খাকি মলাটের বই
আমার নাম মোঃ রফিকুল ইসলাম।
গ্রামে যখন ছিলাম, সবাই আমাকে রফি বলেই ডাকতো।
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকায় একটা কলেজে অনার্স ভর্তি হলাম, সেখানে আমাকে সবাই রফিক বলে ডাকা শুরু করল। তাই এখন আমি রফিক।
আমি থাকি একটা মেসে। এম এ পাশ ছোটখাটো একটা চাকরিতে ঢুকেছি, বেতন বারো হাজার টাকা।
মাসিক চার হাজার দুশ টাকা থাকা খাওয়া, এই বাজারে এই টাকায় থাকার মতো একটা তিন হাত লম্বা দু হাত চওড়া চৌকি আর একটা নড়বড়ে টেবিল সাথে ডাল ভাতের ব্যবস্থা হয়েছে, সেটাই অনেক কিছু।
আমার বাবা একটা ছোট্ট মনোহারী দোকান চালান, আরো তিন ভাইবোনের লেখাপড়া খাওয়া দাওয়া চালাতেই তিনি হিমশিম খান।
আমি টিউশনি করি একটা। আগে তিনটা করতাম, এখন আর সময় পাই না
আমার বেতন আর টিউশনির টাকা থেকে বাড়িতে তিন হাজার টাকা পাঠাই, চারহাজার দুশ টাকা মেসে দেওয়ার পরে হাতে অল্প কিছু টাকা থাকে৷ তাই অফিসে টিউশনিতে যাওয়ার জন্য রিক্সা ভাড়াও থাকে না আমার হাতে।
আমি যাই বাসে। বাসে চড়তে অবশ্য আমার খারাপ লাগে না। কাঁটাসুরের চিপা গলির ঘুপচির মতো মেসবাড়িতে আমার খুব একটা ভালো লাগে না। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে থাকি।
বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি গুলোর খোলা বারান্দা দেখে আমার হাহাকার লাগে, আহারে যত সুখ বুঝি ওই সব বারান্দায় দোলা দেয়।
সন্ধ্যায় ঝলমলে আলোর শহরে আমার চোখ যায় বড় বড় শপিংমল বা ওইসব ফ্ল্যাট বাড়িতে। কত রঙের আলো!
আমার ঘুপচি ঘরে একটা এনার্জি বাল্বে অন্ধকার দূর হয় না।
আমি সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে যাই একেরপর এক।
কিন্তু চাকরি হয় না। পাশ করার পর থেকে আমার বাবা মা আশা করে আছে আমার একটা বড় চাকরি হবে, আমার বোনের বিয়ের দায়িত্ব আমি নিবো। বাড়িতে আরো কিছু বেশি টাকা পাঠাবো ।
মা প্রায়ই আমার বিয়ে দিতে চান।
তারা বেতনের দূরবস্থার কথা বোঝেন না।
আমিও স্বপ্ন দেখি একদিন একটা বড় চাকরি করবো, এ রকম একটা খোলা বারান্দা ওয়ালা একটা ফ্ল্যাটে থাকবো, কিন্তু এসব স্বপ্ন দেখা অনেক সহজ।
বাস্তবতা হলো, মাসের শেষ সাতদিন আমার কাছে খুচরো টাকা ছাড়া কিছু থাকে না।
দুপুরে আমি অফিসে লাঞ্চ করতে পারি না, কারণ ওখানে প্রতি মিলে ৮০ টাকা পরে যায়। আমি খাই জলিলের এর হোটেলে।
অফিস থেকে বেড়িয়ে একটু সামনেই, প্রায় ফুটপাতের উপরেই কয়েকটা বেঞ্চ দেওয়া।
ভাত ডাল, লাল শাক, আলুভর্তা এগুলো আমার রোজ কার খাবার।
আমাকে প্রতি কাপ চাও হিসেব করে খেতে হয়।
আমার অফিস শেষ হয় ছয়টায়, তারপর টিউশনিতে যাই। আমার স্টুডেন্ট ক্লাশ ফোরে পরে, নাম নিশু।
নিশুকে পড়াতে আমার খুব ভালো লাগে।
এর কারন অবশ্য আলাদা।
নিশুর বড় বোন, ইশা। কোন একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।
ইশাকে আমার মনে হয় ও কোন পৃথিবীর মানবী না, স্বর্গ থেকে ভুল করে চলে এসেছে পৃথিবীতে।
পিঠভরা চুল, টানা টানা চোখ।
মাঝে মাঝে আমাকে চা দিয়ে যায়, নিশুর মা ব্যস্ত থাকেন যদি।
ইশা কাছে এলেই একটা মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আছে।
কেমন যেন, অনেকটা কমলালেবুর মতো।
অথবা কোথাও দূরে বাতাবী ফুল ফুটেছে, বাতাসে ভেসে আসা তার আগমনী সুগন্ধ।
ইশা একটু হাসে ঠোঁটের কোণ দিয়ে, আমার মনে হয়, কোন বিলে যেন শত শত কচুরীপানার ফুল, পাপড়িতে ময়ূরকণ্ঠী রঙ নিয়ে ফুটে আছে।
একদিন পড়াতে গিয়ে শুনলাম, নিশু বাইরে গিয়েছে, ইশা আমাকে বসতে বললো।
ইশার হাতে একটা খাকি মলাটের বই।
কি বই ওটা, জানতে চাইলাম।
ইশা এগিয়ে দিলো, এরিখ মারিয়া রেমার্কের “প্রত্যাগত”।
অনুবাদ কিন্তু ভারতীয় প্রকাশনা, আমি পড়লাম না, আমার গল্পের বই পড়ার অভ্যাস নেই। তবুও চাইলাম বইটা।
ইশা বইটা দিয়ে ভেতরে চলে গেলো।
নিশুকে পড়াতে মন বসলো না, চলে এলাম মেসে
বইটা কাছে নিয়ে সেই মিষ্টি গন্ধটা পেতে চাইলাম, কিন্তু এখন শুধুই কাগজের গন্ধ।
তবে বইটা ইশার হাতে ছিল, এজন্য বইটা ছুঁয়ে দেখতেও আমার ভালো লাগে।
বইটা আমার কাছে থেকে যায়, আমি আর ফেরত দেই না।
আমার দিন কেটে যায়।
গরম,জ্যাম,ভীড়ে আমি পাবলিক বাসে গাদাগাদি করে অফিস যাই, অফিস ছুটির পরে টিউশনি।
আবার ক্লান্ত হয়ে ফিরি।
বাড়িতে ফোন করলে শুনি, শুধু অভাবের কথা।
বোনটার বয়স হয়ে যাচ্ছে, পাত্র দেখা দরকার।
বাবার শরীর টানে না, ব্যবসা আগের মতো জমে না।
এখন আমার দায়িত্ব নেওয়া প্রয়োজন
এত কিছুর মধ্যেও আমার মনে আসে ইশার কথা।
টেবিলে হাত দিয়ে বইটা নিই, ছুঁয়ে দেখি।
ফেরত দেওয়ার ইচ্ছে হয় না।
একদিন নিশু বললো, সে সাত দিন পড়বে না।
বাসায় অনুষ্ঠান আছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি অনুষ্ঠান যে তুমি পড়বে না!
নিশুর মা ঢুকতে ঢুকতে বললেন হেসে, ইশার বিয়ে ঠিক হয়েছে।পাত্র বহুজাতিক কোম্পানিতে বড় চাকরি করে। আমাকে অবশ্যই আসতে হবে।
আমি চুপচাপ শুনি।
তারপর পড়ানো শেষ করে চলে আসি।
সাত দিন পরে আবার পড়াতে যাই, শুনি ইশার বিয়ের আয়োজনের গল্প।
আবার বাসে করে মেসে ফিরি।
বাস থেকে তাকিয়ে সুউচ্চ আবাসিক ভবনগুলোতে তাকিয়ে দেখি, কোথাও ইশা আর সাথে ওর বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরী করা বর খুনশুটি করছে।
আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
আমি মেসে ফিরে বইটা ছুঁয়ে দেখি বার বার।
খাকি মলাটের বই
লেখিকা : শানজানা আলম