গল্প: ক্যালেন্ডার!
পর্ব: ১৫!
লেখক: তানভীর তুহিন!
প্রায় চারমাস পর!
ক্যাফেতে বসে আছে মিছিল আর মুবিন। আজ ভার্সিটিতে যায়নি দুজন, ভার্সিটিতে না গিয়ে ঘুরতে এসেছে দুজনে। মিছিল একের পর এক ছোট ছোট চুমুক দিয়ে কফি শেষ করতে ব্যাস্ত। মুবিন চুপচাপ কফির কাপ সামনে নিয়ে বসে আছে। সকাল থেকে মুবিনের ঘ্যানঘ্যান,আজ আই লাভ ইউ টু বলতেই হবে মিছিলকে। অনেক চেনা হয়েছে, অনেক জানা হয়েছে দুজন দুজনকে। এতো স্বাধিন আর স্বাভাবিক স্বম্পর্ক তাদের অথচ মিছিল এখনও অবধি তাকে ভালোবাসি বা আই লাভ ইউ টু বলবে না। এটা মেনে নেবে না সে।
মিছিলেরও একই সয়ংক্রিয় তৈরী করা উত্তর, ” আমি বলবো না। আমি এখনো তোমায় ভালোবেসে উঠতে পারিনি। আর তুমিই তো বলেছিলে প্রেম প্রকাশের আগেই সব মধু থাকে, সব রসগোল্লা থাকে। এখনই যেমন আছে ভালো আছে। তোমায় আমার উপরে ফালানোর জন্য যথেষ্ট অধিকার দিয়েছি, তোমার সাথে ঘুরিফিরি, রাতে ঘন্টার পর ঘন্টা তোমার সাথে কথাবলি, আর পাচটা সাধারন বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড যা যা করে আমরাও তাই করি। এন্ড আই থিংক সো তুমি ফীল করে যে আমি তোমায় অল্পখানিক ভালোবাসি। যখন বেশিখানিক বাসবো তখন বলবো আই লাভ ইউ টু, তখন সারাদিনই ন্যাকা প্রেমিকার মতো ঘ্যাঙাবো আই লাভ ইউ টু বলে বলে। এখন এসব নিয়ে আর কোনো ডিসকাশন তুমি করবা না! ”
কে শুনে কার কথা। মুবিন নাছোড়বান্দা, আজ সে মিছিলের মুখ থেকে ভালোবাসি কথা শুনেই তবে ক্ষান্ত হবে। শুনবে মানে শুনবেই। মুবিন কফি না খেয়ে কপাল কুচকে মিছিলের দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে তার রাগ-বিরক্তির ঢেউ। মিছিল মুবিনের এই চেহারার বেশ মজা নিচ্ছে। সচরাচর মুবিনকে এরকম অসহায় অবস্থায় দেখা যায় না। সবসময় মুবিনই ছড়ি ঘোরায় মিছিলের ওপর এই যেমন মিছিল কবে তার সাথে ঘুরতে যাবে, কোথায় ঘুরতে যাবে, ভার্সিটির পরে মিছিল কতক্ষন তারসাথে থাকবে, রাতে ফোনে কথা বলে কখন ঘুমাবে, আরো নানা ধরনের মুবিনের শাসন মেনে চলতে হয় মিছিলের। যদিও মিছিলের কখনো এসব জিনিসকে শাসন বলে মনে হয় না কারন মুবিন কখনই কোনো ব্যাপার নিয়ে তাকে জোর করে না। একদমই নরম ভাবে, ভেজা বেড়ালের মতো করে বলে, অনেকটা আবদার করার মতো। মিছিলও হাসিমুখে মুবিনের সকল আবদার পুরন করে, কারন এসব আবদারের মাঝে তারও যে ভালোবাসা, অনুভুতি, সুখ নিহিত আছে। মিছিল মুবিনকে ভালোবাসে, পাগলের মতো ভালোবাসে এটা বাইরের যেকোনো একজন মানুষ দেখেই বুঝে যাবে। মুবিনও বোঝে মিছিল তাকে ভালোবাসে, তবুও প্রেয়সীর মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা শুনতে শখ জাগতেই পারে। মিছিল শখটা পুরন করে দিলেই পারে।
মুবিন চোখ মুখ ফুলিয়ে ব্যাঙ সেজে বসে আছে। মিছিল মুবিনের সামনে মিটিমিটি করে হেসে মুবিনকে ক্ষ্যাপাচ্ছে। মুবিন অসহায় কাতর কন্ঠে বলে, ” একবারই তো বলবা। জাস্ট একবার, ছোট করে। একদম তাড়াতাড়ি করে বলে দিলেও হবে। শুধু বললেই হবে আমার, বলো না! ”
মিছিল এতোক্ষন মিটিমিটি হাসছিলো। মুবিনের কথায় হাসিটা খানিক আলগা করে, চোখ দুটো চওড়া করে উপরে টেনে বলে, ” তোমার চুমু খেতে ইচ্ছে করছে? চুমু খাবা? চুমু খাও বা আমি চুমু দিয়ে দিচ্ছি। তবুও বলবো না! ”
– ” না চুমু লাগবে না। শুধু একবার বললেই হবে! ”
– ” তুমি ইতিহাসের প্রথম বয়ফ্রেন্ড যে কিনা গার্লফ্রেন্ড চুমু খাবার পার্মিশন দিচ্ছে তবুও চুমু না খেয়ে গার্লফ্রেন্ডকে আই লাভ ইউ টু বলার জন্য প্যানপ্যান করছে। হাবা কোথাকারের! ”
– ” হু, হাবাই। আচ্ছা আমরা প্রেমিক প্রেমিকা তো? ”
– ” হুম। ক্যান কোনো ডাউট আছে তোমার? ”
– ” তাহলে আই লাভ ইউ টু বলছো না কেনো? রিলেশনশিপে টাচ করা নিয়ে, চুমু খাওয়া নিয়ে, ঘুরতে যাওয়া নিয়ে আরো হাজার কারনে দুজনের মধ্যে ইস্যু ক্রিয়েট হয়। আর আমাদের মধ্যে কী নিয়ে ইস্যু ক্রিয়েট হচ্ছে? আই লাভ ইউ বলা নিয়ে? মানে এটা একদম অদ্ভুত আর আশ্চর্যজনক একটা ব্যাপার না? ”
– ” না কোনো আশ্চর্য নেই এই ব্যাপারে! ”
– ” একজন আউটসাইডার কেউ যদি এসব জানে তাহলে বলবে আমি তোমার জাস্টফ্রেন্ড আর তুমিও আমার জাস্টফ্রেন্ড। আমরা কোনো প্রকার কমিটেড রিলেশনশিপে নাই! ”
– ” আচ্ছা নাই। ধরে নাও আমি তোমার জাস্টফ্রেন্ড। তবুও এই প্যানপ্যানানি অফ করো। ভাল্লাগছে না আর! ”
– ” তোমার কেনো ভালো লাগবে না? ভালো তো লাগতেছে না আমার। প্রায় আড়াইমাস ধরে প্রেম করছি, প্রেমিকার সাথে হাগিং, কিসিং, আউটিং সব হয়েগেছে অথচ আমার প্রেমিকা আমায় এখন অবধি আই লাভ ইউ টু বললো না। ইজন্ট ইট সো স্ট্রেঞ্জ? ”
– ” তুমি কী এখন এইটা নিয়াই আমার মাথা খাবা? যদি তোমার মাথা খাওয়ারই থাকে তাহলে বলো, আমি উঠে যাচ্ছি। কারন আমি আর জাস্ট টলারেট করতে পারছি না। এখন বিরক্তি লাগতেছে আমার ” ঝাঝালো কন্ঠে কথাগুলো বলে টেবিলে মাঝারি ধরনের একটা থাপ্পড় মারে মিছিল।
মুবিন চুপ হয়ে যায়। চুপচাপ বসে আছে মুবিন, মিছিল ফোন টিপছে আর একটু পর পর ফোন থেকে চোখ তুলে মুবিনকে দেখছে। প্রায় ১০-১৫ মিনিট এভাবে চলার পরে মুবিন বলে, ” এই শেষবার জিজ্ঞেস করছি তুমি বলবা নাকি বলবা না? আম সিরিয়াস নাউ মিছিল। আমার কেমন যেনো উইয়ার্ড লাগছে ব্যাপারটা, আর ভেতর থেকে ইনসিকিউরিটিও কাজ করছে। এখন যদি না বলো তাহলে আর বলার সুযোগ পাবে না। বলার জন্য আর আমাকে খুজেই পাবে না! ”
– ” কেনো তুমি নাসার সাথে চুক্তি মঙ্গলে চলে যাবে? ”
মুবিন চোখটা কিছুক্ষন বন্ধ রেখে, দাত খিটে বলে ” তোমার কী আমায় দেখে মনে হচ্ছে না যে আম ড্যাম সিরিয়াস? ”
– ” উফ! উফ! উফ! একটা সাধারন জিনিস নিয়ে তুমি এভাবে সীন ক্রিয়েট করতেছো কীভাবে? আমার বলতে ইচ্ছে করছে না আমি বলবো না। জাস্ট একসেপ্ট ইট! ”
– ” তারমানে তুমি বলবে না? ”
– ” না। কোনোমতেই না! ”
মুবিন ওয়েটারকে ডাক দিয়ে বিল চেয়ে নেয়। তারপর বিল পে করে ক্যাফে থেকে বেড়িয়ে যায়। মিছিলও বেড়িয়ে আসে। বিকাল প্রায় ৪ টা বাজে। মুবিন গাড়ি চালাচ্ছে, মিছিল পাশে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মুবিনের দিকে। তাকিয়ে থেকে থেকে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, মুবিন একবার ফিরেও তাকাচ্ছে না তার দিকে, কোনো কথাও বলছে না। একদম ড্যামকেয়ার ভঙ্গিতে গাড়ি চালাচ্ছে। মিছিল একদমই মুবিনের সাথে থাকলে মুবিনের সাথে কথা না বলে বেশিক্ষন চুপ করে থাকতে পারে না। তার এই বদঅভ্যাসের কারন মুবিন, কারন মুবিন কখনই মিছিলের সাথে এভাবে কথা না বলে থাকে না। মুবিনের সদা সর্বদা মুখ চলতেই থাকে। অথচ আজ একদম চুপ! তাও আবার প্রায় আধাঘন্টা যাবৎ! তাও আবার সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে অযথা তর্ক করে চুপ!
মিছিল আর চুপ করে থাকতে না পেরে বলে, ” কী হইছে? এমনি সময় তো কথা বলে বলে কানের পোকা বের করে ফেলো। এখন একদম সব উল্টে গেছে না? কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না এখন? ”
মুবন একপলক মিছিলের দিকে তাকিয়ে বলে, ” এখন তোমার সাথে কথা বললেই ঝগড়া হবে। তাছাড়াও আমাদের আর কখনো দেখাই হবে না যখন, তখন শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে লাভ কী? ”
মুবিনের কথায় মিছিলের বুকটা ছেৎ করে ওঠে। মিছিলের মনে হয় কেউ যেনো তার মনে কিছু সুচ ফুটিয়ে দিয়েছে। কন্ঠটাও যেনো মুহুর্তের মধ্যেই কেমন জড়িয়ে আসে, মিছিল স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ” কখনো দেখা হবে না মানে? ”
মুবিন আবার মিছিলের দিকে একপলক তাকায়। তারপর আবার সামনের দিকে তাকায়। মুবিন নিরবতার দেয়াল না ভেঙেই নিশ্চুপভাবে গাড়ি চালায়। মিছিল বলে, ” আমি তোমায় জিজ্ঞেস করলাম তো কিছু। দেখা হবে না মানে? ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছো কেনো? ”
– ” ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল না। আমি ডিসাইড করেছি আর কখনও তোমার সামনে আসবো না, আর তোমায় ভালোবাসি বলার সুযোগও করে দেবো না। ”
মিছিল হো হো করে হেসে ওঠে বলে, ” আহারে আমার ছ্যাকাখোর বাপ্পারাজটা রে! যে কিনা এক-দেড় ঘন্টা আমার সাথে ফোনে কথা না বলে থাকতে পারে না। সে কি না কখনও আমার সামনে আসবে না। সো ফানি! ”
মুবিন নিশ্চুপ। মিছিলই আবার বলে, ” একদিক থেকে ভালোই হলো তুমি আমায় ছেড়ে দিলে আমি অন্য একটা নতুন বয়ফ্রেন্ড জোগাড় করতে পারবো। এমনিতেও তোমায় ইদানিং বোরিং লাগছে খুব! ” বলেই খিটখিট শব্দ করে হাসে মিছিল। মুবিন এখনও নিশ্চুপ। মিছিলের এবার ইগো হার্ট হয়, একেতো সাধারন বিষয়টা নিয়ে মুবিন এমন করছে তারউপরে আবার ইগনোর করছে, কথা বলছে না।
মিছিল রাগিস্বরে বলে, ” এখন তোর মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না তো? রাত্রে ফোন দিস! আমিও ফোন ধরবো না। তখন দেখিস কেমন মজা লাগে যখন কেউ ইগনোর করে! ”
মুবিন কোনো কথা না বলে নিরবতাকে প্রাধান্য দিয়ে গাড়ি চালাতে থাকে।
মুবিনের গাড়ি মিছিলের বাসার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় ২-৩ মিনিট যাবৎ দাঁড়িয়ে আছে। মিছিল এখনও গাড়ির ভেতরেই বসে আছে। বসে বসে ভাবছে, তাহলে কী আজ মুবিন চুমুও খাবে না? আরদিন তো নামিয়ে দিয়ে যাবার সময় কত ন্যাকামি করে। আর আজ কথাও বলবে না? মিছিল একবার মুবিনের দিকে তাকায়। মুবিন শক্তমুখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে, শরীরের কোনো হেলদোল নেই। তবে চোখদুটো আবছা খানিক লাল। হয়তো ভেতরে ভেতরে রাগে ফুসছে। মুবিন চুমু খাচ্ছে না দেখে মিছিল নিজ থেকেই মুবিনের গালে আলতো কর একটা চুমু খায়। না! তাতেও মুবিনের হেলদোল নেই। কোনো প্রতিক্রিয়াই করলো না মুবিন, এমনভাবে বসে আছে যেনো মিছিল তার পাশে বসে নেই, আর মিছিল যেনো এই মাত্র তার গালে চুমুও খেলো না। ব্যাপারটা একদমই সহ্য হচ্ছে না মিছিলের। সে আগবাড়িয়ে চুমু খেলো, রাগ ঠান্ডা করতে চাইলো, কিছু না বলুক, না করুক একবার একটু তাকাবে তো এদিকে? তাকালোই না? এসব ভেবে নিজের রাগকে প্রশ্রয় দিয়ে দেয় মিছিল। দাত খিটে মুবিনের দিকে তাকিয়ে বলে, ” তুই বেশি আলহাদ পেয়ে গেছিস না? রাগ নিয়ে কুইপ্পা বইসা থাক, তোর রাগের গুষ্টি কিলাই! ”
বলেই সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে যায় মিছিল। নেমেই সজোরে গাড়ির দড়জাটা বন্ধ করে দেয়, তারপর এক মুহুর্তও না দাঁড়িয়ে হনহনিয়ে হেটে চলে যায়। মুবিনও মিছিলের দিকে না তাকিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে চলে যায়।
চলবে!
#thetanvirtuhin