কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব-১৯

0
801

#কোন_কাননের_ফুল_গো_তুমি
#পর্ব_১৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________
রূপকের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ বাড়িতে। বিষয়টা এমন নয় যে তাকে খেতে দেওয়া হয় না। ছেলের সব জন্য সব ধরণের পছন্দের খাবারই রান্না করেন টিয়া বেগম। কিন্তু তার অভিমানী ছেলে সেই খাবার মুখে তোলে না। এর কারণও আছে। যতদিন না তার আর মিতুলের সম্পর্ক মেনে নেবে সবাই, ততদিন সে এই বাড়িতে কিছুই খাবে না। একমাত্র ভাতিজা আর ছোটো বোন টুম্পা ছাড়া বাড়ির কারও সঙ্গে সে বিশেষ কথাও বলে না। এই জিনিসটা আর কার কাছে কেমন লাগে জানা নেই। তবে টিয়া বেগমকে ভীষণ পীড়া দেয়। তিনি মন উদাস করে বসে থাকেন। তার এই উদাসীনতা রমিজ উদ্দিনের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। তবুও তিনি নিশ্চুপ এবং নির্বাক।

ছাদ থেকে আনা কাপড়গুলো বিছানার ওপর রেখে টিয়া বেগম স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“এভাবে আর কতদিন?”

রমিজ উদ্দিন খাটের সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে বই পড়ছিলেন। স্ত্রীর প্রশ্ন শুনে মুখপানে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“কী আর কতদিন?”

“রূপক বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।”

“আমি কী করতে পারি?”

“তুমি কী করতে পারো মানে? ছেলের প্রতি তোমার কোনো দায়িত্ব নেই?”

“থাকবে না কেন?”

“তাহলে কিছু করছ না কেন?”

“আমি কী করব বলতে পারো?”

“সব কেন আমাকে বলে দিতে হবে? তুমি তোমার ভাইয়ের সাথে কথা বলো। তাকে জানাও সব। তারা তো আর কেউই বাচ্চা কিংবা অবুঝ নয়। বিয়ে তো জোর করেও করার মতো কোনো বিষয় না।”

রমিজ উদ্দিন চুপ করে রইলেন। কোনো জবাব দিলেন না তিনি।
.
.
মিতুল আর শিহাব মুখোমুখি বসে আছে একটা রেস্টুরেন্টে। শিহাবকে ভীষণ হাসি-খুশি দেখাচ্ছে। খুশি থাকারই কথা। যেই মেয়েটাকে এত পছন্দ করে সে, যার সাথে কিছুদিন বাদেই বিয়ে হবে তাকে সামনে থেকে দেখার সুযোগ পেলে খুশি হওয়াটা তো অস্বাভাবিক নয়। মিতুলের ভীষণ খারাপ লাগছিল সেই সাথে নার্ভাসও লাগছিল। কীভাবে সে শিহাবকে সবটা বলবে? শিহাব বুঝবে তো মিতুলের এহেন পরিস্থিতিটা?

আসার পর থেকেই দুজনে চুপ করে বসে আছে। খাবার অর্ডার করার সময় মিতুল শুধু নিজের জন্য একটা কোল্ড ড্রিংকস অর্ডার করলেও শিহাব বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিকেনসহ আরও বিভিন্ন আইটেমের খাবার অর্ডার করেছে। মিতুল বাধা দেয়নি আবার সায়ও দেয়নি। আসার পর থেকে যেমন নিরব ছিল তেমনই আছে।

নিরবতা কাটিয়ে শিহাবই বলল,

“কিছু বলছেন না যে?”

মিতুল হাসার চেষ্টা করল। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে বলল,

“আসলে কীভাবে বলব, কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। তাই চুপ করে আছি।”

“এত ফর্মালিটি করার প্রয়োজন নেই। বন্ধু ভেবে বলে ফেলুন। আমি কিছু মনে করব না।”

মিতুল তাও কিছু বলতে পারল না। শিহাব বলল,

“বাড়িতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?”

“না, না। তেমন কোনো বিষয় নয়।”

“তাহলে কি আপনি বিয়ের জন্য আরও সময় চাচ্ছেন কিংবা অনার্স শেষ করে বিয়ে করতে চাচ্ছেন?”

মিতুল দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

“নাহ্! আচ্ছা আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?”

শিহাব সময় নিল না। কোনো রকম ভনিতা করা ছাড়াই বলল,

“এত অল্প সময়ে ভালোবাসা হয় কিনা আমার জানা নেই। আপনার প্রতি আমার যেই অনুভূতি আছে সেটাকে আপনি ভালো লাগা বলবেন নাকি ভালোবাসা বলবেন আমি জানিনা। তবে আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। যতটা ভালো লাগলে বিয়ে করতে ইচ্ছে হয় কারও।”

মিতুল আহতস্বরে বলল,

“কিন্তু আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।”

শিহাব বজ্রাহত দৃষ্টিতে তাকাল। সেই সময়ে ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য কোনো কথাই বলতে পারল না শিহাব। মিতুল নিজেই বলল,

“আপনার আমাকে ভালো লাগে। হয়তো ভালোওবাসেন। কিন্তু আমার দিক থেকে এমন কিছু নেই আপনার প্রতি। হ্যাঁ, একজন ভালো মানুষ হিসেবে আপনাকে আমার ভালো লাগে। তবে বিয়ে সংসার করার মতোন ভালো লাগা নয় সেটা। অন্যদিকে আমি যাকে ভালোবাসি, সেও আমাকে ভালোবাসে। হুট করেই সবকিছু হয়ে গেল যে আমি কিছু বলারও সুযোগ পাইনি। আপনি শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, বিবেকবান মানুষ। আপনাকে আশা করি আমাকে সব বুঝিয়ে দিতে হবে না।”

শিহাব হাসল। সেই হাসিতে বোধ হয় কিছুটা কষ্টও মিশে ছিল। তবে মিতুলকে সেটা বুঝতে না দিয়ে বলল,

“এই সহজ কথাটা বলতে আপনি এত সময় নিচ্ছিলেন?”

“আপনি প্লিজ আমাকে, আমার পরিবারকে ভুল বুঝবেন না।”

“এভাবে বলবেন না। আমি কাউকেই ভুল বুঝিনি। বরং আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আপনি যদি আরও পরে কিংবা বিয়ের পরে এসব বলতেন তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে যেত। সংসারে অশান্তি হতো। না আপনি ভালো থাকতেন, আর না আমি ভালো থাকতাম। তাছাড়া ভালোলাগাটাও তো এক তরফাই ছিল। ভালো হয়েছে আপনি আগেই সব বলে দিয়েছেন। আমি বাড়িতে বলে ম্যানেজ করে নেব।”

“আমি হয়তো আপনাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক কষ্ট দিয়ে ফেললাম। আসলে আমার কিছু করার…”

শিহাব মিতুলকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“আপনি যদি এভাবে বারবার নিজেকে ছোটো মনে করেন তাহলে আমার ভীষণ খারাপ লাগবে। তাই প্লিজ অনুরোধ করছি, নিজেকে ছোটো ভাববেন না। আপনি আপনার জায়গায় সঠিক। আমিও মন থেকেই চাই, আপনি আপনার ভালোবাসার মানুষটার সাথেই ভালো থাকুন। তবে হ্যাঁ, বিয়েতে কিন্তু দাওয়াত দিতে হবে। আর আমাকে দুইটা রোস্ট দিতে হবে। রাজি তো?”

মিতুল এবার হেসে ফেলল। শিহাবও হেসে বলল,

“অনেক সিরিয়াস কথাবার্তা হয়েছে। এবার প্লিজ অল্প হলেও খান। তাহলে আমি খুব খুশি হবো।”

মিতুল অবাক হয়ে শিহাবকে দেখছে। সে ভাবেনি সবকিছু এত সহজেই মিটে যাবে। শিহাবের প্রতি মন থেকেই সে কৃতজ্ঞ। পৃথিবীতে এখনো অনেক ভালো মানুষ আছে, যারা অন্যের জন্য নিজের খুশিও বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। এইতো শিহাবই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।

শিহাবের কথা রাখতেই মিতুল অল্প কিছু খাবার খেল। বিল পে করে যাওয়ার সময় মিতুলকে রিকশা ঠিক করে দিয়ে শিহাব বলল,

“আমি কি আপনাকে পৌঁছে দেবো?”

মিতুল বলল,

“না, না আমি যেতে পারব।”

“শিওর? প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে কিন্তু।”

“সমস্যা নেই। এখান থেকে আমার বাসা তো কাছেই।”

“ঠিক আছে। সাবধানে যাবেন।”

মিতুল রিকশায় উঠে বসল। শিহাব তখন ডাকল,

“মিতুল, শুনুন।”

“জি?”

“আপনার বিয়েতে প্লিজ আমাকে দাওয়াত দেবেন না। ভালো থাকবেন।”

মিতুল বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না এবং সুযোগও পেল না। শিহাব রিকশাওয়ালাকে বলল,

“যান মামা।”

অজান্তেই মিতুলের ভেতর থেকে কেমন যেন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
বাড়ির সামনে গিয়ে দেখল রূপক দাঁড়িয়ে আছে। মিতুলকে দেখেই এগিয়ে এসে বলল,

“কী ব্যাপার এই সময়ে কোথায় গেছিলে তুমি?”

মিতুল উত্তর দেওয়ার পূর্বেই রূপক ফের প্রশ্ন করল,

“তোমায় কতগুলো ফোন করেছি। রিসিভ করোনি কেন?”

“ওহহো! ফোন তো সাইলেন্ট করা।”

“মানুষকে দুশ্চিন্তায় মে’রে ফেলবে নাকি তুমি?”

মিতুল ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখল রূপক ছাড়াও তার বাবা, ভাই, ভাবি অনেকবার কল করেছিল।

মিতুল এবার কিছু বলার আগেই রূপক বলল,

“যাও ভেতরে যাও।”

আর কথা বাড়াল না মিতুল। কিন্তু ভেতরে গিয়ে সে আরও বেশি চমকে গেল। রমিজ উদ্দিন, টিয়া বেগম, রূপকের ভাই-ভাবি, টুম্পা, ভাতিজা সবাই তাদের ফ্ল্যাটে। বাকি সদস্যরাও ভীষণ ব্যস্ত। আরও বেশি অবাক হয়েছে সে অনিক, আয়ান, আর্শি, রায়া ওদেরকে দেখে। এই সময়ে ওরা এখানে কেন? মিতুল আসতেই সবাই ওকে ঘিরে ধরল। ঘটনা কী এখনো সে বুঝতে পারছে না।

টুম্পা বলল,

“আরে ভাবি, তোমার এখন আসার সময় হলো? কখন থেকে অপেক্ষা করছি আমরা।”

মিতুল চমকে তাকায়। সবার সামনে টুম্পা তাকে ভাবি বলে ডাকল! রিনভী কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

“এখনই এত চমকালে কি হবে? আরও অনেক বেশি চমক বাকি আছে তোমার জন্য।”

“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ভাবি।”

“বুঝবে। আরেকটু সময় যাক।”

এরপর সে রায়া, আর্শি আর টুম্পাকে বলল মিতুলকে রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাড়িতে বিয়ের আমেজ চলে এসেছে। দুই পরিবারই রূপক এবং মিতুলের সম্পর্কটাকে মেনে নিয়েছে। একদম দুই পরিবারকে নিয়েই এখন শুধু বিয়েটা হবে। রূপকের ফাইনাল এক্সাম বাকি। তাকে আবারও চীনে ফিরে যেতে হবে। সে ফিরে আসলেই ধুমধাম করে বিয়েটা হবে। প্রথমে সবাই চাইছিল শুধু আকদ করে রাখতে। কিন্তু রূপক এভাবে মিতুলকে রেখে যেতে ভয় পাচ্ছিল। তাই শুধু দুই পরিবারের উপস্থিতিতে বিয়ে হবে এখন। এসব শুনে মিতুলের চোখে পানি চলে আসে। রূপকের চাচা, কাজিন তারাও সব শুনে মেনে নিয়েছে। উন্নত দেশে যাদের বসবাস তাদের এমন বুঝদার হওয়াটাই তো মানায়।

বাড়ির ছেলেরা চলে গেছে হালকা কিছু কেনাকাটা করতে। হোক না বিয়েটা ঘরোয়া পরিবেশে তাই বলে বউ সাজবে না তা কি হয় নাকি? রূপক তার পছন্দমতো মিতুলের জন্য বিয়ের বেনারসী কিনেছে। গয়না কিনেছে ভাবিকে সাথে নিয়ে।
কেনাকাটা শেষে একদম কাজী নিয়েই বাড়িতে ফিরেছে সবাই। টুটুল বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করেছিল। সেগুলো সে আর অনিক মিলে নিয়ে এসেছে। এত রাতে তো আর রান্না-বান্না করা সম্ভব নয়। সবাই এখন মহা ব্যস্ত।

মিতুলের দুই হাতে মেহেদি দিয়ে দিচ্ছিল রায়া এবং আর্শি। টুম্পা, ওর ভাতিজা আর আয়ান পাশে বসে আছে। তারা মেহেদি দেওয়া দেখছে। আয়ান দুঃখী দুঃখী হয়ে বলল,

“তুমি আরেকটু পরে বিয়ে করলে কী এমন হতো মিতুল আপু?”

“পরে বিয়ে করলে কী হতো?” জানতে চাইল টুম্পা।

আয়ান বলল,

“তাহলে আমি বড়ো হয়ে মিতুল আপুকে বিয়ে করতে পারতাম। কিন্তু তোমার ভাই এসে আমার থেকে মিতুল আপুকে কেড়ে নিয়ে গেল।”

“ওরে ইঁচড়েপাকা ছেলে!”

সবাই হাসলেও আয়ান গম্ভীর হয়ে টুম্পাকে বলল,

“এই তোমার কি বয়ফ্রেন্ড আছে?”

“না তো! কেন?”

“তাহলে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করো। আমি বড়ো হয়ে তোমাকেই বিয়ে করব।”

টুম্পা বিস্মিত হয়ে মিতুলকে বলে,

“ভাবি, তোমার ছোটো বেয়াই তো দারুণ সেয়ানা।”

ওদের কথোপকথনের মাঝে রাজকুমার উড়ে উড়ে ঘরে এলো। সে বিরতিহীনভাবে বলে যাচ্ছে,

“মুতু, রূপ বিয়ে। মুতু, রূপ বিয়ে।”

মুতু বলে ডাকায় মিতুল অবশ্য আজ রাগ করল না। বরং সে হাসছে। রাজকুমারের পিছু পিছু রূপকও রুমে ঢুকল। ব্যস্ত হয়ে বলল,

“দেখি, দেখি আমার বউটাকে দেখি।”

মিতুল লজ্জা পেয়ে গেল। মানুষটা এমন ঠোঁটকাটা কেন? লজ্জা-শরম কিচ্ছু নেই একদম। রূপক যেন এসব থোড়াই পরোয়া করে। সে তার দু’গালে হাত রেখে বলল,

“কী সুন্দর লাগছে!”

এরপর সে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“অনেক মেহেদি দিয়েছ। এবার সবাই ড্রয়িংরুমে গিয়ে শপিং দেখো যাও। ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিয়ে এসো।”

সবাই রুম থেকে বেরিয়ে গেলে রূপক মিতুলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

“বলেছিলাম না সব ঠিক ম্যানেজ করে নেব? সব ম্যানেজ করে নিয়েছি। আর তোমাকেও আমার করে নিচ্ছি।”

মিতুল আবেশিত হয়ে বলল,

“ভালোবাসি।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে