#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৯
ঝিরিঝিরি বাতাসে ভেসে আসছে মৃদুমন্দ বুনোফুলের সৌরভ। ভোরের আলো ফোটেনি তখনও তবুও চারদিক ফ্যাকাশে হয়ে আছে। রাতের ঘুম গাঢ় হয়েছে ভোরের আগেই হঠাৎ কোন পাখির ডাকে ঘুম ভেঙে গেল রিদওয়ানের। চঞ্চল পায়ে কোথা থেকে একটা কাঠবিড়ালি এসে বসলো জানালার কপাটে৷ পাহাড়ঘেরা সৌন্দর্যে এ এক চমৎকার সকাল হওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু হলো না। কাল বাড়ি থেকে বেরোবার মুখে মায়ের দেখা অসুস্থ চেহারাটা মনে পড়লো। নিজের মন তাকে বারংবার বলছিলো, তুই একটা স্বার্থপর৷ তুই বড়ই স্বার্থপর। তোর জন্যই তোর মায়ের এই অসুস্থ ভাব। যে মেয়েটা কখনো জানলোই না তোর অনুভূতি, যার হাতের রেখায় শুরু থেকেই ছিল অন্য পুরুষের নাম সেই মেয়ের জন্য তুই কেন পালিয়ে বেড়াস এই জগৎ-সংসারে! যে মা তোকে জন্ম দিল, এ ধরায় যার কাছে তোর আমৃত্যু ঋণ তাকে কেন কষ্ট দিচ্ছিস?
তাহলে আমি কি করব! নিজেই যেন নিজেকে প্রশ্ন করলো রিদওয়ান। ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, ভুলে যা মেয়টাকে জড়িয়ে যা অন্য কারো মায়ায়।
এতই সহজ! এবারের প্রশ্নে প্রশ্ন কম যেন জিজ্ঞাসাটাই বেশি। উত্তরহীন সব তার প্রশ্ন। রিদওয়ান ছটফটায় বিছানায় গড়িয়ে৷ বাঁশের মাচার ছোট্ট রিসোর্টে কাল রাতেই এসে উঠেছিল সে৷ বাড়ি থেকে অনেকটা দূর এই পাহাড়ে এসে ঠাঁই নিতেই মনের মেঘ পাতলা হয়েছে। অর্নিতাকে নিয়ে অনুভূতির জাল অনেকটাই ছাড়িয়ে নিতে সক্ষম সে। কয়েকটা দিন নিজেকে সময় দিলেই আবার সামলে যাবে অনেকদিনের জন্য৷ এমনটাই তো হচ্ছে সেই প্রথমবার মায়ের কাছে অনুভূতির খোলাসা করার পর থেকে। কাঠবিড়ালিটা এবার জানালা ছেড়ে ঘরের মেঝেতে নেমেছে। হাতে তার পাহাড়ি কোন ফল কেমন কুটুস কুটুস করে খাাচ্ছে৷ ভালো করে তাকাতেই বুঝতে পারলো ওটা আস্ত এক কাঠবাদাম। রিদওয়ান গা ঝাড়া দিয়ে বিছানা ছাড়লো। প্রচণ্ড গরমের পর বর্ষার আগমনী হাওয়ার শীতল ঝাপটা চোখ মুখে লাগতেই পেটে খিদের টান পড়লো। মুখ হাত ধুয়ে দ্রুত রিসোর্ট ছেড়ে বাইরে এলো সে। এদিকটায় খাওয়ার আয়োজন আলাদা নেই রিসোর্টটেই খাবারের জন্য বলে সে বেরিয়ে পড়লো লতায় মোড়ানো পাহাড়ি সীমান্তে। হেঁটে বেরিয়ে খিদেটা আরেকটু চড়ুক তারপর না হয় পেটপুরে খেয়ে নেবে।
____________
রোজকার নিয়মে সকালে উঠে বাড়ির পেছন দিকটার আরও কিছু গাছ কেটে নিলো অর্ণব৷ আজ প্রায় মাস খানেক ধরে সে একটা একটা করে মাঝারি আকারের কড়ই আর কাঠগাছ গুলো কেটে রাখছে। লোক লাগিয়ে বিশাল আকারের কড়ই দুটো কাটিয়ে নিলেও মোটামুটি রকমগুলোতে সে নিজেই হাত লাগাচ্ছে। এ পরিশ্রম তার ইচ্ছাকৃত৷ কেন এমন ইচ্ছা নিজেও জানে না। দাদী প্রায়ই রাগ করেন এ নিয়ে ভয়ও পান বেকায়দা কোন আঘাত না লেগে যায় তার। অর্ণব কান দেয় না সে কথায়। প্রতি সকালে ব্যায়ামের পরিবর্তে এই কাজটাই তার ভালো লাগে। এতে নাকি শরীরের সাথে মনেরও একটা ব্যায়াম চালায় সে। অতিরিক্ত চিন্তার সময়গুলো একাগ্রচিত্তে এমন কোন কঠিন কাজে মন দিলে তার অনেক সমস্যাই দূর হয়ে যায়। হয়তোবা সত্যিই নইলে এখনও সে রিলিফ পেতো না তার পেছনে লাগা মানুষটার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝতে পেরেও। একটা কাঠের গুঁড়ি সম্পূর্ণ উপরে ফেলার পর অর্ণব বসে পড়লো মাটিতে। ট্রাউজার পরিহিত, উদোম ফর্সা বুকে গড়িয়ে পড়ছে স্বচ্ছ ঘামের বিন্দু৷ চোয়াল বেয়েও গড়াচ্ছে স্বেদজলের একই ধারা। দু চোখ বুঁজে লম্বা শ্বাস নেয় সে কয়েকবার আর ভাবে সেই বাইকারকে সে প্রথম কখন দেখেছে! হ্যাঁ মনে পড়েছে প্রথম দেখেছে মতিঝিলে। কারখানারই কোন কাজ সংক্রান্ত বিষয়ে একজনের সাথে দেখা করেছিল সে। কিন্তু সেদিনের দেখাটা তখন মনে লাগেনি যা লেগেছে পরশু সারাদিনের দেখায়। তার জমির কাগজগুলো এখনো তার হাতে আসেনি৷ কাগজপত্রের জন্য সাধারণ একটা জিডির কথা বলেছেন এসপি আঙ্কেল। অর্ণব আরও কিছু ভাবতে বসেছিল কিন্তু সুযোগ হলো না৷ রুজিনা খালা খবর দিলেন বাড়িতে একটা চিঠি এসেছে। এত সকালে চিঠি! অর্ণব বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো সোফার ওপর একটা সাদা খাম৷ চিঠির খাম নয় বরং অতি সাধারণ একটা খাম। হাতে তুলে খামের এপিঠ ওপিঠ দেখে সে রুজিনা খালাকে প্রশ্ন করলো, এটা কে দিলো?
– গেইটের সামনে একটা বাচ্চা আইয়া কইলো এইটা অর্ণব ভাইয়ের চিঠি একটা লোক দিয়া গেছে।
-বাচ্চাটা কে?
-ওই যে রাস্তার ওইপার বাড়ি আবিদ না কি নাম।
রুজিনা খালা স্পষ্ট জবাব দিতে পারলেন না। অর্ণবও চিনতে পারলো না আবিদটা কে। সে খামটা নিয়ে নিজের ঘরে এলো। আপাতত গোসল দরকার নাশতা সেরে অফিসে যাবে। খামটার দিকে আরেকবার নজর বুলিয়ে রেখে দিলো খাটের ওপর।গোসল শেষে তৈরি হয়ে নিচে নেমে নাশতা খেয়ে সোজা বেরিয়ে পড়লো অফিসের জন্য। মনে রইলো না আর সে চিঠির কথা তার তবে অফিসে কাজের ফাঁকে অনেকবার মনে পড়লো কাল রাতের ছোট ছোট বার্তাগুলো। সকল পরিশ্রমের ক্লান্তির মাঝে তাকে শৈত্য প্রবাহের মত শীতল করে গেল সেসব বার্তা। না চাইতেও মনে পড়তে লাগলো শ্যামবরণ মুখের চঞ্চল দুটি কৃষ্ণকালো চোখ।
-গোফওয়ালা জল্লাদ নামটা কেমন বলেন তো!
প্রথম বার্তা এটাই ছিল কাল রাতের। দ্বিতীয়টা এলো একটু পরই লেখা ছিল, মরুভূমি এত শুকিয়েছে কেন বলেন তো আমার না আপনাকে একটু কা়ঁদাতে ইচ্ছে করছে কাঁদবেন?
অর্ণব চায় না তাকে প্রশ্রয় দিতে কিন্তু কাল রাতের একাকীত্বে ওই বার্তাগুলো তাকে সঙ্গ দিচ্ছিলো খুব৷ পরের কিছু বার্তা ছিল, রাতের খাবারে কি খেয়েছেন?
– আমি আজকে কাঁচকলার ভর্তা করেছি যা টেস্ট ছিল ইশ দেখলেই জিভে জল আসবে আপনার।
-আমি সংসারের কাজ জানি না কিন্তু জেনে নেব ভাবছি।
একের পর এক লিখেই চলছিল মেয়েটা। ঘড়ির কাটা বারো ছুঁতেই অর্ণবের রাগ হলো। পড়াশোনা বাদ দিয়ে মেয়েটা এসব কি করছে! অনেকগুলো বার্তার পর অর্ণব একটি জবাব লিখল, ‘আর একটা যদি বাজে মেসেজ আসে তো বাড়ি এসে চাবকে যাব মনে রেখো।’
ব্যস, কাজ হলো তবে অবশ্যই একটা শেষ মেসেজ এসেছিল।
-শুভরাত্রি, বাজে নয় এটা সমাপ্তি মেসেজ। প্লিজ বাড়ি আসবেন না।
এটা পড়েই হাসতে হাসতে শেষ হয় অর্ণব৷ কতদিন পর কে জানে মন খুলে হাসতে পেরেছিল সে। দোতলার একলা ঘরটায় গুমোট হাওয়ার পরিবর্তে জায়গা নিয়েছিল হাসির ফোয়ারা৷ ভালো লাগার একটা পলকা মেঘ ঘিরে নিয়েছিল অর্ণবকে তা সকাল হতেই আবার মিলিয়ে গেছে। এখন আবার শুরু হলো যান্ত্রিক এক দিনের৷
______________
আজকের দিনটায় কাজের চাপ কম। রিদওয়ান ভাই না থাকলেও কাজের প্রেশার খুব একটা পড়ে না রিমন বা বাবার ওপর। তারা দুজনই ভীষণ পরিশ্রমী আর কাজের ক্ষেত্রে কঠোর৷ আজ কাজের পরিমাণ কম মানে কয়েকঘন্টা সময় হাতে এক্সট্রা আছে৷ হাতে সময় থাকা মানেই প্রেমিকার একটা অবসর গচ্ছিত প্রেমিকের হাতে। রিমনের ক্ষেত্রেও তাই আজ প্রেমিকার অর্ধদিবস গচ্ছিত। অফিস থেকে দুপুরে বের হয়েই প্রেমিকাকে নিয়ে বসেছিল রমনায়। কথা ছিল একসাথে দুপুরে খাবে বিকেলটা গাজীপুরে কোথাও ঘুরে কাটিয়ে রাত নাগাদ বাড়ি ফিরবে। রমনায় খুবই অল্প সময় পার করে রিমন বেরিয়ে পড়লো প্রেমিকা নাজনীনকে নিয়ে। গাজীপুরের রাস্তায় গাড়ি চলতেই নাজনীন জানালো তার কাজিনও যাচ্ছে গাজীপুর তার প্রেমিকের সাথে। রিমন প্রথমে কথাটা স্বাভাবিক ভাবে নিলেও পরে মনে পড়লো নাজনীনের কোন কাজিন? শিবলী ভাইয়ের প্রেমিকাও তো নাজনীনের এক কাজিন! দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে সময় লাগলো না যখন নাজনীন নিজেই বলল, ‘শিবলী ভাইয়া ভীষণ রোমান্টিক। আজ রূপার একুশতম জন্মদিন উপলক্ষে একুশটা কেক, একুশটা শাড়ি আর গুণে গুণে একুশটা ফ্লাওয়ার বুকে গিফট করেছে এই দেখো তাদের ভোরের ছবি।’
প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে নাজনীন আগলে ধরলো ফোনখানা। ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে পলক ফেলল রিমন। এতেই যেন মাথায় বিদ্যুতের মত ঝিলিক দিলো এক বুদ্ধি। আপন খালাতো ভাই শিবলী এক মুহূর্তে আপন শত্রুসরূপ মনে হলো তার। অর্নিকে পেলেপুষে বড় করছে তারা এই ষাঁড়ের হাতে দেওয়ার জন্য! আর তার ভাই একটা গাধা! বাপকে হাত করতে জানে না, নিজের মনের বাসনা পূরণ করতে জানে না শুধু জানে বোহিমিয়ান ঢঙ ধরে দুনিয়া ছেড়ে হারিয়ে যেতে। দুনিয়া ছাড়লেও চলত একটা গাধা দুনিয়া থেকে কম হতো। জঞ্জাল! শুধুই দুনিয়ার জঞ্জাল সেসব মানুষ যারা অনুভূতির জানাজা তোলে। রিমন এদের একদম পছন্দ করে না। তার বড় ভাই, তার মা আর অর্নি এদের কাউকেই সে পছন্দ করে না৷ এরা জীবনকে বাংলা সিনেমার নায়িকা শাবানা বানিয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয় প্রতি মুহুর্তে।
-জান, এই ছবিগুলো আজকের?
-হ্যা সকালেই এই সেলব্রেশন ছিল তাদের বেইলি রোডে একটা ক্যাফেতে আর বাকিটা রাতে৷ আমরা আসার আগে কিন্তু সারপ্রাইজ দেব তাদের একটা কেমন!
-নিশ্চয়ই। আচ্ছা ছবিগুলো আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করো পরে দেখব আমি। ইন্টারেস্টিং লাগছে ছবিগুলো পরে কখনো তোমার জন্যও আয়োজন করব।
নাজনীন ছবিগুলো সেন্ড করতে করতে বলল, “আমার এত কিছু লাগবে না জান। এসব লোক দেখানো আয়োজন না তুমি তোমার সাধারণ আয়োজন রেখো আমি তাতেই হ্যাপি।”
রিমন হাসলো একটু৷ মেয়েটা বড্ড বেশি ভালোবাসে তাকে সে খবর তার অজানা নয়। কখনো কখনো বড় বড় আবদার আবার কখনো ছোট ছোট শব্দেই সুখী হয়। কিন্তু এ মুহূর্তে মাথায় ঘুরছে ছবিগুলো। প্রত্যেকটা ছবিতে শিবলী ভাই আর তার প্রেমিকার সম্পূর্ণ চেহারা দেখা যাচ্ছে। কাজে লাগবে খুব কিন্তু তার আগে রোমিও ফিরুক সন্ন্যাস ছেড়ে।
চলবে