#কোন_কাননের_ফুল_গো_তুমি
#পর্ব_৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________
আগন্তুক কোনো পাখি এসে যেন মন কাননে হঠাৎ করেই বলে গেল,’মিতুল, এখান থেকে চলে যা।’
মিতুল ডাকে সাড়া দিল। রূপককে সম্পূর্ণ এড়িয়ে সে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেল। রূপক একবার ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে মিতুলের চলে যাওয়া দেখল কিন্তু কিছু বলল না।
বাড়ি ফিরে মিতুল পার্স সোফায় রেখে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। মমতা বেগম ভ্রু কুঁচকে শুধালেন,
“ব্যাপার কী?”
মিতুল মিটমিট করে হেসে বলল,
“ব্যাপার আবার কী হবে?”
“এভাবে শুয়ে পড়লি কেন?”
“এমনিই।”
এরপর সে শোয়া থেকে উঠে সোজা হয়ে বসল। মাকে টেনে পাশে বসিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি কোথায় গেছিলাম জানো মা?”
মমতা বেগম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। মিতুল বলল,
“নওশাদ স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম।”
“কেন?” বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন তিনি।
“সে ফোন করেছিল। বলল দেখা করতে। আমাদের ধারণাই ঠিক। সে আমাকে বিয়ে করতে চায়।”
“তুই কী বললি?”
“বলেছি এই সম্পর্ক কখনো হবে না।”
“শুরু থেকে বল।”
মিতুল সোফায় পা তুলে বসে শুরু থেকে শেষ অব্দি সবটা বলল মমতা বেগমকে। সব শুনে তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন,
“যাক! ভালোই করেছিস। এখন যা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। তোর বাবা আর টুটুল ফিরলে সন্ধ্যায় রিনভীদের বাড়িতে যাব।”
“কেন?”
“বিয়ের ডেট ফাইনাল করতে।”
“ঠিকাছে।”
সন্ধ্যায় তৈয়ব রহমান অফিস থেকে ফিরে আগে গ্রামে ফোন করলেন। দাদা এবং চাচাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে বেরিয়ে পড়লেন রিনভীদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ঐ বাড়িতেও আজ লোক সমাগম অনেক বেশি। সবাই বেশ উৎসাহ এবং আগ্রহ নিয়ে টুটুলকে দেখছে। সঙ্গে তারা মিতুলকেও পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল। টুটুলের কেমন লাগছিল জানিনা, তবে সবার এমন চাহনীতে মিতুল বেশ গুটিয়ে যাচ্ছিল। সে তার ভাইয়ের পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসল। আয়ান এসে দখল করল তার পাশের জায়গা। মিতুলের চেয়ে আয়ান বয়সে বড়ো হলে বোধ হয় নির্ঘাত মিতুলকে সে প্রেম নিবেদন করত। নাস্তা-পানি খাওয়া হলে ছেলে-মেয়েদের আলাদা জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো। ড্রয়িংরুমে এখন সব মুরুব্বিরা বসে আছেন। টুটুল আর রিনভীকে কথা বলার জন্য ছাদে পাঠানো হলো। যদিও নতুন করে আর কিছুই বলার নেই। ওদের সঙ্গে মিতুল আর আয়ানও আছে। আসার পর থেকে অনিকের দেখা পাওয়া যায়নি। হয়তো বাড়িতে নেই। থাকলে তো নিশ্চয়ই দেখা হতো।
ছাদে হাঁটাহাঁটি করার সময় অনিক চলে এলো। চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক। মিতুলকে দেখে তার হাসি প্রশস্ত হলো। মিতুলও অনিককে দেখে মৃদু হাসল। অনিক এগিয়ে এসে বলল,
“হাই! কেমন আছো?”
মিতুল মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ভালো। আপনি?”
“আমি তো খুব ভালো আছি।”
“তাই? এত খুশির কারণ?”
“আপুর বিয়ে বলে কথা। খুশি হব না? তুমি খুশি নও তোমার ভাইয়ের বিয়ের জন্য?”
“অনেক বেশিই খুশি।”
“আমিও।”
দুজনেই একসঙ্গে হাসল। অনতিদূরে দাঁড়িয়ে থাকা বোন এবং হবু দুলাভাইকে দেখে অনিক মুচকি হেসে বলল,
“দুজনকে খুব সুন্দর মানিয়েছে তাই না বলো?”
