গল্প: ক্যালেন্ডার!
পর্ব: ১৯!
লেখক: তানভীর তুহিন!
প্রায় চার বছর পর!
কানাডার আকাশে সুর্য উঠে সকালের সংকেত স্পষ্ট করছে। মিছিল মুবিনের বাহুতে আলতো চিমটি কেটে কেটে মুবিনকে ডাকছে, ” উঠো, ব্রেকফাস্ট বানাও গিয়ে। ”
মুবিনের কোনো সাড়াশব্দ নেই, মুবিন বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। মিছিল ঘুম জড়ানো কন্ঠে আবার গোঙায়, ” উহ! উঠো না। ”
এবার মুবিনের কানে মিছিলের ডাক পৌছায়। মুবিন মিছিলের দিকে ফিরে মিছিলকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” এখন উঠতে পারবো না। ঘুম পাচ্ছে! ”
মিছিল বিরক্তি নিয়ে বলে, ” শুধু উইকেন্ডের দুদিনই তো তুমি নাস্তা বানাও। সেই দুদিনও হাজার অযুহাত, ঘুমাও তুমি। আমার তো ঠ্যাকা পড়ছে না, আমিই বানাচ্ছি! ”
বলেই উঠে বসে মিছিল। মুবিনও আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলে চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে। মিছিল খাট ছেড়ে নামতে যাবে তখনই মুবিন বলে, ” আমি যাচ্ছি তুমি ঘুমাও! ”
মিছিল ঘুম নিভু নিভু চোখে রাগ নিয়ে তাকায় মুবিনের দিকে। মুবিন চোখ ডলে ঘুম তাড়াতে ব্যাস্ত। মিছিল বলে, ” তোমার প্রত্যেক সপ্তাহের এই একই ঢং তাইনা? সেই তো নাস্তা তুমি বানাতে যাচ্ছো, তাহলে আমার ঘুমে বিরক্তি ক্যান করলা? ” কথা বলতে বলতেই মিছিল মাথা এলিয়ে দেয় বালিশে। মুবিন কিছু না বলে মিছিলের কপালে একটা আলতো চুমু খেয়ে খাট থেকে নেমে পড়ে।
ব্রাশ করে কিচেনে এসে আটা মাখছে মুবিন। মুখে তার চরম বিরক্তি, এখনও ঘুম কাটেনি বরং ঘুম আরো বেশি করে এসে জটলা পাকিয়েছে। আটা মাখছে আর বিরক্তিস্বরে বিড়বিড় করছে মুবিন, ” আরো প্রেম কর বলদ শালা। প্রেম ঠিক ছিলো, এই লিভ ইন রিলেশনশিপটাই যত আকামের কারন। ছুটির দিন কোথায় একটু ঘুমাবো, না এসে ঘরের বাধ্য বউদের মতো আটা মাখছি। থাগ লাইফ, শালার! ”
মিছিলের ঘুম চলে গেছিলো তাই মিছিলও ব্রাশ করে কিচেনে ঢুকছিলো মুবিনকে হেল্প করার জন্য। কিচেনে ঢুকতে ঢুকতেই মুবিনের বিড়বিড়ানো শুনতে পায় মিছিল। কারন মিছিল ঘুমোচ্ছে ভেবে মুবিন একটু জোরে জোরেই আপনমনে বিড়বিড় করছিলো। মিছিল কপট রাগ দেখি শক্ত গলায় পেছন থেকে বলে, ” খুব কষ্ট লেগে গেছে একদম! তাইনা? আর আমি যে সপ্তাহের ৫ দিন ব্রেকফাস্ট বানাই তখন আমার কষ্ট লাগে না? আর আমি তো উঠছিলামই, আলহাদ দেখিয়ে তুমি আসলা ক্যান? আর এসে এখন লিভ ইন এর দোষ দিচ্ছো কেনো? লিভ ইন এর প্ল্যান কার ছিলো? ”
মিছিলের একাধিক প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় মুবিন। মুবিন পিছন ফিরে মিছিলের কথা শুনছিলো, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়ায় কোনো উত্তর বা অযুহাত না দিয়েই আটা মাখায় মন লাগায় মুবিন। মুবিনের আচরনে রাগে লাল হয়ে যায় মিছিল, সে ভেবেছিলো মুবিন হয় সফট আর্গুমেন্ট করবে নাহয় এমনি কোনো অযুহাত দেবে। কিন্তু তা কিছু না করে মুবিন ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ায় প্রচন্ড রাগ হয় মিছিলের। মিছিল এগিয়ে গিয়ে আটা