#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
শেষ পর্ব
কোর্ট কাচারির চক্কর কাটছে সাখাওয়াত আজ প্রায় দু মাসের মত। বড় দাদা প্রায়ই বাড়ি বয়ে এসে অর্ণবকে হাজারো ছলাকলা বুঝিয়ে কেস উঠিয়ে নিতে বলে৷ সে বরাবরই সহজ মুখে জবাব না দিয়ে এড়িয়ে যায়। এই কেস চলবে ঠিক ততদিন যতদিন না অর্ণব নিজের পরিকল্পনা মত সব গুছিয়ে নিতে পারছে। তাইতো নুপুরকে এক রাতে খুব যত্ন করে বুকে টেনে নিলো। স্নেহমাখা সুরে খুব করে বোঝালো তারা অন্য এক জগতে চলে যাবে ছোট্ট এক সংসার গড়তে তাতে কি নুপুর খুব কষ্ট পাবে?
এরই মাঝে অর্নির জীবন পরিবর্তন হয়েছে অনেক। সে ফিনল্যান্ড পৌঁছে ক্লাস করেছে মাত্র এক সপ্তাহ এরই মধ্যে এক ক্লাসফিলোর সাথে ভাব হতেই পার্ট টাইম জব পেয়ে গেল। রিদওয়ান প্রথমে একটু দোনোমোনো করলেও পরে মেনে নিলো। উন্নত বিশ্বে নিজ অর্থায়নে চলাটাই যেন সুন্দর, সহজ বাস্তবতা তদুপরি রিদওয়ান চেষ্টায় আছে এদিকে শিফট হওয়ার। অর্নি রিদওয়ান দুজনেই অধীর আগ্রহে দিন কাটাচ্ছে কবে তাদের একসাথে হওয়ার সুযোগ মিলবে! এক আব্বু ছাড়া বাকি সবার সাথেই যোগাযোগ এখন স্বাভাবিক৷ বৃষ্টি চেষ্টায় আছে স্কলারশিপের সুযোগ হলেই সেও চলে যাবে ইউরোপের কোন এক দেশে। রিমনও চট্টগ্রামের ব্যবসাতে স্যাটেল হওয়ার জন্য নিদারুণ পরিশ্রম করছে। অন্তত সেখানকার ব্যবসায় নিজের একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারলে নাজনীনকে বিয়ের কথাটা জানাতে পারবে৷ ততদিনে নাজনীনেরও পড়াশোনা শেষ হবে আব্বুও তার ওপর যথেষ্ট ডিপেন্ডেবল হবে। রিমন প্রায়ই ভাবে সে তার বাবার যথার্থই যোগ্য সন্তান নইলে এতোটা স্বার্থ সিদ্ধি করেও সকলের মন রক্ষা করতে পারতো না অথচ ভাইয়া মানুষটা আগাগোড়াই আবেগি ঠিক তাদের আম্মুর মত।
_____
আজ শুনানির তারিখ এবং আশা করা যাচ্ছে আজই কেসের ইতি ঘটবে। সকাল নয়টা নাগাদ কোর্টে এসে পৌঁছেছে অর্ণব সাথে তার উকিল এবং তার একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষী ম্যানেজার আঙ্কেল। কোম্পানি বিক্রির পর মোটা অঙ্কের একটা এমাউন্ট দিয়ে ভদ্রলোককে মার্কেটে পুঁজিসহ দোকান করে দিয়েছে সে। নুপুরের বাবাও একবার জামাইর সঙ্গে কোর্টে আসতে চাইলে বলে অর্ণব বারণ করেছে। খুব সকালে খালামনিও ফোন করে দোয়া করলেন যেন সব ভালোয় ভালোয় মিটে যায়। অর্ণব অবশ্য মন থেকে চাইলো ভালো কিছু না হোক যা হয় সবটা তার মনের চাওয়া মতোই হোক। শেষটা সুন্দর হোক ভয়ংকর সুন্দর! ঠিক বারোটায় শুরু হলো অর্ণব চৌধুরীর কেসের শুনানি আসামিপক্ষ সাখাওয়াত চৌধুরী দাড়িয়ে আছে কাঠগড়ায়। দু পক্ষের উকিলের মৌখিক সংঘর্ষ খুব বেশিক্ষণ চলেনি। বলা চলে, চলতে দেয়নি অর্ণব। আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার উকিলকে কেস হালকার ওপর ছেড়ে দেবে এতে সাখাওয়াতের যদি জেল নাও হয় চলবে। এমন কথা শুনে উকিল সাহেব বোকার মত চেয়ে রইলেন অর্ণবের দিকে। এ কেমন মক্কেল তার! জিতের কোন আগ্রহই নেই। তবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই কেসে টাকা তিনি জেতার জন্য পাচ্ছেন না এই কেসের উদ্দেশ্য কিছু মূল্যবান সময় নষ্ট করা। ফলাফল তাই হলো। সাখাওয়াত চৌধুরীর নামে জরিমানা হলো যা টাকায় উসুল হলো৷ কেস শেষ! দীর্ঘ দু মাসের কোর্টে আসা-যাওয়া নিছকই খেল! সাখাওয়াত চৌধুরী বুঝতেই পারলেন না অর্ণব এত বোকা কেমন করে? তাকে আরো বিশ্রিরকম ফাঁসানোর সুযোগ তো ছিল তার কাছে। আর অর্ণব তার স্ত্রীর ধর্ষণের মামলাটা থামিয়ে দিলো কেন? অর্ণব তো এতদিনে সবই জেনে গিয়েছে নিশ্চয়ই তাইতো তিনি ছেলেকে ট্যুরের নামে দু মাস আগেই মালদ্বীপ পাঠিয়ে দিয়েছেন। কত কত টাকা নষ্ট করে ফেলল হারামজাদা এই দু মাসেই। ওর নামে তো কোন কেসই আগালো না উল্টো অর্ণব নাকি সেই কেস ক্লোজ করিয়ে দিয়েছে। অযথাই বদমাশটাকে বাঁচানোর নামে লাখ লাখ টাকার জলাঞ্জলি দিলো! আজই বলতে হবে ওটাকে ফিরে আসতে বরং তিনিই ফিরতি টিকেট কনফার্ম করাবেন। করা হলো টিকেট কনফার্ম। মিনার দেশে ফিরলো তিন দিনের মাথায় তারপর থেকেই সে স্বাভাবিকভাবে এদিক সেদিক ঘুরতে ফিরতে লাগলো।
________
দীর্ঘ দু মাস বাপের বাড়ি থাকার পর আজ নুপুর ফিরে যাচ্ছে নিজের বাড়িতে৷ যে বাড়িতে তার বিয়ের পর থাকার মেয়াদকাল ছিল দেড় মাস। অর্ণব মাস দুই আগে যখন বলল, তাদের ছোট্ট এক সংসার হবে ছোট্ট এক বাড়িতে নুপুর ভেবেছিল অর্ণব হয়তো ছোট একটা ফ্ল্যাট কিনে নিয়ে যাবে তাকে। আর তাইতো রুজিনা খালাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো, দারোয়ান চাচাও নাকি এ মাসে চলে যাবে অন্যকোথাও। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো এ দু মাসে অর্ণব সপ্তাহে দু তিন বার করে এসেছে কিন্তু প্রত্যেকবারই সে থেকেছে মাত্র কয়েকঘন্টা। সন্ধ্যে থেকে রাত দশটা এরপর আর তার টিকিটিও খুঁজে পায়নি নুপুর। মাঝেমাঝেই তার ইচ্ছে হতো লোকটা থাকুক আজ থাকুক রাতটা। এত অল্প সময়ে এলে দেখেও তৃপ্তি হয় না। সরাসরি কিছু না বললেও প্রায়ই ইঙ্গিত দিয়েছে সে থাকার। লোকটা বুঝেও না বোঝার ভান করে চলে গেছে। আর আজ কিছু না জানিয়েই এসে বলছে চলো নুপুর বাড়ি যাবে। হুট করে এ কেমন আবদার। বাবা বললেন রাতটা থাকো তাও শুনলো না। যাওয়ার আগে কিছু সময় আলাদা করে কোন বিষয়ে আলাপও করে গেল সে। বাড়ি ফিরতেই অর্ণব বলল, “ওয়েলকাম ফর দ্য লাস্ট নাইট ইন ইউর প্যারাডাইস! উমম… হেল।”
নুপুর অবাক হয় খুব তবুও প্রশ্ন করে না। অর্ণব বাড়ির খোলামেলা সকল দরজা, জানালা লক করতে করতে নুপুরকে ডেকে বলে এক মগ কফি করো তো। মিনিট দশেকের মাঝেই সে দু মগ কফি নিয়ে ডাইনিংয়ে আসতেই অর্ণবকে দেখতে পায় স্টোর রুম থেকে বের হচ্ছে।
-কফি
-বেডরুমে নিয়ে যাও।
-হাতে ওটা কি?
-কোরবানির গরু কাটার হাতিয়ার।
চমকে যায় নুপুর। এমন রহস্যজনক লাগছে কেন অর্ণবের কথা আজ! তখন কি বলল শেষ রাতের জন্য এ বাড়িতে!
-আমার আপনাকে ভয় লাগছে।
অর্ণব এগিয়ে এসে হাতের পেঁচানো হাতিয়ারটা টেবিলের ওপর রাখে৷ নুপুরে চিবুক ছুঁয়ে মুখটা উঁচু করে নরম স্পর্শ আঁকে তার কপালটাতে।
-তুমি আমায় ভয় পেলে জীবনটাই যে বৃথা যাবে সোনা। ভালোবাসার চোখে শুধু ভালোবাসাই দেখতে চাই। ভয় নেই এসব হাতিয়ার শুধু জন্তুদের জন্য ব্যবহার হয় আর বউয়ের জন্য তো শুধু এটা।
কথাটা বলেই অর্ণব ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় আলতো করে। নুপুরের তবুও ভালো লাগছিলো না। এতোটা ভিন্ন আচরণ আগে তো কখনো দেখেনি সে৷ নুপুরের হাতের দুটো মগই তুলে নিয়ে তাকে জানিয়ে দেয়, তোমার ঘুম প্রয়োজন কফি খেতে হবে না। আমি একটু কাজ করব নিচে বসেই। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো গিয়ে।
নুপুর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে যায় ঘুমুতে। ঘুমিয়েও পড়ে অল্প সময়ে। মধ্যরাতে হঠাৎই তার কানে বাজে অর্ণবের ডাক।
-কি হয়েছে?
-উঠতে হবে।
-এখন!
-হু
-কয়টা বাজে?
-রাত দুইটা বারো।
-এতরাতে উঠব কেন?
-আমাদের যেতে হবে।
-কোথায়!
চোখ মুখ কুঁচকে আছে নুপুরের। গাঢ় ঘুম তার ওপর মধ্যরাত। কিছুতেই তার বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করলো না আবার শুয়েও থাকতে পারলো না অর্ণবের ডাকে। ভালো করে চোখ মেলে তাকাতেই অর্ণব আবারও বলল, “চলো।”
-কোথায় যাব? বাতি জ্বালান।
-হুশশশশশ,,, চুপচাপ এসো আমার সাথে।
কোন কথারই জবাব দিলো না অর্ণব। চুপচাপ তাকে অনুসরণ করে নুপুর নেমে গেল নিচে। তার এক হাত অর্ণবের মুঠোয় বন্দী। তারা মোবাইলের ফ্ল্যাশের সাহায্যে ঢুকে পড়লো স্টোর রুমে। না ভুল, স্টোরের দেয়াল ভেদ করে তারা চলে গেল অন্য আরেকটা রুমে যার ভেতরের অংশটা খুব ছোট। নুপুর আলোছায়াময় জায়গাটাতে খেয়াল করলো কেউ একজন পড়ে আছে হাত, পা আর মুখ বাঁধা অবস্থায়। অর্ণব হাতের ফোনটা তাক করলো মানুষটার মুখে। আলো পড়া মুখটা দেখেই আঁতকে উঠলো নুপুর।
-এই ছেলেটা….
-ছেলে নয় বলো জন্তুটা। এটা কোন মানুষের বাচ্চা নয় ও হলো পিশাচের বাচ্চা ইবলিশ। ওই ছুঁয়েছিল না তোমায় ওর এই হাত দুটো দিয়ে! কেমন হবে এ হাত দুটোকে এখন জ্বালিয়ে দিলে?
কোঁক করে কাতরানোর আওয়াজ এলো বাঁধা মানুষটা থেকে। হয়তো বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছে কিন্তু অর্ণব অত দয়ামায়া দেখাতে জানে না৷ নুপুর ভীত চোখে তাকায় অর্ণবের দিকে। অর্ণব বিশ্রী হেসে আবারও বলে, কি যেন বলেছিলি বাক্যটা? রঙ যেমন তেমন ফিগার মাইরি….. এগুলোই তো বলেছিলি ওকে আটকে রেখে!
নুপুর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অর্ণবের মুখের দিকে। এ কথা তো তাকে সত্যিই বলেছিল এই ছেলেটা কিন্তু সে জানলো কেমন করে? ওই বীভৎস সময়গুলোর একটুও তো বলেনি সে অর্ণবকে কি যন্ত্রণা বয়ে গেছে তার বুক জুড়ে। অর্ণব হাতে সেই ধারালো রামদা তুলে নিলো যেটা নুপুর দেখেছিল সন্ধ্যায়।
-তুমি কি ভয় পাবে খুব?
ছলছল চোখে তাকায় নুপুর। কি বলছে লোকটা! সে কি এখন খু’ন করবে ছেলেটাকে?
-প্লিজ আপনি খুনখারাবি করবেন না প্লিজ। ওকে পুলিশের কাছে দিন আপনার কিছু হয়ে যাবে।
-রিল্যাক্স নুপুর। আমার কিছু হবে না। আমি তো শুধু শাস্তি দিব ওকে।
অর্ণব কোন কথাই শোনেনি তবে খুনখারাবির নামে রামদা’টাও কাজে লাগায়নি৷ সে করেছে অন্যকিছুৃ। আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল মিনারকে কেটে টুকরো করবে নুপুরের সামনে। তা আর শেষ পর্যন্ত করে উঠেনি। আগে থেকেই বাগানে মাটি খুঁড়ে রেখেছিলো একপাশে। হাত পা বাঁধা মিনারকে সেখনেই জীবন্ত মাটিচাপা দিলো। নুপুর অবাক হয়ে পুরোটা সময় শুধু অর্ণবকে দেখে গেল। এ মানুষটা কি আদৌও সুস্থ মস্তিষ্কে আছে! সুস্থ কোন মানুষ কি পারে অন্য একজন মানুষকে জ্যান্ত পুতে ফেলতে! হোক সে অপরাধী তার অপরাধে শাস্তি দিতে আইন আদালত আছে ওপারে আল্লাহর কাঠগড়া আছে তবুও সে কেন নিজ হাতে তুলে নিলো আইন! অর্ণব যখন মিনারকে পুরোদমে মাটির নিচে দাবিয়ে দিলো তখন রাতের প্রহর শেষ হয়েছে। চারপাশ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে। সদ্য চাপা দেয়া মাটির ওপর পাশেই অনেকদিন আগের কেটে রাখা গাছের শুকনো ডাল পাতা ছড়িয়ে দিল দ্রুততার সাথে। নুপুর দাঁড়িয়ে আছে শক্ত হয়ে। সে যেন আর নিজের ভেতরে নেই৷ অর্ণব তড়িঘড়ি বাড়ির ভেতর ঢুকে দু মিনিটের মাঝেই মূল দরজায় তালা লাগিয়ে ফিরে এলো একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে। কি আছে ও ব্যাগে নুপুর জানে না। অল্প সময়ের মাঝেই অর্ণব তার হাত টেনে ছুটে চলল বাড়ির পেছনের ছোট্ট পুরনো পকেট গেইট দিয়ে।
_____
মাস তিনেক পর, সাখাওয়াত চৌধুরীর ছেলের কঙ্কাল খুঁজে পেলেন অর্ণব চৌধুরীর বাগানে মাটি খুঁড়ে। লাগাতার তিনটি মাস ছেলের খোঁজে পুলিশ, ডিবি পুলিশকে জ্বালিয়ে গেছেন৷ তিনটি মাস ধরেই নিখোঁজ অর্ণব চৌধুরী আর তার স্ত্রী নুপুর। সবরকম তদন্ত চালিয়েও খুঁজে পায়নি তারা অর্ণব চৌধুরীকে। আত্মীয়স্বজন এমনকি তার একমাত্র বোনের মাধ্যমেও তার খোঁজ মেলেনি। তিনটি মানুষ একেবারেই হাওয়া হয়ে গেল! সাখাওয়াত চৌধুরী কিছুতেই থেমে নেই অর্ণবের বাড়িটিতে বহুবার তল্লাশি চালিয়েছেন। এবারও তাই করিয়েছেন তবে এবার বাদ পড়েনি বাড়ির একটি কোণাও। মাটি, পুকুরের পানি সবই তল্লাশি করিয়ে বাগান থেকে উদ্ধার করতে পেরেছে কঙ্কালটা। কিন্তু অপরাধী অর্ণব কোথায়!
_______
কুয়াশা মাখা ভোর; শীতের সকালে ধানের কচি চারাগুলোতে শিশির জমে আছে হীরের মত। মতিন বড্ড আনন্দে তাকিয়ে আছে সেদিকে। পরনে তার ফুলহাতা একটা উলের সুয়েটার আর লুঙ্গি অথচ পা দুটি নগ্ন। এই শীতের ভেজা কাদা মাটি পায়ে লাগিয়ে সে হেঁটে হেঁটে দেখছে তার সবুজ কচি ধানের চারাগুলো। বড় ক্ষেতটা পুরোপুরি প্রস্তুত চারা লাগানোর জন্য, অপেক্ষা ছিল শুধুই এই চারাগুলোর বড় হওয়ার। এখন দেখে মনে হচ্ছে আজই কাজটা করা যায় কিন্তু তার আগে এগুলোকে তুলতে হবে। ভোর বেলাতেই সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ছিল ক্ষেত দেখতে। ধান ফেলার পর থেকে তার প্রত্যেক ভোরে এইতো কাজ এরপরই সে বাড়ি ফিরে নাশতা করে। কিছুটা বেলা করে বের হয় বাজারে তার ছোট্টো দোকানটা খুলতে। পাহাড় ঘেঁষা এই ছোট গ্রামটিতে মতিনের দোকান তিনটি মাসেই খুব পরিচিত। ক্ষেতের আইলে দাঁড়িয়ে আশপাশের প্রত্যেকটি ক্ষেত দেখছে মতিন। সরিষা আর ধানের ক্ষেতে চমৎকার লাগছে হলদে সবুজের নকশিকাঁথা। গ্রামের সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে যায় এই ফসলের রঙে। হঠাৎ চোখে পড়লো পাশের বাড়ির বাচ্চা ছেলেটা আসছে এদিকটাতেই।
-এ্যাই ঔরব শোন তো এদিকে।
-কি কাকাবাবু?
-তোর শ্যামা কাকিকে বলতো গিয়ে আমি ডাকছি তাকে৷
-আচ্ছা।
আট বছর বয়সী ঔরব যেমনটা এসেছিল তেমনটাই আবার ছুটে গেল বাড়ির দিকে। মতিনের কথামত কাকিকে ডেকে নয় শুধু একপ্রকার টেনে হিঁচড়ে সঙ্গে করে নিয়ে এলো শ্যামাকে। মতিন তাকিয়ে থাকে তার বউটির দিকে। আজ সকালে কি তাকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে? কেন রাতেও তো সবসময়কার মত ছিল এখন কেন এত মিষ্টি লাগছে! খুব মনোযোগে দেখতে দেখতে খেয়াল হলো এই মুহূর্তে তার মিষ্টি বউটি লাজুক লাজুক হাসছে। এই লাজুক হাসির কারণ কি!
ঔরব শ্যামা কাকিকে মতিন কাকার সামনে আইলে দাঁড় করিয়ে আবার ছুটে চলল নিজ গন্তব্যে। সে তো বেরিয়েছে তার ও পাড়ার বন্ধুর সাথে বরই পাড়বে বলে। ঔরব চলে যেতেই মতিন বলল,
– ধানের চারা দেখো কেমন বড় হয়েছে।
-হু
ক্ষীণ স্বরে জবাব দেয় শ্যামা।
-আজকে, কালকের মধ্যেই লাগিয়ে ফেলতে হবে চারাগুলো।
– নাশতা করবেন না, বাড়ি চলেন।
-করব, তুমি এখানটায় এসো
মতিন বসে থাকা কাঁদা মাটিতেই হাত টেনে বসিয়ে দেয় তার শ্যামাস্নিগ্ধা বউটিকে৷ ভোরের কুয়াশামাখা শীতল হাওয়া, বরফ ঠান্ডা কাঁদায় গা কেঁপে উঠে শ্যামার। মতিন হাসতে হাসতে বলতে থকে,
-এবার বলো তুমি সকাল সকাল এত সেজেছো কেন?
শ্যামা তাকায় না বরের মুখে। লজ্জায় রাঙা মুখটি নামিয়ে সে উঠতে চায় কাঁদা থেকে। তার হাতটি ধরে আটকে দেয় মতিন।
-জবাব দাও…
-আগে বাড়ি আসুন আপনাকে কিছু বলার আছে।
মতিন মানতে চায় না সে কথা। বউকে টেনে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয় কাঁদা জলেই। হাতের তালুতে কাঁদা উঠিয়ে গালে মেখে দেয় শ্যামার।
-আমার বড্ড আনন্দ হচ্ছে সোনাবউ। আমার নিজের করা ফসল হবে দু দিন পরে।নিজ পরিশ্রমে অন্ন জুটবে আমার। এ হাতে তৈরি সব কাজের ফসল।
শ্যামা চোখে চোখ রাখে তার অর্ধাঙ্গের। ঘন গলায় বলে দেয়, “যদি শোনেন আপনার সন্তানের আগমনবার্তা তবে কি এ আনন্দ দ্বিগুণ হবে!”
থমকে দাঁড়ালো মতিন। চমকে তাকায় স্ত্রীর পানে। শ্যামলা মুখে লাজুক হাসি, টানা দুটো চোখে গাঢ় করে কাজলটানা পরনে কচি ধানের চারার রঙের আটপৌরে শাড়িকোথাও যেন কমতি নেই। মতিনের হৃৎপিন্ড বিকল হলো কি একটুর জন্য!
-কি বললে তুমি?
– শুনতে পাননি?
চোখ ফিরিয়ে নেয় শ্যামা। লজ্জায় তার গা শিরশির করছে।
-এ্যাই বউ আবার বলো কি বললে তুমি? আমার সন্তান আসবে! সত্যি বলছো?
ব্যাকুল শোনায় মতিনের কণ্ঠস্বর। সে কাদা মাখা দু হাতের আজলায় মুখটি ধরে শ্যামার। কোনদিক না তাকিয়েই চুমু বসিয়ে দেয় শ্যামার ঠোঁটে।
-কেউ দেখবে।
-দেখলে দেখুক।
– বাড়ি চলুন
-ভালোবাসি আমার শ্যামাঙ্গিনী।
-আমিও ভালোবাসি আমার জল্লাদমুখো।
-গোঁফ এখন নেই।
-তবুও আপনি আমার জল্লাদমুখো।
পুনশ্চঃ অর্নব নুপুর মাস তিনেক আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বসতি গেঁড়েছে পাহাড় ঘেঁষা এক ছোট্ট গ্রামে। পরিকল্পনা তো অনেক আগেই করেছিল অর্ণব একদিন হারিয়ে যাবে হয় তার শ্যামাঙ্গিনীকে নিয়ে নয় সে একাই। ভাগ্য বুঝি সদয় ছিল তার প্রতি তাইতো সেদিন নুপুরকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে শহর ছেড়ে। এখানটায় তার আছে ছোট্ট একটি টিনের চালার মাটির ঘর, ছোট্ট একটি আঙিনা, রসুইঘরের চালায় লতানো লাউ ডগা , আর মাচায় বেয়ে উঠা শিমের লতা। এক টুকরো ধানি জমি আর ছোট্ট একটি দোকান। সবমিলিয়ে তার সাজানো এক রঙিন সংসার। প্রজাপতির ডানায় ভর করা হাজারটা স্বপ্ন। তবুও সুখের দিনের দুঃখ হয়ে প্রায়ই তাকে আঁকড়ে ধরে ভয়ংকর স্বপ্ন৷ সে বুঝতে পারে তার করা পাপ তাকে এই টানাপোড়েনের স্বপ্ন দেখায়। কথায় আছে পাপ ছাড়ে না বাপকেও। মাস তিনেক আগে করা সেই পাপ বোধহয় তাকেও ছাড়ছে না এই রঙিন সংসারে। সত্য হয়েছে তার কোথাও হারিয়ে যাবার ইচ্ছে যুক্ত হয়েছে পাপের ভয়।
________সমাপ্ত__________