ক্যাকটাস ? পর্ব ১০

0
2334

ক্যাকটাস ?
পর্ব ১০
Writer Taniya Sheikh- Tanishq

মনুষ্য জীবনের সাথে ঋতুর দারুন এক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ঋতু বদলে কখনো চৈত্র আসে তো কখনো শ্রাবণ। মানুষের জীবন পরিক্রমাও ঠিক তেমনি। কখনো আসে দুঃখ আবার কখনো বা সুখ। কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সেই বিখ্যাত চরণ বলি,”কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে
দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে? সুখ দুঃখ দু’টোই জীবনের অনিবার্য সত্য। দুঃখ ছাড়া সুখের মধুরতা কোথায়? কোথায় বা এর প্রয়োজনীয়তা তীব্র? দুঃখের চোরাবালিতে পড়লেই তো বোঝে সব সুখ আহরিত করার প্রয়োজনীয়তা৷ বর্ষার করুন ক্রন্দন শেষে পৌষের কুয়াশা উঁকি দিচ্ছে দেশজুড়ে। ভোরের সুমধুর আজানের প্রতিধ্বনিতে পরিবেশে বিরাজ করছে অন্য এক পবিত্রতা। ডাগর হরিনী নয়না এক অষ্টাদশী অপলক চেয়ে আছে সুউচ্চ অট্টালিকার পঞ্চম তলার বারান্দা থেকে। ভাবছে আকাশ এতো শূন্য তবুও সে বিশাল কতো! আর আমার ভেতর নেই কোনো বিশালতা, আছে শুধু সমস্ত জুড়েই শূন্যতার হাহাকার। কুয়াশা কেটে গেলে আকাশটা নীলাকাশ হয়ে উঠবে। নীল আলোর বিক্ষেপণে আকাশের সর্বত্র নীলের ছড়াছড়ি। রঙে রাঙিয়ে উঠবে তার বুক। আর আমার! তানিস্ক

চাদরে জড়ানো গুটিশুটি হয়ে বসে থাকা নীরা হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছে। আজ চারটা মাস হলো দুর্বিষহ জীবন ছেড়ে মুক্ত হয়েছে সে। তবুও ভুলতে পারছে না কিছুই। আহনাফের পরিণতি, আহনাফের শেষসময়ের স্মৃতি তাকে যেমন ব্যথিত করে। তেমনি আহনাফের নিষ্ঠুর আচরণ মনে হতেই মুহূর্তে আবার সব ব্যথা ঘৃণার জলে ধুয়ে যায়। কিছু মানুষ অপছন্দের হয়েও আমাদের জীবনের একাংশ দখল করে নেয়। জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকে। না যায় ভোলা আর না যায় সহ্য করা। আহনাফের থেকে মুক্তি চেয়েছিল নীরা। মনেপ্রাণে চেয়েছিল মুক্তি। কিন্তু যখন দেখল সে আশা ক্ষীণ, নিরুপায় হয়ে মেনে নিতে চাইল অবশেষে। ভাগ্য বড়ো পরিহাস করলো তার সাথে৷ যা চাইল তা তো পেল, অথচ ততদিনে মনোবল তার ধুলোয় মিশেছে। আত্মীয় স্বজন সবাই পরিত্যাগ করলো নিষ্ঠুরভাবে তাকে। কী দোষ তার? সে তো নিরব ছিল, সয়েছিল। তবুও তাকে নিতে হলো অলক্ষির কলঙ্ক। তবে কী সত্যিই সে অলক্ষুণে, অপয়া! সে ধর্ষিতা হলো তাতেও তার দোষ, সে সব মেনে নিল নিরুপায় হয়ে তাতেও তার দোষ, আহনাফ খুন হলো তাতেও তার দোষ, আহনাফের বাবা পাগল হলো তাতেও তার দোষ, জরিনা খালার মাথা খারাপ হলো তাতেও যে তারই দোষ দিল সবাই। কেউ তার কথা কেন একবারও ভাবলো না? কলঙ্কের বিষ গলায় ঢেলেছে তবুও দোষ কেন তারই বার বার? এ কেমন বিচার সবার? হয়ে দেখো রেপ, তারপর মেনে দেখো তাকে। মন থেকে মেনে নিয়ে দেখাও তার লাঞ্ছনা, গঞ্জনা। আমিও তো দেখি কতোবড় মনের পতিপ্রণা স্ত্রীলোক তুমি। নীরা দাঁত কামড়ে ফুঁসে ওঠে ঐসব মানুষের উপর,যারা ঐদিন সব দোষ তাকেই দিয়েছিল।

” নীরু!”

হাতে টুথব্রাশ আর পেষ্ট নিয়ে এগিয়ে আসে শারমিন। সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে সে। নীরাকে খোলা জানালায় ওভাবে কুঁকড়ে বসে থাকতে দেখে ভ্রুকুঞ্চন করে বললো,

” অসুখ বাধাবি নাকি? এমনিতেই তোর এলার্জি জনিত সমস্যা। তারউপর এভাবে জানালা খুলে বসে আছিস ঠান্ডায়? এই নীরু!”

শারমিন লক্ষ্য করে নীরার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। মেজাজ চড়িয়ে হাতের টুথব্রাশ,পেষ্ট ফ্লোরে ছুড়ে মারতেই নীরা ভয়ে মুখ তুলে তাকায়। শারমিন চড়া গলায় বলে,

” সমস্যা কী তোর? এতো মরাকান্না কার জন্য করিস? ঐ শয়তানটার জন্য? ”

” আপু এভাবে বলো না। মরা মানুষকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করতে নেই।” নীরা নাক টেনে টেনে বলে

” চুপ কর! বেশি জ্ঞান দিবি না বলে দিচ্ছি? তোকে কতোবার করে বললাম, যা মেহুর সাথে বেরিয়ে আয়। না তুই গেলি না। সারাটা দিন বসে বসে মরাকান্না করিস। কেন নীরু? তুই কী ভেবেছিস জীবন এভাবেই চলবে তোর? এভাবে জীবন চলে না নীরা! আমি তোকে এভাবে শেষ হতে দেব না। যেমন টেনে বের করে এনেছি ঐ নরক থেকে। তেমনি এই মুখ থুবড়ে পরা জীবন থেকেও তোকে বের করব৷ এভাবে কান্নাকাটি মোটেও সহ্য করবো না আমি।” চিৎকার করে বলে শারমিন

” আমাকে কেন টেনে আনলে? বিষ দিয়ে আসতে খেয়ে মরে যেতাম৷ এভাবে বাঁচার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। ”

শারমিন নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে চড় বসিয়ে দেয় নীরার গালে। নীরা দূর্বল শরীরে উপুড় হয়ে পড়ে। শব্দ করে কাঁদে ওভাবেই। শারমিন নিজের ভুল বুঝতে পেরে বোনকে জড়িয়ে ধরে। থমথমে গলায় বলে,

” আমাকে মাফ করে দে নীরু৷ আমি সব বুঝেও তোকে জোর করছি বার বার। কিন্তু কী করবো আমি? আমার যে তোর কষ্ট সহ্য হয় না আর। এভাবে তোকে কষ্টের সমুদ্রে ডুবতে দিলে আর যে বাঁচাতে পারবো না তোকে। আমি চাই তুই আবার স্বাভাবিক হ। আমাদের আগের হাসিখুশি নীরু হয়ে যা। হবি না নীরু তুই আগের মতো?”

” আমি পারবো না আপু। আমার মনে, শরীরে কোথাও সেই জোর নাই রে আপু। আমি সব হারিয়ে সর্বশান্ত আজ। কিসের জোরে হাসবো আমি? কোন সুখে হাসব আমি আপু?” শারমিনের বুকে ডুকরে কাঁদে নীরা।

” এমন কেন ভাঙছিস তুই? সবকিছুকে অ্যাকসিডেন্ট ভেবে নে। মানুষের জীবনে কী এমন অ্যাকসিডেন্ট হয় না? তাই বলে কী সবাই সেটা নিয়ে শোক করে বসে থাকে? স্ট্রং হ নীরু। নিজের জন্য বাঁচ। বাঁচার মতো বাঁচ বোন।”

” আমার সাথে কেন এমন হলো আপু? আমি কী পাপ করেছিলাম যার কারনে আজ আমি এতোটা নিগৃহীত। আল্লাহ আমাকে বলে দাও! বলে দাও এই ভাঙাচোরা জীবন নিয়ে, এই শরীর নিয়ে কী করবো আমি?” নীরু দু’হাতে খামচে খামচে ক্ষত বিক্ষত করে সমস্ত শরীর। শারমিন বাঁধা দিয়েও ঠেকাতে পারছে না। নীরা মাঝেমাঝেই এমন হাইপার হয়ে ওঠে৷ নিজের ক্ষতি করে বসে তখন। একসময় ক্লান্ত হয়ে ঢলে পড়ে শারমিনের বুকে। ব্যথায়, যন্ত্রণায় ভেতরে ভেতরে ছটফট করে। বাহিরে নিরব হয়ে যায়। ভেতরের যন্ত্রণা, ব্যথা অশ্রু ফোঁটা হয়ে গড়াতে থাকে অবিরত। শারমিন আশা বাঁধে মনে। একদিন এই ভঙ্গুর বীজের খোলস ছেড়ে ভেঙে সাহসী,স্ট্রং একটি নতুন বীজ অঙ্কুরিত হবে। সকল আগত ঝড় ঝাপটা মোকাবেলা করতে পারবে এমন স্ট্রং হবে। যাকে পৃথিবীর কোনো ঝড়েই ভাঙতে পারবে না। সবাই পরাজিত হয় না। কেউ কেউ সময়ের পরিক্রমায় জ্বলে পুড়ে ধারালো হয়ে ওঠে। ভেতর থেকে এতোটা মজবুত হয়। যাকে আঘাত তো করা যায়, কিন্তু ভাঙা আর যায় না। সময় মানুষের বর্তমান কষ্টকে অতীতের স্মৃতিতে কনভার্ট করে৷ Time is the best healer. সময়ের স্রোতে সব ঠিক হয়ে যায় নয়তো ডুবে যায়। শারমিন বোনকে ডুবতে দেবে না।

বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম বহু আগেই পৌঁছে গেছে মেহের৷ অফিসিয়াল জরুরি কাজটা শেষ করে হালিশহর আসতে সন্ধ্যা হলো তার। ঠিকানা অনুসারে বাড়িটির সম্মুখে এসে দাঁড়ায় মেহের। স্পেশালি এখানে আসবে বলেই থ্রিপিছ পড়ে মেহের। নয়ত জিন্স, টপস,কুর্তিই তার নিত্যদিনের পোষাক।নীল,হোয়াইট গোল্ডেন মিশেল রঙের থ্রি পিছ পড়নে, হাতে লাগেজ নিয়ে বাড়িটির সদর দরজায় থামল সে। লেয়ার কাট চুলের পনিটেল আরেকবার ঠিক করে নিল। দীর্ঘ চারমাস পড়ে সামনাসামনি দেখা হবে প্রিয় মানুষটার সাথে। বুকে ভেতরটা হাওয়া লাগা পাতর মতো কাঁপছে। এতো ভীরু সে নয়,তবুও ভয় না সংকোচ কী হবে কে জানে। তাকে ঘিরে ধরেছে। মেহের উপরে উপরে স্বাভাবিকতা এনে কলিং বেলে চাপ দিল। অতিদ্রুতই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো এক ষোড়শী যুবতি কন্যা। উজ্জ্বল শ্যামবর্নের মেয়েটি দেখতে দারুন মায়াবী। মেহের হাসিমাখা মুখে মেয়েটিকে বললো,

” কেমন আছো টুসি?”

” মেহের আপা?” মেঘলা আকাশে বিদ্যুৎ ঝলকে ওঠার মতো ঝলকে উঠলো টুসির চোখ,মুখ। খুশিতে চেঁচিয়ে বললো,

” আম্মা দেখে যাও কে আসছে? আল্লাহ গো! আপা আপনি বাস্তবে দেখি চমৎকার সুন্দরী। কি যে খুশি লাগছে আপনাকে দেখে? আম্মা কই তুমি? ও আম্মা!” টুসি মেহেরের নিষেধ উপেক্ষা করেও লাগেজ টেনে আনলো ভেতরে। মেহের টুসির পিছু পিছু এলো। রাহেলা বানু মেহেরকে দেখে কাঁদো কাঁদো অবস্থা। মেহের দু’হাতে জড়িয়ে বসার ঘরেই বসল তাকে নিয়ে। রাহেলা অভিমানি সুরে বললো,

” এই এলি তুই? এই আমাকে বলিস আমি তোর মায়ের মতো? মা’কে এমনি করে ভুলে যায় কেউ? সারাটাদিন তোর পথ চেয়ে বসে আছি আমি। ”

” হ আপা! আম্মা দুপুর পর্যন্ত আপনার জন্য দুনিয়ার রান্না করছে নিজ হাতে। তারপর এইখানে বসে ঐ যে রাস্তার দিকে একবার, ছাঁদে গিয়ে একবার আপনি আসছেন কিনা দেখে। আপনার দেখা না পেয়ে মুখ ফুলিয়ে বসেছিল এতোক্ষণ।”

” চুপ থাক!” রাহেলা মেহেরের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মেহের মুচকি হেঁসে রাহেলার হাত দু’টো মুঠোবন্ধি করে। বলে,

” তোমাকে কথা দিয়েছিলাম না আসব। তাহলে না এসে থাকতে পারি বলো? আর এতো কষ্ট কেন করেছ তুমি? আমি কী অতিথি নাকি?”

” আমি কী বলেছি তুই অতিথি। তুই কী আমার, সেকি আর বলতে হবে মুখে?”

মেহের লজ্জায় মুখ নুয়ে বসে থাকে। টুসি ডায়নিং টেবিলের সামনে থেকে উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করে,

” আম্মা, খাবার টেবিলে সাজাব?”

” হ্যাঁ, খাবার গুলো আগে একটু গরম করে নিস তো মা।”

” আচ্ছা। ”

” টুসিকে খুব ভালোবাসো তাই না আন্টি?”

” হুমম। সেই আটবছর বয়সে রাফসানের হাত ধরে বাড়িতে আসল ও। এতিম মেয়ে। রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতো। আমার রাফসানকে তো চিনিসই। পারলে পুরো পৃথিবীর দায়ভার সে নিজ কাঁধে তুলে নেয়। তবে টুসিটা খুব ভালো মেয়ে। আমার খুব খেয়াল রাখে। ও যে আমার পেটের মেয়ে না, সে’কথায় ভুলে বসি মাঝে মাঝে।” রাহেলা রান্না ঘরে কাজকরা টুসির দিকে অপলক চেয়ে আছে। মেহের সেদিকে তাকিয়ে বলে,

” আমাকে এতো ভালোবাসবে তো? নাকি,,?

” নাকি কী হ্যাঁ? তোকে তো মাথায় করে রাখব আমি। তুই আমার পাঁচটা না দশটা একটামাত্র ছেলের বউ হবি।” মেহের লজ্জায় আবার মুখ নুইয়ে ফেলে। রাহেলা ওর থুতনি ধরে তুলে বলে,

” হ্যাঁ মা, আমার ছেলেটাকে কী তুই বলবি না আমি?”

” এই না! না! একদম এসব ওকে বলতে যাবে না কিন্তু। ও নিজে এসে আমাকে বলবে যেদিন সেদিনই সব হবে।”

” যদি না বলে?”

” আন্টি! ” মেহের আতঙ্কে জড়ানো কন্ঠে বলে।চোখে মুখে জল ছলছল তার। রাহেলা ওর মাথায় হাত রেখে বলে,

” আমার ভয় করে রে মা। তোদের এতো নিষেধ করা স্বত্বেও তোরা ঐ অলক্ষুণে মেয়েটাকে নিয়ে এলি। ওদিকে আমার আত্মীয় স্বজন সম্পর্ক ছিন্ন করেছে আমাদের সাথে। রাফসানকে তো সহ্য করতেই পারছে কেউ। আঞ্জুটা পুত্রশোকে শয্যাশায়ী। স্বামীটাও ওর পাগল হয়ে পাগলা গারদ। সব দোষ যে তোদের দিচ্ছে ও। তোদের নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয়। সব দোষ ঐ অশুভ, অপয়া মেয়েটার। একদিন আমারও মায়া জন্মেছিল। আজ শুধু অভিশাপ দিতে ইচ্ছা করে। আহারে বেচারা আহনাফ! দেখিস তুই ঐ মেয়ের জনমেই যাবে কাঁদতে কাঁদতে। এতোগুলো জীবন শুধু ওর জন্য নষ্ট হলো। আমার রাফসানকে ওর থেকে দূরে রাখিস মা।”

” আন্টি প্লীজ! এভাবে বলো না ওকে। তুমিও তো মেয়ে। আরেকটা মেয়ের কষ্ট কেন বুঝছ না তা হলে?”

” এই এক কথা বলে বলে মাথা খারাপ করছিস তুই আর রাফসান। আমার ঐ মেয়ের নামই এখন সহ্য হয় না। ওকে লাই দিস না। ঘর ভাঙা মেয়ে কখনো কারো ঘর বাঁধতে দেয় না। দূরে থাকবি তুই আর রাফসান ওর থেকে।,,,।রাহেলা নীরাকে নিয়ে সাবধান করতে লাগলো ওকে। মেহের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাহেলার কাঁধে মাথা রাখলো।
মনে মনে ভাবল, আন্টি দোষ তো ওর না। দোষ আমাদের সংকীর্ণ চিন্তা ধারার। জোর করে রেপিষ্টকে যারা স্বামী বানাতে পারে। তাদের চোখে আসলেই দোষী নীরা। যে সয়ে সেই কেবল বোঝে। বাকিদের সাধ্য কী তা বোঝার? তারা তো শুধু দোষই দেবে।

খাওয়া দাওয়া শেষে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়েছিল মেহের। ঘুম থেকে উঠল প্রায় দশটার দিকে। উঠে বসার ঘরে আসতেই জানতে পারল রাফসান এই মাত্র ফিরেছে। রাহেলা একপ্রকার জোর করে মেহেরকে উপরে পাঠিয়ে দিল। দোতলায় একা রাফসান থাকে। নিচতলায় দু’টো রুম। একটাতে রাহেলা আর টুসি থাকে অন্যটা মনে হয় গেষ্টদের জন্য বরাদ্দ রেখেছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দোতলায় দুটো রুম দেখা যায়। রাহেলা আগেই বলেছে ডান সাইডের রুমটা রাফসানের শোবার ঘর আর বামটাতে তার স্টাডি রুম। মেহের কয়েকবার নক করার পরও কেউ খুললো না। অগত্যা লক ঘুরিয়ে নিজেই রাফসানের রুমে প্রবেশ করলো সে। অনুমতি ছাড়া প্রবেশে অস্বস্তি ফিল করছে, আবার রাফসানের রুমে রাফসানের গায়ের সুগন্ধ অনুভব করে শিউরে উঠছে মেহের৷ ডিম লাইটের অনুজ্জ্বল আলোয় রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখে নিল। গোছালো, পরিপাটি রুম। খাটের কোলঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে মেহের চলে এলো ব্যালকনিতে। সামনের ছোটবড় বিল্ডিংএ জ্বলে ওঠা বাতিতে পুরো শহরটা দেখলো একনজর মেহের। ব্যালকনিতে বাহারি ফুল গাছ লাগানো। মেহের হাতে ছুঁয়ে দেখছিল গাছ, ফুল। হঠাৎ কিছু বিঁধলো ওর হাতে। ব্যথায় আহ! করে উঠল মেহের।

” কে ওখান?” প্রশ্নটা করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো রাফসান। মেহেরকে এখানে দেখে বিস্মিত হয়ে বললো,

” আমার লেডি জেমস বন্ড যে। হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ। কখন এসেছ?”

মেহের বরফের মতো জমে গেল ভেজা,এলোমেলো চুলে সদ্যঃস্নাত রাফসানকে দেখে। বুকটা ঢিপঢিপ করছে ওর। হাতের ব্যথা মুহূর্তে গায়েব। রাফসান মুখে সামনে তুড়ি বাজিয়ে ভ্রু নাচাতেই অপ্রস্তুত হাসল মেহের। হাতের ব্যথাটা টনটন করে উঠল ঘোর কাটতে। রাফসান উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” কাঁটা ফুটালে কী করে?

” ঐ যে তোমার গাছ ফুটিয়ে দিয়েছে। কী হিংসে। আমি যেন তোমাকে দখল করতে এসেছি। দেখো হিংসে জ্বলে পুড়ে কী করেছ?”

রাফসান মেহেরের কথার ভঙ্গি শুনে হাসল। বললো,

” তা তো করবেই। গভীর প্রেম আমাদের।”

” ইশশ!”

” আর ইশশ টিশশ করো না। চলো এন্টিসেপটিক লাগাতে হবে।”

মেহেরকে বিছানায় বসিয়ে ড্রয়ার থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে এলো। মেডিসিন মেহেরের হাতে লাগাতে লাগাতে বললো,

” ক্যাকটাসের কাঁটা ফুটেছে বোধহয়।”

” ক্যাকটাস! কী সাংঘাতিক তুমি। পৃথিবীতে এতো প্লান্ট থাকতে এই বিপদজনক গাছটা লাগানোর শখ হলো তোমার? ”

” মোটেও বিপদজনক নয় ওটা। স্লেফ ডিফেন্ড করে বলেই কী বিপদজনক হয়ে গেল?”

” ধরতে গেলেই কাঁটা ফুটিয়ে দেওয়া সেল্ফ ডিফেন্ড বলছ? আমি কী ক্ষতি করতে চাচ্ছিলাম নাকি?”

” যার যা ধর্ম বুঝলে? আর সবচেয়ে বড় কথা তুমি হাত বাড়াল বলেই তো খোঁচাটা খেলে। সে সেধে এসে তো আর খোঁচা দেয় নি।”

” এমন ভয়ানক জিনিস না রাখলেই তো পারো?” মেহের কপট রাগ দেখাল।রাফসান মুচকি হেঁসে ফার্স্ট এইড বক্স নির্দিষ্ট স্থানে রেখে বললো,

” আগে ছিল না। গত সপ্তাহে অফিস থেকে ফেরার পথে ভ্যানগাড়িতে দেখলাম। জানো মেহের? দারুন একটা সাদা ফুল ফুটেছিল ক্যাকটাসটাতে। কাঁটাযুক্ত গাছেও যে এমন ফুল হয় দেখেই বিস্মিত আমি, সাথে মুগ্ধও বলতে পারো। সব সুন্দর জিনিসই কাঁটা থাকে। এই যেমন গোলাপের কথায় ধরো না।তাই তো নিয়ে এলাম। সব সুন্দর সাথেই কাটা থাকাটা আবশ্যক বুঝলে? নয়তো সুন্দরকে নিরাপত্তা দেবে কী করে? অবলীলায় যে কেউ ছিঁড়ে ফেলতে চাইবে। কাঁটা থাকলে ছিঁড়তে দু’বার ভাবতে হবে। আরও ইন্টারেস্টিং হলো অন্য গাছের মতো রোজ রোজ কেয়ার করা লাগে না। দারুন সহিষ্ণু হয় এরা। মরুভূমির উদ্ভিদ বলেই হয়তো এমন সহিষ্ণু। কেন যেন বিশেষ কারো কথা মনে করিয়ে দেয় ক্যাকটাস আমাকে। যদিও দু’জনই এরা ভিন্ন প্রজাতির। অবস্থানটাও ভিন্ন। তবুও মনে হয় হোক সে ক্যাকটাস নিজের জীবনে কিংবা কেউ আসুক ক্যাকটাস হয়ে তাকে আগলে রাখতে। ঠিক ফুলটার মতো। এখন রোজ রোজ ক্যাকটাসকে দেখলে তার কথা ভাবি। আশ্চর্য হচ্ছো তাই না? আমিও আজকাল হচ্ছি। মানুষের মনের অলিগলিতে কখন কী ঘটে, মানুষ নিজেও হয়তো তার আভাস পায় না। আশ্চর্য কিছু ঘটে যায়। যার কল্পনাও হয়তো করা ছিল না আগে।”

মেহের ভ্রুকুটি করে চেয়ে আছে রাফসানের বিমুগ্ধ হওয়া মুখটায়। মনের কোনে অসহনীয় ব্যথা হচ্ছে শেষ কথাগুলো শুনে। তবে কী রাফসানের হৃদয়ে অন্য কোনো নারীর বাস? না! না! কী ভাবছে সে এসব। এমন কিছুই নয়। একটা গাছ নিয়েই হয়তো পরিচিত কাওকে মিলাচ্ছে। সে যে নারীই হবে এমন তো নাও হতে পারে। রাফসান মেহেরের চুপসে যাওয়া দেখে হেঁসে ওঠে। বলে,

” এতোটা গুম মেরে গেল কেন লেডি জেমস বন্ড? ভয় পেলে নাকি?”

” ভয় কেন পাব?”

” আমিও তো তাই বলি। ভয় কেন পাবে লেডি জেমস বন্ড।” রাফসান উঠে দাঁড়ায়। ব্যালকনির দিকে যেতে যেতে মৃদু স্বরে হেলাল হাফিজের কবিতার চরণ আওড়ায়,

“দারুন আলাদা একা অভিমানী এই ক্যাকটাস।
যেন কোন বোবা রমণীর সখী ছিলো দীর্ঘকাল
কিংবা আজন্ম শুধু দেখেছে আকাল
এরকম ভাব-ভঙ্গি তার।
ধ্রুপদী আঙিনা ব্যাপী
কন্টকিত হাহাকার আর অবহেলা,
যেন সে উদ্ভিদ নয়
তাকালেই মনে হয় বিরান কারবালা।

হয় তো কেটেছে তার মায়া ও মমতাহীন সজল শৈশব
অথবা গিয়েছে দিন
এলোমেলো পরিচর্যাহীন এক রঙিন কৈশোর,
নাকি সে আমার মত খুব ভালোবেসে
পুড়েছে কপাল তার আকালের এই বাংলাদেশে।

বোকা উদ্ভিদ তবে কি
মানুষের কাছে প্রেম চেয়েছিলো?
চেয়েছিলো আরো কিছু বেশি।

চলবে,,,

ক্যাকটাস গত পর্বের আহনাফ মৃত্যু নিয়ে আলোচনা।

আহনাফকে বাঁচানো কিংবা মিলিয়ে দেওয়ার অর্থই ছিল রেপিষ্টকে প্রমোট করা। যা আমি কোনোদিন করবো না। এখন যদি বলেন আপু সে তো ভালো হয়ে গেছিল। আমি বলবো কোথায় দেখলেন? ওহ! ঐ যে তার স্বগতোক্তি থেকে? আহনাফ বার বার বলেছে সে ভালোবাসে আর নীরা বার বার বলেছে সে ঘৃণা করে। গতপর্বে সে বলেছে ঘৃণা করে তবুও আশা বাঁধছে আহনাফের ভালোবাসা পাওয়ার। তার মন বলছে আহনাফ একবার ক্ষমা চাইতো। তাহলে সব ঠিক হয়ে যেত। একটা মানুষ ঘৃণাও করে আবার ঐ মানুষকেও চায়। কখন বলেন তো? নীরা বুঝেছিল তার মুক্তি হয়তো মিলবে না আর সুতরাং এতো মান অভিমানে না যেয়ে মিলই হোক। নীরার দূর্বল ধারণা। গল্পে ধর্ষণ একজন নয় দু’জন হয়েছে। প্রথমজন দ্বিতীয় জনের জীবনটা তারই মতো হোক চায়নি। তাই তো বলেছে “জালেমে বংশ নির্বংশ করে দিছি” এই কথার মাঝে অনেককিছু লুকায়িত। আহনাফের মৃত্যু শুধুমাত্র আহনাফের জন্য শাস্তি নয়। আহনাফকে তৈরি করা পিতার মাতার জন্য শাস্তি। তার পিতা বলেছিল ” ভয় নেই আব্বা। তোমার দিকে বিপদ আসার পূর্বে আমরা তার মুখোমুখি হব আগে। আমোদে প্রমোদে বাঁচো। ” এমন আস্কারার ফল দেখিয়েছি। দেখিয়েছি তার ক্ষমতা কতোটুকু। আহনাফ ভুল স্বীকার করেছে কারন আমি চেয়েছি প্রতিটি ধর্ষক বুঝুক তার দোষ। সে কতোবড় অন্যায় করেছে উপলব্ধি করুক।

যারা নীরা আহনাফের মিল চেয়েছেন। কেমনে মিলাবো? নীরার জায়গা নিজেকে ভেবেছি পারি নি মানতে আহনাফকে। আমি কেন উপস্থাপন করবো নীরার আজীবন বন্দিত্বের কাহিনি? ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে কেন আহনাফকে ভালোবাসতে বাধ্য করবো? শরীরে দেওয়া আঘাত ভোলা যায়। কিন্তু আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুলবেন কী আপনি? নীরার স্থানে একটিবার নিজেকে রাখুন। তারপর ভাবুন কোনটা উচিত ছিল আর কোনটা না।

অনেকে বলেছেন শাস্তি দিয়ে মিলিয়ে দিতেন। রেপিষ্টের শাস্তি সম্পর্কে ধারণা থাকলে হয়তো এমনটা বলতেন না। আর বিনা শাস্তিতে মিলিয়ে দেওয়ার অর্থই ছিল রেপিষ্ট প্রমোট। হিরা মনি, সায়মা, কুমিল্লার তনু কিংবা ঢাবির ঐ স্টুডেন্ট যাকে রাস্তা থেকে টেনে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। এমন আরও অসংখ্য ঘটনা আমাকে রেপিষ্ট প্রমোট করতে নিষেধ করেছে। তদুপরি আপনাদের কষ্ট দেওয়ার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। বাট যা আমার বিবেক নিষেধ করবে তা করার সাধ্য আমার নেই। আপনারা মতামত প্রকাশ করতেই পারেন। কিন্তু আমি তো লেখক। আমি ভুল জিনিস কী করে প্রচার করি বলেন?
অনেকে বলেছেন গল্প পড়ার ইন্টারেস্ট শেষ। আর পড়ব না। তাদের উদ্দেশ্যে বলবো। জি অবশ্যই। আপনার পছন্দ না হলে আপনি পড়বেন না। পাঠক বাড়াতে অন্তত এই গল্পে অনুচিত বিষয় সাপোর্ট করতে পারলাম না আমি। আহনাফের মৃত্যু না হয়ে শাস্তি হতে পারতো। অবশ্যই পারতো তবে কিছু কারণবশত এটাই দিয়েছি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে