#কোন_কাননের_ফুল_গো_তুমি
#পর্ব_১৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
এক দমকা বাতাসে মিতুলের শরীর হালকা শান্ত হলেও মন পূর্বের ন্যায় স্থবির ছিল। তিশা এসে দাঁড়াল সামনে। মিতুল কিছু বলল না অবশ্য আগেই। তিশা একটু দম নিয়ে বলল,
“তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার। ফ্রি তুমি?”
মিতুল মাথা নাড়িয়ে বলল,
“হুম।”
“তাহলে চলো ক্যাফেতে গিয়ে বসি।”
মিতুল রাজি হলো। দুজনে মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসে আছে। তিশা বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলল,
“প্রশ্নটা করা তোমাকে ঠিক হবে কিনা জানিনা। কিন্তু না করেও পারছি না।”
“আপনি বলতে পারেন।”
“তোমার সাথে কি অনিকের কোনো সম্পর্ক আছে?”
মিতুল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলল,
“এসব কী বলছেন!”
“আমি জাস্ট জানতে চাচ্ছি। তোমরা কি রিলেশনে আছো?”
“না।”
তিশা ফের চুপ করে রইল। এবার মিতুলই জিজ্ঞেস করল,
“অনিকের সাথে ব্রেকাপ কেন করলেন আপনি? আবার শুনলাম, বিয়েও নাকি ঠিক হয়েছে আপনার।”
তিশা এবার দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“বেশ কিছুদিন ধরেই অনিকের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া ঠিকঠাক হচ্ছিল না। কথায় কথায় রাগারাগি, ঝগড়া এসব হতোই। অবশ্য রাগারাগি আমিই বেশি করতাম। একটা পর্যায়ে আমি বিরক্ত হয়ে ব্রেকাপ করে ফেলি। তখন অনিক একটু বেশিই রিয়াক্ট করেছে। যেটা আমার ভালো লাগেনি। যার সাথে আমার বিয়ের কথা শুনেছ সম্পর্কে সে আমার কাজিন হয়। আমাদের দুই পরিবারই চাচ্ছিল আমাদের বিয়ের মাধ্যমে সম্পর্কটা আরও মজবুত করতে। অনিকের সাথে রিলেশন ছিল বিধায় আমি রাজি হইনি। একদিন একটু প্রয়োজনেই আমার সেই কাজিনের সাথে দেখা করেছিলাম আমাদের ব্রেকাপের পর। এটা অনিক দেখে ফেলেছিল। রাস্তায় তখন কিছু বলেনি। কিন্তু বাড়িতে ফিরে ফোন বেশ রাগারাগি করে। তাই জেদের বশে আমিও বলি যে, হ্যাঁ আমি ওকেই বিয়ে করব আর বাড়িতেও মতামত জানিয়ে দেই। কিন্তু সত্যি বলতে যতই বিয়ে নিয়ে কথা পরিবারে আগাচ্ছে আমি মনে স্বস্তি পাচ্ছি না। কেমন একটা অশান্তি অনুভব হয় সর্বদা। মেলায় আবার তোমাকে অনিকের সাথে দেখে আমার অশান্তি আরও বেড়ে যায়। সত্যিই আমি সহ্য করতে পারিনি। আমার আরও বেশি খারাপ লেগেছিল যখন অনিক আমার সামনেই তোমার হাত ধরে। আমার এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। আমি বুঝে নিয়েছি যে, অনিককে ছাড়া আমার ভালো থাকা সম্ভব নয়।”
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামল তিশা। মিতুল মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনে বলল,
“আপনাকে দেখানোর জন্যই সে আমার হাত ধরেছিল। আমাদের মাঝে অন্য কোনো সম্পর্ক নেই।”
তিশা চুপ করে আছে। মিতুল জিজ্ঞেস করল,
“এখন আপনি কী চাচ্ছেন?”
“আমি সম্পর্কটা ঠিক করতে চাচ্ছি।”
মিতুল খুশি হলো। বলল,
“এটা তো খুবই ভালো কথা।”
“কিন্তু অনিক আমার ফোন রিসিভ করছে না। ব্লক করে দিয়েছে।”
“হয়তো রাগ করে আছে তাই। আপনিও তো তাকে সবকিছু থেকে ব্লক করে দিয়েছিলেন। এখন তারও এমন করাটা অস্বাভাবিক কিছু না।”
“কিন্তু ও যদি আমাকে কিছু বলার সুযোগই না দেয় তাহলে সম্পর্কটা আমি ঠিক করব কীভাবে? ভার্সিটিতেও তো আসছে না।”
“সে এখনো আমাদের বাড়িতে আছে। আপনি চাইলে আমি দেখা করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারি।”
তিশা ভীষণ আনন্দিত হয়ে বলল,
“তাহলে আমি কৃতজ্ঞ থাকব তোমার প্রতি।”
মিতুল হাসল। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আজ সন্ধ্যায় দেখা করিয়ে দেবো। এড্রেস আমি ম্যাসেজ করে দেবো আপনাকে। ফোন নাম্বারটা দিন।”
তিশা নিজের নাম্বার দিয়ে মিতুলের ফোন নাম্বারও রেখে দিল। এরপর একবুক আশা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সন্ধ্যা হওয়ার।
ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মিতুলের বিকেল হয়ে গেল। ক্লান্ত শরীরে মনে চাচ্ছিল না কিছু করতে। কিন্তু বিশ্রাম নেওয়ার পূর্বে গোসল করাটা জরুরী। গোসল করে এসে নাস্তা চাইল রিনভীর কাছে। রিনভী খাবার এনে টেবিলে রেখে বলল,
“খেয়ে একটা ঘুম দিয়ে নাও তো।”
মিতুল অবাক হলো। অন্য সময় তাকে বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলা হলেও কখনো তো ঘুমাতে বলে না কেউ। আজ হঠাৎ কী হলো? সে ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল,
“ঘুমাব কেন?”
“যাতে নিজেকে একটু ফ্রেশ লাগে। এখন তো ক্লান্ত হয়ে আছো। চোখ-মুখ শুকিয়ে আছে। ঘুমালে ফ্রেশ লাগবে। তবেই না পাত্রপক্ষের পছন্দ হবে।”
মিতুল বোধ হয় আকাশ থেকে পড়ল। এত বড়ো চমকের জন্য তো সে প্রস্তুত ছিল না। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। অস্থির হয়ে জানতে চাইল,
“এর মানে কী? পাত্রপক্ষ কেন আসবে?”
“কেন আসবে মানে? তোমাকে দেখতে আসবে।”
“কিন্তু আমি তো এখনই বিয়ে করতে চাই না।”
মমতা বেগম তখন এসে বললেন,
“দেখতে এলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না। ঘরে বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে থাকলে প্রস্তাব আসবেই। ক’জনকে না করা যায়? তাছাড়া যেই ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে ঐ ছেলে তোর ভাইয়ের কলিগ। তোকে টুটুলের বিয়ের সময় দেখেছিল। তাই ওর বাবা-মাকে জানিয়ে সরাসরি তোর ভাইকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।”
“আর তোমরাও রাজি হয়ে গেলে?”
“রাজি কোথায় হলাম? ছেলেটাকে আমার বেশ ভদ্র মনে হয়েছে। ও তো চাইলেই পারত তোকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে। কিন্তু তা না করে পরিবারের মাধ্যমে এগিয়েছে। এই যুগেও এমন ভদ্র ছেলে হয়?”
মিতুল বলার মতো আর কোনো ভাষা খুঁজে পেল না। মায়ের কথার পিঠে কোনো জবাবও সে দিতে পারল না। খাবারও খেল না সে। চুপচাপ চলে এলো ছাদে। কী করবে বা কী বলবে কিছুই যেন সে বুঝতে পারছে না। অনিক ছাদেই ছিল। মিতুলকে এমন হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে তোমার?”
মিতুলের ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। কেন এত কান্না পাচ্ছে এর নির্দিষ্ট কারণ সে জানে না। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে বলল,
“কিছু না।”
অনিক বেশ কিছুক্ষণ ধরে মিতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“তুমি কাঁদছ কেন?”
“কই কাঁদছি?”
“তোমার চোখে পানি।”
মিতুল আর কিছুই বলতে পারল না। টুপ করে তার দু’চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। এরপর ঝরঝর করে অনবরত চোখের পানি পড়তে লাগল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। অনিক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“এই মিতুল? তোমার কী হয়েছে? এভাবে কাঁদছ কেন?”
এবারও কোনো জবাব দিতে পারল না মিতুল। অনিক ফের জিজ্ঞেস করল,
“কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?”
দু’দিকে মাথা নাড়ল সে।
“তবে? কাঁদছ কেন? আমাকে বলো প্লিজ!”
মিতুল কোনো কথা বলতে পারছে না। অনিকের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। সে অস্থিরচিত্তে বলল,
“আমাকে বন্ধু ভেবে হলেও বলো প্লিজ!”
এবারও কোনো জবাব এলো না। অনিক তাই মিতুলকে শান্ত হওয়ার জন্য সময় দিল। কিছুক্ষণ কাঁদুক। মন হালকা হবে। আর কী হয়েছে সেটাও জানা যাবে। অনিক তাই চুপ করে রেলিঙের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মিনিট দশেক পর মিতুলের কান্নার গতি কমে আসে। এখন সে ফোঁপাচ্ছে। অনিক তখন বলল,
“এবার বলো তো আমায় কী হয়েছে?”
“কিছুই হয়নি।”
“আমাকে মিথ্যা বলবে না একদম। বলো বলছি কী হয়েছে? বাসায় বকেছে কেউ?”
“উঁহু!”
“তবে?”
“বাড়ি থেকে বিয়ের কথা বলছে।”
“এটা তো ভালো খবর। এখানে কাঁদার কী আছে?”
মিতুল চোখ তুলে তাকাল। অনিক বলল,
“না মানে আমি বলতে চাচ্ছি, বিয়ে তো একদিন না একদিন করতেই হবে তাই না? এখানে তো কান্না করার কিছু নেই। তুমি কি অন্য কাউকে পছন্দ করো?”
এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর মিতুলের নিজের কাছেও নেই। সে কি রূপকের জন্যই বিয়ের কথায় এতটা ইমোশোনাল হয়ে পড়েছে? কিন্তু এমনটা হয়ে থাকলেও তো ঠিক হচ্ছে না কাজটা। রূপকের তো অলরেডি কেউ একজন আছে।
মিতুলের থেকে উত্তর না পেয়ে অনিক বুঝিয়ে বলল,
“দুপুরে খাওয়ার সময়ই আমি জানতে পেরেছি আজ তোমাকে দেখতে আসবে। টুটুল ভাইয়া যেভাবে ছেলে ও তার পরিবার সম্পর্কে বলল আমারও তো শুনে বেশ ভালোই মনে হলো। তাছাড়া দেখতে আসা তো একটা প্রাথমিক ধাপ মাত্র। এরপরও কতকিছু পড়ে আছে। দুজনে আলাদা দেখা করবে, কথা বলবে। একজন আরেকজন সম্পর্কে জানবে। সব জেনেশুনে যদি তোমার পছন্দ হয় তাহলে বিয়ে করবে। নয়তো আর আগাবে না। সিম্পল! এজন্য কি কেঁদেকেটে বুক ভাসানোর কোনো মানে হয় পাগলি?”
মিতুল নিরবে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“ঠিক আছে। এখন আপনি আমার একটা কথা রাখবেন?”
“কী কথা?”
“আগে বলেন রাখবেন?”
“তোমাকে বিয়ে করতে হবে নাকি?”
“আমি সিরিয়াস!”
অনিক হেসে বলল,
“আচ্ছা সরি। বলো কী কথা? আমি রাখার চেষ্টা করব ইন-শা-আল্লাহ্।”
মিতুল সুযোগ বুঝে এবার তিশার কথা জানাল অনিককে। কলেজে ওর সঙ্গে বলা কথোপকথন এবং দেখা করার বিষয়টিও। সব শুনে অনিক কিছুক্ষণ থম মেরে রইল। এরপর বলল,
“আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই না।”
“আপনি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছেন।”
“তুমি অন্য কিছু চাও।”
“আমার তো অন্য কিছু লাগবে না।”
“আমি তোমার কথা রাখতে পারব না মিতুল।”
“কেন পারবেন না? তিশা আপু নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। সে আপনাকে ভালোবাসে। আর আপনিও তাকে ভালোবাসেন। তাহলে নিজেদের মধ্যকার ভুল বুঝাবুঝি মিটিয়ে কেন নিচ্ছেন না?”
“ওর দেওয়া আঘাতটা আমি এখনো ভুলতে পারিনি।”
“সবকিছু মনের মাঝে গেঁথে রাখলে তো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা মুশকিল। ভুল তো প্রতিটা মানুষই করে। আর সে যদি তার ভুল বুঝতে পারে তাহলে আপনার উচিত তাকে ক্ষমা করে দেওয়া। এখন ইগো দেখিয়ে যদি আপনি তাকে ক্ষমা না করে ফিরিয়ে দেন। তাহলে আজ থেকে ছয় মাস কিংবা বছর খানেক পর তাকে অন্য কারও পাশে দেখে কিন্তু ঠিকই কষ্ট পাবেন। তখন আফসোস করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। এজন্য সময় থাকতেই তার সাধন করতে হয়। আমি আপুকে কথা দিয়েছি দেখা করিয়ে দেবো। আপনি যদি এটলিস্ট আমার জন্য হলেও দেখা করতে যান তাহলে আমি ভীষণ খুশি হব।”
উত্তরের জন্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন মিতুল কোনো জবাব পেল না তখন সেও নিঃশব্দে নিচে নেমে এলো। বিকেলের ঘুমটা আর তার হলো না। কেমন যেন একটু পরপরই মন খারাপের পরিমাণ পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল। রিনভী ও মা ভেবেছে মিতুল ঘুমিয়ে আছে। তাই একদম সন্ধ্যার কিছু সময় আগ দিয়ে রিনভী গিয়ে মিতুলকে উঠাল। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে রিনভী শাড়ি আর কসমেটিক্স নিয়ে বসে আছে।
“এসব কেন?” জানতে চাইল মিতুল।
“ওমা! এসব কেন মানে? সাজবে না?”
“না। যেভাবে আছি সেভাবেই যাব।”
“তা বললে হয় নাকি? অল্প একটু তো সাজতেই হবে। বেশি সাজাব না। আমার ননোদিনী তো এমনিতেই পরী মাশ-আল্লাহ্।”
রিনভী ও মায়ের জোরের কবলে পড়ে মিতুলকে শাড়ি পরে সাজতে হলো। সব অবশ্য রিনভীই করেছে। মিতুল শুধু পুতুলের মতো নিরব ভূমিকা পালন করেছে। ওর সাজগোজ করানো শেষ হলে রিনভী রান্নাঘরে চলে গেল শাশুড়িকে সাহায্য করার জন্য। ঐদিকে পাত্রপক্ষদেরও আসার সময় হয়ে গেছে।
মিতুলের পরনে নীল রঙের জামদানি শাড়ি। শাড়িটা তার নিজের নয়। রিনভীর। আজই প্রথম ভাঁজ ভাঙা হয়েছে। সে আয়নার সামনে বসে আছে নিশ্চুপ হয়ে। মুখে হাসি নেই, মনে স্বস্তি নেই। দরজায় কড়া নাড়ল অনিক। মিতুল ভেতর থেকে বলল,
“কে?”
অনিক ওপাশ থেকে বলল,
“মিতুল, আমি। আসব?”
“আসুন।”
অনিক ভেতরে ঢুকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। মুগ্ধ হয়ে বলল,
“তোমাকে তো দারুণ লাগছে। পাত্রপক্ষ আজই না তোমাকে বউ করে নিয়ে যায়।”
মিতুল কোনো উত্তর দিল না। অনিক এবার ইতিউতি করে আসল উদ্দেশ্য খুলে বলল এখানে আসার। মাথা চুলকে বলল,
“তিশার সাথে কোথায় দেখা করতে বলেছ?”
“জায়গা সিলেক্ট করিনি। আপনি বলুন কোথায় মিট করবেন? আমি আপুকে ম্যাসেজ করে দিচ্ছি।”
“ওহ আচ্ছা। থাক তাহলে। আমিই কল করে বলে দিচ্ছি।”
“ঠিক আছে।”
“আচ্ছা আমি তাহলে আসি।”
অনিক যাওয়ার পূর্বে আবারও বলে গেল,
“তোমাকে আসলেই খুব সুন্দর লাগছে। কাজল দাওনি কেন চোখে? কাজল দাও। নয়তো নজর লেগে যাবে।”
এরপর মুচকি হেসে সে চলে গেল। রিনভী বেশ কয়েকবার জোর করেছিল কাজল দেওয়ার জন্য। মিতুল দিতে দেয়নি। অনিক চলে যাওয়ার মিনিট দশেক পরই পাত্রপক্ষরা এলো। ছেলে, ছেলের বাবা-মা, ছোটো বোন, দু’জন বন্ধু আর ফুপু এসেছে। কিছুক্ষণ বাদে মিতুলকেও তাদের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। অস্বস্তি ও জড়তায় গাঁট হয়ে রইল মিতুল। তারা টুকটাক প্রশ্ন করল। মিতুলও সেসবের উত্তর দিল শান্তকণঠে। এরপর আবার তাকে ঘরে নিয়ে আসা হলো। টুটুলের বন্ধু ও কলিগ বিধায় ওদের আপ্যায়নের আলাদা ব্যবস্থাও করা হয়েছে। মানে রাতে একেবারে ডিনার করেই গিয়েছে তারা।
দেখতে আসলেই যে বিয়ে হয়ে যায় না এটার মতো গুজব দ্বিতীয়টি আর হয় না এটা টের পেল মিতুল পরেরদিন সকালে। ওই বাড়ি থেকে ফোন করে জানিয়েছে মিতুলকে তাদের ভারী পছন্দ হয়েছে। এছাড়া ছেলের তো আগে থেকেই মিতুলকে পছন্দ। তাই তাদের কারও কোনো আপত্তি নেই এই বিয়েতে। বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা মিতুলকে বাড়ির বউ করে নিয়ে যেতে চায়। এসব শুনে যারপরনাই অবাক হলো মিতুল। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড রাগও হলো তার। সে বিয়ে করতে চায় না। কেন বিয়ে করতে চায় না এটাই এখন এই বাড়ির সবার প্রশ্ন। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই।
এতকিছুর মাঝেও দুটো ভালো খবর পেল সে। একটা অনিকের সঙ্গে তিশার সম্পর্ক ঠিক হওয়ার খবর। আর অন্য খবরটি পেল তারও কিছুদিন পর। নওশাদ ও চৈতির বিয়েটা হয়ে গেছে। দুটো খবরেই সে প্রচণ্ড খুশি হয়েছে। কেবলমাত্র নিজের বেলাতেই তার কোনো খুশি কাজ করছে না। এর মাঝে সব বেশ স্থিতিশীল ছিল। বিয়ে নিয়ে কেউ আর কিছু বলেনি। কেন বলেনি এটা মিতুল বুঝতে পারল পরে।
শুক্রবার ক্লাস নেই বলে একটু বেলা অবধিই ঘুমাচ্ছিল। ঘুম থেকে উঠে খাওয়ার সময় বিয়ে নিয়ে কিছু কথাবার্তা এলো তার কানে। এতদিন সবাই চুপচাপ ছিল কারণ টুটুল এবং বাবা ছেলের সম্পর্কে ভালোমতো খোঁজ-খবর নিচ্ছিল। তারা কোথাও কোনো খারাপ রিপোর্ট পায়নি। বরং ছেলে ও তার পরিবার সম্পর্কে বেশ সুনাম-ই শুনেছে তারা।
মিতুল এসব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে। সে ভেবেছিল বিয়ের ভূত সবার মাথা থেকে নেমেছে। অথচ এখানে ঘটনা অন্যকিছু। সে আর নাস্তা করল না। চুপ করে নিজের রুমে এসে বসে রইল। কিছু সময় বাদে রিনভী এসে জানাল পাত্রপক্ষ আবার আসবে। এবার মানুষজন আরও বেশি। খুব সম্ভবত আজ তারা রিং-ও পরিয়ে যাবে। মিতুল সব শুনল। কিছু বলল না। তার বলার কিছু নেই আর। কী-ই বা বলবে সে? তার কাছে কি যথোপযুক্ত উত্তর আছে? আবার সে বিয়েতে মতও দিতে পারছে না। এরচেয়ে বড়ো দোটানা, অস্বস্তির আর কী হতে পারে?
বিকেলে মমতা বেগম মিতুলকে ছাদে পাঠালেন জামা-কাপড় আনার জন্য। সকাল থেকে সে একদম চুপচাপ। প্রয়োজন ছাড়া কারও সাথে কোনো কথা বলছে না। তার এই নিরবতা কারও চোখে পড়ছে কিনা জানা নেই। আবার এমনও হতে পারে, দেখেও সবাই এড়িয়ে যেতে চাইছে। সবসময় তো আর বাচ্চাদের জেদকে পাত্তা দিলে চলে না। তাদের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা বাড়ির সবার আছে। সবাই তো ভালোই চায় মিতুলের।
মিতুল ছাদে গেল কাপড় আনতে। তার এখন আর ছাদেও আসতে ভালো লাগে না। কেন লাগে না কে জানে! সে আনমনে দড়ির ওপর থেকে কাপড় তুলছিল। সেই সময় পরিচিত কণ্ঠ থেকে তার নাম শুনতে পায়,
“মিতুল।”
মিতুল ভ্রু কুঁচকে তাকাল পেছনে। রূপককে দেখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। কতটা অবাক হয়েছে সেটা বোধ হয় তার চোখ-মুখ দেখেও ঠিক আন্দাজ করা সম্ভব নয়। কেন জানি তার দু’চোখে অশ্রু জমা হতে লাগল। চোখ দুটো চিকচিক করছে অশ্রুকণায়। অস্ফুটস্বরে সে বলে উঠল,
“আপনি!”
রূপক কিছু বলল না। শুধু নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল মিতুলকে। আলতো করে চুমু খেল মিতুলের মাথায়। মিতুলের তখন কী হলো কে জানে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সে।
চলবে..