কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব-০৮

0
757

#কোন_কাননের_ফুল_গো_তুমি
#পর্ব_৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________
“আমি আপনাকে পরে কল করছি।”

বলে ফোনের লাইন কেটে দিল মিতুল। স্মিত হেসে রূপককে বলল,

“আসুন।”

রূপক আর সীমান্ত ভেতরে এলো। সীমান্ত বসেছে বিছানায়। রূপক চেয়ারে। পুরো রুমটায় একবার চোখ বুলিয়ে রূপক বলল,

“টুম্পার কাছে শুনলাম তুমি অসুস্থ।”

“একটু।”

“মুখ দেখে মনে হচ্ছে বেশ ভালোই ভোগ পোহাতে হচ্ছে।”

মিতুল মৃদু হাসল। রূপক বলল,

“মেডিসিন নিচ্ছ ঠিকমতো?”

“হ্যাঁ।”

“সেদিন বৃষ্টিতে না ভিজলে আজ বিছানায় পড়ে থাকতে হতো না।”

জবাব দেওয়ার মতো কোনো উত্তর মিতুলের নিকট নেই। সে চুপ করে রইল। রূপকও বলার মতো আর কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। সে উঠে দাঁড়াল চলে যাওয়ার জন্য। একবারটি মিতুলের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“নিজের খেয়াল রেখো।”

মিতুল মাথা নাড়াল। রূপক আর থাকেনি সেখানে। সীমান্তকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ চলে এসেছে।

এদিকে পরে ফোন করছি বলেও মিতুল আর নওশাদকে ফোন করেনি। ফোনের অপর প্রান্তে চাতক পাখির মতো রাত ১২টা অব্দি অপেক্ষা করে নওশাদ হতাশ হয়ে পড়ে। মিতুল যে কল করবে না বেশ বুঝতে পারে সে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার ভেতর থেকে। এত রাতে ফের কল করাটাও খারাপ দেখায়। তাই নওশাদও আর তাকে কল দিল না। কাল সকালে না হয় কল করা যাবে।
.
.
প্রত্যুষে আজ ঘুম ভাঙার পর মিতুলের কিছুটা সুস্থবোধ লাগছে নিজেকে। মাথা ভার নেই, ঝিমঝিম করছে না। শরীরের তাপমাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। শরীর আগের তুলনায় বেশ হালকাও লাগছে। প্রতিদিন মমতা বেগম এসে তাকে ঘুম থেকে তুলে ফ্রেশ করে দেয়। তারপর খাইয়ে দেয়। আজ তিনি এসে দেখলেন মিতুল আগেই উঠে ফ্রেশ হয়ে চুল বাঁধছে। মেয়েকে এমন সপ্রতিভ দেখে মনে মনে শান্তি পেলেন তিনি। পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন,

“আজ কি শরীরটা একটু ভালো লাগছে?”

“একটু না, মা। অনেকটাই ভালো লাগছে। ঝরঝরে লাগছে বেশ।”

“আলহামদুলিল্লাহ্‌। খাবি আয়।”

“তুমি যাও। আমি আসছি।”

মমতা বেগম চলে যাওয়ার পর মিতুল চুল বেঁধে খেতে আসল। অনেকদিন পর মা-মেয়েতে মিলে বেশ আনন্দের সাথে গল্প-গুজব করতে করতে খাচ্ছে। মিতুল খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল,

“ভাইয়ার বিয়ের ব্যাপারে কথা কতটুকু এগুলো মা?”

“দুই পরিবারই রাজি।”

“ভাইয়া আর রিনভী আপু?”

“টুটুল তো আগে বিয়ে করবে না বলত। এখন দেখছি আল্লাহ্ সুবুদ্ধি দিয়েছে। টুটুলও রাজি, রিনভীও রাজি। এখন শুধু দুই পরিবার বসে বিয়ের ডেট ফাইনাল করব।”

মিতুল খুশিতে উল্লাসিত হয়ে বলল,

“ইয়ে! আমার যে কী খুশি, খুশি লাগছে মা।”

“টুটুলের বিয়েটা হয়ে গেলে তোরও বিয়ে দেবো।”

“ইশ! আমি এত জলদি বিয়ে করব না।”

তিনি চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন,

“এত জলদি কোথায় দেখছিস? তোর বান্ধবীরা বিয়ে-শাদী করে বাচ্চার মা হয়ে বসে আছে।”

“তো তখন কেন বিয়ে দাওনি? আমারও তাহলে কয়েকটা টাকুর-টুকুর থাকত।”

“টাকুর-টুকুর কী আবার?”

