#খুশবু
আরিফ ইসলাম
সুচনা_পর্ব
—নিজ স্বামীর যৌ*নাঙ্গ কেটে হ*ত্যা করার পর বারান্দার খুঁটি ধরে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি।
__ কেনো হ*ত্যা করেছো তুমি?
বার বার একই প্রশ্ন ছুঁড়ছে মেয়েটার দিকে। নির্বাক মেয়েটা বার কয়েক দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্য দিকে মুখ ঘুরালো । সীথিতে সিঁদুর আবছা হয়ে মুছে যাচ্ছে , কিন্তু মেয়েটা তো মুসলিম।
নিজ পতির টাটকা রক্ত এখনো তার শাড়ির আঁচলে লেপ্টে আছে। মায়াবী মুখখানি ভরা আশংকার ছায়া।
কারাগারে এর আগে অনেক মেয়েই এসেছে, কিন্তু এমন শালিন সুশীল মেয়ে কমই দেখেছেন জেল দারোগা সাবরিনা।
__নাম কীরে তোর?
মেয়েটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা চুঁইয়ে চুঁইয়ে মাটিতে পড়ছে। চোখ দুটো গোল্লার মত গোল হয়ে নিচু হয়ে আছে।।
একটু রেগে গিয়ে মিস সাবরিনা আবারো প্রশ্ন বিদ্ধ করে _
_ তোর নাম বলতে বলছি আমি!
মেয়েটা বিনয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিন্তু মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না।
__ তুই কী কথা বলতে পারিস না?
এইবার মেয়েটার শিক্ত নয়নে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে টপ টপ করে ঝরে যাচ্ছে।
মিস সাবরিনা বুঝতে পারে মেয়েটা সত্যিই বোবা।
___ লিখতে পারিস?
মিস সাবরিনার কথা শুনে মেয়েটা তার ঘারটা বার কয়েক নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে জানান দিলো _ হ্যাঁ ।।
__ সাথী ওরে একটা খাতা আর একটা কলম আইনা দাও।
কনস্টেবল সাথী নির্দেশ পাওয়া মাত্রই খাতা কলম এনে হাজির।
মেয়েটার হাতে খাতা কলম দিয়ে নিজের নাম লিখতে বললেন।
বাধ্য মেয়ের মত হাত বাড়িয়ে খাতা কলম কাছে নিলো মেয়েটা।
মিস সাবরিনা মেয়েটার হাত থেকে খাতা নিয়ে দেখলো তাঁতে বড় বড় করে লেখা “খুশবু লতা” ।
সন ২০১১ সাল ।
জিবিকার তাগিদে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে মোদন লাল বাবু ও তাঁর স্ত্রী এবং একমাত্র মেয়ে লতা রানি।
মেয়েটা অনেক সুন্দরী কিন্তু সে বাকহীন । জন্ম থেকেই কথা বলতে পারে না সে । কথা না বলতে পারার ব্যার্থতার দুঃখ কোনোদিনই তার মধ্যে পাওয়া যায়নি ।
স্কুলে সবাই লতাকে ভালোবাসতো । কথা বলতে না পারলেও পড়াশোনায় মেয়েটা বেশ মনোযোগী। একবার ইশারা দিলেই বুঝে উঠতে পারে কী হতে যাচ্ছে এখন।
নতুন কলেজে ভর্তি হওয়ার দিন বাবা মোদন লাল বাবু সাথে গিয়েছেন ।
এই গায়ের কলেজে ভর্তি করায় মেয়েকে।
___ বুঝলি মা , তোরে লইয়া আমার মেলা আশা। বাপের আশা পুর্ণ করিস মা ।
বাবার কথায় নিশ্চুপ মেয়েটা নিরবে মাথা ঝাঁকায়।
প্রথম সেদিন কলেজে যাবে। মা শ্রী জগস্বরী দেবী ভোরে উঠে পুজো দেয় মেয়ের নামে। কপালে আলতো তিলক এঁকে দিয়ে চুমু খেয়ে মেয়েকে আশির্বাদ করে বিদায় দিলেন।
লতা মনের আনন্দে গায়ের আঁকা বাঁকা পথে হাঁটছে।
___ এই লতা দাঁড়া এক লগে যায়!
শফিজ মুন্সির ছোট ছেলে পরানের কথায় এক ঝলক পেছনে তাকিয়ে আবার পথ চলতে থাকে সে ।
___ কিরে তোরে দাড়াইতে কইলাম না!
লতা পরানের কথায় তার হাঁটার গতি আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়।
পরান দৌড়ে গিয়ে লতার হাত ধরে ফেলে।
__ তুই আমার লগে হগল সময় এমন করিস ক্যান? জানোস না আমি তোরে ভালোবাসি ?
লতা সব বুঝে কিন্তু নির্বাক হয়ে শুধু পরানের দিকে তাকিয়ে থাকে। হয়তো বলতে চায় আমিও তোমায় ভালোবাসি।
কিন্তু বলার শক্তি যে বিধাতা তারে দেয়নি ।
তারা হাতে হাত রেখে মেঠো পথ ধরে কলেজের দিকে চলতে থাকে।
___ আস্তাগফিরুল্লাহ , ওইডা শফিজের ছেড়া না । ছি ছি ছি, মুন্সির পোলা হইয়া দেখ কেমনে মালায়নের ছেড়ির লগে ফস্টি নস্টি করতাছে।
জমির ব্যাপারি নাক ছিটকিনি দিয়ে চামচা আবুল মিয়া রে বলতে থাকে।
___ হুজুর এর একটা বিহিত করোন লাগবো। নাইলে আমাগো মুসলিম গো মান সম্মান সব যাইবো গা।
আবুল মিয়া কথায় সায় দিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে বলে উঠে ।
একটু পরেই শফিজ মুন্সির সাথে দেখা হয় জমির ব্যাপারির ।
__আসসালামুয়ালাইকুম মুন্সির পো ।
বিনয়ের সাথে হাত উঁচিয়ে শফিজ মুন্সিকে সালাম দেয় জমির ও আবুল মিয়া।
___ ওয়ালাইকুমুস সালাম ।
__ তুই ক ,,,।
জমির ব্যাপারী আবুল মিয়ার দিকে ঘুরে ইশারায় বলে ।
আবুল মিয়া মালিকের কথা মত মুখ বেঁকিয়ে বলা শুরু করে ।
__ দুঃখের কথা আর কি কমু । আইজ রাস্তায় আওনের পথে দেখলাম ,আপনের পোলা আর মালায়ন মোদনের মাইয়া ঘষাঘষি করতে করতে যাইতেছে। এইরাম চলতে থাকলি তো আমাগো গেরামের কলঙ্ক অইবো।
শফিজ মুন্সি লজ্জায় মাথা নিচু করে বলে।
__ আচ্ছা আমি বিষয়ডা দেখতাছি।
__ হ দেহেন তারা তারি, কোনো অঘটন হওয়ার আগেই। এই চলরে আবুল।
জমির ব্যাপারী অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে উঠে।
পরান আর লতার বন্ধুত্ব আজ নতুন নয়। সেই ছোট বেলা থেকেই তাদের মধ্যে ভাব। বাকহীন মেয়েটা কারো কাছে মনের ভাব প্রকাশ করতে না পারলেও পরানের কাছে পারতো।
___ বাপ পরান তোর নামে আইজ কাইল কী শুনতাছি এইগুলা?
খেতে বসে শফিজ মুন্সি ছেলেকে ধীর গলায় প্রশ্ন করে।
__ বাপ জান,, আমার মনে হয়না কিছু খারাপ করছি । আমি তো হারাদিন লেহা পড়া নিয়া থাকি বাড়তি বন্ধুও নাই।
___ কিন্তু আব্বা জান মালায়নের বোবা ছেড়ির লগে তোর এত কিসের ভাব?
__ আমি আর লতা এক কলেজে পড়তাছি , তাছাড়া লতা আমার ছোট বেলার বন্ধু।
___ আব্বা জান বেধর্মিরা আমাগো বন্ধু হইতে পারে না। আশা করি তুমি বুঝবার পারছো ।
পরানে তার বাবার কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে যায়। অর্ধেক রাখা খেয়ে উঠতে যাবে তখনই শফিজ মুন্সির ধমকে আবার খেতে বসে।
___ খাওন ছাইড়া উঠতে নাই বুঝলা?
পরান বিনয়ের সহিত মাথা ঝুকায়।
সকাল বেলা কলেজে যাবে বলে লতা পরানের বাড়ির কাছে দাঁড়ায় থাকে। কিন্তু আজ আর পরান আসে না ।
পরান অন্য পথে কলেজে চলে গেছে। কিন্তু লতা ঠাই এখনো সেইখানেই দাঁড়িয়ে আছে।
___ লতা এহনো কলেজে আইলো না? ঐ অসুস্থ নাকি।
পরানের মন ছটফট করছিলো লতার জন্য।
দেরি না করে দৌড়ে লতার বাড়িতে যায় সে।
___ কাকি মা বাড়িত আছো ?
পরানের ডাকে জগস্বরী দেবী দরজা খুলে দেয়।
___ পরান তুমি যে, ভালা আছো বাপু?
__ হ কাকিমা ভালা আছি, কিন্তু লতারে আইজ কলেজে দেখলাম না ক্যান ? ঐ কী অসুস্থ?
___ কী কইতাছো? লতা তো সকাল বেলায় কলেজে গেছে।
পরান দৌড়ে কলেজে ফিরে আসে। সবাইকে জিজ্ঞেস করে লতার কথা। কিন্তু কেউ তাকে দেখে নি বলে উত্তর আসে।
অন্ধকার নেমে আসছে, এখনো লতার খোঁজ মিলে নি। হতাশ হয়ে পরান বাড়ির পথে পা বাড়ায়।
___ কেডা ঐহানে?
কালো কালো কারো ছায়া দেখা যাচ্ছে।
পরান পা টিপে কাছে আসতেই দেখে হতাশ দৃষ্টিতে লতা দাঁড়িয়ে আছে। এই কনকনে শীতের সন্ধ্যায় এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে পরানের অপেক্ষায়।
___ তুই আমার লাইগা এইহানে দাঁড়ায় ছিলি সারাদিন।
নির্বাক মেয়েটা বার কয়েক মাথা ঝুঁকিয়ে হ্যা বোধক উত্তর দেয়।
পরান লতারে ধমকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিতে পা বাড়ায়।
