কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-৩৬

0
508

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩৬

রিদওয়ানের সাথে মনোমালিন্যতা দূর হয়েছে এবার বাকি দাদী। এ দুজনের সাথে সব ঠিক থাকলেই চলবে বাকি আত্মীয় স্বজনকে তার আর দরকার নেই। এবার তার ভাবনা চিন্তা সবই যেন স্বার্থপরের মত। তাতে একটুও আফসোস নেই । কাল রাতে রিদওয়ানের কেক কাটার সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত কলটা এলো শরাফত সাহেবের পক্ষ থেকে । তিনি জানালেন তৃতীয় আসামি ধরা পড়েছে কাল সকালেই যেন নুপুরকে নিয়ে একবার থানায় আসে। রাতটা আর থাকা হয়নি অর্ণবের। রাত দুটোতেই সে রওনা দিয়েছে ঢাকার পথে। গাড়িতেই একটু ঘুমিয়ে নিয়েছিলো ভোরে এসে সরাসরি উপস্থিত হয় শ্বশুর বাড়িতে। নুপুর তখনও গভীর ঘুমে তলিয়ে থাকায় টের পেল না নিজ কক্ষে আপন মানুষটির অস্তিত্ব। রাতে আধো ঘুমের দরুণ অর্ণবের চোখদুটো রক্তরাঙা। নাজিম সাহেব তাকে দেখতেই বুঝলেন ছেলেটা রাতে ঘুমায়নি ঠিকঠাক। অর্ণবকে নুপুরের ঘরে পাঠিয়ে বললেন, একটুখানি ঘুমিয়ে নিতে। অর্ণব ঘুমায়নি, নিষ্পলক তাকিয়ে শুধু দেখতে থাকলো প্রাণপ্রিয়াকে। শ্যামা ত্বক কয়েকদিনের অসুস্থতায় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কাঁধের কাছটায় ওড়না না থাকায় খামচির আঁচড়গুলো শুকিয়ে গিয়ে দাগ হয়ে আছে। জমে থাকা ক্ষোভ আচমকাই কেমন রক্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করলো তার। নুপুরকে হসপিটালে দেখার পর থেকেই তার মাথায় শীতল এক দুর্বোধ্য জেদ চেপে আছে এক কথায় বলা যায় খু*ন চেপে আছে। বড্ড কঠোর মনটাকে তার কত মুশকিলে সে চুপ করিয়ে রেখেছে তা শুধু তার অন্তরাত্মাই জানে। তার শীতল চিন্তাধারা অনেক আগেই আন্দাজ করে নিয়েছে নুপুরের এ অবস্থার জন্য একমাত্র সে-ই দায়ী আর তা সহজ সমীকরণ মিলে গেছে নুপুরের বাবার একটি বয়ানেই। সেদিন পুলিশ যখন জিজ্ঞাসাবাদে নাজিম সাহেবকে প্রশ্ন করলেন, আপনার কোন শত্রু আছে বা সন্দেহজনক কেউ আছে আপনার দৃষ্টিতে! জবাবে তিনি জানালেন, জানামতে শত্রু তো নেই তবে মেয়ে কয়েকদিন আগেই জানিয়েছিলো কেউ তার পিছু নিতো। দু চার দিন সে দেখেছে এরপর থেকে তো বাড়ির বাইরে যাওয়া প্রায় বন্ধই ছিলো অনেকগুলো দিন। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর সেদিনই বাইরে গেল তারপর…..

নুপুরকে কেউ ফলো করছে আর অর্ণবকে কেউ ফলো করতো দুটো ঘটনাই সংযুক্ত তা বুঝতে একটুও দেরি হয়নি এবং দ্বিতীয় হিন্ট ছিলো অর্নির ফোনে কিডন্যাপারের কল যা নুপুরের হাতে ছিল। অর্ণব এইটুকুতেই নিজের মত সাজিয়ে নিলো পুরো ঘটনা। তার কোন শত্রুপক্ষ গুপ্তচর লাগিয়েছে তার ওপর এবং অর্নির ওপর নজর রাখার জন্য সেই গুপ্তচর তাকে ঠিকঠাক চিহ্নিত করতে পারলেও ভুল করলো অর্নির বেলায়। অর্নিকে হয়তো কলেজেই প্রথম দেখেছে অৎবা দেখতে গিয়েছে আর সেখানেই বিভ্রান্তিতে পড়েছে নুপুরকে অর্নি ভেবে! কিন্তু কেন? অর্ণবের পাশে দেখেছে নুপুরকে আর ভাই-বোন ভেবে নিয়েছে? তাই বলে লম্বা সময় ধরে এই ভুল চলতে থাকলো আর শত্রুপক্ষ টেরও পেল না! মাথা কাজ করছে না ঠিকঠাক এই একটা জায়গাতেই৷ নিষ্পলক তাকিয়ে ভাবনাটা গড়ালো অনেক সময় তখনো নুপুরের ঘুম ভাঙেনি। বাইরে থেকে তুতুনের গলার আওয়াজ পেতে অর্ণবের যেন হুশ ফিরলো। বসা থেকে উঠে দরজা খুলতেই তুতুন বলল, স্যরি ভাইয়া জাগিয়ে দিলাম? বাবা তো আপুকে জাগাতে বলেছে৷

তুতুনের বলার ধরণটা এত নিরীহ লাগলো অর্ণব দেখে নিঃশব্দে হেসে ফেলল। গাল টেনে বলল, “আমি ডাকছি তোমার আপুকে।”

তুতুন চলে গেলে অর্ণব আবারও গিয়ে বসলো চেয়ার টেনে৷ নিচু স্বরে নুপুরকে ডাকলো বার দুয়েক তাতেই উঠে গেল নুপুর। বোধহয় অবাকও হলো সামনেই অর্ণবকে দেখে তবুও মুখ ফুটে কিছু বলল না। বিছানা ছে্রে নেমেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তার ঘরে লাগোয়া বাথরুম না থাকায় কমন বাথরুমটাই ভরসা। শারীরিক সকল ক্ষত মিলিয়ে না গেলেও হাঁটুর ওপরের আঘাতটা অনেকটাই মিলিয়েছে বলে চলতে ফিরতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না এখন। অর্ণবও আর বসে থাকলো না ঘরে। নুপুর মুখ হাত ধুয়ে বের হতেই অর্ণবও গেল ওয়াশরুমে। ফ্রেশ হয়ে নিজেই যেচে নুপুরের ছোট মাকে জিজ্ঞেস করলো, নাশতা কিছু কি হবে আন্টি?

-জ্বী বাবা বসো টেবিলে আমি এহনই দিতেছি।

অর্ণবের বাজার করার দিন থেকেই মহিলা তাকে বেশ সমাদর করে চলছেন। এই যে নুপুরকে এ বাড়িতে আনার পর থেকেই অর্ণব সন্ধ্যেটা এ বাড়িতে কাটায়, মহিলা রোজই তার জন্য হরেক রকম নাশতার আয়োজন করেন। আজও তাকে আসতে দেখে দ্রুত হাতে নাশতা তৈরি করেছিলেন। টেবিলে সব খাবার সাজিয়ে নিজেই ডাকলেন অর্ণব, নুপুরকে৷ অর্ণব এলেও নুপুর বলল, পরে খাব। এ কথার মূল্য বিন্দু পরিমাণও না দিয়ে অর্ণব একই প্লেটে দুজনের নাশতা নিয়ে নুপুরের ঘরে ঢুকলো। দরজাটা হালকা ভেজিয়ে রেখে বসলো বিছানাতে। পরোটার এক টুকরো ছিঁড়ে তাতে একটুখানি সবজি নিয়ে সে হুট করেই নুপুরের গাল চেপে মুখে ঠুসে দিল৷ আকস্মিক, এমন আচরণে নুপুর অবাক হতেও ভুলে গেল খানিকটা সময়৷ তারপরই কিছুটা চেঁচিয়ে বলে উঠলো, এ কেমন আচরণ!

-যেমনটা আপনি চাইছেন…

বাঁকা হেসে বাঁকা উত্তর৷ নুপুর বসে ছিলো খাটের মাথাশ হেলান দিয়ে এখন আর স্থির থাকা হলো না৷ সোজা হয়ে বসে সে ধাক্কা মেরে বসলো অর্ণবের বুকে। বড় শান্ত গলায় বলতে লাগল,

-কেন করছেন এসব? এত দয়া কেন দেখাতে চাইছেন আমায়? আমি রাস্তার কোন মেয়ে নই যার জন্য আপনার দয়া অতীব জরুরি বলে মনে হবে? আ’ম ফাইন টোট্যালি প্লিজ লিভ মি অন মাই কন্ডিশন….

একটা কথাও অর্ণব কানে তুললো বলে মনে হলো না। সে নির্বিকার পরোটা ছিঁড়ছে, নিজের মুখে পুরছে৷ তার বোধহয় খাওয়া শেষ হলো এবার সে খুব আঁটসাঁট বেঁধে ফিরে বসলো নুপুরের দিকে। আবারও পরোটা ছিঁড়ে ঠিক আগেরই মতন নুপুরের গাল চেপে তা মুখে পুরে দিলো। এবার পরোটার সাথে ছোট্ট একটি হুমকিও দিলো, একটা টুকরো মুখ থেকে ফেলবে তো ভুলে যাব শ্বশুর বাড়িতে আছি আর বাইরে শ্বশুর শ্বাশুড়ি সজাগ কান নিয়ে বসে আছে। বিয়ে করে এখনো উপোস করছি সেই উপোস আজ এখনই ভাঙব বাকিটা তোমার সিদ্ধান্ত।

অর্ণবের অসভ্য হুমকি শুনে ভঙ্গুর দৃষ্টিতে তাকালো নুপুর। এ কেমন হুমকি ছিহ! সামান্য নাশতার জন্য কি কি বলে দিচ্ছে এই লোক! এ কাকে ভালোবেসেছিলো সে?

-যা ভাবার পরে ভেবো আপাতত নাশতা ফিনিশ করো থানায় যেতে হবে আগে।

_______

বাবার সাথে বরাবরই দূরত্ব রিদওয়ানের কিন্তু মা ছিলো তার বুকের ভেতর একেবারে হৃৎপিণ্ডের মধ্যস্থানে৷ তার জীবনে দুটি নারী তার সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে কাছের তার মধ্যে প্রৎম জনই ছিলো তার মা আর দ্বিতীয় স্থানে অর্নিতার জায়গা। কিন্তু আজ বুঝি সে জায়গাটাও নিমেষে খালি হয়ে গেল যখন সে শেষবার দেশের মাটিতে থেকে মায়ের সাথে কথা বলতে চাইলো। এয়ারপোর্টে বসে শেষ কলটা সে মাকেই করেছিলো। ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হতেই সে শুধু আম্মু বলে ডাকতে পারলো। এরপর আর সুযোগ মেলেনি কিছু বলার তার আগেই ওপাশ থেকে আম্মু বলে গেলেন, “দেশ ছাড়ছিস এটা সঠিক সিদ্ধান্ত তোর। কাল বলা হয়নি আজ বলছি আজকের পর কখনো কল করবি না আমার পরিবারের কাউকে। তোর সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। তোর আব্বুর সাথে আমিও তোকে ত্যাজ্য ঘোষণা করছি। আমার ছেলে-মেয়ের থেকেও দূরে থাকবি৷ আর হ্যাঁ এ বাড়িতে তোর কোন ভাগও নেই তোর বউ যেন কখনো পা না দেয় এ বাড়িতে।”

বুকের একটা পাশ খালি নিয়েই দেশ ছেড়েছে রিদওয়ান। বাড়িতে কি হলো কি হয়নি জানে না শুধু জানে আজ তার এই জন্মদিনে সে নিজেকে এতিম বলে মেনে নিলো আজীবনের জন্য। কিছু মানুষ জীবনে ভুল না করেও আজীবন মিথ্যে ভুলের মাশুল গোনে। সে নিজেও তা গুনছে বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে বহুদূর।
_________

থানায় পৌঁছে জানা গেল পুলিশ সন্দেহ করে যাকে এনেছে সে আসামী নয়। পুলিশ যাকে ধরেছে তার বয়সটা চল্লিশের ঘরে। অথচ নুপুরের বর্ণনানুযায়ী আসামী তার সময়বয়সী কিংবা বড় বা ছোট হবে কলেজ, ভার্সিটি স্টুডেন্ট হওয়ার কথা। কথাবার্তায় সে বুঝতে পেরেছিলো ছেলেটা তাকে আরও আগে থেকেই অন্যরকম নজরে রেখেছে হয়তোবা তার কলেজের আশেপাশে থেকেই তাকে দেখতো। আধঘন্টার মধ্যেই হতাশ হয়ে ফিরে এলো অর্ণব-নুপুর। এরপর কেটে গেল আরও একটি সপ্তাহ। প্রকৃতিতে তখন ভীষণ খরা অর্ণব তৃষ্ণায় ধুঁকছে। তার তৃষ্ণা জলপিপাসা না তার তৃষিত হৃদয়ের খোঁজ শ্যামাঙ্গীনি। এরই মাঝে দাদীর শরীরটা আরও ভেঙে পড়ায় দাদীকে হাসপাতালে নেয়া হলো। দিন দুই ডাক্তার অবজারভেশনে থেকেও কোন পরিবর্তন হয়নি। ডাক্তার জানালেন, অবস্থার আর উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না তারা। চাইলে শেষ সময়ের জন্য নিজেদের কাছে রাখুন। অর্ণবেরও তাই মনে হচ্ছিলো কিন্তু বাড়িতে মানুষটার কাছে থাকার মত তো কেউ নেই। অর্নির পরীক্ষা চলছে, রুজিনা খালা একা মানুষ কতক্ষণ নজরে রাখবেন! এই সময়টায় আশেপাশে কারো থাকাটা জরুরি, সবসময় দোয়া, জিকির চলাটাই উত্তম হতো। অর্ণবের ভাবনাটা দাদী নিজেই দূর করে দিলেন নুপুরকে দেখে। দাদীর অবস্থার অবনতি জেনেই নাজিম সাহেব জোর করে মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে এলেন। দাদী তখনও বাঁধো বাঁধো আওয়াজে কথা দু একটা বলতে পারেন৷ নিজেই নুপুরকে ইশারা করলেন পাশে বসতে। মানসিক দিক থেকে বিধ্বস্ত নুপুর একটুও অবহেলা না করে এগিয়ে গেল দাদীর শিথানের কাছে। বৃদ্ধা তখন একটু একটু করে বলতে লাগলেন, “বাড়ি.. চল.. আমার সাথে। আমার অর্ণবের… নাই…. কেউ নাই…. যাবি?” থেমে থেমে বলা নিরুচ্চারিত বাক্যটার অর্থ প্রথমে কেউ বুঝতে না পারলেও পরে নুপুরই কেমন করে যেন বৃদ্ধার হাতের ইশারাটুকু বুঝলো। না চাইতেও সে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে যাবে। নুপুরের বাবাও সান্ত্বনা দিলেন, চাচী মেয়ে যাবে তো নিশ্চয়ই যাবে আপনে যখন বলবেন। সত্যিই গেল নুপুর অর্ণবের বাড়িতে যেদিন দাদী চাইলো। যাওয়ার আগে পুনরায় তাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি হলো, কবুল বলা হলো এমনকি অল্প করে বাসরঘরটাও সাজিয়ে দিলো রুজিনা খালা। যে রাতে নুপুরকে বাড়িতে তোলা হলো তার পরেরদিনই দাদী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। যেন অপেক্ষায় ছিলেন আদরের নাতিটির পাশে সঙ্গীনি দেখার তারপরই হয়তো নিজ দায়িত্ব শেষ বলে মেনে নিয়ে চলে গেলেন পরকালের পথে। কে জানে ভাগয বিধাতা আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন অর্ণবকে কখনো নিঃস্ব করবেন না। তার একলা জীবনে কেউ এলেই কেউ চলে যাবে! প্রকৃতির নিয়ম বড়ই আজব বড়ই চমৎকার তাইতো দাদীর লাশ কবরে নামানোর আগেই সনাক্ত হয়ে গেল নুপুরের জীবনের চরম দূর্দশা নামানো মানুষগুলো। প্রত্যেকেই অর্ণবের জীবনে রক্তের বন্ধনে জড়িত। আর অর্ণব! নুপুরের জল্লাদমুখো মানুষটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুধু দেখে গেল ধর্ষককে, কিডন্যাপ করার পরিকল্পনাকারীকে আর তার পিঠ পিছে চাকু নিয়ে ঘুরতে থাকা মানুষগুলোকে। রক্তে তেজস্বী স্রোতকে কেমন করে সে সরলরেখায় ভীষণ শান্ত রেখে কেমন করে যে বইয়ে দিলো সে সময়টাতে তা শুধু অর্ণবই জানে। জীবনে প্রায় প্রতিটা পদক্ষেপই সে সচেতনতার রেখেছে তাই হয়তো এ বেলাতেও নিজেকে সফল করতে মস্তিষ্কে বরফ ঢেলে হিম শীতলপরিকল্পনাগুলো করে নিলো। দাদীর লাশ দাফন করেই সে রিদওয়ানকে ফোন করে বলল, যত টাকা লাগে লাগুক যেভাবেই হোক একটা ব্যবস্থা কর অর্নিকে তোর কাছে নিয়ে যাওয়ার।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে