#কোন_কাননের_ফুল_গো_তুমি
#পর্ব_১৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________
মিতুলের মন আজ ভীষণ খুশি। দু’সপ্তাহ্ পর গ্রাম থেকে আজ ঢাকায় ফিরছে সে। গ্রামে আসা হয়েছে হুট করেই। দাদির শরীর অসুস্থ ছিল। সবাইকে দেখার জন্য ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন তিনি। তার বয়স হয়েছে। হায়াত-মওতের কথা তো আর বলা যায় না। তাই অসুস্থতার কথা শুনে সকলেই ভড়কে গেছিলেন। মিতুলরা খবর পেয়ে সপরিবারে তাই গ্রামে ছুটে এসেছিল। দু’দিন বাদে দাদির শরীরের উন্নতি দেখে বাকিরা আবার ঢাকায় ফিরে এলেও মিতুল থেকে যায়। দাদির আবদার এবং কাজিনদের বায়না সে উপেক্ষা করতে পারেনি। তাই থেকে গেছিল। এই দুই সপ্তাহ্ তার ভালোই আনন্দে কেটেছে। স্কুলের বান্ধবীদের সাথে প্রচুর সময় কাটিয়েছে। কাজিনদের নিয়ে গ্রাম, ক্ষেত ঘুরে বেরিয়েছে। ইচ্ছেমতো নদীতে ডুবে জ্বরও বাঁধিয়েছিল। এসব স্মৃতি মন্থর করে এখন আবার কিছুটা খারাপ লাগছে তার।
টুটুল ওকে উদাসীন হয়ে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
“কিরে কী হয়েছে? খারাপ লাগছে?”
মিতুল ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“একটু।”
“অনেকদিন পর জার্নি করছিস। হতে পারে এজন্য।”
“কী জানি।”
বাড়ি ফেরার পথে তার মন হঠাৎ করেই রূপকের দেখা পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। গ্রামে যাওয়ার সময় দেখা হয়নি, যাওয়ার কথা বলাও হয়নি। এমনকি এই দু’সপ্তাহ্ তার রূপকের সঙ্গে কোনো যোগাযোগও হয়নি। এখানে সবাইকে নিয়ে এত হৈ-হুল্লোড় এবং ব্যস্ততার মাঝে সময় কেটেছে যে রূপকের কথা তার ঠিক করে মনেও পড়েনি সেভাবে।
বাড়ি ফিরে মা ও রিনভীর সঙ্গে দেখা করল আগে মিতুল। নিজের রুমে যাওয়ার সময় পাশের রুম থেকে আগত মানুষটার সঙ্গে ধাক্কা খেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল সে। পরক্ষণেই হেসে বলল,
“আরে আপনি! কেমন আছেন?”
ওপাশের মানুষটি অনিক। সে দুর্বোধ্য হেসে মলিন মুখে বলল,
“এইতো ভালো। তুমি কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
“কখন এসেছ?”
“মাত্রই এলাম।”
“আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও।”
বলে অনিক বাইরে চলে গেল। অনিকের আজকের ব্যবহার ভীষণ অন্যরকম। কেমন যেন দুঃখী, মনমরা মনে হচ্ছিল। অনেকদূর থেকে এসেছে বিধায় মিতুল ফ্রেশ হতে চলে গেল। গোসল করেই শরীর এলিয়ে দিল বিছানায়। কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে শরীরের আলসেমি ভাঙল। তবে ক্লান্তি কমেনি। একটা ঘুম দিলে ঠিক হয়ে যাবে। সে খেয়ে তাই ঘুমানোর চেষ্টা করল। বিছানায় শরীর এলিয়ে বালিশে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই দু’চোখে ঘুম ঝাপিয়ে পড়ে তার। এই ঘুম ভাঙল একদম বিকেলে। ঘুম থেকে ওঠার পর তার মেজাজ সবসময় বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। এটা কেন হয় সে জানে না। তবে এমনটাই হয়। তাই ভাবল ছাদ থেকে একটু ঘুরে আসবে।
হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রিজ থেকে একটা আইসক্রিম নিয়ে খেতে খেতে ছাদে যাওয়ার জন্য বের হয়ে। সিঁড়িতে তখন টুম্পার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। টুম্পা ভীষণ অবাক হয়ে পিছু ডাকল,
“আরে মিতুল আপু, কেমন আছো?”
মিতুলও টুম্পাকে দেখে আনন্দিত হয়ে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
“আমিও ভালো আছি। কবে এসেছ?”
“আজই। তুমি কোথায় গেছিলে?”
“প্রাইভেট পড়ে আসলাম।”
“ওহ আচ্ছা।”
দুজনে ওপরে উঠতে উঠতে কথা বলছিল। মিতুল তখন জিজ্ঞেস করেই ফেলে,
“তোমার ভাইয়া কেমন আছে?”
“ভালো আছে। ভাইয়া তো চীনে চলে গেছে।”
শুনে মিতুল ভীষণ অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল,
“কবে?”
“গত পরশু।”
“ওহ।”
টুম্পাদের ফ্ল্যাটের সামনে আসার পর টুম্পা বলল,
“ভেতরে আসো।”
মিতুল মৃদু হেসে বলল,
“না, একটু ছাদে যাব। তুমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।”
“ঠিকাছে।”
মিতুল আনমনেই হাঁটছে। তার মনটা হঠাৎ করেই এমন খারাপ হয়ে গেল কেন? আইসক্রিম গলে গলে পড়ছে।সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বাড়ি ফিরে যে সে রূপককে পাবে না এটা সে আশাও করেনি। ছাদে গিয়ে আইসক্রিমটা ফেলে দিল। আর খেতে ইচ্ছে করছে না। একটু দূর হেঁটে সামনে এগোতেই পুঁইশাক দেখে রূপকের কথা আরও গভীরভাবে মনে পড়ে যায় তার। সেই প্রথমদিনের কথা। এরপর ছাদে ঝগড়াঝাঁটি, খুনসুটি, একসাথে সময় কাটানো। সবকিছুই একে একে যেন চোখের দৃশ্যপটে ভেসে উঠছিল। মন এত চঞ্চল আর বেহায়া কেন? কেন সে এসব যেচে মনে করে কষ্ট পেতে চাইছে?
মিতুল আকাশের দিকে তাকিয়ে লম্বা শ্বাস নিল। পুঁইশাকের পাতায় হাত বুলিয়ে উলটোদিকে ঘোরার পর দেখতে পেল সিঁড়িঘরের বাম সাইডে অনিক রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মিতুল সেখানেই এগিয়ে গেল। রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আপনার কি মন খারাপ?”
অনিক অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। কোনো কথা বলল না। মিতুল উত্তরের আশায় অপেক্ষা করে আছে। আবার একই প্রশ্ন করা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। নাকি এখান থেকে চলে যাবে সেটাও সে বুঝতে পারছে না। সাহস সঞ্চয় করে বলল,
“কী হয়েছে আমায় বলা যাবে? বাড়িতে ঝগড়া করেছেন?”
এবারও কোনো উত্তর এলো না অনিকের পক্ষ থেকে। মিতুল বুঝতে পারল, সে যে অনিককে বিরক্ত করছে। আবার এটাও স্পষ্ট যে, অনিক কিছু একটা নিয়ে ভীষণ আপসেট। হয়তো সেটা মিতুলকে বলা যাবে না। সে প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে বলল,
“কী হয়েছে আমি তো জানি না। তবে যাই হোক, মন খারাপ করবেন না। হতাশও হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখবেন।”
এরপর সে চলে আসার জন্য উদ্যত হয়। তখনই রেলিঙের ওপর থাকা মিতুলের হাতের ওপর হাত রেখে চেপে ধরে অনিক। মিতুল চমকে তাকায় অনিকের মুখের দিকে। আরও বেশি সে চমকে যায় অনিকের আরক্তিম চোখ দুটো দেখে। ভাসা ভাসা চোখ দুটো থেকে এখনই বোধ হয় পানি গড়িয়ে পড়বে। ঠোঁট কাঁপছে অনবরত। করুণ ও বিষাদিত তার মুখখানা। আচমকাই অনিক মিতুলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে মিতুল। আমাকে ছেড়ে চলে গেছে!”
মিতুলের বুকটা হুহু করে উঠল। হঠাৎ এমন পরিস্থিতি কিংবা এমনকিছু শোনার জন্য তো সে প্রস্তুত ছিল না মোটেও।
চলবে।