___ আবুল দ্যাখ তো ঐডা শফিজ মুন্সির ছেড়া আর মোদনের ছেড়িডায় না।
জমির ব্যাপারী ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে।
হুকার শেষ টান মেরে আবুল মিয়া ভালো মত দেখে।
___ হ হুজুর ঐডা তো পরান আর লতায়।
___ আমাগো কথার দাম দিলো না শফিজ মুন্সি । এর একটা বিহিত তো করোনি লাগবো ।
জমির ব্যাপারীর ছোট ছেলে ও গেরামের কিছু লোক পথ আটকায় ওদের।
___ কী হইছে পথ আটকালেন ক্যান?
পরানের কিছু বুঝার আগেই সবাই তাকে ধরে বেঁধে ফেলে। এই খবর শফিজ মুন্সির কানে আসতে বেশী সময় লাগে নি। কিন্তু তবুও অনেক দেরী হয়ে গেছে।
গায়ের লোক জন একপর্যায়ে জোর করে লতাকে মুসলিম বানিয়ে পরানের সাথে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ।
___রাইতের বেলায় আকাম করতে যাইয়া ধরা পরছে। বিয়াডা দিয়া দিলেই ভালো অইবো।
জমির ব্যাপারীর কথায় সবাই সমস্বরে সম্মতি জানায়।
গায়ের এক হুজুর কে দিয়ে লতা কে মুসলিম বানায়।
লতা হিন্দুদের নাম , লতার সাথে খুশবু মিলিয়ে নাম দেওয়া হয় খুশবু লতা।
শফিজ মুন্সির আসতে আসতেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন। নির্বাক মেয়েটা অশ্রু সিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে পরানের দিকে। পরানের হাজার বাঁধাতেও গায়ের লোক মানলো না।
___ বুঝলেন মুন্সির পো , যা হবার হইয়া গেছে। অহোন পোলা আর পোলার বউরে বাড়িতে লইয়া যান।
জমির ব্যাপারী ফিসফিসিয়ে শফিজ মুন্সির কানে বলে দেয়।
মোদন লাল মেয়ের ধর্মান্তরিত হওয়া দেখে নাক সিঁটকিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। এমন মেয়ে চায়না তার। জগস্বরী দেবী কেন্দে বুক ভাসিয়েও কোনো লাভ হয়নি।
খুশবু লতা একটা ছেড়া শাড়ি পরে বসে আছে। এতদিন জানতো এটার নাম ফুলসজ্জা , কিন্তু আজ জানলো এটা বাসর রাত।
ঘরের কোনে চোখ পরতেই দেখে একটা আলতার ডিব্বা। মায়ের মুখে শুনেছে মেয়েদের বিয়ে হলে স্বামীর মঙ্গলের জন্য সিঁদুর দিতে হয়।
আলতার কৌটা হাতে নিয়ে আলতো করে সিঁথিতে আলতার সিঁদুর পরে সে।
ভয় ভয় লাখছে খুব, মা ছাড়া আজই তার প্রথম অন্য কোথাও রাত কাটাবে। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।
হঠাৎ কপাট ঠেলে কেউ একজন ভিতরে প্রবেশ করে। পরান ছাড়া আর কে বা হবে। খুশবু লতা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে।
লজ্জা পাচ্ছে হালকা।
চৌকিতে কারো উপস্থিত টের পেয়ে হৃদস্পন্দন আরো বেড়ে যায় লতার। লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলে সে।
থুতনি ধরে মুখ উপর করে খানিক চুপ থেকে।
___ মাশাআল্লাহ,,
আরে এটা তো পরানের কন্ঠ না। খুশবু লতা চোখ খুলতেই দেখে তার সামনে অন্য একজন পুরুষ।
এটা আর কেউ নয় পরানের বাবা শফিজ মুন্সি।
লতা শালিন ভাবে একটু সরে বসে। সম্মান দেখিয়ে তাকে বেশি জায়গা করে দেয় বসবার জন্য।
মুখ দিয়ে রা বের করতে না পারলেও চোখের ভাষায় শফিজ মুন্সি কে সালাম জানাই সে।
শফিজ মুন্সি কয়েক ঝলক অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বুকে হাত বুলিয়ে দেয়। এই প্রথম কোনো পুরুষের হাত এইভাবে পড়াতে ছটফটিয়ে উঠে খুশবু লতা।
শফিজ মুন্সির আচরনে বিরক্ত বোধ করে একটু সড়ে বসে লতা।
কিন্তু শফিজ মুন্সি লোভি দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে খুশবু লতার দিকে।
নির্বাক মেয়েটা এত কিছু না বুঝে ঠাই একই ভাবে বসে আছে।
শফিজ মুন্সি এটা দেখে উত্তেজিত হয়ে লতার দিকে কামুক দৃষ্টিতে এগিয়ে যেতে থাকে।
লতা নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করে । এক পর্যায়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে দৌড়ে দরজা খুলে বের হয় ।
এতদিন যাকে মুন্সি ভেবে এসেছে সবাই। আসলেই কী সে মুন্সি নাকি ছদ্দবেশী দাজ্জালের অনুশারী ।
পরান বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ।
হাতের ইশারায় বাক ভঙ্গিতে পরানকে বুঝাতে চাচ্ছে লতা। কিন্তু পরান কেনো জানি আজ লতার কথা কিছু বুঝতে পারছে না।
গলায় কাশি দিয়ে শফিজ মুন্সি পরানের ঘর থেকে বের হয়।
__ আব্বা তুমি এইহানে কি করতাছো?
পরানের কথায় আমতা আমতা করে শফিজ জবাব দেয়।
__ আইছিলাম তোর লগে কথা কইতে, কিন্তু তোর বউ,,,,, ছি ছি ছি ।
____ কী ? থামলা ক্যান কও?
তোর বউ আমার লগে ___
চলবে ____