মিতুলও সেদিকে তাকিয়ে বলল,
“ভীষণ!”
তারপর শুধাল,
“আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?”
“একটা জরুরী কাজে বাইরে ছিলাম।”
“ওহ।”
এদিকে অনিক, আয়ান এবং মিতুল গল্প করছিল। আর অন্যদিকে টুটুল এবং রিনভী। বড়োদের কথাবার্তা শেষ হলে নিচে ওদের ডাক পড়ল। তাদের কথা শুনে জানা গেল বিয়ের ডেট ঠিক করা হয়েছে আগামী মাসের ৫ তারিখ শুক্রবার। সবাই একসঙ্গে মিষ্টিমুখ করল। অনিকদের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেল মিতুলদের। রাতে ঐ বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছে বলেই খাওয়া-দাওয়ার ঝামেলা আপাতত নেই। বাড়িতে ফিরে ফ্রেশ হয়ে যে যার মতো করে শুয়ে পড়ে।
.
.
পরেরদিনও মিতুলের ভার্সিটিতে যাওয়া হলো না। মমতা বেগমও জোর করেননি। বাবা বলে দিয়েছেন, একেবারে সুস্থবোধ করলেই যেন ক্লাসে যায়। কিন্তু তাই বলে পড়ায় ফাঁকি দেওয়া যাবে না। ক্লাসের পড়াগুলো বাড়িতে বসেই কমপ্লিট করতে বলেছেন তিনি। মিতুলও তাই সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসেছে। সে চেয়ারে বসলেও তার পা দুটো টেবিলের ওপর রাখা। বই কোলের ওপর রেখে গুনগুন করে পড়ছিল। মমতা বেগম চা আর পরোটা নিয়ে এসে বললেন,
“এগুলো কেমন ধরণের বসা? স্বাভাবিক সভ্য মেয়েদের মতো বসে পড়তে পারিস না?”
মিতুল পড়া থামিয়ে বলল,
“না। আমার এভাবে বসে পড়তেই ভালো লাগে।”
“পা নামা।”
মিতুল পা নামিয়ে বসল। মা খাবার টেবিলের ওপর রেখে আবার চলে গেলেন। সেদিকে একবার তাকিয়ে বই বন্ধ করে বিছানায় রাখল মিতুল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ফের টেবিলের ওপর পা রাখল।
“মিতুল।”
ভরাট পুরুষালি কণ্ঠস্বর শুনে হকচকিয়ে দরজার দিকে তাকাল মিতুল। রূপক দাঁড়িয়ে আছে। তড়িঘড়ি করে টেবিল থেকে পা নামিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে গেল সে। অস্পষ্ট স্বরে বলল,
“আপনি!”
“তোমায় দেখতে আসলাম।”
“কেন? আমি কি চিড়িয়াখানার কোনো প্রাণী নাকি যে আমায় দেখতে আসতে হবে।”
“বলছি। তার আগে কি আমি রুমে আসতে পারি?”
মিতুল মুখের ওপর না করতে পারল না। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“হু।”
রূপক রুমে প্রবেশ করে চেয়ার টেনে বসল। তখনই রুমে এলো সীমান্ত। মিতুলকে দেখে বলল,
“তোমার জ্বর কমেছে আন্টি?”
মিতুল স্মিত হেসে বলল,
“হ্যাঁ।”
“তোমার নাকি বিয়ে?”
মিতুল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রূপকের দিকে তাকাল। রূপক হেসে বলে,
“তোর আন্টি না। আঙ্কেলের বিয়ে।”
এরপর সে মিতুলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“টুটুল ভাইয়ার নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“আন্টি তাই গিয়েছিল আমাদের ফ্ল্যাটে। মা, ভাবি সবাই গল্প করতে এলো। ভাবলাম আমিও এসে একবার তোমার খবর নিয়ে যাই।”
“সাংবাদিক নাকি আপনি যে খবর নেবেন।”
“সব কথার এত ডাবল মিনিং বের করো কেন? সোজা কথাকে কোনোভাবেই সোজাভাবে নিতে পারো না?”
মিতুল দমে গেল। রূপক টেবিল থেকে মিতুলের একটা বই নিয়ে উলটে-পালটে দেখতে দেখতে বলল,
“গতকাল রেস্টুরেন্টে কি একাই গিয়েছিলে?”
“আপনি জেনে কী করবেন?”
“কিছুই না। এমনিই জানতে চেয়েছি।”
“হু, একাই গিয়েছিলাম। তবে অন্য একজনের সাথে দেখা করতে।”
“কার সাথে?”
“স্যারের সাথে।”
মিতুল লুকাল না। সত্যিটাই বলল। রূপক চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলল,
“কী! স্যারের সঙ্গে? স্যারের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে দেখা করতে গেছিলে?”
“হ্যাঁ। তো?”
“ছি, ছি! আমি তোমায় কত ইনোসেন্ট ভাবতাম। স্যারের সাথে নিশ্চয়ই কোনো চক্কর চলছে?”
“বাজে কথা বলবেন না তো! দরকার ছিল তাই দেখা করেছি। দেখা করলেই চক্কর চলে নাকি? আপনার সাথেও তো একটা মেয়ে ছিল। আমি কি কিছু বলেছি?”
“ঐ হ্যালো, ঐ মেয়ে আমার বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড…”
“ছি, ছি! আমি আপনাকে কত ভদ্র ভাবতাম। আর আপনি কিনা! শেষমেশ বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে!”
রূপক বুঝল মিতুল তাকে পিঞ্চ মেরেই কথাটা বলেছে। সে বড়ো শ্বাস নিয়ে বলল,
“আমাকে আগে কথা শেষ করতে দাও। রেস্টুরেন্টের বাইরে একটা ছেলে ফোনে কথা বলছিল। খেয়াল করেছিলে? ওটাই আমার বন্ধু। ওদের নিউ রিলেশন। তাই ট্রিট দিতে আমায় নিয়ে গেছিল।”
মিতুল ভেংচি কেটে বলল,
“কী জানি বাবা! সত্যি-মিথ্যা আপনিই ভালো জানেন।”
“বিশ্বাস না হলে চলো মিট করিয়ে দিচ্ছি।”
“আমার বিশ্বাস অর্জন করে আপনার লাভ কী?”
রূপক কাঁধ নাচিয়ে বলল,
“কোনো লাভ নেই। জাস্ট নিজের দিক থেকে স্বচ্ছ থাকলাম।”
মিতুলের ডাক পড়ল তখন ড্রয়িংরুমে। রূপকের মা টিয়া বেগম ডাকছেন। ডাক শুনেই ছুটে চলে গেল মিতুল। টিয়া বেগমকে সে সাংঘাতিক লেভেলের ভয় পায়। মিতুলের ভাষ্যমতে, হাসি কী জিনিস তা এই মহিলা জানেই না। স্বাভাবিকভাবে কথা বললেও মনে হয় রাজ্যের সমস্ত রাগ কথায় ঢেলে বলতেছে।
মিতুল যথাসম্ভব হেসে বিনয়ীস্বরে বলল,
“আন্টি ভালো আছেন?”
টিয়া বেগম বললেন,
“ভালো আছি। তোমার জ্বর সেরেছে?”
“জি, আন্টি।”
“তাহলে টুম্পার সঙ্গে একটু লাইব্রেরিতে যাও তো। ওর কিছু বই কেনা লাগবে। আমাকে ছাড়া তো কোথাও যায় না। আজ শরীরটা ভালো লাগছে না। ম্যাজম্যাজ করছে কেমন যেন!”
মিতুল প্রথমে টুম্পার দিকে তাকাল। পরে তার নিজের মায়ের দিকে। অনুমতির প্রত্যাশা। মুখের ওপর তো আর কাউকে না বলা যায় না। তাই মমতা বেগম রাজি হয়ে বললেন,
“যা একটু ঘুরেফিরে আয়। কয়েকদিন ধরেই তো রুমে আটকা পড়ে আছিস।”
অনুমতি পেয়ে মিতুল হেসে টুম্পাকে বলল,
“তুমি আমার ঘরে এসে একটু বসো। আমি রেডি হয়ে নিই।”
“আচ্ছা আপু।”
বলে টুম্পা মিতুলের সঙ্গে মিতুলের রুমে গেল। তার আগেই সীমান্ত আর রূপক বেরিয়ে গেছিল। মিতুলের রেডি হতে সময় লাগল না। দশ মিনিটের মধ্যেই ওরা রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাড়ি থেকে বের হয়ে মেইন গেইটের কাছে রূপককে দেখতে পায় ওরা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেও তৈরি হয়ে বের হয়েছে। টুম্পা তাই জিজ্ঞেস করল,
“কোথাও যাচ্ছ নাকি ভাইয়া?”
রূপক চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে শার্টের কাছে গলায় ঝুলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, তোদের সাথে।”
টু্ম্পা বিস্মিত হলো। চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলল,
“গতকাল যে কত কান্নাকাটি করলাম। তখন তো রাজি হওনি। তাহলে এখন কেন যাবে? এখন তো তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই। আমার সাথে এখন মিতুল আপু আছে।”
রূপক কোমরে দু’হাত গুঁজে বিরক্ত হওয়ার ভান ধরে বলল,
“তখন তো আর জানতাম না মা না গিয়ে তোকে একা পাঠাবে।”
“একা কোথায়? মিতুল আপু তো আছে।”
“তো? তুইও মেয়ে। মিতুলও মেয়ে। দুজনেই পিচ্চি-বাচ্চা। আজকাল রাস্তাঘাট, মানুষজন কোনোটাই ভালো না। ভাই হয়েছি, আমার একটা দায়িত্ব আছে না?”
“আসছে আমার দায়িত্ববান ভাই!”
মিতুল টুম্পাকে থামিয়ে বলল,
“লিসেন, আমি কোনো পিচ্চি-বাচ্চা নই। অনার্সে পড়া একটা মেয়ে কখনো বাচ্চা হতে পারে না।”
“বয়স কি মানুষের শরীরে লেখা থাকে নাকি? তোমার হাইট দেখো তো! এইটুকুন সাইজ।”
“আমার ওয়েট অনুযায়ী হাইট একদম পার্ফেক্ট আছে। আমি শর্ট নই। আপনিই বেশি লম্বা। এখন বেশি কথা না বলে ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করেন। রিকশা ডেকে আনেন।”
রূপক আরেকটু ঝগড়া করত। কিন্তু দমে গেল সে। এগিয়ে গিয়ে একটা রিকশা নিয়ে এলো। রূপক বসেছে রিকশার ওপরে। ওর সামনে টুম্পা এবং টুম্পার পাশে বসেছে মিতুল। রূপকের এভাবে রিকশার ওপরে উঠে বসার অভ্যাস নেই অনেক বছর যাবৎ। তবুও সে ভাবসাব নিয়ে বলল,
“পড়ে যেতে পারো। আমাকে ধরে বসো।”
মিতুল কিছু বলল না। কিছুদূর আগাতেই রূপকের ভাব সব ফুটা বেলুনের মতো চুপসে যেতে লাগল। রিকশা যখন ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল রূপক তখন চিৎকার করে ওঠে,
“হায়, হায় পড়ে গেলাম। ঐ মামা থামো, ম’রে গেলাম।”
ওর হম্বিতম্বি ও চিৎকার-চেঁচামেচিতে রিকশাওয়ালা বাধ্য হয়েই রিকশা থামাল। মিতুল এবং টুম্পা একসাথেই জানতে চাইল,
“কী হয়েছে?”
রূপক অস্থির হয়ে টুম্পাকে সরিয়ে বলে,
“আগে সর তুই। আমায় নামতে দে।”
ওরা নামার পর মিতুলও বাধ্য হয়ে নেমে গেল। রূপক রিকশাওয়ালাকে পুরো ভাড়া-ই বুঝিয়ে দিয়ে বলল,
“আপনি চলে যান মামা। আমরা সিএনজি করে যাব।”
মিতুল বিরক্ত হয়ে বলল,
“এটা কী হলো? এই মাঝরাস্তায় আপনি সিএনজি কোথায় পাবেন?”
“এত বড়ো শহরে সিএনজির অভাব হবে না। আমার বসতে অসুবিধা হচ্ছিল দেখলে না?”
“তোমাকে কে বলেছিল আসতে ভাইয়া? আমি আর মিতুল আপু তো পারতাম যেতে।”
“ওরে ঘরশত্রু বিভীষণ! ভাইয়ের দুঃখ না বুঝে উলটো ব্লেইম দিচ্ছিস!”
টুম্পা এবং মিতুল দুজনেই বিরক্ত হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও ফাঁকা সিএনজি পাওয়া গেল না। টুম্পা মেজাজ দেখিয়ে বলল,
“ধুর! এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে হেঁটে যাওয়া ভালো। আমি হাঁটছি। চাইলে তোমরাও আসতে পারো।”
টুম্পা হাঁটা শুরু করার পর মিতুল আগুন গরম দৃষ্টিতে তাকায় রূপকের দিকে। রূপক অসহায়ের মতো মুখ করে বলে,
“টুম্পা একা চলে যাচ্ছে। চলো আমরাও হাঁটি। সামনে একটা না একটা সিএনজি পেয়েই যাব দেখবে।”
রাগে মিতুল কথা বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলেছে। সেও হাঁটা শুরু করে। রূপকও পাশাপাশি হাঁটছে আর টুম্পাকে ডাকছে। টুম্পা ডাক উপেক্ষা করেই নিজের মতো হেঁটে যাচ্ছে। ওকে ডাকতে ডাকতে রূপক কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল। যখন দেখল থামছে না তখন পিছু ফিরে মিতুলকে বলল,
“কী জেদি দেখেছ?”
মিতুল তখনো চুপ করে রইল। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে রূপককে কেমন যেন নার্ভাস দেখাল। সে মিতুলকে বলল,
“তোমার ফোনটা মুখের সামনে ধরো তো।”
“কেন?” ভ্রু কুুঁচকে জানতে চাইল মিতুল।
“আগে ধরো।”
“বলবেন তো কেন?”
“দেখো তো তুমি।”
মিতুল বিরক্ত হয়ে মুখের সামনে ফোন ধরল। কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। কাজলও তো লেপ্টায়নি। লিপস্টিক, চুলের স্টাইল সবই তো ঠিক আছে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সে বিরক্ত হয়ে বলল,
“সব ঠিক আছে। কী দেখব?”
রূপক হতাশ ভঙ্গিতে বলল,
“কিছু না। আসো।”
হাঁটতে হাঁটতেই মিতুল আরেকবার ফোনটা মুখের সামনে ধরল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মুখ দেখতে গিয়ে তার নজর পড়ল কাঁধের দিকে। জামার ভেতর পরা ইনারের ফিতা বের হয়ে আছে। এটা দেখে যতটা না বিস্মিত হয়েছে। তারচেয়েও বেশি তার অস্বস্তি এবং লজ্জা লাগছে। এটা কি রূপকের চোখেই পড়তে হলো? টুম্পার চোখে পড়লে কী হতো! ইশ কী লজ্জাজনক, অপ্রীতিকর ঘটনা! লজ্জার পাশাপাশি রূপকের সেন্সও ভালো লাগল মিতুলের। সেই সঙ্গে মনে মনে সে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করল। যতটা অ’স’ভ্য, বদ, বর্বর এই ছেলেকে সে ভেবেছিল ততটাও নয়।।কিন্তু আর একবারও এরপর সে রূপকের মুখের দিকে তাকায়নি। লজ্জায় একদম স্থবির হয়ে আছে।
ভাগ্য ভালো থাকাতে একটু হাঁটার পরই একটা সিএনজি পেয়ে গেল ওরা। যদিও ভাড়া বাড়তি দিতে হবে তথাপি রূপক রাজি হয়ে গেল। নতুবা দুই রমণীর রোষানলে তো ধং’স হয়ে যাবে। লাইব্রেরিতে বই কেনা শেষ হলে রূপক ওদের রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। মিতুল আসতে চাইছিল না। রূপকের দিকে তাকিয়ে বারণও করতে পারছিল না। টুম্পার জন্যই আসতে হয়েছে। খাবার অর্ডার দিয়ে তিনজনে বসে ছিল। টুম্পা বইগুলো ঘেটেঘুটে দেখছে। মিতুলের মাঝে তখনো জড়তা কাজ করছিল। তার একদম মুখোমুখিই আবার রূপক বসে আছে। কী যে এক যন্ত্রণা! ওর অস্বস্তি, লাজে রাঙা মুখ ও জড়তা লক্ষ্য করেই রূপক মিটমিট করে হাসছিল। মিতুল কী করবে বুঝতে না পেরে ফোনের ক্যামেরা বের করে চোখের কাজল দেখছে। কাজল কিছুটা লেপ্টে গেছে, তাই ওড়না দিয়ে মুছছিল। রূপক আড়দৃষ্টিতে তাকিয়ে গুনগুন করে গান গাওয়া শুরু করে,
“তুঝমে নেশা হে,
তু বিলকুল আফিম হে!”
চলবে…