গল্প: ক্যালেন্ডার!
পর্ব: ১১!
লেখক: তানভীর তুহিন!
– ” তোমার না সব বিষয়েই বেশি ফ্যাচফ্যাচ, কোনো কথা সোজাসাপ্টা ভাবে মেনে নেওয়া যেনো তোমার রক্তেই নেই! ” বলেই মুবিন মিছিলের হাত থেকে একপ্রকার জোর করে টেনে চায়ের কাপটা নিয়ে নেয়। তারপর একমুহুর্তও দেরী না করে চায়ের কাপে চুমুক লাগায় মুবিন। খানিক চা মুখে নিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় মুবিন, তাকে দেখে মনে হবে না সে চা খাচ্ছে। তাকে দেখলে যেকেউ’ই ভাববে সে হয়তো কী না কী ধরনের কী খাচ্ছে। মুবিন চা টুকু অতিযত্নে গলা দিয়ে পেটে নামিয়ে মিছিলকে বলে, ” ঠোটে কী চিনির লিপস্টিক লাগায় আসছো তুমি? কই আমার চা তো এতো মিষ্টি ছিলো না! ”
মিছিল এতক্ষন চোখ ছোট করে মুবিনের এসব ঢং দেখছিলো। এই বদমায়েশ ছেলের জন্য সে একটু স্বস্তিতে চা’ও খেতে পারলো না। জ্বালাতনের সার্ফ-এক্সেল, পচা মুবিইইন্না, শালা, হারামজাদা মনে মনে এসব বলে মিছিল গালমন্দ করছিলো মুবিনকে। যেই মুবিন ন্যাকা মার্কা কথাটা বললো মিছিলের যেনো গা-পিত্তি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে মিছিল বললো, ” একদম ঢং মারাবি না তুই, যত্তসব ন্যাকা ন্যাকা কাহিনি! ”
– ” সত্যি বললেও দোষ! ”
– ” হু দোষ। চুপ থাক তো এখন! ”
মুবিন আর কথা না বাড়িয়ে মিছিলের চায়ের কাপের চা খেতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। মিছিল বসে বসে ফোন ঘাটতে থাকে। মুবিন আপনমনে চা খাচ্ছিলো, তখনই মুবিনের রোমান্টিক বিজ্ঞানি চোখদুটো চলে যায় সীমান্ত আর চৈতি’র দিকে। প্ল্যাটফর্মের বিপরীতপাশের ট্রেনের একটা বগিতে উঠে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সীমান্ত, আর চৈতি খানিক দূর থেকে দৌড়ে দৌড়ে আসছে। এমন ভাবে ঢং করে আসছে যেনো সীমান্ত ওর বয়ফ্রেন্ড, আর ট্রেনটাও ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অথচ ট্রেনটা কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, তাহলে ওরা এমন করছে কেনো?
মুবিন চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাক পাড়ে, ” এইই সীমান্ত এদিকে আয়! ”
সীমান্ত দাঁড়িয়ে চৈতির সাথে হাসাহাসি করছিলো। মুবিনের ডাক শুনেই ছুটে আসে। মুবিন জিজ্ঞেস করে, ” একটু আগে তুই আর চৈতি অমন ধরা-ছোয়া! ধরা-ছোয়া! খেলছিলি ক্যান? ”
মুবিন আর সীমান্ত কথা বলছিলো এর মধ্যেই ওদের পাশে এসে চৈতি দাঁড়ায়। চৈতি এসে মুবিনের কথা শুনে ফেলে। কথাগুলো শুনেই চৈতি সীমান্তর কাধে হাত দিয়ে মুবিনের দিকে চোখ নাচায়, তারপর সীমান্তর দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমি আর সীমান্ত ডার্লিং রোমান্টিক সীনের রিক্রিয়েশন করছিলাম। সুন্দর হয়েছে না? ”
মুবিন চোখদুটো সরু করে নিজের ঘারটা এক ঝটকায় টেনে পেছনে নিয়ে যায়। সে বুদ্ধিগত ভাবে মারাত্মক ঝটকা খেয়েছে, চৈতি সীমান্তকে ডার্লিং বলে সম্বোধন করায়। মুবিন নিজের ভেতরে কোনো প্রশ্নবোধক চিহ্ন না রেখে চৈতিকে জিজ্ঞেস করে, ” সীমান্ত তোর ডার্লিং হলো কবে থেকে? প্রেম শুরু করলি কবে তোরা? ”
মুবিনের কথায় হোহো করে হেসে ওঠে সীমান্ত, এক চিমটি পরিমান মুহুর্ত পরে চৈতিও শব্দ করে হেসে ওঠে। মুবিন বেয়াক্কেলের মতো দাঁড়িয়ে আছে, সে সামনের ঘটনার বিরামচিহ্ন নিয়ে সন্দিহান। চৈতি এসে এবার মুবিনের কাধ জড়িয়ে ধরে, মুবিন ভ্রু-কুচকে তাকায় চৈতির দিকে। মিছিল আপনমনে ফোন ঘাটছিলো হঠাৎ সামনে চোখ যেতেই দেখে চৈতি মুবিনের কাধ জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মিছিলের ভেতরটা ধক করে ওঠে, কী দেখছে সে এসব? ব্যাপারটা আরেকটু কাছ থেকে বোঝার জন্য মিছিল উঠে মুবিনের কাছে যায়। মিছিলকে পাশে দেখতেই মুবিন চৈতিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ” আরে বাল ডলাডলি না মারাইয়া বল না কী করছিলি? ”
চৈতি মুখে বিরক্তি নিয়ে বলে, ” আরে বাল ওরে এমনিই ডার্লিং বলেছি। মজা করে!, আর তখন আমরা ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ ফিল্মের ট্রেনের সীনটা রিক্রিয়েট করছিলাম দুষ্টুমি করে। ”
মুবিন মাথাটা উচিয়ে বলে, ” ওহ আচ্ছা! ”
‘ওহ আচ্ছা’ বলে শেষ করার পরমুহুর্তেই মুবিন বলে, ” এই আমি আর মিছিলও করবো এটা! ” মিছিলের চোখ কপালে উঠে যায়। মুহুর্তেই মুখ ঘুরিয়ে বলে, ” আমি গাজা খাইনি, যে এসব ঢং করতে যাবো। ”
মুবিন মিছিলের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চৈতিকে একপাশে টেনে নিয়ে যায়। চৈতিকে টেনে নিয়ে গিয়ে মুবিন চৈতিকে বলে, ” শোন মিছিল যদি ট্রেনে ওঠে তাহলে দিপিকার মতো দৌড়েই টেনে উঠবে। আর আমি শাহরুখের মতো ওর হাত ধরে ট্রেনে টেনে তুলবো। এখন কী করবি জানি না, কিন্তু তোর এটা করতে হবে। ব্যাস শেষ! ”
চৈতি দাত দিয়ে নখ কাটছিলো আর মনযোগ দিয়ে মুবিনের কথা শুনছিলো। মুবিনের কথা শেষ হবার পরে চৈতি বলে, ” হু করে দিবো। কিন্তু বড়সড় ট্রিট দিতে হবে! ”
– ” আরে দিবো। তুই আগে ওরে ম্যানেজ কর! ”
চৈতি ড্যাং ড্যাং করে পা নাচিয়ে মিছিলের কাছে যায়।
মিছিল সামনে হাত বেধে দাঁড়িয়ে আছে। সে চৈতিকে দেখেই বুঝতে পেরেছে যে চৈতি তাকে কী বলতে এসেছে। চৈতি কিছু বলবে তার আগেই মিছিল বলে, ” একদম ঐ পাগলাটার কথায় আমায় মানাতে আসবি না। আমি ওসব ন্যাকামি করতে পারবো না, কোনো মতেই না! ”
চৈতি কপাল কুচকে তীক্ষ্ণ কন্ঠে মিছিলকে ঝাড়ি মেরে বলে, ” আরে বেডি আগে আমায় কথা বলতে তো দিবি। শোন তোর ব্যাগটা আগেই আমি নিয়ে ট্রেনে উঠে যাবো, তুই শুধু ট্রেন যখন ছাড়বে তখন দৌড়ে যাবি। আর মুবিন তোর হাত ধরে ট্রেনে টেনে তুলবে। ব্যাস এটুকুই, আর ট্রেন তো প্ল্যাটফর্ম এরিয়ায় জোরে চলে না। একদমই আস্তে আস্তে চলে। সো নো প্রব্লেম! ”
মিছিল কিছুতেই মানবে না। সে চৈতিকে উল্টো ঝাড়ি মেরে বলে, ” আমি পারবো না। মানে পারবো না! ”
চৈতি বিজ্ঞ কন্ঠে বলে, ” তুই কী ভালোমতো ট্রিপটা ইঞ্জয় করতে চাসনা? তুই যদি এখন মুবিনের ইচ্ছা পুরন না করিস, তাহলে ঐ হারামি পুরো ট্রিপে তোর হাড় জ্বালিয়ে খাবে। আমি ওকে কলেজ থেকে চিনি, ও এমনই। আমি ওকে কলেজ থেকে চিনি তো তাই’ই বলছি। আর তোর এতো প্রব্লেমের কিন্তু কিছু দেখছি না, মুবিন তোকে ভালোবাসে! প্রোপোজও করে দিয়েছে। আর তুইও তো মুবিনকে লাইক করিস, প্রব্লেমের কোনো ইস্যুই দেখছি না! ”
মিছিল থতমত খেয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে, ” আমি মোটেই ওই বেদ্দপটাকে পছন্দ করি না! ”
চৈতি মিছিলের দিকে চোখ টান টান করে তাকিয়ে মিছিলকে কোমড় দিয়ে একটা ধাক্কা মেরে বলে, ” আহারা ন্যাকামনি’টা। আমি বুঝি, বুঝিনা? ”
– ” বাল বুঝো তুমি! ”
– ” হু তোর বাল বুঝি! ”
মিছিল মুখ ভেংচায়। চৈতি বলে, ” এখন তুই এই ছোট কাজটা করবি নাকি পুরো ট্রিপ অশান্তির মধ্যে কাটাবি? ”
মিছিল রেগে চেচিয়ে বলে, ” করবো করবো! ”
চৈতি মিছিলের গাল দুটো টেনে দিয়ে বলে, ” অও, চো চুইট চোনা! ”
আস্তে আস্তে ট্রেনটা গতি বাড়িয়ে প্ল্যাটফর্মের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইছে। সবাই ট্রেনে উঠে গেছে, এমনকি মুবিনও ট্রেনে উঠে গেছে। মুবিন বগির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মিছিলের দিকে তাকিয়ে ক্যাবলাভাবে ফোকলা হাসছে। মিছিল সঙের মতো প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে মুবিনের ইশারার অপেক্ষা করছে। কখন মুবিন হাত বাড়িয়ে দেবে আর সে দৌড়ানো শুরু করবে। গা-পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে মিছিলের। মন চাচ্ছে মুবিনের দিকে দৌড়ে না গিয়ে, দৌড়ে বাড়ি চলে যেতে। ট্রেন আরেকটু গতি বাড়িয়ে দিতেই, মুবিন শিষ বাজিয়ে মিছিলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। মিছিল দৌড় লাগায়, দৌড়ে একদম তুহিনের কাছাকাছি চলে এসেছে সে। হাত বাড়িয়ে মুবিনকে বলছে, ” হাত ধরে উঠাচ্ছো না কেনো? ”
মুবিন বোকা হেসে বলে, ” এখনও লম্বা প্ল্যাটফর্মটা পড়ে আছে। আরেকটু দৌড়াও না, কিযে ভালো লাগছে। আমার মিছিল মনি আমার দিকেই ছুটে আসছে, আবার এসে আমায়ই বলছে হাত ধরে টেনে ওঠাতে। আহ! ”
মিছিলের রাগ মাথায় উঠে গেছে। মিছিল চেচিয়ে বলে, ” আমি কিন্তু এখন দৌড় থামিয়ে প্ল্যাটফর্মেই থেকে যাবো। তখন তুই একলা একলা জাফলং যাইস! ”
মুবিন সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দেয় মিছিলের দিকে। মিছিল হাত ধরতেই, মুবিন মিছিলকে ট্রেনে টেনে তুলে নেয়। মিছিল ট্রেনে উঠেই হাত মুঠ করে মুবিনের পেটে ঘুষি মারে। মুবিন ‘উহ’ মতো শব্দ করে। হাপিয়ে গেছে মেয়েটা। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে, নিজেকে স্বাভাবিক করতে মুখ দিয়ে ‘হুহ! হুহ!’ করে নিঃশ্বাস ফেলছে মিছিল। মুবিন মাতাল দৃষ্টে দেখছে মিছিলকে, এই ক্লান্ত হাপিয়ে ওঠা মিছিলকে যেনো স্বাভাবিক মিছিলের থেকে হাজার কোটি গুন বেশি মায়াবতি,স্নিগ্ধ এবং নিষ্পাপ লাগছে। মিছিল মুবিনের দিকে তাকায়, তাকিয়ে দেখে মুবিন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কী এমন দেখছে যে এভাবে তাকিয়ে আছে? মিছিল ভ্রু-কুচকে বলে, ” এভাবে কী দেখছো? ”
মুবিন মিছিলের কথার পিঠেই দ্রুত বলে, ” একটা চুমু খাই তোমায়? ঠোটে না! গালে অথবা কপালে খেলেও হবে। ”
মিছিলের চোখদুটো কুলবড়ইয়ের ন্যায় বড় হয়ে গেছে, মিছিল ঢোক গিলে আমতানো স্বরে বলে, ” দাত খুলে একদম পকেটে ভরে দেবো। অসভ্য, বদমাইশ কোথাকার! ” বলেই মিছিল হেটে চলে যাওয়া ধরে। পেছন থেকে মুবিন মিছিলের হাত টেনে ধরে।
চলবে!
#thetanvirtuhin