মিতুল হেসে বলল,

“বাচ্চা-কাচ্চা।”

“ফাজিল!”

মিতুলের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। নওশাদ গতকাল রাতে ফোন করেছিল মনে পড়ে যায় তার। সে তার মাকে বলল,

“মা, নওশাদ স্যার ফোন করেছিল।”

তিনি অবাক হলেন না। একই কলেজে যখন আছে তখন দেখা-সাক্ষাৎ হবে, কথা হবে স্বাভাবিক। কিন্তু নওশাদ যে কী চায় সেটা তিনি জানেন না। মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,

“কবে?”

“গতকাল রাতে।”

“কী বলল?”

“এমনিই খোঁজ-খবর নিচ্ছিল। মা, আমার কী মনে হয় জানো?”

“কী?”

“তিনি আমাকে পছন্দ করেন।”

“জানি।”

মিতুল অবাক হয়ে বলল,

“তুমি কীভাবে জানো?”

“নওশাদ গ্রামে অনেকের কাছেই অনেকবার তোর খোঁজ করেছে। সেসব কথা তোর দাদা, চাচারাও শুনেছে। কথা কি আর গোপন থাকে? তার মধ্যে আবার গ্রাম! যা না হয় তারচেয়ে বেশি রটে। তোর চাচারা তো ভীষণ রেগে গেছিল এসব শুনে।”

“আমি তো এসব কিছু জানতাম না।”

“তোকে জানানো হয়নি তাই জানিস না।”

এক সেকেন্ড চুপ থেকে তিনি ফের বললেন,

“মিতুল, তুই কি নওশাদকে এখনো ভালোবাসিস?”

মিতুল প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

“না, মা। তার প্রতি আমার কোনো অনুভূতিই নেই এখন আর। সত্যিই হয়তো তখন আবেগের বশে ওরকম পাগলামি করে ফেলেছিলাম।”

“তোর বাবা কিন্তু জেনে-বুঝেই তোকে এই ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়েছে। টাকার দিকে তাকায়নি। প্রাইভেট ভার্সিটিতে অনেক খরচ জেনেও তোকে এখানে দিয়েছে নওশাদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করিস না কখনো। এক ভুল যেন দ্বিতীয়বার আর রিপিট না হয়।”

“হবে না, মা। যার প্রতি কোনো অনুভূতিই নেই তার সাথে আর ভুল হবে কীভাবে? বাবাকে দেখিয়ে দেবো, আগের মিতুল এখন আর নেই। মিতুল অনেক বদলে গেছে।”

“নওশাদ তোকে সরাসরি কিছু বলেছে?”

“না। কিন্তু তার ভাবে তো বোঝা যায়।”

“তোকে যদি সরাসরি কখনো ভালোবাসার কথা বলে তাহলে সময় না নিয়েই ‘না’ বলে দিবি। নওশাদের সাথে তোর সম্পর্ক কিন্তু কেউ মেনে নেবে না মা।”

“তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ মা। আমায় তুমি বিশ্বাস করো। তোমার থেকে কি কখনো কিছু লুকাই আমি? এবারও কিছু লুকাচ্ছি না।”

মমতা বেগম তৃপ্তির হাসি হাসলেন। ছেলে-মেয়ের ওপর তার অগাধ আস্থা এবং ভরসা আছে। হ্যাঁ, বয়সের দোষে আবেগের বশীভূত হয়ে অল্প বয়সে মিতুল একটা ভুল করে ফেলেছিল এটা সত্য। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মিতুল নিজেকে সামলেও নিয়েছে। এরপর সে একাধিক প্রপোজাল পেলেও রিলেশনমুখী আর হয়নি।

মিতুল খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে চলে গেল। বিছানায় শুয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখতে পেল ১০+ মিসডকল। গতকাল নওশাদ যেই নাম্বার থেকে কল করেছিল, সেই নাম্বার থেকেই এতগুলো মিসডকল এসেছে। সে কল ব্যাক করবে কি করবে না দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকাকালীন সময়ে নওশাদ নিজেই আবার ফোন করল। মিতুল রিসিভ করে সালাম দিল আগে। নওশাদ সালামের উত্তর নিয়ে বলল,

“এতবার ফোন দিলাম। কোথায় ছিলে?”

“খাচ্ছিলাম।”

“ওহ। কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো আছি।”

কেউ আর কিছু বলল না। দু’পাশেই নিরবতা বিরাজমান। মিতুল ভাবছে নওশাদের সাথে সরাসরি এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে কিনা। সেধে এসব কথা তোলাটাও তো কেমন জানি লাগে! নওশাদ তখন নিজে থেকেই বলল,

“মিতুল, দেখা করতে পারবে?”

“কেন?”

“তোমাকে কিছু কথা বলার আছে। এছাড়া অনেকদিন হলো দেখি না তোমাকে।”

নওশাদের কথা রাখতে নয় বরং মিতুল চাচ্ছে ঘটনা বেশিদূর আগানোর আগেই শেষ করতে। আর এজন্যই খোলামেলা কথা বলা প্রয়োজন। ফোনে বলার চেয়ে মুখোমুখি বসে কথা বলাটাই মিতুলের নিকট যুক্তিসংগত মনে হলো। তাই সে রাজি হয়ে বলল,

“ঠিক আছে। আমি রেস্টুরেন্টের নাম ম্যাসেজ করে দিচ্ছি। কখন দেখা করবেন?”

“আমরা একসাথে লাঞ্চ করতে পারি?”

মিতুল কয়েক সেকেন্ড মৌন থেকে বলল,

“ওকে। তাহলে দুপুর সাড়ে বারোটায় চলে আসবেন।”

“থ্যাঙ্কিউ মিতুল।”

“রাখছি।”

বলে মিতুল ফোন কেটে দিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল ১০টা বাজে। এখনো হাতে অনেক সময় আছে। এই সময়টুকুতে কী করা যায়? ছাদে যাবে? না থাক! একটা মুভি দেখা যাক। সে ল্যাপটপ নিয়ে বসল। ইউটিউবে সার্চ দিয়ে ‘Love Mocktail’ মুভিটা দেখা শুরু করে।

১২টা যখন বাজল তখন ল্যাপটপ বন্ধ করে গোসল করতে চলে যায়। রেডি হয়ে বের হওয়ার সময় মমতা বেগম জিজ্ঞেস করেন,

“কোথায় যাচ্ছিস?”

“একটু বাইরে যাচ্ছি মা। ঘরে থেকে বোর হয়ে যাচ্ছি।”

“সুস্থ হতে না হতেই বাইরে যাওয়া শুরু করেছিস। কার সাথে দেখা করবি?”

মিতুল আমতা-আমতা করে বলল,

“কারও সাথে না তো! এমনিই একটু ঘুরব।”

“তুই আমাকে পেটে ধরেছিস নাকি আমি তোকে পেটে ধরেছি?”

“মা! সেই পুরনো ডায়ালগ।”

“যাচ্ছিস যা। দেরি যেন না হয়।”

“ঠিকাছে। আমি যাব আর আসব।”

“সাবধানে গাড়ি দেখে রাস্তা পার হবি।”

“ঠিকাছে মা। তুমি এত চিন্তা কোরো না তো।”

মিতু্ল জুতা পায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রেস্টুরেন্টে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় একটা বেজে যায় তার। নওশাদ আগে থেকেই বসে ছিল। মিতুলকে দেখে একগাল হেসে হাত দিয়ে ইশারা করল। মিতুল হাসল না। রোবটের মতো গিয়ে নওশাদের মুখোমুখি বসল। নওশাদ মিতুলকে খেয়াল করে বুঝল, মিতুল মাত্রই গোসল করে এসেছে। ভেজা চুল থেকে পানি পড়ছে। সাজগোজ বলতে ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক শুধু। কী স্নিগ্ধ আর পবিত্র লাগছে দেখতে! নওশাদ মেন্যু কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলল,

“কী খাবে বলো?”

“যা ইচ্ছে অর্ডার দিন।” শান্তকণঠে বলল মিতুল।

নওশাদ ফ্রাইড রাইস, চিকেন, সালাদ আর কোক অর্ডার করল। লাঞ্চের পূর্বে সে দুটো জুসও দিতে বলল ওয়েটারকে। মিতুল রেস্টুরেন্টে এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছে। কেমন যেন নার্ভাস লাগছে। স্বাভাবিক হতে পারছে না। ওর অস্বস্তি বুঝতে পেরেই হয়তো নওশাদ শুধাল,

“ক্লাস করবে কবে থেকে?”

মিতুল নওশাদের দিকে তাকাল না। নখ দিয়ে টেবিল খুঁটতে খুঁটতে বলল,

“দেখি কাল যেতে পারি।”

“বাসার সবাই ভালো আছে?”

“হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ্‌। আপনার?”

“আলহামদুলিল্লাহ্‌। আমারও বাড়ির সবাই ভালো আছে।”

ওয়েটার এসে জুস দিয়ে গেল। নওশাদ গ্লাসটি মিতুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“খাও।”

মিতুল স্ট্র নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। কোনোভাবেই সহজ হতে পারছে না। নওশাদ বুঝতে পেরে বলল,

“কী হয়েছে মিতুল? তুমি কি নার্ভাস?”

মিতুল ঈষৎ হেসে বলল,

“না, স্যার। ঠিক আছি আমি।”

এরপর বলল,

“ম্যাম কেমন আছে?”

নওশাদ যারপরনাই অবাক হয়ে বলল,

“কোন ম্যাম?”

“আপনার ওয়াইফ।”

নওশাদ হেসে বলল,

“এখনো তো বিয়েই করলাম না। ম্যাম আসবে কোত্থেকে?”

“ওহ।”

“তুমি কিন্তু গতকাল বলোনি সেদিন ক্যাফে সাথে কে ছিল তোমার?”

“পরিচিত। আপনি চিনবেন না।”

“ওহ। আমি ভেবেছি অন্যকিছু।”

“অন্যকিছু? আমিও অবশ্য এমনটাই ভেবেছিলাম।”

“কেমন?”

“ক্যাফে সেদিন আপনার সঙ্গেও তো একটা মেয়ে ছিল তাই না? আমি তাকে ম্যাম ভেবেছিলাম। মানে আপনার ওয়াইফ।”

“না, না তেমন কিছু নয়। অনিকও কি তোমার পরিচিত?”

“হ্যাঁ। তার বোনের সাথে আমার ভাইয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছে।”

“টুটুল ভাইয়া এখনো বিয়ে করেনি?”

“বউ থাকলে কি আরেকটা বিয়ের জন্য মেয়ে দেখত?”

নওশাদ কিছুটা লজ্জা পেল। সে তো ভুলেই গেছিল তার সামনে বসে থাকা মেয়েটি এখন আর ছোট্ট মিতুল নেই। কথার প্যাচ ধরতে শিখে গেছে। অনেক কথার কঠিন কঠিন জবাবও দিতে পারে এখন এই মিতুল। নওশাদকে নিশ্চুপ দেখে মিতুল শুধাল,

“সেই মেয়েটা কে তাহলে স্যার?”

নওশাদ ভাবুক চিত্তে চেয়ে আছে। মিতুলের থেকে কিছু না লুকানোই বোধ হয় ভালো হবে। সে প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে বলল,

“ওর নাম চৈতি। বিয়ের জন্য বাড়িতে মেয়ে দেখছে। বাবা-মায়ের ওকে খুব পছন্দও হয়েছে।”

“আসলেই কিন্তু আপনাদের দারুণ মানিয়েছে। বিয়েটা জলদি করে ফেলুন।”

ওয়েটার এসে এবার লাঞ্চ দিয়ে গেল। মিতুল এখন বেশ স্বাভাবিক। কথার সুর ও প্রসঙ্গ খুঁজে পেয়েছে। সে খেতে খেতে বলল,

“বিয়ে কবে করছেন?”

নওশাদ যুতসই কোনো জবাব খুঁজে পেল না। সে তো চৈতিকে বিয়ে করতে চায় না এটা মিতুলকে বলবে কী করে?

“কী হলো স্যার?”

ভাবনায় ছেদ পড়ল নওশাদের। স্মিত হেসে বলল,

“কিছু না। খাওয়া শেষ করি আগে।”

“খাওয়ার সময় কি কথা বলা যায় না?”

“যায়।”

“তাহলে?”

“আচ্ছা বলো কী জানতে চাও।”

“আমি কী জানতে চাইব? আপনিই তো বললেন, আমাকে নাকি কী বলবেন।”

নওশাদ ইতস্তত করে বলল,

“হ্যাঁ।”

“তাহলে বলুন।”

“খাওয়াটা শেষ করি?”

মিতুল আর জেদ না করে বলল,

“আচ্ছা।”

এরপর দুজনে আর কোনো কথা বলল না। খাওয়ার মাঝে নওশাদ মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। মিতুল অর্ধেক খাবার খেয়ে আর খেল না। পানি খেয়ে চুপ করে বসে রইল সে। নওশাদের খাওয়া শেষ হলে ওয়েটার এসে প্লেটগুলো নিয়ে গেল। মিতুল নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে বলল,

“এবার বলুন।”

নওশাদ টিস্যুতে মুখ মুছতে মুছতে বলল,

“তুমি কি এখনো আমাকে ঘৃণা করো মিতুল?”

মিতুলের যেন উত্তর রেডিই ছিল এমনভাবে বলল,

“এর সঠিক কোনো উত্তর আসলে আমার কাছে নেই।”

“কিন্তু আমি উত্তরটা জানতে চাই।”

“দেখুন স্যার, সেই ঘটনার পরে সময়ের কালক্রমে আমি আপনাকে ভুলেই গেছিলাম। কলেজে যদি না দেখতাম তাহলে হয়তো ফের মনেও পড়ত না। তাহলে যাকে মনেই ছিল না, তার প্রতি ঘৃণা থাকবে কী করে?”

“তাহলে রাগ, জেদ, ক্ষোভ?”

“এসবও আছে কিনা জানিনা। কিন্তু পুরনো স্মৃতি টেনে আনলে বলতে হবে সেই আঘাত হয়তো ভুলতে পারব না। আপনি আপনার জায়গায় হয়তো ঠিকই ছিলেন। কিন্তু সেদিন সবার সামনে আমাকে দেওয়া আপনার থা’প্প’ড় জাস্ট এই আঘাতটাই বোধ হয় সারাজীবন ভু্লতে পারব না।”

“আমিও পরে নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছি মিতুল। সেদিন রাগের বশে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। কিন্তু যতদিনে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছিল। অনেকবার খোঁজ করেও তুমি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারিনি। অতীতের সেই ঘটনার জন্য আমি অনুতপ্ত মিতুল। তোমার গায়ে হাত তোলা আমার উচিত হয়নি। আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না?”

“এখানে ক্ষমার কোনো প্রসঙ্গই আসছে না। আপনি আমার রিলেটিভ না, আমিও আপনার রিলেটিভ না। আবার এমনও নয় যে আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক হবে যার জের ধরে আপনি ক্ষমা চাইছেন।”

“কোনো সম্পর্কই কি হতে পারে না?”

মিতুল নির্লিপ্তি কণ্ঠে বলল,

“জি না, স্যার।”

“যদি বলি বিয়ে করতে চাই?”

“বলতেই পারেন। বিয়েও করতে পারেন। তবে সেটা আমাকে নয়।”

“কেন নয় মিতুল? তুমি না আমাকে ভালোবাসতে? কত পাগলামি করেছ!”

“আপনি বারবার পুরনো কথা কেন টানছেন? তখন আর এখন সময়টা কি এক? অনেক কিছু বদলে গেছে। আমিও বদলে গেছি। এখন আর আপনার প্রতি আমার ভালোলাগা, দরদ, টান, ভালোবাসা কোনো কিছুই নেই।”

“কেন? তুমি কি অন্য কাউকে ভালোবাসো?”

“না।”

“তাহলে সমস্যা কোথায় মিতুল? প্রয়োজনে আমি তোমার বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইব।”

“সেসবের দরকার নেই স্যার। আপনি কেন শুধু শুধু নিজের ইমেজ নষ্ট করবেন? এমন তো নয় যে, আমি আপনাকে এখনো ভালোবাসি। তাই আপনি এটা করবেন না প্লিজ!”

“মিতুল জেদ থেকে এসব বলছ তাই না?”

“না, স্যার। দেখুন, এখন আর কোনো কিছুই ঠিক হওয়ার নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে যায়। আমার বেলাতেও তা-ই হয়েছে। আগের আমি এখনকার আমি এক নই। সত্যিই তখন আবেগের মধ্যে ছিলাম। তাছাড়া তখন যেই আঘাতটা আমি পেয়েছি সেটা কখনোই ভুলতে পারব না। তারচেয়েও বড়ো কথা, আমার পরিবার কোনোদিনই এই সম্পর্ক মেনে নেবে না এবং আমি নিজেও আপনার সঙ্গে কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাই না। তাই ভালো হয়, আপনি আমার আশা ছেড়ে দিন। আপনার বাবা-মা যাকে পছন্দ করেছে তাকেই বিয়ে করে নিন। বিয়ে একটা পবিত্র সম্পর্ক। ভালোবাসা ঠিক হয়ে যাবে।”

ওয়েটার বিল নিয়ে এলো। মিতুল বিল দেখে পার্স থেকে টাকা বের করতে করতে বলল,

“বিলটা আমি দিয়ে দিচ্ছি। আপনার নতুন জীবনের শুরুর ট্রিট আমার পক্ষ থেকে।”

নওশাদ বিল কার্ড নিয়ে মিতুলের টাকা টেবিলের ওপর রেখে দিল। এরপর নিজের ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে বিল মিটিয়ে দিল। মিতুলের টাকাগুলো ফেরত দিয়ে বলল,

“লাঞ্চের ইনভাইট আমি করেছিলাম। কাজেই বিল দেওয়াটাও আমার দায়িত্ব।”

মিতুল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,

“বেশ! নেক্সট টাইম তাহলে চৈতি ম্যামকে সাথে নিয়ে আসবেন। সেদিনের বিলটা কিন্তু আমার।”

নওশাদ নড়েচড়ে বসে অস্থির হয়ে বলল,

“সিরিয়াস হও প্লিজ! মজা কোরো না। কোনোভাবেই কি সম্ভব নয়?”

“কী? আমাদের সম্পর্ক? না। কোনোভাবেই সম্ভব নয়।”

“একটাবার ভেবে দেখো। এখনই কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তুমি সময় নাও।”

“আমার সময় লাগবে না। আমি ভেবে-চিন্তেই যা বলার বলেছি।”

এরপর সে ঘড়িতে সময় দেখে বলল,

“এখন উঠতে হবে। দেরি হলে মা চিন্তা করবে আবার।”

নওশাদ করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডাকল,

“মিতুল!”

মিতুল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নওশাদের করুণ দৃষ্টি, বিষাদিত কণ্ঠস্বর সমস্তকিছুকে অগ্রাহ্য করে মৃদু হেসে বলল,

“সময় থাকতেই চৈতি ম্যামকে বিয়ে করে নিন। পূণরায় যেন আর ভুলের জন্য আফসোস না করতে হয় খেয়াল রাখবেন। শুভকামনা রইল আপনাদের জন্য। আসছি স্যার।”

নওশাদের আর বলার কিছু নেই। কী-ই বা বলবে? স্পষ্টভাষী মিতুল তো যা বলার তা স্পষ্টভাবেই বলে গেল।

মিতুল আর পিছু ফিরেও তাকায়নি। সরাসরি কথা বলার পর মনে হচ্ছে মনের ওপর থেকে একটা ভার নেমে গেছে। নওশাদ স্যার যেমনই হোক, তার আত্মসম্মানবোধ প্রচুর। ছোটোবেলায় তো মিতুল এমনটাই দেখে এসেছে। আত্মসম্মানের জের ধরেই তো তিনি রাগ কন্ট্রোল করতে পারেননি সেদিন। সম্মানে আঘাত তিনি মানতে পারেনি বলেই তো তিনি মিতুলের গায়ে হাত তুলেছেন। সেদিন যার এত আত্মসম্মান ছিল, আজও নিশ্চয়ই আছে। মিতুল সরাসরি ‘না’ করার পর আশা করা যায় নওশাদ স্যারও আর মনে কোনো আশা রাখবে না। মিতুলও এটাই চায়। সে কোনো পিছুটানে নেই এখন আর। তাই সেও চায় নওশাদও তার পিছুটানে না থাকুক। এসব ভাবতে ভাবতে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার পথে গেইটের সামনে রূপকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় মিতুলের। রূপকের সঙ্গে একটা মেয়েও রয়েছে। মিতুল এবং রূপক দুজন দুজনকে দেখে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে।

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে