককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কলার চেপে ধরলো। মুহূর্তের মধ্যে সে নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গেল। যুবককে প্রহার করতে করতে যুবকের নাক দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করল। তবুও আজ যুবক রাগলো না। সে আজ মুনতাসিমের ব্যর্থতা দেখতে পাচ্ছে। আঁখিযুগলে প্রেয়সীকে হারানোর ভয় দেখতে পাচ্ছে সে। এই দিন টা দেখার জন্য সে কত গুলো প্রহর অপেক্ষা করেছে। সে তাচ্ছিল্য করে বলল,
–তুই আমাকে মে’রে ফেললেও সত্যিটা আড়াল করতে পারবি না মুনতাসিম। আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সাথে সাথে ভিডিওটা সোশ্যাল মিডিয়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে। জনগণ দেখবে আর ধিক্কার জানাবে। আর তোর মেহেভীন! তুই তোর মেহেভীনকে কিভাবে সামলাবি? এতকিছুর পরে-ও মেহেভীন বাঁচতে পারবে তো। তোর সামনে তোর প্রেয়সীর প্রাণহীন দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকবে। তখন তোর কেমন লাগবে? ব্যাপারটা অনেক জোস হবে তাই না। প্রকৃতি ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয় না। আমি যেভাবে প্রতিনিয়ত পুড়েছি। তার থেকে দ্বিগুন ভাবে তুই পুড়বি। তোর বিধস্ত রুপ আমাকে তৃপ্তি দিবে। মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে যুবকের মস্তকে বন্দুক ধরলো। বজ্রকণ্ঠে বলল,
–মুনতাসিম কোনোদিন হারতে শিখেনি। তুই কি ভেবেছিস? তোর দেওয়া সামান্য একটা ভিডিও দেখে মুনতাসিম ভয়ে কাবু হয়ে যাবে। তোর মতো কত-শত চুনোপুঁটিকে আমি শায়েস্তা করেছি। তুই আমার কাছে কিছু না। আব্বার দয়ায় বেঁচে আছিস৷ তুই না হয় আমাকে আর মেহেভীনকে আলাদা করবি। আমি পুড়তে পুড়তে কয়লা হয়ে যাব। আমার কয়ার সমস্ত হাড় গুলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। আমার এমন করুন অবস্থা দেখে, তোর প্রতিশোধের জ্বলন্ত আগুন শীতল হয়ে গেল। কিন্তু তোর যে বোন তোকে সাহায্য করছে। তার ছোট্ট দেহটা যদি কেউ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে চলে যায়। একদল নরপশু তার নরম দেহটা শেয়াল কুকুরের মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়ে নদীতে ফেলে দেয়। তোর বোন নামক অস্তিত্ব ধরনীর বুকে গায়েব হয়ে গেল। তখন তোর কেমন লাগবে? নাকি খ’ন্ড খ’ন্ড করে তোর কাছে পাঠাব বল? আচ্ছা আগের সব পরিকল্পনা বাতিল। তুই আমাকে যতটুকু ভাঙবি। আমি তোর বোনকে সেই কয় পি’স করব। যখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না৷ তুই ক্ষুদার জ্বালায় কাতরাবি। তখন আমি তোর বোনের পি’স করা অংশ গুলো তোর খাদ্য হিসেবে পাঠাব। ব্যাপার টা অনেক জোস তাই না বল ভাই! মুনতাসিমের কথায় সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল যুবকের। সমস্ত কায়া থরথর করে কাঁপছে। হাসোজ্জল মুখশ্রীটা মুহুর্তের মাঝে বিষাদগ্রস্ত হয়ে উঠল। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। সে কেন বারবার মুনতাসিমের কাছে হেরে যায়। মুনতাসিমের বলা প্রতিটি বাক্য যুবকের রুহু কাঁপিয়ে তুলেছে। ভয়ে সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসতে শুরু করেছে। কালকে সঞ্চয় করা সমস্ত শক্তি নেতিয়ে পড়েছে। সে নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,
–অমানুষ একটা! এসব কথা বলতে তোর বুক কাঁপল না? তোর মতো জা’নো’য়া’রে’র বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। তুই ম’রে যেতে পারিস না। তুই ম’রে গেলে আমি একটা সুস্থ জীবন কাটাতে পারতাম। তোর জন্য আমার সবকিছু ধংস হয়ে গিয়েছে। তোকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করব না। আমার বোনের কায়াতে একটা ফুলের টোকা পড়লে, তোকে আমি জ্যান্ত পুঁতে ফেলব।
–কালকে রাতে আমাকে ভিডিও দেওয়ার সময় তোর বুক কাঁপেনি? তোর বুদ্ধি কি হাঁটুতে থাকে? আমাকে ভিডিও টা দেওয়ার আগে তোর মনে হয়নি। আমি কাকে মিছে ভয় দেওয়ানোর চেষ্টা করছি৷ মুনতাসিম কাউকে ভয় পায় না। যে মুনতাসিমকে কাবু করতে আসবে। সে নিজেই ধরনীর বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তোর বোনের বুক কাঁপে না। আমাকে প্রতিনিয়ত মা’রা’র প্রচেষ্টা করেই যাচ্ছে। আমি সবকিছু জেনেও তাকে ক্ষমা করছি। যেদিন আমার হৃদয়ে আঘাত পড়বে আল্লাহর কসম বাঁচতে পারবে না। নিজের বোনকে সাবধানে থাকতে বলিস। কথা গুলো বলেই যুবকের বুকে লা’থি মা’র’ল মুনতাসিম। যুবক আহত দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিম গর্জন করে বলল,
–এই কু’লা’ঙ্গা’রে’র বোন আসলে এবার আর ছেড়ে দিবি না। রক্তাক্ত করে আমাকে ফোন দিবি। বারবার এই ঝামেলার কাছে আসতে আমার ভালো লাগে না। আমার কাজের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায়। আমাকে মন্ত্রী সভায় যেতে হবে। আমার সাথে প্রতারণা করার চেষ্টা করলে, কাজে প্রামাণ দেখিয়ে দিব কি হয়। এই জা’নো’য়া’র’কে দু’দিন খেতে দিবি না। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম স্থান ত্যাগ করল। যুবক ব্যর্থ হয়ে নিজেই নিজেকে প্রহার করতে লাগলো। এ জীবনের সে মুনতাসিমের হার দেখতে পাবে না। পরের জন্ম বলে যদি কিছু হয়। তাহলে সে পরের জন্মে মুনতাসিমের থেকে শক্তিশালী হয়ে জন্মামে।
ধরনীর বুকে আঁধার নামতে শুরু করেছে। চৌধুরী গৃহের সবাই নাশতা করার জন্য ড্রয়িং রুমে আসর জমিয়েছে। মেহেভীন মুনতাসিমের বাগানের ফল গুলো সাহেলা চৌধুরীর হাতে দিয়েছিল। তিনি গম্ভীর দৃষ্টিতে একপলক মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করেছিল। সে কিছুটা কড়া কণ্ঠে বলেছিল, “মুনতাসিম তার বাগানে যাওয়া পছন্দ করে না। তুমি আর ওর বাগানে যেও না।” সাহেলা চৌধুরীর কথায় মেহেভীন মস্তক নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। সেই ফল গুলো কেটে সবাইকে দেওয়া হয়েছে। শেজনাজ আর মেহেভীন দু’জন আগেই পেট ভরে পেয়ারা খেয়ে নিয়েছে। দু’জন চোরের মতো এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই যেভাবে মেহেভীনকে ভয় দেখিয়েছে। প্রথমে মেহেভীনের ভয় না লাগলে-ও এখন ভিষণ ভয় লাগছে। মেহেভীনের ফোন আসায় মেহেভীন নিজের কক্ষে চলে গেল। মেহেভীন চলে যেতেই মুনতাসিম গম্ভীর মুখশ্রী করে গৃহে প্রবেশ করল। সবার হাতে তার গাছের পেয়ারা দেখে ধপ করে জ্বলে উঠল। রাগান্বিত হয়ে বলল,
–তোমাদের কি খাবারের অভাব পড়েছে? তোমরা কি তিনবেলা খেতে পাও না। আমি সবাইকে কড়া গলায় বলে দিয়েছি। কেউ আমার ফলের বাগানে প্রবেশ করবে না। আমি বাগানটা পাখিদের জন্য তৈরি করেছি। ফলের বাগানে ফল না থাকলে পাখিরা আসবে! কার এত বড় সাহস আমার বাগানের ফল পেরে নিয়ে আসছে? তার কত বড় কলিজা হয়েছে। আমি আজকে তার কলিজা মেপে দেখব। আমি বছরে একবার করে আমার বাগানের ফল সবাইকে খাওয়াই। তবুও কে চুরি করেছে আমার বাগানে? আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না তাড়াতাড়ি স্বীকার করো। মুনতাসিমের রাগান্বিত মুখশ্রী দেখে সবাই ভয়ে চুপসে গেল। কারো কণ্ঠনালি দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না। উপস্থিত সবার মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। মুনতাসিমের চিৎকার চেচামেচি শুনে মেহেভীন নিচে নেমে আসলো। তার জন্য এভাবে সবাইকে কথা শুনতে হচ্ছে। বিষয়টা মেহেভীনের কাছে ভিষণ খারাপ লাগলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–এভাবে সবার সাথে চিৎকার চেচামেচি করছেন কেন?
–আমার বাগানের ফল চুরি করা হয়েছে। আমি সেই ফল চোরকে খুঁজছি। ধরতে পেলে আগে হাত কাটব। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীনের মুখশ্রী মলিন হয়ে আসলো। দু’টো ফল পারার জন্য সোজাসাপ্টা তাকে চোর বলে সম্মোধন করবে! সে কোনো বাক্য উচ্চারন না করে হাত দু’টো এগিয়ে দিয়ে বলল,
–আমি আপনার গাছের ফল চুরি করেছি। এই নিন আমার হাত কা’টু’ন। মুনতাসিম উত্তপ্ত হতে গিয়েও শান্ত হয়ে গেল৷ বাঘের মতো গর্জন করা ছেলেটা বিড়ালের মতো ম্যাও ম্যাও করে বলল,
–আপনি পেরেছেন আগে বলবেন না। আমি তো সবার সাথে মজা করছিলাম। আপনি এত সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছেন কেন? মুনতাসিমের রুপ বদল দেখে বসে থাকা প্রতিটি মানুষের মুখশ্রীতে বিস্ময় এসে ধরা দিয়েছে। নিজের আঁখিযুগলকে বিশ্বাস করতে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। রিয়াদ চৌধুরী ঘটনা এড়াতে খবরের কাগজ নিয়ে মুখশ্রী আড়াল করলেন। হয়তো নিজের অজান্তে আসা হাসি টুকু আড়াল করতে। মেহেভীনের এবার ভিষণ রাগ হলো সবার সামনে উচ্চ স্বরে কথাও বলতে পারছে না। রক্তিম চোখে মুনতাসিমের দিকে তাকিয়ে বলল,
–সিরিয়াস ভাবে মজা করলে সিরিয়াস ভাবে নিব না। আপনি তো সবাইকে আপনার বাগানে যেতে নিষেধ করেছেন। আমিও দেখব আপনি আমার হাত কিভাবে কা’টে’ন। আমি এখন থেকে নিয়মিত আপনার বাগানের ফল পেরে খাব। আমার মতো এত সুন্দর পাখিকে আপনার পছন্দ হচ্ছে না! আমাকে দেখে একটা পাখিরও মায়া হবে। আপনার আমার প্রতি মায়া হচ্ছে না! মেহেভীনের কথায় মুনতাসিম লজ্জা পেয়ে গেল। আড়দৃষ্টিতে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করে নিল। লজ্জায় দাঁড়াতে পারল না মুনতাসিম। সে দ্রুত কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো। মুনতাসিম চলে যেতেই সবাই শব্দ করে হেসে দিল। সাহেলা চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–যাকে দেখলে বনের সকল পশুরা ও ভয়ে কাঁপে। আজ সে-ও কাউকে দেখে ভয়ে কাঁপছে! সব জায়গায় গর্জন চলে না। দিনশেষে ভিষণ খারাপ মানুষটাও কারো কাছে ভয়ে কাবু হয়ে যায়। এতদিন সবাইকে নাচিয়েছে। এবার তার নাচার সময় এসে গিয়েছে। এবার সে নিজে নেচে দেখুক নাচতে কেমন লাগে। সাহেলা চৌধুরীর কথায় সবাই আবার হাসতে শুরু করল। সুখ যেন তাদের মুখশ্রীতে এসে ধরা দিয়েছে। এই একটা সুখের মুহূর্তে উপভোগ করার জন্য জীবনে কতই না দুঃখ কষ্ট উপভোগ করতে হয়!
চলবে…..
#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪৫
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে বিধস্ত অবস্থা মস্তক নুইয়ে আছে জারিফ। সমস্ত কায়া জুড়ে শত-শত প্রহারের চিহ্ন। গত সাতদিন ধরে রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। তবুও মুখ দিকে একটা বর্ণ ও বের করছে না। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। তাকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আঁখিযুগলের কালো দাগ প্রকাশ করে দিচ্ছে। সে কত নির্ঘুম রাত না ঘুমিয়ে পার করেছে। জারিফের সামনে বসে আছে ওসি প্রলয়। সবাই যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখনই প্রলয়ের কাজ শুরু হয়ে যায়। প্রলয় চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–আমি তোকে ভালো ভাবে বলছি। সত্যি করে বল লা’শ দু’টো কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস? তুই যদি আমাকে সত্যি কথা বলে দিস। তাহলে আমি তোর শাস্তি কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব। প্রলয়ের কথায় শব্দ করে হেসে উঠল জারিফ। প্রলয় চোয়াল শক্ত করে জারিফের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। জারিফ তাচ্ছিল্য করে বলল,
–আমি কেন বলব? আপনার এত ক্ষমতা আপনি খুঁজে বের করে নিন। এমনিতেও আমার বাঁচার ইচ্ছে নেই স্যার। আমি মৃত্যুকে কাছে চেয়েছি বলেই দু’টো জা’নো’য়া’র’কে খু’ন করেছি। জারিফের সহজ সরল স্বীকারোক্তি প্রলয়ের ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলল। ছেলেটার মুখশ্রী জুড়ে অসম্ভব মায়া লেগে আছে। যেন তার মুখশ্রীতে দৃষ্টি পড়লেই সবাই তার মায়াতে আঁটকে যেতে বাধ্য। প্রলয় কণ্ঠে কোমলত্ব নিয়ে এসে বলল,
–তোমার মুখশ্রীতে ভিষণ মায়া ছাড়ানো আছে। এত সুন্দর একটা ছেলে হয়ে ধংসের পথে আসলে কেন?
–ভালোবেসে ভালো আর মহৎ সবাই হতে পারে স্যার। কিন্তু ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষের ভালোর জন্য খারাপ সবাই হতে পারে না৷ আমার জীবনটা ছন্দহীন গানের মতো সুর আছে। কিন্তু কোনো তাল নেই। ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে, সেই ভালোবাসাকে কলঙ্কিত করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা কুলাঙ্গার আমি। জারিফের বাক্য গুলো কর্ণকুহরে আসতেই প্রলয় আগ্রহ প্রবল হয়ে উঠল। সে উৎসুক দৃষ্টিতে জারিফের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। জারিফ শান্ত নদীর ন্যায় স্থির হয়ে গেল। প্রলয় স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
–কার বিরহে এগুলো করলে?
–প্রেয়সীর জন্য।
–পেয়েছিলে তাকে?
–না পাইনি।
–কেন?
–কারন সে মানুষকে ভালোবাসতে পছন্দ করে। কিন্তু আমি তো মানুষ রুপি জা’নো’য়া’র!
–সবকিছু আমায় খুলে বলা যাবে? প্রলয়ের কথায় জারিফ সোজা হয়ে বসলো। শান্ত দৃষ্টিতে প্রলয়কে পরখ করে নিল। প্রলয়ের আঁখিযুগলে আগের মতো রাগ নেই। সে আগ্রহ নিয়ে জারিফের কথা শুনছে। এই জন্যই তাকে সবাই জাদুকর বলে সম্মোধন করে। খুব সহজ মনের ভেতরে গিয়ে কথা বের করে নিয়ে আসতে পারে। জারিফ বুক ভারি করা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। সে অপরাধীর ন্যায় মস্তক নুইয়ে বলতে শুরু করল,
–আমি আর মেহেভীন একসাথে পড়াশোনা করতাম। সে শুধু আমাকে বেস্ট ফ্রেন্ড মনে করতো। আর আমি তাকে মন দিয়ে বসেছিলাম। তাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে দীর্ঘ দিন মনের কথা গুলোকে নিজের মনের মধ্যে গোপন করে রেখেছিলাম৷ আমার মনের কথা গুলো তাকে বলতে না পারার আগুনে দাউদাউ করে জ্বলেছি। মানুষকে তো দমিয়ে রাখা যায়৷ কিন্তু মন! মনকে কিভাবে দমিয়ে রাখবো বলেন স্যার? আমি নিজেকে দমাতে পারলেও মনকে দামাতে পারিনি। তাকে হারিয়ে ফেলার ভিষণ ভয় ছিল আমার। তাকে মন গহীনে যত্ন করে রাখতে চেয়েছিলাম। সে আমার ভালোবাসার মূল্য দেয়নি স্যার। সে আমায় বলেছি সে আমাকে বন্ধু ছাড়া আর কিছুই ভাবে না। আমি নাকি তার কাছে তার ভাইয়ের মতো। আপনিই বলুন স্যার কোনো প্রেমিক পুরুষ তার প্রেয়সীর জামাই থেকে মায়ের পেটের ভাই হতে চাইবে? সেদিন আমাদের ভার্সিটিতে কনসার্ট চলছিল। শহরে নামী-দামী শিল্পীরা এসে তাদের মধুর সুর তুলে সবাইকে মাতোয়ারা করে দিচ্ছিল। মেহেভীন সেদিন লাল টকটকে রঙের একটা শাড়ি পড়েছিল। তার দিকে আমার দৃষ্টি যেতেই আমার হৃদস্পন্দনের গতিবেগ থেমে গিয়েছিল। আমার আঁখিযুগল পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছিল। আমার অনুভূতিরা নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গিয়েছিল। মনকে কড়া বাক্য প্রয়োগ করে-ও সেদিন মনকে দমাতে পারিনি। সমস্ত কার্যক্রম ছেড়ে তার পেছনে ছুটতে শুরু করলাম। সে কয়েকদিন ধরে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। তার অবহেলা আমাকে পোড়াতে পোড়াতে দগ্ধ করে দিচ্ছিল। আমি তাকে ডাকলাম সে আমাকে উপেক্ষা করে চলে গেল। তখন আমার ভিষণ রাগ হয়। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। ছুটে যাই তার পেছনে পেছনে। সেখানে গিয়ে দেখি তার চাচাতো বোন শাড়ি বদল করছে। আরো একদল মেয়ে ছিল। সবাই তৈরি হয়ে বের হয়ে গেল। প্রাপ্তির ফোন আসে প্রাপ্তি ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর এই সুযোগটাই আমি নেই। সেই কক্ষের মধ্যে মেহেভীন একাই ছিল। তার বোনের জিনিস গুলো ব্যাগে তুলছিল। হয়তো সে বাসায় চলে যাবে তার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমি মেহেভীনের হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসি। মেহেভীন নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আমাকে থা’প্প’ড় দিয়ে বসে। এতে আমি আরো ক্ষিপ্ত হয়ে যাই। মেহেভীন আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করে কাউকে দেখতে না পেয়ে কবাটের দিকে অগ্রসর হয়। তখনই আমি তার শাড়ির আঁচল টেনে ধরি। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য খুব চেষ্টা করছিল। ভয়ে তার আঁখিযুগল ছোট ছোট হয়ে আসছিল। আঁখিযুগল বেয়ে অনবরত অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছিল। ওর মুখশ্রীতের ভয় দেখে ভিষণ আনন্দ পাচ্ছিলাম আমি। ভেবেছিলাম ওকে একবার কলঙ্কিত করতে পারলে, কেউ আমাকে আর ওকে আলাদা করতে পারবে না। মেহেভীনকে বিয়ে করতে হলে আমাকেই করতে হবে। আমার ভেতরে শুধু মেহেভীনকে পাবার নেশা জাগছিল। আমি নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে মেহেভীনের শাড়ি খুলে ফেলি। মেহেভীন ভয়ে ছোটাছুটি শুরু করে আর চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে থাকে। প্রাপ্তি কাছে থাকায় টের পেয়ে যায়। কিন্তু কবাট ভেতর থেকে লাগানো দেখে ভেতরে আসতে পারছিল না। এই সুযোগ টাই আমি কাজে লাগানোর চেষ্টা করলাম। সেদিন মেহেভীন হৃদয়বিদায় চিৎকার দিয়ে বলছিল। আমার সাথে এমন করিস না ভাই আমি মরে যাব। সেদিন মেহেভীনের কোনো বাক্যই আমার কর্ণকুহরে আসছিল না। আমি মেহেভীনকে নিজের মুঠোয় বন্দী করে ফেলি। সে আমাকে অনবরত প্রহার করতেই থাকে। একটা সময় বিরক্ত হয়ে ক’ষে থাপ্পড় বসিয়ে দেই তাকে। এতে মেহেভীন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমিও পৈশাচিক হাসি হেসে মেহেভীনের পাশে বসে পড়ি। মেহেভীন একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছিল। আমি একটু একটু করে মেহেভীনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। মেহেভীন দেওয়ালের সাথে গিয়ে ঠেকে। আমি ওর গালে হাত রাখতেই আমার হাতে ও কামড় দিয়ে বসে। আমি রেগে ওর গাল দু’টো চেপে ধরে। শার্টের বোতাম খুলে ওর ওপরে ঝাপিয়ে পড়ার চেষ্টা করতেই ওর আমার গোপনাঙ্গে প্রহার করে। আমি ব্যর্থায় কুঁকড়িয়ে উঠি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমার হিংস্রতা প্রকোপ পায়। এতক্ষণ আদরে বোঝানোর চেষ্টা করে-ও যখন পাখি পোষ মানেনি৷ তখন আদেরর দরকার নেই। ওর দুই হাতের ভাজে আমার হাত রেখে যখনই ওর ওপরে ঝাপিয়ে পড়তে যাব। তখনই প্রাপ্তি ছেলেমেয়ে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ছেলেরা আমাকে তুলে প্রচুর মারধর করে। প্রাপ্তি এসে মেহেভীনকে আগলে নেয়। জীবনের প্রথম মেহেভীনকে সেদিন জ্ঞান হারাতে দেখছিলাম। আমার হিতাহিত জ্ঞান আসতেই বুঝলাম। কি করে ফেলছি আমি। পরিস্থিতি আমার হাতের বাহিরে চলে গিয়েছে। মেহেভীনকে নিয়ে সবাই চলে গেল। সিনিয়ররা আমাকে উল্টো ঝুলিয়ে মেরেছিল। আমাকে ভার্সিটি থেকেও বের করে দেওয়া হয়েছে। অপরাধবোধ আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতো। কিন্তু বিবেক কাজ করতো না। আমি এসব ঘটনা পর আরো দু’বার মেহেভীনকে তুলে চেয়েছি। কিন্তু পারিনি। মেহেভীনের মা একটা জিনিস। মেয়েকে দশ দিক থেকে প্রটেকশন দিয়ে রাখছিল। তারপর বাবার অপ্রিয় সন্তান হলাম। গৃহ হারা হলাম। মেহেভীনের মতো ভালো বন্ধু হারা হলাম। সমাজের চোখ নষ্ট পুরুষ হিসেবে বিবেচিত হলাম। এতকিছুর পরে-ও প্রিয় মানুষটাকে পেলাম না। জারিফের কথা শেষ হবার সাথে কথা প্রলয়ের সমস্ত কায়াতে কাটা দিয়ে উঠল। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,
–ছি এভাবে ভালোবাসা পাওয়া যায়! তুমি তো ভালোবাসা শব্দটাকেই কলুষিত করে ফেলছ। তুমি ভালোবাসার মানুষকে পাবার যোগ্যতা রাখো না বলেই বিধাতা তোমায় ভালোবাসার মানুষ মিলিয়ে দেয়নি। তুমি ভালোবাসার মানুষের ভালোর জন্য দু’টো খুন করেছ বলে তোমার সব অপরাধ মাফ? একটা কথা সব সময় মনে রাখবে। পাপ কখনো তার বাপ কেও ছাড় দেয় না। ভালোবাসা আগলে নেওয়ার জিনিস কলুষিত করে নষ্ট করার নয়। তুমি কথা গুলো কতটা সহজে বলে দিলে! কিন্তু মেহেভীনের পরিস্থিতিটা এতটা সহজ ছিল না। যে মেয়েটা এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে৷ সেই মেয়েটা জানে মৃত্যু কতটা কাছে। তোমাকে ধিক্কার জানাতে বাধ্য হলাম। জারিফ মলিন হাসলো। হাসতে হাসতে বলল,
–জানি স্যার আপনিও সবার মতো আমাকে ঘৃণা করবেন। আমি ঘৃণা করার জন্যই কথা গুলো বলেছি। কারন মানুষ ভালো জিনিসের কদর কম দেয়। আমাদের ভালো মুহূর্তের কথা গুলো বললে আপনি-ও আমায় ভালোবেসে ফেলবেন। আমি তো মেহেভীনের ক্ষতি করারই চেষ্টা করেছি সেদিনের পর। তারপর যখন জানলাম সে অন্য পুরুষে আসক্ত হয়ে গিয়েছে৷ সেদিন আমার কায়ার সমস্ত হাড় গুলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়ে ছিল। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করছিল না। মৃত্যুর আগে মেহেভীনের জন্য ভালো কিছু করতে চাইছিলাম। তখনই আরিয়ান আর মিরাজুলের তথ্য আমি পাই। মেহেভীনের বিয়ের দিন আমিই ওদের সরিয়েছি। ভালোবাসার মানুষের ভালো থাকা দেখতেও শান্তি লাগে। এটা আমি এতদিনে বুঝেছি৷ সেদিন বুঝলে মেহেভীন আমার হয়ে যেতো। পরপারে আল্লাহকে বলব। আল্লাহ তুমি আমাকে মুনতাসিম বানিয়ে দাও। তাহলে মেহেভীন আমাকে ভালোবাসবে। এই জীবনে পাইনি তো কি হয়েছে। পরপারে আল্লাহর কাছে ঠিক চেয়ে নিব। আপনি ভিষণ গভীর জলের মাছ স্যার। কি সুন্দর আমার পেট থেকে কথা গুলো বের করে নিলেন। আপনি এখন এখানে থেকে চলে যান। আমি আর একটা বাক্যও উচ্চারন করব না। প্রলয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জেলের মধ্যে থেকে বের হয়ে গেল। সে সময় মতো এসে জারিফের থেকে তথ্য বের করে নিবে।
চারদিকে প্রভাতের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। মেহেভীন ঘুম থেকে উঠেই মুনতাসিমের বাগানে ফল চুরি করতে এসেছে। আজকে এই বাগানে আসার এতটুকু ইচ্ছে ছিল না তার। কিন্তু বড়ই গাছের হলদে রঙের বড়ই গুলো মেহেভীনের আঁখিযুগলকে আকর্ষণ করে টানছে। এমন লোভনীয় বড়ই আঁখিযুগলের সামনে থাকলে নিজেকে দমিয়ে রাখা যায়। জিভে পানি চলে আসলো মেহেভীনের। সে গাছের নিচে এসে হতাশ হলো গাছটা অতিরিক্ত উঁচু যার ফলে সে বড়ই গুলো পারতে পারছে না। আশেপাশে কোনো কিছুই পাচ্ছে না। যেটা দিয়ে বড়ই গুলো পারবে না। বিরক্ততে মুখশ্রী কুঁচকে এল তার৷ সে বিরক্ত হয়ে লাফাতে শুরু করল। হাত বড়ই ছুঁই ছুঁই হয়েও ধরতে পারল না। তখনই মেহেভীন অনুভব করল সে হওয়াতে ভাসছে। সে দ্রুত নিচের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মুনতাসিমকে দেখে দ্রুত হাত বাড়ির বড়ই গুলো পেরে ওড়নার মধ্যে নিচ্ছে। মেহেভীনের বড়ই পারা হলে মুনতাসিম মেহেভীনকে নিচে নামিয়ে দিল।
–বেলকনি থেকে দেখছিলাম। একটা পাখি বড়ই খাওয়ার জন্য কতটা ছটফট করছে। পাখিটা ভিষণ ছোট গাছের নাগাল পাচ্ছে না। আমি এই বাগানটা পাখিদের জন্যই তৈরি করেছি। আমি থাকতে একটা নিরীহ পাখি ফল খেতে পারবে না। তাই কখনো হয়! নিজ দায়িত্বে আসলাম পাখিকে ফল পেরে খাওয়াতে। আপনার ফল পারা হয়েছে পাখি আর কোনো ফল লাগবে?
–আর লাগবে না এতেই আমার হয়ে যাবে।
–ইশশ, আমার বাগানে কত সুন্দর পাখি প্রবেশ করেছে। এত সুন্দর পাখি দেখলে মন স্থির থাকে! এমন পাখি দেখলেই আমার আদর করে দিতে ইচ্ছে করে। আপনাকে একটু আদর করে দেই পাখি? মুনতাসিমের কথায় মেহেভীনের মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো। সে লজ্জা মিশ্রিত মুখশ্রী আড়াল করে গৃহে দিকে যেতে যেতে বলল,
–অসভ্য একটা।
–ভালো মানুষের দাম নেই। এত বড় উপকার করলাম। কই আমাকে পারিশ্রমিক দিবেন। তা না করে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে চলে যাচ্ছেন!
–কক্ষে আসুন পারিশ্রমিক দিচ্ছি। মেহেভীনের কথায় মুনতাসিম মেহেভীনের পেছনে পেছনে গেল। মুনতাসিম কক্ষে প্রবেশ করে দেখল। মেহেভীন খুব আয়েশ করে লবন দিয়ে বড়ই মাখিয়ে খাচ্ছে। মেহেভীনের খাওয়া দেখে মুনতাসিমের ইচ্ছে জাগল খাওয়ার জন্য। মেহেভীন একটা বড়ই এগিয়ে দিয়ে বলল,
–এই নিন আপনার পারিশ্রমিক। মুনতাসিম বিলম্ব না করে দ্রুড বড়ইটা হাতে নিল। মুখে দিতেই সমস্ত মুখশ্রী কুঁচকে এল তার। সে বিরক্তি মাখা মুখশ্রী কর বলল,
–কি টক, এগুলো মানুষ খায়!
–একদম বাজে কথা বলবেন না। আপনারা ছেলেরা শুধু মিষ্টি খেতে পছন্দ করেন। আর আমরা মেয়েরা সেই মিষ্টিকে জাস্ট ইগনোর করি। আমার টক পছন্দ সেটা যেমন আপনার পছন্দ না। ঠিক তেমনই আপনার মিষ্টি পছন্দ আমার পছন্দ না।
–আপনি একটু হাসুন তো। আপনি হাসলে হালকা করে আপনার গালে টোল পড়ে। আপনি হাসলেই আপনাকে মিষ্টি লাগে। আমি আপনার টোলের মধ্যে লবন রেখে বড়ই খাব। তাহলে আর টক লাগবে না। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন আঁখিযুগল বড় বড় করে, মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মুনতাসিম বলাতে সে কৃত্রিম হাসলে মুনতাসিম সত্যি সত্যি তার গালে লবন রেখে বড়ই খেল। মেহেভীন হতভম্ব হয়ে মুনতাসিমের দিকে তাকিয়ে আছে। মুনতাসিম মেহেভীনের গালে চুমু খেয়ে বলল,“এবার মিষ্টি লাগছে।” কথা গুলো বলেই মুনতাসিম কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। মেহেভীন গম্ভীর দৃষ্টিতে মুনতাসিমের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তখনই মেহেভীনের ফোনটা টুং করে বেজে উঠল। মেহেভীন ফোনটা হাতে নেওয়ার আগেই মুনতাসিম এসে খপ করে ফোনটা কেঁড়ে নিল।
চলবে…..