#খুশনূর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
০৫
শীতের মাঝেও ভ্যাপসা গরম লাগচ্ছে। ঘেমে-নেয়ে একাকার খুশনূর। বুকের ভিতর এখনো দুরু দুরু করছে। শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। মেডিসিন রুমের সেই দৃশ্য এখনো চোখে ভাসচ্ছে। খুশনূর তখন ডাঃ নিবেদিতার কথায় মেডিসিন রুম থেকে কিছু ঔষধ নিতে আসে খুশনূর। ঔষধের সেল্ফ গুলো ঠিক কোনা থেকে ভেসে আসচ্ছে ফিসফিস শব্দ৷ খুশনূর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে দেখার চেষ্টা করলো। ঝাঁপসা আলো দেখেও ফেললো। ডাঃ সমিত আর মেঘা। মেঘার চোখে পানি। ডাঃ সমিতের চোখে মুখে ভয়, অস্থিরতা।খুশনূরের কঁপাল কুঁচকে এলো। ডাঃ নিবেদিতার হাসবেন্ড ডাঃ সমিত। তাদের এসময় এখানে দেখে সন্দেহ হচ্ছে খুশনূরের। সে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। হাতের কাছে ফোন থাকা ভিডিও করতে ভুললো না। কিন্তু সে যা শুনলো তাতে যেন আকাশ ভেঙ্গে মাথায় পড়ল। মেঘা কেঁদে কেঁদে বলল,,
—” আমি প্রেগন্যান্ট। কিছু করো? আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।”
জড়িয়ে ধরলো ডাঃ সুমিতকে। সুমিত বিরক্ত লাগলো। সে ফিসফিস করেই চেঁচিয়ে বলল,,
—” বলেছিলাম প্রটেকশন নিতে। কেন নিলে না? এখন এই উটকো ঝামালে কিভাবে সামলাবো? নিবেদিতা ওল রেডি ডাউট করছে! আর এখন তুমি?”
মেঘা কাঁদতে লাগলো। ডাঃ সমিতকে জড়িয়ে ধরে বলল,,
—” আমি কি করবো এখন?”
ডাঃ সমিত মেঘাকে ছাড়িয়ে নিল। কাঠ গলায় বলল,,
—” ফেলে দাও!”
মেঘা বিস্ময় নিয়ে বলল,,
—” এসব কি বলছো? আমাদের ভালবাসার চিন্হ!”
ডাঃ সমিতের কঁপাল কুঁচকে গেল। দাঁতে চোয়াল শক্ত করে বলল,,
—” তোমার ফালতু কথা শোনার সময় নেই। বাচ্চা ফেলাও। যা টাকা লাগে আমি দিব। তোমার জন্য আমার ক্যারিয়ার নষ্ট করতে পাড়বো না। আমাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ!”
মেঘার যেন পুড়ো দুনিয়া উলটে গেল।সে পা জড়িয়ে ধরলো ডাঃ সমিতের লাভ হলো না। উনি পা ছাড়িয়ে চলে গেল। মেঘা বসেই কাঁদতে লাগলো ” দ” এর মতো করে বসে কাঁদে বুক ভাসতে লাগলো। খুশনূরের কষ্ট লাগলো। তবুও তার কাছে গেল না। নিজের জায়গায় ফিরত এলো।
“টং” করে শব্দ হতেই উঠে ডাঃ নিবেদিতার রুমে গেল খুশনূর। ডাঃ নিবেদিতার হাসি মুখখানি দেখেও বলার সাহস করতে পাড়লো না সে। সুপ্তপর্ণে শ্বাস ছেড়ে হাসার চেষ্টে করে বলল,,
—” বলুন মেম!”
নিবেদিতা হাসলো। বলল,,
—” দেখোতো কোন ঘড়িটা সুন্দর? পরশু আমাদের অ্যানিভার্সারি বিয়ের তিন বছর হবে। তাই কিছু দিতে চাইছি। কিন্তু মাথায় আসচ্ছেনা।”
খুশনূরের বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো। নিবেদিতার মায়াবী মুখখানা তখন এই হাসি থাকবে না। যখন তার অর্ধ্যঙ্গ পরক্রিয়া লিপ্ত। খুশনূর বলতে চাইলো। নিবেদিতা খুশির মুহূর্তে নষ্ট হবে ভেবে চেপে গেল। নিবেদিতার কাছে সে ঋণী অনেক ঋণী। সে আর যাই হোক কষ্ট দিবেনা। খুশনূরকে চুপ থাকতে দেখে নিবেদিতা বলল,,
—” কি হলো? কোথায় হারালে? বলো?
খুশনূরের শূন্যে চেয়ে এসব ভেবে যাচ্ছিলো ব্যাকুল ভাবে। নিবেদিতা কথা শুনে তার সম্মতি ফিরে। চাঁপা হেসে বলে,,
—” মেম এসবে একদম ঢ্যারস আমি!”
নিবেদিতা ফেসে ফেললো। খুশনূরের মনে হলো। তার হাসিতে মুক্ত ঝড়চ্ছে। তার মনে প্রশ্ন উদিত হয়,,
—” এমন একটি মানুষকে কিভাবে ধোকা দিতে পারে ডাঃ সমিত। হাউ? একবার কি বুক কাঁপেনি?”
________
ভার্সিটিতে আজ এক সপ্তাহ চলছে খুশনূরের। সে ক্লাস করে বের হতেই সেই রাতের ছেলেটির তীক্ষ্ণ দৃষ্টির শিকার হয়। এবার অস্থিরতা ধরে রাখতে না পেরে তার সামনে আসে। ভিতরে ভিতরে ভয়ে জুবুথুবু অবস্থা। কেন এমন লাগচ্ছে ভেবে পাচ্ছে না কুহু। আয়াতুল কুরসি পরে বুকে ফু দিয়ে ছেলেটির সামনে এসে গড় গড় করে বলতে লাগে,,
—” দেখুন আম সরি! সেদিন হঠাৎ সে সিচুয়েশনে আমি বেহাল ছিলাম। তার উপর আপনি আমার গায়ে হাত দিয়েছিলেন। সহ্য হয়নি। তাই থাপ্পড় মেড়েছি। তার জন্য আমি দুঃখীত। আর হে এভাবে আর তাকাবেন না। আমার অস্বস্তি লাগে!”
খুশনূরের কথায় শুদ্ধকে নির্বিকার দেখালো। পক্যাটে দু হাত গুঁজে ভাবলেশহীন ভাবে বলল,,
—” হু আর ইউ? ”
খুশনূর থতমত খেয়ে গেল। লোকটি কি তাকে চিন্তে পাড়ছেনা? নাকি চিন্তে চাইছেনা কোনটা?? খুশনূর বলল,,
—” আপনি সত্যি ভুলে গেছেন? নাকি ভোলার নাটক করছেন?”
শুদ্ধ বাঁকা হাসলো। বলল,,
—” আপনি কি আমার আত্মীয়া? ”
খুশনূর মাথা নাড়লো,,
—” নাহ্।”
—” তাহলে আপনাকে আমার চেনার কথাও না!”
খুশনূর ছোট শ্বাস ছাড়লো। এক পলক শুদ্ধকে দেখে স্থান ত্যাগ করলো। কথা বাড়াতে চায় না সে। তার সরি বলার ছিল বলে দিয়েছে ঝামেলা শেষ।
—————
অঞ্জলির মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে পারভিন। সম্পর্ক তার শাশুড়ী হলেও দুজন বান্ধবীর মতো। অঞ্জলি চোখ বুঝে আছেন আরামে। বললেন,,
—” ও বাড়িতে আবার কি হয়েছে? চলে এলি কেন??”
পারভিন মুখ বাঁকিয়ে বলল,,
—” আপনার ছেলে আর নাতীর কাছে আমার কোনো দাম নেই। ছেলেটা এক দমই কথা শুনে না।”
অঞ্জলি হাসলো। বলল,,
—” শুদ্ধ একদম দাদার মতো হয়েছে। ধরে বেঁধে থাকতে চায় না।”
—” আমার তো মনে হয় আম্মা তার থেকে ডেঞ্জারাস। ”
আঞ্জলি হাসে ফেললেন। পারভিন আবার বললেন,,
—” আম্মা আমি ভাবছি এই বেপরোয়া ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দেই। তাহলে যদি ঠান্ডা হয়?”
অঞ্জলি ফিকে হেসে বলল,,
—” তোমার শশুরকে এই ভেবেই আমার সাথে বিয়ে দেয়া হয়েছিল। আজ দেখো আমি কই আর উনি কই!”
হুট করেই বুকটা হাহাকার করে উঠলো অঞ্জলির৷ পুড়নো স্মৃতি ভুলতে চায়। তবুও পাল তোলা নৌকার মতো ভেসে উঠে চোখের পাতায়। দিনটি ছিল গ্রীস্মের একটি দিন। চারিদিকে চৌচির মাঠ, আর খাঁ খাঁ খাল বিল। উত্তপ্ত রোদে পুড়ে স্কুলে থেকে বাড়ি ফিরে সপ্তম শ্রেনীর অধ্যায়ন রত অঞ্জলি। তখনি মা তারা দিয়ে বললেন,,
—” জলধি তৈরি হো মা। হেরা আয়া পড়লো।”
অঞ্জলি ছোট মন। জানতে চাইলো,,
—” কে আম্মা?”
—” তোর হোর বাড়ির লোক!”
অঞ্জলি নির্বিকার। সেদবন তার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। বাবা-মাকে বলে,,
—” আমি বিয়ে করবো না আব্বা। আমি পড়বো!”
—” বিয়ের পর তারা পড়াবে।”
—” তবুও এ বিয়ে করবো না আমি!”
—” বাবা-মার মুখের উপর কথা বলতে নেই যা করতাছি তোমার ভালোর জন্যই!”
সেদিন হাত ছড়িয়ে, মাটিতে গড়াগড়ি করে কেঁদেও লাভ হয় নি। আগত আসা এক আগুন্তকে তার কবুল বলতে হয়।
বিয়ের রাতেই তার বড় মেহরাজ হৈ হৈ করে নিজের বিছানা থেকে নামিয়ে দেয়। সেদিন কতই না কেঁদেছিল সে। সেদিন থেকেই বুঝে গেছিলো। আর যাই হোক এ স্বামী নামক মানুষটি তার আপন নয়।কিন্তু একদিক দিয়ে শান্তিতে ছিল সে। তার পড়াশোনা চলতে লাগলো। তাইতো আজ নিজের স্বপ্ন পুরন করেছে। এবং কি তার মতোই অসহায় মেয়ের স্বপ্ন তিনি পুরন করে চলছে নির্দ্বিধায়।
অঞ্জলির চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। মেহরাজ তাকে কখনো ভালবেসে কাছে ডাকেন নি। একটি বারের জন্য ও না। অথচ সে ব্যাক্তিটির জন্য মনের এক কোনে গভীর অনুভূতি গুলো কবর দেয়া।
—-” তুমি কাঁদছ কেন?”
খুশনূরের কথায় পুড়নো স্মৃতি থেকে বের হয়ে আসে অঞ্জলি। বলে,,
—” পুড়নো স্মৃতি মনে পড়ে গেছে।তোর কথা বল। কলেজ কেমন চলছে?”
খুশনূর হেসে পাশে বসে বলল,,
—” ভালোই চলছে!”
এভাবে আর কিছু সময় পার হলো। পারভিনের সাথে অঞ্জলি পরিচয় করিয়ে দিলো। খুশনূর তো অবাক। বউ শাশুড়ীর কি মিল! যেন মা মেয়ে।
খুশনূর উঠে যেতেই পারভিন বলল,,
—” আম্মা মেয়েটি ভারি মিষ্টি। ”
অঞ্জলি হাই তুলে বলল,,
—” মনে মনে যা ভাবছিস ঝেড়ে ফেল। ”
পারভীন কাচুমাচু করতে লাগলো। মনের মাঝে এক ইচ্ছের বীজ বপন করতে লাগলো। আজ নয় কাল এ ইচ্ছে পুরন করবেই।
চলবে,