ক্যাকটাস?
পর্ব ০৯
Writer Taniya Sheikh -Tanishq
শুল্ক পক্ষের চাঁদ আকাশে৷ রাত হয়েও আঁধার নয় আলোয় ভাসছে পৃথিবী। স্নিগ্ধ কোমল আলোয়৷ রাফসান হসপিটালের করিডোরের রেলিং ঠেঁসে দাঁড়ানো। বগল দাবা হাতদুটো, চাঁদে দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ, পা দু’টো ক্রস করা।
” ঘুমাবে না?”
মেহের মলিন মুখে এসে দাঁড়াল রাফসানের পাশে। রাফসান ওভাবেই বললো,
” ঘুম আসছে না। মা ঘুমিয়েছে?”
” হুমম। ডক্টর ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে। একটা কথা বলি ব্যারিস্টার?”
” হুমম।”
” তুমি বরং ফিরে যাও আন্টিকে নিয়ে। শুধু শুধু ঝামেলায় জড়িও না। আর তাছাড়া,,, ” মেহের মুখ ঘুরিয়ে চাইল রাফসানের দিকে। রাফসান জ্বলন্ত চোখে ফিরে তাকাল। বললো,
” তাছাড়া কী মেহের? ”
” আন্টি কেমন হাইপার হয়ে উঠছে বার বার। প্লীজ তার কথার অবাধ্য হয়ো না আর। চলে যাও।” মেহের মৃদু স্বরে বললো
” জাস্ট স্টপ ইট মেহের। এ বিষয়ে একটা ওয়ার্ডও শুনছে চাচ্ছি না এই মুহূর্তে আমি। প্লীজ,,,!”
” আন্টির কন্ডিশন কিন্তু খারাপ হতে পারতো। কেন বুঝতে চাইছ না? তার তুমি ছাড়া কেউ নেই। তোমার চিন্তায় বিপি হাই হয়ে যাচ্ছে তার। আন্টির উল্টো পাল্টা একটা কিছু হয়ে গেলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে?”
” নীরার কিছু হলে তুমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে? তোমার কথা কেন বলছি? মেহের আমি কোনোদিন পারবো না ঐ মেয়েটার কিছু হলে।” পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লো রাফসান
” কিছুই হবে না ওর। আহনাফ যাই করুক খারাপ কিছু করবে না ওর সাথে। সো রিলাক্স। আর হ্যাঁ ভেবো না নীরাকে ঐ আহনাফের আশায় ফেলে রাখবো৷ জাস্ট কথার কথা বললাম। যে করেই হোক সময় সুযোগ বুঝে ঠিক ঐ জাহান্নাম থেকে উদ্ধার করবো আমি ওকে। তুমি প্লীজ নিজেকে এসবে জরিয়েও না।”
” কথা শেষ তোমার? স্ট্রেঞ্জ তুমি,তোমরা। আহনাফ ওর সাথে খারাপ কিছু করবে না। ওয়াও! দারুন বলেছ তুমি।” তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো রাফসান
” রিলাক্স রাফসান! তুমি যেটা মিন করছ। আমি তেমন করে বলতে চায়নি।আমি জাস্ট,,, ” মেহের থেমে যায়। রাফসান উঁচু গলায় বলে,
” আমি জাস্ট হোয়াট মেহের? আহনাফ কে বিশ্বাস করতে বলো তুমি? ওর জন্মের পর থেকে চিনি ওকে আমি। ও নিজেকেও ওতোটা চেনে না যতোটা ওকে আমি চিনি। ওর মগজ নষ্ট করে ফেলেছে ওর বাবা মা আহ্লাদে, আস্কারায়। তুমি জানো! আমার মনে হয় আহনাফ এখনও দৃঢ় মনে কিছুই চিন্তা করতে পারে। রাগ উঠলে ও ভালোমন্দ জ্ঞান সব ভুলে যায়। আমার ফুপা ফুপি ছেলেকে অমানুষ করে ফেলেছে মেহের। আহনাফ নিজের স্বত্বাকে ভুলে বসেছে। জন্মের পর প্রতিটি মানুষ নিষ্পাপ হয়ে জন্মায় সাথে অসহায়। এই অসহায় শিশুগুলোকে সঠিক পথ দেখানোর দায়িত্ব আল্লাহ পাক পিতা মাতার উপর অর্পন করেছেন। কিন্তু দেখো কিছু পিতা মাতা কী করে! তারা নিজ হাতে বিপথে ঠেলে দেয় সন্তানদের। সন্তান কষ্ট পাবে,কাঁদবে এটা তাদের সহ্য হয় না। স্বাভাবিক তারা পিতা মাতা, তাদের অন্তর সন্তানের জন্যে পুড়বে। কিন্তু তাই বলে সন্তানের ক্ষনিক হাসির জন্য বিপথ দেখাতে হবে? এটা কী দায়িত্বের খেলাপ করলো না? দায়িত্বের খেলাপ করলে খেসারতও তাদেরকেই দিতে হবে৷ আজ যার খুশির জন্য খারাপ জিনিসটাও তার সহজলভ্য করে দেওয়া হচ্ছে। তাকে বোঝানো হচ্ছে সে যা খুশি করতে পারে,চাইতে পারে,ভোগ করতে পারে। হোক সেটা অন্যায়। একদিন এই সকল অন্যায়,অনিয়ম তাদের সন্তানকে গ্রাস করবে। সেদিন হাজার চেষ্টা করেও ঠিক হবে না কিছু। গাছ একবার নুয়ে গেলে সোজা করা কঠিন মেহের। ছাঁচ থেকে একবার মাটি পুড়ে ঘড়া হয়ে আসলে তাকে ভিন্ন কিছু বানানো সম্ভব ই নয় আর। সম্ভব করতে গেলেই ভাঙতে হয়, চূর্ণ বিচূর্ন করতে হয়। এটা কী সম্ভব ঐ পিতার মাতার জন্য? কুমোর যা অবলীলায় পারে, পিতা মাতা তা সহজে পারে না। মমতা তাদের পারতে দেয় না। আজ আহনাফ সৎ নয়, রেপিষ্ট। কার দায় এটা? কিছু সন্তান স্বভাব দোষে দুষ্ট আর কিছু পিতামাতার আদরে স্বভাবটাই হারিয়ে বসে। আহনাফ দ্বিতীয় প্রজাতির জীব৷ তার অপরাধের অর্ধেকাংশর দায় আমার ফুপা ফুপির। সময় ক্ষমতা দেখে না মেহের। সময়ের এক ফোঁড় অসময়ে দশ ফোঁড়। কর্মফল এড়ানোর সাধ্য না আমার আছে না তোমার। আহনাফ বুঝবে কী না জানি না। তবে ভাই হিসেবে ওকে সঠিক পথ দেখানোর দায় আমি এড়াতে পারবো না৷ নীরার পরিনতি আমাদের দায়িত্ব হীনতার ফল। কী করে এভাবে ফেলে যায় তবে ওকে বলো?” রাফসান শ্বাস ফেললো এতোক্ষনে। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আছে তার।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ রইল সেসময়। নিরবতা ভেঙে রাফসান শীতল গলায় বললো,
” আ’ম সরি মেহের। ওভাবে রিয়েক্ট করা উচিত হয়নি তোমার উপর। রাগ করো না। ”
” ইটস ওকে রাফসান। ভুলটা আমারই ছিল। আন্টিকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে খুব আমার।” মেহের মুখ নামিয়ে বললো
” ডোন্ট ওয়ারি। মা’র কিছুই হবে না।” রাফসান মৃদু হাসলো। দৃষ্টি ঘুরিয়ে চেয়ে রইল আকাশে।
মেহের মুখে তুলে চাইল রাফসানের সামনে ফেরানো মুখটায়। অপলক তাকিয়ে আছে রাফসানের সুন্দর মুখখানার দিকে সে। চাঁদের আলোও বুঝি আনন্দিত ও মুখে পড়েছে ভেবে৷ মেহেরের খুব হিংসে হলো চাঁদের আলোর উপর। কেন হলো হিংসে? মেহের লজ্জায় আরক্ত হয়ে মুখ নামিয়ে নিল। ২৭টি বসন্ত পার করে এসেছে। কভু সে বসন্ত দোলে নি মনে।অথচ আজ! আজ সমস্ত বিগত বসন্তেরা নানা রঙে রূপে আলোড়িত করছে হৃদয়। অনেক কথায় বলার ছিল সবই ভুলেছে মেহের। তার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য সবটা ভুলে গেল। নারী স্বত্বার আস্বাদ অনুভব করছে এই ক্ষণে সে। তার নারীত্ব বুঝি ধন্য হবে এই পুরুষের একটু ভালোবাসায়।একটু! না না। এই পুরুষের মনের রাজ্যের একছত্র সম্রাজ্ঞী হবে সে। অন্য কারো প্রবেশাধিকার মোটেও বরদাস্ত করবে না। একচুলও না। মেহের করিডোরের লোহার রেলিংটা সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরেছে৷ লজ্জা রাঙা মুখটা সামান্য উন্নত করে আরেকবার চাইল রাফসানের মুখের উপর৷ বুকটা বুঝি তড়িৎ গতিতে ধড়ফড় করছে। মেহের চাঁদে দিকে তাকিয়ে মনে মনে অনুযোগ করল
” আমার এই সর্বনাশ তোর কারনে হলো আজ। ব্যারিষ্টারের প্রেমে মাঝ সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে ভাসা মনটা নিয়ে কোথায় যাবো আমি এখন? বল আমায়! সর্বনাশি পূর্নিমার আলো। সব দোষ তোর এই রাতের।”
দু’টো মানুষ পাশাপাশি অথচ মন দু’দিকে বেঁকে গেছে৷ এতো কাছে তবুও বোঝে না কেউ কারো মন। এজন্যই বলে বুঝি বিচিত্র, বড় বিচিত্র এ মানব মন।
[ এর পর পাঠকরা নীরার নিজ বর্ণনা পাবেন না। তার স্বীয় বর্ননার স্থানে তৃতীয় পক্ষ বর্ননা করবে]
নীরাকে দুবাহুর মাঝে খুব আবেশে বেঁধে আছে আহনাফ। চক্ষু ছলছল। পাছে নীরা বুঝে যায়, সেই কারনে নীরার হাড্ডিসার সিনার উপর মুখ লুকিয়ে আছে সে। পৃথিবীটা আজ বড় নিষ্ঠুর, নিষ্প্রাণ মনে হচ্ছে আহনাফের কাছে। নিজেকে তারচেয়েও বেশি হীন,অপদার্থ মনে হচ্ছে। মৃত্যুকে এতো ভয় কেন তার? কেন সে বাস্তবতা মেনে মাথা নত করতে পারছে না ন্যায়ের সম্মুখে। জীবনে করা সকল অন্যায়,অপরাধ আজ তাকে হীন,ভীত করে তুলছে। মূল্য দিতে হবে প্রিয় মানুষটার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। চিরজীবনের জন্যে বিদায় দিয়ে। আর এই উষ্ণ আবেশ সে পাবে না। আহনাফ ঘুমন্ত নীরার ওষ্ঠ পাগলের মতো চুম্বন করতে থাকে। নীরার আতঙ্কিত ঘুমজড়ানো ভীরু নেত্র পল্লবের মাঝের দৃষ্টি ফাঁকে ফাঁকে সে দৃশ্য দেখছে। আহনাফ আজ ব্যথা দিল না শুধুই ভালোবাসলো তাকে। যেন সারাজীবনের ভালোবাসা একবারে উজাড় করে দিল। নীরার চোখে আজও জল এলো, তবে কষ্টের নয় অন্য এক অনূভূতির। আহনাফকে সে ঘৃণা করে। মনে প্রাণে ঘৃণা করে। আজ বিকালে যা করেছে তারপর তো আরও৷ আজ হঠাৎ নীরার মন অকারণেই আশা বাঁধতে চাইলো। এভাবে ঘৃণার খেলায় লাভ তো কিছুই নেই। মানুষ ভুল করে। আহনাফও করেছিল। সেকি সব ভুলে একটিবার ক্ষমা চাইতে পারতো না নীরার কাছে? নীরা কী ফিরিয়ে দিত? দিলে আবার ক্ষমা চাইতো। একবার,দুইবার একসময় ঠিক ক্ষমা করে দিত। কিন্তু কই! একবারও তো ক্ষমা চাইলো না সে। বরং বার বার আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে তুললো তাকে। এই কী তার ভালোবাসার নমুনা? এমন করেও বুঝি কেউ ভালোবাসে? এর চেয়ে মৃত্যুও ভালো। একবারে মেরে ফেলুক আহনাফ তাকে। তাতেও যে তার শান্তি। এমন ভালোবাসার মরিচিকায় তো থাকতে হয় না তবে আর।
বিবস্ত্র দু’টি দেহ পরস্পরকে আলিঙ্গন করে আছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে আদি মানব মানবি যেমন ছিল। লজ্জাহীন,সংকোচহীন। কোনো ক্লেশ নেই আছে শুধু ভালোবাসার অতৃপ্ততা। ঐটুকু পেলেই বুঝি সার্থকতা এ দুটি জীবের। দুজনে বেখবর দুজনার মনের গহীনের ঝড়ের। একজন তবুও নিরাশায় আশা বেঁধে আছে। অপরজন তো সেটাও জলাঞ্জলি দিয়েছে বহুক্ষণ পূর্বে। তার জন্য এই অন্তিম ক্ষন অনেক দামি।
ঘড়ির পেন্ডুলাম ডং ডং করে জানান দিল সময় হয়েছে অন্তিম সময়ের। দু’টি জড়ানো দেহের একটি আতঙ্কিত মুখে ধড়ফড়িয়ে উঠল। অপরজনের চোখে কৌতূহল। তার কৌতূহল বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য হলো না৷ আহনাফ এলোমেলো ভাবে কী যেন খুঁজছে। নীরা চাঁদর জড়িয়ে বসে দেখছে ভ্রুকুটি করে। কেমন যেন লাগছে আহনাফকে তার। এমন তো কখনো করে না সে। ভয় লেশমাত্রও থাকে না যখন এ ঘরে আহনাফ থাকে। তবে কী হলো এখন? ফ্লোরে ছড়ানো কাপড় পড়ছে অস্থির হাতে। মৃগী রোগীর মতো অস্থিরতা তার মধ্যে। ঘামছে প্রচন্ড তার কপাল।
আহনাফের কলিজা বুঝি কামড়ে ধরেছে কেউ। এমন কেন হচ্ছে তার সাথে? কেন? না সে পারবে না। কিছুতেই পারবে না নীরাকে হারাতে। সে ভালো হয়ে যাবে। নীরার পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইবে। অনেক ব্যথা দিয়েছে আর দেবে না। কোনোদিনই না। তার দোষে কেন নীরা কষ্ট পাবে। দোষ তো সব তার। হ্যাঁ সব পাপ তার। তবে প্রায়শ্চিত্তও তারই হওয়া উচিত। আহনাফ সকল বাধা নিষেধের সাথে মনে মনে যুদ্ধ করে অবশেষে জয়ী হলো। পূর্নিমার আলো তার মনের সকল আঁধার দূর করল এক নিমেষই। সে সব হারাতে রাজি তবুও তার নীরাকে নয়। অশ্রুসজল চোখে নীরার দিকে ঘাড় ঘুরে তাকায় আহনাফ। নীরা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে আহনাফকে দেখছে। তার আশার প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে দ্বিগুন আলোয়। সেই আলো ডগমগ করলো হঠাৎ মোবাইলের রিংটোনে। বড় বেসুরো লাগলো এই সুরও আজ দুজনের কাছে।
আহনাফ কল রিসিভ করতেই ও পাশ থেকে তার আব্বা রইস চৌধুরী গম্ভীর গলায় বললো,
” সব রেডি। বাড়ির পেছনের জঙ্গল মাড়িয়ে চলে এসো রোডে।”
” আব্বা একটা জরুরি কথা ছিল। প্লীজ বাসায় এসো।”
” আহনাফ! সব কথা পরে। যা বলেছি তাই করো। রাস্তা নির্জন এই মুহূর্তে । ভোর হওয়ার আগেই যা করার করতে হবে। তাড়াতাড়ি এসো।”
আহনাফকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে কট করে লাইনটা কেটে দিল রইস। আহনাফ চিন্তায় পড়ল। সকল চিন্তা নিমেষে কেটে গেল বিছানায় বসা চাঁদ মুখখানা দেখে। সে ভেবে নিল এই চাঁদ কোথাও যাবে না। যা বলার,করার সেই করবে। আহনাফ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে নীরার পাশে বসল। নীরার কপালে চুমু খেয়ে বললো,
” ঘুমিয়ে পড়।” আহনাফ বিছানা ছেড়ে উঠতেই নীরা হাত টেনে ধরল। উদ্বিগ্ন স্বরে বললো,
” কোথায় যাচ্ছেন এতোরাত্রে? আমাকে একা রেখে যাবেন না প্লীজ।”
” এক্ষুনি আসছি। ভয় নেই। কিছুই হবে না তোর। কিছু হতেই দেব না আর আমি। ঘুমিয়ে পড়।”
নীরা আহনাফের কথা মানতে শুয়ে পড়ে৷ চোখ মেলে চেয়ে দেখে আহনাফের যাওয়া। বাইরে থেকে দরজা ভিরিয়ে দেওয়ার সময় আহনাফ মুচকি হাসল। নীরাও হাসল প্রত্যুত্তরে। আহনাফ দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে যায়। নীরা ভাবছে এমন করেই যদি আহনাফ প্রতিদিন প্রতিক্ষণ তাকে ভালোবাসতো। পরক্ষনেই নিজের দুর্ভাগ্যকে পরিহাস করে বললো,
” এতো আশ না রাখ মন। আশা ভাঙার জ্বালা যে বড় কষ্টের।”
গায়ে কাপড় জড়িয়ে উঠে জানালা ধরে দাঁড়ালো সে। কী মিষ্টি পরিবেশ বাইরে। ঘন ঝোপঝাড় আর ঐ যে বাঁশ ঝাড় তার মাথার উপর জ্বলছে রুপালি চাঁদ। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নীরা। ভাবছে তার জীবনে এমন আলো কেন নেই? কী এমন পাপ করেছিল সে জীবনে? কেন এমন দুর্দশা এই ললাটে তার? সবার মতো স্বাভাবিক কেন হলো না তার জীবন? অজান্তেই চোখ বেয়ে জল গড়াল দু’ফোটা। চোখ মুছে বাড়ির নিচে তাকাতেই চমকে উঠল সে। ঝোপঝাড় মাড়িয়ে কেউ এগিয়ে যাচ্ছে অদূরের রাস্তার দিকে। কে? স্বগতোক্তি করল নীরা৷ ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝল ওটা আহনাফ। চাঁদের আলোয় এখন অনেকটা স্পষ্ট তার অবয়ব। কিন্তু আহনাফ জঙ্গলাকীর্ণ ঝোপঝাড় মাড়িয়ে যাচ্ছে কোথায় এতো রাতে? তার যাত্রাপথে দৃষ্টি অনড় রাখল নীরা।
পায়ের তলায় শুকনো পাতা পড়তেই খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে শব্দ হচ্ছে। এদিকটায় রাতে কখনোই আসা হয়নি আহনাফের। জীবনটাই এমন, যা হয় নি পূর্বে তাই হবে ভবিষতে।মানিয়ে চলতেই হবে। আহনাফের ধ্যান ধারণা একরাতেই বিস্তর পরিবর্তিত হলো। ভালোবাসার শক্তি বুঝি একেই বলে। জোস্নার আলোতে পথ চলতে সমস্যা না হলেও কেমন গা ছমছম করছে আহনাফের।
পকেট থেকে সিগারেট বের করে ফুঁকতে ফুঁকতে এগিয়ে যাচ্ছে সে। বাঁশ ঝাড়ের সন্নিকটে এসে থমকে দাঁড়ায় আহনাফ। পাগলিনী বেশে এলো চুলে বাঁশ ঝাড়ের কোনায় দাঁড়িয়ে আছে জরিনা। তাকে দেখে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে হাত দুয়েক দূরে থামল। জরিনাকে এসময় এই বেশে দেখে কপাল কুঞ্চিত করে আহনাফ বলে,
” খালা তুমি এতো রাতে এখানে?”
জরিনার হাত দু’টো পেছনে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে অপলক তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। চোখ দু’টো যেন কোঠর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারলে বাঁচে। দাঁত কপাটি বিশ্রী ভাবে বের হয়ে আছে জরিনার। আহনাফের বুক ধ্বক করে উঠল তা দেখে। আমতা আমতা করে উচু স্বরে ফের জিজ্ঞেস করলো,
” বলো কী করছ এখানে?”
” মাতায় যন্ত্রণা করে রে বাপ। ঘুম আহে না। তোর ভাইডা খালি জ্বালায়।” জরিনা ঘাড় নাড়িয়ে নেকিসুরে বলে।
” ভাই, কার ভাই?”
” কেন তোর। আপন না তয় সৎ। হোক সৎ তাও তো ভাই হয় ক বাপ?”
” তোমার মাথায় আবার সমস্যা দেখা দিছে দেখছি। কী সব উল্টা পাল্টা কথা বলো।যাও বাড়ি যাও।”
” ধমকাইস না রে বাপ। আমারে ধমকাইতাছোস শুনলে রাগ হইব ঐ। আমি কতো বুঝাইতাছি বুঝতাছেই না। সব্বনাশ করবো বইলা তেজ কইরা আছে।”
” কার কথা বলো? ”
” কেন জানোস না? আমার মানিক। ঐ আমারে ঘুমাইতে দিতাছে না রে বাপ। খালি জ্বালাতাছে। টাইন্যা ধইরা এইহানে নিয়ে আইছে। ঐ জিনিস চাইতাছে বার বার।”
” বুঝছি। যাও ঘরে যাও এখন। পরে সময় করে ডাক্তার দেখিয়ে আনবো তোমারে। যাও ঘরে যাও।”
আহনাফ হাতের আধাপোড়া সিগারেট নিচে ফেলে পায়ে পিষলো। জরিনার পাশ কেটে সামনে হাঁটছে আবার সে। খালার মাথাটা পুরোপুরি খারাপ হয়েছে ভেবে খারাপই লাগলো আহনাফের। মানিক মরেছে সেই কবে। বয়সে মানিক আহনাফের দুই বছরের ছোটো ছিল। মানিক যখন পানিতে ডুবে মরে তখন আহনাফ ছিল পাঁচ বছরের শিশু। মানিককে নিয়ে কোনো স্মৃতিই তার মনে নেই। বড় হয়ে খালার এমন পাগলামো দেখে দেখেই মানিকের কথা শুনেছে সবার কাছে। উদ্ভট আচরণ করে হঠাৎ হঠাৎই খালা। মাথা চূড়ান্ত খারাপ হলেই বটি নিয়ে তেড়ে আসতো তাদের দিকে। সবাই মিলে হাত পা বেঁধে রাখতো তখন। তারপর একাই আবার স্বাভাবিক হয়ে যেত। ডাক্তার মানসিক হাসপাতালে পাঠাতে বলেছিল। আহনাফরাই গড়িমসি করেছে এ ব্যাপারে। আজ হয়ত আবার তেমন অবস্থা হয়েছে। কথাটা ভাবতেই আহনাফের ভয় ভয় লাগলো। আহনাফের ভয় আরও বেড়ে গেল পেছনে কারো পায়ের আওয়াজ শুনে। আহনাফ ঢোক গিলে দ্রুত পা চালায়। পেছনের পদধ্বনিটিও তেমন দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। হঠাৎ আহনাফ দূর থেকে আসা অস্পষ্ট কারো চিৎকার শুনতে পেল পেছনে৷ সে ধীর গতিতে হেঁটে শুনতে চাইল সেই চিৎকার স্পষ্টভাবে। ক্রমশ পরিষ্কার হলো সেই চিৎকারের গলা। একি! এ যে নীরার গলা। আহনাফ পেছনে ঘুরে দাঁড়ানোর সাথে সাথে প্রবল বেগে উড়ে এসে ধারালো কিছু তার গলায় এসে বিঁধলো। হাঁটু ভেঙে ধপাস হয়ে পড়ল আহনাফের ছিন্ন মস্তকহীন দেহ শুকনো পাতার আবর্জনার উপর।
এ দৃশ্য দেখামাত্র চিৎকার করে অদূরেই জ্ঞান হারালো নীরা। জরিনা উন্মাদিনীর বেশে আহনাফের ছিন্ন ধড়ের ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্ত দু’হাতে নিয়ে উল্লাস করছে। সামনে তাকিয়ে হাসছে আর বলছে,
” ও মানিক খুশি হইছোস তো? এবার আর রাগ হইবি না তো মায়ের উপরে? দ্যাখ,দ্যাখ রইস্যার বংশ নির্বংশ হইছে। জালেমের বংশ নির্বংশ কইরা দিছি। এহন আমার কাছে তুই আয় মানিক। ও মানিক আয় আয়। ”
নীরার চিৎকারে বাড়িতে থাকা আড়তের লোক দুজন ছুটে আসে। এমন লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড দেখে ভীত সন্ত্রস্ত তারা। একজন দ্রুত মোবাইল করে জানালো রইস চৌধুরীকে। আঞ্জুকে ঘুম থেকে উঠানো হলো। আঞ্জু ছুটে এসে সেখানেই বাকরুদ্ধ হয়ে বসে পড়ে সন্তানের নির্মম মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে। তার শরীর পাথুরে মূর্তির মতো নিশ্চল হয়ে আছে শোকে। রইস চৌধুরী ছুটে এসেছে ততোক্ষণে ঘটনাস্থলে। যা ভেবেছিল নীরার সাথে করবে তা যে তার চোখের মনির সাথেই হলো। একি ভাগ্যের পরিহাস। সন্তানের দ্বিখন্ডিত দেহ দেখে গগনবিদারী আর্তচিৎকার করে ওঠে রইস। আহনাফের রক্তে রঞ্জিত জরিনার অট্টহাসি তাকে দিকবিদিকশূন্য করে তোলে। আবজর্নার উপর পড়ে থাকা বটি তুলে নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে কোপাতে থাকে জরিনাকে সে। জরিনা হাসতে হাসতে প্রাণ ত্যাগ করে। রইস তবুও থামে না। ভয়ে ধারের কাছেও ঘেঁষে না কেউ। রইস চৌধুরীর বোধশক্তি বুঝি শূন্যের কোঠায় নেমেছে। না হুশ আছে, না খেয়াল কোনোকিছুর।
ভোরের আলো ফোটার পূর্বেই পাড়া,মহল্লা শোকাচ্ছন্ন আহনাফ এবং জরিনার মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরে। সবাই ছুটে এলো সচক্ষে দেখার অভিপ্রায়ে। চৌধুরী বাড়ির পেছন প্রাঙ্গনে লোকে লোকারণ্য। যা ছিল এতোদিন এই চারদেয়ালে বন্ধি ; সবই দিনের আলোয় উদ্ভাসিত হলো আজ। সত্যিই সত্য চাপা রাখা সহজ নয় বটে।
চলবে,,,