#কোন_কাননের_ফুল_গো_তুমি
#পর্ব_১৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________
মিতুল ফ্যাকাশে মুখে বলল,
“সরি।”
অনিক শীতল কণ্ঠে বলল,
“ইট’স ওকে।”
এরপর টিস্যু দিয়ে পানিটুকু মোছার চেষ্টা করল। ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে গেল দুজনের। মিতুল খেলেও অনিক শুধু খাবার নাড়াচাড়া করছিল। মিতুল সেটা লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল,
“খাচ্ছেন না কেন?”
“এমনিই ভালো লাগছে না। তুমি খাও।”
দুজনের খাওয়া শেষ হলে রিনভী এবং মমতা বেগমের জন্যও খাবার পার্সেল করে নিল অনিক। এরপর সোজা চলে এলো বাড়িতে। বাড়ি ফিরে ওয়াশরুমে গিয়ে ইচ্ছেমতো চোখে-মুখে পানি দিচ্ছে। বারবার মেলায় তিশার পাশে দাঁড়ানো ছেলেটির কথা মনে পড়ছে তার। দুজনকে পাশাপাশি দেখে তার বুকে অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে। সে চেষ্টা করেছে মিতুলের সামনে স্বাভাবিক থাকার। মূলত সে কারও সামনেই নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করতে চাইছে না। আর তাই তো তিশাকে দেখানোর জন্যই তখন মিতুলের হাত ধরেছিল। তিশাকে সে এটা বোঝাতে চাচ্ছিল যে, তার চলে যাওয়াতে কোনো প্রভাব অনিকের ওপর পড়েনি। এমনকি তার কিছু যায় আসেও না। ওপর থেকে অনেক কিছুই বোঝানো যায়, ভালো থাকার অভিনয় করা যায় কিন্তু ভেতরের যেই দহন? সেটা কী করে নেভানো সম্ভব? কাঙ্ক্ষিত সেই মানুষটা ছাড়া কি আদৌ সম্ভব দহনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া?
রিনভী দরজা ধাক্কাচ্ছে। অনিক হাত-মুখ ধুয়ে দরজা খুলে দিল। তার চোখ লাল। রিনভী আঁৎকে উঠে বলল,
“তোর চোখে কী হয়েছে?”
“কই?”
“লাল হয়ে আছে।”
“কিছু পড়েছে হয়তো। ডেকেছ কেন?”
রিনভী সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“খাবি না?”
“না। খেয়ে এসেছি আমি। এখন একটু রেস্ট নেব। ডেকো না আমাকে।”
“অল্প করে খেয়ে নে।”
“না, আপু। পেটে জায়গা নেই।”
রিনভী আর জোর করল না। ও চলে যাওয়ার পর দরজা আটকে বিছানায় শুয়ে পড়ল অনিক। ফোন থেকে তিশার সাথে তোলা ছবিগুলো দেখছে সে। একেকটা ছবি দেখছে আর ভেতর থেকে তার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে। সে কিছুতেই তিশার বদলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না। বিশ্বাস করতে পারছে না। বুকের ভেতরটা কেমন যেন হুহু করে উঠছে।
বাইরে থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসেছে মিতুল। গ্রুপ থেকে ক্লাসের পড়াগুলো আগে জেনে নিয়েছে। দৃষ্টি তার খোলা বইয়ের ওপর স্থির থাকলেও মন পড়ে আছে অন্য কোথাও। এই অন্য কোথাওটা কোথায়? তার অবচেতন মন বলছে রূপকের কথা। কিন্তু সে রূপকের কথা এত কেন ভাবছে? রূপক তো একবারও তার কথা ভাবেনি। যদি ভাবতই তবে নিশ্চয়ই যাওয়ার পূর্বে বলে যেত একটাবার। পরক্ষণেই প্রবোধ গুনল সে। রূপক কেন তাকে বলে যাবে? সে কী হয় রূপকের? কিচ্ছু না!
এতসব বলেও লাভের লাভ কিছুই হলো না। মন তো শান্ত হলোই না বরং আরও বেশি উচাটন হয়ে পড়ল। অস্থিরতা, অস্বস্তি কোনোটাই কমার নাম নেই। মনে হচ্ছে একটাবার যদি সে রূপকের সঙ্গে কথা বলতে পারত! কিন্তু সেটাই বা কী করে সম্ভব? রূপকের ফোন নাম্বার তো তার কাছে নেই। টুম্পার কাছে যে চাইবে সেটাও সম্ভব নয়। পরে কী না কী ভেবে বসে আবার।
সে কোনোভাবেই নিজেকে আর মনকে স্থির রাখতে পারছিল না। যেভাবেই হোক রূপকের সঙ্গে কথা বলতে হবে। নতুবা তার এই অস্থিরতা বাড়বে বৈ কমবে না। বই বন্ধ করে সে বড়ো করে শ্বাস নিল। ভেতরে অস্থিরতা লুকিয়ে গেল টুম্পাদের অ্যাপার্টমেন্টে। ভাগ্যক্রমে দরজা খুললও টুম্পা। মিতুলকে দেখে একগাল হেসে বলল,
“আরে আপু! কেমন আছো?”
মিতুল মৃদু হেসে বলল,
“ভালো। তুমি?”
“আমিও। এসো ভেতরে এসো।”
টুম্পা সরাসরি মিতুলকে তার ঘরে নিয়ে গেল। ওকে বসতে বলে সে গেল কিছু খাবার আনতে। টুম্পার ফোনটা তার টেবিলের ওপরেই রাখা। একটু সতর্ক দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে মিতুল ফোনটা হাতে নিল। পাওয়ার বাটনে চাপ দিতেই ফোনে স্ক্রিনে ভেসে উঠল টুম্পাদের পারিবারিক একটা ফটো। সেখানে তার দৃষ্টি গিয়ে আটকাল রূপকের হাসিমাখা মুখটার ওপর। কী সুন্দর প্রাণোচ্ছল সেই হাসি! ফোন লক করা। সে তো আর পিন জানে না যে লক খুলে রূপকের নাম্বার নেবে। আশাহত হয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিল একদৃষ্টিতে। টুম্পা তখন চা আর বিস্কুট নিয়ে রুমে প্রবেশ করল। মিতুল তখনো সেটা খেয়াল করেনি।
“কী দেখছ?” চায়ের কাপ টেবিলে রেখে জানতে চাইল টুম্পা।
প্রথমে মিতুল হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“তোমাদের ছবি দেখছি। পাজি রাজকুমারও ছবিতে আছে দেখছি।”
বলে হাসল সে। টুম্পাও হাসিতে যোগ দিয়ে বলল,
“আমাদের পরিবারের সদস্য তো।”
“আচ্ছা তোমার ভাই হঠাৎ চীনে চলে গেল কেন?”
“ওমা! তুমি জানো না ভাইয়া যে ওখানে পড়াশোনা করে?”
“হুম জানি। কিন্তু ছুটিতে এলে তো মিনিমাম বেশ ভালো সময় নিয়েই আসে সবাই। সে এত দ্রুত চলে গেল যে?”
“ভাইয়া তো চাচ্চুর কাছে থাকে সেখানে। আমার চাচাতো বোন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হাসপাতালেও ভর্তি করা হয়েছে। ভাইয়াকে দেখার জন্য কান্নাকাটি করছিল। তাই বাধ্য হয়েই আগে চলে গেছে।”
“তোমার কাজিন কি ছোটো?”
“না, না। ভাইয়ার চেয়ে দু’বছরের ছোটো। ওদের তো প্রায় বিয়ে ঠিক বলা যায়। দু’পরিবারেরই মত আছে।”
মিতুল যেন বজ্রাহত হলো। টুম্পার কথাটা ঠিক বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। সে নিজেই এখন নিজেকে দোষারোপ করছে। কেন সে এখানে আসতে গেল? কৌতুহল, উত্তেজনা যদি চেপে রাখতে পারত তাহলে অন্তত এই তিক্ত সত্যটার মুখোমুখি তাকে হতে হতো না। কিছু সত্য এত পীড়াদায়ক কেন হয়? আশ্চর্য! তার এমন কেন লাগছে? কেমন অন্য এক অনুভূতি। এই অনুভূতির নাম কী? কষ্ট?
টুম্পা বিভিন্ন গল্প-গুজব করছিল। মিতুলের সেখানে মন নেই। সে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি এখন যাই টুম্পা। অনেক পড়া বাকি আছে।”
“আমারও পড়া আছে। আচ্ছা ঠিকাছে কাল আবার আড্ডা দেবো।”
মিতুল ম্লান হেসে মাথা নাড়াল। চুপচাপ নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়ল সে। এই অসময়ে রুমের লাইট বন্ধ করে শুয়ে থাকতে দেখে মমতা বেগম এলেন। লাইট জ্বালিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“মিতুল? কী হয়েছে?”
মিতুল গুটিসুটি হয়ে শুয়ে ছিল। মনমরা হয়ে বলল,
“মাথা ব্যথা করছে মা।”
“মেডিসিন আনব?”
“উঁহু! ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে।”
“তাহলে আয় খেয়ে নে।”
“পরে খাব আব্বু আর ভাইয়া আসলে।”
মমতা বেগম আর জোর করলেন না। লাইট বন্ধ করে আবার চলে গেলেন। মিতুল অবশ্য রাতে আর উঠল না খাওয়ার জন্য। সবাই অনেক জোরাজুরি করার পরও গভীর ঘুমের ভান ধরে সে জীর্ণশীর্ণ হয়ে শুয়ে রইল।
সকালে তার ঘুমও ভাঙল প্রতিদিনের তুলনায় আগে আগে। গতকাল রাতের মন খারাপের রেশ তার এখনো কাটেনি। সে অনেকটা জড়বস্তুর মতো ফ্রেশ হয়ে বই নিয়ে বসল। তবে পড়ত পারল না। কিছুতেই পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না। মনের ওপর আর প্রেশার না দিয়ে রেডি হয়ে সে ভার্সিটিতে চলে এলো। আসার পূর্বে মায়ের জোরাজুরিতে তাকে এক গ্লাস দুধ আর সেদ্ধ ডিম খেতে হয়েছে। রুটি-ভাজি খাওয়ার জন্য জোর করলেও মিতুল তা শোনেনি। সময়ের আগেই ভার্সিটিতে এসে ক্যাম্পাসের এক কর্ণারে একা একা বসে রইল সে। এখনো ক্লাসের কেউই আসেনি। সে চুপ করে বসে থেকে অতীতের অনেক কথাই ভাবছে।
টিচার্স রুম থেকে মিতুলকে বসে থাকতে দেখে নওশাদ। সে ঘড়িতে সময় দেখল। এত আগেই তো ওর ভার্সিটিতে আসার কথা নয়। সে এগিয়ে গেল মিতুলের কাছে। সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর পরও মিতুলের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। এর মানে কী? মিতুল কি তার উপস্থিতি টের পায়নি? অবশ্য মুখ দেখে ওকে ভীষণ চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। কিছু একটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছে। হয়তো এ কারণেই সে নওশাদের উপস্থিতি টের পায়নি। নিরবতা কাটিয়ে নওশাদ জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কি কিছু ভাবছ?”
ভাবনায় ছেদ পড়তেই চোখ তুলে তাকাল মিতুল। নওশাদকে দেখে একটুও অবাক হলো না। কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখাল না। ভাবলেশহীন বলল,
“না।”
“আজ এত তাড়াতাড়ি এসেছ যে?”
“এমনিই।”
“তোমাকে ভীষণ আপসেট দেখাচ্ছে। কী হয়েছে?”
“কিছু হয়নি।”
নওশাদ দীর্ঘশ্বাস নিল। মিতুলের কী হয়েছে না জানলেও কিছু যে একটা হয়েছে এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত। এটাও নিশ্চিত যে মিতুল তাকে আপসেট হওয়ার কারণ বলবে না। উপরন্তু নওশাদের সেই অধিকারও নেই যে সে জানার জন্য জোর করবে। সে চৈতিকে বিয়ে করবে বলে তো ফাইনাল ডিসিশন নিয়েই নিয়েছে। তবুও মিতুলকে দেখলে তার এমন কেন লাগে? এতটা মায়া সে কেন দেখতে পায় মেয়েটার মুখে? দেখলই যখন আগে কেন দেখল না? তাহলে হয়তো আজ অধিকারবিহীন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না। গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে একটা নীল রঙের কার্ড সে মিতুলের দিকে এগিয়ে দিল। মিতুল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“কী এটা?”
“আমার বিয়ের কার্ড।”
মিতুল হাত বাড়িয়ে কার্ড নিল। নওশাদ বলল,
“তোমার ইচ্ছেই পূরণ করছি। বিয়েতে আসবে তো?”
“চেষ্টা করব।”
“চেষ্টা কেন? শিওরিটি দিতে পারছ না?”
মিতুল কিছু বলল না। নওশাদ শ্রাগ করে বলল,
“ঠিকাছে। তোমার চেষ্টাটাই আমার জন্য অনেক কিছু। সবাইকে বিয়ের ইনভাইটেশন কার্ড দেওয়ার জন্যই আজ কলেজে এসেছি। আগামীকাল থেকে বিয়ের ছুটিতে থাকব। দেখা হবে না বেশ কয়েকদিন। ভালো থেকো।”
কথা শেষ করে নওশাদ উলটোপথে হাঁটা আরম্ভ করে। পেছন থেকে মিতুল বলে,
“শুভকামনা রইল।”
নওশাদ শুনলেও পিছু ফিরে তাকাল না। সে চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ মিতুল এখানে বসে রইল। বিয়ের কার্ড নেড়েচেড়ে দেখল। সেই মুহূর্তে তার রূপকের বিয়ের কথাটিও মনে পড়ে যায়। আনমনেই বিষন্নতা ফের পেয়ে বসল তাকে। সে উঠে দাঁড়াল ক্লাসে যাবে বলে। তখন অদূরে পেছন থেকে কারও কণ্ঠে তার নাম শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ফিরে দেখতে পায় তিশাকে। সে দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসছে মিতুলের কাছে।
চলবে..