-আম্মানসূরা
সজীব মাহমুদ ভীষন নারী বিদ্বেষী লোক। হবেনা কেন! গত আট বছরে ডজন খানেক ভাইভা দিয়েছে। অনেক গুলোতে তার চেয়ে কম যোগ্যতা নিয়ে নারী প্রার্থীদের চাকরি পেতে দেখেছে। তখন রাগে ভিতরে ভিতরে জ্বলেছে আর ভেবেছে, কেন যে পুরুষ হলাম! দেশের নারী বান্ধব নিয়ম কানুনের উপরও তার বেজায় রাগ, আরে এক পুরুষের চাকরী দিয়ে মা, বোন, বউ মানে তিন নারীর ভাগ্য খুলে যায় কিন্তু এক নারীর চাকরিতে কি কয়েক পুরুষের ভাগ্য খুলে? প্রেমিকের চাকরিপ্রাপ্তি বেকার প্রেমিকার জন্য আনন্দ বন্যা কিন্তু প্রেমিকার চাকরি তো বেকার প্রেমিকের জন্য মৃত্য পরোয়ানা।
সে এই মৃত্যু গ্রহন করেছে ছয় বছর আগে, তার প্রেমিকা চাকরি পেয়ে যাবার পর দশ বছরের প্রেম এক বছরেই শেষ,,,, এরপর থেকেই সজীব মাহমুদ নারী বিদ্বেষী। অনেক ভাইভা পার করে অবশেষে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার মাধ্যমে এমপিও ভুক্ত হাইস্কুলে শিক্ষক হিসাবে মন্দের ভালো টাইপ একটা উপায় হয়েছে তার। সে অবশ্য তাতেই খুশী। আজ তার প্রথম ক্লাস। ক্লাস সেভেনের প্রথম ঘন্টায় বাংলা ক্লাসে ঢোকার মাধ্যমেই তার শিক্ষক জীবনের শুভ সুচনা হল।
প্রথমেই নিজের ব্যপারে সংক্ষেপে পরিচয় দিল তারপর রোল কল করল। সে ভাবল, বাচ্চাদেরকে সত্যদ্রষ্টা হিসাবে গড়ে তুলবে। সমাজ, ধর্ম, সাহিত্য সর্বত্র মায়ের জয় জয়কার! যেন বাবারা কিছুই না! তাই আজ ক্লাসে বাবা সম্পর্কে সবার আবেগ ও পর্যবেক্ষণ কে জাগিয়ে তুলবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। প্রথমে বাবাকে নিয়ে একটা আবেগপূর্ণ লেকচার দিল- বাবার ত্যাগ, প্রেম, মায়া, দয়া ও শক্তি প্রভৃতি ব্যাখ্যা করল। তার লেকচার শুনে বাচ্চাদের চোখ ছল ছল করতে লাগল। সে লক্ষ্য করল বাচ্চারা আবেগাক্রান্ত হয়ে গেছে। এই আবেগ কে বেগ দিতে সে বলল- বাচ্চারা, এখন সবাই ‘আমি ও আমার বাবা’ শিরোনামে রচনা লিখ তো।
দশ মিনিট পরেই এক এক করে বিভিন্ন বাচ্চারা লেখা জমা দিতে থাকল। সে সবার লেখা জোড়ে জোড়ে পড়ে শোনাতে লাগল। ক্লাসে হাততালির বন্যা বইতে থাকল। সবাই খুব কাচা হাতে আনাড়ি কিন্তু সহজ, সরল ও মায়াবী ভাবে লিখেছে। কিছু কিছু লেখা পড়ে সে নিজেই আপ্লুত হয়ে গেছে। হঠাত সে খেয়াল করল, ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল খাতা দেয়নি বরং খাতা বুকে চেপে ধরে রেখেছে। সে মেয়েটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কিছু লেখ নাই মা? ( ভেবেছে মেয়েটার বাবা হয়ত মৃত)
মেয়েটা দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে উত্তর দিল, ‘স্যার আমি লিখেছি কিন্তু আপনার নিকট একটা অনুরোধ ছিল, আপনি আমার খাতা জোরে পড়বেন না। আমি চাইনা এটা আপনি ছাড়া আর কেউ জানুক।’
ছাত্রীর এরকম অনুরোধে সে খুব অবাক হয়ে গেল আর বলল- আচ্ছা আমি একা পড়ব, দেখি কি লিখেছ!
সজীব মাহমুদ খুব আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করল,
” আমার নাম কান্তা। আমি কাঠালিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় এ ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমার রোল- ১। আমি ক্লাস ফাইভের সমাপনী পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস সহ বৃত্তি পেয়েছি। আমার বাবার নাম, মো: মনির আলম। বাবা আমাকে অনেক ভালবাসে। আমি পড়ালেখায় ভাল, এ নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই কিন্তু আমি তাকে নিয়ে লজ্জা পাই। বাবা প্রায়ই বলেন- আমার সাত পুরুষের কপাল তাই তোর মতন হীরার টুকরা আমার ঘরে জন্মাইছে। আমি তখন মনে মনে বলি- আমার ভাগ্য খুব খারাপ তাই আমি এই ঘরে জন্মেছি।
আমার বাবা খুব গরীব। সে আমাদের স্কুলের সামনে প্রতিদিন ঝালমুড়ি বিক্রি করে। রোজ খুব ভোরে ওঠে, ঝালমুড়ির জন্য মশলা তৈরি করে। তারপর তার গামলা ও বাক্স নিয়ে স্কুলে আসে। আমার বান্ধবীরা যখন তার থেকে মুড়ি কিনে তখন আমার খুব কষ্ট লাগে, লজ্জা লাগে। আমি এই কারনে টিফিনের সময় স্কুল থেকে বের হইনা। কাওকে বলিওনা সে আমার বাবা। বাবাও যেন স্কুলের ছেলেমেয়েদের সামনে আমায় না ডাকে সেটাও তাকে বলেছি।
যেদিন আমাদের ক্লাসের টেনে টুনে পাস করা হালিমা বলল, দেখ ওই মুড়িয়ালাটা কত গরীব, গায়ের জামাটা কত ছেড়া আর পায়েও জুতা নেই! সেদিন আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম, লজ্জা পেয়েছিলাম। বাসায় এসে কেদেছিলাম। বাবা বাসায় এসে যখন জিজ্ঞেস করল, আম্মাজান আপনি কান্দেন কেন? তখন আমি তাকে হালিমার সব কথা বলে দিয়েছিলাম। সব শুনে সে মিনিট পাচেক চুপ করে ছিল। এরপর থেকে সে আর ছেড়া জামায় স্কুলে আসেনা, জামাতে সেলাই আর তালি থাকে।
মাঝেমাঝে আমি খুব কান্না করি, আমি কেন ঝালমুড়িয়ালার মেয়ে হলাম অথচ ফেল করা নাসিমার বাবা চেয়ারম্যান। ক্লাসের সবার বাবাই আমার বাবার থেকে অনেক ভাল। আমার বাবা মন্দ নয় তবে গরীব ঝালমুড়িয়ালা। আমি ঝালমুড়িয়ালার মেয়ে, এই পরিচয় আমাকে কষ্ট দেয়। বাবার ভালবাসা আমার কাছে অনেক তুচ্ছ লাগে তাই। আমার বাবার জন্য অনেক মায়াও লাগে। নিজের এই মনোভাবের জন্য কষ্টও লাগে। আমি বুঝি আমি আমার ভাল বাবার খারাপ মেয়ে।”
এই পর্যন্ত পড়ে সজীব মাহমুদের চোখে জল এসে পড়ল। সে ঝাপসা চোখে চিঠির লাস্ট লাইন কোনমতে পড়ল- ” স্যার আমি কি খুব খারাপ মেয়ে?”