#খুশনূর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
০১
নিরব স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের একটি চেয়ারে ঝিম মেরে বসে আছে একটি ১৮-১৯ বছরের শুভ্র সুন্দরী মেয়ে।উস্কোখুস্কো চুল, এলেমেলো জামা কাপড়, চোখের জলের সাথে কাজলের দাগ শুকিয়ে ছোপ ছোপ কালির দাগ লেপ্টে আছে গাল খানিতে।তাতেও তার রূপ এক ফুটো ফেকাসে করতে পারেনি। বরং রূপ যেন আরো বেড়েছে। আশে-পাশে দু-একজন মানুষ বার বার তাকাছে তার দিকে। অঞ্জলির কৌতূহল জাগলো। এত সুন্দরী, রূপসীর এ হাল কেন?কৌতুহল দামতে না পেরে এগিয়ে গেলো সে।
—” তোমার কিছু হয়েছে?”
মেয়েটি মাথা নত করেই না জানালো। অঞ্জলি তার পাশে বসে মাথা হাত বুলিয়ে বলল,,
—” তোমার সাথে কেউ নেই?”
মেয়েটি এবার মাথা তুলে তাকালো। কাজল কালো চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। আবারো আগের মত ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,,
—“আমার কেউ নেই!”
কথাটি যেন অঞ্জলির বুকে গিয়ে বিঁধল। তারোতো কেউ নেই। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। এ বয়সে পরিজন ছেড়ে একা থাকতে হচ্ছে তাঁর।কি ভেবে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে ফেললেন তিনি। আদুরে কন্ঠে বললেন,,
—” যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছেন!”
মেয়েটি ফুপিয়ে উঠলো। অঞ্জলির বুকে তার মায়ের সুখ পাচ্ছে। সে আরো আকড়ে ধরলো।
অঞ্জলি প্রশ্ন করলেন,,
–” তোমার নাম কি মা?”
মেয়েটি অঞ্জলির বুক থেকে মাথা তুলে ম্লান হেসে বলে,,
—“খুশনূর”
অঞ্জলি তাকিয়ে রইলো মেয়েটি ফিকে পড়ে যাওয়া মুখ খানিতে। দেখে মনে হচ্ছে আজ কতদিন যেন মেয়েটি ভালো করে খায় নি। সুন্দর মুখখানা কান্নার ফলে লাল হয়ে আছে। অঞ্জলি চোখের পানি মুছে দিলেন জিগ্যেস করলেন,,
—” কোথায় যাবে?”
—” ঢাকা!”
—” কার কাছে যাবে?”
মাথা নত করে ফেললো খুশনূর।
—” কেন যাচ্ছো?”
—” চাকরির জন্য!”
অঞ্জলি ছোট শ্বাস ছাড়লো। বললো,,
—” হয়তো ভাবছো? একজন অপরিচিত মানুষ এত কথা কেন জিগ্যেস করছে? ”
খুশনূর তাকালো তার দিক। মাথায় এ প্রশ্নিটি ঘুর ঘুর করছিলো। কিন্তু? তার বিষাদের কাছে সব প্রশ্ন উবে গেছিলো। অঞ্জলি নির্বিকার, নির্লিপ্ত ভাবে বলল,,
—” আমার ভাগ্যটা তোমার মতোই। আমারো কেউ নেই!”
_______________
রাতের হিম শীতল হাওয়া ঘরের কোনে কোনে ডুকে পড়ছে। জানালার পাশে মাথা ঠেকে দাঁড়িয়ে আছে খুশনূর। চোখ জোড়া বাহিরের দূর টিমটিম আলোর দিকে।
—” আম্মাও তোমাকে আশ্রয় দিলো?”
ছোট শ্বাস ফেলে বলল ফারিয়া। খুশনূর পিছনে না ফিরেই বলল,,
–“হুম!”
–” আম্মার মন অনেক বড়। আমাকেউ সেই রাস্তা থেকে তার এই অট্টালিকা আশ্রয় দিয়েছে।”
হাসলো ফারিয়া। তারপর বিছানা গুছাতে লেগে পড়লো সে। আর খুশনূর? সে চোখ বুঝে আছে। তার চোখের পাতায় ভাসাচ্ছে, তার অতীত!
বাবা-মার আদরের সন্তান ছিল খুশনূর। ছয় মাস আগেই মা মারা গেছে তার। শোকে কাতরে থাকা খুশনূর। মা মারা যাওয়ার ১০ দিন যায়নি? বাবা বিয়ে করে নিয়ে আসেন। সৎ মার অত্যচারে অতিষ্ঠ খুশনূর। বাবাকে নালিশ করতেই, সৎ মা খুশনূরের নামে বাবার কাছে রসিয়ে রসিয়ে বলে,,
—” তোমার মেয়ে তো হাত ছাড়া হয়ে গেছে? দারোয়ান নয়, সবজি ওয়ালা নয়, ফেক্সিলোড এর দোকান ওয়ালা নয়, সকলের সাথে প্রেমলিলায় মত্ত। ”
বাবা তার মার কথা বিশ্বাস করেই ঘর থেকে বের করে দেয় খুশনূরকে। খুশনূর কেঁদে কুটে নানা বাড়ি আসে সেখানেও ঠায় মিলেনি তার। তাইতো একাই পথ চলতে নেমে পড়েছে সে। সে বাড়িটিতে আর ফিরতে চায় না সে। এখান থেকেই হয়তো জীবন যুদ্ধের শুরু!
___________
মায়া ডায়াগনস্টিক হাসপাতাল থেকে হাসি মুখে বের হয় খুশনূর। চাকরিটা সে পেয়েই গেছে। এত দিনের কষ্টের মাঝে একটি খুশির ঝলক পেলো। খবরটি অঞ্জলিকে দিবে ভেবেই ছুটে চললো বাস ধরতে। কিন্তু খুশিটি কিছু মুহূর্তেই তার কাছ থেকে হাজার মাইল দূরে ছুটে গেল। বাসে উঠার সময় পিছন থেকে কেউ খুশনূরের বুকে মাঝে বিশ্রী ভাবে স্পর্শ করলো। মুহূর্তেই ঘৃণিত অনুভূতি শরীরের কাঁটা দিয়ে উঠলো। পিছনে ফিরে কিছু অপরিচিত মুখ দেখে ভয়ে মুখ শুকিয়ে এলো। বাসের সিটে চেপে বসে দু হাতে মুখে গুঁজে কান্না করে দিলো। এমন পরিস্থিতিতে এর আগে কখনো পরেনি সে।
বাসায় ফিরে ঝরনা নিচে বসে হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠে খুশনূর। সাবান দিয়ে শরীরের স্পর্শ করার জায়গাটি ধুতে লাগলো। এমনটি কি না হলে পাড়তো না? পুরুষ গুলো বুঝি এমনি হয়? মনের মাঝে এক ঝাঁক প্রশ্ন উদিত হলো।তার।
—” খুশনূর? কি হয়েছে? দরজা খোলো!”
শান্ত হলো খুশনূর ভেজা শরীরে বেড়িয়ে এলো। অঞ্জলি চমাকলো।
—” তোমার এ হাল কেন?”
খুশনূর কেঁদে দিলো। তার সাথে ঘটে যাওয়া কথাটি সম্পূর্ণ বলেই থামলো। অঞ্জলি ফোস করে দম ছেড়ে বলল,,
—” জীবনে চলতে গেলে এমন সিচুয়েশনে পড়তেই হয়। সে পর্দাশীল হোক বা বেপর্দা। আমাদের সমাজের আছেই এমন কিছু কাপুরুষ। তাদের জন্য এভাবে ভেঙ্গে পড়তে নেই খুশনূর। কখনো হাতে নাতে ধরতে পেলে কখনো ছাড়বে না। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো সব।”
চলবে