কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-২৯

0
462

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২৯

“তোর উড বি কিছু মনে করেনি তো!”

নুপুরকে দেখে প্রথম প্রশ্নটা করেই সবাইকে চমকে দিলো অর্নিতা৷ নুপুর অবাক হয়ে তাকায় প্রিয় বান্ধবীটির দিকে। তার দৃষ্টির বিষ্ময় আর প্রশ্ন না বোঝাটা বুঝতে পেরে অর্নিতা আবার বলল, “বলছি এখানে তোকে ডেকেছি তার জন্য কিছু মনে করেনি তো তোর হবু বর?”

স্বতঃস্ফূর্ত স্বরে কথা বলছে অর্নিতা। এমন কথাবার্তা অর্নির মুখে বোধহয় উপস্থিত তিনজনের কেউই আশা করেনি। নুপুর আহত হৃদয়ে কাতর হয়ে চেয়ে আছে। অর্ণবও যেন আঘাত পেল বোনের আচরণে মনে মনে নিজের ওপরও ক্ষোভ জমলো। আজ সে-ই মাধ্যম এই মেয়ে দুটির মধুর সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টিকারী। একটু আগে অব্দি নুপুরকে দেখে তার মস্তিষ্কে তীব্র রোষানল থাকলেও এই মুহূর্তে বোনের আচরণে তা মিলিয়ে গেল। এই মেয়েটা হেয় হওয়ার মত অন্যায় করেনি৷ দাদী তাকে আজ সকালেও খুব করে বুঝিয়েছেন নুপুরের ওপর ক্রোধ যেন প্রকাশ না পায় তার। ওপরওয়ালার ইচ্ছেতেই সব হয় আর যা হয় তার মধ্যে বান্দার জন্য নিশ্চয়ই মঙ্গলকর কিছু থাকে। অর্ণব ভেবেছিলো বোনকে থামাবে তার আর প্রয়োজন পড়লো না। রিদওয়ানই তাকে থামিয়ে দিল, “এসব কেমন কথা অর্নি! তুই এভাবে কথা বলছিস কেন?”

-খারাপ কিছু তো বলিনি।

কাটকাট জবাব দেয় অর্নিতা। চুপচাপ তখনো অর্নিদের টেবিলের সামনে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে আছে নুপুর। রিদওয়ান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। নিঃশব্দে অন্য একটি চেয়ার টেনে নুপুরকে বসতে বলে। অর্ণবও দাঁড়িয়ে ছিল এবার তাকেও বলে, তুই কেন দাঁড়িয়ে আছিস সংয়ের মত। ইনভাইট করতে হবে বসার জন্য?”

প্রচণ্ড শব্দ করে ফাঁকা আরেকটি চেয়ার টেনে অর্নিতার পাশে বসে অর্ণব। একজন ওয়েটার আসে সেময়ে তাদের অর্ডার গ্রহণ করতে৷ রিদওয়ান একপলক তিনজনের মুখশ্রীতে দৃষ্টি দিয়ে নিজেই খাবার অর্ডার করে। নুপুর বলতে চায় সে এখন খাবে না শুধু একটু সময় কথা বলবে অর্নিতার সাথে। নাহ, গলা পার হয়ে ঠোঁট পর্যন্ত আসে না তার শব্দধ্বনি৷ কিছু সময় কেটে যায় নিস্তব্ধতায় তারপর প্রথম কথা নুপুরই বলে অর্নিতার দিকে চেয়ে।

-কেমন আছিস?

-ভালো।

আবার থেমে যায় কথা তাদের। কি বলবে খুঁজেই পায় না যেন। রিদওয়ান বিচক্ষণ লক্ষ্য করে এখানে সে ছাড়া বাকি তিনটা মানুষই জড়াগ্রস্ত নিজ নিজ আবেগে। এভাবে একসাথে এক টেবিলে বসে তারা কথা বলতে পারবে না আর না খেতে৷ তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় মেয়ে দুটিকে একা ছাড়া হোক। যেমন ভাবন তেমনই কাজ, সে অর্ণবকে বলে উঠে পড়ে অন্য টেবিলের জন্য। অর্ণব আর রিদওয়ান সরে যেতেই নুপুর স্বস্তি পায়। ক্ষীণ হেসে জিজ্ঞেস করে, “খুব বেশি রেগে আছিস আমার ওপর?”

– রেগে থাকার অধিকারই কেড়ে নিয়েছিস।

-এভাবে বলিস না….

“কিভাবে বলব তবে? কি করছিস তুই, কেন করছিস? আমার ভাইটার জীবন কেমন করে কেটেছে অজানা তোর? যেচে কেন ঢুকেছিলি তার জীবনে? বিয়ে যদি অন্য কাউকেই করবি তবে আমার ভাইয়ের পিছু নিয়েছিলি কেন?”

উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলতে গিয়ে গলার স্বর চড়ে গেল অর্নিতার। একটু দূরে বসা অর্ণবের কানে সে আওয়াজ পৌঁছুতেই অর্ণব উঠে এলো আবার।

-গলার আওয়াজ নিচে রেখে যা বলার বল অর্নি। আর কি ফালতু কথা বলছিস তুই! আমি যেন একটাও এসব নিয়ে কোন কথা না শুনি নইলে ভুলে যাব আমরা কোন পাবলিক প্লেসে আছি।

অর্ণব ফিরে গেল রিদওয়ানের কাছে। খাবার এসেছে দুই টেবিলে আলাদা করে৷ রিদওয়ানের পেটের খিদে মিটিয়ে ঠিকঠাক খেয়ে নিল। বাকি তিনজনের কারোই প্লেটের খাবার উদর পর্যন্ত পৌঁছালো না।

______

নাজিম সাহেব সাড়ে তিনটেয় কল পেলেন হবু বেয়াইয়ের। আজ ছেলে মেয়ের দেখা করার কথা ছিল৷ পূর্ব পরিকল্পনার এ কথা তো জানানো হয়েছিল নুপুরকেও অথচ মেয়ে এখনো পৌঁছায়নি। ছেলে আর তার ভাবি অনেক আগেই পৌঁছে গেছে বাড়ির কাছাকাছি এক মার্কেটে। সেখানে নুপুর উপস্থিত হলে আজই বিয়ের শাড়ি কিনে ফেলবে বলে মনস্থির করেছিল পাত্রের পরিবার৷ এক ফাঁকে ছেলেমেয়েতে একটু কথাবার্তারও সুযোগ হবে৷ কিন্তু একি! মেয়ে তো এখনও পৌঁছায়নি তারওপর ফোনটাও তুলছে না। তাই বাধ্য হয়েই মেয়ের বাবাকে জিজ্ঞেস করা হলো মেয়ে কোথায়? তিনি বাড়ির বাইরে কাজে ব্যস্ত ছিলেন বলে আজ দুপুরে বাড়িতে খেতেও যাননি। এখন হুট করেকি বলবেন তার মেয়ে কোথায়! কিছু একটা তো বলতেই হয় বলে মিথ্যে বললেন, মেয়ের ফোনটা চুরি হয়ে গেছে তাই তিনিও কলে পাচ্ছেন না। বাড়ি গিয়ে পাঠাচ্ছেন মেয়েকে। মুখে এ কথা বললেও মনে মনে আতঙ্কিত হলেন মেয়ে ফোন কেন তুলছে না! বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে পেলেন ঘুমন্ত অবস্থায়। তুতুন প্রাইভেট পড়তে গেছে আর বাড়ির সদর দরজা হাট করে খোলা। প্রথমেই পুরো ঘরে মেয়েকে খুঁজলেন নাহ, ঘরে কোথাও নেই মেয়েটা। মোবাইলটা পাওয়া গেল তার ড্রেসিংটেবিলের ওপর। চিন্তার রেখা দীর্ঘ হলো ললাটজুড়ে৷ স্ত্রীকে দ্রুত ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, নুপুর কোথায়?

মহিলা প্রথমে ঘুমের ঘোর কাটাতে পারছিলেন না৷ পরে স্বামীর ধমক খেয়ে মনে করলেন নুপুর বেরিয়েছে অনেকক্ষণ হলো। এবার জবাব দিলেন, আপনার মাইয়া জামাইর লগে সাক্ষাৎ করতে গেছে আর কই যাইব!

– কখন গেছে?

-তিনটায় থাকার কথা ছিল না মার্কেটে? দুইডার পরেই বাইর হইছে।

বাড়ি থেকে মার্কেটের দূরত্ব বাসে পঁচিশ মিনিটের৷ আর যদি নুপুর ভেঙে এখান থেকে রিকশায় গেলে পনেরো মিনিট বড় বাজার সেখান থেকে অটোতে গেলে বিশ মিনিট সব মিলিয়ে এক ঘন্টা তো লাগার কথা না। এখন তো প্রায় চারটা বাজতে চলল আর বেয়াই কল করেছে সাড়ে তিনটায়। নুপুর কোথায় গেল?

-নুপুর কার সাথে গেছে?

– একলাই গেছে। কইলো কোন বান্ধবী যাইব সামনে থাইকা….

-নাম কি বলছে সে?

-নাম… একটুক্ষণ চিন্তা করলেন ছোট মা৷ মনে করে বললেন, নাম বলে নাই আমারে।

-গবেট মহিলা তোমারে আমি কাল কি বলছিলাম! আজকে যেন তুমিও ওর সাথে যাও আর তুমি পড়ে পড়ে ঘুম দিতাছো৷ তোমারে ইচ্ছে করতাছে…. দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন নজিম সাহেব। নুপুর কেয়ারলেস মেয়ে না সে বাড়ির বাইরে গেলে প্রতিবারই বাবাকে জানিয়ে যায়। ইদানীং কালে মেয়ের সাথে কিছুটা মনোমালিন্যতা চলছিলো ঠিকই কিন্তু আজ সে না বলে বেরিয়ে যাবে এমনটা ভাবেননি। গত কয়েকদিনে স্বাভাবিকভাবে কোন কথাই হয়নি মেয়ের সাথে কিন্তু কাল তো দূর থেকেই বার কয়েক বলে গেছেন আজ যেন ছোট মাকে সাথে নিয়ে মার্কেটে যায়। আর ফোনটা কেন বাড়িতে রেখে গেছে! হঠাৎই মনটা কু ডাকতে লাগল নাজিম সাহেবের। প্রথম দফাতেই মাথায় এলো অর্ণবের কথা৷ নুপুর কি ওই ছেলেটার কাছে গেল! সেদিন ওভাবে ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিয়ে মনে মনে তিনিও অশান্তিতে ভুগছিলেন। যতই হোক তার মেয়ে যে ওই ছেলেকে ভালোবাসে সে ব্যাপারে আগেই বুঝেছেন কিন্তু অমন বাবা মায়ের ছেলের কাছে মেয়ে দিতে মন সায় দেয়নি। উপরন্তু, ছেলের টাকা পয়সাও অনেক বেশি। তিনি বরাবরই অসম সম্পর্কে ভয় পান হোক বয়সের কিংবা সেটা অর্থের অসমতা। অবশ্য চার কূল মিলিয়ে পাওয়া মুশকিল তাই পাত্র ঠিক করেছেন বয়সে মেয়ের চেয়ে অনেকটা বড়। কিন্তু নুপুর কোথায় গেল?

________

খাবার কারোই পেটে না পড়লেও অর্ণবের কঠিন মনোভাবের তোপে পড়ে সবাইকে যেতে হলো শপিংমলে। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় নুপুর বিদায় নিতে অর্নিকে বলল, যাই আমি ভালো থাকিস।

অর্ণব তা শুনতেই দাঁতে দাঁত চেপে বলে বসলো, “তোর বান্ধবীকেও বল শপিংয়ে যেতে আমাদের সাথে। শুধু কি লাঞ্চ করতে এসেছে নাকি! আমার বউয়ের শাড়ি, গয়না দেখবে না? দেখবে কি পছন্দও তো করে দিবে।”

রিদওয়ানের রাগ হলো খুব এ পর্যয়ে এসে। চাপা ক্রোধের সাথে ধমকে উঠল সে।

-কি শুরু করলি তুই? নিব্বি পোলাপান সাজতে চাইছিস, প্রেমিকাকে হারানোর জ্বালায় উন্মাদ হইছিস তা বোঝাতে চাচ্ছিস!

অর্ণব পাত্তা দেওয়ার মুডে নেই৷ সে নিজের মত রোখ চেপে আছে নুপুরকে সঙ্গে নিয়েই শপিংয়ে যাবে। নুপুর নির্বাক অর্নিও বাড়াবাড়ি টের পেয়ে চুপসে গেছে। কথা তো অনেক ছিল নুপুরের সাথে বলার মত কিন্তু হলো কই! তার ভাইয়ের যে এই মেয়েটাকে মনে গেঁথে রাখার মত অন্যায় হয়ে গেছে সে খবর জানে সে। তাই চাইছিলো ভাইয়ের জীবনে এই একটা সুখ আমরণ আপন হোক৷ দুটো মানুষ একে অপরকে ভালোবাসে অথচ তারা এক হতে পারবে না এমন নিয়তি এ ভবে শত্রুরও না হোক৷ কিন্তু এখন তো সে চাইলেও সম্ভব না ভাইয়ের জীবনে নুপুরকে জুড়ে দেয়া। কিন্তু পরিস্থিতি আর ঘোলা না হোক তা ভেবে সে রিদওয়ানকে বলল, ওকে একটা ট্যাক্সি করে দিন তো এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।

অর্ণব জেদ আঁকড়ে রইলো। সে যেতে দিলো না নুপুরকে। বাধ্য হয়ে নুপুর গেল শপিংমলে। প্রথমেই বিয়ের জন্য লাল রঙের লেহেঙ্গা পছন্দ করা হলো বৃষ্টির জন্য। নুপুরের বরাবরই শাড়ি পছন্দ বউদের জন্য অথচ অর্ণব যখন খুঁচিয়ে বলল, আমার বউয়ের জন্য লেহেঙ্গা তো তোর বান্ধবী পছন্দ করবে অর্নি। ব্যস, সে কথা কানে যেতেই খুব দামী আর কারুকাজ শোভিত লেহেঙ্গা পছন্দ করল নুপুর। অর্ণবও ঠিক সেটাই কিনলো আর তা দেখে প্রচণ্ড রেগে গেল সে। এ কথা ঠিক, বোনের ওপর রাগ আছে রিদওয়ানের তাই বলে যা হবেই সেটাকে অন্তত বোনের জন্য সুখকর করতে চায় সে৷ দু দিন পার হলেই যে ছেলেটার অর্ধাঙ্গিনী হবে তার বোন সে ছেলের অন্যকোন মেয়ের প্রতি একরোখা আচরণ আর অনুভূতি দেখানোটা মোটেই সহ্য হচ্ছে না। সে একরকম রেগেই অর্নিকে বলল, আমি কোন ড্রামা দেখতে চাইছি না থাক তোরা।

রিদওয়ান শাড়ির শপ থেকে বেরিয়ে যেতেই অর্নিও গেল তার পেছনে। গ্যাড়াকলে ফেঁসে গেছে বলে মনে হচ্ছে অর্নির। ভাই, স্বামী, বান্ধবী কার দিকটা ভববে! তারপরই মনে হলো দাদী তাকে সবসময় বলেন, স্বামী তোমার অর্ধেক অঙ্গ। সব কিছুর আগে তোমার তার মন বুঝতে হইব। অর্নিও তাই করলো আগে রিদওয়ানকে থামানো দরকার। নুপুর আর ভাইয়ার হোক শেষদফা লড়াই কিংবা সন্ধি। আপাতত সে আর এগুবে না সেদিকে। অর্নি প্রস্থান করতেই অর্ণবেরও জেদ নেমে গেল যেন। নিজের ভেতরের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা যে তাকে বিশ্রীরকম যন্ত্রণা দিচ্ছে তা উপলব্ধি হচ্ছে এখন। নিজের যন্ত্রণায় সে নুপুরকে জ্বালাতে চাইছে। কত নিষ্ঠুর আচরণ এই! সদ্য কেনা শাড়ির ব্যাগটাতে দৃষ্টি রেখে ধীর গলায় নুপুরকে উদ্দেশ্য করে বলল, চলে যাও। আর কখনও আমার দৃষ্টি সীমানায় এসো না।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে