গল্প: ক্যালেন্ডার!
পর্ব: ১৭!
লেখক: তানভীর তুহিন!
মুবিনের ফ্ল্যাটের দরজায় তালা ঝুলছে। গাড়ি ছাড়া মুবিন কোথাও বের হয় না। গাড়ি পার্কিংয়ে পার্ক করা অথচ ফ্ল্যাটে তালা ঝুলছে। মুবিন গেলো কোথায়?
মিছিল ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যে সে এখন কী করবে। কেমন যেনো দিশেহারা লাগছে নিজেকে তার। থমকে দাঁড়িয়ে আছে মিছিল। শাওন মিছিলের কাধে হাত দিয়ে বলে, ” আরে টেনশন করিস না। দাড়া, আমি পাশের ফ্ল্যাটে জিজ্ঞেস দেখছি ওনারা কিছু জানেন কিনা। ”
মিছিল কিছু বলে না, স্তব্ধতায় যেনো তলিয়ে গেছে মিছিল। শাওন গিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের দড়জায় টোকা লাগায়। একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা বেড়িয়ে আসে। শাওনকে দেখেই মহিলা একটু হেসে বলে, ” শাওন যে! কেমন আছো? ”
– ” এইতো আন্টি ভালো। আসলে মুবিনের ফোনটা গতকাল রাত থেকে অফ। ভার্সিটিতেও যায়নি আজ। তাই ওর সাথে দেখা করার জন্য এলাম। নিচে দেখলাম ওর গাড়ি পার্ক করা কিন্তু এখানে তালা ঝুলছে। মুবিন কোথায় গেছে সে ব্যাপারে কিছু জানেন আন্টি? ”
– ” না। মুবিনকে তো গতকাল রাত প্রায় ১১ টার দিকে বেড়িয়ে যেতে দেখেছি। হয়তো তারপরে আর ফ্ল্যাটে আসেনি। কিন্তু ও গাড়ি না নিয়ে গেলো কোথায়? ”
– ” সেটাই তো ভাবার বিষয়। ও তো গাড়ি ছাড়া বের হয় না। ”
– ” আমার মতে আহাদ সাহেবকে ব্যাপারটা জানাও। উনি দেখে নেবে সবটা! ”
– ” না আন্টি। যদি মুবিন একটু পরে চলে আসে আর যদি শোনে যে ওর বাবাকে এসব জানিয়েছি তাহলে শুধু শুধুই চিল্লাচিল্লি করবে। আপনি তো জানেন ওর আর ওর বাবার বন্ডিং এর ব্যাপারে! ”
– ” হ্যা তাও ঠিক। আচ্ছা তোমরা বরং ভেতরে এসে বসো? ”
– ” না আন্টি। আমরা বরং ওর দরজার সামনেই ওয়েট করি! ”
– ” আচ্ছা, ও এলে আমায়ও জানিয়ে দিও। ”
– ” আচ্ছা আন্টি। ”
প্রায় আড়াইঘন্টা যাবৎ দাঁড়িয়ে থেকে, সিড়িতে বসে, দেয়ালে হেলান দিয়ে, হাটু ভর দিয়ে বসে মুবিনের অপেক্ষা করছে ওরা। কিন্তু মুবিনের কোন পাত্তা-ফাত্তা নেই। এভাবে অপেক্ষা করটাও বিরক্তির। অবশেষে অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে শাওন আহাদ শেখকে কল করে। আহাদ শেখ ফোন রিসিভ করতেই শাওন সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ” কেমন আছেন আঙ্কেল? ”
আহাদ শেখ সালামের উত্তর দিয়ে চনমনে মেজাজে বলে, ” এইতো ভালো। তা তোমার কী খবর শাওন? ”
– ” হ্যা আঙ্কেল ভালোই। আসলে আঙ্কেল মুবিনকে না খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওর ফোন গতকাল রাত থেকে বন্ধ, গাড়িটাও ওর এপার্টমেন্টের পার্কিংয়ে পার্ক করা, এখানে এসে ওর পাশের ফ্ল্যাটের আন্টিকে জিজ্ঞেস করলাম ওর ব্যাপারে। আন্টি বললো, ও নাকি গতকাল রাত ১১ টায় বেড়িয়েছে। ”
– ” গাড়ি পার্কিংয়ে। গাড়ি ছাড়া কোথায় গেলো? আচ্ছা তোমাদের সাথে কী ওর কোনো কিছু হয়েছে? ”
আহাদ শেখের কথায় ভাবনায় পড়ে যায় শাওন। কারন আহাদ শেখ মিছিলের ব্যাপারে কিছু জানেনা, এখন কী মিছিলের সাথের ঝগড়াটার কথা বলবে? ঝগড়ার কথা বলতে গেলে তো ওদের সম্পর্কের কথাও বলতে হবে। শাওন কান থেকে ফোন নামিয়ে মুখের কাছ থেকে ফোনটা খানিক দূড়ে সরিয়ে মিছিলকে ডাক দেয়। মিছিল নিশ্চুপভাবে মনমরাভাবে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। শাওন ডাকায় হেলান ভেঙে এগিয়ে আসে। মিছিল আসতেই শাওন ফিসফিসিয়ে বলে, ” আঙ্কেল জিজ্ঞেস করছে আমাদের সাথে মুবিনের কিছু হয়েছে নাকি? তোর আর মুবিনের ওই ঝগড়া আর মুবিনের ওই কথাগুলোর কথা বলবো ওনাকে? ”
মিছিল শাওনকে কিছু না বলে ইশারায় ফোনটা তার কাছে দিতে বলে। ফোন হাতে নিয়ে কানের কাছে ধরে মিছিল বলে, ” আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। ”
ওপাশ থেকে আহাদ শেখ বলে, ” হুস দিস? ”
– ” আমি মিছিল, আঙ্কেল। মুবিনের বন্ধু! ”
আহাদ শেখ কিছু বলে না। আহাদ শেখ চুপ থাকায় মিছিলও চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করে। কিছু মুহুর্ত চুপ থাকার পরে আহাদ শেখ গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে মারে, ” শুধু বন্ধু নাকি প্রেমিকা? ”
মিছিল একটুও অবাক হয় না। কারন সে মনে মনে এই প্রশ্নটারই আশা করেছিলো আহাদ শেখ এর কাছ থেকে। প্রশ্ন অনুমান করে রাখায় উত্তরও তৈরীই ছিলো মিছিলের। মিছিল দ্রুতভঙ্গিতে বলে, ” হ্যা আঙ্কেল প্রেমিকা! ”
আহাদ শেখ হাসতে শুরু করে। হাসির শব্দ শুনে এপাশ থেকে মিছিল বুঝে যায় আহাদ শেখ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে। তাচ্ছিল্যের হাসিটাকে কিচ্ছুক্ষন খুচিয়ে খুচিয়ে সুড়সুড়ি দেবার পরে আহাদ শেখ বলে, ” স্ট্রেঞ্জ না? উইয়ার্ড আর অকওয়ার্ডও আমার ছেলে প্রেম করে সেই কথাটা আমার জানতে হয় ছেলের প্রেমিকার কাছ থেকে। মানে আমি আমার ছেলের জন্যে মোটেই কেউ নই, আম সাচ এ্যা লুজার! আন্ড সাচ এ্যা ওরস্ট ফাদার! ”
মিছিল জবাব খুজে পায় না। আহাদ শেখকে সে মোটেই ঘৃনা করে না কিন্তু প্রথমবার কথা বলাতে কেমন যেনো একটা চরম অস্বস্তিবোধ হচ্ছে তার। মিছিল আহাদ শেখের কথায় কর্নপাত না করে বলে, ” আসলে আঙ্কেল মুবিনের সাথে গতকাল আমার একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে! ”
তারপর মিছিল কিছু না লুকিয়ে নির্দিধ্বায় সবটা বলে আহাদ শেখকে। আহাদ শেখ সবটা শুনে মিছিলকে বলে, ” আমি মুবিনকে চিনি এই ছোট একটা জিনিস নিয়ে ও ওর গার্লফ্রেন্ডের সাথে এমন করবে এটা হতে পারে না। অন্য আর কোনো কথা থাকলে তুমি নিশ্চিন্তে, নির্দিধ্বায়, ফ্রি’লি বলতে পারো। আমি মাইন্ড করবো না! ”
মানুষটা কতোটা ভাবে মুবিনের জন্য। আর মুবিন মানুষটার নাম অবধি শুনলে রেগে যায়। বড়ই আশ্চর্যের! ব্যাপার তাইনা?
মিছিল মলিন হেসে উত্তর দেয়, ” আঙ্কেল আমি কিছুই লুকোইনি। যা হয়েছে সেটাই বলেছি! ”
– ” আচ্ছা আমি দেখে নিচ্ছি ব্যাপারটা। ওর কোনো ট্রেস পেলেই জানাবো তোমাদের! ”
– ” থ্যাংকস আঙ্কেল! ” একপ্রকার মুখ ফসকেই মিছিলের মুখ থেকে কথাটা বেড়িয়ে গেছে। এই চরম ভুলটা সে কীভাবে করে ফেললো? মিছিল থুতুনি শক্ত করে চোখদুটো বন্ধ করে নেয়।
ওপাশ থেকে আহাদ শেখ তীব্র কন্ঠে হাসে। হ্যা এবারও তাচ্ছিল্যের হাসিই হাসে। হাসতে হাসতে আহাদ শেখ বলে, ” আমার ছেলের খোজ পাওয়া যাচ্ছে না। তার খোজ বের করবো তার জন্যই আমার তার গার্লফ্রেন্ডের মুখ থেকে থ্যাংকস শুনতে হচ্ছে। আম দ্যা মোস্ট লাকিয়েস্ট ড্যাড ইন দ্যা আর্থ! ” বলেই হাসতে থাকে আহাদ শেখ। মিছিল কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোনটা কেটে দেয় আহাদ শেখ। মিছিলের মুখের কথাটুকু মিছিলের মুখেই আটকে পড়ে। মিছিল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনটা শাওনের দিকে এগিয়ে দেয়, শাওন ফোনটা নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে যথারীতি দেয়ালে হেলান দিয়ে মাথা উচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সীমান্তও শাওনের পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চৈতি সিড়িতে বসে সিড়ির রেলিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে আছে, মিছিলও গিয়ে সিড়িতে বসে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দেয়। এপার্টমেন্ট এর সিড়ি তেমন বেশ ব্যাবহার হয় না। কারন সবাই উপর-নিচ যাতায়াতের জন্য লিফটই ব্যাবহার করে।
আসরের আযান দিচ্ছে। সেই সকাল প্রায় সাড়ে ১০ টা থেকে সবাই মুবিনের ফ্ল্যাটের সামনে অপেক্ষা করছে , অপেক্ষা করতে করতে হাপিয়ে উঠেছে ওরা। মিছিলের মনে নানান ধরনের আজে-বাজে চিন্তা আসছে। এই যেমন, মুবিন ওকে ছেড়ে চিরকালের জন্য দুড়ে কোথাও চলে যায়নি তো?, মুবিন কী গতকালের কথাগুলো সিরিয়াস হয়েই বলেছিলো? মিছিল এসব ভেবে ভেবে নিজেকে অপরাধী দাবি করতে থাকে। সে যদি কাল ভালোবাসি কথাটা বলে দিতো তাহলে তো আর এসব হতো না, তাইনা? সে কাল মুবিনকে ওভাবে ট্রিট না করলেই পারতো। তাহলে আজ সব ঠিক থাকতো, সে মুবিনের সাথে বাইরে কোথাও বসে প্রেম করতো। ভাবতেই চোখ দিয়ে দুফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে মিছিলের।
সে তো শুধুমাত্র মজার ছলেই গতকাল অমন করেছিলো। কিন্তু সে ব্যাপারটাকেই যে মুবিন টেনে এতো বিশাল করে ফেলবে তা তার কল্পনাতীত ছিলো। মিছিল হু! হু! শব্দ করে ফুপিয়ে কেদে ওঠে। শাওন-সীমান্ত অবাক স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মিছিলের দিকে। মিছিলকে শান্তনা দেবার ভাষাও তাদের জানা নেই, তারা নিজেদেরই শান্তনা দিতে পারছে না। কারন এর আগে কখনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি তারা।
চৈতি মিছিলকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” আরে পাগল কাদিস না। আঙ্কেল ঠিকই কিছু না কিছু জানাবে! ” কথা বলার সময় চৈতির গলাও কান্নায় জড়িয়ে আসে।
সীমান্ত মিছিলের কাছে গিয়ে বলে, ” আর কতক্ষন এভাবে বসে থাকবি? চল বাসায় চল। আর কাদিস না, দেখিস কালকের মধ্যেই মুবিনকে পাওয়া যাবে। ”
মিছিল কিছু না বলে, ফুপিয়ে কাদতে থাকে।
মুবিনের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে শাওন-সীমান্ত মিছিলকে ওর বাড়িতে দিতে আসে, চৈতিও আসে। মিছিল এখনও কাদছে। শাওন মিছিলকে বলে, ” কাদিস না। আমি এখন বাসায় গিয়ে আমাদের সার্কেল নিয়ে ওকে খোজা শুরু করবো। আর কোনো কিছু জানতে পারলেই তোকে জানাবো। যা বাসায় গিয়ে খেয়ে দেয়ে রেস্ট কর! ”
মিছিল কিছু বলার জন্য খুজে পায়না। কাদতে কাদতে বাসার ভেতরে চলে যায়।
শাওন-সীমান্ত চৈতিকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে, নিজেরা বাসায় গিয়ে নিজেদের বন্ধুবান্ধবদের সাহায্য নিয়ে মুবিনের খোজ লাগানোর চেষ্টা চালাতে থাকে।
চলবে!
#thetanvirtuhin