কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব-১৭

0
789

#কোন_কাননের_ফুল_গো_তুমি
#পর্ব_১৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
মিতুলের কান্না থামছে না কিছুতেই। বরং হেঁচকি তুলে কাঁদছে এবার সে। রূপক ব্যস্ত হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে,

“কাঁদছ কেন তুমি? প্লিজ! থামো।”

মিতুল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,

“কেন এসেছেন আপনি?”

“তোমার জন্য।”

“আমার জন্য?”

“হ্যাঁ। মুতুকন্যার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যাবে এটা শুনেও আমি দূরদেশে কীভাবে থাকতে পারি?”

মিতুলের কান্না এবার কমে এলো। তার চোখে-মুখে বিস্ময়। রূপক বোধ হয় সেই বিস্ময় বুঝতে পেরেই বলল,

“টুম্পার কাছে তোমার বিয়ের খবর শুনেছি আরও তিন দিন আগেই। একটু ঝামেলায় পড়ে গেছিলাম আর টিকিটও পাচ্ছিলাম না বিধায় একটু দেরি হলো।”

“একটু দেরি?”

“কেন বেশি হয়ে গেছে?”

“আজ পাত্রপক্ষ আমাকে আংটি পরাতে আসবে।”

“আসুক।”

“আসুক?”

“হ্যাঁ, আসুক। তার আগেই আমি তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলব।”

“কী কথা বলবেন?”

“এইযে, যে কথার জের ধরে তুমি আমার অপেক্ষায় ছিলে। আমার আগমনে কেঁদে ফেললে।”

“আপনি আমায় না বলে কেন চলে গেছেন?”

“বলার মতো সময়ই বা পেলাম কোথায়? তার আগেই তো তুমি আমায় না বলে গ্রামে চলে গেছ।”

“আপনি টুম্পার থেকে আমার ফোন নাম্বার নিতে পারতেন।”

“অভিমান করেই নিইনি। আর এরপর জরুরী খবরে এমনভাবে চলে যেতে হলো যে অন্যকিছু আর মাথাতেই ছিল না। আমি অপেক্ষায় ছিলাম তুমি হয়তো আমার সাথে যোগাযোগ করবে। কিন্তু করোনি। পরে আমি ধরেই নিয়েছি, আমার প্রতি তোমার কোনো ফিলিংস নেই। তাই আমিও আর তোমায় বিরক্ত করতে চাইনি। কিন্তু টুম্পার কাছে যখন শুনলাম তুমি বিয়েতে রাজি নও তখন আমার অবচেতন মন বলল আমার ফিরে আসাটা জরুরী।”

“খুব জরুরী খবরটা কি আপনার কাজিন ছিল? যার জন্য আপনি না বলে-কয়েই চলে গেছিলেন?”

রূপক একটু থমকাল। কিছুটা সময় নিয়ে বলল,

“টুম্পা তোমাকে বলেছে এসব?”

“ভুল কিছু বলেছে নাকি মিথ্যা?”

“কোনোটাই না। আমার লাইফে চাচ্চুর অবদান, আমার কাজিনের অবদান অনেক। তাই ঐ মুহূর্তে আমাকে যেতেই হয়েছিল।”

“আপনাদের পরিবার চায় দুজনের বিয়ে হোক।”

“পরিবার চাইলেই তো হবে না। আমাদেরও মতামত আছে।”

“সেই মতামত আমি আর শুনতে চাচ্ছি না। আপনার পরিবার যাকে চায় তাকেই বিয়ে করুন। আমি আসছি।”

অভিমানে কথাগুলো বলে জামা-কাপড় নিয়ে মিতুল চলে যাচ্ছে। রূপক তখন পেছন থেকে বলে,

“দাঁড়াও মিতুল।”

মিতুল দাঁড়াল না। ছাদের দরজা পর্যন্ত যেতেই রূপক চিৎকার করে বলল,

“আমি তোমাকে ভালোবাসি মিতুল।”

মিতুল থমকে গেল। তার পা চলছে না আর। একই সঙ্গে দুটো কারণে তাকে থমকে যেতে হয়েছে। তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন মমতা বেগম আর পেছনে বলা রূপকের মুখে ভালোবাসি কথা। মা নিশ্চয়ই শুনে ফেলেছে!

মিতুলের আসতে দেরি হচ্ছিল বিধায় মমতা বেগম নিজেই ছাদে এসেছেন। ছাদে যে তিনি আচার রোদে দিয়েছিলেন মিতুলকে এটা বলা হয়নি। কাজেই আচার নেওয়ার জন্য তাকে আসতে হলো। রিনভীকে খুব একটা ছাদে পাঠান না তিনি। এখন মনে হচ্ছে তার আসাটা অনুচিত ছিল। রূপক এগিয়ে এলেও মিতুলকে আর কিছু বলতে পারল না। সে নিজেও অবাক হয়েছে মমতা বেগমকে দেখে। মমতা বেগম অবশ্য কাউকেই কিছু বললেন না। আচারও নিলেন না। মিতুলের হাত ধরে সোজা নিচে নিয়ে গেলেন।

টুটুল রিনভীকে কাজে সাহায্য করছিল। আজ যেহেতু মানুষজন আরও বেশি আসবে তাই আয়োজনও বেশি। মমতা বেগম নিঃশব্দে মিতুলকে টেনে ওর ঘরে নিয়ে গেল। টুটুল বিষয়টা ভালোভাবে নিল না। তার কাছে ঘটনা আরও বেশি অদ্ভুত লাগল মিতুলকে কাঁদতে দেখে।

রুমে এসে দরজা আটকে দিলেন মমতা বেগম। ঠান্ডা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

“তোর বিয়েতে রাজি না হওয়ার কারণ কি এটাই?”

মিতুল কোনো উত্তর দিতে পারল না। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

“তোর কান্না শুনতে আসিনি। উত্তর দে। কতদিনের সম্পর্ক তোদের?”

মিতুল সহসা জবাব দিতে পারল না এবারও। মমতা বেগম ধমকে উঠলেন। মিতুল কম্পিত হয়ে বলল,

“তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”

“তাহলে তো ভালোই। রেডি হয়ে নে।”

বলে তিনি দরজা খুলতে গেলেন। মিতুল তখন ভয়ে ভয়ে বলল,

“কিন্তু আমি বোধ হয় তাকে ভালোবাসি মা।”

মমতা বেগম শুনলেন। একবার ফিরেও তাকালেন মেয়ের দিকে। কিন্তু কিছু বললেন না। দরজা খুলে নিরবে চলে গেলেন।

বাড়িটা হঠাৎ করেই যেন নিরব ও গুমোট হয়ে গেল। সবার ভেতরে ভেতরেই যেন কিছু একটা চলছে। কিন্তু কেউই সেটা মুখে প্রকাশ করছে না। আজও মিতুলকে রিনভী-ই সাজিয়ে দিল। যথা সময়ে পাত্রপক্ষও এলো। খাওয়া-দাওয়াও হলো। আংটি পরানোর সময় হলে টুটুল হেসে বলল,

“আমরা আরেকটু সময় নিই? মিতুল আর শিহাব তো এখনো কেউ কাউকে সেভাবে চেনে না। দুজনে বরং আরেকটু সময় নিক। কথাবার্তা বলুক, সময় কাটাক। এখনকার যুগ বোঝেনই তো। আপনারা কী বলেন?”

সবাই অবশ্য টুটুলের পরামর্শকে ভালোভাবেই নিল এবং রাজিও হয়ে গেল। এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে মিতুল। এতটাই অবাক হয়েছে যে বিস্মিত ভাব তার চোখ-মুখ থেকে সরছিল না। বিদায়ের সময় সবাইকে গাড়ি অবধি পৌঁছে দিতে মিতুলও এলো। ওরা চলে যাওয়ার পর অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে টুটুল বলল,

“ভালোবাসার মর্যাদা আমার কাছে আছে। আমার পক্ষ থেকে যতটুকু করার করেছি। এখন তুই যাকে ভালোবাসিস বাকিটা তার কাজ। তাকে বল পরিবারসমেত প্রস্তাব নিয়ে আসতে।”

ব্যস এইটুকু কথা বলেই টুটুল নিজের রুমে চলে গেল। বাবা-মা’ও কিছু বলল না। এতক্ষণে মিতুল বুঝতে পারল কেন হঠাৎ করেই বাড়িটা গুমোট হয়ে গেছিল। সে একা দাঁড়িয়ে আছে ড্রয়িংরুমে। রিনভী কাঁধে হাত রেখে বলল,

“মা যখন রুমের ভেতর তোমার সঙ্গে কথা বলছিল তখন তোমার ভাইয়া সব শুনেছে। পরে মাকে জিজ্ঞেস করায় মা সব জানালেন। এরপর তোমার ভাইয়াই বাবা-মাকে বোঝালেন যে, তুমি না চাইলে যেন কেউ জোর না করে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে হলেও সংসার তো করা যায় না।তুমি এখন রূপক ভাইয়ার সাথে কথা বলো যাও। তাকে বলো পরিবার নিয়ে আসতে।”

মিতুল রুমে চলে এলো। কীভাবে কথা বলবে সে? ফোন নাম্বারও তো নেই। তার নাম্বার জোগার করতে হলো না। টুম্পা নিজেই কিছুক্ষণ পর কল দিয়ে বলল রাত নয়টায় ছাদে যেতে। রূপক সেখানেই তার জন্য অপেক্ষা করবে।
.
.
গম্ভীর মুখ করে সোফার এক কোণায় বসে আছেন টিয়া বেগম। তার পাশেই বসে আছেন রমিজ উদ্দিন। রূপকের বড়ো ভাই স্বপন নির্বিকার। তার বলার মতো কিছু নেই এখানে। রূপকের মুখে অকপটে বলা মিতুলকে বিয়ে করার কথা শুনে সকলেই ভাষাহীন। রমিজ উদ্দিন বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,

“এতদিন পরে এসে তুমি এসব কী কথা বলছ বুঝতে পারছ?”

রূপক বলল,

“বুঝতে পারছি বাবা। কিন্তু তুমি একবার আমার দিকটাও বোঝার চেষ্টা করো।”

“আমি বুঝলেই কি সব হবে? তুমি সবকিছু খুব ভালো করেই জানো। আমি কী জবাব দেবো ওদের?”

“বিয়েতে কিন্তু আমি কখনোই শক্ত কোনো মতামত দিইনি। এমনকি তোমরাও কখনো আমার মতামত জানতে চাওনি। সবটা নিজেরা ঠিক করেছ, নিজেরা কথা বলেছ। তাছাড়া আমি যতদূর জানি, বিয়ের ফাইনাল কথাও কিন্তু হয়নি। জাস্ট দুই পরিবার মিলে তোমরা তোমাদের পছন্দ জানিয়েছ।”

এই পর্যায়ে এসে টিয়া বেগম বললেন,

“মিতুলের যে বিয়ের কথাবার্তা চলছে তুমি জানো না?”

“জানি, মা। জানি বলেই এভাবে ছুটে এসেছি।”

যারপরনাই অবাক হলেন টিয়া বেগম। এতক্ষণ ছেলের হঠাৎ দেশে আসার কারণ যে এটা, তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললেন,

“তুমি মিতুলের জন্য এসেছ?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে আমরা আর কী বলব? নিশ্চয়ই সব ভেবে-চিন্তেই এসেছ যে কী করবে।”

“তোমাদের ছাড়া আমি কিছুই করতে পারব না। এই সময়ে এসে তোমরা আমাকে সাপোর্ট করবে না?”

রমিজ উদ্দিন বললেন,

“বুঝতে পারছি না কী করা উচিত। একটু সময় দাও। আমরা ভেবে দেখি।”

এরপর তিনি নিজের রুমে চলে গেলেন। টিয়া বেগমও আর একটা রা করলেন না। নিরবে তিনিও প্রস্থান করলেন। স্বপন পিঠ চাপড়ে বলল,

“চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

মলিন হাসল রূপক। বলা তো খুব সহজ যে, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে কি সব আদৌ এতটা সহজ? রূপকের তো তা মনে হয় না। তবুও সে আশায় বুক পেতে আছে বাবা-মা নিশ্চয়ই তার মনের ভাবটা বুঝবে।

গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সে ঘড়ির দিকে তাকাল। নয়টা বাজতে এখনো পনেরো মিনিট বাকি। টুম্পা ড্রয়িংরুমেই দাঁড়ানো ছিল। রূপক জিজ্ঞেস করল,

“বলেছিলি?”

টুম্পা উত্তর দিল,

“হ্যাঁ।”

নয়টা বাজার আগেই রূপক ছাদে চলে গেল। গিয়ে অবাকও হলো সে। মিতুল আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। সে গিয়ে পাশে দাঁড়াল। ক্ষীণস্বরে বলল,

“এখনো তো নয়টা বাজেনি। এত তাড়াতাড়ি চলে এসেছ কেন?”

“আপনি কেন এসেছেন তাহলে এত তাড়াতাড়ি?”

রূপক কিছু বলতে গিয়েও হেসে ফেলল। রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

“পাত্রপক্ষ এসেছিল?”

“হুম।”

“কী বলল?”

“কিছু বলেনি। ভাইয়া সব ম্যানেজ করে নিয়েছে।”

“আন্টি তখন বকেছিল?”

“না।”

“বাড়ির সবাই জেনে গেছে?”

“হুম।”

“কী বলেছে তারা?”

“আপনাকে পরিবারসহ যেতে বলেছে।”

দুজনেই চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। নিরবতা কাটিয়ে রূপকই বলল,

“তোমার কি মন খারাপ?”

মিতুল এই কথা জবাব দিল না। বরং বলল,

“আমার মনে হচ্ছে সবটা এত সহজ হবে না।”

“কেন?”

“জানিনা। তবে মন এটাই বলছে। অন্তত পরিবার মানবে বলে মনে হচ্ছে না।”

“কার?”

“আপনার।”

“এমন কেন মনে হলো?”

“অনেক কারণই আছে। প্রথমত, তারা চায় আপনার কাজিনের সাথে বিয়ে হোক। দ্বিতীয়ত, এখনো আপনার পড়াশোনা কমপ্লিট হয়নি। তৃতীয়ত, আপনাদের ফিনানশিয়াল অবস্থা আমাদের চেয়ে ঢের ভালো।”

“এসব ইস্যু কি তোমার কাছেও গুরুত্বপূর্ণ?”

“আমার কাছে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটা নয় এসবে কী আসে যায়?”

“কারণ ভালো আমি তোমাকেই বাসি। আর সংসারও তোমার সাথেই করব। তাই তোমার চাওয়া, মনে হওয়াটাই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

মিতুল চুপ করে রইল। রূপক ওকে হাত ধরে পাশ থেকে সামনে এনে মুখোমুখি দাঁড় করাল। দু’গালে হাত রেখে বলল,

“ধরো পরিবার মানল না, কী করবে তখন? আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?”

মিতুলের বুক কেঁপে উঠল তৎক্ষণাৎ। রাতের অন্ধকারেও রূপকের চোখ চোখ রাখা দায়। সে চকিতে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। রূপক আকুতিভরা স্বরে বলল,

“সবকিছু এড়িয়ে আমার হাতটা শক্ত করে ধরতে পারবে না মিতুল?”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে