ক্যাকটাস ?
পর্ব-১৩
Writer Taniya Sheikh-Tanishq
এই শহরের প্রাণচাঞ্চল্যের উত্তাপে ম্লান পৌষ।
এখানে কুয়াশা হারায় অট্টালিকার পাছে, ঠিক আমারই মতো যেন।
হারিয়ে, ফুরিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য বলতে আছে মাত্র এ দেহ।
রাফসানের গাড়ি ড্রাইভ করছে। ব্যাক সিটে বসে আছে নীরা। উদভ্রান্ত নজরে বাইরেটা দেখছে সে। এমনভাবে বসে আছে যেন কোনো ভাস্করের নিপুণ হাতের তৈরি এক ছন্নছাড়া মানবীর ভাস্কর্য। সম্পূর্ণই বুঝি তার নৈরাশ্যে আচ্ছন্ন। এখানে থেকেও সে নেই এখানে।
পাশে বসে মেহের ননস্টপ কথা বলেই যাচ্ছে। একটু পরপর বলছে বুঝেছ না? রাফসান নিরবতা ভেঙে গম্ভীরমুখে ছোট্ট করে বলছে,
” হুম!” তারপর আবার বলে যাচ্ছে মেহের। তার কাজের কথা, তার আসন্ন পোষ্টিংএর কথা সর্বপরি তার বিষয়ে খুঁটিনাটি অনেক প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক কথা। রাফসান শুনছে না এমন নয়। সে শুনছে তবে মনোযোগ তার পেছনে। দৃষ্টিও সতর্কে সেদিকেই বার বার ফিরে ফিরে যাচ্ছে। কী আছে সেখানে পৃথিবীর কেউ না জানুক। কেবল রাফসান তা জানে। কাউকে কী কখনো বলা হবে, এই একপাক্ষিক অব্যক্ত প্রণয়োপখ্যানের আদ্যোপান্ত! হয়তো না, আবার হয়তো বা হ্যাঁ।
“কে বলে ভালোবাসা কেবলই দর্শনে হয়?
এই আমি তো তাকে ভেবে ভেবেই পাগলপ্রায়।”
রাফসান দেখে যাচ্ছে, শুধু দেখেই যাচ্ছে ঐ অস্বচ্ছ কাকচক্ষু। এতো নিষেধ, এতো যে মানা তবুও গ্রাহ্য করছে না মন তার একচুল। এই কী ভালোবাসার অপার ক্ষমতা? এই কী সেই প্রহেলিকা যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। কেন? কেন রে মন? কেন তুই এতো বেয়ারা হলি? কেন সব অসাধ্য জেনেও নিজেকে খোয়ালি ঐ কাকচক্ষুর দূর্ভেদ্য অন্তরালে। পরিনাম জেনেও কেন এ পথে হেঁটে চলেছিস? মৃত্যুকে আলিঙ্গণে ভয় নেই, তবে তাকে পাব না ভাবতেই জগতের সমস্ত ভয় এসে বুকে চেপে বসে। কী যন্ত্রণায় আমার দিবারাত্রি কাটে তা যে শুধু আমিই জানি। লোকে শুনলে হাসবে বলবে,”ত্রিশ পেরিয়েও তুমি এতো বোকা,এতো অধম?”
আমি কী করে বোঝায় তাদের, মনের চোরাবালিতে নিজেকে খোয়ানোর ইতিহাস। সব যদি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে, ভেবে চিন্তে তারপর হতো, তবে মজনু মজনু নয় কয়েস রয়ে যেত। গাড়ি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে শাঁই শাঁই এগিয়ে চলছে। জনবহুল রাস্তার দু’ধার ছেড়ে জনশূন্য ফুটপাথ। সবটা উপেক্ষা করে এগিয়ে চলছে গাড়ি।
মেহের অনেক্ষণ হলো চুপ করে আছে। সমস্ত মুখ তার বিষন্ন। গাড়ি সিগন্যালে পড়লে রাফসান আরেকবার লুকিং গ্লাসে তাকায়। কোনো হেলদোল নেই ব্যাক সিটে বসা মানবীর মধ্যে। রাফসান তার চোখে নিজের কোনো অস্তিত্বই দেখেনি। দেখবেই বা কী করে? কী হয় রাফসান তার? তেমন কিছুই না হয়েও কিছু। সেই কিছুটাই রাফসানের সকল যন্ত্রণার মূল। এই কিছুটাতেই তাকে বোবা বানিয়ে দেয় নীরার সম্মুখে। লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। রাফসান সামান্যের জন্য ধরা পড়ে না নীরার চোখে। নীরার বিরক্ত ভরা চাহনী হঠাৎ তার উপর নিক্ষিপ্ত হয়। দমবন্ধ হতে হতে বাঁচে রাফসান। বড় কষ্টে শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক করে সে। কৈশোরের প্রেমের বাণে বিদ্ধ যুবকের ন্যায় ছটফট করে তার ভেতরটা। রাফসানের খুব ইচ্ছা হচ্ছে আর একটিবার তাকিয়ে তাকে দেখার। এই মুহূর্তে এমন দুঃসাহস দেখানোর অর্থই হলো সর্বনাশকে নিমন্ত্রণ করা। রাফসান দূর্বল চিত্তের কিশোর প্রেমিক যুবক নয়। তার মধ্যে সেই শক্তি আছে যা দ্বারা সহজে না হোক কঠিনে হলেও সব নিয়ন্ত্রণ করা সক্ষম। রাফসান নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু হাসল। মেহেরের দিকে নজর পড়তেই ভ্রুকুটি করে বললো,
” কী হয়েছে? ”
মেহের অশ্রু ছলছল বাচ্চা শিশুর মতো তার দিকে তাকায়। যেন এখনই চোখের কোনার বাঁধ ভেঙে জলে ভাসিয়ে নেবে সব। রাফসান নড়েচড়ে বসলো। মেহেরকে এতোটা অসহায় হতে এর আগে দেখেনি সে। স্বভাবতই বিস্ময় তার চোখে মুখে। উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে জবাব না পেয়ে। পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
” মেহের কী হয়েছে বলো?”
” রাফসান!” মেহের আছরে পড়ে তার বুকে। দু’হাতে গলা জড়িয়ে শব্দ করে কেঁদে ওঠে। পেছনে বসা নীরা উৎকন্ঠিত মেহেরের কান্নাকাটি দেখে। রাফসান অস্বস্তি অনুভব করছে। নীরাকে এক পলক দেখলো সে। নীরা উদ্বিগ্ন হয়ে আছে মেহেরের দিকে চেয়ে। আচ্ছা একটু হিংসা সৃষ্টি হলে কী হতো তার মনে? রাফসান মনে মনে হাপিত্যেশ করে। রাফসান মেহেরকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে পানির বোতল এগিয়ে দেয়। মেহের বোতলটা কোলের মধ্যে নিয়েই নাক টানে। নীরা মুখ এগিয়ে বলে,
” আপু কী হয়েছে? ”
” আব্বু স্ট্রোক করছে,,!” মেহের থেমে যায়। জানালার বাইরে তাকিয়ে চোখ মোছে সে। ঘুরে রাফসানকে বলে,
” আমাকে যেতে হবে রাফসান।”
” অবশ্যই যাবে। চলো আমিও যাব।”
” স্যরি! তোমাকে নিতে পারব না। আমার পরিবারকে তো চেনোই তুমি। প্লীজ কষ্ট নিয়ো না। আমি নিরুপায়। ” মেহের রাফসানের হাতটা নিজের হাতে নেয়। রাফসান নীরাকে দেখে আড়চোখে৷ সে শুধু মেহেরের মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। রাফসানকে দেখলে বুঝি ভস্মীভূত হয়ে যাবে। রাফসানের অনুরাগ হয়। রাফসান মেহেরের হাতটা শক্ত করে ধরে আশস্ত করে বলে,
” পাগলি তুমি? রাগ করব কেন? যাও। তবে প্রমিস করো গুরুতর সমস্যা হলে আমাকে জানাবে। জানাবে তো?”
” হ্যাঁ! ” মেহের আবার গলা জড়িয়ে ধরে রাফসানে। রাফসান মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়। মেহের রাফসানকে অনুরোধ করে রাতটা বাসায় থেকে যেতে। সে না থাকলেও শারমিন এবং নীরা তো আছেই। রাফসান রাজি হচ্ছিল না। এমনিতেও সে নীরার আশেপাশে থাকলে তাল হারাচ্ছে। রিস্ক নেওয়া মানেই দূর্ঘটনা ঘটে যাবে। কতোক্ষন নিজের মনকে বাঁধা নিষেধের বেড়াজালে আঁটকে রাখতে পারবে সে? নীরা মানেই তার জন্য ঘূর্ণিঝড়। তার উপস্থিত সব এলোমেলো করে দেয় রাফসানের। যতো দূরে থাকা যায় ততোই ভালো। যন্ত্রণা হোক তবুও সেটা মধুর। মুখোমুখি হলেই আকাঙ্খা বেড়ে যায়। যা পাওয়ার নয় তার আকাঙ্ক্ষা করা বোকামি। মেহের বার বার অনুরোধ করায় অনিচ্ছা স্বত্বেও রাফসানকে রাজি হতে হলো। তবে শুধু রাতটা থাকবে বলে৷ সকালেই সে চলে যাবে। মেহের ধন্যবাদ দেয় কথা রাখার জন্য। নীরার কাছে এসে বলে দেয় রাফসানের খেয়াল রাখতে৷ নীরা নিতান্তই অনীহা মনে মাথা নাড়িয়ে ঠিক আছে বলে। মেহেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নীরার জানা নেই। সে শুধু করুন চোখে চেয়ে রয় মেহেরের যাওয়ার পথে। মেহের মোবাইলের ম্যাসেজ বক্স অপেন করে। একটু আগে ওর ছোট ভাই মাহাদি টেক্সট করেছিল। হসপিটালের নাম,ঠিকানাও দিয়েছে খবরটা জানিয়ে৷ মেহের ঠিকানা দেখে আরেকদফা চোখের জল ফেললো। হাঁটতে হাটতে বনানীর ওভার ব্রিজে উঠে গেছে সে।কল লিস্টে গিয়েই দেখলো পনেরো টা মিসড কল মাহাদির। মোবাইল সাইলেন্ট থাকায় কিছুই টের পাই নি সে সময়মতো। হঠাৎ মোবাইল অন করতেই টেক্সট চোখে পড়ে। এক মুহূর্তের জন্যে থমকে গিয়েছিল তার পৃথিবী। বাবার সাথে যাই হোক সে তো বাবা ছিল। মেহের তার হাত ধরেই চলতে শিখেছে। সেই বাবার কিছু হওয়া মানেই মেহেরের পৃথিবী শূন্য হয়ে যাওয়া। দূরে থাক তবুও বেঁচে থাকুক বাবা। মেহের কাঁপা হাতে ভাইকে কল করে। ডিটেইলসে সব শুনতে শুনতে বাসে উঠে বসে সে।
সিগন্যাল ছেড়েছে, গাড়ি আবার চলছে। নীরা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। মেহেরের জন্য খারাপ লাগছে ওর। মনে মনে প্রার্থনা করছে যেন সব ঠিক হয়ে যায়। সুস্থ হয়ে যায় মেহেরের বাবা। রাফসান একমনে গাড়ি ড্রাইভ করছে। নীরার উপস্থিতি ভেতরটা তোলপাড় করলেও বাহিরে সে নির্বাক, স্থবির।
নীরার প্রচন্ড রকম অস্বস্তি হচ্ছে এই লোকের সাথে একা বাড়ি ফিরতে। আবার থাকবেও নাকি আজ! কবে যে একটা ভালো জব হবে আর এই সব অতীত পিছু ছাড়বে? নীরা আজকাল স্বার্থপর ভাবনা ভাবে। নিজেকে ছাড়া কিছুই তার ভাবনায় আসে না। তার কেউ কোথাও নেই। নিজেকে বাঁচাতে তাকে সব ভুলে সামনে এগোতে হবে। এসব লোক, তাদের ঘেরা অতীত সব উপেক্ষা করবে সে। এই লোকের থাকা না থাকায়, তার মধ্যে কোনো ভাবাবেগের উদয় হতে দেওয়া যাবে না আর। নীরা মনোযোগ ক্যারিয়ারের ভাবনায় ডোবায়। আজকের মতোই ভালো দক্ষতা দেখাতে হবে তাকে৷ এটাই তার লক্ষ্য হবে,ভিন্ন কিছু নয়।
বাসায় পৌঁছে নীরা ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে চলে আসে। সারাদিন কর্মব্যস্ত থেকে এ’সময় বড্ড টায়ার্ড হয়ে যায়। রান্নাঘরে ঢোকার মন মানসিকতা থাকে না৷ অন্যদিন সকালে রান্না করে ফ্রিজে রেখে যায় কিংবা শারমিন, মেহের মন মতো রান্না করে। রাতে এসে খুব একটা রান্নার ঝামেলা পোহাতে হয় না। কিন্তু আজ ঝামেলা হচ্ছে এই লোকটার কারনে৷ অতিথি আপ্যায়ন সওয়াবের কাজ। নীরার তাতে সমস্যা নেই। তবে এই লোক কিংবা তার পরিবার অতিথি হয়ে আসলে ঘোর সমস্যা নীরার জন্য। তাদের খাওয়ানোতে বিন্দুমাত্র রুচি কাজ করে না নীরার ভেতর। রাগে দাঁত কামড়ে ভাত বসায় চুলায় নীরা। মাংস চপিং বোর্ডে উপর কাটছে মনমরা হয়ে। সময় বুঝি এভাবেই বদল হয়৷ একদিন রাফসান নীরার রান্না খেতে চায়নি, আর আজ নীরা খাওয়াতে চাচ্ছে না।
শারমিন এখনও ফেরেনি দেখে নীরার আরও বেশি রাগ হচ্ছে। যদিও এসব রাগ,বিরক্তি শুধুই মনে মনে।বাহিরে সে স্বাভাবিক। যা যুদ্ধ হয় তার মনেই হয়। বাহিরে তার আঁচ পাওয়া ভার। নীরা রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে রুমে দিকে অগ্রসর হয়।
” নীরু!” নীরা শান্ত বাচ্চার মতো নত মুখে ঘুরে দাঁড়ায় রাফসানের ডাকে।
” এই আপনি আমাকে নিরু কেন বললেন? নিরু আমাকে আপন লোকেরা বলে। আপনি ডাকলে নীরা ডাকবেন নয়তো না ডাকবেন।”
মনে মনে ভীষণ রেগে বললেও সামনে শীতল কন্ঠে বলে,
” জি বলুন!”
” আমার মোবাইল টা অফ হয়ে গেছে। চার্জ শেষ। চার্জার হবে?” রাফসান চঞ্চল চোখে এদিক সেদিক চেয়ে বললো। চশমার ফাঁকে সে চোখের ভাষা বোঝা সহজ কথা নয়। নীরাকে তার ব্যাকুল মন ভাবতে চাইলেও সে সেই সুযোগ তেমন দিচ্ছে না। বড় শক্ত শাসনে রেখেছে মনকে। নীরা দৃষ্টি তুলে রাফসানের দিকে তাকিয়ে বললো,
” আমি দেখছি আছে কী না?”
নীরা বাটনওয়ালা স্বল্পদামি মোবাইল সেট ব্যবহার করে। তার মোবাইল চার্জারে হবে না বিধায় শারমিনের চার্জার নিয়ে এলো। রাফসান হাত বাড়িয়ে চার্জার নিতেই নীরার হাতে স্পর্শ হলো সামান্য। দুজনই ঝটকা মেরে হাতটা নিজের কাছে নিয়ে এলো। নীরা গটগট করে হেঁটে চলে আসে রান্না ঘরে। রাফসান স্যরি বলার অবসর টুকুও পেল না। মেহেরের রুমে ফিরে এলো রাফসান। চার্জার অন করে বিছানায় গা এলিয়ে বসলো। চশমাটা খুলে রাখলো সাইড টেবিলের কোনে। কপালে আঙুল ঠেসে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে।
শারমিন ফিরল রাত করে। এসে রাফসানকে দেখে সে’কী খুশি। এতোক্ষনের পিনপতন নিরবতা নিমেষে গায়েব৷ শারমিনের হাসি আর কথার ঝরনায় মুখরিত বসার ঘরটা। তবে মাঝে মাঝে নিরব হয়েও যাচ্ছে ওরা মেহেরের বাবার কথা ভেবে। রাফসান ইদানিং কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে বোধহয়। শারমিন হঠাৎ কথাটা বলে হাসল। রাফসান হেঁসে বললো,
” কথা বলা কমায় নি বরং কথায় আজকাল খুঁজে পাচ্ছি না বলার মতো।”
শারমিন গম্ভীর মুখে বলে,
” ইন্টেরেস্টিং ব্যাপার তো? আপনি কী জানেন এসব কিসের লক্ষণ?”
” না!”
” প্রেমে পড়ার লক্ষণ! ” বলেই শব্দ করে হাসে শারমিন। রাফসান অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তবে কী তাকে দেখলে আন্দাজ করতে পারছে সবাই? না! না! তা কী করে সম্ভব? রাফসান অনিচ্ছা পূর্বক হাসল। বললো,
” আমি তো জানতাম প্রেমে পড়লে মানুষ বকবক করে, কারনে অকারনে। আর তুমি বলছ ভিন্ন কথা?”
” সবার ক্ষেত্রে একই রকম হয় নাকি?”
” আচ্ছা! ” রাফসান ভ্রু তুলে মুচকি হাসল। হঠাৎ ভাবল শারমিন মজা করছে হয়তো তার সাথে। তাতেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
” হুম!” শারমিন সূক্ষ্ম চোখে রাফসানকে দেখলো। তার আজ পাকা ধারণা হয়ে গেল, শুধু মেহের নয় রাফসানও হাবুডুবু খাচ্ছে ভালোবেসে৷ অথচ কেউ কাউকে কিচ্ছুটি বলছে না। দু’টো এক ধাঁচের। এক ধাঁচের লোকদের প্রেম না করাই ভালো। বিপরীতে আকর্ষণ বিকর্ষণ সবই যথার্থ হয়। আলাদা রকমের এক্সাইটমেন্ট কাজ করে বিপরীত প্রেমে।
কথা বলার একফাঁকে নীরাকে কফি দিতে বলে শারমিন। নীরা রান্নাঘরেই ছিল। মাংসটা প্রায় হয়ে এসেছে। মাছটাও রান্না শেষ। মাংস রান্না হতেই চুলায় দুধ বসিয়ে দেয়। ততোক্ষণে আরেকবার ডাক পড়ে তার বসার ঘর থেকে। নীরা মাথায় ওড়নাটা টেনে ধীর পায়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। শারমিন হাসিমুখে বললো,
” ভাইয়ের সাথে কথা বলেছিস?”
শারমিনের প্রশ্নের জবাবে কী বলবে ভেবে পেল না নীরা। চুপ করে রইল কথা খুঁজতে গিয়ে। রাফসান বুঝল নীরার দিকে একপলক তাকিয়ে। শারমিনকে বললো,
” হ্যাঁ হয়েছে।”
নীরা চোখ তুলে তাকিয়ে রইল রাফসানের দিকে৷ রাফসান শারমিনের দিকে মুখ করে বসা। নীরাকে চুপ দেখে শারমিন বললো,
” আমার বোনটা বোকার জাহাজ বুঝলেন ভাই। এতো বুঝায় একটু চালাক,চতুর হ। বোঝেই না। আমার অফিসে লোক নেবে। মার্কেটিং বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে এমন মেয়েদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে। একবার ভেবেছিলাম ওর সিভিটা স্যারকে দেব। পরে দিলাম না। ভাবলাম আরও মাস দুয়েক থাক এখানে। শিখুক কিছু। ভালো করেছি না রাফসান ভাই?”
” হ্যাঁ তুমি তো ওর বোন। যা করবে ভালোই হবে। তবে আমার মতে ও ভালো করে পড়ালেখাটা কন্টিনিউ করলেই বেশি ভালো হয়।”
” পড়ালেখা তো ছাড়ছে না। ওটাও করছে পাশাপাশি এটাও করুক। বুঝেনই তো সব। আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। শীঘ্রই হয়ে যাবে। ওর কী হবে ভাবলেই মাথা ঘোরে আমার। একে তো বোকা তারউপর বিধবা। কী হবে ওর? জীবনটাই শেষ গেল অকালে। বিয়ে দিতে গেলেও কতো কথা হবে সবই তো জানেন। মেয়েমানুষের কপাল একবার ভাঙলে জোড়া লাগেনা সহজে। ওর কপালটাই পোড়া।” শারমিন স্থির চোখে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রয়।
রাফসানের কলিজা মনে হয় কেউ খামচে ধরল। দাঁত পিষে,হাত মুঠ করে চোখের পাতা ফেললো সে। নীরার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। দু’চোখের কোনা ভরে উঠলো নোনাপানিতে। যা ভাবতে চায় না তাই বার বার ওর সামনে আসে। কান্না গলা অব্দি এসে ঠেকেছে বিধবা শব্দটা শুনে। সে বিধবা! এই যে অমোঘ সত্য তার জন্য! এমন কারো বিধবা যে বেঁচে থাকতে তাকে শান্তি দেয় নি। মরেও গিয়েও সমাজের চোখে ছোট করে গেছে। এতোটাই ছোট যে সবাই তাকে হেয় করে। তার মূল্য যেন ঐ সধবা ট্যাগেই ছিল৷ বিধবা, ডিভোর্সী এদের তো সমাজের লোকে রিজেক্টেড বলে উপহাস করে। চার বিয়ে সুন্নত শুনলেই কেউ কেউ সগৌরবে হাসে। বিধবা,ডিভোর্সী বিয়ে করা সুন্নত শুনলে পরক্ষণে নাক সিটকায়। নীরা এখন আর নাক সিটকানির ভয় করে না। তার কোনো পুরুষের প্রয়োজন নেই। এই মূল্যহীন জীবনের বোঝা সে একাই টেনে যাবে। আমৃত্যু বয়ে বেড়াবে নিয়তির দেওয়া ঘা। নীরা টালমাটাল পায়ে চলে আসে রান্না ঘরে। হাঁটু মুড়ে বসে নিরবে কাঁদে অপমানে পিষ্ট হয়ে,
“” শূন্য সব শূন্য। যা আছে ধরা মাঝে তার সবই অমূল্য। একা আমিই শুধু বিনামূল্য।”
চলবে,,,