কোনো একদিন পর্ব-৯+১০ এবং শেষ পর্ব

2
3199

#কোনো_একদিন
#পর্ব_৯ + ১০ (শেষ পর্ব)
#কলমে_অপরাজিতা_ইসলাম

“কবুল কবুল কবুল”

সবাই ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উঠলো।

কাঁপা কাঁপা গলায় মেহেক কবুল বলার পর একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলো।আজ থেকে মাসফি আর মেহেক একসাথে থাকবে ভাবতেই একটা জড়তা কাজ করছে মেহেকের মনে।আজ ১৫ই আগস্ট।গত কয়েকদিন প্রচুর ধকল গিয়েছে সবার উপর দিয়ে।অবশেষে মাসফি আর মেহেকের বিয়ে সম্পন্ন হলো।

মাসফি মেহেকের দিকে তাকিয়ে শুধু মুচকি হাসলো।

অন্যদিকে সিয়াম মাসফির পাশেই বসে ছিল।কিন্তু মেহেক কবুল বলার সময় উঠে চলে যায় অন্য এক দিকে।

“ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই।আজও যে ছেলেটা শত-শত মেয়ের হার্টবিট থামিয়ে দেয়,সেই ছেলেটা কাউকে ভালোবেসে কাঁদছে।আসলেই সিয়াম তোমার মতো করে সবাই ভালোবাসতে পারে না।কিন্তু কি বলো তো,আমাদের জীবনের প্রথম ভালোবাসাটা ভুল মানুষের সাথেই হয়।একটাবার কি আমাকে সুযোগ দেওয়া যাবে তোমার মনের রাণী হওয়ার জন্য?কথা দিচ্ছি আমিই তোমার জীবনের শেষ ভালোবাসা হয়ে দেখাবো।”

পেছন থেকে কারোর এমন কথা শুনে সিয়াম চমকে তাকালো।সামনে তুলিকে অশ্রুশিক্ত নয়নে তাকিয়ে থাকতে দেখে সিয়াম অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গিয়েছে।

“তুলি তুমি এখানে?”

“হুমম আমি।”

“তুমি কি বলছো এসব?”

“যা সত্যি সেটাই বলছি।”

“তুমি কি করে জানলে আমার আর মেহেকের ব্যাপারে?”

“ভালোবাসার মানুষের সব কিছুই তো জানতে হয় তাইনা?”

“একটু আগেই তুমি বললে না যে আমাদের জীবনের প্রথম ভালোবাসা ভুল মানুষের সাথে হয়।সেই একই ভুল তো তুমিও করেছো।কারণ আমি আর কাউকে ভালোবাসতে পারবো না।আর না কাউকে আমার জীবনে ঠাঁই দিতে পারবো।”

“তুমি যদি আমাকে সত্যি ভালোবেসে থাকো তাহলে আজ এখানেই তুমি তুলিকে বিয়ে করবে।ধরে নাও এটা তোমার ভালোবাসার মানুষের শেষ ইচ্ছে।”

মেহেকের কন্ঠ শুনে তুলি আর সিয়াম দুজনেই চকিত নয়নে তাকালো ওর দিকে।

“মেহেক তুমি এখানে কি করছো?”

“আমি এখানে এসেছি তোমাকে আর তুলিকে এক করতে।”

“সেটা কখনোই সম্ভব নয়।”

“কেন সম্ভব নয়?”

“কারণ আমার সমস্ত ভালোবাসা আমি একজনকেই উৎসর্গ করেছি।”

“সিয়াম, তুমি তো জানো মন ভাঙ্গার ক্ষত কতটা গভীর।সেই একই কষ্ট কি তুমি তুলিকেও দিতে চাও?”

মেহেকের কথা সিয়াম কি বলবে ভেবে পেল না।সত্যিই তো তুলির এখানে কোন দোষ নেই।তাহলে ওও কেন কষ্ট পাবে।

“আর একটা কথা,আমি এখন তোমার ভাইয়ের বউ।তাই তুমি চাইলেও আর কখনোই আমাকে পাবে না।কিন্তু তোমার এই কষ্ট আমি আর দেখতে পারছি না।নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে।আমিও যে ভালো নেই সিয়াম।প্রতিনিয়ত তোমার বিষন্ন মুখটা দেখে আমাকে আমার অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।তাই প্লিজ তুমি তুলিকে বিয়ে করে নাও।প্লিজ সিয়াম প্লিজজজজজ।”

মেহেকের কথায় বেশ অনেক্ক্ষণ চুপ করে থেকে সিয়াম ‘ঠিক আছে’ বলে হনহন করে স্টেজের সামনে গিয়ে দাড়ালো।মেহেক হালকে হেসে তুলির চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,

“নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে সব সময় আগলে রাখিস।”

তুলি কোনোকিছু না বলে মেহেককে জড়িয়ে ধরলো।মেহেকও আলতো করে তুলিকে জড়িয়ে ধরলো।কিছুক্ষণ পর মেহেক আর তুলিও গিয়ে স্টেজের সামনে দাড়ালো।

“আজ এখানে সিয়াম আর তুলির ও বিয়ে হবে।”

মেহেকের কথায় সব বেশ অবাক হলো।সিয়ামের মা মিসেস সাবিহা চৌধুরী বললেন,

“কিন্তু আজকেই কিভাবে?আর হুট করেই এই সিদ্ধান্ত কেন নিলে তোমরা?”

“আসলে আন্টি আমি আর তুলি চাই আমাদের বিয়েটা যেন একসাথেই হয়।আর এখানে তো সবাই উপস্থিত আছে।তুলির বাবা-মা ও আছে।আশা করি এতে কারো আপত্তি হওয়ার কথা না।”

মেহেকের কথায় সবাই সাই দিলে একই মঞ্চে মেহেক-মাসফি আর সিয়াম-তুলির বিয়ে সম্পন্ন হয়।মাসফিদের রুম আগেই সাজানো ছিল।কিন্তু সিয়ামদের জন্য সবাই দ্রুত আরো একটা রুম সাজিয়ে ফেলল।সবাই খাবার খাওয়া শেষ করে মেহেক আর তুলিকে নিয়ে ওদের দুজনের রুমে গিয়ে রেখে আসে।আজকে আর কারোর মজা করার কোনো ইচ্ছে নেই।কারণ সবাই অনেক বেশি ক্লান্ত।তাই রাত ১২টার আশেপাশেই সবাই ঘুমাতে চলে গেল।

মেহেক ঘোমটা দিয়ে বসে আছে।দরজা বন্ধ করার আওয়াজে মেহেক কেঁপে উঠল।মাসফি ধীরে ধীরে মেহেকের কাছে এসে বসলো।ঘোমটা তুলে মেহেকের দিকে তাকিয়ে বললো,

“মাই লাভ”

মাসফির কথা শুনে মেহেক লজ্জামাখা একটা হাসি দিয়ে মুখ নিচু করে নিলো।

“আমার লজ্জাবতীকে লজ্জা পেলে আরো বেশি সুন্দর লাগে।”

এটা বলেই মাসফি মেহেকের কপালে একটা ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো।এরপর বলল,

“এগুলো খুলে ফ্রেশ হয়ে অযু করে আসো।নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি চলো।”

মাসফির কথায় মেহেক মাথা নেড়ে একটা সুতির নীল রংয়ের জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।কিছুক্ষণ পর অযু করে এসে দেখলো মাসফি অন্য ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে অযু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে দাড়িয়ে আছে।মেহেক ও পাশের জায়নামাজে গিয়ে দাড়ালো।নামাজ পড়ে মাসফি আর মেহেক বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো।

মেহেক মাসফির দিকে তাকিয়ে বলল,

“আচ্ছা মাসফি তোমার কাছে ভালোবাসা কী?কিভাবে দেখো তুমি ভালোবাসা নামক এই শব্দটিকে?ভালোবাসা বলতে তুমি কি বোঝো?”

মেহেকের কথায় মাসফি বারান্দার রেলিংয়ে হাত রেখে বলল,

“ভালোবাসা শব্দটা যতটা ছোট এর ব্যাখ্যা ঠিক ততটাই বিশাল।ভালোবাসা মানে আবেগ,অনুভূতি,মায়া,মোহ,ভালোলাগা,মান,অভিমান,এই সবকিছুর সংমিশ্রণ।একেক জনের কাছে ভালোবাসার ব্যাখ্যা একেক রকম।তবে আমার কাছে ভালোবাসা মানে সবসময় ভালো থাকা,প্রিয় মানুষটিকে ভালো রাখা।ভালোবাসার মানুষটিকে সব সময় আগলে রাখা।এমনভাবে ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে রাখা যেন আমার ভালোবাসার মানুষটা কখনো আমাকে ছেড়ে না যেতে পারে।আমি হয়তো তোমাকে ১০০% ই ভালো রাখতে পারবো না।কারণ,সব সম্পর্কেই যেমন ভালোবাসা থাকে তেমনি মান-অভিমান ও থাকে।কিন্তু আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো যেন তোমাকে ভালো রাখতে পারি।তোমার মুখ থেকে যেন কখনোই মিষ্টি হাসিটা হারিয়ে না যায় সেটা খেয়াল রাখার দায়িত্ব আমার।তুমি হয়তো আমাকে অনেক কারণেই ভুল বুঝেছো,হয়তো ভবিষ্যতেও ভুল বুঝবে।সেটা আমাকে বলবে।আমার থেকে কৈফিয়ত চাইবে যে কেন আমি এমনটা করেছি।কিন্তু প্লিজ কখনো আমাকে ছেড়ে যেও না।আমি তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি।তুমি আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা।আর তুমিই আমার জীবনের শেষ ভালেবাসা।আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত শুধু এবং শুধুমাত্র তোমাকেই ভালোবাসবো।তোমাকে কখনো ঠকাবো না কথা দিলাম।”

এটা বলেই মাসফি পেছন থেকে মেহেককে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিল।মেহেক মাসফির ছোঁয়া পেলে চোখ বন্ধ করে ফেলল।হঠাৎই মাসফি মেহেককে ঘুড়িয়ে এক হাত চুলের মধ্যে ঢুকিয়ে অন্য হাতে কোমড় পেচিয়ে ধরল।আর তারপর মেহেকের কাঁপতে থাকা ওষ্ঠদ্বয় নিজের অধীনে নিয়ে নিল।মেহেক পরম আবেশে মাসফির টিশার্ট খামচে ধরলো।বেশ কিছুক্ষণ পর মাসফি মেহেককে ছেড়ে দিয়ে দু’জনেই হাঁপাতে লাগলো।মাসফি আবারো মেহেকের কাছে এসে ওকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলে মেহেকের ডক্টর হৃদির কথাগুলো মনে পড়ে যায়।মেহেক মাসফির দিকে তাকিয়ে বলল,

“মাসফি হৃদি আপুর কথাগুলো মনে আছে তো?”

মেহেকের কথায় মাসফির মুখটা কালো হয়ে হেল।মাসফি মাথা নেড়ে কোনোকিছু না বলেই বাইরে বেরিয়ে গেল হনহন করে।মেহেক কিছু না বলে অপলক দৃষ্টিতে মাসফির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।কিছুক্ষণ দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠিকভাবে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল মেহেক।

_____________________________

সিয়াম আর তুলি নফল নামাজ পড়ে বিছানায় পাশাপাশি বসে আছে।কারো মুখেই কোনো কথা নেই।বেশ কিছুক্ষণ পর নিরবতা কাটিয়ে সিয়াম বলল,

“দেখো তুলি তুমি সবটাই জানো।সবটা জানার পরেই আমাকে বিয়ে করেছো।কিন্তু আমি এখনো শুধু মেহেককেই ভালোবাসি।ওকে ভুলে যাওয়া আমার জন্য এতটাও সহজ না।কারণ মেহেক আমার প্রথম ভালোবাসা।আমি জানিনা কখনো তোমাকে ভালোবাসতে পারবো কিনা।তবে একটা কথা দিতে পারি।যদি তোমার কথা অনুযায়ী সত্যি আমার জীবনে শেষ ভালোবাসা বলতে কিছু আসে তাহলে সেদিন আমি তোমাকে নিজে থেকে কাছে টেনে নিব।ততদিন অবধি তুমি আর আমি সাধারণ কাপলদের মতোই থাকবো।কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো শারীরিক সম্পর্ক হবে না।আশা করি তুমি আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছো।”

তুলি একধ্যানে সিয়ামের কথাগুলো শুনছিল।

“সিয়াম তুমি যেদিন ফার্মহাউসে মেহেককে ‘ভালোবাসার সজ্ঞা’ বলছিলে তখনি আমি গিয়ে সেখানে উপস্থিত হই।সেদিনই আমি জানতে পারি তুমি মেহেককে ভালোবাসো।বিশ্বাস করো,সেদিন যেন আমার পুরো পৃথিবী উল্টে গিয়েছিল।কারণ আমি তোমাকে আজ থেকে নয় বরং আরো দুই বছর আগে থেকেই ভালোবাসি।এতদিন বলিনি ভয়ের জন্য।যদি তুমি আমাকে না করে দাও আর আমার সাথে বন্ধুত্বটাও নষ্ট করে দাও এই জন্য।কিন্তু সেদিন যখন তেমার কথাগুলো শুনলাম তখন বুঝতে পারলাম তোমার জীবনে আমাকে আসতেই হবে।আর কিছু নাই বা পারলাম।অন্তত আমার ভালেবাসা দিয়ে তোমার অগোছালো জীবনটাকে গোছালো করে দিতে তো পারবো।এতেই হবে আমার।তোমার জীবন সঙ্গিনী হতে পেরেছি।তাতেই আমি খুশি।আমার আর কিচ্ছু চাই না।তোমার যতদিন সময় লাগে তুমি নাও।কিন্তু দয়া করে আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ।আমি তোমাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ।একটা কথা কি জানো,না পাওয়ার থেকে পেয়ে হারানোর কষ্ট অত্যাধিক।সেই যন্ত্রণা সহ্য করার মতো ক্ষমতা আমার নেই।তাই প্লিজ আর কিছু না পারো,শুধু আমার পাশে থেকো প্লিজ।”

তুলির এমন কান্না জড়িত কথা শুনে খুব মায়া হচ্ছে সিয়ামের।এখন ওর মনে হচ্ছে,কেন মেহেককে না ভালোবেসে প্রথমেই তুলিকে ভালোবাসলো না!

“সিয়াম তোমার বুকে আমাকে একটু জায়গা দিবে?”

তুলির এমন আকুতি ভরা কন্ঠ শুনে একটানে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো তুলিকে।তারপর তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“আমাকে একটু সময় দাও।যত দ্রুত সম্ভব তোমাকে আমি তোমার প্রাপ্য সম্মান এবং ভালোবাসা দিয়ে নিজের করে নিব।শুধু আমাকে একটু সময় দাও।”

তুলি সিয়ামকে আলতো হাতে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

“তোমার যত সময় লাগে তুমি নাও।আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি মৃত্যুর আগ অবধি অপেক্ষা করতে রাজি আছি।ততদিন পর্যন্ত শুধু এমন করেই আমাকে বুকে আগলে রেখো তাহলেই হবে।”

সিয়াম মুচকি হেসে আরো শক্ত করে তুলিকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল।তুলিও পরম আবেশে নিজের প্রিয় মানুষটার বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্ত মনে চোখ বন্ধ করে নিল।

চলবে?

বিঃদ্রঃ এত বড় পর্ব মনে হয় আজকেই প্রথম দিলাম।আর হ্যা গল্পটা আর মাত্র তিন/চার পর্বেই শেষ করে দিব।

ধন্যবাদ🥰

#কোনো_একদিন
#পর্ব_১০(শেষ পর্ব)
#কলমে_অপরাজিতা_ইসলাম

দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে চারটি মাস।এই চার মাসে অনেক কিছুই হয়েছে।রাজ আর তাহার এনগেজমেন্ট হয়েছে গত মাসে।সানভি আর মিহি এখনো চুটিয়ে প্রেম করছে।খুব শীঘ্রই বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবে তারা।তাহার সেই বিষাক্ত অতীত জেনেও রাজ তাহাকে সাদরে গ্রহন করেছে।

তাহা গ্রামের মেয়ে ছিল।মা ছিল না ওর।বাবা দ্বিতীয় বার বিয়ে করার পর সৎ মা মোটেও ওকে সহ্য করতে পারতো না।একদিন তাহা কোচিং করে বাড়ি ফিরছিল।তখনই কয়েকটা বখাটে মিলে তাহাকে নিয়ে যায় তাদের আস্তানায়।তাহা চিৎকার করেও ওদেরকে থামাতে পারেনি।কিন্তু ঠিক সেই সময় সেখানে রাজ গিয়ে হাজির হয়।সেদিন রাজ ওর বন্ধুর বাসায় ঘুরতে গিয়েছিল।তখনই একটা মেয়ের আওয়াজ পেয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়।এরপর তাহা সব কথা রাজকে বলতে না পারলেও রাজের জোরাজুরিতে বাধ্য হয় ওর অবস্থা বলতে।সেদিন রাতেই তাহাকে নিয়ে রাজ ওদের বাসায় আসে।রাজের পরিবার তাহাকে নিয়ে কোনো ঝামেলা করেনি।এরপর থেকেই রাজ ধীরে ধীরে তাহা নামক এই মিষ্টি মেয়েটার প্রেমে পড়ে যায় রাজ।এই ছিল তাহা আর রাজের কাহিনী।

অন্যদিকে সিয়াম আর তুলির সম্পর্কটা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও মেহেক-মাসফির জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অমাবস্যা।কিছুদিন আগে মাসফির সাথে মেহেক যে মেয়েটাকে সেদিন দেখেছিল সেটার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।তখন থেকেই মাসফির থেকে মেহেককে আলাদা করে নিয়েছে মেহেকের পরিবার।মেহেক সেদিন কোনো প্রতিবাদ করেনি।বরং একটা রোবটের মতো হয়ে ছিল।মাসফির দিক থেকে সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।মাসফি মেহেককে ছাড়া যেন প্রাণহীন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে এক প্রকার।অনেক যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি।এক প্রকার নিজেকে ঘর বন্দি করে নিয়েছে।

বিকেল তিনটার দিকে দরজায় কারো আওয়াজের শব্দে মাসফির ঘুম ভেঙ্গে যায়।ওও উঠে গিয়ে দেখলো তুলি হাতে একটা খাম নিয়ে দাড়িয়ে আছে।

“কি হলো?এখানে কি করছিস তুই তাহা?”

“তোর সাথে আমি এখানে গল্প করতো আসিনি।এসেছি এই খামটা দিতে।আজ একজন কুরিয়ার ম্যান এসে এটা দিয়ে গিয়েছে।”

গম্ভীর কন্ঠে জবাব দিল তাুলি।মাসফি হতাশ হয়ে তুলির হাত থেকে খামটা নিয়ে বলল,

“কে পাঠিয়েছে?”

“সেটা নিজেই দেখে নে।”

এটা বলেই তুলি চলে গেল।এরপর মাসফি দরজা লাগিয়ে দিয়ে খামটা খুলল।তিন টা আলাদা আলাদা কাগজ।প্রথম কাগজটা খুলে মাসফির মাথায় যেন বাজ পড়লো।কারণ সেখানে ডিভোর্স পেপার।কিন্তু কারোর সই নেই।ওও তারাতাড়ি করে দ্বিতীয় কাগজটা খুলল।সেখানে লেখা আছে,

“ডিয়ার মাসফি,আজ তুমি আমার পরিচয় পাবে।
প্রথমেই বলে রাখি সেদিনের ভিডিও ক্লিপটা আমিই ভাইরাল করেছি আর সেটা যে ফেক ছিল তা তো তুমিও জানো আর আমি তো জানিই।কারণ সবটাই তো আমার প্ল্যান ছিল।সেদিন লিফটে মেয়েটা তোমাকে বলে ওর চোখে কিছু পড়েছে তাই একটু দেখতে।তুমিও সরল মনে সেটাই করলে।আর তখনই মেহেকের আগমন ঘটলো।আসলে সেখানে সিসি টিভি ও লাগানো ছিল।বেচারা তুমি এসব কিছু না জেনেই ফেসে গেলে।এটা তো শুধু সমাজের চোখে তোমাকে ছোট করার একটা ট্রেইলার মাত্র।

এরপর আসি মেহেক আর তোমার ফিজিক্যালি ইনভল্ভ হওয়ার ব্যাপারে।সেটাও আমার পূর্ব পরিকল্পিত ছিল যাতে তুমি মেহেকের কাছে আসতে না পারো।ডক্টর হৃদি আমাকে সাহায্য করেছে।কারণ সে জানতো আমি ভুল কিছু করবো না।

এখন তো আসল ধামাকার কথাটা তোমাকে জানাবো।ফাইরুজ খান ফায়াজ আমার একমাত্র বড় বোনের বর ছিল।তাহলে চলো তোমাকে আসল ঘটনা টুকু খুলেই বলি,

২০১৭ সালে আমার বড় আপু জানায় সে ফায়াজ ভাইয়াকে ভালোভাসে।তারা দু’জন বিয়ে করতে চায়।ফায়াজ ভাইয়া অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে।তাই আমার বাবা-মাও আর না করেনি।তাদের ভাইয়াকে দেখে মায়া হয়েছিল।তবুও আমি ভাইয়ার সম্পর্কে সবকিছুর খোঁজ-খবর নেই।তখনো আমরা কেউ জানতাম না যে ভাইয়া একজন মাফিয়া কিং।তো বিয়ের বেশ কয়েক মাস পর আপু এই কথাটা জানতে পারে।তখন আপু আমাকেও এটা জানায় যে ভাইয়া একজন মাফিয়া।সেদিন আপু আর আমি দু’জনই ভাইয়ার সাথে কথা বলি।আসলে কি বলো তো,আমরা চোখের সামনে যা দেখি সেটা কখনো কখনো ভুল প্রমানিত হয়।ফায়াজ ভাইয়াকে এই জগতে তোমার প্রাণ প্রিয় বন্ধু আয়ান এনেছিল।ফায়াজ ভাইয়া,আয়ান আর তুমি ছিলে বেস্ট ফ্রেন্ড।কিন্তু আয়ান ছিল একটা কালসাপ।তুমি যে ফাইলটার জন্য নিজের বন্ধুকে মারলে,আসলে সেটা আয়ানের পরিকল্পিত প্ল্যান ছিল যাতে করে তুমি ফায়াজকে মারো।আর পরবর্তীতে আয়ান তোমার বিশ্বাস যুগিয়ে ঐ ফাইলটা নিয়ে তোমাকে মারতে পারে।ভাবতে পারছো?তুমি কত বড় গোলক ধাঁধায় আটকে আছো।তুমি এতো বুদ্ধিমান হওয়া সত্বেও বোকার উপাধি পেলে আজ।আর কি বলো তো,তুমি যেদিন ভাইয়াকে মেরে ফেললে সেদিন আপুর কোল জুড়ে ওদের ভালোবাসার একমাত্র সন্তান ‘ইমিরা ইরজা’এই পৃথিবীতে আসে।আপু যখন ভাইয়ার মৃতদেহটা দেখলো তখন পাথর হয়ে গিয়েছিল।আমি তখন লেখাপড়ার জন্য সিংগাপুরে ছিলাম।আপু মানসিকভাবে অনেক ভেঙে পড়ে।কারণ ভাইয়া আর আপু একে-অপরকে নিজের থেকে বেশি ভালেবাসত।আমি এই ঘটনার পর আপু আর ইরজাকে সিংগাপুরে নিয়ে যায় নিজের কাছে।কিন্তু আপু ভালো নেই আজও।প্রতিনিয়ত ভাইয়ার জন্য ছটফট করে।আমি শুধু দেখেছি কিন্তু কিছুই করতে পারিনি।কারণ আপুর মুখের হাসিটা একমাত্র ভাইয়া নিজে ফিরিয়ে দিতে পারতো।কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়।তোমার একটা ভুলের জন্য আমার বোনের মুখের হাসি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।আমার চোখের মণি ইরজা জন্মের পরপরই নিজের বাবার মৃতদেহ দেখেছে।বাবার ভালোবাসা পায়নি।আচ্ছা তোমাদের শত্রুতার জন্য আমার বোন আর তার মেয়ে কেন ভালোবাসাহীন নিষ্প্রাণ হয়ে দিন কাটাচ্ছ?জানি কোনো উত্তর নেই তোমার কাছে।মেহেককে ছাড়া তুমি যেমন ভালো নেই,প্রতি মুহূর্তে গুমরে মরছো তেমনি আমার বোনটাও ভালো নেই।তার জন্য আজ আমিও ভালো নেই।এই এত এত পাপের ফল তো তোমাকে পেতেই হবে তাইনা?এখন প্রতিটা প্রহরে তুমি উপলব্ধি করতে পারবে যে ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে একা একা জীবন কাটানো কতটা কষ্টের।আমিও তোমাকে তিলে তিলে শেষ হয়ে যেতে দেখতে চাই।কারণ আমার বোনটাও যে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে।

শেষ ধামাকার জন্য তৃতীয় চিঠিটা খোলো।”

ইতি,
‘ব্ল্যাক রোজ’

মাসফির মাথা কাজ করছে না।একদিনে এত এত ধামাকা ওর মাথা মেনে নিতে পারছেনা।তবুও শেষ চিঠিটা খুলল।

“প্রেগন্যান্সির পজিটিভ রিপোর্ট”

নিচে মেহেকের নাম লেখা।তার নিচে কিছু লেখা দেখতে পেল মাসফি,

“তেমার জন্য বড় চমক হলো তুমি বাবা হবে অথচ তার অনুভূতি কষ্টদায়ক হবে।কারণ তোমার সন্তানকে তুমি কখনোই কাছে পাবে না।ভাবছো তো এটা কিভাবে সম্ভব?আসলে একদিন তুমি ড্রিংক করার ফলে নিজের মধ্যে ছিলে না।আর সেদিন আমিও তেমাকে আমার কাছে আসতে বাঁধা দিতে পারিনি।কারণ ভালো তো আমিও কোনো একটা সময় বেসে ফেলেছি।তোমাকে ভালেবাসতে চাইনি।আমি তো প্রতিশোধের জন্য তোমার কাছে গিয়েছিলাম।কিন্তু কখন যে ভালবেসে ফেললাম নিজেও বুঝতে পারিনি।যখন বুঝতে পারলাম তখন আর কিছু করার ছিল না।আশা করি এতোক্ষণে বুঝে গিয়েছো এই এতকিছুর পেছনে আসল ব্যক্তি টা কে? হ্যা ঠিকই ধরেছো,আমিই সেই ‘ব্ল্যাক রোজ’।এখন শুধু তুমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবে।কিন্তু আমার বা আমাদের সন্তানের দেখা কখনোই পাবে না।আমার কাছে অন্যায়ের কোনো ক্ষমা নেই।তোমার জন্য আমি আমার আপুকে কষ্ট পেতে দেখেছি।তাই তোমাকে মাফ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।আমি আমার অনাগত সন্তান এবং আপু আর ইরজাকে নিয়ে তোমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে এসেছি।তাই আর খুঁজেও লাভ হবে না।আমি আমার কথা রেখেছি।আজ ইরজার জন্মদিন।এই দিনেই ফায়াজ ভাইয়া আমাদেরকে ছেড়ে না ফেরার চলে গিয়েছে।আর আজকের এই দিনেই তুমিও নিজের ভালোবাসাকে হারিয়ে একা হয়ে গেলে চিরদিনের মতো।

পরিশেষে একটা কথায় বলবো,

“আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেই তোমার সব অন্যায় মেনে নিব না।ভালো তো দূর থেকেও বাসা যায়।আজ আমি হয়তো তেমার সাথে নেই।কিন্তু তোমার আর আমার ভালোবাসার একমাত্র প্রতীক আমার সাথে আছে।হ্যা,আমাদের একটা ফুটফুটে মেয়ে হবে।তাকে নিয়েই আমি বাকিটা জীবন কাটাতে পারবো আপুর মতো।কিন্তু তুমি এক অদৃশ্য আগুনের জলন্ত লাভায় জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে।আমি চাইলেই আর পাঁচটা মেয়ের মতো তোমাকে মেনে নিতে পারতাম।কিন্তু আমার কাছে যে অন্যায়কারীদের কোনো মাফ নেই।আমার কাছে ‘ভালোবাসার সজ্ঞা’ মানে বহুদূরে থেকেও ভালোবেসে একে-অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও জীবনে বাঁচা যায়।বাঁচতে শিখতে হয়।আমিও নাহয় আপুর মতো করে তোমার স্মৃতি আর আমাদের মেয়েকে নিয়েই বাকিটা জীবন বাঁচব।

আর হ্যা ডিভোর্স পেপারে আমি সিগনেচার করিনি।কারণ তোমাকে নতুন করে জীবন শুরু করতে দিবো না আমি।তুমি ডিভোর্স পেপার নিয়ে শুধু দেখবে এটাই চাই আমি।কারণ আমি যে তোমাকে অন্য আর কারোর হতে দিতে পারবো না।তোমাকে যে শাস্তি-ই দেই না কেন,দিনশেষে তুমি শুধু আমার এবং আমারই!”

চিঠিটা পড়েই মাসফি ধপ করে মাটিতে বসে পরলো।দুই চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরছে।আজ নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে।কি থেকে কি হয়ে গেল সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না ওও।শুধু এটুকু বুঝতে পারছে,মেহেক আসলেই অনন্য।মাসফি আপাতত কিছু ভাবার অবস্থায় নেই।কিছুক্ষণের মধ্যেই ওও হঠাৎ পড়ে গেল মাটিতে।

দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা পর মাসফি চোখ খুলে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করে।হাতে ক্যানোলা লাগানো।চারপাশে সবাই দাঁড়িয়ে আছে।সবার চোখেই পানি।

মাসফিকে বিকালে সিয়াম ডাকতে গিয়ে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে বারবার ডাকতে লাগে।তাতেও কোনো কাজ না হওয়ায় দরজার ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঢুকে মাসফিকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে সিয়াম চিৎকার করে সবাইকে ডাক দেয়।তখনই ওকে হসপিটালে আনা হয়।তারপর ওর পাশে পড়ে থাকা চিঠিটা পড়ে আর কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে আসলে কি হয়েছে।

মাসফি কোনোকিছু না বলে চুপ করে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।আর মনে মনে একটা কথায় আওরাতে লাগে,

“ভালোবাসি বলেই ভুলতে পারি না।”

অপর পাশে মেহেকও নিজের পেটে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে,

“ভালোবাসি বলেই ভুলতে পারি না।”

সমাপ্ত।

2 মন্তব্য

  1. Tomar golpo sotti aladai dhoroner. Prothome mone hochhilo j sob kichu ekdom simple , kintu joto porlam toto eta jotil theke jotilotoro hoye gelo.
    Keep writing👍

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে