গল্প: ক্যালেন্ডার!
পর্ব: ১২!
লেখক: তানভীর তুহিন!
মিছিল বলে, ” হাত ছাড়ো মুবিন। এখন লিমিট ক্রস করছো তুমি! ”
মুবিন হেসে বলে, ” কিছুই তো করলাম না। তাহলে লিমিট ক্রস হলো কোথায়? ”
মিছিল চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মুবিনের স্পর্ষে তার বুকে ধ্রিম ধ্রিম শব্দে ঢাক, ঢোল, ড্রাম সব একসাথে বাজছে। মুবিন খানিক চওড়া হেসে মিছিলের হাতটা ধরে আছে, মিছিলের হাতের উল্টোপিঠে থাম্বফিংগার দিয়ে স্লাইড করছে মুবিন। মুবিনের এই অতিসাধারণ ছোয়ায়’ও মাতাল হয়ে উঠছে মিছিলের মন। মিছিল চোয়াল শক্ত করে বলে, ” মুবিন ছাড়ো! ”
মুবিন সঙ্গে সঙ্গে মিছিলের হাত ছেড়ে দিয়ে বলে, ” আচ্ছা ছেড়ে দিলাম। তবে এখান থেকে যেয়ো না, কিছুক্ষন দাড়াও এখানে! ”
মিছিল চুপচাপ ট্রেনের দরজার পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মুবিন ট্রেনের অবিরাম পথচলা দেখছে, মিছিলও দেখছে। মুবিন বাইরের আধো ঝাপসা রেললাইনের পাশের চলমান রাস্তা দেখতে দেখতে মিছিলকে বলে, ” আচ্ছা মিছিল তুমি আমায় ভালোবাসো এটা কবে বলবে? ”
মিছিলের চটজলদি জবাব, ” কোনোদিনও না। কারন আমি তোমায় কোনোদিনও ভালোবাসবো না! ”
মুবিন দাত বের করে হেসে আত্মবিশ্বাসী বাক্যে বলে, ” এজন্য’ই তো তোমায় আরো বেশি করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। ”
মিছিল চোখ সরু করে বলে, ” মানে? কীসের জন্য বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে করে? ”
– ” এইযে তুমি এতো নিশ্চিতভাবে বলো যে কোনোদিনও ভালোবাসবে না। এটাই আমায় আভাস দিয়ে দেয় যে তুমি আমায় ভালোবাসতে শুরু করে দিয়েছো। আর এরকম আভাস পেলে যেকারোরই ভেতরকার প্রেম ফুলে-ফেপে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক! ”
– ” কোত্থেকে যে পাও এসব মুলাপচা লজিক, গড নৌস। ”
– ” জানবে, তুমিও একদিন জানবে। আর যেদিন জানবে সেদিন এই মুলাপচা লজিকগুলোই তোমার কাছে চকলেট আইস্ক্রিমের মতো লাগবে! ”
– ” হু! যা! তা! যত্তসব! ”
মুবিন আর মিছিল ছোটোখাটো ধরনের একটা তর্কে জড়াচ্ছিলো। তখনই শাওন এসে বলে, ” কীরে তোরা এখানেই দাঁড়ায় থাকবি নাকি? এখানে যদি দাঁড়িয়েই থাকবি তাহলে টাকা খরচ করে ট্রেনের টিকেট কিনলি কেনো? ”
মুবিন শাওনকে ধমক দিয়ে বলে, ” তুই শালা শান্তিতে প্রেমও করতে দিবি না। দেখছিস যখন এখানে দাঁড়িয়ে আছি, তারমানে নিশ্চই প্রেম করছি তাইনা? ”
মিছিল চোখ রাঙিয়ে তাকায় মুবিনের দিকে। তারপর শাওনকে বলে, ” আমরা মোটেই প্রেম-ট্রেম করছি না রে এখানে। তুই সিটে চল তো! ” বলেই মিছিল সিটের দিকে আগায়।
শাওন মুবিনকে বলে, ” কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? যাবিনা? চল সিটে চল! ”
– ” তোরা যা একটা সিগারেট টেনে আসছি! ”
– ” আচ্ছা তাড়াতাড়ি আয়! ”
মিছিল মুবিনকে সিগারেট না খাওয়ার জন্য বলবে ভেবেছিলো। কিন্তু কী না কী ভেবে কথাটা না বলেই চলে যায় মিছিল। মিছিল আর শাওন চলে গেলেই মুবিন একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ধোয়া টানা শুরু করে, ছোট ছোট টান দিয়ে সিগারেটের ধোয়া ভেতর বাহির করছে মুবিন। এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে তার মধ্যে!
মুবিন একটা সেন্টার ফ্রুট মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে গিয়ে সিটে বসলো। মুবিন গিয়ে বসতেই যেনো আড্ডাটা জমজমাট হলো। এতোক্ষন চারপাশে কথা তো হচ্ছিলো কিন্তু তেমন প্রান ছিলো না এই আড্ডায়। বগির প্রায় অর্ধেকটা জুড়েই ওরা, ২১ জনের প্রায় সবাই’ই সিট ছেড়ে উঠে সিটে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কথায় কথায় চৈতি মুবিনকে গান গাইতে বলে। মুবিন অবশ্য গান গাইবে বলে, নিজের গিটারটা নিয়ে এসেছিলো। তাই আর দেরি না করে গিটারের টুং! টাং! শব্দের সাথে সুর তোলে মুবিন,
” মনে পড়ে রুবি রায়
মনে পড়ে রুবি রায়, কবিতায় তোমাকে
একদিন কত করে ডেকেছি!
আজ হায় রুবি রায় ডেকে বল আমাকে
তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি
মনে পড়ে রুবি রায়, কবিতায় তোমাকে
একদিন কত করে ডেকেছি!
আজ হায় রুবি রায়, ডেকে বল আমাকে
তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি
রোদ জ্বলা দুপুরে, সুর তুলে নূপুরে
বাস থেকে তুমি যবে নাবতে
রোদ জ্বলা দুপুরে, সুর তুলে নূপুরে
বাস থেকে তুমি যবে নাবতে
একটি কিশোর ছেলে একা কেন দাঁড়িয়ে
সে কথা কি কোনোদিন ভাবতে?
মনে পড়ে রুবি রায়, কবিতায় তোমাকে
একদিন কত করে ডেকেছি!
আজ হায় রুবি রায় ডেকে বল আমাকে
তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি
দ্বীপ জ্বলা সন্ধ্যায়
দ্বীপ জ্বলা সন্ধ্যায়, হৃদয়ের জানালায়
কান্নার খাঁচা শুধু রেখেছি
দ্বীপ জ্বলা সন্ধ্যায়, হৃদয়ের জানালায়
কান্নার খাঁচা শুধু রেখেছি
ও পাখি সেতো আসে নি
তুমি ভালোবাসনি
স্বপ্নের জাল বৃথা বুনেছি
মনে পড়ে রুবি রায়, কবিতায় তোমাকে
একদিন কত করে ডেকেছি!
আজ হায় রুবি রায় ডেকে বল আমাকে
তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি
মনে পড়ে রুবি রায়
মনে পড়ে রুবি রায়! ”
সবাই মুবিনের সাথে সুর মেলায়। তারপর একে একে সীমান্ত, চৈতি, অলোক, শ্রাবন সবাই’ই গান গায়। সীমান্ত অবশ্য একটা ইংলিশ গান গেয়েছিলো, কারন ওর ইংলিশ একসেন্ট এবং গানের সুর এককথায় চরম জোশ। তারপর গান গাওয়ার পালা আসে মিছিলের, প্রথমে গাইবে না গাইবে না করলেও পরে গেয়ে ফেলে। মিছিল গায় ‘বাড়িয়ে দাও তোমার হাত!’ গানটা। মিছিল যখন গান গাইছিলো তখন মুবিন ওর গানের তালে তালে গিটার বাজাচ্ছিলো আর স্থির মুগ্ধ নয়নে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিলো মিছিলকে। মুবিন যখন এভাবে স্থির মুগ্ধ নয়নে দেখছিলো মিছিলকে, তখন মিছিলের মনে হচ্ছিলো কেউ অতি নিকট থেকে তাকে আলিঙ্গন করছে।মিছিলের গান গাওয়া শেষ হতেই মুবিন নিজের হাতটা মিছিলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ” এই নাও বাড়িয়ে দিয়েছি আমার হাত, তুমি আমার আঙুল ধরে! আমায় ধরে হাটতে পারো। ”
মিছিল মিথ্যে চোখ গরম দেখিয়ে হেসে দিয়ে বলে, ” ধুর! ”
সবাই একসাথে হো হো করে হেসে ওঠে মুবিন মিছিলের রঙ্গতামাশায়।
আসলেই কী কেউ তাকিয়ে থেকেই এভাবে মাতাল করে দিতে পারে কাউকে? শুধুমাত্র চাহনিতেই কী যাদুর তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে অনুভুতির ঢেউ কে উত্তাল করে দেওয়া যায়? হ্যা যায় হয়তো, নাহলে মুবিন কীভাবে পারছে? ওর প্রত্যেকটা চাহনি’ই যেনো কামিয়াব এবং সফল। কীভাবে পারছে আমায় অদৃশ্যভাবে কাছে টেনে নিতে? এসব ভেবে ভেবে ছোট ছোট মুহুর্তগুলোকে অতীত করছে মিছিল। সামনেই মুবিন বসা। থুতনিতে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে রক্তিম আকাশের পানে, আকাশটাকে যেনো কেউ খুন করেছে। এলোপাথাড়ি যেনো কোপানো হয়েছে আকাশটাকে, পশ্চিম আকাশটা রক্তিম বর্ন ধারন করেছে। সেই রক্তিম আকাশের শেষ প্রান্তের নিভু হলুদ রঙের সূর্যটা আকাশের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে তলিয়ে যাচ্ছে অজানায়। অনেকটা অপরাধির মতো তলিয়ে যাচ্ছে, হয়তো অনুসন্ধান করলে জানা যাবে এই রক্তাক্ত আকাশের খুনি এই নিভু হলদে রঙা সূর্যটা। যার বুকে সে সারাটাদিন ছিলো তাকেই খুন করে পালিয়ে যাচ্ছে? কেনো খুন করলো? এতোটা স্বার্থপর কেনো হলো সূর্যটা? বেইমান! অকৃতজ্ঞ! বিশ্বাসঘাতক সূর্য! এসব আবোলতাবোল ভাবছে মিছিল। কেনো ভাবছে? এই প্রশ্নের তদন্ত করবে সে। হ্যা এখনই তদন্ত শুরু করবে। মিছিল অবান্তর বিষয়টা নিয়ে তদন্ত শুরু করতে যাবে তার আগেই মিছিলকে অবাক করে দিয়ে মুবিন মিছিলের হাতটা ধরে।
হঠাৎ হাত ধরলো কেনো? এতক্ষন তো আকাশ নিয়ে গবেষনা করছিলো জনাব, হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই হাত ধরে বসলো? কথাটা ভেবেই মিছিল পাশে তাকালো। সবাই বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। মিছিলের পাশে বসা চৈতি ঘুমোচ্ছে, মুবিনের পাশে বসা শাওন-সীমান্ত’ও ঘুমোচ্ছে। মিছিলের ইচ্ছে করছেনা মুবিনকে কটুকথা শুনিয়ে মুবিনের কাছ থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতে, তাই হাতটা আর ছাড়িয়ে নিলো না মিছিল। শুধু মুখে একটা বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন এনে চোখ দিয়ে নিজের হাতের দিকে ইশারা করে চোখ নাচিয়ে ইঙ্গিতে মুবিনের কাছে হাত ধরার কারন জানতে চায় মিছিল। মুবিন প্রশ্ন বুঝেও কোনো উত্তর দেয় না, উত্তর না দিয়েই মিছিলের হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরে। মিছিলের চেহারার প্রশ্নবোধক চিহ্নটা আরো গাঢ়ো হয়ে ওঠে। মিছিলের চেহারায় থাকা গাঢ়ো প্রশ্নবোধক চিহ্নটা মুছে দেবার কোনো ভ্রুক্ষেপ’ই নেই মুবিনের। তার সমস্ত ভ্রুক্ষেপ এখন মিছিল! শুধুই মিছিল!, মিছিলের চেহারার প্রশ্নবোধক চিহ্ন না।
মুবিন মিছিলের হাত ধরার শক্ততার মাত্রা বাড়িয়ে মিছিলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ” আই লাভ ইউ মিছিল মনি! ”
কথাটা শুনতেই পরাপর লাগাতার বেশ কয়েকবার হার্ট বিট মিস করে মিছিল। প্রোপোজ করার একটা অতিসাধারণ ধরন আই লাভ ইউ বলা, এর আগেও বহু ছেলের মুখে বহুবার আই লাভ ইউ শুনেছে সে। কিন্তু কখনো এমন ভালোলাগা, এমন মুগ্ধতা, এমন স্নিগ্ধতা, এমন প্রাপ্তি অনুভব করেনি সে। কী আছে মুবিনের মধ্যে? কী দিয়ে দিন দিন আমায় পাগল করে নিচ্ছে ও?
মুবিন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মিছিলের চোখ দুটোর পানে, মিছিলের চোখ দুটোও স্থিরভাবে তাক করা মুবিনের চোখদুটোর দিকে। মিছিল অস্ফুট বাক্যে বলে, ” হঠাৎ এসব বলছো? ”
মুবিন মিছিলের হাতটা ছেড়ে দেয়, মিছিল চাচ্ছিলো মুবিন আরেকটু ধরে রাখুক হাতটা। একদম শক্ত করে ধরে রাখুক। কিন্তু মিছিলের ইচ্ছাটা অজানাই রয়ে যায় মুবিনের, মুবিন হাতটা ছেড়ে দিয়ে নরম গলায় বলে, ” আকাশ দেখে খুব ইচ্ছে করছিলো আমার সাহিত্যকনাটাকে প্রেম নিবেদন করার। তাই দেরী না করে বলে দিলাম! ”
মিছিল নিভু গলায় ছোট করে বলে, ” ওহ! ”
মুবিন আর কিছু না বলে, আকাশ দেখায় মনোযোগ দেয়। তার সবচেয়ে কাছের বস্তু এই আকাশ! যদিও অবস্থানের দিক থেকে অনেক দূরত্ব এই দুই বন্ধুর মাঝে। তবুও অন্তরাত্মার দিক থেকে তারা অতি সন্নিকটে।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা ট্রেন এসে সিলেট রেলস্টেশনে দাড়িয়েছে। সবাই গা”ছেড়ে দিয়ে ট্রেন থেকে নেমেছে, সবারই ঘুম আধপাকা হয়ে আছে। শুধু মুবিন আর মিছিলের ছাড়া।
রেলস্টেশন থেলে লেগুনায় চড়ে সবাই সিলেটের আম্বরখানার হোটেল কায়কোবাদে গিয়ে উঠলো। গতকাল রাতেই এখানে সবার জন্য রুম বুক করে রেখেছিলো মুবিন।
সবাই হোটেলের ডাইনিং এরিয়ায় খাবার খেয়ে যে যার রুমে গিয়ে গা এলিয়ে দেয়। কার সবার’ই ক্লান্তিতে গা ছেড়ে দিয়েছে প্রায়।
চলবে!
#thetanvirtuhin
generally I do not comment on any story. This is my first comment. So please don’t use such a word in your reply that I get discouraged. I don’t know who are you? Please pardon me for disliking your abuse of Bengali language in such a romantic beautiful story.
Thank you