মাখার মাঝারি গামলাটা টান মেরে নিজের দিকে এগিয়ে নেয়, তারপর আটায় হাত দিয়ে আটা মাখতে শুরু করে। মুবিন কিছু না বলে ওখানেই দাঁড়িয়ে মিছিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। মিছিলের কপালের সামনের কোনায় গোটাকতক চুল পড়ে আছে। আর চুল সব হাতখোপা করে বাধা। ওই গোটাকতক পড়ে থাকা চুল আলতো আদ্র বাতাসে দুলছে সাথে মুবিনের মনের ভেতরটাও দুলছে। সম্পর্কের প্রায় পাচবছর পরেও মিছিলের জন্য ঠিক প্রথমকার মতো অনুভুতি হচ্ছে মুবিনের। ব্যাপারটা উপলব্ধি করতেই মুচকি হেসে ফেলে মুবিন। মুবিনকে দাঁড়িয়ে মিছিলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে দেখে মিছিল মুবিনকে বলে, ” এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে সময় নষ্ট না করে গিয়ে ঘুমাও। তোমার না ঘুম নষ্ট হয়েছে! ” বলেই চোখ দুটো আবার আটার গামলায় নিক্ষেপ করে মিছিল। মুবিন কিছু না বলে গিয়ে মিছিলকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মিছিলের খোলা ঘাড়ে ঠোট ছোয়ায়। তারপর মিছিলের পাতলা টি-শার্ট সরিয়ে মিছিলের পেট খামচে ধরে। মুবিনের আকস্মিক আচরনে মোটেও অবাক হয়ে যায়নি মিছিল, কারন সে জানতো মুবিন এখন এমন কিছুই করবে। মিছিল কোনো প্রতিক্রিয়া না করে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে, ” এই ঢং আলহাদ না করে গিয়ে ঘুমাও। ঘুম নষ্ট হলো তো তোমার!, যাও ঘুমাও গিয়ে কাজে দিবে। ”
– ” এখানে এতো সুন্দর বালিশ থাকতে খাটে গিয়ে ঘুমাবো কেনো? এখানেই ঘুমিয়ে যাচ্ছি, খাটের চেয়ে এখানেই বেটার ফিল করবো। ” বলেই মুবিন নিজের মাথাটা বাকিয়ে মিছিলের ঘাড়ে পেতে দেয়। মিছিল কিছু বলে না। কারন মিছিল জানে এখন সে হাজারবার বললেও মুবিন এখান থেকে যাবে না। তাই মিছিল কিছু না বলে আটা মাখাতে মনযোগ দেয়, আর মুবিন ওভাবেই মিছিলের কাধে মাথা পেতে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে।
খানিকবাদে মিছিল বলে, ” এই তুমি রুটি বেলে দাও আমি ভাজছি! ”
মুবিন মৃদু গোঙানো স্বরে বলে, ” তুমি বেলে ফেলো আমি ভেজে দিবোনে! ”
মিছিল মুবিনের পেটে কনুই দিয়ে গুতো মেরে বলে, ” এতো আলসে ক্যান তুই? ”
মুবিন কিছু বলে না। মিছিল আবার বলে, ” সারাদিন শুধু এসবই করিস খালি। কোনো কাজে তো হেল্প জীবনেও করবি না, সব কাজ একার আমারই করতে হয়। ”
মুবিন চোখ বুজে থাকা অবস্থাতেই মিছিলের টি-শার্টটা একটু হেচকা টান মেরে বলে, ” এই যে এটা পড়ে আছস? এটাও গত সপ্তাহে আমারে দিয়ে ধোয়াইছিস। তারপরেও আমি তোর কাজে হেল্প করি না? ”
মিছিল আবার মুবিনের পেটে কনুই দিয়ে গুতো মেরে বলে, ” একসাথে গোসল করতে ঢুকবেন। গোসল করতে ঢুকে তিনঘণ্টা লাগায় আপনি গোসল গোসল খেলবেন তাহলে জামাকাপড় তো আপনারই ধুতে হবে তাইনা? ”
– ” এমনিতেও তুমি আমার উপর বেশি জোরজুলুম করো! ”
– ” সহ্য না হলে নতুন প্রেমিকা খুজে নাও, এমনিতেও প্রেমের পাচ বছর হয়ে গেছে। বিয়ের আগেই বিয়ের পরের সব কাজ করে ফেলছো, এখন আর জোরজুলুম ভালো লাগবে কেনো? অথচ রিলেশনশিপের শুরুর দিকে এই জোরজুলুম’ই তোমার প্রিয় পছন্দের ছিলো! ”
– ” তো এখন অপ্রিয়, অপছন্দের সেটা কখন বললাম? ”
মিছিল ঘাড় ঘুরিয়ে মুবিনের দিকে তাকিয়ে বলে, ” এই মাত্রই না বললা আমি তোমার উপর বেশি জোরজুলুম করি? ”
– ” হু বললাম, কিন্তু এটা কখন বললাম যে তোমার জোরজুলুম আমার কাছে অসহ্যকর? ”
– ” বুঝিয়ে বলা লাগে না। গলার ভয়েস টোন শুনলেই বোঝা যায়! ”
– ” তুমি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার নাকি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার? ”
– ” নিজের বিগড়ে যাওয়া বয়ফ্রেন্ডের ভয়েস টোন যেকোনো সাধারন স্বাভাবিক মেয়েই বুঝতে পারবে। তার জন্য সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হতে হয় না! ”
– ” রিলেশনশিপে লয়াল থাকাটাকে বিগড়ে যাওয়া বলে? ”
মিছিল কিছু না বলে না। মুবিন আবার জিজ্ঞেস করে, ” এখন চুপ করে আছিস কেনো? বাই এনি চান্স তুই আমায় কোনো মেয়ে-ফেয়ে নিয়ে ডাউট করছিস না তো জানু? ”
– ” ক্যাজুয়ালি বলছি। আর মেয়ে নিয়ে ডাউট? তাও তোরে? কোন মেয়ের মাথা খারাপ হইলো রে ভাই যে তোর সাথে প্রেম করবে? আমার কপাল ফুটো ছিলো যে আমি পটে গেছিলাম! ”
– ” মুড সুইংয়ের বস্তা তো তুমি। এই না গতকাল রাতে যখন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছিলা তখন বললা তোমায় পেয়ে লাকি, এমএসসি’র পরেই বিয়ে করে ফেলবা, আর বিয়ের পরেই বাচ্চা নিয়ে নিবা। আর এখন তোমার কপাল ফুটো? ”
– ” অনেক ঢং করছো, এখন আমায় ছেড়ে খুন্তি ধরো। রুটি ভাজো! ”
– ” তুমি ভাজো না, আমি হেল্প করছি। ”
মিছিল কপাল কুচকে পেছনে তাকিয়ে বলে, ” রুটি ভেজে দিলে আমার হেল্প হবে। রুটি যদি আমিই ভাজি তাহলে তুমি আমায় হেল্প করছো কীভাবে? ”
– ” এই যে সকাল সকাল আদর করছি, এভাবে! ”
– ” এটাকে আদর বলে না। খাস বাংলায় লুইচ্চামি বলে এটাকে! ”
মুবিন সঙ্গে সঙ্গে মিছিলকে ছেড়ে পাশে থাকা খুন্তিটা হাতে নিয়ে বলে, ” আমি রুটি ভেজেই হেল্প করছি! ”
মিছিল খিলখিলিয়ে হেসে বলে, ” আহালে বাচ্চাটা, আমি মজা করছিলাম। তুই জড়িয়ে ধরে থাক আমি ভাজছি, এতেই হেল্প হবে। ”
মুবিন খুন্তি ছেড়ে বাকা হেসে বলে, ” লুক ইটস কলড ডাবল ক্রসিং! ”
মিছিল ভ্রু কুচকে বলে, ” এখানে কে কী ডাবল ক্রস করলো? ”
– ” এই যেমন আমি তোমায় ইমোশনাল করে দিয়ে কাজ থেকে বেচে গেলাম! ”
– ” আমি ইমোশনাল কখন হলাম? ”
– ” জাস্ট কিডিং, রুটি ভাজো ক্ষুদা লাগছে। ”
– ” আগে ক্লিয়ার করো ইমোশনাল কখন হলাম? ”
– ” যখন বললা তুই জড়িয়ে ধরে থাক আমি ভাজছি, এতেই হেল্প হবে, তখন! ”
– ” এটাকে ইমোশনাল হয়ে যাওয়া বলে নাকি? ”
– ” রুটি ভাজো, তুমি বুঝবানা। ”
– ” আচ্ছা। বাই দ্যা ওয়ে আজকে সব জামাকাপড় তুমি ধুয়ে দিবা। ”
– ” তার মানে আজকেও ৩ ঘন্টার গোসল শো হবে! ” বলেই চওড়া হাসে মুবিন।
– ” হু ঢং, নিউমোনিয়া হয়ে যাবে আমার। ”
– ” আচ্ছা তাহলে ২ ঘন্টা! ”
– ” আরেকটা কথাও বলবি না, ব্রেকফাস্ট বানাতে দে! ”
চলবে!
#thetanvirtuhin
প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে!♥
” Tanvir’s Writings “